জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় নিত্যনতুন পরিকল্পনা আসে। তিনি বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, তা সত্ত্বেও আর একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইলেন। তিনি ফরাসি ভাষার চর্চা করেছেন অনেকদিন, তিনি জানেন যে ফরাসিদেশে ফ্রেঞ্চ আকাদেমি ফরাসি ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা ও সাহিত্য সমীক্ষার ভার নিয়ে থাকে। এদেশে সে রকম কোনও সাহিত্য প্রতিষ্ঠান নেই। যেকোনও সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা ও শ্ৰীবৃদ্ধির জন্য এরকম একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। বিজ্ঞান এখন অবশ্য পাঠ্যবিষয়, কিন্তু বাংলায় বিজ্ঞানের পরিভাষা নেই। বাংলায় ভূগোল কিংবা দর্শন পাঠ করতে গেলেও পরিভাষা দরকার। কে এসব ঠিক করবে?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্ৰস্তাব দিলেন, বাংলার বিশিষ্ট সব লেখক, পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদদের একসঙ্গে জড়ো করে একটি সারস্বত সমাজ গঠন করা হোক। মাঝে মাঝে এই সব গুণিজন একসঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাভাষার একটা সুনির্দিষ্ট রূপ দেবার ব্যবস্থা গ্ৰহণ করবেন।
এজন্য প্রাথমিক যা খরচপত্র লাগে তা দেবেন জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ আর সংগঠনের জন্য খাটাখাটনি করবে রবি। সাহিত্য সংক্রান্ত যে-কোনও ব্যাপারেই রবির প্রবল উৎসাহ।
এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক হল রবি, আর সভাপতি কে হবেন? প্রথমেই যাওয়া হল, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কাছে। বেলেঘাটা-গুড়োর মিত্তিরবাড়ির এই রাজেন্দ্রলাল অসাধারণ পণ্ডিত, বাগ্নী ও সুলেখক। মানুষটি কানে কিছু কম শোনেন, তাই কথা বলেন বেশি। কিন্তু অযথা কিছু বলেন না। বিজ্ঞানসন্মত ইতিহাস চর্চা তিনিই শুরু করেছেন বলা যায়। রাজেন্দ্রলালেল The Snaskrit Buddhist Literature of Nepal বইটি রবির খুব প্রিয়। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে বহুকাল জড়িত, তা ছাড়া কুল বুক সোসাইটি, লিটারেচার সোসাইটি এবং আর্ট স্কুল স্থাপনের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা। সাহেবদের কাছ থেকে অনেক সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু সাহেবদের সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলতেও তিনি ছাড়েন না। ফটােগ্রাফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পরই তিনি ছিলেন তার কোষাধ্যক্ষ ও সম্পাদক, কিন্তু তিনি দেখেছিলেন ইংরেজ ও ভারতীয় সভ্যদের মধ্যে ব্যবহারের তারতম্য ঘটছে। আদালতের বিচার দু রকম। একদিন সোসাইটিতে এই বৈষম্যের সমর্থনে ইংরেজরা হৈ-চৈ করছিল, রাজেন্দ্রলাল ধমক দিয়ে বলে ওঠেন, এদেশে যত ইংরেজ আসে, তার বেশিরভাগই বিলিতি সমাজের আবর্জনা!
এই উক্তির জন্য তাঁকে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ত্যাগ করতে হয়েছিল, কিন্তু কলকাতায় মুখে মুখে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিল, সাহেবদের মুখের ওপর এমন কথা বলার সাহসও কারুর থাকতে পারে।
মানিকতলায় আপার সার্কুলার রোডে শ্ৰীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে থাকেন রাজেন্দ্রলাল। রবিকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন, রবির মুখে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্যের কথা শুনে তিনি খুবই আগ্রহ দেখালেন। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শুরু করে কুল বুক সোসাইটি পর্যন্ত সবই তো সাহেবদের উদ্যোগে গড়া হয়, বাঙালিরা নিজেরা কোনও প্রতিষ্ঠান গড়তে পারবে না কেন? এই প্রতিষ্ঠান যে কতখানি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, তা তিনি অনেকক্ষণ ধরে রবিকে বোঝালেন। তারপর বললেন, আমাকে সভাপতি হতে বলছ? আমার আপত্তি করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু আরও তো গণ্যমান্য, বিদ্বান ব্যক্তিরা রয়েছেন! ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমবাবু, দ্বিজেন্দ্ৰবাবু, সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর…। তুমি ওঁদের কাছে গিয়ে মত সংগ্রহ করো, তারপর একদিন সভা ডেকে কমিটি তৈরি করা যাবে।
রবি এরপর গেল বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে। তিনি এখন আলিপুর আদালতে কাজ করছেন। বঙ্গদর্শনে তার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ সদ্য শেষ হয়েছে। মেজাজ বেশ প্ৰসন্ন আছে। তিনি এখন হিন্দু ধর্মের পক্ষে প্রখর প্রবক্তা, খ্রিস্টান ও ব্ৰাক্ষরা পৌত্তলিকতা কিংবা পুজো-আচ্চা সম্পর্কে কটাক্ষ করলেই তিনি ইংরেজি বাংলায় তার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মোগল-পাঠান আমলে হিন্দুরা নির্বীৰ্য হয়ে পড়েছিল। সব জায়গায় তারা কাপুরুষের মতন পদানত হয়েছে, এ কথা বঙ্কিম মানতে রাজি নন। তাঁর মতে, এ সবই ভ্রান্ত ইতিহাস। মুসলমান ঐতিহাসিকরা নিজেদের পরাজয়ের কথা গোপন করে হিন্দুদের বশ্যতার কথা বেশি করে লিখেছেন। রাজপুতানা এবং দক্ষিণাত্যে কি মুসলমান আক্রমণকারীরা বারবার পিছিয়ে আসেনি। উড়িষ্যার রাজা নরসিংহ দেব কি বাংলার পাঠান শাসক তোঘল খাঁকে সসৈন্যে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেননি?
বখতিয়ার খিলজি মাত্ৰ সতেরোজন অশ্বারোহী নিয়ে এসে বঙ্গবিজয় করেছিল, এ কথা শুনলেই বঙ্কিম ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ভুল, একেবারেই ভুল ইতিহাস! রাজধানীতে ঢুকেছিল আসলে সতেরোজন ছিচকে চোর। বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন পালিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জেমস-ও কি পালাননি? সমগ্ৰ গৌড় বঙ্গ অধিকার করার জন্য আক্রমণকারীদের লড়াই চালাতে হয়েছিল এক বছর। বাঙালি চরিত্র কালিমালিপ্ত করার জন্যই মিনহাজউদ্দীনের মতন ঐতিহাসিকরা এমন গাল-গল্প বানিয়েছে, যেন গোটা কতক অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজি এসে পড়ার পরই সমগ্র বাঙালি জাতি ভয় পেয়ে তার পায়ে আছড়ে পড়েছে!
বঙ্কিমের মতামত এমন জেদী ধরনের যে, অন্য দিকের কোনও যুক্তির তিনি ধার ধারেন না। তাঁর আত্মবিশ্বাস এক এক সময় দম্ভের পর্যায়ে পড়ে।
রবিকে তিনি ভালোই চেনেন, কিশোর রবির একটি কবিতা তিনি ছাপিয়ে ছিলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ঠাকুরবাড়িতে তার যাতায়াত আছে বটে, কিন্তু মনে মনে তিনি ব্রাহ্মদের সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব পোষণ করেন। উদীয়মান লেখক রবির প্রতি তিনি দৃষ্টি রেখেছেন, প্রকাশ্যে তিনি রবির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। এই তো কিছুদিন আগে রমেশ দত্তর মেয়ের নিমন্ত্রণ সভায় রবির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। রমেশ দত্তর কন্যা কমলার সঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুর বিবাহ হল হিন্দু পদ্ধতিতে। শ্বশুর ও জামাতা দুজনেই বিলেতফেরত, হিন্দু মতে কালাপানি পেরুলে প্ৰায়শ্চিত করতে হয়, ওঁরা তা করেননি, তাই নিয়ে সমাজে বেশ শোরগোল হয়েছে। সে যাই হোক, সেই উৎসবে রমেশচন্দ্ৰ বঙ্কিমবাবুর গলায় একটা মালা পরাতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্ৰ প্ৰবীণ লেখকের ঔদার্যে বলেছিলেন, আরে না, না, আমাকে কেন, এ মালা রবিকে দাও। তুমি ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ পড়েছ? কী অপূর্ব কাব্য লিখেছে রবি।
কিন্তু নিজের বাড়িতে অন্তরঙ্গদের মাঝে বঙ্কিম এতোটা উদার হতে পারে না। একদিন রবির প্রসঙ্গ উঠায় বঙ্কিম বউঠাকুরানীর হাট উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছিলেন, স্থানে স্থানে সুন্দর উচ্চস্তরের লেখা আছে। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে সেটা নিষ্ফল হয়েছে। রবির যথেষ্ট গিফটেড বটে, কিন্তু প্রিকোশাস।
রবির কাছ থেক সারস্বত সমাজের উদ্দেশ্যের বয়ানখানি নিয়ে পাঠ করে বঙ্কিম বললেন, হ্যাঁ, বেশ ভালোই তো। তবে ফরাসি আকাদেমির ধাঁচে যখন হচ্ছে, তখন এর নাম “আকাদেমি অব বেঙ্গলি লিটারেচার” রাখলেই তো হয়।
রবি বলল, প্রথমদিনের সভায় এই নাম নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্ৰ সই করে দিলেন।
আরও কয়েকজনের সম্মতি-সাক্ষর সংগ্রহ করার পর রবি গেল বিদ্যাসাগরের কাছে। তিনি থাকেন বাদুড়বাগানে।
বিদ্যাসাগর মশাইয়ের শরীর-মন কিছুই এখন ভালো নেই। মনটাই ভেঙে গেছে বেশি। বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের জন্য তিনি কী কঠোর পরিশ্রম করলেন, কত বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, অকুতোভয়ে শেষ পর্যন্ত আইনও প্রণীত হল, কিন্তু দেশের মানুষ তো মানল না। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে নিজের অর্থব্যয়ে কয়েকটি বিধবার বিয়ে দিলেন, কিন্তু এই আমূল কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে তাতে সাড়া জেগেছে কতটুকু? কেউ কেউ বেশ মজা পেয়েছে, সংবাদপত্রে নাম ছাপাবার জন্য বিধবা বিবাহে সম্মত হয়, তারপর সেই স্ত্রীর সঙ্গে উপপত্নীর মতন ব্যবহার করে। বিধবা বিবাহ চালু করার প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগরের নিজস্ব ধার জমে গেছে আশি হাজার টাকা!
তারপর তিনি বহু বিবাহ রদ করবার জন্য কলম ধরলেন। হিন্দু সমাজে জড়িয়ে আছে বহুরকম কুপ্ৰথা। কুলীন ব্ৰাহ্মণরা পঞ্চাশ-একশোটা বিবাহ করে অতগুলি মেয়ের সর্বনাশের কারণ হয়। তিনি নিজে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বহু বিবাহের পরিসংখ্যান জোগাড় করেছেন, তারপর ইংরেজ সরকারের কাছে আর্জি জানালেন যাতে আইন করে এই প্ৰথা বন্ধ করা হয়। আশ্চর্য ব্যাপার, এ দেশের শিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকেও তিনি এ ব্যাপারে সমর্থন পেলেন না। অধিকাংশ লোকই তাঁর বিপক্ষে। বহু বিবাহ বন্ধ না হলে যে বিধবার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, তা এঁরা বুঝলেন না। বিপক্ষীয়দের মতে, এই প্রথার ধীরে ধীরে অবসান হবে, আইন জারি করে বন্ধ করার দরকার নেই। অদ্ভুত যুক্তি! দাস-প্ৰথা, সতীদাহ প্ৰথা আইন করে বন্ধ করতে হয়নি? আপনা-আপনি বন্ধ হবার কোনও লক্ষণ দেখা গিয়েছিল? কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিংবা মতলব বাজ ব্যক্তিদের একমাত্র শাস্তির ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা যায়!
সমধর্মী মানুষদের এই বিরূপতা দেখে বিদ্যাসাগর নিরাশ হয়ে গেছেন। আরও আঘাত পেয়েছেন অনেক নিকটজনের কাছ থেকে। যাদের তিনি সাহায্য করেছেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, তারাও আড়ালে তার নিন্দে করে। পরোপকারের এই প্রতিদান। এমনকি তার জন্মস্থান বীরসিংহ, যে গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি কত অর্থব্যয় করেছেন, সে গ্রামের মানুষও তাঁর একটা অনুরোধের মূল্য দেয় না। রাগে-দুঃখে তিনি আর কোনওদিন বীরসিংহ গ্রামে যাবেন না প্রতিজ্ঞা করেছেন। এখন মাঝে মাঝে সাঁওতাল পরগনায় কর্মট্যাঁড়ে গিয়ে থাকেন। যেখানকার সাঁওতালরা তাকে ভালোবাসে। সেই সরল, কপটতাহীন সাঁওতাল নারী-পুরুষদের তাঁর মনে হয় খাঁটি মানুষ!
তাঁর স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে গেছে। অনেক বছর আগে মেরি কার্পেন্টার নামে এক বিবির সঙ্গে বালিতে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, সেখানে ঘোড়ার গাড়ি উল্টে ছিটকে পড়ে যান রাস্তায়। বাইরের আঘাত সেরে গেল, কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরে যে চোট লেগেছিল তার নিরাময় হল না। কোনও কোনও চিকিৎসকের মতে তাঁর যকৃৎ উল্টে গেছে। কিছুই হজম হতে চায় না। এখন আর কোনও সমাজ সংস্কারে তাঁর মন নেই। প্রেস ও প্রকাশনী বিক্রি করে দিয়েছেন, শুধু নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও কলেজ নিয়েই আছেন।
সারস্বত সম্মিলনে যারা যোগ দিতে রাজি হয়েছেন, সেই তালিকাটি দেখলেন বিদ্যাসাগর। বঙ্কিমের নামটার ওপর তাঁর চোখ আটকে গেল। ইংরাজ-ভৃত্য এই ব্যক্তিটি দু-চারখানা নভেল লিখে খ্যাতি পেয়েছেন বটে, কিন্তু সমাজেরও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে চান। ইনি বরাবর বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। বিদ্রূপ করেছেন বিধবা বিবাহ আন্দোলন নিয়ে, এমনকি বিদ্যাসাগরকে মুর্খ বলতেও দ্বিধা করেননি। বহু বিবাহ বন্ধ করারও ইনি পক্ষপাতী নন। এমনকি ইনি বিদ্যাসাগরকে তেমন লেখক বলেও মানতে চান না। বিদ্যাসাগর নাকি কোনও মৌলিক রচনা লেখেননি। সবাইকেই নভেল-নাটক-পদ্য লিখতে হবে, না হলে সাহিত্য হবে না? নতুন বাংলা গদ্য ভাষা গড়ে উঠছে, এখন প্ৰবন্ধ, অনুবাদের বিশেষ উপযোগিতা নেই? বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ পড়ে বলেছিলেন, এ তো কান্নার জোলাপ!
কোনও এক সভায় এই বঙ্কিমের সঙ্গে একাসনে বসতে হবে বিদ্যাসাগরকে? হেসে হেসে কথা বলতে হবে? ওসব ভণ্ডামি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
মৃদু হেসে কাগজপত্র রবিকে ফিরিয়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর বললেন, না, বাপু, আমি এর মধ্যে নেই! রবি অবাক হয়ে বলল, সে কি! আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন না? আমরা চাই, আপনি সভাপতি হবেন। বিদ্যাসাগর দু দিকে মাথা নেড়ে বললেন, আমি তো যাবই না। এ বুড়ার আর একটা কথা শুনে রাখো। এ রকম কাজে আমাদের মতন লোকদের বাদ দেওয়াই উচিত, হোমরা-চোমরাদের লয়ে কোনও কাজ হবে না। কারুর সঙ্গে কারুর মতে মিলবে না। বরং তোমাদের মতন ছেলেছোকরারা যদি সমবেত হয়ে কিছু করতে পার তো দেখ।
রবি জানে, বিদ্যাসাগর একবার না বললে আর তার মত ফেরানো প্ৰায় অসম্ভব।
সারস্বত সমাজের কাজে ঘোরাঘুরির জন্য রবি এখন প্রায় সময়েই বাড়ি থাকতে পারে না। সদর স্ট্রিটের অত বড় বাড়িতে বিকেল-সন্ধে কাদম্বরীকে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটাতে হয়। রবির সে কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কিছুটা অপরাধ বোধ হয়, কিন্তু বাংলা আকাদেমি গড়ার আকাঙ্ক্ষাটা তাকে মাতিয়ে তুলেছে, বড় বড় পণ্ডিত ও সাহিত্যজীবীদের কাছে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই বিষয়ে আলোচনা করতে তার উৎসাহের অবধি নেই। রবি তার সহযোগী হিসেবে পেয়েছে কেশব সেনের ছোট ভাই কৃষ্ণ-বিহারী সেনকে, কৃষ্ণ-বিহারী এম এ পরীক্ষায় ফাস্ট হওয়া ছাত্র। রবির ইচ্ছে, কোনও গোষ্ঠীভেদ না করে সমস্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদেরই এই সমিতিতে টেনে আনা। অনেকেরই সম্মতি পাওয়া গেল, বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কেউ এখনও তার মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেননি।
রবির এই ব্যস্ততা নিয়ে কোনও অনুযোগ করেন না কাদম্বরী। তিনি আড়ালে আড়ালে থাকেন। গোধূলির ক্ষীয়মান আলোয় তিনি একা একা ঘুরে বেড়ান। এ ঘর থেকে ও ঘরে, বারান্দায়, ছাদে। কখনও পিয়ানোর সামনে বসে বাজিয়ে যান আপন মনে। কোনও কোন সন্ধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে যেতে চান বির্জিতলাও-এর বাড়ির আসবে, কাদম্বরীর যেতে ইচ্ছে করে না।
সারস্বত সমাজের প্রথম অধিবেশন হল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। রাজেন্দ্রলাল, বঙ্কিম, সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ছাড়াও এলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রমুখ। অনেক লম্বা লম্বা বক্তৃতা ও কমিটি গড়া হল, পরিভাষার সমস্যা নিয়ে চলল দীর্ঘ সময়ের বাদানুবাদ।
এর পরের দু একটা মাসিক অধিবেশনেই রবি বুঝতে পারল কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপদলীয় কোন্দল শুরু হয়ে গেছে। এই সব বড় বড় মানুষগুলির প্রত্যেকেরই আত্মম্ভরিতার লম্বা লম্বা লেজ আছে, সেই লেজের বিড়ে পাকিয়ে সিংহাসন তৈরি করে তার ওপর এক একজন রাজা সেজে বসে থাকেন। এঁরা দূরবীনের উলটোদিক দিয়ে দেখেন জগৎসংসারটাকে। বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আর তেমন গা করেন না, কয়েকজন আড়ালে বলাবলি করতে লাগল, ওসব ঠাকুরবাড়ির ব্যাপার, সব বিষয়েই ওরা কৃতিত্ব নিতে চায়!
রবি নিরাশ হয়ে পড়ল। বাঙালি জাতির এত দূর অধঃপতনের পরেও এখনও এঁরা সবাই একসঙ্গে হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে একটা কিছু গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে পারছেন না? শুধুই দলাদলি আর পরনিন্দা চলতে থাকবে? রবি উপলব্ধি করল, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সাবধানবাণী কত মৰ্মে মর্মে সত্য।
সারস্বত সমাজের অধিবেশনে নিয়মমাফিক চলতে লাগল বটে। কিন্তু রবির আর কোনও গরজ রইল না। এর জন্য এতখানি সময় দিয়ে তার লেখার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
হঠাৎ একদিন রবির জ্বর এসে গেল। রীতিমতন শীত ও কাঁপুনি। ম্যালেরিয়া নাকি? দুপুরবেলা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল রবি, কারুকে কিছু জানাল না। কয়েকদিন যাবৎ কাদম্বরীরও শরীর খারাপ, নীলমাধব ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। রবির অসুখ-বিসুখ কম হয়, শরীর বেশ মজবুত। শরীর নিয়ে সে বেশি চিন্তাও করে না। শ্রাবণ মাসের ভ্যাপসা গরমে রবি শীতে কাঁপছে। প্রবল জ্বর হলে তার একটা আরামের দিকও আছে, সমস্ত শরীর কেমন যেন হালকা হয়ে যায়, যেন বাতাসে ভাসে। জেগে থাকা অবস্থাতেই চিন্তাগুলো মনে হয় স্বপ্ন স্বপ্ন।
অনেকদিন কোনও গান রচনা করা হয়নি, সেই জ্বরের ঘোরে রবি একটা গান বাঁধবার চেষ্টা করল। একটি দুটি লাইন ঠিক এসে গেল, তৃতীয় লাইনটা ভাবতে গিয়ে গুলিয়ে গেল প্রথম লাইনটা। কিছুতেই মনে পড়ে না। সেটা হাতড়াতে গিয়ে আবার তৃতীয় লাইনটা হারিয়ে যায়।
কপালে একটা হাতের ছোঁয়া লাগতে চমকে উঠল রবি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন কাদম্বরী। উরিাখুরি চুল, চোখ দুটি ছলছলে, শরীরে একটা আটপৌরে হলুদ শাড়ি জড়ানো।
দুজনে পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে রবি গিয়েছিল কাদম্বরীর কাছে ক্ষমা চাইতে, কাদম্বরী উদাসীনভাবে কাটাকাটা উত্তর দিয়েছেন, রবি বুঝতে পেরেছিল, ওঁর রাগ পড়েনি। তারপর কাদম্বরী অসুখে শয্যাশায়িনী হলেন, মনোর মা আর নিস্তারণী দাসী তাঁর ঘরে বসে থাকে, রবি সকাল-বিকেল দেখে এসেছে, অন্তরঙ্গ কোনও কথা হয়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে গেছেন শিলাইদহে, জোড়াসাঁকো থেকে দুজন কর্মচারি এসে রয়েছে এ বাড়িতে।
রবি অস্ফুট স্বরে বলল, নতুন বউঠান!
কাদম্বরী বললেন, রবি। তোমার অসুখ হয়েছে, আমাকে খবর দাওনি?
রবি কাদম্বরীর ডান হাতখানি ধরল। সে হাত খুব উষ্ণ। কাদম্বরীর মুখ দেখলেও টের পাওয়া যায় জ্বরের ঝাঁঝ।
রবি বলল, তোমারও তো বেশ জুর, তুমি উঠে এলে কেন?
কাদম্বরী বললেন, মেয়েমানুষের জ্বর হলে কিছু হয় না। সরকার মশাইকে জানাচ্ছি, নীলু ডাক্তারকে ডেকে আনুক তোমার জন্য। এত জ্বর, তোমার কপালে জলপটি দেওয়া হয়নি-
রবি বলল, এখুনি ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। মোটে একদিনের জ্বর, আমার এমনিই ঠিক হয়ে যাব।
কাদম্বরী বললেন, তুমি চুপটি করে শুয়ে পড়ে। এক্ষুনি আসছি।
রুপোর বাটিতে ঠাণ্ডা জল আর পরিষ্কার একটুকরো কাপড় নিয়ে একটু পরেই ফিরে এলেন কাদম্বরী। একপাশে বসে রবির কপালে জলপট্টি দিলেন যত্ন করে।
রবি বলল, এ তোমার ভারি অন্যায়, নতুন বউঠান। তোমার এখন শুয়ে থাকার কথা। তুমি জলপট্টি নাওনি কেন?
কাদম্বরী বললেন, তোমার এই মাথায় কত কী চিন্তা করতে হয়। বেশি গরম হলে ক্ষতি হতে পারে। আমাদের মাথার আর কী দাম আছে!
রবি বলল, চিন্তা সব মানুষই করে। তবে তোমার মনের মধ্যে কী যে চলে, তার আমি কোনও হদিশ পাই না।
কাদম্বরী হেসে বললেন, হদিশ করার সময় কোথায় তোমার?
রবি বলল, আমি দোষ করেছি। পথভ্রান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই দোষ কি একেবারে ক্ষমার আযোগ্য?
কাদম্বরী বললেন, ক্ষমার প্রশ্ন আসেই না, রবি। তুমি কি সৰ্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকবে নাকি আমার জন্য। আমি বুঝি তা বুঝি না?
রবি বলল, একটা লাভ হল কি জান, নতুন বউঠান, এই কয়েক মাস অন্যদের কাছে ঘুরে ঘুরে আমার উপলব্ধি হল, তোমার কাছাকাছি থাকতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।
দুদিন বাদে রবির জ্বর ছাড়ল। কাদম্বরীর ছাড়ল তার পরের দিন। আবার শনিবারে দুজনেরই একসঙ্গে জ্বর এল। নীলমাধব ডাক্তার দুজনকেই ওষুধ দিলেন। সেই ওষুধে জ্বর ছাড়ে, আবার আসে। এই পালা জ্বর ক্ৰমে গা-সহা হয়ে গেল।
জ্বর যখন থাকে না তখন রবি লিখতে বসে যায়, কাদম্বরী ঘর গুছোতে শুরু করেন। সন্ধের পর দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করে কিংবা গান গায়। রবি তার সদ্য লেখা কবিতাটা পড়ে শোনায়। কাদম্বরী রবির সব লেখার প্রথম পাঠিকা কিংবা শ্ৰোতা।
এই জুর রবির চেয়ে কাদম্বরীকেই কাহিল করেছে বেশি। মুখখানি শীর্ণ মনে হয়, চক্ষু দুটি বেশি উজ্জ্বল দেখায়। শেমিজ ঢলঢলে হয়ে গেছে, হাত দুটিও রোগা রোগা। কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি একটুও কমেনি। জ্বর-মুক্ত দিনে সারা বাড়ি ছুটে বেড়ান, স্নান করেন দুবার, নিজের হাতে রবির জন্য দু একটি পদ রান্না করেন।
এর মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফিরে এলেন শিলাইদহ থেকে। বাড়িতে অসুখের কথা শুনে তিনি স্ত্রীর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, ছোটভাইয়ের হাত ধরে নাড়ির গতি বুঝতে চাইলেন এবং তখুনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। হাওয়া বদল দরকার। শুধ ওষুধে সব অসুখ সারে না। দাৰ্জিলিং! সেখানকার নির্মল, শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাবে।
দু-একদিনের মধ্যেই যাওয়া যাবে না। কিছু কাজ সেরে নিতে হবে। যাওয়া হবে সামনের মাসে। তবু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সরকারবাবুকে ডেকে ব্যবস্থা নিতে বললেন। একজন গোমস্তাকে এখনই পাঠিয়ে দিতে হবে দার্জিলিং, সে একটা বাড়ি ভাড়া করে সব গোছগাছ করে রাখবে, রান্নার ঠাকুর ও দাসদাসী যাবে কয়েকজন, রেলের কামরা রিজার্ভ করা দরকার। এই সব নির্দেশ দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন।
আজ পূর্ণিমা, এমন সন্ধ্যায় ঘরের মধ্যে কাটানোর কোনও মানে হয় না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলে গেছেন, এখনও আসেননি, রবি আর কাদম্বরী উঠে গেল ছাদে। ময়দানের দিকটা জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে, যেন একটা সমুদ্র। জ্যোৎস্নার মধ্যে যেন একটা সুরের মুর্ছনাও রয়েছে, যেন সুরালোকে চলেছে কোনও সঙ্গীত-উৎসব।
দুই প্রায় সমবয়স্ক যুবক-যুবতী বসে আছে পাশাপাশি। কেউ কোনও কথা বলছে না। আজ কাদম্বরী রবিকে কোনও গান গাইবার জন্য অনুরোধ করেননি, রবিও কোন খুনসুটি করছে না। সব কথার চেয়ে নীরবতাই যেন এখন শ্ৰেষ্ঠ উপভোগ্য।
এইভাবে বসে রইল অনেকক্ষণ। দুজনে দুজনের হাত ধরে আছে। দুজনেরই জ্বর আছে গায়ে। হাত দুটি তপ্ত। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে পরস্পরের দিকে। তবু কোনও কথা নেই।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে কেল্লা থেকে কামান দাগার শব্দ হল। পরপর বেশ কয়েকবার। সেই সঙ্গে শোনা গেল জাহাজের ভোঁ। বিলেতের জাহাজ ছাড়ছে। বাংলার ছোট লাট স্যার অ্যাসলি ইডেন আজ বিদায় নিচ্ছেন। কুখ্যাত এই ছোটলাট, জোর করে চাপিয়েছেন ভার্নাকুলার অ্যাক্ট। অবসর নিচ্ছেন বলে আজ অনেক বাড়িতে আনন্দে উলুধ্বনি করা হয়েছে।
এই সময়েই বাড়ির সামনে এসে থামল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফিটন গাড়ি।
পরদিন রবির ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। চোখ মেলার পরই মনে হল, আজ জ্বর আছে, না নেই? নিজের কপালে হাত রেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শরীরে কোনও গ্লানি নেই, একটা যেন আবেশ জড়ানো। পালঙ্ক থেকে নেমে রবি সেই ঘুমের রেশ লাগা চোখেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। পৃথিবীরও এখনও ঘুম ভাঙেনি। এদিকের রাস্তায় ফেরিওয়ালা, গোয়ালাও বিশেষ দেখা যায় না। ঊষার আলো প্ৰথমে যেন হালকা নীল বর্ণ, তারপর একটু একটু করে লাগছে রক্তিম আভা।
সদর স্ট্রিট যেখানে শেষ হয়েছে, সেই ফ্রি স্কুলের বাগানে গাছপালার আড়ালে দেখা যাচ্ছে হিরন্ময় আলোয় ধোওয়া নতুন সূর্যকে। সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রবির চোখের ওপর থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। এই যবনিকার অন্তরালে শুধু আনন্দ ও সৌন্দর্যের তরঙ্গ। এতদিনের চেনা বিশ্বের বদলে উদ্ভাসিত হল এক নতুন বিশ্ব। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে বিদূরিত হল তার রশ্নি, মুহূর্তে মিলিয়ে গেল সব বিপদ।
ঠিক যেন এক দৈব দর্শনের মতন নিস্পন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রবি। শিহরিত হয়ে আছে সমস্ত রোমকূপ। সে শুনতে পাচ্ছে একটা ঝরঝর শব্দ। যেন এই মাত্র কোথাও কঠিন পাথর ফাটিয়ে বেরিয়ে এল একটা ঝর্না। সেই নবীন জলধারার শব্দ তার নাম ধরে ডাকছে।
বাসি মুখেই রবি লিখতে বসে গেল।
সে বুঝতে পারছে, আজ সে কবিতা রচনা করছে না, আজ কবিতা স্বতোৎসার। ভাষার জন্য চিন্তা করতে হচ্ছে না। চিন্তাই বেরিয়ে আসছে নিজস্ব ভাষায়। কয়েক লাইন লিখে বারবার পড়ছে রবি, নিজেই বিস্মিত হয়ে ভাবছে, এ কার লেখা?
আজ প্রত্যুষে কি তার নবজন্ম হল?
সারাদিন ধরে লিখে গেল রবি। মাঝে কাদম্বরী তার ঘরে এসে কয়েকবার উকি দিয়ে গেছেন, রবি লক্ষ করেনি। সে আজ খেতে যায়নি, প্লেটে করে কিছু ফল মিষ্টি কেউ রেখে গেছে তার সামনে, সে তার থেকেও খেয়েছে সামান্যই। সে কয়েক লাইন লিখছে, খাচ্ছে, বারবার পাঠ করছে সেই লাইনগুলো, আবার লিখছে।
বিকেলের দিকে কাদম্বরী গা ধুয়ে সাজগোজ করে এসে মৃদু স্বরে ডাকলেন তাঁকে। রবি সাড়া দিল না।
রবি অন্যমনস্কভাবে বলল, না!
কাদম্বরী রাগ করে বললেন, রবি, এবার আমি তোমার খাতা কেড়ে নেব কিন্তু!
রবি ফিরেও তাকাল না, কিছু বললও না।
কাদম্বরী এবারে একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে রবির লেখার পাশে আঁকিবুঁকি কেটে দিলেন।
রবি বলল, আঃ, কী হচ্ছে?
কাদম্বরী বললেন, রবি, তুমি সারাদিন মাথা গুঁজে পড়ে থাকবে, এটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তুমি ওঠো। না হলে সব লেখা কাটাকুটি করে দেব বলছি!
রবি কয়েকবার মাথা ঝাঁকুনি দিল। তারপর উঠে বসে বলল, নতুন বউঠান, কী লিখেছি, শুনবে? এটার নাম ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।
কাদম্বরী বললেন, হ্যাঁ, শোনাও। তারপর তুমি স্নান করে পোশাক বদলাবে। আমরা আজও ছাদে গিয়ে বসব।
রবি পড়ল, প্রথম চার লাইন।
আজি এ প্রভাতে প্ৰভাত-বিহগে।
কী গান গাইল রে!
অতি দূর দূর আকাশ হইতে
ভাসিয়া আইল রে!
এইটুকু পড়েই, মুখ তুলে তাকিয়ে রবি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?
কাদম্বরী ঈষৎ ভুরু কোঁচকালেন। ধীরে মাথা দুলিয়ে বললেন, তেমন ভালো লাগছে না তো! ‘ভাসিয়া আইল রে’, এটা কেমন যেন!
রবির বুকে যেন একটা শেল বিঁধল। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে শোনাতে শুরু করেছিল। তার দৃঢ় ধারণা, এ কবিতা
একেবারে অন্যরকম। তার নবজন্মের কবিতা।
সে ফ্যাকাসে গলায় বলল, তোমার ভালো লাগছে না? নতুন বউঠান, এ কবিতা আমি চেষ্টা করে লিখছি না। আপনা আপনি বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে।
কাদম্বরী নিচু গলায় বললেন, আপনা আপনি বেরিয়ে এলেই কি ভালো কবিতা হয়। কবিতা তো একটা নির্মাণের ব্যাপার, তাই না? আমি অবশ্য বিশেষ কিছুই বুঝি না।
রবি গম্ভীর হয়ে আবার পড়তে শুরু করলঃ
না জানি কেমনে পশিল হেথায়
পথ হারা তার একটি তান,
আঁধার গুহায় ভ্ৰমিয়া ভ্রমিয়া
আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ছুঁয়েছে আমার প্রাণ…
রবি আবার মুখ তুলল।
কাদম্বরী অপরাধীর মতন মুখ করে বললেন, কী জানি, আমি এতে নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো আমার বোঝার ভুল-
রবির মাথায় রাগ চড়ে গেল। কাদম্বরীর দিকে সে এমন রক্তচক্ষে কখনও তাকায়নি। তার মনে হল, এ রমণী কিছুই কবিতা বোঝে না। একে আর শুনিয়ে কী হবে? নাঃ, আর কোনওদিন সে নতুন বউঠানকে তার কবিতা শোনাবে না।
কাদম্বরী ঝুঁকে রবির গা ছুঁয়ে মিনতি করে বললেন, রবি, তুমি রাগ করছ? আর একটু পড়ো-
রবি এবার অনেকটা বাদ দিয়ে চিৎকার করে পড়তে লাগলঃ
আজি এ প্ৰভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্ৰাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পর
জাগিয়া উঠিল প্রাণ…
কাদম্বরী বললেন, বাঃ, এই জায়গাটা ভালো লাগছে। সত্যি বেশ ভালো লাগছে। রবি পড়ে যেতে লাগল প্রায় গর্জনের স্বরে :
জাগিয়া উঠেছে প্ৰাণ
ওরে উথলি উঠেছে বারি
ওরে প্রাণের বসনা প্ৰাণের আবেগ
রুধি রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরিজ উঠছে দারুণ রোষে…
কাদম্বরী রীতিমতন ভয় পেয়ে রবির একটা হাত চেপে ধরে আর্ত গলায় বলে উঠলেন, রবি, রবি, থামো। তোমার আজ কী হয়েছে, রবি?
রবি থেমে গেল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। থমথমে মুখ, উষ্ণ শ্বাস।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, নতুন বউঠান, আজ আমার ঘোর লেগেছে। কিসের ঘোর তা জানি না। আমি যেন আর আমাতে নেই!