ঢাকার সেগুনবাগানে মামুনের এক দিদির বাড়ি। তাঁর দুলাভাই শামসুল আলম একজন সম্পন্ন উকিল। আলম সাহেব যেমন দিলদার তেমনই মজলিশী, তাঁর বাড়িতে গানবাজনা আর খাওয়া-দাওয়ার উৎসব লেগেই আছে। মাদারীপুর থেকে ঢাকা এসে মামুন উঠলেন তাঁর এই দিদির বাড়িতে। সঙ্গে তার সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে হেনাকে নিয়ে এসেছেন, এই মেয়েটি তাঁর বড় আদরের। ফিরোজাও প্রায় জোর করে হেনাকে স্বামীর সঙ্গে পাঠিয়েছেন। তিনি বুঝেছেন যে মামুন আবার রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠতে, অথবা জেল খাটতে যাচ্ছেন। সঙ্গে মেয়েটা থাকলে তবু হয়তো খানিকটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করবেন।
মামুনের দিদি মালিহার মোট এগারোটি সন্তান, তাদের মধ্যে দু’জন অকালে প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িটি যেন একটি বড় গাছ, যেখানে সব সময় শোনা যায় পাখিদের কলরব। শিশুদের সংসর্গ মামুনের ভালো লাগে, ওদের সঙ্গে কৌতুকে মেতে উঠলে মনের মেঘ কেটে যায়।
প্রথম কিছুদিন মামুন বাড়িতে বসেই কাটালেন। আলতাফের পীড়াপিড়িতেও তিনি পার্টি মিটিং-এ যেতে চাইলেন না, আগে অবস্থাটা বুঝে নিতে চান। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর প্রায় বছর চারেক তিনি রাজনীতি থেকে বিযুক্ত ছিলেন। রাজনীতি এমনই এক ব্যাপার যে একবার দূরে সরে গেলে ফাঁক ভরাট হয়ে যায়, ফিরে এসে নিজের জায়গাটা খুঁজে পাওয়া শক্ত হয়। একসময় মামুন প্রথম সারিতে চেয়ার পেতেন, এখন তিনি তৃতীয় বা চতুর্থ সারিতে স্থান পাবেন কিনা তাও জানেন না।
এ বাড়িতে প্রায়ই গানবাজনার আসর বসে, সঙ্গীত-প্রিয় মামুন এখানে এসে দিন দিন যেন চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগলেন। ফিরোজার আপত্তির জন্য তাঁর নিজের বাড়িতে গানবাজনার চর্চা একেবারে প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।
অনেক গণ্যমান্য মানুষও আসেন এখানে, যাঁদের সাহচর্য মামুনকে প্রেরণা দেয়। আসেন কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ শহীদুল্লা, গোবিন্দচন্দ্র দেব-এর মতন পণ্ডিতেরা।
মোতাহার ভাই-এর সঙ্গে মামুনের অনেক দিনের পরিচয়। তিনি এলেই কাজী নজরুলের গল্প শুরু হয়ে যায়। নজরুল যখন সৃষ্টিশীল, প্রাণবন্ত ছিলেন তখন এই মোতাহার হোসেনের বাড়িতে উঠেছেন একাধিকবার। নজরুল খুব ভালবাসতেন একে। আদর করে ডাকতেন মোতিহার।
নজরুল এখন জড়, বাক্যহীন বলেই তাঁর আগেকার কাহিনী শুনতে বেশি ভালো লাগে। কথায় কথায় মামুন একবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মোতাহার ভাই, কবি নজরুল ঠিক কবে, কোন্ জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন সেটা একটু বলেন তো! নানা লোকে নানা কথা বলে, কিন্তু আপনিই সবচেয়ে ভালো জানবেন!
মোতাহার সাহেব বললেন, সে সময়ে অবশ্য আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম না, তবে সবিস্তারে শুনেছি। ওঁর এক ছেলে, বুলবুল, সে মারা যাবার পর উনি কী রকম আঘাত পেয়েছিলেন জানো তো! সেই আঘাত উনি আর সামলাতে পারেননি।
মামুন বললেন, সে তো অনেক আগের কথা। তারপর উনি বহু বছর সুস্থ ছিলেন, সারা দেশে ঝটিকা সফর দিয়েছেন, কত গান লিখেছেন…
মোতাহার সাহেব বললেন, হ্যাঁ, তার পরেও দশ বারো বছর সুস্থ ছিলেন, কিন্তু সেই সময় আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, সে চিঠির বয়ান আমার স্পষ্ট মনে আছে। উনি লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীট-এর মত খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।”
–রবীন্দ্রনাথ কি কারুকে তুই বলতেন?
–কবিগুরু ঠিক ঐ ভাষায় বলেন নাই হয়তো। তিনি ঠিক কী ভেবে ঐ কথা বলেছিলেন, তাও জানি না, কিন্তু নজরুলের মনের মধ্যে একটা ট্রাজেডির আশঙ্কা সেই সময় থেকেই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল মনে হয়। প্রায়ই বলতেন এরকম কথা। তারপর কবিগুরু মারা গেলেন উনিশশো একচল্লিশ সনের অগাস্টে আর পরের বছর জুলাই মাসে নির্বাক হয়ে গেলেন নজরুল।
–রেডিও স্টেশনে টক দিতে গিয়ে নাকি—
–আমি নৃপেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে সে দিনের বর্ণনা শুনেছি।
–নৃপেন্দ্রবাবু, মানে কোন্ নৃপেন্দ্রবাবু?
–কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। কবির খুব বন্ধু ছিলেন তিনি। তিনি তখন কলকাতা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেন। আর নজরুল তখন ফজলুল হক সাহেবের ‘নবযুগ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। সেই নবযুগে নজরুল একটা লেখা লিখেছিলেন, আমার সুন্দর! কী, অপরূপ লেখা! যদিও গদ্য, তবু সব লাইন আমার মনে আছে। “আমার সুন্দর প্রথমে এলেন গদ্য হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে…। আমার সুন্দর এলেন শোকসুন্দর হয়ে। আমার পুত্র এলো নিবিড় স্নেহ-সুন্দর হয়ে…।” দ্যাখো, এই লেখাতে এতদিন পরেও সেই ছেলের কথা। ছেলের জন্য শোক!
-এই লেখাটার সঙ্গে তাঁর রোগের–
–এত সুন্দর একটা লেখা, এতেও নিন্দুকের গাত্রদাহ হয়? ঐ লেখাটাকে কুৎসিত কদর্য বিদ্রূপ করে সাপ্তাহিক ‘কৃষক’ পত্রিকায় একটা লেখা ছাপা হলো, তার নাম ‘সুন্দরম’। নজরুল আগে লেখাটি দেখেন নি। জুলাই মাসের নয় তারিখে তিনি বেতার কেন্দ্রে গেছেন। সেদিন ছোটদের আসরে তাঁর একটা গল্প শুনাবার কথা। অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে একটু দেরি আছে, তিনি অপেক্ষা করছেন, সেখানে পড়েছিল ঐ ‘কৃষক’ পত্রিকাটা। সময় কাটানোর জন্য পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঐ কুৎসিত লেখাটা তাঁর চোখে পড়লো। এটা পড়েই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর টক দিতে গিয়ে দু’চার কথা বলার পরেই তাঁর বাক্রোধ হয়ে গেল। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ ট্যাক্সি করে বাড়ি নিয়ে গেলেন তাঁকে…।
এই কাহিনী শুনতে শুনতে মামুনেরও যেন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। অতি কষ্টে আবেগ দমন করে তিনি ঝাঁঝালো গলায় বললেন, অত বড় একজন কবিকে কত অন্যায় আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে। কত নিন্দা, কত কুৎসা! ছি ছি ছি! কবিদের মন স্পর্শকাতর হয়, অন্যায় অপবাদ তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। আমাদের নিজের জাতের লোকেরাও তো তাঁকে কম দুঃখ দেয় নি!
মোতাহার সাহেব বললেন, আরে, প্রথম দিকে আমাদের নিজেদের জাতের লোকেরাই তো কবিকে আক্রমণ করেছে বেশি! মোসলেম দর্পণ কাগজে তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘ইসলাম-বৈরী মুসলমান কবি’। ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় এক মুন্সী মোহাম্মদ লিখেছিল, “লোকটা মুসলমান না শয়তান?” তারপর “মোহাম্মদী” আর “সওগাত” কাগজের ঝগড়ার কথা তো তোমরা জানো না। তখন তোমরা ছেলেমানুষ ছিলে। “মোহাম্মদী”তে আকরম খাঁ নজরুলকে কত গালিই না। দিয়েছেন। সেই জন্য আমরা ওঁকে বলতাম আক্রমণ খাঁ। নজরুল বলতেন, আক্রমিয়া মিঞা। সওগাত ছিল প্রগতিশীলদের কাগজ, নজরুল সেখানে ‘চানাচুর’ নামে একটা বিভাগ লিখতেন, কত মজা করে উত্তর দিতেন।
মামুন বললেন, আমি পুরোনো মোহাম্মদী ও সওগাতের ফাঁইল দেখেছি। মোতাহার ভাই, আপনি লক্ষ করেছেন, সেই সময় যারা নজরুলকে হীন আক্রমণ করেছিল, এখন দেখি, পূর্ব বাংলায় তারাই অনেকে নজরুলের জয়গান করে। নজরুলের জন্য তাদের কত দরদ! যত সব ভণ্ডামি!
মোতাহার সাহেব মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ জানি। দেখছি তো সব!
মামুন উত্তেজিত হয়ে উঠে বললেন, এরাই এখন আবার নজরুলকে পাকিস্তানী কবি বানাতে চায়। নজরুলের কবিতায় মহাশ্মশান কেটে কবরস্থান বা গোরস্থান বসিয়ে দিচ্ছে। এটা আপনি সমর্থন করেন? আমাদের পূর্ব বাংলায় এখন ভাষার ওপর যে যথেচ্ছাচার হচ্ছে।
শামসুল আলম একপাশে বসে চুপচাপ শুনছিলেন সব। এবারে তিনি বললেন, আরে, মামুন মিঞা, তুমি বারবার পূর্ব বাংলা পূর্ব বাংলা কইতাছো ক্যান? পূর্ব বাংলা তো আর নাই। পূর্ব পাকিস্তান, এই বৎসর থিকা আমরা পূর্ব পাকিস্তানী। আর হিপোক্রিসিই তো আমাগো ন্যাশনাল প্যাস্টাইম!
মামুন তাঁর জামাইবাবুর দিকে কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে। আস্তে বললেন, পূর্ব বাংলা না, পূর্ব পাকিস্তান। ঠিক! তবে এটা রপ্ত করতে আমার একটু সময় লাগবে! কথা ঘুরে যায় অন্যদিকে, অবধারিত ভাবে রাজনীতি এসে পড়ে।
ডঃ শহীদুল্লাহ্ সাহেব এলে অবশ্য রঙ্গরসের কথাই বেশি হয়। ছোট্টখাট্টো চেহারার মানুষটি। দেখলে বোঝাই যায় না, উনি অমন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। আরবী, ফারসী যেমন জানেন, তেমনই আবার সংস্কৃতে অগাধ জ্ঞান। ছেলেবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল সদানন্দ। এখনো সেই সদানন্দই আছেন।
শামসুল আলম-এর বড় মেয়ে বিলকিস, ডাকনাম মঞ্জু, সবে মাত্র সতেরো বছর বয়েস পূর্ণ। হয়েছে। মেয়েটি ভারি সুশ্রী। এমন কোমলতামাখা মুখ যে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাকে দেখলেই শহীদুল্লাহ সাহেব বলেন, ও শামসুল, এ মেয়ে যে প্রায় অরক্ষণীয়া হতে চললো, এর বিয়ে দেবে না?
আলম সাহেব বলেন, আমার আর ওর মায়েরও তো তাই ইচ্ছে, কিন্তু ও যে আরও লেখাপড়া করতে চায়!
শহীদুল্লাহ সাহেব ভুরু নাচিয়ে বললেন, মেয়েদের কিঞ্চিৎ লিখনং পড়নং বিবাহেরি কারণং। বুঝলে না? অ্যাঁ?
মঞ্জু বেশ চটপট কথা বলতে পারে। সে শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বললো, নানা, আপনি ঈদের নামাজে ইমাম হন, আবার কথায় কথায় সংস্কৃত বলেন কেন?
শহীদুল্লাহ সাহেব উঁচু গলায় হেসে বললেন, আমার কথা জানো না? অনেকে যে আমার নামটাই একসময় বদলে দিতে চেয়েছিল। বলিনারায়ণ! কী করে হলো জানো? শহীদ মানে বলি, আর আল্লাহ–নারায়ণ। সন্ধি করে হলো বলিনারায়ণ! তা থাক, আসল কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছো কেন? তোমার জন্য পাত্র দেখি, অ্যাাঁ?–
মামুন বললেন, মঞ্জু যদি পড়তে চায়, তাহলে পড়ান না কেন ওকে দুলাভাই!
আলম বললেন, পড়াতে তো আপত্তি নাই। কিন্তু মেয়ে বায়না ধরেছে যে সে কলকাতার কলেজে পড়বে!
কেন, কলকাতায় কেন? আমাদের ঢাকায় কি মেয়েদের কলেজ নাই? ভালো কলেজ আছে!
সে কথা বুঝায় কে বলল! তুমি পারো তত বুঝাও! কার কাছ থেকে যেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের নাম শুনেছে। সেইখানে ও ভর্তি হতে চায়। আমার এক ভাই তো থাকে কলকাতায়, পার্ক সার্কাসে বাড়ি আছে, সেইখানে থাকবে।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, মঞ্জু, তোর এত কলকাতায় গিয়ে পড়ার শখ কেন?
মঞ্জু সংক্ষেপে বললো, আমার ইচ্ছা করে।
মামুন বললেন, আমার মতে ঢাকায় পড়াই ভালো।
শহীদুল্লাহ্ সাহেব বললেন, কলকাতার কলেজগুলি কি আর আগের মত আছে?
আলম সাহেব বললেন, মেয়ের কথা শুনলে আপনারা তাজ্জব হয়ে যাবেন। ওরে আমি কলকাতায় নিয়ে গেছিলাম চুয়াল্লিশ সালে, তখন ওর বয়েস কত হবে, বড় জোর পাঁচ বছর। অথচ সেই সময়কার কথা নাকি ওর সব মনে আছে। পার্ক সাকাসে রাস্তার দুই ধারে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে, তাও তার মনে আছে! এ কখনো হয়!
মামুন বললেন, সে কলকাতা আর আগের মত নাই! শুনতে তো পাই খুব অপরিষ্কার, মানুষ এত বেড়েছে
আচ্ছা মঞ্জু, কলকাতায় তুই পড়তে গেলে, কোনো হিন্দুর ছেলে যদি তোকে বিয়ে করতে চায়?
আলম সাহেব সোসাহে হাসিমুখে বললেন, আমিও তো সেই কথা বলি! আমার মেয়ের এমন রূপ, ওকে দেখেই হিন্দু ছেলেদের মাথা ঘুরে যাবে। কেউ না কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে বিয়ে করে ফেলবেই, কী বলেন? তারপর, মঞ্জু, তুই চুলে সিন্দুর দিবি, হাতে লোহার চুড়ি পড়বি। রোজ সন্ধ্যাবেলা শঙ্খতে ফুঁ দিতে হবে, গঙ্গায় স্নান করতে করতে মন্ত্র পড়তে হবে, মন্ত্র পড়ায় ভুল হইলেই মুখঝামটা খাবি শাশুড়ি ঠাকরুণের কাছে। তারপর কালীপূজার সময় মন্দিরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে…
মঞ্জু ত্রস্তে বলে উঠলো, না, না!
তার মুখে আতঙ্কের ছাপ। তা দেখে সবাই হেসে উঠতেই মঞ্জু ছুটে পালিয়ে গেল ঘর। থেকে।
আলম সাহেব বললেন, ঐ কালী ঠাকুরের কথা শুনলেই মেয়ে ভয় পেয়ে যায়। মোতাহার ভাই এমন একখানা গল্প শুনিয়েছিলেন কালী মন্দির সম্পর্কে!
মামুন বললেন, কী গল্প, শুনি, শুনি!
মোতাহার সাহেব সেদিন উপস্থিত নেই, আলম সাহেবই শোনালেন কাহিনীটি।
মোতাহার হোসেন একসময় কলেজের প্রকটর ছিলেন। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি। গিয়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছিল তাঁর ডিউটির অন্তর্গত। সেই ব্যাপারেই একবার হয়েছিল তাঁর এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। এসব পার্টিশনের অনেক আগেকার কথা। তাঁর একটি ছাত্র প্রায়ই বিনীত ভাবে প্রশ্ন করে, স্যার, একবার আমাদের ওখানে আসবেন না? ‘ওখানে’ মানে রমনার কালীবাড়ি, ছাত্রটির বাবা সেখানকার পুরোহিত। স্বাভাবিক কারণেই প্রকটরের সেখানে কখনো পদার্পণ ঘটেনি। ছাত্রটি গলবস্ত্র হয়ে অনুনয় করে, স্যার একদিন চলুন, গুরুমাকে, বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে আসুন, দেখে যাবেন।
মোতাহার সাহেব ছাত্রটিকে বললেন, তোমাদের মন্দিরে কি আমরা যেতে পারি? আমরা যে মুসলমান!
ছেলেটি জিভ কেটে বলেছিল, স্যার, আপনি আমার শিক্ষক, গুরুদেব। আমি নিজে আপনাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবো, কোনো অসুবিধে হবে না!
মোতাহার হোসেনের এইসব ব্যাপারে খুব উৎসাহ। বাল্যকাল থেকেই তিনি হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। তার নিজের কোনো সংস্কার নেই। তাঁর স্ত্রী যেতে চান না, তবু তিনি বললেন, চলো, চলো। বাচ্চাদের নিয়ে চলো!
রেসকোর্সের মাঠে রমনা কালীবাড়িটি অনেক দিনের পুরোনো। অনেকে বলে, একসময়ে। সেখানে নরবলি হতো। মুসলমান ছেলেমেয়েরা সে কালীবাড়ির ধার-কাছ দিয়েও যায় না, দিনের বেলাতেই তাদের গা ছমছম করে। মোতাহার সাহেবের স্ত্রী তাঁর দুটি বাচ্চা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চললেন দুরুদুরু বুকে। মোতাহার সাহেব এবং তাঁর ছাত্রটি গল্প করতে করতে যাচ্ছে আগে আগে।
কালীবাড়ির কাছে পৌঁছে মোতাহার সাহেব রইলেন বাইরে, পুরুষদের সঙ্গে। তাঁর স্ত্রীকে বাচ্চাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ভেতরে। মন্দিরের ভেতরটা অন্ধকার, সেখানে জ্বলছে। একটা প্রদীপ। ওঁরা অবশ্য মন্দিরের মধ্যে গেলেন না, পাশের অন্দরমহলে দোতলায় পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে, তার পাশ দিয়ে তাঁদের এনে বসানো হলো একটা খালি ঘরে। একটু পরে এক বিশাল কায় মহিলা এলেন ওঁদের সঙ্গে আলাপ করতে। তাঁর পরনে চওড়া লালপেড়ে শাড়ী, কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর ল্যাপা, মুখখানা হাসি হাসি। প্রথমে তিনি বাচ্চা মেয়ে দুটিকে আদর করলেন, তারপর মোতাহার সাহেবের স্ত্রীর হাত ধরে সস্নেহে একথা সেকথা বলতে বলতে একসময় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, মা, তোমরা কী জাত? ব্রাহ্মণ না কায়স্থ?
যেই শুনলেন মুসলমান, অমনি তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। সেই বিশালবপু নিয়ে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে লাগলেন, ওরে কী সর্বনাশ হলো! ম্লেচ্ছ এনে ঢুকিয়েছে মন্দিরে! হায়, হায়, কী হবে! মহাপাপে সবাই যে নির্বংশ হবো!
যারা খেতে বসেছিল তাদের সামনে থেকে পাতাগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, খাস নি, খাস নি! মহা পাপ হবে! সবাই পুকুরে স্নান করে আয়!
তারপর শুরু হয়ে গেল মহাগণ্ডগোল। একদল দুদ্দাড় করে নিচে নেমে যাচ্ছে, অন্য দল। উঠে আসছে ওপরে। এরই মাঝখানে এক অসহায় মহিলা তাঁর দুটি বাচ্চাকে নিয়ে বেরবার পথ। পাচ্ছেন না। মেয়ে দুটি ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।
মামুন সর্বাঙ্গে কাঁটা হয়ে শুনছিলেন, এই পর্যন্ত শোনবার পর তিনি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর? ওদের কি মারধর করলো?
আলম সাহেব বললেন, না, সে সব কিছু হয়নি। সেই ছাত্রটিও শেষ পর্যন্ত ওদের বার করে নিয়ে আসে এবং নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয় বাড়িতে। সে বারবার ক্ষমা চেয়েছিল গলবস্ত্র হয়ে। সে আগে থেকে সবাইকে জানিয়ে রাখলে বোধহয় এতটা হতো না! কিন্তু ঐ বাচ্চা মেয়ে দুটির কী অভিজ্ঞতা হলো বলো তো! কতদিন কেটে গেছে, এখনো সেই কথা ভাবলে তাদের গায়ে কাঁটা দেয়!
মামুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। ঠিক এতটা না হলেও এর কাছাকাছি অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁরও আছে। আবার এর উল্টো অভিজ্ঞতাও হয়েছে, কিন্তু অল্প বয়েসের অপমানের কথাই সারাজীবনের মত দাগ কেটে যায়।
এ বাড়ির জানলা দিয়ে পাশাপাশি দুটি জনশূন্য বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। দরজা-জানলা ভাঙা। ও বাড়ির মানুষরা এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। যেতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো ওদের কোনো দোষ ছিল না, আবার একেবারে যে ছিল না তাও জোর দিয়ে বলা যায় না।
মাঝে মাঝে মামুন একা একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসেন। ঢাকা শহরের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তাঁর যৌবনে দেখা ঢাকা শহর ছিল ছিমছাম, সুন্দর। এইসব এলাকাগুলো ছিল শান্ত, নির্জন। তখন কত পুকুর ছিল, ফাঁকা মাঠ ছিল, অবস্থাপন্ন লোকদের বাড়ির সামনে বড় বড় বাগান ছিল। পার্টিশানের পর অনেক হিন্দু ঢাকা শহর ছেড়ে সীমান্তের ওপারে চলে গেছে, তার বদলে নতুন লোক এসেছে পাঁচ গুণ বা তারও বেশি। কলকাতা থেকে এসেছে অনেকে, বিহার থেকে, আসাম থেকে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও দলে দলে আসছে। কিছু বাড়ি হস্তান্তরিত হয়ে গেছে, কিছু বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, আর পুকুর-মাঠ নিশ্চিহ্ন করে নিত্য নতুন বাড়ি উঠছে সব দিকে।
প্রেস ক্লাবের বাড়িটাতে ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বোস। হাতির পুলের কাছেই এক বাড়িতে থাকতেন মোহিতলাল মজুমদার। ঐ বাড়িতে ডঃ সুশোভন সরকার। পুরোনো স্মৃতি ছায়াছবির মতন ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
একদিন কবি জসিমুদ্দিনের বাড়িতে সারা সন্ধে আড্ডা দিয়ে ফেরবার পথে মামুন একটা ভাঙা বাড়ির সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। এর আগেও এই বাড়ির পাশ দিয়ে বেশ কয়েকবার গেছেন, তখন কিছু খেয়াল হয়নি, আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
এটাই রাজেন সর্বাধিকারীর বাড়ি নয়?
দেয়ালে পোড়া পোড়া দাগ, আগুন লেগেছিল, কোনো একসময় আগুন লাগানো হয়েছিল নিশ্চয়ই। বাড়িটার চেহারাই তাই পাল্টে গেছে। সদর দরজার দিকটাই ছিল অন্যরকম, সামনে ছিল অতসী ফুলগাছের ঝাড়। মোটাসোটা চেহারার ডাক্তারবাবু ধুতি আর ফতুয়া পরে ঐ বাগানে জল দিতে দিতেই অনেক সময় রুগীদের অসুখের বিবরণ শুনে নিদান দিতেন। রাজেন ডাক্তারের এক ছেলের নাম ছিল বিকু, ব্যাডমিন্টনে চাম্পিয়ন ছিল সে। মামুন তাঁর সঙ্গে অনেকদিন খেলেছেন। এই বাড়ির পেছনেই ছিল ব্যাডমিন্টন কোর্ট, সাদা প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা ছিপছিপে ঝকঝকে চেহারার বিকু সেখানে ছোট ছোট ছেলেদের ট্রেনিং দিত, এ বাড়ির মেয়েরাও ব্যাডমিন্টন খেলতো নিয়মিত, তাদের খেলা দেখতে ভিড় জমে যেত এখানে। একটি মেয়ের নাম ছিল মল্লিকা, সে ছিল লক্ষ্মী ট্যারা, সে মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি হতো খুব। সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
রাজেন ডাক্তার কি এখানেই মারা যান? বিকু, মল্লিকা:তাদের দীর্ঘশ্বাস কি এ বাড়ির আনাচে কানাচে রয়ে গেছে? বাড়িটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়, ভেতরে কোথাও যেন মিটমিট করে জ্বলছে একটা প্রদীপ বা মোমবাতি। এখানে কেউ থাকে এখানে? মামুনের একবার ইচ্ছে হলো সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখেন। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি তাঁর চেনা। কিন্তু মামুনের ভয় করলো।
এরপর বাড়ি ফেরার সময় রাস্তা হারিয়ে ফেললেন মামুন। সব রাস্তাই যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগে। যেন পুরো শহরটাই অতীতে ডুবে গেছে। রাস্তায় দু’একটি লোক চলাচল করছে, তাদের জিজ্ঞেস করবেন সেগুনবাগিচা কোন্ দিকে? মামুনের লজ্জা হলো, ঢাকা শহরটা তাঁর এত. চেনা, অথচ তিনি পথ চিনতে পারছেন না? একসময় টানা আড়াই বছর তিনি চাকরি করেছেন ঢাকায়।
শেষ পর্যন্ত কারুকে জিজ্ঞেস না করেই, অনেক পথ ঘুরে তিনি পৌঁছে গেলেন সেগুনবাগানে। দোতলায় হারমোনিয়ামের সুর আর গান শোনা যাচ্ছে। ওপরে এসে দেখলেন আজ বাইরের কোনো গায়ক বা আড্ডাধারী আসেনি, দুলাভাইও নেই সেখানে, আজ বসেছে অল্প বয়েসীদের আসর। মঞ্জু গান গাইছে হারমোনিয়াম বাজিয়ে, তার সামনে বসে আছে তারই কাছাকাছি বয়েসী আর তিনটি ছেলেমেয়ে।
দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মামুন একটুক্ষণ শুনলেন। মঞ্জু শুধু দেখতেই সুন্দর হয় নি, বেশ মিষ্টি গানের গলা তো! সে গাইছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে!”
মামুনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দিনকাল কত তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে। বছর কুড়ি আগেও ঢাকায় এইসব পরিবার কত রক্ষণশীল ছিল! মঞ্জুর বয়েসী কোনো মেয়ে বেনী দুলিয়ে প্রেমের গান গাইছে, সামনে দুটি অপরিচিত যুবক, এ দৃশ্য তখন কল্পনাও করা যেত না। শিক্ষিত হিন্দুদের বাড়িতে, বিশেষত ব্রাহ্মদের বাড়িতে অবশ্য এসবের চল ছিল। তারা এখন নেই, নতুন কালের ছেলেমেয়েরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। অচেনা একটি ছেলে মাঝে মাঝে গলা মেলাচ্ছে মঞ্জুর সঙ্গে।
ওরা হয়তো মামুনকে দেখে অস্বস্তিবোধ করবে, তবু মামুনের চলে যেতে পা সরলো না। একবার তার সঙ্গে মঞ্জুর চোখাচোখি হতেই মামুন অপ্রস্তুতের হাসি দিয়ে বললেন, আমি তোদের মধ্যে এসে বসতে পারি?
মঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে মামুনের হাত ধরে টেনে বললো, আসেন, আসেন। আপনিও তো। গান জানেন, আপনি আমাদের গান শোনাবেন।
এই যৌবনের সাহচর্যে মামুনের মন হালকা হয়ে গেল। স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, অকারণ হাসি, এসব শুধু যৌবনেই সম্ভব।
অনেক গান হলো, মামুনও গাইলেন কয়েকখানা। অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে দু’জন শামসুল আলমের আত্মীয়। একজন তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে, আর একজন পিসিমার ছেলে। ওদের নাম নাজমা আর রশীদ। আর একটি ছেলের নাম পলাশ, সে রশীদের বন্ধু। ওরা সবাই এসেছে কলকাতা থেকে, কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মামুন বুঝে গেলেন মঞ্জুর কেন কলকাতার কলেজে গিয়ে পড়ার আগ্রহ। তিনি কবি মানুষ, মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক চট করে টের পেয়ে যান। মঞ্জুর সঙ্গে রশীদের সেইরকম একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে, দু’জনে দু’জনের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকায়।
মামুন ভাবলেন, আহা রে, ওরা যেন কষ্ট না পায়। এই বয়েসের কষ্টে বুক ভেঙে যায় একেবারে!
পলাশ নামের ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করে কথায় কথায় পুরোনো পরিচয়ের সূত্র বেরিয়ে পড়লো। পলাশের বাবার নাম সুরঞ্জন ভাদুড়ী, তাঁকে বিলক্ষণ চিনতেন মামুন। নাজিমুদ্দিন রোডে কাজী আবদুল ওদুদের জোহরা মঞ্জিলের পাশেই ছিল ওঁদের বাড়ি। সে বাড়ির নাম ছিল শান্তি কুটির। কী গমগমে গানের গলা ছিল সুরঞ্জনবাবুর, একেবারে পঙ্কজ মল্লিককেও হার মানিয়ে দিতেন। এই বাড়িতেও তিনি আসতেন নিয়মিত।
খোঁজখবর নিয়ে জানলেন যে সুরঞ্জন ভাদুড়ীদের কোনো ট্রাজেডির শিকার হতে হয়নি, সময় মতন বাড়ি বদল করে চলে গেছেন। তাঁরা পেয়েছেন কলকাতার পার্ক সাকাসের একটি ভালো বাড়ি, রশীদদের বাড়ির কাছেই। সেই জন্যই রশীদের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব। রশীদরা। ঢাকায় আসছেন শুনে সুরঞ্জন ভাদুড়ী তাঁর ছেলেকে বলেছেন, যা, তুইও ঘুরে আয়। নিজের জন্মভূমিটা একবার দেখবি না?
পলাশ তাদের প্রাক্তন বাড়িতে রশীদদের সঙ্গে গিয়েছিল এর মধ্যে। সে বাড়ির বর্তমান মালিক তাকে খুব খুব খাতির যত্ন করেছেন, একেবারে অন্দর মহলে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন সব কিছু। খাইয়েছেন খুব। বর্তমান মালিকও তো একসময় কলকাতার লোক ছিলেন, তাই পলাশদের পেয়ে তিনি মেতে উঠেছিলেন পুরোনো গল্পে।
এসব কথা শুনে মামুনের খুব ভালো লাগলো। সুরঞ্জন ভাদুড়ী তাঁর প্রিয় গায়ক ছিলেন, এখন তিনি কলকাতায় বাংলা সিনেমায় সুর দেন। ছেলেটিরও গানের গলা বেশ।
একসময় মালিহা বেগম এসে খাওয়ার তাড়া দিলেন সকলকে। রশীদরা উঠেছে তাদের অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে, আজ রাতে এখানে খেয়ে যাবে। একসঙ্গে খেতে বসলো সকলে। মামুনের দিদি নিজে রান্না করেছেন, তাঁর রান্নার হাত অপূর্ব।
প্রথমে বিরিয়ানি পাতে পড়তেই মামুন সংকীর্ণ চোখে পলাশের দিকে তাকালেন। এই বিরিয়ানির মধ্যে রয়েছে বড় গোস্ত। তাঁর হঠাৎ পুরোনো একদিনের কথা মনে পড়লো।
তিনি বললেন, আপা, পলাশকে বিরিয়ানি দিও না। ওর জন্য অন্য কিছু করো নি?
মালিহা হাতা দিয়ে বিরিয়ানি তুলতে গিয়েও অপ্রস্তুত হলেন।
রশীদ বললো, না, না, ঠিক আছে। ও খায়!
পলাশ বলল, বিফ বলছেন তো? আমি বিফ খাই। রশীদদের বাড়িতে কতবার খেয়েছি।
মামুন তাঁর দিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপা, তোমার মনে আছে?
মালিহা চোখ দিয়ে একটা ইসারা করলেন, যাতে মামুন ঐ সব প্রসঙ্গ এখন না তোলেন!
মামুন কিছু বললেন না, কিন্তু মনে পড়া তো আটকানো যায় না। এই পলাশের বাবা সুরঞ্জন ভাদুড়ী এ বাড়িতে কত এসেছেন, কত গান গেয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে গেছেন, কিন্তু এ বাড়িতে কোনোদিন তাঁকে কোনো খাবার খাওয়ানো যায় নি। গোরুর মাংস তো দূরের কথা, সামান্য কোনো মিষ্টি বা এক গেলাস পানিও মুখে তোলেন নি কখনো। অন্যরা খাচ্ছে, সেই। সময় তাঁকে কিছু খাওয়াবার প্রস্তাব দিলেই হাত জোড় করে বলতেন, ঐটা মাপ করবেন। বামুনের ছেলে, আর কিছু না মানি, শুধু এইটুকু মানি, অন্যের বাড়িতে কিছু খাই না।
প্রত্যেকবার এই কথাটা শোনা মাত্র তাঁর গানের সুরের রেশ কেটে যেত!
মামুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, মাত্র একটা জেনারেশন। আর এক জেনারেশান আগে যদি এরকম মেলামেশা থাকতো, যদি খাদ্যের বাছবিচার কিংবা ছোঁওয়াছানির ব্যাপার না থাকতো, তা হলে সুরঞ্জন ভাদুড়ীর মতন মানুষদের এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হতো না।
এমনকি, তাহলে হয়তো পাকিস্তান, দেশ বিভাগের প্রশ্নই উঠতো না!
কারণটা খুব সামান্য মনে হয়, কিন্তু এই সব অনেক সামান্য কত বীজ থেকেই তো বিষবৃক্ষ জন্মায়। আস্তে আস্তে বাড়ে। অবিশ্বাস আর ভুল বোঝাবুঝির সার-পানি পেয়ে তা একদিন মহীরুহ হয়।
হাত গুটিয়ে, খাওয়া বন্ধ করে মামুন চেয়ে রইলেন এই নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের দিকে।