Tell me in what part of the wood
Do you want to flirt with me.
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কবজির কাছটা এখনও জ্বালা করছে। ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে কাকিমা চেপে ধরেছিলেন। জলে ডোবার আগে মানুষ এইভাবে আঁকড়ে ধরে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে। নয়তো চাকার তলায় চলে যাবার সম্ভাবনা ছিল। ট্রেনের পেছনের লাল আলোটি ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে এখনও ভাসছে। একটি মুখ দূর থেকে দূরে ক্রমশই আরও দূরে সরে যাচ্ছে। চেষ্টা করলেও যে-মুখটিকে আমি কোনও দিনই ভুলতে পারব না। আকাশের দিকে তাকালে ভেসে উঠবে। স্থির জলে ভাসবে। স্বপ্নে উঁকি মেরে যাবে। বিষণ্ণ আশাহত দুটি চোখ। ভেজাভেজা চোখের পাতা। বারেবারে কেঁপে-ওঠা পাতলা দুটি ঠোঁট।
মুকু হাত ধরে টান মারল, তোমার দেখছি ঘোর লেগে গেছে! এমন ভাব করছ, কেউ যেন কখনও বিদেশ টিদেশ যায় না! মানুষে মানুষে যেন ছাড়াছাড়ি হয় না! আমি বলে কোথাকার মেয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে এককথায় কোথায় চলে এলুম, একটুও মন খারাপ হল না আর তুমি পুরুষমানুষ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করছ! চলো।
শূন্য প্লাটফর্ম কী অদ্ভুত দেখতে! একজোড়া লাইন পড়ে আছে। কিছু কাগজ, দু’-একটা ভাড়, তেল, কালি, রেল-রেল গন্ধ। বাক্স প্যাটরা বেডিং-এর ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকা অপেক্ষমাণ। কিছু যাত্রী। সকলকেই যেতে হবে। আগে আর পরে। নীল পোশাক পরা দু’-একজন রেলকর্মী। গল্পরত দু’-একজন টিকিট চেকার। লোহার ঠ্যালাগাড়ি চেপে মালপত্র আসতে শুরু করছে। সতর্ক সময়নিষ্ঠ যাত্রীরা স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে আসছেন। কাঁধে জলের বোতল, হাতে ব্যাগ। লাল জামা পরা পোর্টারের মাথায় মোটঘাট। সায়েবি চেহারার পাঞ্জাবি যুবক। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে লাস্যময়ী যুবতী। প্ল্যাটফর্ম আবার জমজমাট হয়ে উঠছে। একটু পরেই দুন এক্সপ্রেস ছাড়বে। সুরেলা গলায় মহিলাকণ্ঠ বারেবারে বিভিন্ন ভাষায় সেই সংবাদই ঘোষণা করছে। জোড়া লাইন কোন সুদূরে চলে গেছে। কেবলই মনে হচ্ছে, আমিও এখুনি কোথাও চলে যাই। বারেবারে আসি, বারেবারে ফিরে যাই। আজ যদি না ফিরি কেমন হয়! স্বামী নির্মলানন্দ দেরাদুনে, আলমোড়ায়, মাদ্রাজে, যে-কোনও জায়গায় আমার স্থান করে দিতে পারেন। আমি একবার হ্যাঁ বললেই হয়। মুকু বললে, তুমি অমন হা করে লাইনের নিরুদ্দেশ যাত্রা দেখছ কেন? প্রাণ ছটফট করছে বুঝি?
ধরেছ ঠিক।
আমারও ওইরকম করে। মনে হয় চলে যাই। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। শুধু চলেই যাই। নাও চলো। কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
মুকু আমার শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে। কেউ দেখলে ভাববে স্বামী-স্ত্রী। মুকু কি আমাকে জালে জড়াবার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছে?
রেলের ক্যান্টিনটি বেশ বড়। লোকজন রয়েছে, তবে বসার জায়গা পেতে অসুবিধে হল না। কোণের দিকে পাশাপাশি দুটি আসন। পাশের টেবিলে সৌম্য চেহারার এক প্রৌঢ় বসে আছেন। তাঁর উলটো দিকে বসে আছেন এক প্রৌঢ়া। কাঁচাপাকা চুল। হালকা রঙের সিল্কের শাড়ি। ধবধবে সাদা ব্লাউজ। রং আর স্বাস্থ্য যেন ফেটে পড়ছে। কপালের মাঝখানে লাল টিপ, ভোরের সূর্যের মতো ভাসছে। দু’জনেই কফির পেয়ালায় হালকা চুমুক মারছেন। মৃদু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। চারপাশে মৃদু একটি সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। সুখ যেন মানুষের চেহারা ধরে এই রেলের ক্যান্টিনে কফির কাপ নিয়ে বসেছে। পৃথিবীতে সব আছে। যা চাইব, তাই দেখতে পাব। পমেড-মাথা কাকিমার মামাশ্বশুর। মানী মানুষের কাছে যৌনবিজ্ঞান পাঠাবার মতো কদর্য চরিত্র। মাতামহের মতো গৃহী সাধক। মাতুলের মতো আত্মভোলা শিল্পী। পিতার মতো নিঃসঙ্গ সৈনিক। স্বামী নির্মলানন্দের মতো সর্বত্যাগী জ্ঞানী সাধক। আলোয় কালোয় বেশ সাজিয়েছ ভগবান!
দু’হাতের তালুতে চিবুক ধরে মুকু বেশ বসেছে! যেন হাতের ফাঁকে পদ্ম ফুটেছে। অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসল। চোখদুটো গভীর সরোবরের মতো কেঁপে উঠল। নাকের পাশের ছোট্ট নাকছাবি উৎসব রাতের চুমকির মতো ঝিলিক মেরে উঠল। বসন্ত নয়, তবু মনে হল মনের সব জানলা দরজা খুলে গেছে। দখিনা বাতাস বইছে। পাপিয়া বড় আকুল সুরে ডাকছে, পিউ কাহা! মরেছে, আমি প্রেমে পড়ে গেছি। মুকুর মুখের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। শুনেছি গভীর রাতে নির্জন পাহাড়ের ফাটল থেকে এক ধরনের রস বেরিয়ে আসে। যার নাম শিলাজতু। বড় দুর্লভ বস্তু। আমার মনের স্তরেও শিলাজতু জমছে ধীরে ধীরে। ধ্যাত, কী আমি সন্ন্যাস সন্ন্যাস করছি! জীবন্ত দেবী ছেড়ে মৃত ঈশ্বরের সন্ধানে মহামূল্য জীবন অপচয় করে ফেলছি। কে জানে আবার এই পৃথিবীতে আসা হবে কি না! শুদ্ধ কোনও পিতামাতার দৈহিক মিলনে, নির্জন কোনও প্রকোষ্ঠে, রজনীর গভীরে ছোট্ট একটি জ্বণের আকারে আবার এই জীবন কি ধরা পড়বে। বাইরে তখন শ্রাবণের ধারা, ভিজে বাতাস, সিক্ত পাতার আনন্দোচ্ছ্বাস। কেউ-ই কারও দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। দুটি দৃষ্টি মাইলের পর মাইল কী সব অপ্রকাশিত কথা লিখে চলেছে ভাষাহীন ভাষায়। সুখেনের কথা, জবার কথা মনে পড়ছে। জবা মা হবে। আমার মা যেমন মা হয়েছিলেন! নরনারীর মিলন যদি পাপের হত, তা হলে শঙ্কর, বুদ্ধ, চৈতন্য, বিবেকানন্দ আসতেন। কী করে?
আমার ডান হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মুকুর কবজি ধরে ফেলল। সারাশরীরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ! আমার সমস্ত মন সেই স্পর্শে নিবেদিত। সবুজ ফসলের খেতে যেন সেচের জল কুলকুল। করে বয়ে চলেছে। লক্ষ করিনি, কখন ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ জগৎ থেকে চলে গেছি কোন মায়ার জগতে! মানুষের এখনও রসবোধ আছে। ওয়েটার ভদ্রলোক কতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে আমাদের দুজনের এই তন্ময়তা দেখছিলেন জানি না। চোখাচোখি হতেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবেন?
বেশ খিদে পেয়েছে। মুকুকে জিজ্ঞেস করলুম, কী খাবে?
