1 of 3

১.২৩ একটা মোটরবাইক চেপে হাজির

একটা মোটরবাইক চেপে হাজির হলো আলতাফ। মাদারিপুর থেকে সে খোঁজ করতে করতে আসছে। মোটরবাইকের তেজী আওয়াজ কাঁপিয়ে দিচ্ছে দিগন্ত পর্যন্ত, একপাল কাচ্চাবাচ্চা ছুটে আসছে পেছন পেছন। শীতকাল বলেই গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছোবার রাস্তা পেয়েছে। তাও ঠেলে ঠেলে আনতে হয়েছে দু জায়গায়।

মামুনের বাড়ির উঠোনের কাছে শিশুবাহিনী সমেত মোটরবাইক এসে থামলো। আধুনিক যুদ্ধের সেনাপতির মতন চেহারা আলতাফের। ফসা রং, দাড়ি নেই, গোঁফ আছে, মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা চুল। চোখে সান গ্লাস, গায়ে একটা চামড়ার কোট, দু হাতে দস্তানা।

মোটরবাইকের গর্জন থামিয়ে, হাত থেকে দস্তানা খুলে সে হাঁক দিল, মামুন ভাই! মামুন ভাই!

মামুন আগেই জানলা দিয়ে দেখেছেন এই অদ্ভুত আগন্তুককে। তিনি ঠিক আন্দাজ করতে পারছেন না যে লোকটি কিসের দূত। অবশ্য অশুভ আশঙ্কাটাই প্রথম মনে জাগে। দিনকাল ভালো নয়! কে কার নামে কখন কোথায় লাগিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। কয়েকদিন আগেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা সাহেব বলছিলেন, মামুন, তুমি যে এখনো এত বেশি কলকাতার গল্প করো, সেটা কিন্তু অনেকে ভালো চোখে দেখবে না। কেউ কেউ ভাবতে পারে, এখনো তোমার মন পড়ে আছে ভারতে! কিংবা তুমি ভারতের দালাল!

স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্মলগ্নের প্রায় পরে পরেই কাশ্মীর নিয়ে একটা বখেরার সৃষ্টি হয়ে আছে। তিক্ততা বাড়ছে ক্রমশই। যুদ্ধ উপলক্ষে সকলেরই দেশাত্মবোধ তীব্র হয়ে ওঠে। দেশাত্মবোধের অপর নাম ঘৃণা। ভাই-ভাই ঝগড়া করে বাড়ির মাঝখানে বেড়া তুললে তারা শত্রুর চেয়েও বেশি শত্রু হয়। ডাক শুনে মামুন বেরিয়ে এলেন এবং যুবকটিকে একেবারেই চিনতে পারলেন না।

যুবকটি সাড়ম্বরে কৃত্রিম গলায় বললো, সেলাম আলেকুম, মামুনভাই, শরীর-গতিক সব ভালো তো?

মামুন অনেকটা যান্ত্রিকভাবে উত্তর দিলেন, আলাইকুম আসেলাম! হ্যাঁ ভালো আছি। আপনি?

চোখ থেকে সান গ্লাস খুলে যুবকটি বললো, আমায় চিনতে পারলেন না? আমি আলতাফ। আলতাফ হোসেন!

অন্তত দু’জন আলতাফ হোসেনকে চেনেন মামুন। তার মধ্যে একজন আলতাফ তো খুবই প্রতিপত্তিশালী। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় নাজিমুদ্দিনের আমলে সরকারের প্রচার সচিব। এমনিতে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষ, কিন্তু শরীরের প্রতিটি গাঁটে গাঁটে যেন সাম্প্রদায়িকতার বিষ জমে ছিল। সেই উদ্দেশ্যে তিনি যে-কোনো ঘটনাকেই ইচ্ছে মতন রূপ দিতে পারতেন। মামুন একবার সেই আলতাফ হোসেনকে বলেছিলেন…

নাঃ, আবার কলকাতার কথা মনে এসে যাচ্ছে। সে যাই হোক, এই মোটরবাইক-আরোহী আলতাফকে তিনি আগে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। লোকটি এমন অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলছে, যেমন অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলতে পারে হয় কোনো পুলিশের গোয়েন্দা অথবা কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মামুন বললেন, আসেন, আসেন, ভিতরে আসেন!

আলতাফ প্রথমে তার যানটিতে চাবি লাগালো। তারপর বললো, মনে তো হচ্ছে আপনি এখনো আমারে চিনতে পারেন নাই? আমার আব্বা রফিক আহমদ সরকারকে মনে আছে তো? দায়ুদকান্দিতে আপনাদের একেবারে প্রতিবেশী ছিলেন?

মামুন এবারে একেবারে পরিষ্কার বুঝে গেলেন। দায়ুদকান্দিতে ঐনামের কেউ ছিল না, প্রতিবেশী হলে মামুনের নিশ্চিত মনে থাকতো। এই লোকটি অন্য কোনো মতলোবে এসেছে।

বাড়ির দাওয়াতে মোড়া পেতে তিনি বসতে দিলেন আলতাফকে। এখন শেষ বিকেল, চা খাওয়ার সময়। অন্দরমহলে চায়ের কথা জানিয়ে দিয়ে মামুন জিজ্ঞেস করলেন, এখন আপনি। কোথা থেকে আসছেন? রাত্তিরটা এই গরিবের বাড়িতেই থাকেন।

আলতাফ বললো, আরে মামুন ভাই, আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন! আমি কত। ছোট, আপনার পোলার মতন। ভাবী কোথায়?

–আসছেন, চা বানিয়ে নিয়ে আসছেন।

–অনেকদিন আপনি ঢাকায় যাননি, তাই না মামুন ভাই? ঢাকায় আপনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল শেষবার মাকুশা মাজারের কাছে। সেখানকার ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেসে আপনি আড্ডা দিতে যেতেন না? আবদুল গণি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীন এঁরা সব থাকতেন, আমিও ছিলাম। আপনি আমার সাথে কথাও বলেছেন!

–ও তাই নাকি? আমার তো মনে নাই!

মামুনের মনে হলো, এই লোকটি নানারকম কথা বার করতে চাইছে। এর কাছে যে-কোনো মন্তব্যই বিপজ্জনক। তবু, ভালো ব্যবহার করতেই হবে।

আলতাফ পকেট থেকে একটি পাঁচশো পঞ্চান্ন নম্বর সিগারেটের প্যাকেট বার করে মামুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ন্যান!

মামুন বললেন, আমার চলে না।

তিনি মনে মনে ভাবলেন, বিদেশী দামী সিগারেট, ওর সান গ্লাস, চামড়ার কোট, দস্তানা, ঐ মোটরবাইক, সবই বিদেশী! এই সবই বর্তমান পাকিস্তানী যুবকদের ভোগ্যবস্তু।

সিগারেটে টান দিয়ে আলতাফ বললো, এই গ্রামের ইস্কুলে আপনি পড়াচ্ছেন নাকি, মামুনভাই?

–নাঃ!

–তা হলে ঢাকা শহর ছেড়ে এখানে বসে আছেন কেন?

–এমনিই চুপচাপ বসে আছি।

–আপনার সন্ধান কী করে পাইলাম জানেন? নদীমাতৃক নামে একটি পত্রিকায় আপনে সাক্ষাৎকার দিছেন, না? সেইটা পড়লাম।

–ও।

–আপনি কয়েকটা বেশ ভালো কথা বলেছেন। আপনার সাথে আমার খুব প্রয়োজন। আপনাকে একবার টাঙ্গাইল যেতে হবে। আমার সাথেই চলেন।

–আমি টাঙ্গাইল যাবো? কেন?

–আগে আমার পরিচয়টা দিয়া লই। বায়ান্নর ছাত্র আন্দোলনে আমি ভালোই জুটছিলাম, অল্পের জন্য জেল খাঁটি নাই। তারপর বি এ পাশ করছি। কিন্তু চাকরিবাকরিতে মন বসে না। ঢাকা শহরের আড্ডাই আমারে খাইছে। বাড়ি থেকে টাকা পয়সা পেতাম, বুঝলেন। আমার আব্বা একটু মাঝে মধ্যে বকাবকি করলেও আমার মায় আমারে খুব ভালোবাসে। চলছিল বেশ। ভালোই। কিন্তু মা এখন একটা বায়না ধরেছেন। সেইজন্যই আপনার সাহায্য চাইতে ছুটে এসেছি।

মামুন মুখভঙ্গিতে যথাসাধ্য ভদ্রতার ভাব বজায় রাখবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই প্রলভ যুবকটির কাহিনী কেন তিনি শুনতে বাধ্য তা কে জানে! এর গল্পের মাথা-মুণ্ডুও তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

তিনি শুষ্কভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী সাহায্য করবো আমি?

–আমার মা এখন বলছেন, ওরে বকু, (বকু আমার ডাক নাম, বুঝলেন, শুধু আমার মা আমারে এই নামে ডাকে) মা বললেন, তুই শুধু শুধু আজরাইলডার মতন ঘুইরা বেড়াস, তুই বিয়া শাদী না করলে তোরে আমি আর টাকা দিমু না!

যেন এটা একটা হাসির কথা, আলতাফ প্রচণ্ড জোরে বাড়ি কাঁপিয়ে হেসে উঠলো হাহা শব্দে।

মামুনও কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললেন, কিন্তু আমার তো কোনো বিবাহযোগ্য কন্যা নাই, আমি তোমারে কী ভাবে সাহায্য করবো বলো তো? আমার মেয়েরা নেহাতই ছোট ছোট।

–সে জানি, সে জানি! তাছাড়া, আপনার বিবাহযোগ্য কন্যা থাকলেও কোনো লাভ ছিল। বিয়ে করলে আমি একটি মাত্র মেয়েকেই বিয়ে করবো। মনে মনে তাকে ঠিক করা আছে। সেই ব্যাপারেই আপনার সাহায্য চাই।

–আর একটু বুঝিয়ে বলো!

–টাঙ্গাইলের উকিল সুকুমার বক্সী আপনার বন্ধু না? তিনি প্রায়ই আপনার কথা বলেন। সেই বক্সী বাড়ির মেয়ে পারুলকে আমি বিয়ে করতে চাই। আপনাকে গিয়ে একটু বুঝিয়ে বলতে হবে।

মামুন চুপ করে গেলেন। সুকুমার বক্সীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে বটে কিন্তু তা ঠিক বন্ধুত্বের পর্যায়ে পড়ে না। টাঙ্গাইলে ঐ বাড়িতে তিনি দু একবার গেছেন। সুকুমার বক্সী মানুষটি ভারি নিরস, মেপে মেপে হিসেব করে কথা বলে।

আলতাফ বললল, মামুনভাই, তা হলে যাচ্ছেন তো আমার সঙ্গে?

–তুমি এই জন্য এতদূরে আমার কাছে এসেছো? আমার পক্ষে এখন টাঙ্গাইল যাওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া আমার অনুরোধই বা তাঁরা শুনবেন কেন! আজকাল ভিন্ন জাতের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসার বিয়ে হচ্ছে, তা জানি। কিন্তু কোনো হিন্দু সম্বন্ধ করে কোনো মুসলমান ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইবে, এতটা বোধহয় এখনো হয় নি!

আলতাফ চোখ নাচিয়ে গূঢ় ইঙ্গিত করে বললো, ভাব ভালোবাসা আছে, ভাব ভালোবাসা আছে! পারুলের মত আছে। কিন্তু ঐ গোঁয়ার উকিলটাই রাজি নয়। আমি ইচ্ছে করলে ঐ মেয়েকে বক্সীবাড়ি থেকে একদিন উঠিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারি, কিন্তু তখন আপনাদের মতন লিবারালরাই বলবেন, হিন্দুদের ওপর জবরদস্তি করা হচ্ছে, অন্যায় হচ্ছে! ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়াই ঠিক কি না?

–তুমি আমায় ঘটকালি করতে বলছো?

–অগত্যা, আর উপায় কী?

–আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

–আপনি একবার টাঙ্গাইল চলুন, আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই হবে। ঐ বক্সী-উকিল আপনাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে!

–বললাম তো, আমার পক্ষে এটা সম্ভব না।

বাড়ির ভেতর থেকে একটি বাচ্চা মেয়ে চা নিয়ে এলো। সঙ্গে দুটি ডিম ভাজা।

আলতাফ বললো, ভাবী কোথায়? ভাবী এলেন না?

ফিরোজা বাইরের লোকের সামনে সচরাচর আসেন না। কিন্তু এই আগন্তুক সম্পর্কে তার কৌতূহল হয়েছে, তিনি ঘরের মধ্যে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। আলতাফের হাঁক-ডাকের চোটে তাঁকে বেরিয়ে আসতে হলো।

আলতাফ যেন তাঁকে কতকাল ধরে চেনে। সে বললো, এই যে ভাবী, মামুনভাইকে একটু ছেড়ে দিতে হবে কয়েকটা দিনের জন্য। উনি আমার সঙ্গে টাঙ্গাইল যাবেন।

ফিরোজা আলতাফের প্রস্তাব সবই শুনেছেন। এরকম বিবাহ তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। তিনি বললেন, উনি তো এখন যেতে পারবেন না। এদিকে কাজ আছে।

আলতাফ ফিরোজার কঠিন কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব না দিয়ে বললো, কী আর এমন কাজ! চলেন চলেন, আপনিও সাথে চলেন, কটা দিন বেড়িয়ে আসবেন। টাঙ্গাইলে আমাদের একখানা বাড়ি আছে, সেখানে থাকবেন।

ফিরোজা বললেন, ধন্যবাদ। যখন আমাদের টাঙ্গাইল যাবার প্রয়োজন হবে, তখন আপনাকে নিশ্চয় জানাবো। এখন আমাদের যাওয়া হবে না।

আলতাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উঠোনের দিকে দেখলো। কয়েকটা বাচ্চা এখনো তার মোটরবাইকটার গায়ে হাত বুলোচ্ছে। উল্টোদিকের ঘরগুলির জানলায় কয়েকটি উৎসুক মুখ। বিকেল প্রায় শেষ, লাল হয়ে এসেছে আকাশ। একপাল মুরগী ছুটোছুটি করছে এদিক সেদিক।

আলতাফ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মামুনভাই, একটু ঘরের মধ্যে চলেন তো, আপনার সাথে একটা প্রাইভেট কথা আছে।

মামুন ভাবলেন, এইবারই এসেছে চরম মুহূর্ত। এতক্ষণ আলতাফের কোনো কথাতেই সত্যের ধ্বনি ছিল না। সবই কেমন আলগা আলগা। এই প্রাইভেট কথাটাই খাঁটি শোনালো। এবারে সে গ্রেফতারি পরোয়ানা বার করবে নিশ্চিত। কিংবা রিভলভার দেখাবে। কিন্তু কী দোষ করেছেন তিনি? ঐ ছোট্ট একটি পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে কথা বলাটাই অন্যায় হয়েছে?

ঘরের মধ্যে এসে আলতাফ গোপন কথার ভঙ্গিতে বললো, মামুন ভাই, আপনাকে টাঙ্গাইল যেতেই হবে। না বলবেন না!

বিপদ এলেও মামুন আত্ম-সম্ভ্রম হারাতে রাজি নন। তাঁকে এরা ভয় দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। জোর করে নিয়ে যেতে চায় তো যাক। মুসলিম লীগের কর্মীদের রাগ আছে তাঁর ওপর। এই ছেলেটিকেও মনে হচ্ছে সেই দলের।

তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়।

–আপনাকে মৌলানা ভাসানী ডেকে পাঠিয়েছেন!

নামটা শুনে চমকে উঠলেও মামুন ভাবান্তর দেখালেন না। এটা একটা টোপ মনে হচ্ছে।

–কেন, মৌলানা কি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন হিন্দু মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েতে ঘটকালি করতে?

–এই দেখুন তোয়াহা ভাই-এর একটা চিঠি।

চিঠিটা খুলে মামুন অবাক না হয়ে পারলেন না। ঘরের মধ্যে আলো কম, তিনি জানলার কাছে এসে চিঠিখানা পরীক্ষা করে দেখলেন। যুব লীগের প্যাড, হাতের লেখাও তাঁর চেনা।

আলতাফ বললো, মামুন ভাই, যুব লীগের একজন কর্মী। আপনি আমাকে আগে দেখেছেন, এখন হয়তো মনে করতে পারছেন না। টাঙ্গাইলে আমরা সবাই যাচ্ছি, মৌলানা ভাসানী আপনাকেও যেতে বলেছেন।

মামুন ভুরু কুঁচকে বললেন, আমি একজন সামান্য মানুষ, মৌলানার মতন অত বড় একজন নেতা আমাকে ডাকবেন কেন?

মৌলানা চাইছেন সব ছোট ছোট দলগুলিকে এক করে ভবিষ্যতের একটা কর্ম পদ্ধতি ঠিক করতে। আওয়ামি মুসলিম লীগ থেকে আপনার মতন বেশ বড় একটা ফ্যাকশান বেরিয়ে এসেছে, উনি তাদের সবাইকে আবার ডাকতে চান। আপনি শোনেন নি যে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দেবার প্রস্তাব উঠেছে?

–কই না, শুনিনি তো!

–আপনি গ্রামে বসে বসে ভেজিটেট করছেন, এসব জানবেন কী করে? ‘চলো যাই কাজে, মানব সমাজে’! চলুন, চলুন, বেরিয়ে পড়তে হবে।

–তা হলে তোমার ঐ বিয়ের ব্যাপারটা কী বলছিলে? আলতাফ আবার জোরে হেসে উঠলো মাথা দুলিয়ে। তারপর বললো, আমি একটু উল্টাপাল্টা কথা বলি। আপনাকে একটু টেস্ট করছিলাম মামুনভাই, আপনি কিন্তু হেরে গেছেন!

–এখনো বুঝলাম না!

–নদীমাতৃক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অন্তর্বিবাহ চালু হওয়া উচিত। এরকম বিয়ে যত বেশি হবে ততই মঙ্গল। তা না হলে সাম্প্রদায়িকতার বিষ কোনোদিন ঘুচবে না। বলেন নি একথা?

মামুন চুপ করে রইলেন।

–অথচ আমি যখন আপনাকে এইরকম একটা বিয়েতে ঘটকালি করতে বললাম, তখন আপনি পিছিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কথা ও কাজে মিল নাই। মামুনভাই, মুখে আমরা যা প্রচার করবো, নিজের জীবনেও তো তা প্র্যাকটিস করতে হবে! তাই না?

মামুন কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। এই ছেলেটা তাকে একেবারে জব্দ করে দিয়েছে। প্রথম থেকেই একটা ভুল ধারণা করেছিলেন বলে এই ছেলেটি সম্পর্কে তাঁর মনে একটা প্রতিরোধের ভাব গড়ে উঠেছিল।

আলতাফ আবার বললো, আপনাকে প্রথমে মিথ্যা বলেছিলাম। আমাদের বাড়ি দায়ুদকান্দি নয়, টাঙ্গাইল। আপনি শুনে খুশি হবেন, আপনার বন্ধু সুকুমার বক্সীর বাড়ির আমি জামাই। পারুলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে গত বৎসর।

মামুনের চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। এখন এই ছেলেটির সব কিছুই প্রশংসনীয় মনে হলো তাঁর কাছে। কী সুন্দর স্বাস্থ্য ছেলেটির, কী রকম সরল-তেজী মুখ, উৎসাহে-ভরপূর কণ্ঠস্বর।

 তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এতক্ষণ একথা বলোনি কেন? বক্সীবাবু আপত্তি করেন নাই?

–মোটেই না। ও বাড়িতে আমার প্রত্যেকদিন জামাই-আদর।

–তোমার বাড়িতে?

–আমার মা কান্নাকাটি করেছিলেন, আমাকে দিব্যি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি বড় ছেলে তো, মাকে ভয় দেখালাম, তাহলে আমি করাচী চলে যাবো! এখন দুই ফ্যামিলিতে খুব ভাব।

–বাঃ, তুমি তো কামাল করেছো, আলতাফ।

–তা হলে আপনি যাচ্ছেন তো? মামুন ভাই!

–তুমি আমার খোঁজে এতদূর এসেছো, আমি এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, সারা পৃথিবী আমাকে ভুলে গেছে।

–এরকম সেলফ-পিটি আপনাকে মানায় না, মামুন ভাই। আপনার কত বেশী অভিজ্ঞতা, আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু আশা করি।

এবার আর মামুন আবেগ দমন করতে পারলেন না, তিনি আলতাফকে জড়িয়ে ধরলেন।

আলতাফ তাঁর বাড়িতে রাত কাটাতে রাজি হলো না। মাদারীপুরে তার এক বন্ধু আছে, তার বাড়িতে ফিরে যাবার কথা দিয়ে এসেছে। পুরোপুরি অন্ধকার হবার আগেই সে মোটরবাইকে গর্জন তুলে ফিরে গেল।

রাত্রে আহারাদির পর মামুন কথাটা পাড়লেন ফিরোজার কাছে। তিনি দু-একদিনের মধ্যেই ঢাকা যেতে চান। সেখান থেকে টাঙ্গাইল যাবেন।

ফিরোজা বললেন, আপনি ঐ লোকের কথা শুনে টাঙ্গাইলে হিন্দু মেয়ের বিয়ে দিতে যাবেন?

মামুন হেসে বললেন, ও ছেলে আমাদের অপেক্ষায় বসে থাকে নি। আগেই কাজ সেরে ফেলেছে।

ফিরোজা তাতেও খুশী হলেন না। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, তবু আপনার ওসবের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। ও লোকের মুখ দেখেই মনে হয়, ওরা শুধু গোলমাল পাকাতে জানে।

-আমার কিন্তু মনে হলো, এই সব ছেলেরাই নতুন ভাবে দেশ গড়বে। একেবারে টগবগ করছে। প্রাণ খুলে হাসতে জানে। সে যাই হোক, আমি তো ওর জন্যে যাচ্ছি না, আমাকে মৌলানা ভাসানী ডেকে পাঠিয়েছেন।

ভাসানীর মতন অত বড় একজন নেতা তাঁকে স্মরণ করেছেন বলে মামুনের মনে বেশ একটু গর্বই হয়েছে কিন্তু ঐ নাম শুনে ফিরোজা বিচলিত হলেন না। তিনি রাগ রাগ ভাবে বললেন, তেনার আবার আপনেরে কী দরকার? আপনে আবার পার্টি করতে যাবেন নাকি?

মামুন মাথা দোলালেন। আলতাফ কী বলে গেল? ভেজিটেট! ঠিকই বলেছে, এখানে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থেকে তাঁর যেন শিকড় গজিয়ে গেছে।

মামুন মনস্থির করে ফেলেছেন। ফিরোজাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। এখনই রাগিয়ে দিয়ে লাভ নেই। তিনি কথা ঘুরিয়ে ফিরোজার প্রশংসা শুরু করলেন হঠাৎ। তারপর তাঁকে আদর করতে করতে অনেকদিন বাদে মিলিত হলেন খুব উৎসাহের সঙ্গে। এই শীতের রাতেও ঘাম ঝরলো।

ফিরোজা ঘুমিয়ে পড়ায় মামুন গায়ে একটা চাঁদর জড়িয়ে চলে এলেন বাইরে। সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। শীতকালের পরিষ্কার আকাশ। শহরের একজন এসে তাঁকে ডেকে গেল, তাতেই তিনি নতুন করে কর্মচাঞ্চল্য অনুভব করছেন। যেন ফিরে এসেছে পৌরুষ। গান গাইতে ইচ্ছে করছে।

এমনকি একটা কবিতার লাইনও মনে পড়ে গেল। বহুকাল পরে, আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতন। লাইনটা বিড়বিড় করতে লাগলেন তিনি। এখনই লিখে না রাখলে হারিয়ে যেতে পারে। আবার তিনি কবিতা লিখবেন? আলতাফের মতন ছেলেরা সেই কবিতা পছন্দ করবে তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *