1 of 3

১.৩১ স্বাধীনতার কয়েক বছর পর

স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ভারতের রাজ্যগুলির আলাদা আলাদা সীমানা যখন নতুন করে নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখন একটা চমকপ্রদ প্রস্তাব এলো দিল্লি থেকে। পশ্চিম বাংলা নামে খণ্ডিত রাজ্যটির আর সীমানা চিহ্নিত করার দরকার নেই, পশ্চিম বাংলাকে মিশিয়ে দেওয়া হোক বিহারের সঙ্গে।

এই অভিনব প্রস্তাবটি যারই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত হোক, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এর সমর্থক, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ এর প্রবল প্রবক্তা এবং বাংলা ও বিহারেরদুই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ আহ্লাদের সঙ্গে এই প্রস্তাব লুফে নিলেন। পশ্চিমবাংলা আর বিহার মিলেমিশে গেলে কত সুবিধে, দুটিতে মিলে একটি বেশ বড় আর শক্তিশালী রাজ্য হবে; বিহারে আছে খনিজ সম্পদ আর কাঁচামাল, পশ্চিম বাংলায় আছে কলকারখানা আর বন্দর, একেবারে রাজযোটক! তা ছাড়া পাকিস্তান থেকে অনবরত উদ্বাস্তুর স্রোত আসছে, পঞ্চাশের দশকে সেই স্রোত হঠাৎ বেড়ে গেল, প্রতি মাসেই আসছে কুড়ি-পঁচিশ হাজার, সরকারি হিসেবে পঞ্চান্ন সালের মধ্যেই এদিকে চলে এসেছে ২৮ লক্ষেরও বেশি বাঙালি উদ্বাস্তু। এই বিপুল সংখ্যক অবাঞ্ছিত অতিথির গুরুভার পশ্চিমবাংলা একা সামলাবে কী করে? বিহার-বাংলা এক হলে সেই রাজ্যে উদ্বাস্তুদের স্থান করে দেওয়া সহজ হবে।

পশ্চিম বাংলার মানুষ কিন্তু এই প্রস্তাব শুনে হতবাক হয়ে গেল। প্রথমে বিস্ময়, তারপর ক্ষোভ, তারপর ক্রোধ। শহরের রাস্তায়, ট্রামে বাসে, চায়ের দোকানে সর্বত্র এক আলোচনা, বেঙ্গল-বিহার মাজার! ক্রমে শহর ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়লো এই ক্ষোভ আর ক্রোধ। বাঙালিরা ভাবলো, তাদের বাঙালীত্ব মুছে দেবার জন্য এ এক কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র! বিহার আয়তনে বড়, সেখানকার জনসংখ্যাও পশ্চিম বাংলার চেয়ে বেশি, বিহারের সঙ্গে মিশে গেলে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যাবে।

পাকিস্তানে যেমন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চলেছে, তেমনি ভারতে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালাবার প্রয়াসও অব্যাহত। গোটা দক্ষিণ ভারত হিন্দিকে একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে মেনে নেবার বিরোধী, উন্নাসিক বাঙালিরা নিজেদের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এতই গর্বিত যে অন্য কোনো ভাষাকে তারা গ্রাহ্যই করে না। হিন্দিভাষী বিহারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে বাঙালিদের নাকটা ভোঁতা করা যাবে।

ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হলেও এই সময়ে পথেঘাটে লোকে প্রকাশ্যে : চিৎকার করে বলতে লাগলো, পশ্চিম বাংলাটা কি বিধান রায়ের বাপের সম্পত্তি?

চিকিৎসক হিসেবে প্রবাদতুল্য খ্যাতি পেয়েছেন বিধানচন্দ্র, রাজনীতিতেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলায় বক্তৃতা দিতে গেলে তাঁর কথা আটকে যায়, অনবরত ইংরিজি শব্দ চলে আসে। তাঁর বাংলা জ্ঞান সম্পর্কে নানা রকম গুজব প্রচলিত আছে। শোনা যায় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি একবার তারাদাস চ্যাটার্জি বলে সম্বোধন করেছিলেন, এবং তাঁকে তাঁর “শ্রীকান্ত” উপন্যাসের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আর একবার, বিভূতিভূষণের “পথের পাঁচালী” উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তরুণ পরিচালক সত্যজিৎ রায় যখন অর্থাভাবে বিপদে পড়ে শুভার্থীদের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন কোন্ দফতর থেকে টাকা দেওয়া যায় এই চিন্তা করতে করতে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তাহলে রোড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট থেকে কিছু বরাদ্দ করে দাও।

আর একটি কাহিনী আরও কৌতুকপ্রদ। একবার তিনি দিল্লি থেকে বিমানে ফিরছেন কলকাতায়। নামবার সময় বিমানটি যখন কলকাতা নগরীর উপর দিয়ে ঘুরছে, তখন তিনি জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে তার দলবলকে বললেন, ওহে, লোকে যতই কলকাতার বদনাম করুক, কিন্তু দ্যাখো, এখনো শহরটা কত সুন্দর। সেই যে মাইকেল লিখে গেছেন না, “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে…”

একজন অফিসার মিনমিন করে বললেন, স্যার ওটা মাইকেলের লেখা নয়, রবীন্দ্রনাথের…

 বিধানবাবু অমনি চটে গিয়ে বললেন, সবই রবীন্দ্রনাথের? কেন, মাইকেল কি কিছু লেখেন নি?

হয়তো এ সবই নিছক গুজব, বিরোধীপক্ষের দুষ্টুমি-মেশানো রটনা, কিন্তু রসিকতার স্বাদ পেলে তা জনসাধারণের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়।

শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, শুধু বুদ্ধিজীবীরা নয়, শুধু শিক্ষক-ছাত্রমহল নয়, পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষও বাংলা-বিহার একীকরণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চলে গেল। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ। যে-সব পত্রপত্রিকা কংগ্রেসের সমর্থক ছিল, তারাও এই ব্যাপারে সরকারকে সমর্থন জানালো না। দিকে দিকে শুরু হয়ে গেল প্রতিবাদ আন্দোলন। চলতে লাগলো ধর-পাকড়।

এদিকে যখন এইসব চলছে, ওদিকে পাকিস্তানে তখন রচিত হচ্ছে নতুন শাসনতন্ত্র। এতদিন পাকিস্তানের বড় অংশটির নাম ছিল পূর্ব বাংলা, নতুন শাসনতন্ত্রে এই নাম মুছে দিয়ে নাম দেওয়া হলো পূর্ব পাকিস্তান। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানরা আর বাঙালি রইলো না, তারা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানী। নতুন শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ঘোষণা করা হলো ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে, সেখানে প্রযোজ্য হবে শরিয়তের আইন, মুসলমান ছাড়া অন্য কেউ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রস্টানরা সেখানে হয়ে গেল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

পূর্ব বাংলা নামটা বিলুপ্ত হওয়াতেও সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা বা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ কেউ আপত্তি জানালেন না। এককালের তেজস্বী নেতা ফজলুল হক সাহেব এখন পাকিস্তানের সরকার পক্ষের লোক, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে তিনি নিযুক্ত হলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, তিনি এই ব্যবস্থা মেনে নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের এই নতুন। পরিচয় নিঃশর্তে গ্রহণ করার আর একটি কারণ তারা এই উপলক্ষে একটি বড় উপহার পেয়েছে। বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলন, শহীদের রক্তদান, প্রাণপণে উর্দু-বিরোধিতার সুফল পাওয়া গেছে, প্রধানমন্ত্রী জনাব মহম্মদ আলী ঘোষণা করেছেন যে নতুন সংবিধানে বাংলা ও উর্দু, এই দুটিই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই উপহারের বিনিময়ে অবশ্য স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি মুলতুবি রইলো।

পূর্ব বাংলার মানুষ বাংলা ভাষার দাবি আদায় করল ঠিকই, কিন্তু তাদের বাঙালিত্ব হারালো। বাঙালী শব্দটার মধ্যেই বড় হিন্দু হিন্দু গন্ধ! পশ্চিম পাকিস্তানীরা অন্তত তাই-ই মনে করে।

এদিকে পশ্চিম বাংলাকেও যদি বিহারের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে পৃথিবী থেকে বাঙালি জাতটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারত। বাংলাভাষা হয়তো আরও কিছুদিন টিকে থাকতো কিন্তু বাঙালি বলে কেউ আর নিজের পরিচয় দিতে পারতো না। দেশের নামেই তো মানুষের পরিচয়!

কিন্তু পশ্চিম বাংলা টিকে গেল কোনোক্রমে। মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরি! হাজার রকম সমস্যা কণ্টকিত পশ্চিম বাংলার মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের সদুপদেশ কিংবা বিধান রায়ের নির্দেশ মানতে রাজি হলো না। বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সরকার পক্ষও পিছিয়ে গেলেন খানিকটা। বাঙালিদের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা অনেক দিনের, জোর করে তাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। এই সময় বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা যেন নিজের মৃত্যু দিয়ে সমাধানের পথ করে দিয়ে গেলেন। মেঘনাদ সাহা লোকসভার সদস্য ছিলেন, তাঁর শূন্য আসনে উপনির্বাচন হবে। নির্বাচনের ইস্যু হলো বেঙ্গল-বিহার মাজার। প্রবল পরাক্রমশালী কংগ্রেস দল সেই নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হবার ফলে একেবারে ধামা চাপা পড়ে গেল ঐ প্রস্তাব। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বাঙালিত্ব আপাতত অটুট রইলো এবং ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাব।

বাংলা-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ায় তার প্রভাব পড়লো লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য, অসহায়, মানুষের ওপর। যারা উদ্বাস্তু। রক্তবীজের ঝাড়ের মতন তাদের সংখ্যা অনবরত বাড়ছে। হঠাৎ এই সময়েই কেন যে নতুন করে আবার দলে দলে হিন্দু-বৌদ্ধরা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসছে ভারতে, তার কোনো কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ভারতীয় শাসনকর্তারা দারুণ উদ্বিগ্ন, পাকিস্তানের কোনো কোনো নেতা বলছেন, হিন্দুরা চলে যাচ্ছে ভাবাবেগের তাড়নায়। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা হিন্দুদের নিরাপত্তার মৌখিক আশ্বাস দিয়ে বলছেন, তোমরা যেও, তোমরা থাকো। তবু তারা আসছে। পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে। নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে, জীবিকা ছেড়ে কোন্ তাড়নায় তারা চলে আসছে সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে, তা তারাই জানে। নতুন দেশে তাদের মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই, কেউ তাদের দিকে স্বাগতম বলে হাত বাড়িয়ে দেয় না, তারা এসে আশ্রয় নিচ্ছে রেল স্টেশনে, পথের ধারে, খয়রাতি তাঁবুতে, অর্ধাহার ও রোগ ভোগে ধুকছে; তবু তারা আসছে, দাবানলে তাড়া খাওয়া জন্তু-জানোয়ারের মতন নয়, পঙ্গপালের মতনও নয়, পরিত্যক্ত বাড়ির দেয়াল বেয়ে নেমে আসা পিঁপড়ের সারির মতন। ওরা ভূমিকম্পের কথা আগে থেকেই টের পায়।

এত উদ্বাস্তু পশ্চিম বাংলায় গাদাগাদি করে থাকবে কী করে? ওরা বাঙালি হলেও পশ্চিম। বাংলার মানুষ ওদের উপদ্রবে তিতিবিরক্ত। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য নতুন করে জায়গা। খোঁজাখুঁজি হতে লাগলো বিহারের চম্পারণে ও পূর্ণিয়ায়, উড়িষ্যা ও বিন্ধ্যপ্রদেশে। ওদের আর বাঙালি থাকবার দরকার নেই। ওরা কোনোক্ৰমে বাঁচুক।

“মহারাজা” নামে জাহাজে চাপিয়ে এক ব্যাচ উদ্বাস্তুকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কালাপানি পেরিয়ে আন্দামানের দ্বীপে।

এই রকম সময়ে জেল থেকে খালাস পেয়ে গেল হারীত মণ্ডল। তার নামে খুনের মামলা আদালতে টেকেনি। কিন্তু পুলিস তাকে পুরোপুরি ছাড়লো না। জেল গেট থেকে বেরুবার পরই পুলিস তাকে আবার ধরে নিয়ে এল লালবাজারে। কোনো একজন মন্ত্রীর নির্দেশে পুলিসের একজন বড় কর্তা তাকে একটি নিভৃত ঘরে বসিয়ে বললো, শোনো হে, তোমার বিরুদ্ধে কেস তুলে নেওয়া হয়েছে তোমার পরিবারের লোকজনের কথা বিবেচনা করে। তোমাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে এক শর্তে, সেটাও তোমার ভালর জন্যই। পনেরো দিনের মধ্যে তোমাকে এ রাজ্য ছেড়ে সপরিবারে চলে যেতে হবে। মধ্যপ্রদেশের ক্যাম্পে যাবে না আন্দামানে যাবে সেটা তুমি নিজে বেছে নাও। তুমি যে রিফিউজিদের খেপিয়েছে তারা যেন পশ্চিম বাংলা ছেড়ে বাইরে না যায়, তাতে তুমি তাদেরই ক্ষতি করছে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে যা সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে তার সুযোগ না নেওয়া যে কতবড় বোকামি তা বোঝো না? মনে থাকে যেন, ঠিক পনেরো দিন সময় দেওয়া হলো তোমাকে, এর মধ্যে তুমি কোথাও কোনো মিটিং করতে পারবে না। যদি করো—

কথা থামিয়ে পুলিসের কতটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হারীত মণ্ডলের চোখের দিকে।

হারীত মণ্ডল নির্বোধ নয় মোটেই। পুলিসের কতার ঐ অসমাপ্ত বাক্য ও স্থির দৃষ্টির মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে তা বুঝতে তার এক মুহূর্তও দেরি হলো না। খুনের মামলা চাপিয়ে পুলিস। তাকে জব্দ করতে পারেনি বটে কিন্তু অন্য অনেক ভাবে পুলিস তার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। এরপর কোনো মিছিলে বা সভায় সামান্য গণ্ডগোলের ছুতোয় পুলিস সোজাসুজি তার মাথায় গুলি চালিয়ে খতম করে দেবে। সেজন্য পুলিসকে কোনো কৈফিয়ৎ দিতে হয় না।

কিন্তু হারীত মণ্ডলের মাথার গড়নটাই এমন যে কারুর ধমক শুনে সে চট করে ভয় পায় না। এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনেও সে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

গত সাত মাস জেলখানায় তার সঙ্গে ধোপা নাপিতের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এখন তার মুখভর্তি দাড়ি, মাথার চুলে জট, তাতে আবার উকুন হয়েছে। উকুনগুলো মাথা বেয়ে দাড়িতেও নেমে আসে। ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে সে বললো, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো স্যার? আপনেগো বাড়ি কি যশোরে ছিল?

জাঁদরেল পুলিস কতাটি এই আকস্মিক প্রশ্ন শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।

হারীত মণ্ডল বললো, আপনার কথায় একটু যেন যশোরের টান আছে। ঠিক কিনা কন? তা যশোরের লোক হইলে আপনেও তো রিফুজি, স্যার? আপনেও রিফুজি, আমিও রিফুজি। আপনেরা কলকাতায় থাকবেন, আর আমরা কেন বিদেশে যামু?

পুলিশের কতাটি এবারে অনেকটা সামলে উঠে বললেন, তোমার কি এখানে কোনো থাকার জায়গা আছে? তুমি পরের বাড়ি জবরদখল করে আছে, সেটা বে-আইনী। সেইজন্যই সরকার তোমাদের অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন!

ও, তাইলে আমাগো মতন যারা গরিব, যারা নিচু জাত, যাগো এদেশে কোন আত্মীয়স্বজন নাই তাগোই আপনেরা বিদেশে পাঠাবেন। বোঝলাম। কিন্তু সে দেশে গিয়ে আমরা খাবো কী?

সরকার তোমাদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করবেন। তোমাদের যার যা পেশা ছিল সেগুলো আবার কাজে লাগাবে!

হারীত মণ্ডল আবার হেসে ফেলল। যেন বেশ একটা মজার কথা শুনেছে। পাল্টা একটা রসিকতা করার ঝোঁকে সে বললো, স্যার, আমার পেশা ছিল–

পুলিসের কতটি তার কথা শেষ করতে না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যা বলেছি, বুঝেছো আশা করি। মনে থাকে যেন, পনেরো দিন।

হ্যাঁ স্যার, মনে থাকবে, পনেরো দিন।

পুলিসের গাড়ি হারীত মণ্ডলকে পৌঁছে দিল কাশীপুর। কলোনির সব লোকজন তাকে দেখে ভিড় করে এলে সে দু’হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলতে লাগলো, না, না, এখন কোনো কথা না, এখন সবাই যাও, এখন দুইদিন আমি শুধু খাবো আর ঘুমাবো।

সত্যি সত্যি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো সে। তাকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পুলিসের হুমকি যে ফাঁকা নয় তা সে জানে। এখন তাকে ঘিরে এই কলোনিতে কোনো উত্তেজনা ছড়ালে সেই সুযোগে পুলিস তার ওপর প্রতিশোধ নেবে। পুলিসের সাজানো মামলা জজ সাহেবরা নামঞ্জুর করে দিলে পুলিস তা সহ্য করে না, একথা সে জেলখানাতেই অন্য আসামীদের কাছে শুনেছে।

পারুলবালার কাছে সে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। মুখে হাসি এনে সে বললো, জেলের খিচুরি খাইয়া প্যাটে চড়া পইড়া গ্যাছে। ছোট বউ, একটু মাছের ঝোল আর গরম ভাত খাওয়াইতে পারবি? পুঁটি মাছ, খইলসা মাছ যা হয়!

নিজের সংসারের খোঁজখবর নিল সে। এই সাতমাস নানরকম দুর্যোগের মধ্য দিয়ে কাটলেও শেষের দিকে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। তার ছেলে সুচরিত চন্দ্রা নামে একটি বড়লোক মহিলার নজরে পড়ে গেছে, সে মহিলা সুচরিতের লেখাপড়ার সব ভার নিয়ে নিয়েছেন এবং পারুলকেও একটি ভদ্রমতন কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন। আপাতত তাদের সংসার চালাবার দুশ্চিন্তা নেই।

হারীতের আবার হাসি পেল। সংসার! এই অস্থায়ী আস্তানাও আবার গোটাতে হবে। পারুলের চাকরি, ছেলের লেখাপড়া এ সব কিছুই আর কিছু না, নিবাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাকে। হারীত ভাবলো, জেল থেকে ছাড়া না পেলেই বরং ভাল ছিল, সে জেল খাটতো, কিন্তু পারুল তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে থেকে যেতে পারতো এখানে।

ভাত রান্না হবার আগেই সে পারুলকে একবার কাছে ডেকে একটানে তুলে আনলো বিছানায়। পায়ের ধাক্কায় বন্ধ করে দিল দরজা। তার ভাবগতিক দেখে পারুল ভয় পেয়ে গেলেও হারীত তাকে ছাড়লো না। তাদের চ্যাঁচার বেড়ার ঘর, পাশ দিয়ে লোকজন গেলে টের পাওয়া যায়, ঘোর দুপুরবেলা, যে-কেউ হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে, তবু হারীত বুভুক্ষুর মতন খেতে লাগলো পারুলের শরীর।

তারপর সে ঘুমোতে লাগলো পড়ে পড়ে। যেন অনেক দিনের জমা ঘুম সে পুষিয়ে নিচ্ছে। রান্না হয়ে গেছে, ভাত বাড়ার পরেও অনেক ঠ্যালাঠেলিতে সে আর উঠতে চায় না।

পরদিন হারীত তাদের কলোনির দু’জন লোককে ডেকে পাঠিয়ে গোপন শলাপরামর্শ করলো অনেকক্ষণ। হলধর অর ভূষণ নামে এই লোক দুটি হারীতের খুব অনুগত। হারীত তাদের বললো, শোন, আমার ফাঁসী হয়নি বটে, কিন্তু আমি দাগী হয়ে গেছি। তোরা এখন ধরে নে যে আমি আর নাই! আমি কিছু করতে গেলে আর প্রাণে বাঁচবো না। তোদেরও সামনে খুব বিপদ। উদ্বাস্তুদের বাইরে পাঠানো শুরু হয়ে গেছে, এখন এইসব বাড়ির মালিকরা সুযোগ নেবে, তোদের এখান থেকে উচ্ছেদ করে বনে-জঙ্গলে পাঠিয়ে দেবে। সুতরাং, তোদের এককাট্টা হয়ে থাকতে হবে সব সময়। তবু তোরা নিজেরা পারবি না। স্থানীয় কমুনিস্ট পার্টি আর ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ কর, তারা কংগ্রেস সরকারের এই পলিসির বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা তোদের সাহায্য করতে পারবে।

হলধর আর ভূষণ হারীতের হাত চেপে ধরে বললো, কিন্তু হারীতদা, তুমি চলে যাবে কেন? আমরা থাকলে তুমিও থাকবে। তুমিই আমাদের এই সুন্দর জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাদের প্রাণ থাকতে তোমাদের যেতে দেবো না।

হারীত বললো, আমি না থাকলে তবু তোদের টিকে থাকার আশা আছে। আমি থাকলে তোদের বিপদ আরও বাড়বে। নানান ছুতোয় পুলিস যখন তখন হামলা করবে। আমাকে যেতেই হবে!

পুলিসের কর্তার কাছে হারীত যে রসিকতা করতে গিয়েছিল, সেটা নিজের পেশা সম্পর্কে। তাকে আন্দামান কিংবা মধ্য প্রদেশের জঙ্গল বেছে নিতে বলা হয়েছে। পূর্ব বাংলায় হারীতের পেশা ছিল মূর্তি বানানো। জাতে তারা কুমোর। হারীত নিজে অবশ্য হাঁড়ি-কলসি বানায়নি কখনো, সে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতীর মূর্তি গড়তো। আন্দামানের দ্বীপে কিংবা মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে সে তার এই পুরনো পেশা কী করে কাজে লাগাবে? কে তাকে পয়সা দেবে?

সমুদ্রের অভিজ্ঞতা নেই হারীতের, সে জঙ্গলেই যাওয়া ঠিক করলো।

এখান থেকে চলে যেতে হবে শুনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল পারুলবালা। সে ধরে নিল, এটা তার স্বামীর আর একটা পাগলামি। জঙ্গলে গিয়ে সে নেতাগিরি করতে চায়। হারীত হাসতে হাসতে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ওরে ছোট বৌ, এখানে থাকলে আমার। মাথাটাই থাকবে না। বিধবা হইয়া থাকতে রাজি আছোস তো ক! আবার আমি লাফালাফি শুরু করি!

হারীতের এ রকম লঘু ভঙ্গির জন্য তার কথা বিশ্বাস করে না পারুল। সে আরও কাঁদে।

এর মধ্যে এক বিকেলে তাদের অন্ধকার ঘরে চন্দ্রোদয় হলো। সুচরিতের কাছ থেকে চন্দ্রা এসেছে হারীতের সঙ্গে দেখা করতে। চন্দ্রা পরে এসেছে একটা গোলাপী সিল্কের শাড়ী, তার ওষ্ঠাধর রক্তিম, তার শরীরের বিলিতি সুবাসে ভরে গেল ঘর।

হারীত খাটে শুয়ে ছিল, তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে বলতে লাগলো, কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! এ রকম কখনো করে। আমাকে ডেকে পাঠালেই তো আমি যেতাম। আপনি এই নোংরা কাদার মধ্যে–

চন্দ্রার সঙ্গে অসমঞ্জ রায় এবং আর একজন মহিলাও এসেছে। চন্দ্রা হারীতের খাটের এক কোণে বসে পড়ে কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললো, আপনি নাকি চলে যেতে চাইছেন? আপনি পাগল হয়েছেন নাকি? না, না, কোনো মতেই আপনার যাওয়া চলবে না।

হারীত কোনো কথা না বলে চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক পলক। তার মনে পড়েগেল সুলেখার কথা। এর আগেও সুলেখার কথা তার অনেকবার মনে পড়েছে, কিন্তু সুলেখার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। তার ধারণা, এই কলোনি থেকে বেরুলেই তার পেছনে পুলিস লাগবে। হারীত ও বাড়িতে আবার যাওয়া-আসা করলে ত্রিদিব-সুলেখা ঝামেলায় পড়তে পারেন। জেলে থাকার সময় ত্রিদিব দু’বার দেখা করতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে, উকিলের ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু সুলেখার সঙ্গে দেখা হয়নি।

সুলেখার সঙ্গে চন্দ্রার অনেক অমিল। সুলেখা এ রকম উগ্র নন। সুলেখা না হাসলেও তাঁর মুখে যেন সব সময় স্নিগ্ধ হাসি ছড়ানো থাকে। সুলেখা খুব কম কথা বলেন, আর এই মহিলাকে দেখেই মনে হচ্ছে ইনি অন্যদের কথা বলতে দেবেন না।

অসমঞ্জ রায় বললেন, আপনার ছেলে ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে, পড়াশুনো ভালোই করছে, তাছাড়া আপনি তো নিদোষ হিসেবে ছাড়া পেয়ে গেছেন, আপনি এখন চলে যাবেন কেন?

হারীত বললো, সরকার আমাদের এই সব বাড়ি ছেড়ে দিতে বলছেন, আমাদের অন্য জায়গায় জায়গা দেবেন…

চন্দ্রা বললো, অন্য জায়গা মানে ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে? সেখানে আপনারা খাবেন কী? সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষে নেবেন? না, না, বরং এই রকম বাড়ি বা জমি এদিকে আর যত আছে, সব দখল করে নিতে হবে। আপনারা দাবি ছাড়বেন না!

হারীত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার মনে পড়লো, পুলিস সাহেবের সেই তীব্র দৃষ্টি। তিনি পনেরো দিন সময় দিয়েছেন। নিশ্চয়ই লক্ষ্য রাখছেন হারীতের ওপর। নদিন কেটে গেছে!

দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারীত বললল, না, দিদিমনি, আমার আর উপায় নাই, আমারে চলে যেতেই হবে!

চন্দ্রা বললো, কেন? কে বলেছে আপনি নিরুপায়। আমরা আছি না? আপনি কিসের ভয়ে চলে যাবেন?

পুলিসের ভয়ে।

পুলিস? পুলিস কী করবে? আমরা অ্যাসেম্বলি অভিযান করবো। এদেশে কি ডেমোক্রেসি নেই? পুলিস তো জনতার চাকর! আমরা আপনাকে প্রটেকশন দেবো, আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন?

অসমঞ্জ রায় বললেন, আপনার নামে তো আর কেস নেই!

হারীত বললো, পুলিশ আমাকে ছাড়বে না। আপনারা ভদ্দরলোক, আপনারা বড়লোক, পুলিশ আপনাদের ভয় পেতে পারে। কিন্তু আমরা মারা পড়বো, পুলিশ আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে। বাঁচতে হলে আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে।

চন্দ্রা বললো, ঠিক আছে, আপনি কিছুদিন অন্য জায়গায় গিয়ে থাকুন, আপনার ফ্যামিলি নিয়ে। আপনাকে কোনো কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমরা দরকার হলে দিল্লিতে গিয়ে…

যখন-তখন হারীতের হাসি পেয়ে যায়। এই সব ভাল ভাল ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা তাকে এখন সাহায্য করতে চাইছেন, এতে তার হাসি পাবে না? যদি এক বছর আগে আসতেন… থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে পাগলা কুকুরের মতন পিটিয়েছে, একজন পুলিসের দারোগা তার পেটে এমন লাথি মেরেছিল যে হারীতের কাপড় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন বড় দেরি হয়ে গেছে। বড়লোকদের বাড়ির এই মা-লক্ষ্মীটি হতভাগা রিফিউজিদের জন্য কেন এত দরদ দেখাচ্ছেন, তাই বা কে জানে!

ঘরের দরজার কাছে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। সুচরিত দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে ভর দিয়ে। হারীত তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো। তারপর সুচরিতের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে সে বললো, ভুলু, তুই এখানে একা থাকতে পারবি? তুই থাক, লেখাপড়া শেখ, যদি কপালে থাকে আবার দেখা হবে।

তারপর চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে চোখ তুলে বললো, আপনারা তো সবাইকে রাখতে পারবেন না। সরকার উদ্বাস্তুদের বাইরে পাঠাতে শুরু করেছেন, অনেককেই যেতে হবে। তারা সেখানে কী করে থাকবে, কী খেয়ে বাঁচবে, তা কে দেখবে বলুন? আমি ওদের মধ্যে গিয়েই থাকতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *