আমি খুব ভাল করেই জানি মানুষ আসলে খুব একা। সে একটি দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পড়শি এবং ঘর নিয়ে দলবদ্ধ বেঁচে থাকবার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কারণ সে ভয় পায়। জাগতিক সমস্ত কিছুকে ভয় পায় বলে পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের কোমর আঁকড়ে থাকে, আঁকড়ে রাখে সন্তানের হাত। ভয় দলছুট হওয়ার। ভয় একা হওয়ার। খুব গোপনে গোপনে মানুষ বড় একা, তাই আর এক হতে চায় না।
আমার যখন দশ বছর বয়স, ডান হাতে একটি সন্ধিবেত আর বাম হাতে একটি ইংরেজি গ্রামার বই নিয়ে আমার বাবা আমাকে রোজ রাতে পড়াতে বসতেন। বাবা খুব যত্ন করে টেনস্ শেখাতেন। বুঝতে সামান্য দেরি হলেই পিঠে পড়ত সপাং সপাং বেত। রাতে বিছানায় শুয়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কাঁদতাম। বাবাকে কত রকম অভিশাপ দিতাম। এখন মাঝে মধ্যেই আমার সেই পিঠে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে, সেই সন্ধিবেতের মুছে যাওয়া দাগে স্পর্শ রেখে স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে আশীর্বাদের। ছোটবেলায় ওই ভয়ঙ্কর এক একটি বেতের আঘাতে কী ভীষণ ভালবাসা ছিল আমি তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। ঘরে বাইরে আমার বাবার খুব দাপট ছিল। দিনে অন্তত বত্রিশবার বাবা আমাদের বলতেন ‘ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ’, ভোরবেলায় সে গ্রীষ্ম হোক, কনকনে শীত হোক, ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে জুতোর মচ্মচ্ শব্দ তুলে বেরিয়ে যেতেন, ফেরার সঠিক কোনও সময় ছিল না। কোনওদিন দুপুরে হয়ত এক হাঁটু ধুলো মেখে উঠোনের মাটিতে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলছি, বাবা হঠাৎ এসে জুতোর তলায় এক্কা দোক্কার দাগ মুছে খেলা ভেঙে দিতেন, কোনওদিন রান্নাঘরে মা’র পাশে গিয়ে বসলে বাবা ধমকে তুলে আনতেন, মা যদি বলতেন—বসে যদি রান্নাটা শেখে, শিখুক। বাবা চোখমুখ লাল করে বলতেন—ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনও কিছু—খেলা, ঘুম, আড্ডা কিংবা বেড়ানোর অনুমতি আমাদের ছিল না। নাওয়া এবং খাওয়া ছাড়া বাদবাকি সময় লেখাপড়ার, পায়খানা প্রস্রাবের জন্যও বাবা খুব অল্প সময় ব্যয় করতে বলতেন। রাতের বেলাটা ছিল বাবার নিজস্ব নিয়মে গড়া, নিজের তোশকের নিচে যত্ন করে রাখা সন্ধিবেতটা নিয়ে আসতেন, বলতেন বই নিয়ে এস। বাবার খুব প্রিয় বিষয় ছিল ইংরেজি গ্রামার। পড়া মুখস্থ না হলে কোনও কোনও রাত মধ্যরাত পার করে যেত, ঘুমে চোখ ছোট হয়ে আসত, শরীরের হাত পা জোড়া খুলে নরম হয়ে আসত, তবু ছাড়পত্র মিলত না ঘুমোতে যাবার। কোনও কোনও দিন পড়া খুব চমৎকার বলতে পারলে বাবা সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতেন, মাছ বা মাংসের সবচেয়ে বড় টুকরোটা তুলে দিতেন পাতে, সেদিন আমার সকাল সকাল ছুটি।
এখন বাবার আগের সেই দাপট নেই। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। স্থবির পড়ে থাকেন একলা ঘরে। বাবার মত ভয়ঙ্কর মানুষটিও বড় একা।
আমার মাও একা। কারা যেন আমার মাকে বুঝিয়েছে ধর্ম কর্মে মন দিলে হবে অপার শান্তিলাভ। মা একটি ভুল বিশ্বাস নিয়ে গভীর রাত্তিরে তাহাৰ্জ্জুদের নামাজ পড়েন, শেষরাতে সুর করে দুলতে দুলতে পড়েন—‘ফাবিআইয়ে আলা-ই-রাববুক’। মা-ও খুব একা।
আমার একটি চমৎকার ছোট বোন ছিল। ও কথা বললেই সারা বাড়ি হেসে উঠত। ও গা দোলালেই সারা বাড়ি রিনরিন করে বাজত। এত সুন্দর গান গাইত মেয়েটি, এমন দিন নেই ওর গান শুনে চোখে জল আসেনি আমার। বড় বড় বিয়ের ঘর আসত ছোট বোনটির জন্য। বাবা রাজি হতেন না, বলতেন—ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ।
বোনটি এখন আর গান গায় না। আমার সেই আশ্চর্য সুন্দর বোনটি এখন খুব যত্ন করে আলনার কাপড় গোছায়, রোদে ডালের বড়ি শুকোতে দেয়, সারা দুপুর রান্না করে কই মাছের ঝোল। বিকেল হলে কানে সোনার দুল পরে স্বামীর সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যায়। আমার বোনটিও বড় একা।
আমিও। এখন আমি আর ছোটবেলার মত টেনস্ ভুল করি না। আমাকে প্রচুর লিখতে হয়। টেবিলে স্তুপ হয়ে থাকে এত বই পড়ে পড়ে রাত পার হয়ে যায়, ছোটবেলার মত আমার চোখে রাজ্যির ঘুম নামে না।
বাবা বলতেন বড় হও। যত বড় হই, বাবা বলেন আরও বড় হও। আরও বড় হওয়া আমার আর হয়নি। এখনও বছরে দু’বার বাবার সামনে দাড়ালে বাবা আরও বড় হতে বলেন। আমার আর বড় হওয়া হবে না জানি তবু বাবার সেই এককালের দাপুটে শরীরের সামনে দাড়ালে আমিও নরম হয়ে আসি, বলি—হব। কবে আর হব! তসবিহু জপতে জপতে মার আঙুলে কড় পড়ে গেছে, মা আমাকে দেখলে বুকের কাছে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন—তুই যেখানে থাকিস, সুখে থাকিস তো? শুনে আমার এত কান্না পায়, মনে মনে বলি—সুখী সবাই হয় না, মা। চোখের জল গোপন করে আমি এমন সশব্দে হেসে উঠি যে মা কিছু বুঝতেই পারেন না। বুঝলে আর রক্ষে আছে ? সারারাত ঘুমোবেন না, নানারকম নামাজ পড়বেন।
২. এই সমাজে মেয়েদের বেঁচে থাকবার জন্য অন্য একটি মানুষ দরকার হয়। কিছু লতা গাছ আছে ওরা অন্য এক বৃক্ষ আশ্রয় করে বেঁচে থাকে, কিছু দুর্বল গাছকে আবার বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে ঠেস দিয়েও রাখতে হয়। আমাদের সমাজ মেয়েদের লতা বা দুর্বল গাছের মত মনে করে—যারা আশ্রয় এবং অবলম্বন ছাড়া বাঁচে না।
আসলে কিন্তু বাঁচে। বেশ অশ্বত্থের মত বেঁচে উঠতে পারে। কিন্তু মাটি নেই—মাটি তেমন উর্বর নয় যে স্বচ্ছন্দে বেড়ে ওঠা যায়, মাটিতে কাঁকড় বাকড়, নুড়ি খোয়া এত বেশি যে জল নেই, পুষ্টি নেই—বৃক্ষ বাড়ে না।
তেমন আমিও বাড়ছি না। আমার চারপাশের এই ছোট্ট গণ্ডিতে মাঝে মধ্যে আমার এমন দম বন্ধ হয়ে আসে যে সারা শহর সাত চক্কর দিলেও মনে হয় ছোট্ট, একটা ম্যাচ বাক্সের মত মনে হয় শহরটাকে, কখনও দেশটাকে।
এখন আর বলে না। স্বামীর মা, বোন এসে চুক্ চুক্ করে দুঃখ করে যায়। ওদের চোখে অন্য এক স্বপ্ন খেলা করে। স্বামীও সেই স্বপ্নের নদীতে বড় সাতরাতে চায়।
আমার হাত ভিজে যায় নীতার চোখের জলে। নীতা আমাকে বড় আপন ভাবছে বলে প্রতিদিন এসে বসে থাকে, কিছু একটা বলা দরকার আমার। রফিকের আত্মীয়রা বন্ধ্যা মেয়ে বিয়ে করবার জন্য রফিকের ভাগ্যকে দোষ দেয়। দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলে। আমি জানি নীতা একদিন এসে আমাকে এও বলবে রফিক বিয়ে করেছে।
এই চমৎকার মেয়েটি, মগরার পর থেকে এক নদী স্রোতস্বিনী স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে একটি সংসার সাজিয়েছে, আমি তাকে কোনও সম্ভাবনার কথা শোনাতে পারি না।
ডাঃ রজব আলী’র ‘সন্ধিবেত’ আর ‘চাবুকে’র কারণে ঐ পরিবারের কেউ ডাক্তার হতে না পারলেও, ঠিকই একজন ডাক্তার হয়েছে !!
এবং সেই নতুন ডাক্তার কতৃক ডাঃ রজব আলী বড় কষ্টটাই পেয়েছেন ।।