যা হয় কিছু বলো না।
মুকু ভদ্রলোককে সামনে থেকে সরাতে চাইছে। আমার সারাশরীরে আড়ামোড়া ভাঙার মতো অদ্ভুত এক অনুভূতি প্রবল হয়ে উঠছে। মন যেসব উপাদান আর উপাধানে সেজে উঠছে, তাতে এই মুহূর্তে নির্জন একটি ঘর পেলে ভাল হয়, একটি শয্যা থাকা চাই। বলশালী এক দৈত্যকে কোমর ধরে আটকাতে চাইছি। সে আমায় খানাখন্দের ওপর দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে।
ও হ্যাঁ, ওমলেট আর কফি।
ওয়েটার ধীরে ধীরে চলে গেলেন। টেবিলের ওপর ফেলে রাখা আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে মুকু বললে, তুমি বেশ সুন্দর হয়েছ।
তুমিও।
সে তোমার চোখে। আয়না কিন্তু অন্য কথা বলে।
একটু রোগা হয়ে সত্যিই তুমি সুন্দর হয়েছ। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না।
মুকু মাথা নিচু করল। কপালের সামনে থেকে মাথার পেছন অবধি সিঁথি চলে গেছে। স্বপ্ন দেখছি, আমি যেন রাজবেশে সিঁদুর পরাচ্ছি। দূর থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের শব্দ। রজনীগন্ধার সুবাস।
পাশের টেবিলে প্রৌঢ় দম্পতি মৃদু গলায় নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছেন। মাঝে মাঝেই কানে আসছে একটি অঞ্চলের নাম, আলমোড়া। স্বামী নির্মলানন্দ আমাকে আলমোড়া পাঠাতে চান। হিমালয়ের কাছাকাছি। আজ থেকে বেশি না, মাত্র তিরিশ বছর পরে আমি আর মুকু ওই আসনে বসতে পারি। সুখী আর সাত্ত্বিক চেহারা নিয়ে। এমন তো কিছু খারাপ নয়, বড় মধুর ভবিষ্যৎ!
মুকু মুখ তুলে তাকাল। মন যদি চোখে আসে, চোখের চেহারা কীরকম হয়? যেমন দেখছি এই মুহূর্তে। মুকু বললে, তোমাকে একটা ছবি দেখাব?
কার ছবি? তোমার?
না। দেখাতে পারি একটা শর্তে। রাগ করা চলবে না।
দেখাও।
দু’প্লেট ওমলেট টেবিলে এসে নামল। মুকু মাথা নিচু করে কোলের ওপর রাখা হাতব্যাগে। ছবি খুঁজছে। ডান হাতের দু’গাছা চুড়ি, সংসারের শব্দে ঠুনুর ঠুনুর করছে। বড় একান্ত, বড় আপন, ভীষণ মায়ায় ভরা। গরম ওমলেটের অল্প অল্প ধোঁয়া মুকুর কোকড়া কোকড়া কালো– চুলের কাছে পাক খাচ্ছে। ব্যাগ থেকে হলদে রঙের একটা খাম তুলে মুকু টেবিলে আলগোছে। রাখল। উদাস দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওমলেটের দিকে। তাকাবার মতোই ভাজা হয়েছে। কাঁচা সোনার রং ছাড়ছে।
কী আছে খামে?
খুলে দেখো।
খামটা খুলতেই হাফ সাইজের একটা ছবি বেরিয়ে এল। কনক! কনক আর সুদর্শন চেহারার এক যুবক পাশাপাশি। কাঁধে কাধ লেগে আছে। কতদিন পরে কনককে আবার দেখতে পেলুম! সেই উজ্জ্বল ধারালো মুখ। টানাটানা চোখ, বাঁশির মতো নাক।
ছেলেটি কে মুকু?
বুঝতে পারছ না?
কী? সেই?
হ্যাঁ সেই। আমার সন্দেহই ঠিক হল। সেই হোমচৌধুরী। যার কথা তোমাকে আমি চিঠিতে লিখেছিলুম।
বিয়ে হয়ে গেছে?
কী মনে হচ্ছে?
কনক তা হলে বেঁচে আছে?
বহাল তবিয়তে। আমার দিদি অত সহজে হার স্বীকার করার মেয়ে নয়।
কোথায় আছে?
জাহাজে।
তার মানে?
দিদির বর রেডিয়ো অফিসার। প্রচুর টাকা মাইনে। বিশ্ব-ঘোরা চাকরি। আজ এ বন্দরে, কাল ও বন্দরে। কী মজা! সারাপৃথিবী দেখে বেড়াবে।
কাদের জাহাজ?
পি. ও. লাইনার।
কত টাকা মাইনে মুকু?
দশ-বারো হাজার তো হবেই।
মাসে?
হ্যাঁ গো মাসে। পুরো মাইনেটাই সেভিংস, কারণ সবই তো ফ্রি।
ঈর্ষায় সারাশরীর জ্বলে উঠল। কী করলুম জীবনে? ইডিয়টের মতো কল্পবিলাসে জীবনটা নষ্ট করে ফেললুম। সময় চলে গেছে। আর নতুন করে সুরে বাঁধতে চাইলেও বাঁধা যাবে না। যে বীজ বুনেছি সেই ফসলই তুলতে হবে। কেউ ফলায় জাফরান, কেউ খেসারি। যার যেমন বরাত।
মুকু চামচে দিয়ে ওমলেট কাটছে। ডিশের সঙ্গে চামচে লেগে কড়াশ কড়াশ শব্দ হচ্ছে। আঁতে ঘা লাগছে। মুখ তুলে বলল, কী, মন খারাপ হয়ে গেল?
না না, মন খারাপ হবে কেন?
সত্যি বলো তো, দিদিকে তুমি ভালবেসেছিলে কি না?
ভালবাসা অনেক উচ্চস্তরের জিনিস। বেসেছিলুম কি না জানি না, তবে ভাল লেগেছিল। বিয়ের কথা ভাবিনি।
সে তুমি কোনও দিনই ভাবতে পারবে না। তুমি সপ্লিট পার্সোন্যালিটিতে ভুগছ। কেউ যদি তোমার দুটো সত্তাকে কোনওদিন জোর করে এক করে দিতে পারে, তবেই তুমি সুখী হবে। যে বোঝে সে বোঝে।
তার মানে?
তোমার মুখের কথা এক, তোমার মনের কথা আর এক। যে তোমার মুখের কথা শুনে চলে যাবে সে তোমার ওপর অবিচার করবে, তোমার ক্ষতি করবে। তোমাকে বাঁধতে হবে, যেমন করে মানুষ নদীকে বাঁধে।
আমার সন্ন্যাস, আমার পরমার্থ!
রাখো তোমার সন্ন্যাস, তোমার পরমার্থ। সন্ন্যাস কাকে বলে জানো?
অ্যাঁ!
সন্ন্যাস কাকে বলে জানো?
সন্ন্যাস মানে ত্যাগ।
কী ত্যাগ?
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য।
তা হলে মানুষের আর রইলটা কী? ধরো বাঘ যদি আলোচালের হবিষ্যি খায়, সিংহ যদি কলাপাতা চিবোয়, গন্ডার যদি জাবনা চিবোয়, তাতে বাঘত্ব, সিংহত্ব, গন্ডারত্ব বজায় থাকে?
তোমার ব্যাখ্যায় সন্ন্যাস তা হলে কী?
সৎ জীবন, কর্মময় জীবন।
পাশের টেবিলের সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আপনার রুমাল পড়ে গেছে।
নিচু হয়ে রুমালটা তুলছি, প্রৌঢ়া বললেন, তোমাকে চেনাচেনা লাগছে। তুমি কি স্বামী নির্মলানন্দের কাছে যাও?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ঠিক ধরেছি। মুকুকে দেখিয়ে বললেন, এ তোমার কে হয়?
উত্তর দিতে গিয়ে দু’বার ঢোক গিলতে হল, আমার বোন হয়।
বাঃ, বেশ মেয়েটি। কী পড়ছ মা?
মুকু মুখে ওমলেট তুলছিল, নামিয়ে রেখে বললে, এম এ।
ভদ্রমহিলা চোখের ভঙ্গি করে বললেন, তাই নাকি? বাঃ এত কম বয়েসে এম এ করছ? প্রৌঢ় মানুষটিকে বললেন, হ্যাঁগা, একবার তাকিয়ে দেখো, আমাদের সুজয়ের সঙ্গে ভারী সুন্দর মানাত, তাই না?
ভদ্রলোক সরাসরি মুকুর দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বলে হাসতে লাগলেন আপন মনে, তৃপ্ত মানুষের মতো। দাঁতগুলি বড় সুন্দর। মুক্তোর মতো সারি সারি বসানো। হাসি থামিয়ে ভদ্রলোক ঘড়ি দেখলেন। তাড়াতাড়ি আসন থেকে উঠে বললেন, চলো চলো, সময় হয়ে গেছে। এখুনি ট্রেন ইন করবে।
ভদ্রমহিলা মুকুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে মুকুর মাথায় হাত রেখে বললেন, পবিত্র হও, পবিত্র হও। আমাকে বললেন, একদিন তোমার বোনকে স্বামীজির ওখানে নিয়ে এসো।
দু’জনে আগে পরে বেরিয়ে গেলেন। মুকু ওমলেটের ডিশের পাশে টেবিলের ধারে মাথা ঠেকিয়ে ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। ঘাড়ের কাছে এলিয়ে-থাকা খোঁপা দুলে দুলে উঠছে। চওড়া পিঠে ব্লাউজের ভি-অংশ হাসির দমকে হুক ছেড়ে খুলে যাবার মতো হচ্ছে। মায়াবী মেয়ে, মায়াবী রাত, পাপীর চোখ।
ওয়েটার ভদ্রলোক দু’কাপ কফি এনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কোথায় রাখবেন? মহাসমস্যা। বোঝা মুশকিল, মুকু হাসছে না কাঁদছে। জলের গেলাসদুটো একপাশে সরিয়ে কাপদুটোর জায়গা করে দিলুম। ভদ্রলোক সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে, কফি রেখে চলে গেলেন।
মুকু মাথা তুলল। জিজ্ঞেস করলুম, হাসছ কেন?
গম্ভীর মুখে বললে, আমার বাজারটা একবার দেখলে?
কথা শেষ করেই আবার হাসতে লাগল। মেয়েদের এই এক দোষ। শুরু করতে জানে, শেষ করতে জানে না। হাসলে হাসি থামে না। কাদলে কান্না থামে না। এইভাবে ফুলেফুলে হাসলে, আর পাঁচজন কী ভাববেন!
হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলতে লাগল, ভদ্রমহিলা আমাকে ছেলের বউ ঠিক করে ফেলেছেন, আমি এদিকে আর একজনের বউ হব বলে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি।
কার?
টেবিলের ওপর দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে সরু সরু আঙুল তুলে খিলখিল হেসে বললে, তোমার, তোমার।
হাতের চারটে আঙুল সাপের ছোবলের মতো মুখের এখানে ওখানে লাগছে। হাতের চুড়ি দু’গাছা দুলছে, ঝিলিক মারছে। মুকু পরিবেশ ভুলে গেছে। চারপাশে এত লোকজন! পাগল হয়ে গেল নাকি? ফিসফিস করে বললুম, অ্যায় মুকু, কী হচ্ছে কী?
দু’হাত মাথার ওপর তুলে খোঁপা ঠিক করতে করতে বললে, কী গো সন্ন্যাসী! দেখি, কে হারে কে জেতে? উনি বলে গেলেন, পবিত্র হও। আমি যে অপবিত্র হবার জন্যেই এসেছি।
আবার হাসি।
মুকু প্লিজ। তোমাকে আমার ভয় করছে। ওরকম করছ কেন?
ভয় করছে? তুমি না পুরুষমানুষ? যে-মানুষ মাতৃগর্ভে জন্মেছে সে মানুষ কখনও পবিত্র হতে পারে না।
কী বলছ তুমি? ড্যামেজিং কথাবার্তা!
ভেবে দেখো। জীবনের সব মুহূর্ত একজায়গায় জড়ো করে করে, বেছে বেছে দেখো সাদা, কালো, হলদে, সবুজ। জীবন বহু বর্ণের মুহূর্তের মালা।
মুকু কফিতে চুমুক চালাল। ফুড়ুত করে পাখি উড়ে যাবার মতো শব্দ হল। চোখ মুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। ছোট্ট কপালের চারপাশে চুল ঝুলে পড়েছে। অসাধারণ দেখাচ্ছে। মানবীকে মনে হচ্ছে দেবী। মনের কী মতিভ্রম! একটু ভালবাসার কথা শুনেই কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা আমাকে ঠকাতে আসেনি তো?
প্রশ্ন করলুম, হঠাৎ এই উদ্ভট খেয়াল চাপল কেন, আমাকে বিয়ে করবে?
শুনবে তা হলে, তোমার জন্যে নয়, তোমার বাবার জন্যে।
সে আবার কী?
তোমার বাবাকে আমি ভালবাসি। অমন চরিত্র লাখে এক মেলে। উপায় থাকলে আমি তাকেই বিয়ে করতুম।
মুকুর কথা শুনে ঠোঁটের কাছে ধরে থাকা কাপ হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা বলে কী? সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি?