বেশ তাড়াতাড়িই শীত পড়ে গেছে এবার। সকালের রোদ্দুর বড় মধুর লাগে। এ বাড়িতে কাবুল নামে একটা ছোঁকরা চাকর আছে, সে কোথা থেকে যেন প্রত্যেক ভোরবেলা জোগাড় করে আনে এক কলসী খেজুরের রস। কী ঠাণ্ডা আর সুস্বাদু সেই রস, এর তুলনায় কোথায় লাগে বোতলের মিষ্টি পানি!
কিন্তু মামুনের দিদির ছেলেমেয়েরা অনেকেই এই রস খেতে চায় না। তাদের নাকি কী রকম গন্ধ লাগে! মামুন শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়! ছেলেমেয়েগুলো একেবারে শহুরে হয়ে গেল! ওরা কোকা কোলার খুব ভক্ত। এই মার্কিন পানীয় একেবারে দেশ ছেয়ে ফেলেছে। প্রথম প্রথম যখন আসে, তখন লোকে কত রকম ভাবেই না উচ্চারণ করতো এই নাম, খোকা কোলে, চোচা চুলা, কোচা খোলা, চোকা চোলা আরও কত কী! মামুন নিজে দু-এক বার খেয়ে দেখেছেন, এমন কিছু আহা মরি স্বাদ পান নি।
মার্কিন জিনিসপত্রে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। মার্কিনী সিনেমার প্রভাবে মার্কিনী ধাঁচে পোশাক-আসাক পরতে শুরু করেছে যুবক-যুবতীরা। গ্রামের নব্বই ভাগ মানুষ এখনো দু’বেলা খেতে পায় না, আর শহরের মানুষ বিদেশ থেকে আমদানি করা বিস্কুট দিয়ে চা খায়।
মামুনের মেয়ে হেনা অবশ্য রস ভালোবাসে। ফুটফুটে সুন্দর মুখোনি তার, সে মায়ের রং পেয়েছে, সবাই তার গাল টিপে আদর করে বলে, ঠিক পুতুলের মতন! এই কথাটা বারবার শুনতে শুনতে মামুন ভাবেন, বেশির ভাগ মানুষেরই কল্পনা শক্তি কত কম। সবাই ‘পুতুলের মতন’ বলে কেন, মানুষকে পুতুলের মতন দেখতে হলে কী সুন্দর বোঝায়?
এ বাড়িতে হেনার কাছাকাছি বয়েসের আরও ছেলেমেয়ে থাকলেও সে বেশির ভাগ সময় বাবার কাছ ঘেঁষে থাকে। রাত্তিরে বাবার সঙ্গেই শোয়। দিনের বেলা মামুন বাইরের ঘরে। অন্যদের সঙ্গে গল্প করার সময়েও হেনা বারেবারেই একটা পড়ার বই নিয়ে ছুটে আসে, বলে, আব্ব, এই কথাটার মানে বলে দেন!
সকালবেলায় মামুন হেনা আর তার সমবয়েসী বাবলিকে নিয়ে বেড়াতে বেরোন। হাঁটতে হাঁটতে চলে যান বেশ অনেকটা দূরে, ফেরেন রিকশাতে। ঢাকা শহরটাকে যেন তিনি নতুন করে চিনছেন।
একদিন সকালে মঞ্জু বললো, মামু, আমি একটু যাবো আপনার সাথে?
মামুন বললো, হ্যাঁ, চল না!
মঞ্জু বললো, আপনি তাহলে একটু আম্মুকে বলেন। আমি চাইলে আম্মু মত দেবে না।
মামুন দিদিকে জানিয়ে মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে বেরুলেন। একটা আকাশী নীল শাড়ী পরেছে মঞ্জু, সেই রঙের ব্লাউজ, চোখে সূক্ষ্ম সুমা টানা, কপালে একটা লাল টিপ। প্রাতঃভ্রমণের পক্ষে একটু বেশিই সাজগোজ মনে হয়। মামুন মনে মনে হাসলেন। মঞ্জুর নিশ্চয়ই একটা কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। মামুনের দিদির বাড়ি অনেক ব্যাপারে প্রগতিশীল হলেও বাড়ির মেয়েদের এখনো একা রাস্তায় বেরুবার অনুমতি দেওয়া হয় না। কলকাতার রাস্তায় যেমন মেয়েদের হাঁটতে দেখা যায়, ঢাকায় এখনো সে রকম নয়।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মামুন ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিকে যাবো, বিলকিসবানু?
মঞ্জু কিছু বলার আগেই হেনা বললো, আব্ব, নদীর দিকে চলেন।।
বুড়ি গঙ্গার ঘাটে অনেক নৌকো বাঁধা থাকে, বড় বড় স্টিমার ভোঁ ছাড়ে, একদিন সেইসব দেখে হেনার খুব পছন্দ হয়েছিল।
মঞ্জু বললো, না, না, ওদিকে না, ধানমণ্ডির দিকে যাবো, ওদিকে সুন্দর সুন্দর বাগান আছে।
মামুন আবার মুচকি হাসলেন। তিনি ঠিকই ধরেছেন। শহীদ পলাশরা ঐ ধানমণ্ডিতেই এক বাড়িতে উঠেছে। গত তিন-চারদিন শহীদরা এদিকে আসে নি, এর মধ্যেই কিছু ঘটেছে নাকি? কাল সারাদিন দিদির মুখখানা ভার ভার দেখাচ্ছিল। কলকাতার ছেলেরা আবার বেশি। বাড়াবাড়ি করে ফেলে নি তো?
মামুন মঞ্জুকে তবু বললেন, কেন, চল না, নদীর দিকেই যাই!
মঞ্জু করুণ মুখ করে বললো, না মামু, ধানমণ্ডির দিকে গেলেই ভালো লাগবে, চলেন না, দেখবেন কত নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে।
–অতদূর হেঁটে যেতে পারবি, না রিক্শা লাগবে?
–হেঁটেই যাবো!
মঞ্জু একা কখনো রাস্তায় না বেরুলেও সে রাস্তা চেনে। সে-ই পথ দেখিয়ে আগে আগে চললো।
এক সময় ঢাকায় ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা ছিল প্রচুর। টাঙ্গাচালক কুট্টিরা ছিল এক চতুর প্রজাতি। কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ছিল তাদের, অবশ্য তাদের অনেক রসিকতাও ফিরতে লোকের মুখে মুখে। স্বাধীনতার পর সেই কুট্টিরা দ্রুত অপসৃত হয়ে গেল, তাদের জায়গায় এসেছে সাইকেল রিক্শা। রাস্তা একেবারে ভরে গেছে সাইকেল রিক্শায়। এদের জন্য সহজে রাস্তা পার হওয়া যায় না। তবু কলকাতার মানুষ-টানা রিশার চেয়ে এই রিশা অনেক ভালো। মামুনের মনে আছে, তাঁর ছাত্র বয়েসে কলকাতার অধিকাংশ রিকশা টানতো বিহারী মুসলমানরা। মামুন কক্ষনো কলকাতায় রিকশা চাপতেন না!
মঞ্জু বেশি তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, সে আর ধৈর্য ধরতে পারছে না বোধহয়, মামুন এগিয়ে তার পাশে গেলেন। মঞ্জুর সরল মুখোনিতে ব্যগ্রতা আর অস্থিরতা মাখানো। তার চোখ দুটি ছুটন্ত হরিণীর মতন। ছুটন্ত হরিণীর চোখ কেমন হয় মামুন কখনো দেখেন নি, তবু এই উপমাটাই মনে পড়লো তাঁর। মঞ্জুর মুখের সঙ্গে হরিণীর মুখের একটু মিল আছে ঠিকই।
–কি রে, মঞ্জু, তুই এখনো কলকাতায় গিয়ে কলেজে পড়ার বায়না ধরে আছিস নাকি?
মঞ্জু তার টলটলে চোখ দুটি মামুনের দিকে ফিরিয়ে বললো, জী!
–তুই তো বড় জেদী মাইয়া দেখি! কেন, কলকাতার ওপরে তোর এত টান কেন?
–আমার ইচ্ছা করে।
মঞ্জুর ওপর মামুনের যথেষ্ট স্নেহ থাকলেও তিনি তার এই ইচ্ছেটা সমর্থন করতে পারছেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুসলমানরা তাদের দাবি মতন পাকিস্তান পেয়েছে, এখন এখানকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে বিদেশে যাবে কেন? এ দেশে কি ইস্কুল কলেজ নেই। উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে হয় তো সে আলাদা কথা! তবু, এ দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ছেলেমেয়েদের সামান্য স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার জন্যই পাঠাচ্ছে বিলেত-আমেরিকায়। ফরেন এক্সচেঞ্জের শ্রাদ্ধ হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানী বড়লোকরা তো পাঠাচ্ছেই, বাঙালীদেরও উৎসাহের কমতি নেই। মুখে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য কত দরদ, কিন্তু নিজের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবার জন্য একেবারে পাগল! যাদের বিলেত-আমেরিকায় পাঠাবার সামর্থ্য নেই, তারা ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছে ইণ্ডিয়ার পাবলিক স্কুলে, দার্জিলিং-এ, আজমীরে। মামুনের পরিচিত, আওয়ামি লীগের প্রথম সারির নেতা আতাউর রহমান খানই তো তাঁর দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন শিলং-এ।
মামুন গলায় অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্য এনে বললেন, না মামনি, যদি পড়তে চাও, তোমাকে ঢাকাতেই পড়তে হবে।
মঞ্জু বললো, আমি আরও কেন ঢাকায় পড়তে চাই না জানেন? এখানে থাকলে আমার পড়াই হবে না!
–কেন, ঢাকায় কি অন্য মেয়েরা পড়ছে না? কত মেয়ে এখান থেকে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে বেরিয়েছে।
–আপনি আমাদের বাড়ির মানুষদের চেনেন না। যেদিন থেকে আমি শাড়ী পরতে শুরু করেছি, সেদিন থেকে আমার নানা-নানীরা আমার…
বলতে বলতে থেমে গেল মঞ্জু। লজ্জায় তার গালদুটিতে অরুণাভা এলো, আবার চোখের কোণেও যেন অশ্রু চিক চিক করলো।
মামুন তার মাথায় হাত রেখে বললেন, সবাই বিয়ের কথা বলেন তো? বিয়ের পরেও তো তুই লেখাপড়া করতে পারিস!
মঞ্জু মুখ ফিরিয়ে বললো, না!
মামুন একটু অবাক হয়ে গেলেন। মঞ্জু বিয়ে করতে চায় না? সতেরো বছর বয়েস হয়েছে, এই বয়েস থেকেই তো মেয়েরা বিয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শহীদ বলে ছেলেটার সম্পর্কে ওর যে টান হয়েছে, সেটা কি অন্য কিছু?
পর মুহূর্তেই মামুন আত্মসমালোচনা করলেন। তিনিই বা কেন মঞ্জুর এক্ষুনি বিয়ে দিয়ে। দেওয়ার ব্যাপারটা সমর্থন করছেন? তিনি কি মনে মনে বুড়োটে হয়ে গেছেন! এই বয়েসী মেয়ের তো আরও কত রকম স্বপ্ন থাকতে পারে! মঞ্জুর নানা-নানীর দলের পক্ষ নেওয়া তো তাঁকে মানায় না!
ধানমণ্ডিতে এসে মঞ্জু ঠিক স্থির লক্ষ্যেই চললো। সোজা একটি বাড়ির সামনে এসে থেমে বললো, মামু, এইটা হোসেনচাচার বাড়ি। আপনি হোসেনচাচারে চেনেন না?
মামুন তাঁর জামাইবাবুর আত্মীয় শাখাওয়াত হোসেনকে একটু-আধটু চেনেন। মঞ্জুর কথা শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, এখন এই বাড়ির মধ্যে যাওয়াই তাঁর কর্তব্য।
বাড়ির দরজার কাছে যাবার আগেই সে বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে একটি যুবক চেঁচিয়ে বললো, মঞ্জু এসো, এসো!
মামুনের বুকটা একবার ধক করে উঠলো। ছেলেটি শহীদ নয়, পলাশ। এত সকালে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে! সে কি জানতো যে মঞ্জু আজ সকালে আসবে? আগে থেকে ওদের মধ্যে কথা হয়ে ছিল! শহীদ কোথায়? তিনি ভেবেছিলেন, শহীদের সঙ্গেই মঞ্জুর মনের আদান প্রদান হয়েছে! তা হলে কি মঞ্জুর মনের মানুষ শহীদ নয়, পলাশ? এই ছেলেটির গানের গলা। ভালো। এ সেদিন মঞ্জুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছিল। মঞ্জু যদি এরকম একটা সাংঘাতিক ভুল করে বসে, তা হলে তার পরিণতি কী হবে?
আবার মামুন আত্মসমালোচনা করলেন। সত্যিই কি তিনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? এতকাল তিনি নিজেকে মানবতাবাদী মনে করতেন, তাহলে তিনি শহীদ আর পলাশের মধ্যে তফাত করছেন কেন? দু’জনেই যুবক, দু’জনেরই মঞ্জুর প্রেমিক হবার যোগ্যতা আছে, তবু তিনি পলাশকে অপছন্দ করছেন, সে হিন্দু বলে?
মামুন নিজেই এর উত্তর তৈরি করে মনকে বোঝালেন, আমার পছন্দ-অপছন্দে তো কিছু আসে যায় না! মঞ্জুর মনের মানুষ যদি শহীদের বদলে পলাশ হয়, তা হলে দু’পক্ষেই অনেক গোলমালের সৃষ্টি হবে! মঞ্জু তা সহ্য করতে পারবে তো?
দরজা খুলে দিল পলাশ, কিন্তু সে একা নয়, শহীদকেও ডেকে এনেছে। যুবক দুটি মঞ্জুর দিকে নজর না দিয়ে মামুনকেই বেশি খাতির করে বললো, আসুন, মামুনমামা, আসুন।
মামুন তবু অস্বস্তি বোধ করলেন। শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় যৎসামান্য। বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে এরকম হুট করে তাঁর বাড়িতে এসে পড়া মামুনকে মানায় না। বিশেষত এত সকালে। এখন এরা নিশ্চয়ই নাস্তা করে যেতে বলবেন। এই বয়েসে তিনি কি প্রেমের দূতিয়ালির ভূমিকা নিচ্ছেন?
শহীদ বললো, মামুনমামা, আমরা গোয়ালন্দ গিয়েছিলুম। দারুণ লাগলো।
পলাশ বললো, স্টিমারে করে রিভারজার্নি, একেবারে ফ্যান্টাস্টিক! আমার তো এরকম কোনো এক্সপিরিয়েন্স আগে কোনোদিন হয় নি। মঞ্জুকে কত করে বললুম আমাদের সঙ্গে যেতে!
মামুন আড় চোখে তাকালেন মঞ্জুর দিকে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে আছে শহীদের দিকে। একেবারে নিষ্পলক দৃষ্টি।
মামুনের আবার খটকা লাগলো। তবে কি একটু আগে তিনি ভুল বুঝেছিলেন? পলাশ যে-ভাবে দোতলার বারান্দা থেকে মঞ্জু মঞ্জু বলে চেঁচিয়ে উঠলো, এদিককার কোনো ছেলে কোনো অনাত্মীয় মেয়েকে ওরকমভাবে ডাকে না। পলাশের ঐ অতি-আগ্রহ, তা কি নিজের জন্য নয়, বন্ধুর জন্য?
মামুনকে বাইরের বসবার ঘরে বসিয়ে মঞ্জু চলে গেল অন্দরমহলে। দু’চার কথা বলে পলাশ আর শহীদও সরে পড়লো। হেনা আর বাবলি বসে রইলো মামুনের গা সেঁটে।
মামুন ওদের বললেন, যা, ভিতরে যা, দিদির সঙ্গে যা!
হেনা আর বাবলি যেতে চায় না। ওরা শিশু হলেও বুঝেছে যে মঞ্জু আপা এখন ওদের দিকে মনোযোগ দেবে না। অচেনা বাড়িতে ওরা আর কার কাছে যাবে?
একটু পরেই চটি ফটফটিয়ে শাখাওয়াত হোসেন এলেন সেই ঘরে। এককালে রোগা পাতলা ছিলেন, এখন বিরাট হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। পরনে সিল্কের লুঙ্গি আর একটা বেশ দামি শাল। হোটেলের ব্যবসায় তিনি রাতারাতি ধনী হয়েছেন, এতবড় বাড়ির মালিক হয়েছেন মাত্র দু’বছরের মধ্যে, জাপানী গাড়ি কিনেছেন।
মামুনকে সাদর সম্ভাষণ করে তিনি বললেন, কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য, আপনার মতন মানুষ পায়ের ধূলি দিয়েছেন আমার বাড়িতে! কী সংবাদ কন? আপনার কোন সেবায় লাগতে পারি?
সত্যিকারের অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়লেন মামুন। অসময়ে কারুর বাড়িতে এলে এটা ভাবাই তো স্বাভাবিক যে কোনো জরুরি কথা আছে। ওঁর সঙ্গে মামুনের এমন কিছু বন্ধুত্বও নেই যে বলবেন, এমনিই আপনার খবর নিতে এলাম। মঞ্জু তাঁকে সত্যি বিপদে ফেলে দিয়েছে।
আমতা আমতা করে মামুন বললেন, অনেকদিন পরে দেখা হলো। আপনার শরীর কেমন?
হোসেন সাহেব বললেন, পেচ্ছাপে একটু চিনি হয়েছে, তা ছাড়া এমনিতে ভালোই আছি। আপনি কেমন?
মামুন বললেন, আমার ব্লাড পেশার কিছুটা হাই। তবে ওষুধপত্তর কিছু খাই না। থানকুনি পাতার রস খাই। আপনিও খেয়ে দেখতে পারেন, ওতে শুগারও কমে।
হোসেন সাহেব সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন। এই সকালবেলা বাড়ি বয়ে মামুন কি এইসব আলোচনা করার জন্য এসেছেন?
মামুনও বুঝতে পারলেন, তাঁর বোকামি হচ্ছে। কিন্তু তিনি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতন একটা নাম মনে পড়লো। আলতাফ! আলতাফের কাছে বেশ কয়েকবার তিনি শাখাওয়াত হোসেনের নাম শুনেছেন। আলতাফদের সঙ্গে এর কী যেন একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে। একে আলতাফ হোটেলওয়ালা হোসেন বলে উল্লেখ করেছিল।
মামুন এবারে খানিকটা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আলতাফের কাছে আপনার অনেক কথা শুনেছি।
কিন্তু এর ফল হলো বিপরীত। হোসেন সাহেবের ভুরু আরও কুঁচকে গেল। তিনি নীরস গলায় বললেন, আলতাফ মানে, আমার ভাইয়ের ব্যাটা আলতাফ? তারে আপনি চেনলেন ক্যামনে?
–সে মাদারিপুরে আমার বাড়িতে গিয়েছিল। খুব ভালো ছেলে।
–সেডারে তো আমি দুই চক্ষে দ্যাখতে পারি না। সে কী কইছে আমার সম্পর্কে?
–আপনার অনেক প্রশংসা করছিল।
–কিন্তু তার সাথে তো আমি কোনো সম্পর্ক রাখি না। আমার বাড়িতেও তারে আসতে মানা করছি।
–সে কি? কেন? আমার তো ছেলেটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে।
–আপনি তা হলে ওদের ভালো করে চেনেন না। ওরা পাকিস্তানের দুশমন। ঐ সব মতিচ্ছন্ন ছেলেদের জেলে ভরে রাখা উচিত।
–কিন্তু আপনি ওদের পার্টি ফাণ্ডে মোটা চাঁদা দিয়েছেন শুনেছি। মাঝে মাঝেই দ্যান।
তা দেই, সে অন্য কথা। ব্যবসা করে খেতে হয়, তাই চান্দা দিতে হয়। আপনিও ওদের দলে আছেন নাকি? ওরা তো কমুনিস্ট!
মামুন দুর্বল ভাবে হেসে বললেন, না, এটা বোধহয় আপনি ঠিক বলছেন না। ওরা তো যুব লীগ করে।
হোসেন সাহেব জোর দিয়ে বললেন, শোনেন, আপনারে আমি বুঝয়ে বলি। বরিশালে কমুনিস্টদের স্থানীয় জনসাধারণ পিট্টি দিয়েছিল, সে কথা জানেন তো? এখন কমুনিস্টগুলা আণ্ডার গ্রাউণ্ডে গেছে। ওদের মধ্যে অনেক হিন্দু আছে, তারাই আলতাফের মতন বলদগুলারে ক্ষ্যাপায়। এখন ওরা তলে তলে সব আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওদের জন্যই তো আওয়ামি মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম কথাটা বাদ হয়ে গেল!
মামুন এবারেও ক্ষীণ আপত্তি করে বললেন, মৌলানা ভাসানী নিজেই তো ঐ প্রস্তাব করেছেন। আসলে ব্যাপার কী জানেন, মুসলিম লীগের সঙ্গেই তো আমাদের লড়তে হবে, তাই আওয়ামি দলেও মুসলিম নামটা থাকলে কনফিউশান হয়।
–শুধু এই জন্য?
–তা ছাড়া, দলটার একটা অসাম্প্রদায়িক চেহারা হলে সংখ্যালঘুদেরও দলে পাওয়া যাবে। দল আরও শক্তিশালী হবে।
–আমি আপনাকে বলি, শুনে রাখেন, ঐ বুড়া ভাসানীও একটা কমুনিস্ট!
মামুন একথায় হেসে উঠলেন। হোসেন সাহেবের মুখোনি কিন্তু অতি কঠোর হয়ে আছে। তিনি হাসির উত্তর না দিয়ে বললেন, ওদের হাতে পাওয়ার গেলে পাকিস্তানের সর্বনাশ হবে। যারা এখানে বসে সেকুলারিজমের কথা বলে তারা পাকিস্তানের দুশমন। পাটিশান হইল ক্যান? আবার কি আপনারা ইণ্ডিয়ার সাথে মার্জ করতে চান? সত্য করে বলেন তো!
–না, মোটেই তা চাই না! সে প্রশ্নই ওঠে না।
–তবে! তাইলে এইসব কথা ওঠে কী ভাবে? আপনারা বাঙালী বাঙালী রব তোলেন, শুনে আমার গা জ্বলে যায়। বাঙালী হয়ে এতকাল তো আমরা হিন্দুদের হাতে কচুপোড়া খেয়েছি। এখন আমাদের হতে হবে প্রকৃত পাকিস্তানী।
মামুন এমন তর্কের মধ্যে যেতে চান না। আলতাফের প্রসঙ্গ তুলে তো আরও বিপদ হলো! হোসেন সাহেবের মতন মানুষ তিনি আরও দেখেছেন। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য হাতে পেয়ে যারা হঠাৎ বড়লোক হয়েছে, তারা এখন মুসলিম লীগের কট্টর সমর্থক।
কথা ঘোরাবার জন্য তিনি বললেন, আপনার বাড়িতে ইণ্ডিয়া থেকে গেস্ট এসেছে। দেখলাম।
হোসেন সাহেব বললেন, হ্যাঁ। কলকাতায় আমার কিছু প্রপার্টি আছে, ওরা দেখাশুনা করে।
–কলকাতায় গেছেন নাকি এর মধ্যে?
–গেছি দুই তিন বার।
–আমি স্বাধীনতার পর আর কলকাতায় যাই নাই। কেমন দেখলেন কলকাতার অবস্থা?
–খুব খারাপ। তারচেয়ে আমাদের ঢাকা শহর অনেক ভালো। দেখবেন, আর কিছুদিনের মধ্যে কলকাতা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের ঢাকার আরও উন্নতি হবে।
এরপর আবার মামুন কথা খুঁজে পেলেন না। কী ভাবে আলাপ চালিয়ে যাবেন বুঝতে পারছেন না।
হোসেন সাহেব কিস্তু ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কাজের মানুষ, সুতরাং তিনি ধরেই নিয়েছেন যে মামুনও কোনো কাজের কথা বলার জন্যই এসেছেন।
তিনি মামুনের চোখে চোখ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বলেন?
মামুন ভাবলেন, এবারে আত্মসমর্পণ করাই ভালো। সত্যি কথাটা বলে ফেললেই অস্বস্তিমুক্ত হওয়া যায়।
তিনি বললেন, ভোরবেলা বেড়াতে বেড়াতে এইদিকে এসেছিলাম। আপনাদের এদিকে সুন্দর সুন্দর নতুন বাড়ি উঠেছে। আমার আপার মেয়ে মঞ্জু, তাকে চেনেন তো, সে বললো, একবার আপনার বাড়িতে কার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবে, তাই আমিও…।
হোসেন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে কাঠিন্যের আবরণটা সরিয়ে ফেলে বললেন, এ তো আমার সৌভাগ্য! আপনি নিজে থেকে এসেছেন…কী খাবেন বলেন।
মামুন বললেন, এখন কিছু খাবো না, এক কাপ চা।
–সে কি, গরিবের বাড়িতে এসেছেন, সামান্য কিছু নাস্তা করবেন আমাদের সঙ্গে। এই ছোট মেয়েদুটিরে এখানে বসায়ে রেখেছেন কেন? ওদের দেখি মুখ শুকায়ে গেছে! এই আবদুল–
এর পর তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আপ্যায়নের জন্য। শুরু করে দিলেন হাঁক ডাক। হোসেন সাহেব ব্যস্ত মানুষ, একটু পরেই তাঁর বেরুবার কথা ছিল, কিন্তু অতিথি সৎকারের জন্য তিনি খানিকটা সময় নষ্ট করতেও দ্বিধা করলেন না।
প্রথমে একবার চা এলো। তারপর হোসেন সাহেব মামুনের সামনেই নামাজ পড়তে বসলেন। বিশেষ বিশেষ উৎসব ছাড়া মামুন প্রতিদিন নামাজ পড়েন না। এখন তিনি শাখাওয়াত হোসেনের ব্যক্তিত্বের সামনে একটু কাচুমাচু হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, এই অবস্থায় তাঁর চুপ করে বসে থাকা ভালো দেখায় না। তিনিও নামাজ পড়তে বসে গেলেন।
নাস্তা শেষ করার পর মঞ্জু এসে বললো, মামু, ওরা গাড়ি করে সোনার গাঁওয়ে যাচ্ছে। আমাকেও যেতে বলছে সাথে। আমি যাবো?
মামুন চমকে উঠলেন। মঞ্জু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না? এখন সোনার গাঁও গেলে ফিরতে অনেক দেরি হবে। দিদি যদি রাগ করেন? দিদির বাড়িতে কী নিয়ম তিনি জানেন না ঠিক। তিনি মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, দায়িত্ব তাঁর।
তিনি বললেন, না মামণি, এখন বাড়ি চলো। অন্যদিন যেও!
মঞ্জুর মুখখানা ম্লান হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। শহীদ বললো, কেন মামা, ও চলুক না আমাদের সঙ্গে। দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসবো।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ ‘সোনার গাঁও যাবে কেন?
–এমনিই বেড়াতে যাবো। কাদের ভাই বলছেন, গাড়িটা পাওয়া যাবে। মঞ্জুকে আমরা বাড়ি পৌঁছে দেবো।
–আর কে কে যাবে?
–আমরা সবাই যাবো। নাদেরা যাবে, মনিরা যাবে…।
হোসেন সাহেব ওপরে উঠে গেছেন, অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরা মামুনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। মামুন আবার মঞ্জুকে দেখলেন।
তিনি একটু দৃঢ় হয়ে বললেন, না, বাড়িতে বলে আসা হয় নাই, মঞ্জুর না যাওয়াই ভালো।
পলাশ খুব সহজ সমাধানের ভঙ্গিতে বললো, আপনি তো বাড়িতে ফিরছেন। আপনি। বাড়িতে জানিয়ে দেবেন। আমাদের গাড়িতে মঞ্জুর জায়গা হয়ে যাবে!
ব্যাপারটা তো এত সহজ নয়। তাঁর দিদি-জামাইবাবু কী ভাবে এটা গ্রহণ করবেন, তা মামুন জানেন না।
মামুনের মনটা দু’ভাগ হয়ে গেল। একদিকে তিনি মঞ্জুর গুরুজনশ্রেণীর এবং অভিভাবক। অন্যদিকে তিনি কবি মামুন। কয়েকটি অল্প বয়েসী ছেলেমেয়ে এই চমৎকার শীতের সকালে গাড়ি চেপে হইচই করে বেড়াতে যাবে, কবি মামুন হিসেবে এতে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কী দোষ আছে এতে? খানিকটা বেহিসেবী উচ্ছলতাই তো যৌবনের স্বভাবধর্ম। আবার অভিভাবক হিসেবে তাঁর মনে হচ্ছে, বিবাহযোগ্যা মেয়েকে এরকম যখন তখন ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।
শহীদ আর পলাশরা পীড়াপীড়ি করতে লাগলো বারবার। শেষ পর্যন্ত মামুন সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে, যা। দিদিকে আমি বুঝিয়ে বলবো। হেনা আর বাবলিকেও সঙ্গে নিয়ে নে!
মঞ্জুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। শহীদ আর পলাশ একসঙ্গে বলে উঠলো, হুররে! মঞ্জুর খুশী মুখ দেখে মামুন ভাবলেন, তিনি রাজি না হলে মেয়েটা সারা দিন মন-মরা। হয়ে থাকতো!
হেনা আর বাবলিকে সঙ্গে নিতে ওরা রাজি, কিন্তু হেনা তার বাবাকে ছেড়ে যেতে চায় না। বাবলি যাবে।
মেয়েকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন মামুন। হোসেন সাহেবের বাড়ির সামনে দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। দুটিই হোসেন সাহেবের নাকি? হোটেলের ব্যবসায় খুব লাভ হয়। বর্তমান অবস্থায় হোসেন সাহেব অতি দ্রুত ধনাঢ্য হচ্ছেন, সুতরাং তিনি দেশের বর্তমান অবস্থাটাই বজায় রাখতে চাইবেন, এতে আর আশ্চর্য কী! তিনি কথায় কথায় জানিয়েছেন, খুব শিগগির তিনি করাচীতেও একটি হোটেল খুলবেন। পশ্চিম পাকিস্তানী অনেক সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর বেশ দহরম-মহরম আছে।
একটু দূরে এসে মামুন সাইকেল রিকশা ধরার জন্য দাঁড়ালেন। এখন অধিকাংশ রিকশাতেই সওয়ারি।
একবার তিনি পেছন ফিরে দেখলেন, হোসেন সাহেবের বাড়ির সামনে একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে গল্প করছে মঞ্জু আর পলাশ। শহীদ কাছাকাছি নেই। পলাশের কী একটা কথায় মঞ্জু হাসতে হাসতে সারা শরীরটা দোলাতে লাগলো।
শহীদ না পলাশ, কার দিকে বেশি ঝুঁকেছে মঞ্জু? সে কোনো বিপজ্জনক পথে পা বাড়াচ্ছে না তো! কলকাতায় যাওয়ার চিন্তাটা তার মাথা থেকে একেবারে ঘুচিয়ে দিতে হবে। ওরা এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে হেসে হেসে গল্প করার বদলে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসুক না।
শহীদের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়ের প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? শহীদ ছেলেটি বেশ। হ্যাঁ। বাড়ি ফিরেই দিদিকে বলতে হবে এই কথাটা। তা হলেই সব ব্যাপারটা সুষ্ঠু হবে। শহীদদের ব্যবসা আছে কলকাতায়, ইচ্ছে করলে সে এদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এখানেও ব্যবসা শুরু করতে পারে।
সাইকেল রিকশা ডেকে উঠতে গিয়ে মামুন আবার হাসলেন আপন মনে। নিজের সম্পর্কেই খানিকটা বিদ্রূপের হাসি। হঠাৎ বিয়ের ঘটকালি করার জন্য তাঁর এত ঝোঁক হলো কেন তা তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না।