২১
মিস্টার দিগা পাঁড়ে?
এ যন্ত্রণার মধ্যেও পৃথুর হাসি পায়।
ডাক। মেরী, ঘরেই ডাক।
বলেই, ওর মনে পড়ে যায় যে হাইলি-রেসপেক্টেবল ভদ্রলোকের বাড়ি এটা। সরি, সাহেব-মেম-এর বাড়ি। দিগা পাঁড়ের মতো অসভ্য জংলি লোককে কোনওক্রমেই এ বাড়ির ভিতরে আসতে দেওয়া যায় না।
পৃথু, তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, না, না, ডেকো না, ভিতরে ডেকো না। বাইরেই চেয়ার পেতে দাও, আমিই যাচ্ছি।
দিগা পাঁড়ে স্যুট পরে না, জুতো পরে না, ইংরিজি বলে না, পাইপ খায় না। না, না।
মনে মনে বলে পৃথু।
তারপর বলে, শোনো মেরী, প্লিজ! খাওয়ার আছে কি কিছু?
নাঃ। কিছুই নেই।
জানত পৃথু। সাহেব-মেমরা না-বলে কয়ে কেউ কারও বাড়ি আসে না, অসময়ে খায় না, এসব ঘাস্টলি ইণ্ডিয়ান হ্যাবিটস। যেই আসবে, তাকেই খেতে দিতে হবে এ আবার কী কথা?
মেরী বলল, চিজ আছে স্যার। ডিমও আছে। ওমলেট বা চিজ টোস্ট করে দেব কি?
ওহো! তাই তো! দিগা তো মাত্র একবেলা, একচড়াই খায়, তাও স্বপাক, যদিও জাত বিচার নেই ওর। ও তো এসব কিছুই খাবে না। মনে পড়ে গেল পৃথুর। বাঁচা গেল, লজ্জা থেকে।
নাঃ। ওসবের দরকার নেই। শোনো মেরী! ভাল করে এক গ্লাস ফ্রেশ-লাইম বানিয়ে দাও।
শীতকালটাকে অনেকই কারণে পৃথু ভালবাসে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ এই-ই যে দিনের বেলা তার কাছে, বাড়িতে কোনও মূর্খ ইল-ম্যানারড লোক না-বুঝে, না-জেনে চলে এলে বাইরের বাগানে বা লন-এ স্বচ্ছন্দে বসাতে পারে। পৃথুরও ইজ্জৎ থাকে আগন্তুকদের কাছে। বসতে পারে। রুষা এবং আগন্তুকেরও কাছে বে-ইজ্জৎ হতে হয় না।
ফ্রেশ লাইম! সাহেবের জন্যে? এই সাহেবের জন্যে আনব স্যার?
হ্যাঁ। সাহেবের জন্যে।
উইথ ওয়াটার? অর সোডা স্যার?
ওয়াটার।
সুইট? অর সল্ট স্যার?
সইট? সইট। উইথ প্লেন্টি অফ সুইটস। বেশি করে চিনি দিয়ে।
আপনার ব্রেকফাস্ট তাহলে কী হবে স্যার? কুক তো রেডি করে ফেলেছে। আপনি কি ডাইনিং টেবলে আসবেন না স্যার?
বাইরেই দাও।
বাইরে যে কাক স্যার। মেমসাহেব বলেছেন, বাইরে কোনও খাবার ব্যাপারই নয়! কাক চামচ নিয়ে গেছিল।
তবে? কী হবে?
যাবার আগেই খেয়ে নিন। আমি বরং এখানেই নিয়ে আসছি।
আমি খাব না।
সে কি?
হ্যাঁ। আমি খাব না।
খাবার নষ্ট হলে মেমসাহেব যে বকবেন!
দমবন্ধ লাগে পৃথুর। গলায় বকলেস বাঁধা কুকুরের মতো পরাধীন বলে মনে হয়! বুকের মধ্যে গভীর কষ্ট বোধ করে একরকম!
নষ্ট কোরো না।
কী করে স্যার?
উঃ।
মেরীর এই অদ্ভুত ন্যাগিং-সেবা অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে।
কী করে স্যার? ব্রেকফাস্ট নষ্ট, না-করব স্যার?
আঃ! তোমরাই খেয়ে নাও। তুমিই খেয়ে নাও। দুখী আর তুমি!
সে তো নষ্টই হবে।
যা বলছি করো। আর কথায় কথায় স্যার স্যার কোরো না আমাকে। অনেকদিন বলেছি।
পৃথু ভাবছিল মেরীকে বলে কীই বা লাভ? ভাবছিল, নষ্ট কিছুই হয় না আসলে আমার পেটে গেলে কাজে লাগত আর তোমাদের পেটে গেলে নষ্ট হবে?
থ্যাঙ্ক উ্য!
বলে, কিণ্ডারগার্টেনের মেয়ের মতো ভঙ্গি করল মেরী।
পৃথু বাইরে বেরতে গেল।
মেরী বলল, মালটিভিটামিনস ট্যাবলেট?
দাও। জেলুসেল? খালি পেটে খাবেন?
দাও। পান খেলেই দরকার হবে।
নিয়ে আসছি স্যার। বাইরে। এক্ষুনি।
আমার জন্যে শুধু এক কাপ চা দেবে। আর কিছুই না।
ইয়েস স্যার।
দিগা চেয়ারে না-বসে, ঘাসেরই উপর উবু হয়ে বসেছিল। কাছে যেতেই, পৃথু দেখল, তার চোখমুখ ফোলা। মনে হল, শরীরে প্রচণ্ড জ্বরও। ঠোঁটের কোণায় রক্ত শুকিয়ে আছে, মনে হল, ঘুমোয়ওনি অনেকদিন। মুখে এবং ডান হাতে কাটা দাগ। রক্ত শুকোয়নি সেখানেও।
সংসারে কিছু লোকের মুখে এক আশ্চর্য সমর্পণ-তন্ময়তা থাকে। দিগার মুখটিও তেমন। কারও প্রতিই ওর কোনও অনুযোগ অভিযোগ নেই। একেবারেই নয়। নিজের প্রতিও নয়। কে বা কারা তাকে ধরে এমন করে মারল?
পৃথু ডাকল, দিগা!
কী!
ব্যাপার কী?
দিগা হাসল।
তার শুকোনো-রক্ত ঠোঁটের সেই আশ্চর্য হাসিতে কৌতুক, এবং অশেষ ক্ষমা মাখানো ছিল।
তোমাকে মারল কে? বনবিভাগের লোকেরা?
না, পুলিশ। বালাঘাট থেকে এসেছিল। পুলিশ ছেড়ে দেবার পর আমাকে ধরে নিয়ে গেছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা। জীপে করে এসেছিল। নিয়ে গিয়ে, জিজ্ঞাসাবাদ করল সুফকর এর বনবাংলোতে। অনেকই তো দূর। অফসর, সব জানল। আমাকে জিগগেস করে।
কী জানল?
কে শিকার করল বারাশিঙা? কেমন করে করল? ইত্যাদি।
তুমি কী বললে?
বললাম, আপনি, শামীম ভাই, ঠুঠা আমার কাছে এসেছিলেন পিকনিক করতে। এমন সময় ঢোলরা বারাশিঙাটাকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাঁলো নদী পেরিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে এল আমারই ডেরার সামনে। বলতে গেলে, ঢোলদের হাতের নৃশংস মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই এবং ওদের ভয়-পাইয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই গুলির আওয়াজ করার জন্যেই বন্দুক ছুঁড়েছিলেন শামীম ভাই।
কী বললেন ফরেস্টার?
প্রথমে বিশ্বাস করলেন না। গার্ডরাও নিয়ে গিয়ে মারল আমাকে। তারপর আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল ওঁর কাছে।
উনি মুখে বললেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু, মৃত্যু মৃত্যুই। মৃত্যুর মধ্যে নৃশংস বা মধুর বলে কোনও ভাগাভাগি নেই। ঢোলদেরও সৃষ্টি করেছেন শ্রীরাম ভাগোয়ান, বারাশিঙাদেরও তিনিই করেছেন। ঢোলদের কাজই হচ্ছে দাপাদাপি করে বেরিয়ে, জঙ্গলের হরিণ, শম্বর, বারাশিঙা এবং অন্যসব জানোয়ারকে সারা জঙ্গলে সমানভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া। জগতে, জঙ্গলে, যা-কিছুই ঘটে সবই আগেই ঠিক করা; সবকিছুরই মানে থাকে। এক অদৃশ্য হাতই সবকিছু পরিচালনা করেন।
খুব ভাল লাগল অফসর-এর কথা শুনে। মনে হল, মানুষটা ভগবানকে আমার জানার চেয়েও অনেক গভীরভাবে জেনেছে। অথচ লোকটা খাকি-পোশাক পরা। বাইরের পোশাকটা কিছু নয়। আমার চেয়ে অনেকই বড় সাধক উনি। উনি যা করছেন, সেটা তাঁর পেটের অন্ন জোগাবারই জন্যে। সেটা কর্ম ওঁর কর্ম, ওঁর ধর্মকে নোংরা করতে পারেনি।
এই অবধি বলে, দিগা একটু চুপ করে রইল। ওর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, চমৎকার মানুষ অফসর সাব।
চমৎকার! তা তো বুঝলাম, তাহলে তোমার এ দশা হল কী করে?
এ দশা তো করেছে পুলিশ আর ফরেস্ট গার্ডরা।
কেন?
ওদের দারুণ গালাগালি খেতে হয়েছে অফসরদের কাছে এই বারাশিঙাটার ব্যাপার নিয়ে। তাই-ই ওদের রাগ আমার উপরে চাপাল। অন্যায় তো হয়েইছে। আমি অবশ্য রাম ভগোয়ানের কাছেই বেশি অপরাধী মনে করি নিজেকে। মানুষের আদালতে কে অপরাধী আর কে নয়, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। শামীম ভাই না মারলেই পারত।
পৃথু বলল, তুমি মিথ্যা বললে, আমাদের বাঁচাতে? আশ্চর্য!
দিগা হাসল। বলল, অন্যকে বাঁচাতে মিথ্যা বললে দোষ হয় না।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
না। এই-ই তো এলাম সকালের বাস ধরে। কাল রাতে ওরা আমাকে বড় রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছিল। আসলে, আমার অসুবিধে হয়েছিল, আপনারা চলে আসার পর। দিনে রাতে শকুন আর শেয়ালদের চিৎকার, মাছির ভনভনানি আর দুর্গন্ধে রীতিমতো পাগল হবার অবস্থা। এখন শুধু কংকালটাই পড়ে আছে। রোদে শুকনো; পরিষ্কার। শিংটা আর চামড়াটা তো শামীমভাই নিয়েই এসেছিল। যেটুকু মাংস ছিল ছোট ছোট পাখিতে খেয়ে গেছে। এখনও রাতে কটাং কটাং করে হাড়-কামড়ে বেড়ায় কঙ্কালের। নানা নিশাচর জানোয়ারে।
মেরী ফ্রেশ-লাইম এনে, দিগাকে দেখেই আঁতকে উঠল।
গ্লাসটা নামিয়ে, ওকে দিয়ে, চা-টা পৃথুকে দিয়েই ইংরিজিতে বলল, স্যার! হুজ হি? মিঃ পাঁড়ে?
দিগা পাঁড়ে। আমার বন্ধু।
আপনার বন্ধু? স্যার? একসকিউজ মী স্যার? হি লুকস লাইক আ টেরীবল ড্যাকয়েট।
“একসকিউজ মী” কথাটা মেরী এমন মিষ্টি করে বলে যে, শুনে মনে হয় কোনও তিনবছরের শিশুই বুঝি মিস-এর কাছে ‘ছোট-বাইরে’ করতে যাওয়ার জন্যে ছুটি চাইছে।
পৃথু চা ও মালটিভিটামিনস এবং দিগা ফ্রেশ-লাইম খাওয়ার পর ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ল। মোড় থেকে পৃথু দুটো পান খেল। একশ-বিশ জর্দা। খায়, রিলিজসলি। তারপর রিলিজসলি এদেশীয় তাবৎ বাদামি সাহেবদের কল্পিত মুখগুলির উপর পিচিক করে পিক ফেলল। তারপর সাইকেল রিকশা নিল একটা। নিয়ে, ডাক্তারের কাছে গেল। কোম্পানির ডাক্তার নয়। ঝিংকুর কাছে। ঝিংকুর বড় ভাই টিংকুও ডাক্তার। সীওনীতে। ওদের বাবাও প্রাকটিস করেন মান্দলাতে।
ঝিংকু ব্যাণ্ডেজ করে দিল হাতে, ওষুধপত্র দিয়ে। ইঞ্জেকশান নিল না কিছুতেই দিগা। বলল, সুঁই নেয় না ও। নেবেও না কোনওদিন।
ঝিংকু হেসে বলল, আরে ভাই, যদি মরা বাঁচার প্রশ্ন ওঠে? যদি তোমার ধনুষ্টংকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে? তাহলেও নেবে না?
দিগা ছেলেমানুষ, বিজ্ঞান-বিশ্বাসী ঝিংকুর চোখে সোজা তাকিয়ে ওর বিশ্বাস দিয়ে ঝিংকুর চোখ দুটি বিদ্ধ করে বলল, আপনি কি চিরদিন বাঁচবেন ডাগদার সাব? মওত যখন আসবে, তখন কি সুঁই আটকে দেবে মওত? প্যায়দা যে হয়েছে, সে তার সঙ্গে করেই কপালে লিখে এনেছে মওত-এর জনমপতরী। তোমাদের দাওয়াই-এর প্যাকেটের উপর যেমন লেখা থাকে—মেনুফ্যাকচারিং ডেট, ইকসপায়ারিং ডেট—। ঠিক্কে না?
ঝিংকু এইরকম জ্ঞানের কথা শুনে অভ্যস্ত নয়। চুপ মেরে গেল।
ওর ফীস দিয়ে পৃথু বাইরে এসে দিগাকে নিয়ে একটা রিকশা করল। এখন যাবে সাবীর মিঞার বাড়ি। একটা মিটিং-এর দরকার। মিঞার বাড়ি আর দোকান একই সঙ্গে। সামনে দোকান। পিছনে বাড়ি। ক্যাশ বাক্সের সামনে সাবীরের বড় ছেলে ওয়াজ্জু বসে ছিল। চেহারা প্রায় বাবারই মতো, ছিপছিপে। পৃথুকে দেখেই সেলাম করে বলল, সেলাম সাহাব।
আব্বা কাঁহা?
আব্বা তো ভোপালমে।
কব গ্যায়া?
ইতোয়ারকা রোজ।
লওটেঙ্গে কব্?
কাল ইয়া পরশু। বলেই, বলল, আইয়ে, অন্দর আইয়ে, উতারিয়ে না রিকশাসে! চায়ে মাঙ্গাউ, পান মাঙ্গাউ? আপ্কা লায়েক উব কোঈ সেওয়া।
পৃথু বলল, না, না। আমি যাচ্ছি। আব্বাকে বোলো, যেন, এসেই যোগাযোগ করেন।
রিকশা ঘুরিয়ে ভুচুর গ্যারাজের দিকে যেতে বলল রিকশাওয়ালাকে।
যখনই সাবীর মিঞার কাছে আসে, সাবীর আর তার ছেলেদের ব্যবহার পৃথুকে মুগ্ধ করে। এদের এই তমদ্দ্দুন আর এতলাখ শেখার মতো। পৃথুর বাবা বলতেন, বাঙালি ব্যবসা করবে কি? সুন্দর করে হাত-জোড় করে নমস্কার পর্যন্ত করতে শেখেনি।
কথাটা বোধহয় আংশিক সত্য। ব্যবসা, ভাল ব্যবহার এবং সততা দিয়েই গড়ে ওঠে।
ভুচু গ্যারাজেই ছিল। দিগাকে দেখে তাড়াতাড়ি একটা ঢাউস ডজ কিংসওয়ে গাড়ির পাশে চেয়ার পেতে বসতে দিল ওদের। তীক্ষ্ণ চোখে একবার দিগার শারীরিক অবস্থাটা বুঝে নেবার চেষ্টা করল। তারপর বলল, দু মিনিটে আসছি। এক ঝাঞ্ঝাটিয়া খদ্দেরকে বিদায় করেই।
শীতের রোদে ভুচুর গ্যারাজের টিনের চাল গরম হয়ে ছিল। তার নীচে বসে বেশ লাগছিল পৃথুর। নানারকম আওয়াজ আসছিল কানে। মিশ্র শব্দ সব অর্কেস্ট্রার মতো। মার্ডগার্ড পেটানোর একটানা ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ, লেদ মেসিনের আওয়াজ, রঙ চাঁচবার চ্যাঁ-চ্যোঁ আওয়াজ। একপাশে একটা ফিয়াট গাড়ির এঞ্জিন টিউন করছে ভুচুর অ্যাসিস্ট্যান্ট নাগবেকার। অন্যপাশে একটা মাহীন্দ্র জীপে জাওয়ালা হর্ন ফিট হচ্ছে। তীক্ষ্ণ এবং ভোঁতা, উদারা মুদারা তারার মিশ্র আওয়াজ। কিন্তু ভাল করে কান পাতলে বোঝা যাবে এই বিভিন্নতার মধ্যেও একটা ছন্দ আছে। বিভিন্ন স্কেল মিলে মিশে গেছে যেন। আসলে, মিলে ঠিক যায়নি, সি শার্প-এ বাঁধা আছে গরিষ্ঠ আওয়াজগুলি। তানপুরার আওয়াজের মতো এই আওয়াজেও গলা মিলিয়ে নিয়ে রেওয়াজ করা যায়।
আহা! গান বাজনার কথা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যায় পৃথুর।
দিগা বসেছিল প্রসন্ন মুখে। ওর শরীরের বৈকল্য ওর মুখে বা মনে এসে পৌঁছয়নি। সাধক হলে, বোধহয় এরকমই হয়।
ভুচু ফিরে এল একটু পরেই। দিগাকে শুধোল, খবর কওন দিয়া? লাল্লু?
দিগা বলল, জানি না। লাল্লুর কাছ থেকেও জানতে পারে। কিন্তু ওর দোষ কী? মিথ্যে তো বলেনি। মিথ্যে বলবেই বা কেন?
মিথ্যে বলবে নাই-বা কেন? পাঁচ কে জি মতো মাংস আর এক কেজি কলিজা নিয়ে ভাগল সেদিন সুরতহারাম! প্রয়োজনে একটা মিথ্যে না বলতে পারলে, সে মাংস হজমই বা হবে কেন? দেখাচ্ছি শালাকে। শামীমকে বলব ওকে ফিট করে দেবে।
দিগা হাত তুলে বলল, না, না, ছিঃ ছিঃ এ কী কথা! এমন কোরো না। বেচারি। দোষ কী ওর?
তোমারও তো কোনওই দোষ নেই পাঁড়েজি। না শিকারে ছিলে; না মাংস খেলে। তবে? মারটা তোমাকে খেতে হল কেন? ইয়ে জামানাতে দোষ যার নেই সেই-ই মার খায়। ওই-ই নিয়ম এখন।
সেটা কপালের লিখন। দ্যাখো ভুচুবাবু, “জগ ভল ভলেহি, পোচ কহুঁ পোচু”
মানে?
মানে হচ্ছে, এই সংসার ভালর কাছে ভাল; মন্দের কাছে মন্দ। তাছাড়া “পরপীড়া সম নহিঁ অধমাঈ” পরকে কষ্ট দেওয়ার মতো নীচতা আর কিছুই নেই। যা হয়েছে, তা হয়েছে। লাল্লু দোষ করেনি কোনও। তোমাদের চোখে যদি তা দোষ হয়ও, তাহলেও ওকে কষ্ট দিয়ো না।
ভুচু পৃথুকে সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, সেকথা আমরা বুঝব পাঁড়েজি! তোমার জ্ঞান তোমার থাকুক। আমাকে জ্ঞান দিও না।
পৃথু বলল, দিগাকে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয় ভুচু।
নিশ্চয়ই। জীপটা নিয়ে তুমিই পৌঁছে দিয়ে এসো পৃথুদা। আমি তো ফেঁসে আছি। আর কেউই নেই এখন যাকে জীপ দিয়ে পাঠাতে পারি। তুমি জানো, “যিসকি বাঁদরী ওহি নাচায়” এই প্রবচনে বিশ্বাস করি আমি। তোমার কথা আলাদা। আমার গাড়ির স্টীয়ারিং-এ তুমি ছাড়া আর কাউকেই হাত ছোঁয়াতে দিই না আমি। আমাকে একটু বিল-টিল নিয়ে বসতে হবে। অর্জুন দাস সোলাঙ্কিদের অনেকগুলো টাকা বাকি। শালারা ইন্টারেস্ট বাঁচিয়েই তা থেকে বিল দেয়। আসলে হাতই পড়ে না। এতদিন বাদে পেমেন্ট দেয়। এমন হারামি পার্টি আর দুটি নেই আমার। টাকাওয়ালারা ভাবে সারা জীবন মাল না ছেড়ে কেবল বাণ্ডিল দেখিয়েই কাজ হাসিল করবে।
পৃথু বলল, চলি, তাহলে। দাও, জীপের চাবি দাও।
আরে দাঁড়াও। তোমার জন্যে পান আনতে দিয়েছি। পান না খেয়ে কোথায় যাবে? শামীমের ভাষায় দো পান কমসে কম। থোরা সা জর্দা কমসে কম। এই হুদা, পান কে আনতে গেল? সব শালা সুরতহারাম। জীপটা বের কর। ঝেড়ে পুছে দে। দ্যাখ, তেল আছে কি নেই। না থাকলে, আগরওয়ালের পাম্প থেকে বিশ লিটার তেল ভরে নিয়ে আয় জলদি। এই নে, স্লিপ নিয়ে যা।
গাড়িটা কাল পাঠিয়েছিল ভুচু? রুষা? অজাইব সিংকে দিয়ে? বলছিল, কী একটা আওয়াজ হচ্ছে গাড়িতে?
পৃথু বলল।
হ্যাঁ! হ্যাঁ! নিয়ে এসেছিল। দেখেও দিয়েছি।
জীপে তেল ছিল। আগরওয়ালের পাম্পে যেতে হল না আর হুদার। পানও এসে গেল। দিগাকে নিয়ে জীপে উঠল পৃথু। স্টীয়ারিং-এ বসল। স্টার্ট করল জীপটা পানের পিক ফেলে।
পৃথুর মা বলতেন, খোকন, জর্দা খেলে কখনও প্রথম পিক গিলবি না, ফেলে দিবি। পৃথু মায়ের এই কথাটি মেনে চলে। তাতে, বুকের মধ্যে ধকধকানি একটু কম লাগে।
ভুচু হঠাৎই দিগার পাশে উঠে পড়ে বলল, চলো তো একটু পৃথুদা। আমিও যাই।
কোথায়? বাঁ দিকে চলো।
সে কি? যাবার ছিল তো ডানদিকে। বাজারে গিয়ে কী হবে?
আরে! চলোই না।
বিরক্ত গলায় বলল ভুচু।
জীপটাকে ফারস্ট গীয়ারে গড়িয়েই সেকেণ্ড-এ ফেলে দিল পৃথু। টপ-এ ফেলতেও সময় লাগল না।
বাজারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভুচু বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও। বাঁয়ে লাগিয়ে দাও। ব্রেক করে দাঁড় করাল পৃথু জীপটাকে।
থামতেই, ভুচু নেমে সামনের দোকানে ঢুকে গেল। বড় একটা মুদির দোকান। ভেডুয়ার দোকান। ভেড়ুয়া মাঝি।
পৃথু আবার পানের পিক ফেলল পথের ধুলোয়।
বানোয়ারীলাল এসে দাঁড়াল পাশে। সাইকেল থেকে নেমে বলল, খাল-খরিয়াৎ সব ঠিক্কে না হ্যায়?
সব ঠিক্কে।
পান-ভরা মুখে বলল পৃথু।
আপকি কোঈ রিস্তেদার আয়ে হুয়ে হ্যায় ক্যা রায়নামে?
জী হাঁ।
হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় বলল পৃথু। ভাঁটুবাবু কা বারেমে?
জী হাঁ। আপকি আপনা সাড়ুভাই?
একটু বিস্ময় ও সন্দেহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল বানোয়ারীলাল।
পৃথু পান-ভরা মুখে দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, সমঝে না, বানোয়ারীলালজি! ভায়রাভাই, ভগ্নীপতি, যা কিছুই বলতে পারেন। রক্তর আত্মীয়তা নেই।
হেসে বলল, এহি না বাত! আভভি সমঝা!
কী সমঝালেন বানোয়ারীলালজি তা অবশ্য বোঝা গেল না।
ভুচু ফিরে এল। সঙ্গে একটি ছেলে। তার হাতে পোঁটলা-পুঁটলি।
কী এসব?
পৃথু শুধোল।
আরে, দিগার জন্যে।
দিগা বলল, এত্ব! এ তো আমার সারা বছর লাগবে শেষ করতে।
ওর গলাটা একটু নাকি-নাকি শোনাল। নাকের চোটটা বেশ বেশিই হয়েছে বোধহয়।
বে-ফিক্কর রহো পাঁড়েজি। এ তো পৃথুদা আর আমরা মিলে খিচুড়ি খেয়েই উড়িয়ে দেব। এখন এই-ই রইল। কাল লাড়ুয়ার হাট থেকে সবজিও কিনে পাঠিয়ে দেব তোকে। আলু, চালের সঙ্গে আছে। আলাদা করে নিয়ো।
না। আর কিছুই পাঠাবে না কাল। কোনও সবজিরই দরকার নেই।
ভুচুকে ফিরে গিয়ে গ্যারাজে নামিয়ে দিয়ে জীপ ছোটাল পৃথু। পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাটচান্দ্রা ছাড়িয়ে ফাঁকায় এসে পড়ল। জঙ্গলে।
জীপের স্টিয়ারিং-এ বসলেই পৃথু যেন তার প্রথম যৌবনে ফিরে যায়। জীপ-এর এঞ্জিন ওর সঙ্গে কথা বলে। জঙ্গলের মধ্যে, বহুদূর থেকে আওয়াজ শুনেই ও বলে দিতে পারে, কী জীপ সেটা; পেট্রল না ডিজেল, মিলিটারি ডিসপোজালের অ্যামেরিকান জীপ, না মাহিন্দ্রর না দোঙ্গা! এবং কোন গিয়ারে সেটা চলছে। জীপের এঞ্জিনের আওয়াজকে জঙ্গলেরই অনুষঙ্গ বলে মনে হয়। সভ্য মানুষের ইতিহাসে আগুন আবিষ্কার যেমন এক ঘটনার মত ঘটনা, পৃথুর মতো জঙ্গলের মানুষদের ইতিহাসেও জীপ আবিষ্কারও তেমনই এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বনে জঙ্গলে যাদেরই যাতায়াত আছে, তারা সকলেই এ-কথা মেনে নেবেন বোধহয়।
পিচ রাস্তা ছেড়ে দিল ও। ডাইনে ঢুকল হাঁলো নদীর পাশে পাশের পায়ে চলা পথের মতো পথে। শেষ সকালের বনের গন্ধে নাক ভরে গেল পৃথুর। নদীর পাশে পাশে শুখরা আর ছররা ঘাসের বন। হলুদ পাতায় কাঁটা। লালচে ফুল ফুটেছে তাতে। ঘাসের মাঠের পরই অনেকগুলো বড় বড় জামুন গাছ আছে। এদিকের জঙ্গলে বেশিই ধাওয়া (গঁদ), হাররা, বহেড়া, কসসী আর কুহমি গাছের হরজাই জঙ্গল। নদীর মধ্যে জায়গায় জায়গায় গাংগারিয়া ফুলের ঝাড়। প্রজাপতি উড়ছে। কাঁচপোকা উড়ছে। শীতের মিষ্টি রোদদুরে তিরতির করে কাঁপছে তাদের পাখা। রোদ ঠিকরে যাচ্ছে।
এবার সেকেণ্ড গীয়ারে যেতে হচ্ছে। রাস্তা বলতে তো কিছু নেই। জীপ বা মোটর সাইকেলের পক্ষেই যাওয়া সম্ভব। মোটর সাইকেলে গেলে, তাও নেমে পড়তে হয় বিশেষ বিশেষ জায়গা পেরতে। জীপের চারটি চাকার মাধ্যমে পৃথু যেন বনপথকে তার নিজের শরীর দিয়েই ছুঁয়ে যাচ্ছে। টায়ারের নীচে ঝরা ফুল বা খড়কুটো দলে গেলেই ওর মনে হচ্ছে নিজের পায়েই যেন মাড়িয়ে গেল তা।
জীপটাকে দাঁড় করাল। পান খাবে বলে। ড্যাশবোর্ড থেকে ভুচুর দেওয়া শালপাতার সোনার মোড়ক থেকে পান বের করে মুখে দিল। জর্দা ফেলল মুখে। সামনেই মস্ত একটা হররা গাছ। এত উঁচু যে, ঘাড় পেছনে হেঁটে হেঁট করে তাকাতে হয়। এই হররার ফল বাঁদররা খুব শখ করে খায়। মানুষও খায়। হজমি হিসেবে। কাশির ওষুধ হিসেবেও খায়। কালো কালো দেখতে থাকে ফলগুলো প্রথমে। পরে সবুজ হয়ে ওঠে। এ দিয়ে আদিবাসীরা তাদের বাড়ি-ঘর রঙ করার জন্যে একরকম রঙও তৈরি করে। হালকা হলুদ রঙ হয়।
হঠাৎ দিগা বলল, তুমি যেগুলো দিলে, সব-দাঁবাইয়াই কি খেতে হবে?
নিশ্চয়ই।
দিগা হাসল। বলল, জঙ্গলে অনেকইরকম ওষুধ আছে। আমি জড়ি-বুটি করে দু-তিনদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাব পিরথুবাবু। চিন্তা কোরো না।
পৃথু রেগে বলল, খাবেই না যখন ওষুধ, তখন অত হাঙ্গামা করালে কেন?
হাঙ্গামা করে, তুমি আনন্দ পেলে, তাই আপত্তি করিনি।
হাসি-হাসি মুখে দিগা বলল।
তারপর বলল, কারও আনন্দেই বাধা দিতে নেই। তোমার বিবেক আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে বলল। তোমরা আমাকে ভালবাসো যে, তাও আমি বুঝি। ওষুধ চাই না, ওষুধ খাব না বলে ওখানেই তোমাদের সঙ্গে মারামারির দরকার মনে করিনি। তোমাদের মনের খুশির দাম, নিশ্চয়ই এই কটি ওষুধের দাম এর চেয়ে বেশি? তাই না?
কিছুই না বলে, পৃথু স্টীয়ারিং-এ হাত ছুঁইয়ে অ্যাকসিলারেটরে ডান পায়ের পাতা রাখল আলতো করে।
দিগা আবার বলল, এবার দেখছি, একদিন তোমাদের সঙ্গে ঝগড়াই করতে হবে। তোমরা যে রোজ আমাকে এত এত ভিক্ষা দাও, থলে ভর্তি চাল ডাল আলু; এ সব আমার পছন্দ হচ্ছে না। জান, পিরথুবাবু, মাধুকরী করে খাওয়া আর ভিক্ষা করে খাওয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে।
পৃথু চকিতে একবার দিগার মুখ চেয়েই, চুপ করে জীপ চালাতে লাগল।
তফাৎটা যদি তোমরা নিজেরা না বোঝ, তাহলে আমি তোমাদের বোঝাতে পারি এমন সাধ্য কি আমার আছে? ভিক্ষা আর মাধুকরী এক জিনিস নয়। আমাকে ভিখিরি ভেবো না।