1 of 2

৩৫. অমরনাথ শুয়ে আছেন

অমরনাথ শুয়ে আছেন তাঁর খাটে। যে খাটটা কখনই তাঁর নিজস্ব ছিল না। বিয়ের পর অঞ্জলি ওই খাট নিয়ে এসেছিল। দীপা কিংবা তাঁর অন্য ছেলেদের অনেক বাল্যস্মৃতি রয়েছে ওই খাটকে ঘিরে। খাটের ওপাশে বসে অঞ্জলি মাঝেমাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরা মাত্র সে তীব্র চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অমরনাথের বুকে। চা-বাগানের অন্যান্য বাবুদের স্ত্রীরা তাকে সামলাতে চেষ্টা করছে প্ৰাণপণে। একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মনোরমাকে। নিজেকে তিনি কোনমতে বহন করে এনেছিলেন এই ঘরে, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনিও অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তাঁকে সেবা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কয়েকজন। দূরের দরজায় দীপা দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মত। তার সঙ্গে হাজার হাজার টাকা এবং একটি ব্যাঙ্ক ড্রাফট।

অমরনাথকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল। যেন প্রশান্ত মনে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর পরনে এখনও লুঙ্গি আর গেঞ্জি। সেন্দুটিও ধোপদূরস্ত। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন দীপার কাছে, হবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবতে পারিনি। প্ৰচণ্ড লড়াই করেছিলেন, চেষ্টা করলাম।

দীপার শরীর এখন চৈত্রের আকাশ। একটা গরম হলকা যেন পাক খাচ্ছে শরীরময়। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল জিভ নড়ছে না। আর সেই সময় অঞ্জলির জ্ঞান ফিরে এল। স্বামীর বুকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হতেই তার নজর পড়ল দীপার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর পাল্টে গেল তার। হিমশীতল গলায় যদি উপহাস মেশে তাহলে এমনভাবে শব্দ উচ্চারণ করা যায়।

অঞ্জলি বলল, এসো, অত দূরে কেন, এসে দ্যাখো, যাকে এতকাল বাবা বলতে, যিনি তোমার সর্বনাশ করেছিলেন বলেছিলে, তিনি কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছেন। কাছে এসো।

নাড়া খেল দীপা। ঘরে যারা ভিড় করে ছিল গম্ভীর মুখে তারা এবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। অঞ্জলি টলতে টলতে খাট থেকে নামলো। ওকে আটকাবার চেষ্টা কেউ করল না। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছিল। কয়েক পা এগিয়ে এসে চিল-চিৎকারে অঞ্জলি বলে উঠল, জন্মমাত্র মাকে খেয়েছিল বিয়েমাত্র স্বামীকে গিলেছিল, তবু তোর নোলা ভরল না রে, ওকে শেষ না করলে তোর কিছুতেই কি পেট ভরছিল না? হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন মনোরমা, বউমা! না, এমন কথা বোলো না, বোলো না। পাপ হবে, পাপ হবে।

পাপ হবে? ফুঁসে উঠল অঞ্জলি, কিসের পাপ? আর পাপ হলে কে ভয় পাচ্ছে? আমার আর কি রইল? কি হবে পাপে? এতদিন মানুষটা ভাল ছিল। খেতে ঘুমাতো, তবু তো ছিল। যেই ইনি এলেন কলকাতা থেকে–। দাঁতে দাঁত লেগে গেল অঞ্জলির। তার শরীর টলতে লাগল। দুজন মহিলা দুপাশ থেকে ধরে মেঝেতেই শুইয়ে দিলেন তাকে। সবাই খুব অপ্ৰস্তুত।

পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। এখন তার চৈতন্য পরিষ্কার। কথাগুলো গরম লোহার মত তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেল আচমকা। সে নড়তে পারছিল না।

ডাক্তারবাবু পাশে দাঁড়িয়েছিলো। এবার তিনি দীপার কাঁধে হাত রাখলেন, আপসেট হয়ে না। এইসময় অনেক মানুষ নাৰ্ভ হারিয়ে ফেলে, সেন্স কাজ করে না। উনি কি বলছেন তা নিজেই জানেন না।

দীপা দেখল মনোরমাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল অমরনাথের কাছে। ছেলের মাথার পাশে ধাপ করে বসে পড়লেন তিনি। ওর খুব ইচ্ছে করছিল অমরনাথের কাছে যায়। কিন্তু সেই সঙ্গে ভয় হচ্ছিল জ্ঞান ফিরে আসামাত্র অঞ্জলি যদি আবার চিৎকার শুরু করে। ওই খারাপ কথাগুলো যদি আবার শুনতে হয়। ডাক্তারবাবু ওর পিঠে হাত দিয়ে তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। দীপার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। সে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল। ডাক্তারবাবুকে এবং সেইসঙ্গে কান্না ছিটকে উঠল। এতক্ষণের চাপা যন্ত্রণা শোক এবং আহত হবার অনুভূতি মিলে মিশে একাকার। এই কান্না অমরনাথের জন্যে যতটা নিজের জন্যে তার চেয়ে কিছু কম নয়। ডাক্তারবাবু মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন বি স্টেডি। তুমি আর পাঁচটা মেয়ের মত নাও! তোমার নার্ভ খুব শক্ত, আমি জানি; বি স্টেডি।

কান্নার বেগ সামান্য কমলে দীপার অনুভবে একটা পুরুষালি গন্ধ ছড়ালো। এই গন্ধ অমরনাথ জড়িয়ে ধরলে সে অনুভব করত। পলকেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে ছুটে গেল অমরনাথের কাছে। মৃত মানুষের হাত টেনে নিয়ে নিজের মুখ রাখল। সে এখানে। আর তখনই খাটের এক কোণে দাঁড়ানো বড় ভাই বলে উঠল, এই দিদি, তুই বাবাকে ছুঁবি না।

কেউ একজন প্রতিবাদ করল, এই, তুই কি যা তা বলছিস?

ঠিক বলছি। দিদির জন্যে বাবা মারা গিয়েছে।

দীপার কানে কথাগুলো ঢুকছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল সে। যেন অমরনাথের স্পর্শের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই হাত কতবার তাকে টুয়ে গিয়েছে। এখনও উত্তাপ চলে যায়নি চামড়ার। মানুষ মরে গেলে সম্পর্কও মরে যায়?

ডাক্তারবাবুর গলা কানে এল, শ্যামল, আর দেরি করে কোন লাভ নেই।

শ্যামলদা বলল, নিয়ে গেলেই হয়। সাহেব। আসবেন শুনছিলাম।

এসে পড়লেন বলে। তৈরী হও তোমরা।

মনোরম কোন কথা বলছেন না। ওরা অমরনাথকে পোশাক পরানোর জন্যে হাত লাগাতেই তিনি দীপাকে নিয়ে নেমে এলেন উঠোনে। একটানা কেঁদে যাচ্ছিল দীপা। তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন রান্নাঘরের সিঁড়িতে। তাঁর দৃষ্টি শূন্য। দীপাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকা ছাড়া এই মুহুর্তে তার যেন কিছুই করার ছিল না।

একসময় ললিতাদি এগিয়ে এল। কাছে। নিচু গলায় বলল, দীপা, তোমাকে ওঁরা ডাকছেন। একবার এসে।

দীপা মাথা ঝাঁকালো, আমি যাব না, কোথাও যাব না। মনোরমার কোল থেকে মুখ তুলতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।

ললিতা বললেন, ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাহেব এসেছেন। এই সময় তোমার গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। লক্ষ্মীটি, উঠে এসো।

অমরনাথকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দীপা শক্ত হয়ে গেল। আর তখনই মনোরমা শুকনো স্বরে বললেন, যা। দীপা ধীরে ধীরে উঠল। ললিতা তার হাত ধরল।

অঞ্জলিকে ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছিল। তার পৃথিবীতে আর কেউ নিজের বলে রইল না। এইরকম একটা বোধে আক্রান্ত হয়ে সে বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। দীপাকে ছেড়ে দিয়ে ললিতাদি তার কাছে গিয়ে বলল, কাকিমা, নিজেকে একটু সামলান। ছেলেরা সামনে আছে, ওদের কথা ভাবুন।

একসময় অমরনাথকে নিয়ে ওরা রওনা হল। শিউলি গাছের পাশ দিয়ে মাঠ ডিঙিয়ে আসাম রোডের দিকে মিছিলটাি চলে গেল হরিধ্বনি দিতে দিতে। মেয়েদের শ্মশানে যাওয়ার চল এখনও এ-বাগানে হয়নি। শুধু ছেলে না থাকলে এবং মেয়ে যদি অবিবাহিতা হয় তাহলে তাকে মুখাগ্নির জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সে-সব ক্ষেত্রে মৃতের দাদা ভাই বা ওই রকম আত্মীয় যদি না থাকে। তবেই।

সবাই মিলে অঞ্জলিকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলে, দীপা একা মাঠে দাঁড়িয়ে আসাম রোডে শবমিছিল দেখছিল। কিছু বয়স্ক মানুষ যাঁরা শ্মশানে যাননি তাঁরা এখন ফিরে যাচ্ছিলেন যে যাঁর বাড়িতে। এই চা-বাগানের ম্যানেজার তাঁর গাড়িতে চেপে রওনা হচ্ছিলেন শ্মশানের দিকে। ওঠার মুখে জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েরা যদি যেতে চায় তিনি লিফট দিতে পারেন। কিন্তু কেউ কিছু জবাব দিল না।

যে মানুষটির সঙ্গে তার সবচেয়ে অপ্রীতির সম্পর্ক তৈরি হত বারংবার অথচ যে মানুষটির ভালবাসা সে অনুভব করত প্রতিটি মুহুর্তে এই পৃথিবীতে যে ছিল তার প্রকৃত শুভাকাঙক্ষী, তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নিজের কথা চিন্তা না করে, আজ আর তিনি কোথাও বইলেন না।

দীপা ধীরে ধীরে হটিতে লাগল। শ্মশানযাত্রীদেবী থেকে অনেক দুবে, একা একা। তার পায়ে জুতো নেই, চোখে জলের দাগ। আঙরাভাসা নদী, বাজার, চৌমাথা পেরিয়ে সে যখন পুলের ওপর এসে দাঁড়াল তখন শ্মশানযাত্রীরা নেমে গিয়েছে নিচে। চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে অনেক দূর থেকে মানুষটিকে ছাই হয়ে যেতে দেখল সে। মানুষটি মরে যাওয়ার পর্ব আগুনের স্পর্শেই শুধু ছাই হয়ে যায়? জীবন্ত মানুষও তো কারো কারো কাছে ছাই হতে পারে! জন্মাবার পর তাকে যে দুটো মানুষ স্নেহ-ভালবাসাব্য আপ্লুত হয়ে নিয়ে এসে নিজের সন্তানের মত মানুষ করতে চেয়েছিল, বাবা ও মা বলতে শিখিয়েছিল তার একজন যদি চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অন্যজন জ্বালা ঈষার সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব লোপ পাবাব আশঙ্কায় মরীয়া হয়ে এতদিনের সম্পর্কই শুধু পুড়িয়ে ছাই করে দেয়নি নিজেকে অনেক নিচে নামাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।

দীপা আবার বাড়ির পথ ধরল। চৌমাথায় সবাই তাকে এখন লক্ষ্য করছে। এই চেনা জায়গাটাকে এখন তার অচেনা মনে হচ্ছে। চৌমাথা, পোস্ট অফিস, স্কুলের মাঠ, বাজার, আঙরাভাসা নদী সব যেন অচেনা, অপরিচিত। অথবা তাদের সঙ্গে জড়িযে থাকা স্মৃতিগুলো এই মুহুর্তে অবশ হয়ে গিয়েছে। আসাম রোড দিয়ে কোয়ার্টার্সের সামনে পৌঁছে স্থির হল সে। এখন সে ওই বাড়িতে থাকবে কি করে? যে চারজন মানুষ ওই বাড়িতে বাস করবে তাদের তিনজন তাকে আর পছন্দ করছে না। অঞ্জলি যে ভাষা প্রকাশ্যে ব্যবহার করেছে, বড় ভাই যে কথাগুলো উচ্চারণ করতে সাহস পেয়েছে তারপর আর ওখানে থাকার কোন মানে হয় না। যদি এটা মেনে নিতে হয় তাহলে অনেক দিন আগে সে প্রতুলবাবুর বাড়িতে সব মেনে নিয়ে বিধবা হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু কোথায় যাবে সে? এই পৃথিবীতে তার যাওয়ার জায়গা নেই। হোস্টেল খুলতে দেরি আছে। আর দুদিন বাদেই পূজো। এবার মা দুর্গ অদ্ভুতভাবে আসছেন তাদের পৃথিবীতে।

বারান্দায় উঠে এল দীপা। ললিতাদি এবার তার সামনে দাঁড়িয়ে। যে ললিতাদি একসময় শ্যামলদাকে পাওয়ার জন্যে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, যে-কারণে শ্যামলদার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন, যাকে এই চা-বাগানের সবাই খারাপ মেয়ে বলে একসময় এড়িয়ে চলত সেই ললিতাদি আজ তাদের বাড়ির সমস্যা সামলাচ্ছে। সময় সব কিছু খুব সহজেই পালটে দিয়ে যায়। ললিতাদি জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছিলে দীপা?

শ্মশানের রাস্তায়।

দাহ হয়ে গিয়েছে?

হ্যাঁ।

এখনই শ্মশানযাত্রীরা ফিরে আসবে। ওদের জন্যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। বুধুয়াকে পাঠিয়েছি মিষ্টি আনতে বাজারে। এলে মিষ্টি জল দিতে হবে।

বুধুয়া? বুধুযা এসেছে?

হ্যাঁ।

খবর পেয়ে চলে এসেছে।

কিন্তু মিষ্টি খাওয়াতে হবে কেন?

নিয়ম। ললিতাদি বলল, মানুষগুলোর তো অনেক পরিশ্রম হল। আর হ্যাঁ, তুমি একবার ভেতরে যাও। তোমার মা বারংবাব তোমার খোঁজ করছেন।

দীপা শক্ত হয়ে গেল। ঠোঁট কামড়াল। ললিতাদি বলল, যাও।

অগত্যা দীপা পা বাডাল। আর এক প্রস্তু শ্রাক্রমণ আর একগাদা নোংরা কথায় তাকে স্নান করতে হবে এখন। তখন অমরনাথের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলেনি। কিন্তু এবার জানতে চাইবে কেন তাকে এসব বলা হচ্ছে। কি দোষ তার?

বড় ঘরটায় মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে অঞ্জলি। তার একপাশে কয়েকজন মহিলা। একজন তাকে ডাকল, এসো। ওই তো দীপা এসে গিয়েছে।

অঞ্জলি উঠে বসতে চাইলে একজন মহিলা বাধা দিলেন, না, না, আপনি উঠবেন না। আত মাথা ঘুরছে —।

কিন্তু অঞ্জলি শুনল না। হাত বাড়িয়ে সে ডাকল, দীপা, কাছে আয়।

একেবাবে অন্যরকম গলা। দীপা হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু তখনই তার নজর পড়ল অঞ্জলির ওপর। ইতিমধ্যেই হাত থেকে শাখা নেওয়া খুলে নিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। হঠাৎ যেন শরীরটাকে রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। অঞ্জলি এবার কান্না মেশানো গলায় ডাকল, রাগ করিস না মা, কাছে আয়।

যেন শেকড়ের শেষ প্ৰান্তে টান পড়ল। দীপা নিজেকে সামলাতে পারল না। একরকম টলতে টলতেই সে অঞ্জলির কাছে পৌঁছে গেল। তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে অঞ্জলি ড়ুকরে কেঁদে উঠল,  তোকে ও সবচেয়ে ভালবাসত রে। তোর জন্যেই শুধু দিনরাত চিন্তা কবত। তোব অত বড় ক্ষতি হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল মানুষটা। তোকে ও পাগলের মত ভালবাসত।

দীপা কেঁদে ফেলল। এই সত্যি কথাটা বুকের সমস্ত আড়াল যেন এক টানে সরিয়ে ফেলল।

কান্না চলল। কিছুক্ষণ। অঞ্জলি সেই অবস্থায় বলতে লাগল, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি রে। আমার মাথার কোন ঠিক নেই। তোকে তখন কি বলতে কি বলেছি, মানুষটার প্রাণ ছিল না। শুনে গেল তো সব, কি করে। প্ৰায়শ্চিত্ত করি।

দীপা চিৎকার করে উঠল, মা।

আমি তোর সঙ্গে সৎমার মত ব্যবহার করেছি। কি করে করলাম–।

এই সময় শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এল। বুধুয়াও এল মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে। অঞ্জলির ছোট ছেলে ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাদে বড় ছেলে এল, মা! একটি কিশোরের গলা থেকে যুবকের স্বর বের হল যেন।

অঞ্জলি কেঁপে উঠল। তার কান্না থেমে গেল। দীপাকে জড়িয়ে ধরেই সে আবার অমরনাথের উদ্দেশে বিলাপ শুরু করল। বড় ছেলে যেন হতবাক। দিদি যে আবার মায়ের এত কাছাকাছি পৌঁছে যাবে সে সম্ভবত আশাই করেনি।

পুত্রের মৃত্যুশোকে একটা মানুষ যে কতটা পাথর হয়ে যেতে পারে তা মনোরমাকে না। দেখে বোঝা দীপার পক্ষে সম্ভব ছিল না। জলপাইগুড়িতে যে কাপড়ে গিয়েছিলেন সেই এক কাপড়ে তিনি বসেছিলেন মধ্যরাত পর্যন্ত। সন্ধের মুখে প্ৰায় জোর করে দীপা তাঁকে তাঁর ঘরে নিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ বিছানায় শোননি। ঠাকুরের ছবির দিকে পেছন ফিরে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। বারংবার বলা সত্ত্বেও কথার জবাব দেননি। মনোরম সামান্য সুস্থ আছেন আর তাঁর ঠাকুরের সামনে প্ৰদীপ জ্বলেনি এমন একটা সন্ধ্যার কথা দীপা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। রক্ত মাংসেব শরীরটা যেন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

আজ রাত্রে এ বাড়িতে রান্না হবার কথাও নয়। দুই ছেলে হবিষ্যি করবে। কিন্তু মেয়েদের জন্যে সামান্য খাবার ডাক্তারবাবুর স্ত্রী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অঞ্জলি সেটা ছুঁয়েও দ্যাখেনি। রাত বাড়লে দীপার হঠাৎ খিদে পেল। অথচ আরহাওয়া এমন যে সেই খাবার খেতে যেতেও খারাপ লাগছিল। অমরনাথকে সে ভালবাসত। অমরনাথের কাজের প্ৰতিবাদে সে একসময় জলপাইগুড়ির হোস্টেল ছেড়ে চলে এসেছিল। নগ্ন একটা সত্য বলেছিল বলে অমরনাথ সেদিন অপমানিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু এর বাইরে অমরনাথই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যিনি তাকে বুঝতে পারতেন। সেই অমরনাথের চলে যাওয়াটা তার কাছে যেমন কষ্টের তেমনই এই রাত্রে খিদেবোধটাও সমান সত্যি।

বড় বাড়ির দরজা বন্ধ। উঠোনের ওপাশে রান্নাঘরের দরজাও খোলা হয়নি। সে মনোরমার ঘর থেকে বেরিয়ে কলতলার দিকে গেল। টিউবওয়েল টিপে জল বেবাঁ করে বেশ খানিকটা গিলে ফেলতেই শরীর যেন গুলিয়ে উঠল। মাথার মুখে জল দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সে চমকে উঠল। রান্নাঘরের বারান্দায় কেউ একজন বসে আছে। কে? চোর? অনেকগুলো চিন্তা একসঙ্গে পাকিয়ে ওঠামাত্র সে চিৎকার করে উঠল, কে?

হাম। আমি  বুধুয়ার গলা।

সহসা যেন নিঃশ্বাস সহজ হল, ওখানে কি করছিস?

এইস্যাই। বইঠা। হ্যায়। বুধুয়ার গলায় নির্লিপ্ততা।

বাড়ি যাসনি কেন?

এইস্যাই।

খেয়েছিস কিছু?

নেহি। ভুখ নেহি লাগিতা।

তোর ঘুম পাচ্ছে না?

নেহি।

দীপা অবাক হয়ে গেল। অমরনাথের সঙ্গে বুধুয়ার সম্পর্ক প্ৰভু এবং ভূত্যের। হাটের দিন ব্যাগ হাতে পেছন পেছন যেত। অমরনাথের বাজার করা নিয়ে সে অঞ্জলির সঙ্গে তর্ক করত। কিন্তু কখনই অমরনাথের মুখের ওপর কথা বলার স্পদ্ধা দেখায়নি। এই বাড়ির চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে নিশ্চয়ই খুব কষ্টে ছিল বেচারা। আজ এই রাত্রে একা রান্নাঘরের বারান্দায় ওইভাবে যে মানুষ বসে থাকে তার মনটাকে এ বাড়ির কেউ কখনও বুঝতেই চায়নি। দীপা বলল, বুধুয়া তুই রান্নাঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।

বুধুয়া জবাব দিল না। এবং দীপা আবিষ্কার করল তার সমস্ত খিদেবোধটা এক মুহুর্তেই উধাও হয়ে গিয়েছে। পায়ে পায়ে মনোরমার ঘরে ঢুকে সে দরজা দিল। তারপর দুহাতে মনোরমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাল, ঠাকুমা, ঠাকুমা এবার উঠে বসি।

মনোরমা চোখ তুলে তাকালেন। তারপর শুকনো গলায় জানতে চাইলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিলি? দীপা বলল, বুধুয়া। রান্নাঘরের বারান্দায় বসে আছে। তুমি ওঠে। শুয়ে পড়। তুমি না শুলে আমি ঘুমাতে পারব না।

মনোরমা উঠলেন, আমি বাথরুম থেকে আসছি। তুই আমার বিছানা নিচে করে দে।

নিচে কেন?

ছেলেদুটো আজ নিচে শোবে, আমি খাটে শুতে পারব না। মনোরমা বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আর তার কয়েক সেকেণ্ড বাদে হঠাৎ একটা কান্না বাজল উঠোনে। এ নিশ্চয়ই বুধুয়া। দীপা দরজা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করল। মনোরমা দাঁড়িয়ে আছেন উঠোনে আর তার পায়ের ওপর মাথা রেখে বুধুয়া কেঁদে যাচ্ছে, বাবু দেওতা থা, মা, বাবু হামকো তিনশো। রুপিয়া দেকে বোলা বুধুয়া আজসে তুমি কিসি কো গোলাম নেহি হ্যায়, তুমি ব্যবসা করো। লেকিন হাম জিন্দেগি ভর বাবুকো গোলাম—

অমরনাথের মৃত্যু যেন একটি পরবারের বিশেষ কারো চলে যাওয়া নয়, চা-বাগানের সমস্ত মানুষের আত্মীয়বিয়োগ বলে ক্রমশ মনে হচ্ছিল। দুবেলা মানুষজন আসছেন। ডাক্তাববাবুর পরবার বিশেষ করে দেখাশোনা করছেন। শ্যামলদা এবং ললিতাদি দুবেলা খবর নিচ্ছেন। অঞ্জলি যত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়েছিল তত তাড়াতাড়ি সামলে উঠেছে।

পুজো এসে গেল অমরনাথেবা শ্ৰাদ্ধের আগেই। এ বাড়িতে পুজোর আরহাওয়া নেই। এখনও পুজো হচ্ছে বাজারে। চা-বাগানের একমাত্র পুজো কালীঠাকুরের  দুই ভাই থাকা সত্ত্বেও অমরনাথের কাজের ব্যাপারে দীপাকেই সব দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক একটুও স্বাভাবিক হয়নি তার। কিন্তু সেটা নিয়ে মোটেই ভাবছে না সে। অঞ্জলি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে এখন। ব্যাঙ্ক ড্রাফট পোস্ট অফিসে জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছে অঞ্জলির নামে। সেইটে পাওয়ায় তার দুশ্চিন্তা সামান্য কমেছে।

এসব সত্ত্বেও মনোরমা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক হননি। ঠাকুমাকে বোঝাবার কিছু নেই। যে মানুষ জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এসেছে তাঁকে নতুন করে উপদেশ দিতে যাওয়ার কোন মানে হয় না। তবু এক রাত্রে দীপা তাঁকে বলেছিল, তুমি কেন এত চিন্তা করছি ঠাকুমা। আমার ওপর তোমার একটুও ভরসা নেই?

মনোরমা জবাব দেননি। এখন তিনি একরেলা খাচ্ছেন। প্ৰায় হবিষ্যান্নই বলা চলে। একা থাকলেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন। দীপা দ্বিতীয়বার কথাটা তুলতে মুখ খুলেছিলেন, আমার শৈশব কেটেছিল বাবা-মায়ের কাছে, সবার যেমন কাটে। অল্প বয়সে বিয়ে হল। স্বামীকে পেলাম। তাঁর বাড়িতে গেলাম। বাবা মায়ের হাত থেকে তিনি আমার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে নৌকাড়ুবি হল, পেটে তোর বাবাকে নিয়ে ফিরে এলাম আবার সেই বাবার কাছে। তারপর বাবা গেলেন। ভাই দায়িত্ব নিল আমার। ছেলে হল, মানুষ করলাম। উপযুক্ত ছেলে চাকরি পেয়ে নিয়ে এল। কাছে। এবার সে নিল দায়িত্ব। জীবনে এত স্বস্তি কখনও পাইনি। তা সেই ছেলেও চলে গেল। এবার দায়িত্ব নেবে ছেলের বউ? হয়তো নেবে। কিন্তু আমি কে? আমি কি একটা মানুষ? এইভাবে একজনের পর একজনের কাঁধে ভর করে বেঁচে থাকাকে কি মানুষের জীবন বলে? তোর মাকে কি আমি কখনও চিনতাম? অথচ এখন তার ভরসায় আমাকে জীবন কাটাতে হবে। এই হল বিধিলিপি।

দীপা অবাক হয়ে বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আত্মসম্মানবোধ প্রতিটি মানুষের আছে। যারা নিজেকে উন্মোচিত করতে অক্ষম তারা সেটাকে চেপে রাখে, মুখ বুজে সন্যে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে মাঝেমাঝেই সেই বোধটা নিশ্চয়ই ঠোকর ম্যাবে। তারা হয়তো দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী হতে পারেন না। কিন্তু জ্বালা তো সবার সমান। সে বলেছিল, ঠাকুমা, আমি তো তোমাদের বংশের কেউ নই। তোমাদের রিও আমার শরীবে নেই। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি তোমার গায়ের গন্ধ নিয়ে প্রতিটি বাঞে ঘুমিয়েছি। মেয়ে হিসেরে কি করা উচিত তা শিখেছি তোমার কাছ থেকে। এখন বল তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কম দামী?

মনোরমা দীপার হাত জড়িয়ে ধরলেন। সেই স্পর্শে অনেক কথা বলে ফেললেন তিনি।

দীপা বলল, তুমি আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা কর ঠাকুমা, আমি চাকরি পাওয়ামাএ তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। তুমি আর আমি থাকব।

দীপা যাই বলুক মনোরমার কোন পরিবর্তন ঘটল না। অঞ্জলি ব্যাপার্বটাকে যেন লক্ষ্যই করছিল না। এমন কি অমরনাথের কাজের ব্যাপারে সে যখন মনোরমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলুন। আমি আমাদের সাধ্যমত সব করার চেষ্টা করছি। মনোরমা তখন জবাব দিয়েছিলেন, তুমি যা ভাল বোঝ। তাই কব।

শ্ৰাদ্ধের কাজে যোগ দেবার জন্যে বাবুদের বাড়িতে গিয়ে ছেলেরা বলে এসেছে। বাজবি এবং অন্যান্যদের জানানো হয়েছে। দূরের আত্মীয়দের চিঠিতে সংবাদ জানানোবা কাজ সারা। কলকাতায় সুভাষচন্দ্ৰকে অঞ্জলি নিজে চিঠি লিখেছে। সুভাষচন্দ্র টেলিগ্রামে দুঃখ প্ৰকাশ করে জানিয়েছেন যে তাঁর শরীর এত খারাপ যে আসা সম্ভব হচ্ছে না। অঞ্জলি শ্রাদ্ধের দুদিন আগে দীপাকে বলল, তুই অফিসে গিয়ে সাহেবকে নেমন্তন্ন করে আয়।

আমি? আমি কখনও ওদিকে যাইনি।

যোইনি বলে কখনও যাবি না। এমন তো কথা নেই।

কি বলব?

আসতে বলবি। এখন ওই লোকটার ওপর সব নির্ভব করছে।

বড় হয়েছিস অথচ বাস্তবজ্ঞান হচ্ছে না কেন? তোর বাবার চাকরি যতদিন ছিল, অফিসে না গেলেও, এই বাড়িতে থাকার হক ছিল আমাদের। এখন তো যে কোন মুহূর্তে বলে দিতে পারে বাড়ি ছেড়ে দাও। অবশ্য যদ্দিন সব প্ৰাপ্য টাকা না হাতে দিচ্ছে তদ্দিন তাড়াতে পারবে না। কিন্তু দিয়ে দিলেই তো অন্য বাবুকে ঢুকিয়ে দেবে এখানে। যদি পারিস এ ব্যাপারে কথা বলিস একবার।

কি কথা বলব?

বড় খোকা পাস করা পর্যন্ত যদি এখানে থাকা যায়! অঞ্জলি মরীয়া হয়ে বলল। দীপা কিছু বলল না।

চা-বাগানের ভেতর দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে অফিস এবং ফ্যাক্টরির দিকে যাওয়া নিষেধ ছিল ছেলেবেলায়। দীপা সেই পথে ফ্যাক্টরির সামনে আসতেই মালবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আসার কারণ। দীপা উদ্দেশ্যটা জানাতেই নিজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিয়ে গেলেন অফিস বাড়িতে। গিয়ে বড়বাবুকে ব্যাপারটা বললেন। বড়বাবু দীপাংকে নিয়ে গেলেন বাডসাহেবের ঘরে।.পবিচয় করিয়ে দেবার পর বড়সাহেব ওকে বসতে বললেন। দীপা বসল।

বড়সাহেব বললেন, এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার। মিস্টার মুখার্জী এই চা-বাগানব অ্যাসেট ছিলেন। কোম্পানি তাঁর চিকিৎসাবি জন্যে সব রকম সহযোগিতা করবেছে কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ওয়েল, নিশ্চয়ই যাব আমি। কখন যেতে হবে? ভদ্রলোক কথা বলছিলেন যে ইংরেজিতে তার উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না দীপার।

দীপা বলল, এগারটা নাগাদ এলে ভাল হয়।

ঠিক আছে। তুমি তো কলকাতায় পড় দ্য কোন কলেজে?

স্কটিশ চার্চ।

আচ্ছা! ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি।

আমার থার্ড ইয়ার চলছে।

গুড। ঠিক আছে, আমি যাব।

শ্রাদ্ধের দিন যে ব্যাপারটা ঘটবে তা দীপা আন্দাজ করেনি। একগাদা মানুষের সামনে বড়সাহেব বড়বাবুকে দিয়ে অঞ্জলিকে ডেকে আনলেন। দীপা দাঁড়িয়েছিল! বন্ডসাহেব হিন্দীতে বললেন,  আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার ভাল লেগেছে! ও ইংরেজি বলতে এবং বুঝতে পারে। আমাদের কোম্পানিতে এখনও মেয়েদের ক্লার্ক হিসেরে নেওয়া হয়নি। ইন ফ্যাক্ট কেউ অ্যাপ্লাই করেনি। কিন্তু মিস্টার মুখার্জীর মেয়ে হিসেরে আমি ওর নাম হেড অফিসে সুপারিশ করব যাতে এখানে ওকে চাকরি দেওয়া হয়। ওর যা কোয়ালিফিকেশন তাতে কোন অসুবিধে হবে না। আপনারা আপত্তি আছে?

অঞ্জলি বিগলিত হন, আপনার দয়া। ওর চাকরি হলে আমরা বেঁচে যাব। এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

না, না। ও চাকরি করলে আপনাদের এখান থেকে কোথাও যেতে হবে না। বাডসাহেব দীপার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কালই আমাকে অ্যাপ্লিকেশন দিও।

দীপা কি বলবে বুঝে উঠছিল না। এই চা-বাগানে চাকরি করা মানে সমস্ত জীবন একটা কুয়োর মধ্যে আটকে থাকা। যে স্বপ্ন সে দেখছে তা থেকে লক্ষ মাইল ছিটকে যাওয়া। একটা কেরানির জীবন কি তার কামা? কখনই না। অমরনাথ বলেছেন, অনেক ওপরে উঠতে হবে, অনেক বড় হতে হবে তাকে।

বড়সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাবছ তুমি?

আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন গ্র্যাজুয়েট হই।

আচ্ছা! কিন্তু তুমি এখনই চাকরি করতে পার।

বাবার ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে।

ওয়েল, সেটা তোমার ব্যাপার। কতদিন লাগবে?

দু বছর।

আমি জানি না কোম্পানি এতটা দিন তোমাকে ডিস্টার্ব না করে থাকবে কিনা! দেখি, কি করতে পারি। তুমিও ভেবে দ্যাখো। সাহেব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন।

সেই রাত্রে তুমুল হল। অঞ্জলি যেন পাগল হয়ে গেল। প্রথম দিকে বোঝাতে চেয়েছিল ভাল কথায়, শেষে শ্লেষ এল গলায়, বিদ্যোধরী হবে। গ্র্যাজুয়েট হয়ে দুটো ডানা নেড়ে ঘুরে বেড়াবে? তখন কেউ দেবে চাকরি? তোমার বাবা এই করেই তোমাদের মানুষ করেননি? আমি কোন কথা শুনতে চাই না।

আমি আগে পড়াশুনা শেষ করব। আই এ এস দেব।

তাতে আমার কি হবে? আমি তো তখন পথে বসব। একটু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তোর। জন্ম দিয়ে মা মরে গেল, বাপ দায়িত্ব নিল না, আমরাই তোকে এত বড় করেছি, আর আমাদের দুদিনে তুই পাশে দাঁড়াবি না?

দীপা বলল, মা, যে টাকা পোস্ট অফিসে আছে, যা কোম্পানি থেকে পারে তাতে তোমরা তিন চার বছর বাড়ি ভাড়া করে ভালভাবে থাকতে পাববো। তিদিনে আমার চাকরি হয়ে যাবেই। আমাকে এই বদ্ধ জায়গায় সারাজীবন কাটাতে হবে না। তখন তোমরা আমার কাছে থাকতে পারবে।

বাঃ। সেই সময় যদি তোমার মতিগতি পাল্টে যায় তাহলে জমানো টাকা শেষ করে কোথায় দাঁড়াবো আমরা?

মতিগতি তো এখানে থাকলেও পাল্টাতে পারে।

না। এখানে তোমাকে মন্ত্রণা দেবার কেউ নেই। অঞ্জলি বলল, এখানকার সবাই জানবে তুমি বাবার জন্যে চাকরি পেয়েছ।

দীপা কোন জবাব দিল না। চা-বাগানের এই জীবন অমরনাথদের কি পছন্দ ছিল। কোন উচ্চাশা নেই, শুধু দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া! অসম্ভব। সে মরে গেলেও এখানে থাকতে পারবে না। তাকে অনেক বড় হতে হবে। এই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সে কি অকতজ্ঞ হচ্ছে? না। কখনই নয়। অঞ্জলির ব্যবহার যাই হোক সে কখনই কর্তব্য থেকে সরে যাবে না।

অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, চুপ করে কি ভাবছ?

বিড়সাহেবের কাছে তো আমি সময় চেয়েছি।

সময় যদি না দেয়?

তখন দেখা যাবে।

এটা তো পাশ কাটানো কথা। তোর ব্যাপার। কি বলতে v

কি ব্যাপারে?

কলকাতার কোন ছেলে কি তোর মাথা ঘুরিয়েছে?

কি যাতা বলছ?

ঠিকই বলছি। তোর মামা একবার লিখেছিল এমন কথা। শোন দীপা, যে ছেলের সঙ্গে তুমি ঘুরে বেড়াও সে মজা লোটা ছাড়া কিছু করবে না। যদি কুমারী হতে তাহলে হয়তো বিয়ে থা করত। চারধারে যখন এত কুমারী মেয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন সাধ করে কেউ বিধবাকে বিয়ে করে? ওসব মতলব ছেড়ে দে।

তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ মা। আমি যাই কবি কখনও অকৃতজ্ঞ হব না।

এই সরল স্বীকারোক্তিতে আস্থা পেল না অঞ্জলি। সমানে সে আক্রমণ চালিয়ে গেল কদিন ধরে। শেষপর্যন্ত ঘোষণা করল, ঠিক আছে, যদি দুই আড়াই বছর সাহেব অপেক্ষা না করে, যদি আমাদের এই বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করে তাহলে যেন এ জীবনে তোর মুখ আমাকে দেখতে না হয়। আমি লোকের বাড়িতে বাসন মেজে খাবো তাও ভাল তবু তোর পয়সায় মুখে ভাত তুলব না।

তুমি কি আমাকে এখনই চলে যেতে বলছ?

তোকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

বেশ, আমি চলে যাচ্ছি।

তাই তো যাবি। নিজের আখের গুছিযে চলে যাবি না?

আর তখন বড় ছেলে বলল, মা, তুমি কেন এত খোসামোদ করছি। দু বছর পারে আমি স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে যাব। তখন সাহেবকে বলব আমাকে চাকরি দিতে।

এই বিতর্কে মনোরমা অংশ নিলেন না। তিনি যেন এসব ব্যাপারের অনেক উর্ধের্ব চলে গিয়েছেন। যে দিন দীপা কলকাতায় যাবে তার আগের রাত্রে তিনি কথা বললেন, দীপা, তোর মনে আছে, অনেকদিন আগে তেজেনবাবু আমাকে নিয়ে হরিদ্বার যেতে চেয়েছিলেন। তোর বাবা অভিমান করেছিল, আমি যেতে চাইনি!

মনে আছে। খুব মজা হয়েছিল। দীপা বলল।

এখন মনে হয় তখন গেলে পারতাম।

কেন?

যদি সেই মানুষটার দেখা পেতাম তাহলে বলতাম আমার এত বড় সর্বনাশ কেন করল?

কে?

যে একটা রাত্রে এসেছিল দায় মেটাতে।

ঠাকুমা!

হ্যাঁ রে। যে সন্ন্যাসী সে তো সংসারের কাছে মৃত। আমার কাছেও। আমার বৈধব্য তাই সত্যি। কিন্তু সেই মানুষটা তো বেশ বেঁচে আছে।

তুমি তো কখনও সেটা স্বীকার করোনি।

স্বীকার করলে তোর বাবা খুব কষ্ট পেত।

ঠাকুমা, তুমি আমার সঙ্গে হরিদ্ধারে যাবে?

কেন?

ওঁকে খুঁজতে।

হিমালয় তো এট্টুসখানি জায়গা নয়। এত বড় একটা পর্বতে কাউকে খুঁজতে যাওয়া বোকামি। মনোরমা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর দুহাতে দীপাকে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে বললেন, মা গো, জীবন হিমালয়ের চেয়ে অনেক বড়। সেখান থেকে যেটা খুঁজে নিতে চাইবি সেটা খুঁজবি আন্তরিকভাবে। কারো সঙ্গে আপোস করবি না। আমার বয়সে কিছু খোঁজা যায় না, খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু তোর বযসটা ঠিকঠাক খোঁজাব বয়স।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *