1 of 3

১.২৯ প্রীতিলতার হাঁপানির টান বেড়েছে

প্রীতিলতার হাঁপানির টান বেড়েছে, ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাত্তিরে তাঁর ঘুম আসছে না। অধ্যাপক অসমঞ্জ রায়ও রাত জেগে পড়াশুনো করছেন। ছেলেমেয়েরা অন্য ঘরে শোয়, অনেক রাত, এখন তারা কেউ জেগে নেই। মস্ত বড় পালঙ্কটার এক কোণে কুঁকড়ে রয়েছে প্রীতিলতার ছোট্ট শরীরটা, তাঁর পাশে বিরাট শূন্যতা।

শোওয়ার ঘরে একটা ছোট-টেবিল রয়েছে। প্রীতিলতার যাতে চোখে আলো না পড়ে সেইজন্য একটা টেল ল্যাম্প জ্বেলে নিয়েছেন অসমঞ্জ রায়। ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে এ বছর, সেই অনুযায়ী অসমঞ্জ রায়কেও তাঁর নোট বই পাল্টাতে হবে, সীজন শুরু হতে আর দেরি নেই, তাই তাঁকে রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে। প্রকাশক তাড়া দিচ্ছে রোজ।

লিখতে লিখতে একবার তিনি তাকালেন স্ত্রীর দিকে। সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে প্রীতিলতার বুকে। পৃথিবীতে এত বাতাস তবু প্রীতিলতার নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট। অনেক চিকিৎসা করেও কোনোই সুফল হয় নি, ইদানীং সাধু-ফকিরদের শেকড়বাকড়ের পরীক্ষা চলছে।

প্রীতিলতার গলা দিয়ে একটা কান্নার মতন শব্দ হতেই অসমঞ্জ রায় উঠে এসে দাঁড়ালেন মাথার কাছে। প্রীতিলতার চোখ দুটি বোজা, অল্প অল্প শীতেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অসমঞ্জ রায় ভাবলেন, প্রতি বোধহয় স্বপ্ন দেখছে।

একটুক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। যেন অনেকদিন পর নিজের স্ত্রীকে দেখছেন। শুকিয়ে কতটুকু হয়ে গেছে শরীরটা, যেন চেনাই যায় না। বিয়ের সময় যারা প্রীতিলতাকে দেখেছে যেমন স্বাস্থ্য, তেমনই প্রাণ-প্রাচুর্য অসমঞ্জ রায়ের চোখেও সেই ছবিটাই লেগে আছে, তিনি প্রীতিকে সেইভাবেই মনে রাখতে চান। হঠাৎ তিনি গভীর মমতাবোধ করলেন স্ত্রীর জন্য। তিনি তাঁর ডান হাতটা আস্তে আস্তে রাখলেন প্রীতির কপালে।

প্রীতিলতা চোখ তুলে তাকাতেই তিনি নরমভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কষ্ট হচ্ছে, প্রীতি? কোনো ওষুধ দেবো?

প্রীতিলতা নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন দু’দিকে।

হাঁপানির চিকিৎসা বড় বড় ডাক্তাররাই করতে পারে না, স্বামীর হাতের ছোঁয়ায় আর কী এমন উপকার হবে! তবু কাজ অসমাপ্ত রেখে অসমঞ্জ রায় বিছানার ধার ঘেঁষে বসলেন। মাঝে মাঝে এমনও হয় যে সারাদিনে প্রীতির সঙ্গে ভালো করে একটা দুটো কথা বলারও সময় পাওয়া যায় না। অথচ প্রীতিলতার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকেই অসমঞ্জ রায়ের সৌভাগ্য ফিরেছে। আগে তিনি ছিলেন শহরতলীর কলেজের সামান্য একজন লেকচারার, প্রীতির বাবাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সুযোগ করে দেন। প্রীতির বাবা ছিলেন কন্ট্রোলার। নোট বই-এর প্রথম প্রকাশকের সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। তাছাড়া, প্রীতির কাছ থেকে পেয়েছেন সব ব্যাপারে উৎসাহ।

–ঘুম আসছে না? তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো, প্রীতি?

প্রীতিলতা কোনো কথা না বলে স্থির ভাবে চেয়ে রইলেন।

একটু বাদে দেওয়ালের বড় ঘড়িটার দিকে চোখ গেল, অসমঞ্জ রায় ভাবলেন, বারো মিনিট বসা হয়েছে, এবারে বোধহয় উঠে পড়া যায়। কত কাজ, আজ রাত্তিরের মধ্যে একটা পীস্ শেষ করতেই হবে। তিনি প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

তিনি ওঠবার আগেই প্রীতি হাত তুলে তাঁর হাত থামিয়ে দিয়ে অস্ফুটভাবে বললেন, এবারে তুমি শুয়ে পড়ো!

অসমঞ্জ রায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ওরে বাবা, খাটতে খাটতে কাঁধ ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। দেখি যদি আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শেষ করা যায়!

প্রীতিলতা আস্তে আস্তে বললেন, আমি যদি তুমি হতাম, তা হলে বোধহয় এইরকমই করতাম।

অসমঞ্জ রায় কথাটা ঠিক শুনতে বা বুঝতে পারলেন না। টান বেশি বাড়লে প্রীতির গলার আওয়াজটা ফ্যাসফেসে হয়ে যায়। একটা কীরকম যেন মেশিন চলার মতন শব্দ বেরোয়। তিনি মাথাটা ঝুঁকিয়ে প্রীতির মুখের কাছে এনে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে?

প্রীতিলতা ঠিক ঐ কথাটাই বললেন আবার। এবারে অসমঞ্জ রায় শুনতে পেলেও বুঝতে পারলেন না। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। কিন্তু কৌতুকের হাসি ফুটে উঠলো প্রীতিলতার ঠোঁটে।

–তুমি কী বললে? এই রকম মানে কী রকম?

–আমি তোমার মতন একজন ব্যস্ত পুরুষ মানুষ হলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতাম না।

অসমঞ্জ রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্রভাবে আহত বোধ করলেন। আজই তিনি জরুরি কাজের মাঝখানে উঠে এসে প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, প্রীতিকে একটু সেবা করতে চাইলেন, আর আজই প্রীতির মুখে এই কথা? প্রীতি না ডাকতেই তো তিনি এসেছিলেন।

অভিমানের সঙ্গে তিনি বললেন, আমি বুঝি তোমায় খুব অযত্ন করি? আমাকে নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বটে…

প্রীতিলতা তাঁর স্বামীর বাহু ছুঁয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, না, না, তুমি আর কী করবে? তুমি তো যথেষ্ট করেছে। আমি পুরুষ মানুষ হলে বোধহয় এতটাও পারতাম না।

–এখন আর কথা বলো না। ঘুমোও। কথা বললে তোমার কষ্ট হবে।

–কথা না বললেও আমার একইরকম কষ্ট হয়।

–আমি তো তোমার চিকিৎসার কোনোরকম ত্রুটি করিনি!

–তা তো জানিই। আমার এ রোগ সারবে না। বোধহয় কোনো পাপ-টাপ করেছিলাম।

–ধ্যাৎ! ওসব বাজে কথা। একেবারে না সারলেও যদি খুব নিয়মে থাকো, তাহলে কষ্টটা কম হবে। ঘুমই হচ্ছে এই রোগের আসল ওষুধ!

অসমঞ্জ রায় উঠে দাঁড়াতেই প্রীতিলতা কাতরভাবে বললেন, এই, শোনো! আর একটুখানি বসবে? তোমার কাজের খুব ক্ষতি হবে?

অসমঞ্জ রায় আবার বসে পড়ে, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ক্ষতি আবার কী, আজ না হয়। কাল হবে। জগৎ হারামজাদা বড্ড তাড়া দিচ্ছে।

কথা থামিয়ে তিনি ঝুঁকে পড়ে অনেকদিন বাদে প্রীতিলতাকে একটা চুম্বন দিলেন। প্রীতিলতার ঠোঁট ঠাণ্ডা। তাতেও নিরস্ত না হয়ে অসমঞ্জ রায় প্রীতিলতার বুকে এক হাত রেখে আর এক হাতে ব্লাউজের বোতাম খুলতে গেলেন। তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কালি লেগে। আছে। এই অবস্থাতেও তাঁর খেয়াল হলো যে তাঁর পেনটা লিক করছে। ওটা বদলাতে হবে। নতুন দেশি ফাউন্টেন পেন উঠেছে, একেবারে অপদার্থ!

প্রীতিলতা বললেন, আজ শুয়ে শুয়ে যতসব অদ্ভুত কথা ভাবছিলাম। ধরো, আমি যদি পুরুষ মানুষ হতাম, আর তুমি হতে আমার বউ! আমি বেশ ব্যস্ত, অনেক লোক আমায় চেনে, অনেক লোক খাতির করে, আর তুমি একটা হাঁপানির রুগী, মাসের মধ্যে পঁচিশ দিনই বিছানায় শুয়ে থাকো আর ঘ্যান ঘ্যান করো, তা হলে আমি তোমায় শুধু মিষ্টি কথা বলে সান্ত্বনা দিয়ে তারপর অন্য মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। অন্য কোনো মেয়েকে বেশি কাছে পেতে চাইতাম!

অসমঞ্জ রায়ের যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই সময় বিবর্ণ হয়ে গেল তাঁর মুখ। একটু আগে ছিল অভিমান, এখন জ্বলে উঠলো রাগ। প্রীতি এমন ঘুরিয়ে কথা বলতে শিখলো কবে থেকে? টিরানি অব দা উইক! দুর্বলের নিষ্ঠুর অত্যাচার। মেয়েরা অতি দুর্বল হলেও জহ্লাদিনী। হতে পারে। প্রতি জানে যে অসমঞ্জ রায় এখন বেশি রেগে তাকে কঠোর কথা বলতে পারবেন, হঠাৎ একটা থাপ্পড় কষাতে পারবেন না!

–আমি বুঝি অন্য মেয়েদের সঙ্গে…আমি কি তোমার জন্য যতদূর সাধ্য…

–না, না, না, তুমি সেরকম কিছু করেছে, তা বলছি না। কিন্তু আমি বোধহয় করতাম। তুমি ভালো, আমি অতটা ভালো নই!

–প্রীতি, তুমি ঠিক কী বলতে চাও, খুলে বলো তো! এইসব কথা কেন তোমার মনে আসছে?

–বলবো? না, থাক, আজ থাক!

–কেন, বলবে না কেন? যদি কিছু সত্যি সন্দেহ হয়ে থাকে তোমার তাহলে খুলে বলো!

–না, সন্দেহ আমার হয়নি। শুধু একটা ব্যাপার আমার মনে লেগেছে। তুমি চন্দ্রাকে—

–ওঃ, চন্দ্রা? তাই বলো!

অসমঞ্জ রায় কৃত্রিম ভাবে এমন জোরে হেসে উঠলেন যে পাশের ঘরে ছেলেমেয়েরা জেগে থাকলে শুনতে পেত! তখনো প্রীতিলতার ঘুমন্ত স্তনে তাঁর হাত।

হাসতে হাসতে অসমঞ্জ রায় বললেন, চন্দ্রাকে নিয়ে তোমার সন্দেহ? ওকে তো আমি মাত্র কয়েকদিন ধরে চিনি, এখনো দু’সপ্তাহও হয় নি। ওরা একটা চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশান খুলেছে, তাতে জোর করে প্রেসিডেন্ট করেছে আমাকে। আমি হতে চাইনি, কিন্তু ওরা একেবারে নাছোড়বান্দা!

–চন্দ্রা মেয়েটি আমাদের বাড়িতে আসে, আমার সঙ্গে তো আলাপ করিয়ে দাওনি একবারও।

–ও মেয়েটা তো পাগলের মতন। ঝড়ের বেগে আসে, হুড় হুড় করে কথা বলে যায়, নিজেই বেশি বলে, তারপর কাজের কথা শেষ হলেই চলে যায় সঙ্গে সঙ্গে!

–যারা কাজ করে, তারা বুঝি অন্য কথা বলে না? আমি তো একদিন জানতাম, বাড়িতে কোনো মেয়ে এলে তারা ভেতরে এসে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে।

–ঐ চন্দ্রা তো অন্যরকম। ঠিক বাঙালীদের মতন নয়। আপকান্ট্রিতে কোথায় নাকি ছিল, আমি ঠিক জানি না, মানে, বাঙালী আদপ কায়দা জানে না।

–চন্দ্রা সিগারেট খায়!

–সে আজকাল হাই সোসাইটির অনেকেই…মানে বাঙালীদের চেয়ে অবাঙালীরা আরও এক কাঠি এগিয়ে আছে। গত বছর বোম্বোতে যে কনফারেন্সে গেলুম, তাতে দেখি যে বেশ কয়েকজন মহিলা ফুক ফুক করে সিগারেট টানছে সবার সামনে। একজন তো আমাদের ভাইস চ্যান্সেলারের মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে…

প্রীতিলতা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন স্বামীর দিকে। মনে হয় তিনি কিছু শুনছেন না। তাঁর মুখখানা লালচে হয়ে গেছে। একটা কাশির দমক চাপা দেবার চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে নিশ্বাস নিচ্ছেন হাঁ করে। প্রীতিলতার স্বভাব অত্যন্ত নরম, পৃথিবীকে তিনি খারাপ চোখে দেখেন।

–চন্দ্রা মেয়েটি ভালো। তুমি ওর সঙ্গে মিশতে পারো।

কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন অসমঞ্জ রায়। আজ প্রীতির ব্যবহারে তিনি শুধু আহত নন, বিস্মিতও হচ্ছেন যথেষ্ট। আজ কী ভর করেছে প্রীতির ওপর?

–ও, তোমার বুঝি নিজস্ব স্পাই আছে। তুমি এর মধ্যেই চন্দ্রা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছো?

–বাঃ, বাড়িতে একটা মেয়ে আসছে, তার সম্পর্কে কৌতূহল হবে না? শুনলাম তো, মেয়েটা গরিবদের জন্য সত্যিই অনেক কিছু করে!

–তা অবশ্য তুমি ঠিকই শুনেছো। ঐসব নিয়েই মেতে আছে। বিয়ের দু’বছর পরেই বিয়ে ভেঙে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা কিছু হয় নি, কিন্তু আর পাঁচটা মেয়ের মতন ঘরে বন্দী না থেকে ও কাজ নিয়ে সব কিছু ভুলে থাকতে চায়।

প্রীতি মাথাটা একটু উঁচু করে সরল ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, যে-সব মেয়েরা দেশের সেবা করে, তারা কি সিগারেট খায়? হাতকাটা ব্লাউজ পরে? ঠোঁটে লিপস্টিক মাখে?

অসমঞ্জ রায় কপাল ঘোঁচ করে বললেন, ওসব তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা কেন তা। নিয়ে মাথা ঘামাবো? চন্দ্রার সঙ্গে আমার অত্যন্ত ফর্মাল সম্পর্ক, শুধু কাজের কথা হয়, আমাকে। দিয়ে ফাঁইলপত্তর সই করাতে আসে। তবে যারা দেশের কাজ করবে তাদের যে সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকতে হবে, তারই বা কী মানে আছে! বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ছবি দেখো নি? নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা, তাকে আমি একবার সামনাসামনি দেখেছি, সে অবশ্য লিপস্টিক মাখে না, কিন্তু শাড়ীটা….

–তোমাকে চন্দ্রাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করলো কেন? তোমার সঙ্গে আগে থেকে চেনা। ছিল?

–আমি আগে চন্দ্রাকে দেখিইনি কোনোদিন! ওরা নিজেরাই এসে বললো, আমি রেড ক্রসের সঙ্গে যুক্ত আছি বলেই বোধহয়…তাছাড়া আমি দাঙ্গার সময় রিলিফের অনেক কাজ করেছি।

–আমি চন্দ্রাকে একটা চিঠি লিখবো ভাবছি।

অসমঞ্জ রায়ের মাথায় আচমকা যেন একটা কোনো ভারি বস্তুর আঘাত লাগলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে গেলেন। রোগা, দুর্বল, অসহায় প্রীতিলতা আজ এ কি সাঙ্ঘাতিক খেলা শুরু করেছে?

–তুমি চন্দ্রাকে চিঠি লিখবে? কেন? প্রীতি, তোমার মাথায় কী ঢুকেছে বলো তো!

–তেমন কিছু নয়, বিশ্বাস করো! নিছক একটা কৌতূহল। আমি জানতে চাই, আজকের ঘটনাটা শুনলে চন্দ্রার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়! তোমার সম্পর্কে ওর ভক্তি বাড়বে, না কমবে!

–আজকের ঘটনা? তার মানে! কোন্ ঘটনা?

–তুমি পারুলের ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিলে। পারুলকেও চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে এককথায়। ছেলেটা পড়াশুনো করতে চেয়েছিল।

–আঃ, তোমাকে তো তখন বললুম, এ ছেলেটার বাপটা একটা খুনী! হারীত মণ্ডলের কেসটা আমিও কাগজে পড়েছি। এখন জেলে আছে। তোমাকে ওরা সে কথা আগে। জানিয়েছিল?

–বাপ খুনী হলে ছেলে বুঝি আর লেখাপড়া করতে পারবে না? সেরকম নিয়ম আছে কোনো? তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে যারা পড়ে, তাদের সবারই বাবা কে কী করে না করে তোমরা যাচাই করে নাও?

–তুমি বড় অবুঝের মতন কথা বলছো, প্রীতি! শুধু সে জন্য নয়। ঐ হারীত মণ্ডল কাকে খুন করেছে জানো? আমাদের সমুর খুড় শ্বশুরকে!

–সমুর খুড় শ্বশুর?

–আমার মামাতো ভাই সমু বরানগরের সরকার বাড়ির মেয়ে বিয়ে করেছে তুমি জানো না? সমুর বউ ফুলটুসীর আপন কাকা অসিতবরণ সরকার খুন হয়েছেন তাঁদের কাশীপুরের বাগানবাড়িতে। তাই নিয়ে কত কাণ্ড হলো।

প্রীতিলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ফেরালেন। কী যেন চিন্তা করলেন একটু। তারপর আপন মনে বললেন, খুনীর ছেলে! কী জানি! আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছিল ছেলেটিকে..সমুর শ্বশুরবাড়িতে কী হয়েছে না হয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? আমরা কী সাতজন্মে সে বাড়িতে যাই? 

–এ তুমি অদ্ভুত কথা বলছে, প্রীতি। সমুর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, আমার নিজের মামার সঙ্গে তো সম্পর্ক রাখতে হবে! মামার কুটুমকে যে খুন করেছে….

অসমঞ্জ রায় ঝপ করে উঠে দাঁড়ালেন। রাগে তাঁর মুখ গনগন করছে। এনাফ ইজ এনা! এবারে তাঁকে স্বামী হিসেবে, সংসারের অধিপতি হিসেবে চরম অধিকার প্রয়োগ করতে হবে। মেয়েদের সঙ্গে তর্ক করতে গেলে কখনো শেষ হয় না।

টেবিলের কাছে এসে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কোনো খুনীর বউকে আমি বাড়িতে স্থান দিতে পারবো না, এই আমার শেষ কথা! রিফিউজিদের মধ্যে কত ক্রিমিনাল তৈরি হচ্ছে তুমি জানো না! রিফিউজি বলেই যে দয়ায় গলে গিয়ে তাদের সাহায্য করতে হবে, সেটা একটা ইডিয়টিক ধারণা!

প্রীতিলতা তবু মিনমিন করে বললেন, আমাকে না জিজ্ঞেস করেই তুমি পারুলকে ছাড়িয়ে দিলে, আমার ছেলেমেয়েদের এখন কে দেখবে?

–কালই আমি অন্য আয়া জোগাড় করে আনবো। এখন ঘুমোও, কিংবা চুপ করে থাকো। আমাকে কাজ করতে দাও!

সিগারেট ধরিয়ে অসমঞ্জ রায় কলম হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু মাথা গরম হয়ে গেছে, লেখা আসবে না। এক দৃষ্টে তিনি তাকিয়ে আছেন কাগজের দিকে। প্রীতির বাবার সঙ্গে কালই দেখা করতে হবে। প্রীতি কিছু বলার আগেই অসমঞ্জ রায় তাঁকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবেন। প্রীতির বাবাকে তিনি এখনো ভয় পান। প্রীতির বাবা একবার বলেছিলেন, প্রীতিকে নিয়ে পুরী কিংবা গোপালপুর যেতে। প্রীতির ভাই-বোনেরা যদি কেউ নিয়ে যায়, অসমঞ্জ রায় সব খরচ দিতে রাজি আছেন।

দেওয়াল-ঘড়ির শব্দতেই শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে রাত্রির নিস্তব্ধতা। এই লেখা আজ আর শেষ হবে না। মুখ ফিরিয়ে তিনি একবার দেখলেন প্রীতিলতাকে। চোখ বোজা থাকলেও ঘুমোয় নি, বোঝা যায়। বাতাসের তরঙ্গে টের পাওয়া যায়। শয্যাশায়িনী হলেও সব ব্যাপারে প্রীতির স্পষ্ট মতামত আছে। প্রীতি এত সহজে হার মেনে নেবে না। অসমঞ্জ রায় হঠাৎ যেন গলায় একটা বিপদের গন্ধ পেলেন।

আবার উঠে এসে তিনি গাঢ় গলায় বললেন, প্রীতি, তুমি যদি চাও, আমি চন্দ্রার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না। ওদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পোস্ট থেকে আমি রেজিগনেশান। দেবো। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অত সময় বা উৎসাহও আমার নেই!

প্রীতি কোনো সাড়া শব্দ করলেন না।

সে রাতে ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে ফেললেও পরদিনই অসমঞ্জ রায় মতবদল করলেন। চন্দ্রার সঙ্গে তাঁর বাইরে যাবার কথা আছে। সেই কথা তাঁকে রাখতেই হবে।

চন্দ্রাদের বাড়ির নিজস্ব গাড়ি আছে। সেই গাড়িতেই যাওয়া হলো ধুবুলিয়ার দিকে। সামনে ড্রাইভার, পেছনে শুধু চন্দ্রা আর অসমঞ্জ রায়। চন্দ্রার পরনে আজ একটা নীল-ডুরে তাঁতের শাড়ি, চোখে সানগ্লাস। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই অসমঞ্জ রায়ের বুক ধক ধক করছে। পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিজ্ঞ পুরুষ তিনি, কিন্তু এরকম আগে কখনো হয়নি। চন্দ্রার শরীরটি যেন অয়স্কান্ত মণি দিয়ে গড়া। চন্দ্রার মুখের থেকে তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না। কপালে যা থাকে থাক, চন্দ্রার কাছ থেকে তিনি কিছুতেই দূরে সরে যেতে পারবেন না।

চন্দ্রা আজ প্রায় কোনো কথাই বলছে না। মুখোনি রেখাহীন। অসমঞ্জ রায়ের প্রশ্নে শুধু হুঁ না  করে যাচ্ছে। চন্দ্রা একবার একটা সিগারেট প্যাকেট বার করতেই অসমঞ্জ রায় দেশলাই জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে চন্দ্রার গাল ছুঁয়ে দিলেন ইচ্ছে করে। তারপর উঠতি যুবার মতন কাঁপা গলায় বললেন, চন্দ্রা, আজকের দিনটা কী সুন্দর!

চন্দ্রা মুখটা একটু সরিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে বললো, মিঃ রায়, আপনাকে একটা কথা বলবো বলবো করছিলুম। আপনার স্ত্রী আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।

অসমঞ্জরায় সেই মুহূর্তে এই অসহায় হয়ে গেলেন যে কোনো কথাই বলতে পারলেন না।

চন্দ্রা আবার বললো, তিনি কী লিখেছেন, আপনি জানেন নিশ্চয়ই! আমি কাশীপুর কলোনিতে গিয়ে ছেলেটিকে খুঁজে বার করেছি। হি ইজ এ ব্রিলিয়ান্ট বয়। আপনি তাকে কোনো সাহায্য না করে তাড়িয়ে দিলেন কী করে? আপনি আপনার স্ত্রীর কোনো মতামতেরও মূল্য দেন না? আই এগ্রি উইথ হার যে আপনি এটা খুব অন্যায় কাজ করেছেন।

–কিন্তু চন্দ্রা, তুমি জানো না, ঐ ছেলেটার বাবা একজন খুনী!

–হ্যাঁ জানি। সব শুনেছি! তাতে কী হয়েছে। খুন করেছে, বেশ করেছে! ওরা অসহায়, ওদের কেউ জায়গা দেবে না, ওরা জোর করে কেড়ে নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক! এরকম আরও অনেক খুন করতে হবে, আগুন জ্বালাতে হবে! বাগানবাড়ি জবর দখল করা কোনো অপরাধ? অন্য দেশ হলে ঐ হারীত মণ্ডল বীরের সম্মান পেত!!

চোখ থেকে রোদ-চশমা খুলে চন্দ্রা তীব্র চোখে তাকালো অসমঞ্জ রায়ের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *