1 of 3

১.৪৭ আগের দিনই খবর দিয়ে

আগের দিনই খবর দিয়ে রেখেছিলেন, বেলা একটার সময় ত্রিদিব গাড়ি নিয়ে এসে তুলে নিলেন মমতাদের। এক গাড়িতে আটজন, তাও তো সুপ্রীতি কিছুতেই আসতে চাইলেন না; ত্রিদিব অবশ্য বারবার সুপ্রীতিকে বলেছিলেন, ওর মধ্যেই কোনো রকমে জায়গা হয়ে যাবে। প্রতাপও শেষ মুহূর্তে থেকে যেতে চাইছিলেন, ত্রিদিব প্রায় জোর করেই প্রতাপকে নিজের পাশে। বসালেন। মুন্নিকে বসতে হলো মায়ের কোলে, বাবলু কিছুতেই কারুর কোলে বসবে না, উপরন্তু তাকে জানলার ধার ছেড়ে দিতে হবে। ইডেন গার্ডেনে বিরাট মেলা ও প্রদর্শনী হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবার্ষিকী উপলক্ষে, ত্রিদিব সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে।

গাড়ি চলার পর দেখা গেল, খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না, সবাই মোটামুটি সেট করে গেছে, তখন প্রতাপ বললেন, তা হলে দিদিকেও নিয়ে গেলে হত না? আর একজনও ঠিক এঁটে যাবে। দিদি একলা একলা বাড়িতে পড়ে থাকবে?

ত্রিদিব বললেন, হ্যাঁ, জায়গা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু উনি যে আসতে চাইছেন না।

প্রতাপ সুলেখাকে বললেন, সুলেখা তুমি গিয়ে একটু বলো। তোমার কথা দিদি ঠেলতে পারবেন না।

আবার গাড়ি ব্যাক করে আনা হলো। সুলেখার সঙ্গে মমতাও উঠে গেলেন ওপরে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সুপ্রীতিকে নিয়ে এলেন। সুপ্রীতি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, আমি বুড়ি হয়ে গেছি, আমার কী আর ওসব দেখার বয়েস আছে! আমায় নিয়ে টানাটানি কেন।

ত্রিদিব বললেন, দিদি, আপনি মোটেই বুড়ি হননি। আপনি না গেলে আমাদের সবারই খুব খারাপ লাগতো।

সুপ্রীতি ওঠার ফলে তুতুলের পাশে বসা পিকলুকে সে জায়গা ছেড়ে নেমে গিয়ে বসতে হলো সামনের সীটে।

প্রতাপ ঘাড় ঘুরিয়ে সুলেখাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করে দিদিকে এত তাড়াতাড়ি রাজি করালে?

সুলেখা মিষ্টি হেসে বললেন, খুব সোজা। গিয়ে বললুম, আপনি না গেলে আমরা দু’জনেও যাবো না!

সুপ্রীতি সঙ্কুচিত হয়ে যতদূর কম জায়গা নিয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বললেন, একসঙ্গে এত লোক একটা গাড়িতে উঠলে পুলিসে ধরে না?

ছেলেমেয়েরা সবাই হেসে উঠলো।

প্রতাপ বললেন, দিদি, তোমার মনে নেই, একবার অসিতদার গাড়িতে আমরা কতজন মিলে দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিলাম? বাবা-মা এসেছিলেন সেবার…

ছেলেমেয়েরা পুরানো কথায় আগ্রহী নয়। বাবলু জিজ্ঞেস করলো, দাদা, ইডেন গার্ডেন মানে স্বর্গের বাগান, তাই না?

পিকলু বললো, হ্যাঁ, সেখানে আদম আর ইভ থাকতো। সেখানে শয়তান ইভকে জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাইয়েছিল।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, শয়তান স্বর্গের বাগানে গেল কী করে? শয়তানের তো নরকে থাকার কথা।

পিকলু বললো, এ ক্রিশ্চিয়ানদের শয়তান। আমাদের তো এই রকম কোনো শয়তান নেই। অরিজিন্যাল সিন-এর ব্যাপারটাও আমাদের নেই।

বাবলু বললো, জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাইয়ে শয়তান তো ভালোই করেছিল। না হলে মেয়েরা চিরকাল বোকা থেকে যেত!

মুন্নি বললো, আমি ঐখানে গিয়ে গেয়ান বিরিক্ষের ফল খাবো!

এবারে বড়রাও হেসে উঠলো, বাবলু তার ছোট বোনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে বললো, দূর পাগলি! এই ইডেন সেই ইডেন নয়! আমরা কি স্বর্গে যাচ্ছি নাকি?

প্ৰতাপ বললেন, আমাদের ছেলেবেলায় ইডেন গার্ডেন খুব সুন্দর, সাজানো জায়গা ছিল। ৩ সাহেব-মেম যেত, প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা গোরাদের ব্যাণ্ড বাজতো। বর্মা থেকে একটা তো প্যাগোডা তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এর মধ্যে। এখন কী অবস্থা কে জানে, অনেকদিন তো যাই নি!

ত্রিদিব বললেন, এখনও বেশ ভালো আছে। মজুমদার সাহেব, সিগারেট আছে নাকি, দিন তো একটা খাই।

ত্রিদিব স্টিয়ারিং-এর ওপর এক হাত রেখে সিগারেট ধরালেন। বাবলু মুগ্ধভাবে চেয়ে রইলো সেদিকে। তার মামাবাবু এক হাতে গাড়ি চালাতে পারেন! সে নিজে দু হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতে শিখেছে, বড় হয়ে সে দু হাত ছেড়ে মটরগাড়ি চালাবে!

সেন্ট্রাল এভিনিউতে কিসের যেন একটা মিছিল, দারুণ জ্যাম হয়ে আছে, গাড়ি এগোতেই চাইছে না। ছোটদের আর ধৈর্য থাকছে না। সুলেখার কথা মতন ত্রিদিব ডান দিকে গিরীশ পার্কের পাশ দিয়ে বেঁকে মশলাপট্টি ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে এসে পড়লেন। অদূরে হাওড়া ব্রীজ দেখেই বাবলুর বুকটা ধক করে উঠলো। দুপুরের রোদে ঝকমক করছে যেন একটা রূপোলি পাহাড়। ঐ পাহাড়ের চূড়ায় আছে সুদূরের হাতছানি।

মহিলা তিনজন গঙ্গানদী দেখে প্রণাম করলেন হাত তুলে। সুপ্রীতি বললেন, এইবার একবার দেওঘর যাবো, কতদিন মাকে দেখি না। আমরা এই যে মেলা দেখতে যাচ্ছি, মা এই সব দেখলে কত খুশী হয়, একেবারে ছেলেমানুষের মতন এটা কিনতে চায়, ওটা কিনতে চায়..

মা যে ইদানীং কত বদলে গেছেন, তা সুপ্রীতি বা মমতারা জানেন না। প্রতাপ কিছু বললেন, চুপ করে রইলেন।

মমতা বললেন, আমরা বাড়ি বদলাবার পর মাকে কিছুদিন কলকাতায় এনে রাখতে হবে।

স্ট্র্যান্ড রোড ধরে বড় বড় লরি ও ঠ্যালা গাড়ির পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে ত্রিদিবের গাড়ি এক সময়ে এসে থামলো ইডেন গার্ডেনের সামনে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার পর বাচ্চারা তো বটেই, মমতা সুপ্রীতিরাও বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন খানিকটা। এত বিশাল মেলা বা প্রদর্শনী ওঁরাও আগে কখনো দেখেননি। কতগুলি মণ্ডপ, কত রকমারি দোকান, কত জিনিসপত্র, কত খাবার, কত রং। এর মধ্যে তো মানুষ দিশাহারা হয়ে যাবে। মানুষের ভিড়ও প্রচুর। এখানে কেউ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর হবে।

দলটির নেতৃত্ব নিলেন প্রতাপ। সবাই একসঙ্গে কাছাকাছি থেকে এগোতে লাগলেন। কোনো দোকানের সামনে থামা হলেও মিনিট পাঁচেক বাদেই তিনি হাঁক দিচ্ছেন, এবারে চলো। এক জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়ালে চলবে না, অনেক কিছু দেখার আছে! বাবলু দু একবার এদিক। ওদিক দৌড় মারবার চেষ্টা করলেও প্রতাপ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন তার ওপরে, পিকলুকে সঙ্গে সঙ্গে পাঠাচ্ছেন তাকে ধরে আনতে।

মাঝে মাঝেই জল। তাতে ভাসছে ছোটো ছোটো রঙিন নৌকো। বড় বড় গাছের নিচে অনেক বেলুন ঝুলিয়ে এয়ার গান দিয়ে চাঁদমারির খেলা চলছে। ঠিক মাঝখানের বেলুনটি ফাটাতে পারলে একটা বড় টর্চলাইট পুরস্কার। বাবলু-পিকলুরা সেখানে দশটা পয়সা নষ্ট। করলো, বাবলু আরও পয়সা চাইলে প্রতাপ গম্ভীর ভাবে বললেন, আর নয়!

এক জায়গায় জলের ওপর একটা রেস্টুরেন্ট, নাম স্বপনপুরী। নানা রঙের আলো দিয়ে। সেটি সাজানো। সেটি আবার একটু একটু ঘুরছে। একে ভাসমান দোকান, তায় আবার নিজে নিজে ঘুরন্ত, তা দেখে ওদের মুগ্ধতার সীমা থাকে না। সুপ্রীতি দু তিনবার জিজ্ঞেস করলেন, কী। করে করলো, অ্যাাঁ? পিকলু তার বিজ্ঞান-পড়া বুদ্ধি দিয়ে বোঝাতে লাগলো।

সুলেখা ত্রিদিবকে বললেন, তুমি আমাদের ওখানে খাওয়াবে?

ত্রিদিব বললেন, হ্যাঁ, খাওয়াতে পারি। কিন্তু এখন তো কারুর খিদে পায়নি, সব দেখে টেখে ফেরার সময় খাবো বরং।

এই সব সময়ে প্রতাপেরই সমস্ত খরচ করা অভ্যেস। এই সব হোটেল-টোটেলে এতজন মিলে খেতে কত টাকা লাগবে কে জানে! অনেকদিন প্রতাপ হোটেল-রেস্টুরেন্টে ঢোকেন নি। তিনি আজ সঙ্গে বেশি টাকা আনেননি, মমতার কাছে কিছু আছে কী? তিনি মমতার দিকে তাকালেন। মমতা ঠিক বুঝতে পেরেছেন, তিনি সামান্য হেসে মাথাটা অতি সূক্ষ্মভাবে নাড়লেন, তারপরই আবার গল্প করতে লাগলেন সুলেখার সঙ্গে।

ত্রিদিব বললেন, পিকলুরা বরং আলাদা ঘুরে ঘুরে দেখুক। সব সময় বড়দের সঙ্গে থাকতে ওদের ভালো লাগবে কেন?

পিকলু এই কথাটা শোনা মাত্র ত্রিদিবের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা বোধ করলো। মনে মনে সে। এটাই চাইছিল, কিন্তু বাবার সামনে বলার সাহস পাচ্ছিল না।

প্রতাপ বললেন, ওরা আলাদা যাবে, কিন্তু বাবলুটা যে অতি অবাধ্য, ওকে সামলাবে কে?

মমতা ত্রিদিবকে সমর্থন করে বললেন, না, ওরা আলাদাই যাক। ওরা ওদের মতন দেখুক। বাবলু যদি হারিয়ে যায় তা হলে আমরা আর ওকে খুঁজবো না, ও বাড়িতে ফিরতেও পারবে না। ও এখানে কোনো চায়ের দোকানে বেয়ারার কাজ করবে, সেই বেশ হবে!

বাবলু বললো, হ্যাঁ, আমি ঠিক রাস্তা চিনে বাড়ি যেতে পারবো।

সুপ্রীতি বাবলুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এই দস্যিটা সব পারে! কিন্তু তুই যদি আজ হারিয়ে যাস, তাহলে আমিও আজ আর বাড়ি যাবো না। আমাকেও আর কেউ খুঁজে পাবে না!

ঠিক হলো যে, দু ঘণ্টা বাদে পিকলুবাবলুরা সেই স্বপনপুরীর কাছে ফিরে আসবে। ত্রিদিব নিজের ঘড়িটা খুলে পরিয়ে দিলেন পিকলুর হাতে।

মুন্নিকে তার আপত্তি সত্ত্বেও নিজের কাছে রাখলেন মমতা। প্রতাপ পিকলুর হাতে পাঁচটা টাকা দিলেন ওদের খরচের জন্য। পরের মুহূর্তেই পিকলুবাবলু-তুতুল অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।

প্রতাপ সুলেখাকে বললেন, এবারে তুমি যাতে হারিয়ে না যাও, সেটার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে আমাকে। বাবলুর পরেই তোমাকে নিয়ে আমাদের বেশি ভয়। সুলেখা ভূভঙ্গি করে হেসে বললেন, আ-হা-হা-হা!

একথাও ঠিক কাছাকাছি মানুষজনেরা সুলেখাকে বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছে। সুলেখার রূপ শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও চোখ টানে। সুপ্রীতি বা মমতাও মোটেই অসুন্দর নন, মমতাকে দেখে বোঝাই যায় না তাঁর পিকলুর মতন বড় ছেলে আছে, কিন্তু সুলেখার রূপের ধরনটাই অন্যরকম। অথচ সুলেখা কিছুই সাজগোজ করেননি, মাথার চুল শ্যাম্পু করা, একটা খোঁপাও বাঁধেননি আজ।

সুলেখার প্রতি অন্য লোকদের এই আকর্ষণ ত্রিদিব গ্রাহ্য করছেন না, তার গা-সহা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রতাপ ঈষা বোধ করছেন। পাশ দিয়ে যাবার সময় কেউ যাতে ইচ্ছে করে সুলেখার শরীর ছুঁয়ে না যায় সেইজন্য প্রতাপ সুলেখাকে প্রায় পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছেন, ভিড় এড়িয়ে তিনি তাঁর দলটিকে নিয়ে চলেছেন জলের ধার দিয়ে।

মমতা বললেন, আমাকে একটা বঁটি কিনতে হবে। এখানে পাওয়া যাবে না?

সুপ্রীতি বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বঁটিটার একেবারে ধার নষ্ট হয়ে গেছে।

সুলেখা বললেন, না, প্লীজ, এখান থেকে বঁটি কিনো না।

মমতা বললেন, কেন?

সুলেখা বললেন, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি, এখান থেকে কোনো কাজের জিনিস কেনা মানায় না! তুমি একটা বঁটি হাতে নিয়ে ঘুরবে নাকি?

প্রতাপ ব্যঙ্গ করে বললেন, শুধু বঁটি? কেন, ঝাঁটা কিনতে হবে না?

মমতা স্বামীর দিকে তাকালেন। বিবাহিত পুরুষরা অন্য সুন্দরী মেয়েদের সামনে নিজের স্ত্রীকে ছোটখাটো খোঁটা দিয়ে আনন্দ পায়।

মমতা বললেন, আসলে আমার কী কেনার ইচ্ছে শুনলে তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না। হাসবে!

ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন, কী?

সামনের একটা দোকানের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মমতা বললেন, একটা কার্পেট। বেশ পুরু হবে, ডিজাইন করা থাকবে। একটা কার্পেট-পাতা ঘরে থাকার খুব শখ আমার।

সবাই কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে গেলেন। একটা সাধারণ ভাড়া বাড়িতে যে থাকে, তার কার্পেটের শখ সত্যিই অবিশ্বাস্য। সুপ্রীতি স্বেচ্ছায় যে বাড়ি ছেড়ে এসেছেন, তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নিজের ঘরে লাল কার্পেট পাতা ছিল।

মমতা আবার বললেন, একদিন আমি আমার দু একটা গয়না বিক্রি করেও একখানা কার্পেট। কিনবোবা।

বিষয়টাকে লঘু করার জন্য সুলেখা বললেন, তখন তো তোমার ঘরে ঢুকতেই আমাদের ভয় করবে। যেসব বাড়িতে কার্পেট পাতা থাকে, সেসব বাড়ির লোকেরা এমন করে যেন পা দিয়ে খুব অন্যায় করে ফেলেছি। জুতো খুলতে ভুলে গেলে তো আর রক্ষা নেই!

এই সময় একজন লোক কোথা থেকে এসে বললো, আরে ত্রিদিবদা, আপনারা কখন এলেন? দূর থেকে আপনাদের দেখলুম।

লোকটি কথা বলছে ত্রিদিবের সঙ্গে কিন্তু চেয়ে আছে সুলেখার দিকে। লোকটি সামান্য মুখ চেনা, ত্রিদিব তার নাম করতে পারলেন না বলে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারলেন না। লোকটি কিন্তু ওঁদের সঙ্গে সেঁটে রইলো এবং অনর্গল কথা বলতে লাগলো। প্রতাপ স্পষ্টতই বিরক্ত হলেন, কিন্তু ত্রিদিবের চেনা লোককে তো তিনি ধমকে চলে যেতে বলতে পারেন না?

সুলেখা একটি চানাচুরের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, এই দ্যাখো, সেই ভবানীপুরের চানাচুর, খুব নাম করা। কিনবে?

সবার জন্য এক এক ঠোঙা চানাচুর কেনা হলো। সঙ্গের সেই উটকো লোকটা দাম দেবার চেষ্টা করতেই সুযোগ পেয়ে প্রতাপ রুঢ় ভাবে তাকে বললেন, আপনি পয়সা বার করছেন কেন?

লোকটির কাছ থেকে আলাদা হবার জন্য একটু পরে সুলেখা, মমতা আর সুপ্রীতি উঠে বসলেন নাগরদোলায়। পুরুষদের কেউ চাপবেন না। তিন নারী যেন বালিকা বয়েসে ফিরে। গিয়ে খানিকটা ভয়-মেশানো খুশিতে হাসতে লাগলেন খুব।

পিকলুবাবলু-তুতুল ঘুরে ঘুরে দেখছে একটার পর একটা মণ্ডপ। পিকলু বিজ্ঞানের ছাত্র। হলেও ইতিহাস সম্পর্কে সে খুব আগ্রহী। পড়েছেও অনেক। যেখানে সিরাজউদ্দৌলার বষা, তলোয়ার, বন্দুক রাখা আছে, সেই মণ্ডপে ঢুকে সে তার ভাই বোনকে শোনাতে লাগলো পলাশী যুদ্ধের কলঙ্ক কাহিনী। তুতুল মুগ্ধ হয়ে শোনে, কিন্তু বাবলুর অত ইতিহাস-জ্ঞান সঞ্চয়নের ধৈর্য নেই, সে এটা সেটা হাত দিয়ে দেখতে চায় আর রক্ষকদের বকুনি খায়। সিরাজউদ্দৌলার। বশটা ছুঁয়ে সে বললো, উরিব্বাস, কত লম্বা! দাদা, সিরাজ নবাব কত লম্বা ছিল, এত বড় বশা। নিয়ে যুদ্ধ করতে পারতো!

পিকলু বললো, এই বর্শা নিয়ে যুদ্ধ করতো না, এটা অনেকটা ডেকরেটিভ, বুঝলি, হয়তো সিংহাসনের পাশে সাজানো থাকতো, জুতোর দোকানে দেখিস না, এক একটা কী রকম পেলাম পেল্লায় জুতো থাকে! ভবিষ্যতের কেউ তোর মতন হয়তো সেই একখানা জুতো দেখে ভাববে, এখনকার কালে অত বড় পা-ওয়ালা মানুষ ছিল!

তুতুল বললো, এই কামানটা কিন্তু বেশ ছোট। এর থেকে অনেক বড় কামান দেখলাম স জায়গায়।

পিকলু বললো, এটা ইংরেজদের কামান। নবাবী কামান ঢাউস ঢাউস ছিল, কিন্তু ইংরেজদের কামান ছোট হলেও বেশি এফেকটিভ। চট করে মুখ ঘোরাতে পারতো, ক্যারি করার সুবিধে ছিল। সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয় করে এই রকম কয়েকটা কামান কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ততল বললো, পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করতো—

পিকলু বললো, তাহলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো! এক একটা সামান্য সামান্য ঘটনায় ইতিহাসের নিয়তি বদলে যায়।

ইদানীং নির্মলেন্দু লাহিড়ীর রেকর্ড করা সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি খুব জনপ্রিয়। রেডিওতে প্রায়ই বাজে। সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজোয় মাইকে বাজে। নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কাঁপা কাঁপা গলায় সংলাপ শুনতে শুনতে অনেকের মুখস্থ। বাবলু সেই নাটকেরই সংলাপ চেঁচিয়ে বলে উঠলো, বাংলা বিহার উড়িষ্যার হে মহান অধিপতি, তোমায় তো ভুলিনি জনাব? তারই পুরস্কার কি এই কণ্টক মুকুট? তারই পুরস্কার কি এই ছিন্ন পাদুকা!

বাবলুর রিনরিনে কণ্ঠস্বর শুনে অনেকে ঘুরে তাকালো, কেউ বললেন, বাঃ, খোকা, আর একটু বলো তো!

পিকলু লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

আর একটি মণ্ডপে রয়েছে নন্দকুমার ও রামমোহন রায়ের পাগড়ি, চোগা-চাপকান। তা ছাড়া রয়েছে রামমোহনের চুল, পৈতে ও নিজের হাতে লেখা চিঠি। পিকলু রামমোহনের খুব ভক্ত, সে প্রায়ই বলে রামমোহন হচ্ছেন ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষ, তাঁর জন্যই আমরা পশ্চিম দুনিয়াকে চিনতে শিখেছি, একালের জ্ঞান-বিজ্ঞান…

বাবলু দৌড়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়, একবার সে আইসক্রিম কেনার জন্য দাদার কাছ থেকে পয়সা চাইতে আসে, আর একবার সে বাদাম কিনে এনে দাদা আর দিদিকে দেয়। খানিকবাদে এসে দেখে যে পিকলু তখনও মন দিয়ে রামমোহনের একটা পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করছে, সে পিকলুর হাত ধরে টানাটানি করে বলে, দাদা, চলো, অন্য কোথাও চলো।

পিকলু ঐ রকমই আর একটি মণ্ডপে ঢোকে, যেখানে রয়েছে বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। বিদ্যাসাগরের দুধ খাওয়ার বাটি, দোয়াতদানি। রামকৃষ্ণের ছাতা, একটা খঙ্গ।

এটাও বাবলুর পছন্দ হয় না। সে বললো, দাদা, ঐ দিকে চলো না, ওখানে রানা প্রতাপের সব জিনিস আছে।

পিকলু বললো, দাঁড়া, একটু পরে যাবো।

বাবলুর এই সব বাজে বাজে জিনিস দেখার ধৈর্য নেই। সে একাই চলে গেল রানা প্রতাপের মণ্ডপে। বিদ্যাসাগর-রামকৃষ্ণকে সে ভালো করে চেনে না। কিন্তু ইস্কুলের বইতে পড়া রানা প্রতাপের কাহিনী তাকে চঞ্চল করে। বইতে একটা ছবি আছে, রানা প্রতাপের ভাই শক্ত সিংহ দূর থেকে ডাকছে, হো নীল ঘোড়াকা সওয়ার!

রানা প্রতাপের বর্ম, তলোয়ার, পাগড়ির দিকে মুগ্ধ ভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে বাবলু মনে মনে একটি নীল ঘোড়ার সওয়ার হয়ে যায়। সে যেন সত্যিই শুনতে পায় টগবগ টগবগ ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ।

অন্য মণ্ডপে তুতুল পিকলুকে জিজ্ঞেস করে, রামকৃষ্ণ এই খাঁড়াটা নিয়ে কী করতেন?

পিকলু বললো, তুই সেই গল্পটা জানিস না? রামকৃষ্ণ মা কালীকে স্বচক্ষে দেখার জন্য ডেকে ডেকে পাগল হচ্ছিলেন। দেখা দাও, দেখা দাও বলে আর্তনাদ করতেন। তারপর সত্যিই বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, এরকম টেমপোরারি ইনস্যানিটি হতে পারে। কিছুতেই যখন দেখা পাচ্ছেন না, তখন মা কালীর হাত থেকে খাঁড়াটা খুলে নিয়ে বলেছিলেন, মা, দেখা দিবি না, তা হলে আমি তোর সামনেই আত্মঘাতী হবো। নিজের গলাটা যখন কাটতে গেলেন, তখন মা কালী নাকি সশরীরে এসে তাঁর হাত চেপে ধরেছিলেন।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, সত্যি মা কালী এসেছিলেন?

পিকলু অবজ্ঞার সঙ্গে হেসে বললো, সত্যি সত্যি মাকালী বলে কিছু আছে নাকি? তুই-ও যেমন! নিশ্চয়ই হ্যাঁলুসিনেশান জাতীয় কিছু ব্যাপার? আর এদিকে দ্যাখ কী কনট্রাস্ট। বিদ্যাসাগরও রামকৃষ্ণের সমসাময়িক, তিনিও তো গ্রাম্য মানুষের ছেলে, কিন্তু তিনি বলতেন ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবার আমার সময় নেই, আমার অনেক কাজ। তিনি তখন গ্রামে গ্রামে ছেলেমেয়েদের জন্য ইস্কুল খোলা, বিধবা বিবাহ এইসব নিয়ে ব্যস্ত। বাঙালী মেয়েরা যে আজ লেখাপড়া শিখতে পারছে তা বিদ্যাসাগরের জন্যই। কিন্তু এখনকার বাঙালী মেয়েরা রামকৃষ্ণেরই পুজো করে, তুই ক’জনের বাড়িতে বিদ্যাসাগরের ছবি বাঁধানো দেখেছিস?

একটু পরে বাবলু এসে আবদার ধরলো, সে সার্কাস দেখবে।

সার্কাস, মানে মাঝারি আকারের একটা তাঁবু, তার বাইরে সবললামহর্ষক ছবি আঁকা বিজ্ঞাপন। কাটা মুণ্ড কথা বলে, তলার দিকটা মাছের মতন–ওপরের দিকে একটি সুন্দরী মেয়ে, মটর সাইকেল আরোহীর মরণকূপে ঝাঁপ ইত্যাদি। আট আনা করে টিকিট। পিকলু পয়সা হিসেব করে দেখলো যাওয়া যেতে পারে।

তুতুল কাতরভাবে বললো, আমার ওসব দেখতে ইচ্ছে করছে না।

কিন্তু বাবলুর জিদ সে দেখবেই দেখবে। তখন একটা টিকিট কেটে বাবলুকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ভেতরে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের শো, ভাঙার পর বাবলু দাঁড়িয়ে থাকবে গেটের কাছে।

তুতুল বললো, অনেকটা তো সময়। চলো, আমরা ততক্ষণ একটু ঘুরে আসি।

দু’জনে হাঁটতে লাগলো মন্থর ভাবে। আর একটি মণ্ডপ দেখে পিকলু জিজ্ঞেস করলো, এটার মধ্যে যাবি?

তুতুল বললো, বাইরেই ভালো লাগছে। একটু হাঁটি।

পিকলু আবার খানিকটা বাদাম কিনলো, তারপর বাদাম ভাঙতে ভাঙতে হাঁটতে লাগলো, দু’জনেই নিঃশব্দ। অন্য বহু লোক কথা বলছে, মাইকে নানারকম আওয়াজ, হারানো নাম ঘোষণা, এর মধ্যে ওদের কথা বলার দরকার নেই। তুতুল আজ পরে এসেছে গোলাপি রঙের। একটা শাড়ি, গলায় একটা কাঁচের মালা। কপালে টিপ। পিকলু পরে আছে সাদা জামা, সাদা। প্যান্ট। সে জামার বুকের বোতাম লাগায় না। তার মাথার চুল এলোমেলো।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এলো বুকটা নির্জন জায়গায়। এত ভিড়ের কাছাকাছিই যে এমন। নির্জন জায়গা থাকতে পারে, যেন বিশ্বাসই করা যায় না। কয়েকটা পাশাপাশি বড় গাছ, তারপরে খানিকটা জমি সবুজ মখমলের মতন ঘাসে ঢাকা। কয়েকটা তাঁবুর পেছন দিক, তাই। এদিকে কেউ আসছে না।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, এখানে ঘাসের ওপর একটু বসবে?

পিকলু বসে পড়ে বাদামের ঠোঙাটা ঘাসের ওপর রাখলো। তারপর বললো, জায়গাটা এত পরিষ্কার, ওঠার সময় বাদামের খেলাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাবো।

দু’জনে শেষ করতে লাগলো বাদাম। পিকলু দু’বার ঘড়ি দেখলো। হাতে নতুন ঘড়ি উঠলে সব সময় সেই দিকেই মন থাকে।

তুতুল বললো, এত ঘড়ি দেখছো কেন? এখনো অনেক সময় বাকি আছে!

পিকলু বললো, বাবলুটাকে তো বিশ্বাস নেই। যদি একটু আগে শেষ হয়ে যায়, অমনি কোথায় যে চলে যাবে!

–পিকলুদা, আমি একটা কথা বলবো?

–বল!

কিন্তু তুতুল আর কিছু বললো না। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে চেয়ে রইলো মাটির দিকে।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করে পিকলু জিজ্ঞেস করলো, কী বলবি, বল!

ততুল মুখ তুললো। বড় বড় পল্লব মেলে প্রগাঢ় ভাবে তাকিয়ে রইলো পিকলুর দিকে। তার দু চোখের কোণে সামান্য জল চিকচিক করছে। সে বললো, আমি তোমাকে কী বলতে চাই, তুমি তা জানো না? তুমি বুঝতে পারো না!

পিকলু মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ, পারি।

–কী বলো তো!

–তা মুখে বলার দরকার নেই।

–আমার কী হয়েছে জানি না। আমি আজকাল সর্বক্ষণ তোমার কথা ভাবি। তোমাকে খানিকক্ষণ না দেখলেই আমার মন ছটফট করে। আমি কাছে আছি, অথচ তুমি যদি অন্যদের সঙ্গে বেশি কথা বলো, তা হলে খুব কষ্ট হয় আমার। কেন এরকম হচ্ছে। আমি নিজেকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি…

পিকলু চুপ করে রইলো।

–তুমি আমাকে খারাপ মেয়ে মনে করো, তাই না? আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটা অন্যায় আমি জানি…।

পিকলু তুতুলের একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের মুঠোয় রাখলো, তারপর নরম ভাবে বললো, না, ভালোবাসা অন্যায় নয়। আমিও তোকে ভালোবাসি। কিন্তু একজন নারী একজন পুরুষকে কিংবা একজন পুরুষ একজন নারীকে যেভাবে ভালোবাসে, এ ভালোবাসা সেরকম নয়।

–তুমি…তুমি অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসো?

পিকলু একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তার দৃষ্টি চলে গেল দূরে। সে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে দাঁতে দিয়ে বললো, উঁ?

–পিকলুদা, তুমি অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসো?

–নাঃ।

–তুমি কবিতা লেখো, আমি দেখেছি।

–কী করে দেখলি?

–টেবিলের ওপর তোমার খাতা পড়ে থাকে…একটা পত্রিকায় দেখলাম তোমার একটা কবিতা ছাপাও হয়েছে, মনে হলো কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলা–

–ওসব কাল্পনিক। নারী, নয়, নারীত্বের প্রতি….

–আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

–কী বললি, কিসের অপেক্ষা?

–আমি তোমার কাছে এখন কিছু চাইবো না। আমি তোমাকে একটুও জ্বালাতন করবো না। তুমি যতদিন বলবে, আমি ততদিন অপেক্ষা করবো। কিন্তু তুমি শুধু আমার থাকবে, তুমি অন্য কারুর কাছে চলে যাবে না। তুমি কথা দাও!

পিকলু তুতুলের হাতটা ছেড়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। বেশ কয়েক শুত। তারপর পরিষ্কার গলায় বললো, এসব কথা আমাকে বলিস না। আমি কোনো বন্ধন সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া, তুতুল, আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি, সেই গলাবাসার মধ্যে স্নেহ, মমতা, এই সব মিশে আছে। কিন্তু প্রেম নয়। আমি তোর প্রেমিক হতে পারবো না। সেরকম চিন্তা আমার মাথাতেই আসে না।

তুল মাথা ঝুঁকিয়ে ব্যাকুল ভাবে বলতে গেল, কিন্তু পিকলুদা, আমি যে—

পিকলু তার মুখে নিজের হাত চাপা দিয়ে বললো, চুপ, ঐসব কথা আর নয়!

পর ওরা চুপ করেই বসে রইলো। তুতুলের কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়লো সবুজ ঘাসগুলিকে সারবান করার জন্য। পিকলু একটা সিগারেট পোড়ালো। বাদামের খেলাগুলো সে তুলতে লাগলো যত্ন করে।

বাতাসে খসে পড়লো কয়েকটি গাছের পাতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *