1 of 2

২০. হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে

হাওড়া স্টেশনে সূর্যর সঙ্গে সাংকেতিক কথা বলে দেখা করল একজন দাড়ি-গোঁফওয়ালা যুবক। মাথায় বাবরি চুল, সাধু সন্ন্যাসীদের মতন মাঝখান দিয়ে সিঁথিকাটা। মুখ-ভরতি পান। আধময়লা ধুতি ও মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। তাকে দেখলে কোনও মন্দিরের পাণ্ডা মনে হয়।

যাবার কথা চন্দননগরে, যুবকটি তাকে নিয়ে গেল বর্ধমান। ট্রেনে একটি কথাও হল। বর্ধমান স্টেশনে নেমে যুবকটি একখানা মস্তবড় তরমুজের আধখানা কিনে ফেলল। তার এক টুকরো সূর্যকে দিয়ে বলল, খাওনা, বেশ সরেস জিনিস! পেট ঠান্ডা হয়।

যুবকটি তার দাড়ি ও জামা রসে মাখামাখি করে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেল তরমুজ। পথেঘাটে দাঁড়িয়ে কিছু খাওয়ার অভ্যাস সূর্যর নেই। তা ছাড়া হাতে রস লেগে যাওয়া তার পছন্দ নয়। আলতো ভাবে যতটুকু সম্ভব খেয়ে নিল–যেন এটাও তার কর্তব্যের অঙ্গ।

তারপর যুবকটি ফেরিওয়ালার কাছ থেকে দু’খিলি পান কিনে এক খিলি সূর্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও!

সূর্য বলল, আমি পান খাই না।

খাও না? তা বেশ।

বিনা বাক্যব্যয়ে সে দ্বিতীয় খিলিটাও মুখে পুরে দিল। তারপর লাইনের ধারে গিয়ে পিক ফেলে এসে বলল, তোমাকে দিন সাতেক বাড়ির বাইরে থাকতে হবে। পারবে?

পারব।

তা বেশ! আমার নাম হল গে যোগানন্দ আচার্যি। তোমার নামটি কী ভাই? সূর্য বলল, আমার নাম অমর পালিত।

তা বেশ! তুমি রান্না করতে জানো?

সূর্য একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, রান্না?

যোগানন্দ এবার পান খাওয়া ঠোঁটে একগাল হেসে বলল, তোমার ওপরে ভাই ভার পড়েছে রান্না করার! রান্না না জানলে যে তোমাকে না খেয়ে থাকতে হবে!

সূর্য কোনও উত্তর দিল না। হরকুমার তাকে দেশের কাজ করার জন্য দীক্ষা দিয়েছিলেন–এর সঙ্গে রান্না করার কী সম্পর্ক?

যোগানন্দ জিজ্ঞেস করল, তুমি বর্ধমান টাউনে আগে এসেছ? আসোনি? চলো, তা হলে টাউনটা একটু ঘুরে দেখা যাক।

ঘণ্টাখানেক ওরা ঘুরল বর্ধমানের রাস্তায়। যোগানন্দ বেশ পেটুক ধরনের। একটু আগে অতখানি তরমুজ খেয়েও তার আশ মেটেনি, রাজবাড়ির গেটের কাছে একটা দোকানে গরম গরম তেলেভাজা হচ্ছে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিনে ফেলল একগাদা বেগুনি, আলুর চপ। খানিকটা বাদেই সে দাঁড়াল আবার একটা শরবতের দোকানের পাশে। এর স্বভাবটা যেন ন্যালাখ্যাপা ধরনের, স্বার্থত্যাগী দেশকর্মী বলে মনেই হয় না।

ফিরতি ট্রেন ধরে ওরা চন্দননগরে পৌঁছোল সন্ধ্যার পর। বোড়াই চণ্ডীতলায় একটা মুদিখানায় ঢুকে যোগানন্দ কী যেন কথা বলল, তারপর হাঁটতে হাঁটতে শহর ছাড়িয়ে চলে এল হলদেডাঙায়। অন্ধকার, ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা মস্ত বড় দোতলা বাড়ি, দেখলে ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়। গাড়িবারান্দার পর চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। যোগানন্দ পকেট থেকে চাবি বার করে সদর দরজার তালা খুলল, তারপর নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দু’জনে ঢুকল ভেতরে। যোগানন্দ দেশলাই জ্বালতে দেখা গেল সরু বারান্দার পর একটা সিমেন্ট-বাঁধানো চাতাল, তার মাঝখানে তুলসী মঞ্চ। তুলসী মঞ্চের ওপর প্রদীপ বসানোই ছিল, সেটা জ্বালিয়ে দিয়েই যোগানন্দ বলল, এবার হ্যারিকেন খুঁজতে। হবে!

হ্যারিকেন পাওয়া গেল বারান্দাতেই, সেটা নিয়ে ওরা উঠল দোতলায়। বেশ বড় সাইজের পাঁচ-ছ’ খানা ঘর–ওরা চলে এল বাড়ির একেবারে পিছন দিকের ঘরটায়–সঙ্গে ব্যালকনি আছে। সেই ঘরের মেঝেতে খানকয়েক মাদুর ছড়ানো, একটা কুঁজো, কিছু হড়িকড়াই বাটি।

হ্যারিকেন নামিয়ে রেখে যোগানন্দ বলল, এখানে তোমাকে থাকতে হবে। ভূতের ভয় নেই তো? পারবে একলা থাকতে?

সূর্য ভয় পায়নি, সে বেশ রোমাঞ্চিতই বোধ করছে। এত বড় একটা বাড়ি তার একার জন্য, এটা কি কম কথা?

যোগানন্দ বলল, এবাড়িটা মানকুন্ডুর বিশ্বাসবাবুদের। তাদের নায়েবের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে ননীমাধব সান্যাল। উনি তোমার মেলোমশাই হন। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, তোমার মাসি আর মেলোমশাই পাটনায় বেড়াতে গেছেন–দু-চার দিনের মধ্যেই আসবেন। তুমি জগদ্দল, কঁকিনাড়া, গোঁদলপাড়া–এইসব জায়গায় জুটমিলে চাকরি খুঁজতে এসেছ! বুঝলে? রাত্তিরবেলাটা পারতপক্ষে ফরাসি এলাকার বাইরে থেকো না!

সূর্য জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আমার আসল কাজটা কী?

সেটা আমিও জানি না। জানতে পারবে ঠিক সময়ে। নাও, জামাটামা খুলে ফেলো। আজকের রাতটা আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।

যোগানন্দ তার পাঞ্জাবি-ধুতি খুলে ফেলে শুধু আন্ডারওয়্যার পরে মাদুরে বসল। সূর্য তাকিয়ে দেখল, যোগানন্দর সাঙ্ঘাতিক ভালো স্বাস্থ্য। রীতিমতন ব্যায়াম না করলে এ রকম স্বাস্থ্য হয় না। তবে, যোগানন্দর পিঠে অনেকগুলো লম্বা লম্বা কালসিটে দাগ। যোগানন্দ সম্পর্কে সূর্যর মনে এখন একটু একটু শ্রদ্ধা জাগছে। জিজ্ঞেস করল, পিঠে ওই দাগগুলো কীসের?

যোগানন্দ ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, কিছু না! শ্যামনগরে যেবার ধরা পড়লাম, থানার, দারোগা খুব টেটিয়া ছিল।

আপনি জেল খেটেছেন?

বছর চারেক আটকে রেখেছিল।

হরদাকে চিনতেন?

হরদাই আমার গুরু। উনিই আমাকে এ-লাইনে এনেছেন।

আমাকেও।

জানি।

আমারও জেলের ভেতরটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

এত তাড়াতাড়ি কীসের? একদিন-না-একদিন যেতেই হবে।

যোগানন্দ আবার উঠে পড়ে বলল, নাও নাও, রান্নার জোগাড়যন্তর করতে হবে না? দেখি কী আছে! শোনো, তুমি এই পাশের বারান্দাতেই রান্না করে নিয়োনীচে আর যেতে হবে না। সকালের দিকে একজন মালিকে পাবে–কিন্তু সন্ধের পর সেব্যাটা গাঁজার আড্ডায় যায়–তার টিকিরও দেখা পাবে না।

যোগানন্দ হাঁড়িকুড়ি নেড়েচেড়ে দেখে বলল, তুমি নুন ছাড়া খেতে পারবে? নুনও নেই দেখছি! শুধু আছে চাল, আর মুসুরির ডাল। খিচুড়ি হয়ে যাবে।

সূর্যর খিদে নেই, রাত্তিরে তার আর কিছুই খাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু যোগানন্দর স্বাস্থ্য দেখে বুঝতে পারল, এই লোকের ঘন ঘন খিদে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

বারান্দার তোলা উনুনে যোগানন্দ চটপট আগুন ধরিয়ে ফেলল। চাল-ডাল একসঙ্গে চাপিয়ে দিয়ে আপশোসের সুরে বলল, একটা কিছু তরকারি না হলে কি ভদ্দরলোকে খেতে পারে! কাল সকালে মালিটাকে দিয়ে কিছু আনিয়ে নিয়ে। কিন্তু এখন কী করা যায়।

একটুখানি থেমে ফের বলল, এক কাজ করা যাক। তুমি ভাই চট করে কয়েকটা ডুমুর পেড়ে আনতে পারবে?

সূর্য জিজ্ঞেস করল, ডুমুর কী?

যোগানন্দ সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ডুমুর চেনো না, তুমি কোথাকার সাহেব হে? ডুমুরই তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এলাইনে যখন এসেছ, ডুমুর চিনতে হবে, ডুমুরের ফুল চিনতে হবে, সাপের পাঁচ-পা ‘চিনতে হবে, বারো হাত কঁকুড়ের তেরো হাত বিচি চিনতে হবে, বুঝলে? তুমি উনুনে একটু হাওয়া দাও, আমিই নিয়ে আসছি ডুমুর।

হ্যারিকেন না নিয়েই বেরিয়ে গেল যোগানন্দ। খানিকক্ষণের মধ্যেই যখন ফিরে এল, তখন শুধু ডুমুর নয়, তার সঙ্গে নুন, শুকনো লঙ্কা ও পেঁয়াজও নিয়ে এসেছে কোথা থেকে। কী ভাবে জোগাড় করল, সে রহস্য ভাঙল না। মুখ-চোখ তার আনন্দে উদ্ভাসিত। সোনার জিনিসের মতন সাবধানে নুনটুকু একটা পাত্রে রেখে বলল, নুন ছাড়া কোনও ভদ্দরলোকে খেতে পারে? খাওয়াটাই মাঠে মারা যেত!

গরম গরম খিচুড়ি ও ডুমুর-পেঁয়াজের তরকারি হালুম হালুম করে অমৃতের মতন খেয়ে ফেলল যোগানন্দ। সূর্যরও বেশ ভালোই লাগল খেতে। এই প্রথম সে চাল ও ডালের খিচুড়িতে রূপান্তর হওয়া আগাগোড়া দেখল–এবং এতে তারও খানিকটা অংশ আছে বলে রান্নার স্বাদটাই অন্য রকম মনে হল।

তৃপ্তি করে খেয়ে যোগানন্দ বলল, আমি এঁটো বাসনপত্তরগুলো নিচ্ছি, তুমি হ্যারিকেনটা নাও–চলো পুকুরঘাট থেকে সব ধুয়ে নিয়ে আসি।

পুকুর তো নয়, মস্ত বড় দিঘি। বাঁধানো ঘাট। এতক্ষণে জ্যোৎস্না ফুটেছে–দেখা যায় দিঘির মাঝখানে লাল রঙের শালুক ফুটে আছে। দিঘির ওপারে কয়েকটা খোলার ঘর। চার পাশে বড় বড় গাছ। বাড়িটা এককালে বাগানবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হত মনে হয়। বাড়ি থেকে দিঘি পর্যন্ত আসবার পথটুকু দু’পাশে কেয়ারি করা মেহেদির বেড়া। দল বেঁধে বেঁধে হালকা মেঘ ওড়াউড়ি করছে আকাশে।

দোতলায় ফিরে এসেই যোগানন্দ বলল, আর দেরি করে লাভ কী? শুয়ে পড়া যাক।

সত্যি সত্যি তক্ষুনি মাদুর বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার নাক ডাকতে লাগল।

খাওয়া এবং ঘুমোবার ব্যাপারেই যেন যোগানন্দের যত কিছু উৎসাহ! এর সঙ্গে, তার পিঠের ওই কালসিটে দাগ ও চার বছর জেল খাটার কোনও মিল নেই। হয়তো এমন হতে পারে–যখন কোনও কাজের দায়িত্ব আসে তখন সে আহার-নিদ্রা ভুলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার যখন কাজ থাকে না, সে বেশি করে খেয়ে ও ঘুমিয়ে সব উসুল করে নেয়।

সূর্যর সহজে ঘুম আসে না। অচেনা, অন্য রকম জায়গা, কোথাও কোনও শব্দ নেই, হ্যারিকেনটা নিবিয়ে দেওয়ার পর মনে হয়, সারা দুনিয়াটা এখন যেন জ্যোৎস্নার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। কলকাতায় এইসময়ে তাদের বাড়িতে কারওর খাওয়াই হয়নি। বাবা বোধহয় এখনও ফেরেননি অনাথ আশ্রম থেকে। শ্রীলেখা সারাদিন নিশ্চয়ই খুব কেঁদেছে। হঠাৎ শ্রীলেখার কথা ভেবে সুর্যর খুব মনখারাপ লাগল। শ্রীলেখার বিয়ে হয়ে যাবে, সে অন্য বাড়িতে চলে যাবে–তখন সূর্য কী করবে? শ্রীলেখাকে যে তার খুব দরকার।

চন্দননগরের সেই বাগানবাড়ির নির্জনতা সূর্যর চিত্তে খানিকটা কোমল ভাব এনে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সূর্য তার আগে অন্য কারওর কথা এ রকম ভাবে ভাবেনি। অনেকক্ষণ ধরে শ্রীলেখার কথা তার মাথায় ঘুরতে লাগল। সে ঠিক করল, শ্রীলেখাকে আর কখনও কষ্ট দেবে না।

সকালবেলা যোগানন্দই ডেকে তুলল সূর্যকে। তার ততক্ষণে জামাকাপড় পরা হয়ে গেছে। সূর্যকে বলল, আমি ভাই চলোম। তোমাকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না– আজ বা কালই দাদারা এসে পড়বেন। একটু চারদিক দেখে শুনে থেকো–এই আর কি!

সূর্য ওর সঙ্গে একতলা পর্যন্ত এল। ভালো করে ভোর হয়নি তখনও। অসংখ্য পাখির কিচিমিচি শুরু হয়ে গেছে। বাগানের গাছপালায় একটা টাটকা গন্ধ।

বিদায় নেবার সময় যোগানন্দ খুব সাধারণ ভাবে এমন একটা কথা বলল, যা সূর্যর বুকে খুব একটা ধাক্কা মারল। এমন সরল সুন্দর কথা সূর্য আগে কখনও শোনেনি। যোগানন্দ বলল, ভাই অমর, তোমাকে একটা কথা শুধু বলে যাই। এই যে তুমি এ-পথে এসেছ–এটা শুধু নিজের জন্য। যা করবে, শুধু নিজের কাজ ভেবে করবে। পরাধীনতার দুঃখ যদি তোমার নিজের দুঃখ বলে মনে হয় তা হলেই তুমি সার্থক হবে। অন্যরা যদি ভুল করে, অন্যরা যদি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, এমনকী আমাকেও যদি ভয় পেয়ে পালাতে দেখো-তুমি পালিয়ো না। তোমার যতটুকু সাধ্য–তুমি করে যাবে।

যোগানন্দ চলে যাবার পর সূর্য একা একা সারা বাড়িটা ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। মালিকে দিয়ে কিছু খাবার আনাল। তার সঙ্গে কিছু টাকা আছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সে অতিরিক্ত কোনও জামাকাপড় আনেনি–স্নান করবে কী করে? একটা ঘরে অবশ্য কয়েকটা শাড়ি ও গামছা আছে কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা উচিত কি না সে বুঝতে পারল না। এমনিতে তার অন্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না–কিন্তু সিঁড়ির মুখটাতেই একটা ভিমরুলের চাক–সেখান দিয়ে যেতে-আসতে তার গা ছমছম করছে। ভিমরুলের হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় সে জানে না। সূর্য সেদিন বাড়ি থেকে একদম বেরোলই না–সারাটা দিন, বিকেল, সন্ধ্যা ঘরে শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার পর খুবই একঘেয়ে লাগার জন্য সে বেশ কিছুক্ষণ ডন-বৈঠক মেরে ক্লান্ত করে ফেলল শরীরটাকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিনই শঙ্করবাবু আর সিরাজুল তারিখ এসে হাজির। শঙ্করবাবু গোড়া থেকেই সূর্যকে একটু যেন অপছন্দ করেছিলেন–এখানেও অপ্রসন্ন হয়েই রইলেন। সূর্যকে হুকুম করে কথা বলতে লাগলেন। তারিখ সাহেব আগের মতনই অমায়িক। এখানে কী উদ্দেশ্যে যে তারা জমায়েত হয়েছেন–তার কোনও ইঙ্গিতই নেই–যেন বেশ একটা পিকনিক হচ্ছে। সারা দিন ধরেই রান্নার উদ্যোগ আয়োজনে কেটে যায়। সূর্য ভাত রাঁধতে গিয়েছিল, তার আনাড়িপনা দেখে তারিখ সাহেব হেসেই বাঁচেন না। নিজেই সে দায়িত্ব নিয়ে নিলেন, কোথা থেকে একটা মুরগি যোগাড় করে আনলেন–খুব আহ্লাদ করে খাওয়া হল।

বিকেলবেলা সূর্যকে বাড়িতে রেখে ওঁরা দু’জন বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন অনেক রাত্রে। মুখ-চোখ খুব বেশি খুশি। সূর্য একটু মনমরা হয়ে গেল। তাকে কিছুই জানানো হচ্ছে না, সব কিছুই তাকে বাদ দিয়ে হচ্ছে–তা হলে এখানে ডেকে আনা কেন? রান্না করার জন্য?

পরদিন এলেন এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। এই ভদ্রলোকেরই নাম ননীমাধব সান্যাল, এঁরই সূর্যর মেলোমশাই হবার কথা। মহিলার নাম বনলতা। এ কথা বুঝতেও সূর্যর খুব দেরি হল না যে এঁরা স্বামী-স্ত্রী নন। এঁরা পরস্পরকে আপনি বলে কথা বলেন। এই বাড়িটাকে এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে পলাতক বিপ্লবীরা এখানে এসে গোপন আস্তানা নিতে পারে। তখনও ফরাসি এলাকায় লুকিয়ে থাকার সুযোগ অনেক। এই বাড়িটার আশেপাশে কৌতূহলী মানুষজনও বিশেষ দেখা যায় না।

ননীমাধব ও বনলতা আসবার পর বেশ জমে উঠল। ননীমাধব বেশ মজলিশি ধরনের মানুষ। সূর্যর কাছ থেকে গত কয়েক দিনের বিবরণ শুনে তিনি বললেন, আর সেই জমিদারপুত্তুরটি কোথায় গেল? আমার শালীপুত্রকে এই বাড়িতে একা ফেলে সে চলে গেল?

সূর্য জিজ্ঞেস করল, জমিদারের ছেলেটি কে?

যখন জানল, যোগানন্দই কোনও এক জমিদারের সন্তান–সে বিস্মিত না হয়ে পারল না। তার মনে পড়ল, শুকনো খিচুড়ি ও ডুমুরের তরকারি কী উপভোগ করে খেয়েছিল সে। হরকুমারের কাছ থেকে দীক্ষা নেবার পর কত রকমের মানুষের সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে।

একথা ঠিক, মানুষ অনেক রকম। নিজের পরিচিত গণ্ডীর বাইরে না এলে তা বোঝা যায় না।

বনলতার মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা–সব সময় ফিটফাট সেজেগুঁজে থাকেন। দেখে কেউ কিছু সন্দেহই করতে পারবে না–অথচ এই বনলতাই কিছুদিন আগে হার্মোনিয়ামের মধ্যে রিভলবার ভরে নিয়ে কুমিল্লায় পৌঁছে। দিয়ে এসেছেন।

বড়রা যখন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে শলাপরামর্শ করেন, বনলতা তখন গল্পে মেতে ওঠেন সূর্যর সঙ্গে। পা ছড়িয়ে বসে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, এবার বলো, আমার দিদি কেমন আছেন?

সূর্য বুঝতে পারে না। বনলতার দিদির খবর সে কী করে জানবে?

বনলতা বললেন, বাঃ, বুঝতে পারলে না? আমি যদি তোমার মাসি হই, তা হলে তোমার মা আমার দিদি হলেন না? কেমন আছেন তোমার মা? কলকাতায় থাকেন? নিশ্চয়ই তাকে খুব সুন্দর দেখতে!

সূর্য নির্বিকার মুখে জানাল, আমার মা নেই।

বনলতার মুখখানা এক মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন সূর্যর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, জানো, আমারও মা নেই। তোমার চেয়ে আমি যখন ছোট, তখন আমার মা মারা গেছেন। তোমার বাবা?

সূর্য চুপ করে রইল।

বনলতা হঠাৎ রেগে উঠে বললেন, আমার সঙ্গে তোমার অত নিয়ম নিয়ে আদিখ্যেতা করতে হবে না! আমি যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দাও! পুলিশ যদি ধরে– তখন কি তুমি এক রকম কথা বলবে, আর আমি আর এক রকম কথা বলব? সব মিলিয়ে নিতে হবে না? তোমার মা সত্যিই নেই?

সূর্য দু’দিকে মাথা নাড়ল।

কত দিন আগে মারা গেছেন?

আমার মনে নেই।

বনলতা একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার চোখদুটো সজল হয়ে এল। আস্তে আস্তে বললেন, হরদাকে যখন আমি বলেছিলাম আমার মা নেই–উনি বলেছিলেন, সে জন্য দুঃখ করতে নেই–এই দেশই তো আমাদের সকলের মা। কিন্তু তোমায় আমি সেকথা বলব না। ছোট বয়সে যে নিজের মাকে হারিয়েছে তার মতন দুঃখী আর কেউ নেই। তোমার বাবা আছেন তো?

হ্যাঁ।

আর কে আছেন? ভাই, বোন?

কেউ না।

তুমি এইটুকু ছেলে, সব সময় এমন গম্ভীর থাকো কেন?

কই, না তো!

তুমি আজ স্নান করার সময় দিঘি থেকে কয়েকটা শাপলা তুলে আনতে পারবে? ভালো তরকারি হয়।

আমি সাঁতার জানি না।

সাঁতার জানো না? এ মা, এ কী কথা? এক্ষুণি শিখে নাও। যে-কোনও সময় দরকার লাগতে পারে।

আপনি শিখিয়ে দেবেন?

আমি?

বনলতা একটু যেন লজ্জা পেলেন। আরক্ত মুখে বললেন, আমি কি পারব? তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। শংকরদাকে বলো।

থাক, পরে শিখে নেব।

আমি কী করে সাঁতার শিখেছিলাম জানো? তখন আমরা কামারহাটিতে থাকতাম বাড়ির সঙ্গেই একটা পুকুর। আমার বউদি আমাকে ইচ্ছে করে করে গভীর জলে ঠেলে দিতেন–আমি যা ভয় পেতাম–আঁকুপাকু করে, হাত-পা ছুঁড়ে–। তোমাকেও স্নান করার সময় যদি আমি ঠেলে দিই জোর করে তবে তোমার সঙ্গে বোধহয় গায়ের জোরে পারব না। তুমি কি আমার থেকেও লম্বা?

হ্যাঁ।

বনলতা উঠে দাঁড়িয়ে সূর্যকে পাশে ডাকলেন। মেয়েদের তুলনায় বনলতা বেশ লম্বা–তবু সূর্যর মাথা তাকে ছাড়িয়ে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে সূর্য অবলীলাক্রমে বনলতার কাঁধের ওপর একটা হাত তুলে দিল। তারপর চাপ দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করল একটু।

বনলতা প্রথমটায় বুঝতে পারেননি, রীতিমতন অবাক হয়ে সূর্যর দিকে তাকালেন। তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, হুঁ, ছেলে এর মধ্যেই পেকে বুনো! আমি তোমার মাসি হই না?

সূর্যর হাতখানা ধরে খুব মিষ্টি করে বললেন, এখন এসব দিকে মন দিতে নেই, বুঝলে? তোমার বয়সে মন বেশি চঞ্চল থাকে নিজের মনকে ঠিক করো! আগে দেশ স্বাধীন হোক–

কোনও উত্তর না দিয়ে সূর্য অদ্ভুত ভাবে হাসল।

ছ’দিনের দিন বেশি রাত্তিরে আরও তিনজন মানুষ এসে হাজির। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে সূর্য নিজেকে সামলাতে পারল না, ডেকে উঠল, ব্রজদা!

হাজারিবাগে হরকুমারের আস্তানায় সূর্য এই ব্রজগোপালকে দেখেছিল। এতদিন বাদে সূর্য আর একজন চেনা লোককে পেল। তার ধারণা ছিল ব্রজগোপাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন।

ব্রজগোপাল সূর্যকে জড়িয়ে ধরলেন। খানিকটা আপ্লুত গলায় বললেন, হরদাকে বাঁচাতে পারলি না?

খানিকটা সামলে নিয়ে ব্রজগোপাল বললেন, সূয্যি, শিগগিরই সারা দেশে আগুন জ্বলবে। এবার শেষ ধাক্কা মারব ব্যাটাদের। এই সময়ে যারা এগিয়ে আসবে না। তারা পোকামাকড়, মানুষ না! আমাদের অনেক প্রস্তুতি দরকার। তোকে যা বলব, পারবি তো?

পারব।

আজ রাত্তিরে আমরা বেরোব। একটা কথা শুধু বলে রাখি। কেউ যদি ধরা পড়ে, কেউ যদি মারা যায় তা হলে তাকে সাহায্য করার জন্য অন্য কারওর এগিয়ে যাবার দরকার নেই। প্রত্যেকটা প্রাণের দাম আলাদা–এমনকী আমিও যদি উন্ডেড হই– আমাকে ফেলে রেখে চলে আসবি।

বনলতা বললেন, ওর গিয়ে কাজ নেই। ও তো একেবারে ছেলেমানুষ–ও আমার কাছে থাক।

ব্রজগোপালের সঙ্গে যে দু’জন এসেছিল, তার মধ্যে একজনকে সূর্যর চেনা চেনা লাগছিল। নিখুঁত ভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো, সাহেবি পোশাক-পরা, গম্ভীর ধরনের। এবার সে সূর্যর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, না, না, ও থাকবে কেন। ও যাবে। ও ঠিক পারবে।

গলার আওয়াজ শুনেই সূর্য চিনতে পারল। এই সেই যোগানন্দবাবরি চুল, দাড়ি গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। তার সেদিনকার চেহারাটাই ছদ্মবেশ ছিল না আজকেরটা, বোঝা যায় না। সূর্য তার হাত চেপে ধরলে। এই মানুষটিকেও সূর্যর বেশ পছন্দ হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *