রমলা সেন চোখ ছোট করলেন, ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেল? তার মানে? দীপা বলল, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি রমলা সেন। আমার জীবনে ইনি প্ৰথম বড় হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কলেজে পড়ান। আর ইনি শমিত, স্কুলে পড়ান, কিন্তু আসল পরিচয় একটি শিক্ষিত নাটকের দলের পরিচালক। নাটক নিয়ে থাকেন, স্বপ্ন দ্যাখেন। নাটকই এঁর সব
রমলা সেন বললেন, ওমা, এমন নাটুকে লোকের সঙ্গে তোর আলাপ হল কি করে?
দীপা হেসে ফেলল, হয়ে গেল।
শমিত চুপচাপ শুনছিল, আপনারা দুজনেই একটু বাড়িয়ে বললেন।
রমলা সেন হোঁচট খেলেন, আমি আবার কি বাড়িয়ে বললাম!
সত্যি যদি নিজেকে নাটুকে ভাবতে পারতাম তাহলে খুশী হতাম। সেটা ভাবতে গেলে দিনরাত তাই নিয়ে ড়ুবে থাকতে হয়। আসলে নাটক এমন একটা শিল্প যা একক চেষ্টায় করা সম্ভব নয়। সহ-অভিনেতা থেকে শুরু করে আলো এমন কি যে উইংস টানবে তাকেও নাটকের লোক হতে হবে। ড়ুবে থাকলে সেসব চোখ মেলে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে না। যাঁরা লেখেন বা ছবি আঁকেন তাঁদের সেই সুযোগ আছে। শমিত হাসল।
রমলা সেন সোজা হয়ে বসলেন, এ ছেলে তো বলে ভাল। বাঃ, চমৎকার।
শমিত বলল, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা প্রশ্ন করব?
রমলা সেন নীরবে মাথা নাড়লেন।
শমিত বলল, সেদিন আপনাকে এক পলক দেখলেও আমার মনে হচ্ছে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে আপনার। সেদিন ওই রুমালটা নিশ্চয়ই মাথায় বাঁধেননি।
উঃ, এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার প্রাণ বেরিয়ে গেল!
আমি কিন্তু প্ৰথমেই বলেছি আপনি কিছু মনে করলে বলব না। বিব্রত হল শমিত।
দীপা শব্দ করে হেসে উঠল। গম্ভীর হয়ে গেলেন রমলা সেন। সঙ্গে সঙ্গে দীপা থেমে গেল। ওর মনে হল যেসব কথা উনি তাকে বলতে পেরেছেন তা নিশ্চয়ই শমিতকে শোনাতে চান না। রমলা সেন শমিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি মেয়েদের খুব খুঁটিয়ে দ্যাখো।
মেয়েদের বললে ঠিক বলা হবে না। আমি রাস্তা ঘাটে মানুষের চাল-চলুন চেহারা দেখি। নাটকের কোন চরিত্রের সঙ্গে মিল আছে এমন চেহারার মানুষ দেখলে আরও ভাল করে তাকে লক্ষ্য করি। এটা খুব কাজে লাগে।
তোমার নাটকে আমার মত কোন চরিত্র আছে নাকি!
না। তাই সেদিন ভাল করে দেখিনি।
রিয়েল ইনটেলিজেন্ট। ভাল লাগল। হ্যাঁ, সেদিন তুমি আমার মাথায় রুমাল দ্যাখোনি। কেন দেখনি বলতে পারব না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
দীপা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, হোস্টেলটা কোথায়?
বাগবাজারে। একটা সিট এ মাসের শেষে খালি হচ্ছে। আমি বলে রেখেছিলাম। তোমার দরখাস্ত কালকের মধ্যে জমা দিতে হবে।
টার্মস কি?
তেমন কিছু না।
আমি চাকরি করছি বলতে হবে তো?
না। আমি বলেছি তুমি কলেজে পড় আর প্রাইভেট টিউশনি কর। চাকুরি ঠিক আছে, ফাইন্যাল দিয়েই জয়েন করবে!
সেকি! এতো একদম মিথ্যে কথা।
মিথ্যে নয়। আমি যে স্কুলে পড়াই তার মর্নিং সেকসনে কিছুদিন পরেই ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে লোক নেবে। ইচ্ছে করলে তুমি করতে পার।
গ্রাজুয়েট না হয়েই।
প্রাইমারি সেকসনে অসুবিধে হবে না।
হোস্টেলে কত টাকা লাগবে?
মনে হয় এখানে যা দিচ্ছ তার থেকে বেশী নয়।
রমলা সেন চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলেন। এবার প্রশ্ন না করে পারলেন না, তোর এখানে কি অসুবিধে হচ্ছে। এখানে সবাই ছাত্রী, পড়াশুনার আরহাওয়া আছে—!
সবই ঠিক। মুশকিল হয় ছুটি পড়লে সবাই যে যার বাড়িতে চলে যায়। এমন কি ঠাকুর চাকরীও। তখন হোস্টেলে থাকা যায় না। তারপর পরীক্ষা হয়ে গেলে এই হোস্টেল ছাড়তে হবে। তখন কোথায় যাবো?
তুই বাড়িতে যাস না?
কোন বাড়ি?
আঃ, তোর বাবার বাড়ি।
বাবা মারা যাওয়ার পর যাওয়ার সম্পর্ক নেই।
সেকি? কেন?
অনেক গল্প। শোনাতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে।
সেদিন বলছিলি বটে তুই তোর গার্জেন কিন্তু আমি ব্যাপারটা ধরতে পারিনি। কি করে এমন হল? তোর মা কি চাননি যে তুই পড়াশুনা করিস?
বললাম তো আরও জটিল ব্যাপার। দীপা গম্ভীর হল।
শমিত জিজ্ঞাসা করল, আজ এ্যাপ্লিকেশনটা পেলে ভাল হত। যাওয়ার পথে জমা দিয়ে যেতাম। কাল আসতে পারব না।
তাহলে আমাকে ঠিকানাটা বলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।
কাকে?
মানে?
দিতে হবে সেক্রেটারির হাতে। ঠিক আছে, আমাকে একটা ভাল কাগজ এনে দাও, আমি লিখে দিচ্ছি, তুমি সই করে দেবে।
মাথা নেড়ে রমলা সেনকে আসছি বলে বেরিয়ে গেল দীপা। রমলা সেন বললেন, তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছ। বসো।
ধন্যবাদ। শমিত চেয়ার টেনে বসল।
তোমরা কি ধরনের নাটক করো?
সাধারণত অ্যাডাপ্টেশন।
কেন?
তাতে দর্শকরা ভাল বিদেশী নাটক সম্পর্কে ধারণা তৈরী করতে পারেন। আর আমরাও ভাল নাটকে কাজ করার সুযোগ পাই।
আমার মনে হচ্ছে দীপাকে তুমি খুব পছন্দ করো।
হ্যাঁ। ওর মধ্যে তেজী ভাব আছে যা আমি পছন্দ করি।
বাঃ, এভাবে উত্তর দিতে পারলে তুমি?
আপনি আমাকে প্রশ্ন যখন করতে পারলেন তখন উত্তর দিতে বাধা কি!
তুমি দীপাকে কতটুকু জানো?
এইসময় দীপা কাগজ নিয়ে ঢুকাল। ঢুকে বলল, আমার কথা কি বলা হচ্ছিল।
রমলা সেন বললেন, আমি ওকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তোকে কতটা জানে?
দীপা শমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, কি জবাব দেবেন?
শমিত হাসল, এখনও তো হিসাব করিনি। দিন কাগজটা। সে কাগজ নিয়ে ঝটপট লিখে ফেলল। লাইনগুলো। লিখে বলল, পড়ে সই করো।
ঠোঁট উল্টে দীপা চোখ বোলালো, তারপর সই করে দিল। কাগজটা নিয়ে শমিত উঠে দাঁড়াল, চলি, আপনারা কথা বলুন। আজ পুরো রিহার্সাল আছে। শমিত চলে গেল। ওর যাওয়া দেখলেন রমলা সেন। তারপর বললেন, বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। স্কুলে পড়ায় বলল, না?
হ্যাঁ। একটা কাজ করতে হয় বলে করছে।
হ্যাঁরে, তুই কি ওকে ভালবাসিস?
দীপা রমলা সেনকে এক মুহূর্ত দেখল। তারপর বলল, মাথায় আসেনি।
মানে?
ভালবাসার যেসব গন্ধ এতদিন পড়েছি তার নায়িকার মনের ভাব আমার কখনও হয়নি।
এ তুই ফাঁকিমারা কথা বললি।
সত্যি কথা কিন্তু। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও শমিতকে বন্ধু হিসেরে পছন্দ হয় আমার। মনে হয় ওর ওপর আস্থা রাখা যায়। হয়তো ওর বয়সী ছেলেদের তুলনায় ব্যক্তিত্ব বেশী বলেই এটা মনে হয়। কিন্তু ওর জন্যে আমার মনে কখনও তোলপাড় হয়নি। তাই তোমাকে কি করে বলব ওকে ভালবাসি! দীপা অকপটে বলল।
অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি এল। আগের চিঠির বক্তব্যে যদি কোন অসঙ্গত্তি থাকে তাহলে দীপা যেন তাকে মার্জনা করে। সেই সঙ্গে জানানো, যদি এ ব্যাপারে দীপা মনে করে তার কোন সাহায্য প্রয়োজন তাহলে তা সে করতে প্ৰস্তুত। চিঠি পড়ে দীপার ভাল লাগল। সে চিঠি লিখে জানাল, সুভাষচন্দ্ৰ যেসব কাগজপত্র উদ্ধার করেছেন তাতে তাঁর হিসেব অনুযায়ী বারো লক্ষ টাকা হবে। বাস্তবে এই অংক কম বা বেশী হতে পারে। এখন কোন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে দান করতে হলে প্ৰথমে দান করার অধিকার তাকে অর্জন করতে হবে। যেহেতু এই কাজ জলপাইগুড়ির আদালত বা সরকারি অফিসেই করতে হবে তাই যদি অমলকুমার সাহায্য করেন তাহলে সে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। চিঠির উত্তর কলেজ হোস্টেলের ঠিকানায় না দিয়ে নতুন ঠিকানায় যেন দেওয়া হয়। দীপা ওয়ার্কিং দুৰ্গা মৌলের ঠিকানটা জানিয়ে লিখল সামনের মাসের এক তারিখে সে ওই ঠিকানায় উঠে যাচ্ছে।
কিন্তু ওই চিঠির উত্তর এত তাড়াতাড়ি এল যে নতুন ঠিকানার প্রয়োজন হল না। চিঠিতে অমলকুমার লিখেছে যে সে জলপাইগুড়ির প্রোথিতযশা উকিল জীবনগতি রায় মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। রায় মহাশয় খুব বড় মাপের মানুষ। সব শুনে বলছেন এমন একটা কাজ যে মেয়ে করতে পারে তাকে তিনি একটি পয়সা পারিশ্রমিক না নিয়ে সাহায্য করবেন। কিন্তু এসব করতে হলে দীপাকে দিন কয়েক জলপাইগুড়িতে থাকতে হবে আইনগত কারণে। দীপা যত তাড়াতাড়ি আসতে পারে তত ভাল হয়।
দীপা ঝুঁকি নিল। সুভাষচন্দ্রের দেওয়া সমস্ত কাগজ সে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিল অমলকুমারের নামে। সেই সঙ্গে জানাল সামনের মাসের শেষ দিকে সে যেতে পারবে। কারণ তার তখন দুটি থাকবে। সমস্যা হল জলপাইগুড়ি শহরে কোন থাকার জায়গা নেই। সেখানকার হোটেলের ব্যবস্থা কিরকম অথবা তারা একা মেয়েকে থাকতে দেয়। কিনা তাও জানে না। অতএর একটা নিশ্চয়ই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
কলেজ হোস্টেল ছেড়ে সে যখন ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে এল তখন শমিত আর মায়া সঙ্গে ছিল। এখানকার বেশীর ভাগ মেয়েই শিক্ষিতা। দুচারজন অফিসে কাজ করে। তাদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের মেলামেশা কম। শমিতের ভেতরে ঢোকা নিষেধ, মায়া ওকে ঘরে পৌঁছে দিল। দীপার রুমমেট এক মধ্যবয়সী মহিলা। আর জি কর হসপিট্যালে নার্সের চাকরি করেন। যেমন কালো তেমন ভারী শরীর। দিনটা ছিল রবিবার। মহিলা নিজের খাটে বসে টেবিলে আয়না রেখে সন্না দিয়ে পাকা চুল তুলছিলেন। ওরা ঢুকতেই হাতের আড়ালে সন্না লুকিয়ে জিনিসপত্র নামাতে দেখলেন। ঘরে ঢোকার আগে দীপা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে টাকা পয়সা জমা দিয়ে এসেছিল। মহিলা আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জেলা?
মায়া জবাব দিল, জলপাইগুড়ি। আপনি এঘরে থাকেন বুঝি?
হ্যাঁ, এটা আমারই ঘর। কত রুমমেট এল গেল। আমি কিন্তু রয়েই গেছি। এই হোস্টেলে যে কেউ দেবিকার ঘর বললে এই ঘরাটাই দেখিয়ে দেবে।
মায়া হাসল, তাহলে তো আমার বন্ধু এখানে আপনার সঙ্গে ভালই থাকবে।
দেবিকা বললেন, ও, তুমি থাকবে ভাই?
দীপা বেশ চটে গেল। একে কথায় মাতকবরীর ভাব স্পষ্ট তার ওপর সরাসরি তুমি বলা তার মোটেই পছন্দ নয়। বয়সে বড় হলেও জিজ্ঞাসা করে তুমি বলা উচিত। সে জবাব দিল না। মায়া ওকে বিছানা পাততে সাহায্য করল। সেটা দেখতে দেখতে দেবিকা জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ে থা হয়ে গেছে না হয়নি!
মায়া জবাব দিল, ওমা, আপনি চোখে দেখে বুঝতে পারেন না?
চোখে দেখে? সেদিন চলে গিয়েছে। হাসপাতালে চাকরি করছি। যা সব কেস দেখছি রোজ মাথা ঘুরে যাচ্ছে। মাথায় সিঁদুর দিয়ে খালাস করতে এল, স্বামীর নাম দেখালো। স্বামী দেবতাটিকেও দেখলাম। অল্প বয়স দুজনের। বাচ্চা হল সন্ধেবেলায়, ভোর বেলায় মায়ের পাত্তা নেই। খোঁজ খোঁজ। বেড খালি, কোথাও পাওয়া গেল না। পুলিশে খবর গেল। তারা খবর নিয়ে বলল ঠিকানাটা মিথ্যে। ওই নামে কেউ থাকে না। বাচ্চাটার কি হবে? তা এক দারোয়ানের বউ চেয়ে নিল, তার বাচ্চা হচ্ছে না। দশ বছর। তবে?
দীপা মায়ার দিকে তাকল, কোন কথা বাড়াচ্ছিস?
মায়া আবার হাসল, তাহলে আজ চলি। নিচে শমিত দাঁড়িয়ে আছে। কাল কলেজে দেখা হবে। বলে দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে বলল, আমার বন্ধু খুব গভীর, কম কথা বলে, আপনিও বেশী কথা বলবেন না। বলে বেরিয়ে গেল।
দীপা অনেক কষ্টে হাসি চাপল। সে দেবিকার দিকে পেছন ফিরে বালিস ঠিক করল। টুকিটাকি কাজ। সারল। দেবিকা বিছানায় বসে চুপচাপ ওকে দেখছিলেন এবার নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তো ভাই তোমাকে অন্য ঘরে যেতে হবে।
কেন? ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল দীপা।
আমি তো কথা না বলে থাকতে পারি না। মাথা নাড়লেন তিনি।
ঠিক আছে, আপনি কথা বলবেন। দীপা একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
তাহলে ঠিক আছে। হ্যাঁ, যেকথা বলছিলাম, দেখে মনে হয় বিয়ে থা। হয়নি। বিপদ বল ভয় বল এখানেই। মা বাবা সম্বন্ধ করছে না তো?
দীপা কথা বলল না। দেবিকা বললেন, করবে না। মেয়ে চাকরি করলে কোন মা বাপ চায় না তাকে খরচ করে বিয়ে দিই। যে গরু দুধ দেয় তাকে কেউ বিক্ৰী করতে চায়? আর এই করতে করতে দেখবে একসময় তোমার আমার মত বয়স হয়ে যাবে, আর তখন বিয়ে হবে না। আমি তো এর আগের দুই রুমমেটকে বলে বলে বিয়ে করালাম।
কথা না বলে পারল না। দীপা, আপনার খুব বিয়ের শখ ছিল বুঝি?
খুউব। সেই ছেলেবেলায় যখন রান্নাবাটি খেলতাম তখন থেকে। সময়ে কেউ বিয়ে দিল না। দুবার যে নিজে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু ডাক্তার বল আর রুগী বল, হাসপাতালে ঢুকলে কত মিষ্টি কথা, হাসপাতালের বাইরে চোখ উল্টে দেয়। তাই বলছিলাম, বিপদ বল, ভয় বল, এখানেই। দেবিকা গলা নামালেন, কোথায় চাকরি কর?
করি না, করব। স্কুলে।
অ। আমার এক পেশেন্ট ছিল স্কুলের মাস্টারনি। অমন খেঁকুড়ে মেয়েমানুষ আমি বাবা জীবনে দেখিনি। যেমন রোগা তেমনি খেঁকুড়ে। রোজ বিকেলে আয়না বের করে বেডে বসে পাউডার মাখত। এক রাত্রে আমায় বলে কিনা, জানান দিয়ে তবে রাত্রে আসবেন নইলে অন্ধকারে আপনাকে বোঝা যায় না। কি আম্পদ্দ!
দীপা হাসি চাপল। হঠাৎ দেবিকা লাফিয়ে উঠলেন, ওরে বাবারে। কথা বলতে বলতে কি দেরি না হয়ে গেল। আমার ডিউটির সময় হয়ে গেছে। আজ আবার নার্সিং সুপার দাঁত দেখাবে। দীপা মুখ ফিরিয়ে চোখ বই-তে রাখল। মহিলা এই ঘরেই জামাকাপড় পরিবর্তন করছেন। দীপা যে রয়েছে তা যেন খেয়ালেই নেই। পোশাক পাল্টে চুল আঁচড়ে দেবিকা বললেন, কাল সকালে আবার দেখা হবে। কি যেন নাম তোমার? নাম না জানলে কথা বলা যায় নাকি!
দীপাবলি।
আমি ওই বলী টলি বলতে পারব না। শোন দীপু, আমি চলে যাচ্ছি, আজ রাত্ৰে তুমি আমার মাছটা খেয়ে নিও। চেয়ে খেও নইলে ঠাকুর দেবে না।
আপনি রাত্রে ফিরবেন না?
না। নাইট ডিউটি। নাইট ডিউটি নিই কেন বলতো? রাত দশটার পর পাঁচটা পর্যন্ত টানা ঘুম। এদিকে সারাদিনেও বিশ্রাম। রাতে হাসপাতালে কপাল খারাপ না হলে কোন ঝামেলা থাকে না তো। চলি। দুদ্দাড় করে ঘরের বাইরে চলে গিয়েও ফিরে এলেন তিনি। মুখ ঢুকিয়ে বললেন, মাছটা মনে করে খেয়ো। টাকা যখন রিফান্ড দেবে না। তখন মাছটা আর ছাড়ব কেন? রোজ ছাড়ি, আজ টাইট। শব্দ তুলে চলে গেলেন দেবিকা। দীপা উঠে বসল। অদ্ভুত মহিলা। এতক্ষণ ওর ওপর তার বেশ রাগ হচ্ছিল। নিজের বা অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু থাকতে পারে তা এই ধরনের মহিলা ভাবতেও পারেন না। কানের পোকা বের করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। আবার মাছ খেতে বলে যাওয়াটা ওঁর ছবিটাকে পাল্টে দিল। সে ওইভাবে চেয়ে মাছ খেতে আগ্রহী নয়। কিন্তু ওই বলার মধ্যে সহজ মন ছিল, এটাও ঠিক।
নতুন হোস্টেলে অসুবিধে হচ্ছে না। দীপার একমাত্র দেবিকাদেবীর কথার তুবড়ি ছাড়া। কলেজ হোস্টেলের সঙ্গে এখানকার একটা বড় তফাৎ বাসিন্দাদের বয়স হয়েছে। সেই কারণে হাঁটা চলায় ব্যবহারে একটা ভারি ব্যাপার আছে। দুদলের আলোচনার বিষয়ও আলাদা। বড়রা অনেকেই মোহ করে দলে টানতে চাইছেন। এদের মধ্যে যেমন অবিবাহিতার সংখ্য বেশী তেমনি স্বামী পরিত্যক্ত অথবা অর্থের কারণে স্বামীসংসার ছেড়ে আসা মহিলাও আছেন। সমস্ত পশ্চিমবাংলায় এঁদের সংখ্যা যদিও হাতে গোনা যায় যাঁরা নিজের উপার্জন করে দাঁড়িয়ে আছেন তবু কথা বললে এঁদের হা হুতাশ বুঝতে অসুবিধে হয় না।
পরীক্ষার জন্যে তিনমাসের ছুটি আরম্ভ হতেই অমলকুমারের চিঠি এল জলপাইগুড়ি থেকে নতুন ঠিকানায়। অমলকুমার জানিয়েছে, জলপাইগুড়ির হোস্টেলে কোন মহিলা সাধারণত একা থাকেন না। হোটেল দুটি খুব উঁচু মানেরও নয়। তাছাড়া জলপাইগুড়িতে এসে হোস্টেলে ওঠার কথা না ভাবলেই ভাল হয়। পুরোনো আত্মীয়তার কথা যদি না তোলা হয় তাহলে যে মন নিয়ে চিঠি জবাব দীপা দিয়েছে সেই মনেই রায়কতাপাড়ায় অমলকুমারের বাড়িতে সে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে অমলকুমারের মায়ের কোন আপত্তি নেই। অমলকুমার উকিলবাবুকে সমস্যাটা জানিয়েছিল। তিনিও বলেছেন, থাকার জায়গার কোন অভাব হবে না। তাঁর বাড়িতেও বহু জায়গা আছে। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-শিল্পপতি শ্ৰীযুক্ত বীরেন ঘোষ তাদের পাড়ার লোক। ঘোষমহাশয়ের একটি ভাল গেস্ট হাউস আছে। উকিলবাবু তাঁর সঙ্গে কথা বলে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। পত্রপাঠ করে আসছে জানালে অমলকুমার স্টেশনে অপেক্ষা করবে।
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে শমিতের রিহার্সাল রুমে গোল দীপা। গিয়ে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাড়ার একটি ছেলে বলল, রিহার্সাল পার্টিদের খুঁজছেন? পারেন না। বাড়িওয়ালা ঘর বন্ধ করে দিয়েছে।
সেকি? কেন?
ভাড়া দিতে পারেনি, তাই।
কতদিন এমন হল?
দিন চারেক। তবে ওদের সামনের পার্কে পারেন।
পার্কে?
হ্যাঁ। ওখানে কালকেও রিহার্সাল দিয়েছে জানি।
পার্কে নাটকের রিহার্সাল দেওয়া যায় স্বপ্নেও ভাবেনি দীপা। বেশ কৌতূহলী হয়ে সে ছেলেটির দেখানো পথ দিয়ে পার্কে এল। তখন সন্ধে হব হব। আলো জ্বলে গিয়েছে। পার্কের মাঝখানে অন্ধকার। এদিকে বৃদ্ধ এবং মাঝবয়সীরা আড্ডা মারছে আলোর তলায়। ঘুরতে ঘুরতে এক কোণে সুদীপ এবং আরও চারটি ছেলেকে দেখতে পেল। বেঞ্চি দখল করে তারা বসে আছে। তাকে দেখে সুদীপ বলল, আরে, কি ব্যাপার?
এখানে রিহার্সাল হচ্ছে শুনলাম।
হ্যাঁ। চার মাস ঘর ভাড়া দিতে পারিনি বলে বাড়িওয়ালা বের করে দিয়েছে।
চার মাস? কত ভাড়া ছিল?
পনের টাকা করে, যাট টাকা।
ষাটি টাকা। দেননি কেন?
কত লস হচ্ছে এক একটা শো করে জানা আছে?
দীপার মুখে এসেছিল লসই যখন হচ্ছে তখন নাটক করছেন কেন? কিন্তু সে কিছুই বলল না। সুদীপ হাসল, এই পার্কে রিহার্সালের আইডিয়া খারাপ না। ওপেন এয়ারে অভিনয় করলে গলা ভাল হয়, গরমে কম ঘামতে হয়। শুধু বৃষ্টি নামলে প্ৰব্লেম।
দীপা জানতে চাইল, ষাটি টাকা পেলে বাড়িওয়ালা ঘর খুলে দেবেন?
জানিনা দেবে কিনা। খুব রাগারাগি হয়ে গেছে। কিন্তু–।
আপনি আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
আপনাদের আগের রিহার্সাল রুমে। কাল টিউশনির টাকা পেয়েছি। এখন দিয়ে দিচ্ছি। পরে আপনারা আমাকে শোধ করে দেবেন।
অসম্ভব।
মানে?
শমিত আমাকে শেষ করে ফেলবে। ও গিয়েছে এক জায়গায় টাকা জোগাড় করতে। ও ফিরে না আসা পর্যন্ত-, ওই যে, এসে গিয়েছে। সুদীপের দৃষ্টি অনুসরণ করে দীপা দেখল। শমিত আরও দুটো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে। সঙ্গে মায়াও আছে। দীপার খেয়াল হল মায়া তাকে এ ব্যাপারে কোন কথা বলেনি। তাকে দেখে শমিত খুবই সাধারণ গলায় বলল, কতক্ষণ?
একটু আগে। দীপা কথা দুটো বলে মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসল।
এদিকে শমিত গলা তুলেছে ততক্ষণে, বন্ধুগণ। একটা সুখবর আছে। আমরা আমাদের ঘর ফিরে পাচ্ছি। এই যে চাবি ফিরে পেয়েছি। সে চাবি দেখাল।
সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি করে হল ব্যাপারটা?
বাড়িওয়ালার স্ত্রীর জন্যে। আমি তো মাঝেমধ্যে মাসীমা বলে জল চেয়ে খেয়েছি। স্বামী আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন শুনে উনি তাঁকে খুব তিরস্কার করেছেন। আর তাই স্বামীর মনে হয়েছে কাজটা ঠিক হয়নি। হয়তো পাড়ায় রটে গিয়েছে যে তিনি যেহেতু আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন তাই আমরা পার্কে রিহার্সাল দিচ্ছি। এতে পাড়ার পাঁচজনের কাছে উনি বোধহয় ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন। যাহোক, ওসবে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি বাড়িওয়ালাকে কথা দিয়েছি। এখন থেকে নিয়মিত ভাড়া দেবই আর বকেয়াটা প্ৰতি কল শো পিছু এক মাসের করে দেব।
শমিতের কথা শেষ হওয়ামাত্ৰ হাততালি পড়ল। সুদীপ বলল, বাঁচা গেল। তাহলে কি আজ রিহার্সাল এখানে হবে?
সবাই এসেছে? শিমিত জানতে চাইল।
না, এখনও আসেনি। আমি বলি কি এখন ঘরে ফিরে যাওয়া যাক।
সুদীপ প্ৰস্তাব দিতে সবাই তাকে সমর্থন করল। দল যখন ঘরে ফিরছে তখন শমিত দীপাকে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?
আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
কোন অসুবিধে হয়েছে?
না। কিন্তু এত ব্যাপার ঘটল আমাকে বলেননি কেন?
শুনলে কি করতেন?
কিছু একটা সাধ্যমত চেষ্টা করতাম।
তুমি যদি আমাদের দলের একজন হতে তাহলে নিশ্চয়ই বলতাম।
ও। দীপা চুপচাপ হোটল। মায়া সুদীপের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগে আগে যাচ্ছে। দীপা বলল, এসেছিলাম। কারণ আমাকে জলপাইগুড়িতে যেতে হচ্ছে।
কেন?
ওখানকার সব সম্পত্তি, যা আমার নয়, অথচ আমার বলে সবার ধারণা তা আইনসঙ্গত করে কোন দাতব্য প্ৰতিষ্ঠানকে দান করে দিতে যাচ্ছি।
যদি আইনসঙ্গত হবার পরে দানের ইচ্ছেটা চলে যায়?
আপনি আমাকে এখনও চেনেননি।
হুম। করে যাওয়া হচ্ছে।
আগামীকাল।
ওখানে থাকার ব্যবস্থা?
হয়ে যাবে।
আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? সঙ্গে গেলে কাজ হবে?
না। হঠাৎ চাপা চিৎকার করে উঠল দীপা।
কি হল? অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল শমিত।
সঙ্গে সঙ্গে ধাতস্থ হল দীপা। এবং সেই সঙ্গে লজ্জা পেল। বলল, সরি।
শমিত অদ্ভুত চোখে তাকাল। দীপা বলল, আমি চলি।
তাহলে এলে কেন?
আপনাকে জানাতে?
চল ঘরে গিয়ে বসবে।
অসম্ভব।
কেন?
আমি দলের একজন নাই। দীপা উল্টো রাস্তা ধরল।
নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস। জলপাইগুড়িতে যায় না। কিন্তু একটা লোক্যাল ট্রেন পেয়ে গেল সে শিলিগুড়ি থেকে সেটা হলদিবাড়ি যাবে জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে। ট্রেনে আসতে আসতে কেবলই মনে হয়েছে অসীমের কথা। শমিত সঙ্গে আসতে চাওয়ামাত্র সে যেভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল তার জন্যে কোন প্ৰস্তুতি ছিল না। অসীম যা করেছিল তা শমিতকে করতে দিতে চায় না সে।
আসার আগে সময় ছিল না। অমলকুমারকে চিঠি দিলে সেটা এখানে পৌঁছানো হত না তার আসার আগে। চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে বেলাকোবা পার হওয়ামাত্র চিন্তা শুরু হল। কোথায় উঠবে। কোন ব্যবস্থাই নেই। কি করা যায়? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি মারল। বেলা দশটা নাগাদ স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে সে সোজা কলেজের হোস্টেটলে চলে এল। রিকশা থেকে নামমাত্র দারোয়ান তাকে দেখল। দেখে চিনতে পারল। তার মুখে হাসি ফুটল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, বড়দি আছেন? দারোয়ান মাথা নেড়ে হাঁ বলতে তাকে স্যুটকেসটা দেখতে বলে সে ভেতরে ঢুকাল।
বড়দি তাকে দেখে অবাক হলেন। সব কিছু জানার পর বললেন সে স্বচ্ছন্দে দিন পাঁচেক হোস্টেলের গেস্টরুমে থাকতে পারে। খাওয়া-দাওয়া এখানেই। পাঁচ দিনের জন্যে গেস্ট ফি। বাবদ পনের টাকা দিতে হবে। টাকার পরিমাণটা শুনেই মনে পড়ল তার শমিতদের কথা। ওরা এই টাকাটা দিতে পারলে লিজায় পড়ত না।
রিকশা নিয়ে দুপুরের পরে সে রায়কতপাড়ায় এল দিনবাজার ঘুরে। করলা নদীটা দেখে মনটা ভারী হয়ে গেল। রায়কতপাড়ায় ঢুকে অমলকুমারের নাম বললে কেউ চিনতে পারছিল না। দীপা ইচ্ছে করেই অমলকুমারের বাবার নাম বলছিল না। শেষ পর্যন্ত সে জীবনগতি রায় মশাই-এর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানল তিনি এখন আদালতে। বাড়িতে ফিরে চেম্বারে বসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে অমলকুমারের খবর পাওয়া গেল। উমাগতি স্কুলের পাশেই ওদের বাড়ি। একটুও ইতস্তত না করে সে অমলকুমারের বাড়িতে এল। রাস্তার ধারে টিনের দরজা। দরজাটি ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে চওড়া পরিষ্কার উঠেন। এক বয়স্কা বিধবা মহিলা উঠোনে মোড়া পেতে রোদুরে চুল শুকোতে শুকোতে বই পড়ছেন। শব্দ শুনে অবাক চোখে তাকালেন। দীপা এগিয়ে গেল, অমলবাবু আছেন?
না। ও বাড়িতে নেই। ময়নাগুঁড়ি গিয়েছে। বিকেলে ফিরবে।
ও, আচ্ছা। আপনি?
আমি ওর মা। ভদ্রমহিলা বলতে বলতে চেনার চেষ্টা করছিলেন। একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, তুমি নিশ্চয়ই দীপাবলী?
হ্যাঁ।
ওমা, কখন এসেছে? তোমার তো সোজা আমাদের বাড়িতে ওঠার কথা।
না, ঠিক সেরকম কথা হয়নি। দীপার ভাল লাগল। মহিলার বলার ধরন, আমি আমার পুরোনো হোস্টেলে উঠেছি।
কেন? আমার কুঁড়েঘর কি খুব খারাপ। অন্যায় করেছ।
আমি তো আপনাকে আগে চিনতাম না।
তা ঠিক। প্রৌঢ়া মাথা নাড়লেন, তা অবশ্য বলতে পার। এসে ভেতরে এসে কখন এলে? আজ সকালের ট্ৰেনে?
হ্যাঁ। দীপা ওঁকে অনুসরণ করল।
এক ঘণ্টা ধরে বারান্দায় পাশাপাশি বসে অনেক কথা হল। ভদ্রমহিলা একবারও ভুলেও প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর পরবার সংক্রান্ত কোন কথা বললেন না। তিনি শুধু দীপার কলকাতার জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। সেসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। একসময় জলখাবারের কথা উঠতে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি মিষ্টি খাও তো?
দীপা হাত নাড়ল, না মাসীমা, মিষ্টিতে আমার আপত্তি আছে।
চা এল, সঙ্গে বিস্কুট আর ডিমের ওমলেট। ডিম দেখে দীপা মহিলার দিকে তাকাল একবার প্রতুলবাবুর দাদার স্ত্রী ইনি। সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা বাড়ল।
পাঁচটার কিছু বাদে অমলকুমার ফিরল। লম্বা, সুগঠিত বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চোখ দুটো আলাদা ধরনের। গভীর। মাসীমা জিজ্ঞাসা করল, বল তো এ কে?
অমলকুমার ভাবতে চাইল। কিন্তু দীপা সুযোগ দিল না, আমি দীপা।
আরে! আপনি? কখন এলেন?
ও আজ সকালে এসে পুরোনো হোস্টেলে উঠেছে। মাসীমা বললেন।
সে কি! মা তো আপনাকে এখানেই রাখতে চেয়েছিল।
মাসীমা মাথা নাড়লেন, না, থাক। এ নিয়ে জোর করিস না। তুই বরং ওকে একবার জীবনগতিবাবুর বাড়িতে নিয়ে যা। যে কাজের জন্যে এসেছে সেটাই আগে করা দরকার।
টিনের দরজা পেরিয়ে দীপা বলল, আপনি খেটেখুটে এলেন, জিরোবার সময় পেলেন না। খারাপ লাগছে খুব।
একদম খাটিনি। ময়নাগুঁড়িতে গিয়েছিলাম ব্যবসার কাজে। কাজ হয়নি।
আপনি ব্যবসা করেন?
হ্যাঁ।
জীবনগতি রায় মহাশয় অত্যন্ত সজন লোক দীপার। এই ভাবনার প্রচুর প্রশংসা করলেন। খুব কম মানুষ পৃথিবীতে আছে যারা এমন কাজ করতে পারে। আগামীকাল তাকে এগারটার সময় কোর্টে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। দিন চারেকের মধ্যে যাতে সব হয়ে যায় তার চেষ্টা করবেন। সেখান থেকে বেরিয়ে দীপা বলল, একটা রিকশা ডেকে দেবেন?
আমাদের বাড়িতে যাবেন না আজ?
সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। কাল না হয় যাওয়া যাবে।
চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি বউঠান।
শুনুন। আপনাকে একটা অনুরোধ করব?
নিশ্চয়ই।
আমায় দীপা বলে ডাকরেন।
অমলকুমার মুখ তুলে তাকাল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আমি আজ পর্যন্ত আপনার বয়সী কোনো সদ্যপরিচিত মহিলাকে নাম ধরে ডাকিনি।
ডাকতে আপত্তি আছে?
না। তবে সেক্ষেত্রে আমাকে অমল বলতে হবে।
বেশ। তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।
আমি আমৃত্যু এর মর্যাদা রাখব। অমলকুমার হাত তুলে রিকশা ডাকল।