স্বাধীনতা পরাধীনতা নিয়ে যে যেখানে মাথা ঘামাক, সত্যিকার স্বাধীনতা যদি কেউ পেয়ে থাকে তো পেয়েছে সুবৰ্ণলতার ছেলেমেয়েরা পিসির বাড়ি এসে।
রাতদিন অনেকগুলো রক্তচক্ষুর তলায় থাকতে থাকতে ওরা জানতো না মুক্তির স্বাদ কি, স্বচ্ছন্দচারণের সুখ কি? কারণে-অকারণে হঠাৎ আচমকা কেউ ধমকে উঠবে, এমন আশঙ্কা নিয়েই তাদের জীবন।
বিশেষ করে সেজকাকা!
ছেলেপুলেকে একবার একটু হুড়োহুড়ি করতে দেখলেই বা একবার তাদের একটু হেসে উঠতে শুনলেই তিনি সেই ছেলেপুলের পেটের পিলে চমকে দিয়ে হাঁক দেবেন, কে ওখানে? শুনে যা এদিকে!
ব্যস, তাতেই এমন কাপুনি ধরে যায় যে এদিকে আসবার ক্ষমতা আর থাকে না। অতএব সেই না আসার অপরাধেই বিরাশী সিক্কা, মোগলাই গাট্টা, রামচিমটি, শ্যামচিমটি ইত্যাদি করে অনেক কিছুরই স্বাদ পেতে হয়।
সুবৰ্ণলতা তার ছেলেদের মারে না বলেই বোধ করি সুবৰ্ণলতার ছেলেদের মারবার জন্যে এত হাত নিসপিস করে সেজকাকার।
মা ঠেঙায় না ছেলেদের, এমন মেমসাহেবীয়ানা অসহ্য বলেই হয়তো সেজকাকা মায়ের সেই মেমসাহেবীয়ানার শোধ নেন।
ভাগ্নের গায়ে হাত তুলতে না হয়। হাত কাপে, ভাইপোর গায়ে হাত তোলায় তো সে আশঙ্কা নেই!
সেই আবহাওয়া থেকে এসে মাঠে-মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। কাদা, মাটি, খড়, বাশ, পাতা লতা নিয়ে যতরকম খেলা তা সব খেলছে। পিসতুতো ভাইবোনেরা সঙ্গী।
কিন্তু আসল মজা হচ্ছে, এখানে এসে অবধি শুধু পিসতুতো দাদা-দিদিরাই নয়, আরো একজন তাদের খেলার মহোৎসাহী সঙ্গী। তিনি হচ্ছেন মা।
হ্যাঁ, মা!
সুবৰ্ণলতা তার বয়েস এবং পদমর্যাদার ভার ফেলে সমবয়সীত্বে নেমে আসে, রীতিমত যোগ দেয় খেলায়। যেমন ছেলেরা উঠোনে মাঝখানে দুদিকে দুটো পুকুর কেটে মাঝখানে একটা সঁকো বানাবে, অথচ জুৎ করতে পারছে না, কঞ্চি আর বাঁখারি নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, সুবৰ্ণলতা এসে পড়ে এবং বসে পড়ে একগাল হেসে বলে ওঠে, আমায় যদি তোদের খেলায় নিস তো আমি করে দিতে পারি।
মাকে নেওয়া না-নেওয়া আবার একটা কথা নাকি? ছেলেরা কৃতাৰ্থমন্য হয়ে বলে ওঠে, তুমি আসবে?
বললাম তো, যদি নিস!
নেবো নেবো, এসো তুমি খেলতে।
অতঃপর নেমেই আসে সুবৰ্ণলতা, নেমে আসে শিশুর খেলাঘরে। তোড়জোড় দেখে কে।
এই, একটা বাঁশ নিয়ে আয় দিকিন!.এই, একটা বড় দেখে গাছের ডাল নিয়ে আয় দিকি!… ওই চারটি বুনো ফুলের চারা আনতে পারিস? আলাদা একটু বাগান করবো!
এমন সব ফরমাশ করে সুবৰ্ণলতা, আর সেই আদেশ পালন করে। ধন্য হয় ছেলেরা।
মা একমুখ হাসছেন।
মা সহজ হালকা সোতে গা ভাসাচ্ছেন। এর থেকে আনন্দের আর কি আছে!
তা আজও সেই আনন্দ দিতে এল সুবৰ্ণলতা।
ওরা কৃতাৰ্থমন্য হয়ে এগিয়ে আসে।
সুবৰ্ণলতা বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, খেলবো তোদের সঙ্গে। কিন্তু একটা শর্তে!
সুবৰ্ণলতার মুখটা আলো-আলো দেখায়।
তারপর মাটি মাখতে মাখতে আসল কথাটি বলে সুবৰ্ণলতা, আমায় তোদের অম্বিকাকাকুর বাড়িতে একবার নিয়ে যাবি?
অম্বিকাকাকুর বাড়ি!
পরস্পর দৃষ্টি-বিনিময় করে হেসে ওঠে।
অম্বিকাকাকুর বাড়ি! সে তো ওই-ওইটা। ওখানে আবার নিয়ে যাওয়া কি?
অর্থাৎ ওটা আবার একটা নিয়ে যাবার জায়গা নাকি!
সুবৰ্ণলতাও কি তা জানে না?
তবু সুবৰ্ণলতা তার ছেলের সাহায্য প্রার্থনা করে।
একা ফট্ করে যেতে পারে না তো, শুধু একটা পুরুষ ছেলের নির্জন ঘরে যাওয়া!
ছেলে একটা সঙ্গে থাকাই ভাল।
তাই কৌতুক-কৌতুক মুখ করে নিয়ে বলে, তা জানি রে বাপু, তবু চল না। মানে খেলার শেষে!
আজকের খেলা একটা সত্যিকার বাড়ি তৈরি। গতকাল অনেক মাটি মেখে ছোট ছোট চৌকো। চৌকো ইট তৈরি করে রেখেছিল, আজ সেইগুলো জুড়ে জুড়ে সত্যিকারী পাকা বাড়ি করা হবে।
প্ল্যান!
সে তো মাথাতেই আছে।
ছোট ছোট সেই ইটগুলো রোদে ভাজা ভাজা হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। সুবৰ্ণলতা সেগুলি নাড়তে নাড়তে বলে, এই ঠিক কাজ করছিস। ইট তৈরি করে নিয়ে তবে বাড়ি বানানো খুব ভাল। মজবুত হয়। কারণ শুধু কাদার দেওয়াল নেতিয়ে পড়ে!
তারপর ইটের পর ইট সাজিয়ে দেওয়াল তুলে দেয় সুবর্ণ ওদের। তৈরি হয় শোবার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর, ভাড়ারঘর, ঠাকুরঘর।
ভানু পুলকিত গলায় বলে, মা!
কী রে?
তুমি আর-জন্মে বোধ হয় মিস্ত্রি ছিলে!
সুবৰ্ণ হেসে ওঠে, তা ছিলাম হয়তো।
তারপর সুবৰ্ণ কাদামাটির হাত ধুতে ধুতে বলে, এইবার তবে চল!
চলো।
অকৃতজ্ঞ ভানু অনিচ্ছা-মন্থর গতিতে চলে। এইমাত্র মা তাদের বাক্যদত্ত করিয়ে নিয়েছে তাই, নিচেৎ কে চায় এই খেলা ফেলে অম্বিকাকাকার বাড়ি যেতে?
যে অম্বিকাকাকাকে নিত্য দেখতে পাওয়া যায়!
তবু চলে।
সুবৰ্ণলতাও যায়।
সুবৰ্ণলতার বুকটা দুরদুর করে, মনটা ভয়-ভয়, উত্তেজিত-উত্তেজিত।
যেন বিরাট এক অভিযানে বেরিয়েছে সে।
কবিতার সন্ধানে অম্বিকার বাড়িতে এসে হাজির সুবৰ্ণলতা।
সংসারজ্ঞানহীন অম্বিকাও কিঞ্চিৎ বিপন্ন না হয়ে পারে না। এতটা সেও আশা করে নি। বারেবারেই তাই বলতে থাকে, কী মুশকিল, বলুন তো! আপনি নিজে এলেন, হুকুম হলে গন্ধমাদন পর্বতটাই বয়ে নিয়ে যেতম!
তারপর হেসে ফেলে বলে, অবশ্য তারপর নিশ্চয়ই হতাশ হতেন। বিশল্যকরণীর চিহ্ন খুঁজে পেতেন না।
কিন্তু কি পেত। আর না পেত। সেকথা ভাবতে বসছে না সুবৰ্ণলতা। সুবৰ্ণলতা রুদ্ধনিঃশ্বাসে আর দুরন্ত আবেগে একটা ধূলিধূসরিত সেলফের মধ্যে রাখা প্রায় জঞ্জালসদৃশ্য কাগজের স্তূপ হাতড়াচ্ছে।
প্ৰকাণ্ড সেলফটার তাকে তাকে নেই। হেন জিনিস নেই। খবরের কাগজের কাটিঙের ফাইল, ইংরেজি-বাংলা নানা পত্রিকার সম্ভার, গোছাগোছা প্রবন্ধের পাণ্ড়ুলিপি, ক্যালেণ্ডার, হ্যাণ্ডবিল, চিঠিপত্রের রাশি, কী নয়! এর মধ্যে থেকে কবিতা উদ্ধার করতে হবে। তাও খাতায় নয়, খুচরো কাগজে লেখা।
সুবৰ্ণলতা সব উল্টোতে থাকে।
অম্বিকা ব্যস্ত হয়ে বলে, দেখছেন তো কী অবস্থা! সৃষ্টির আদি থেকে ধুলো জমে চলেছে। পর পর কেবল চাপানেই হয়, নামানো তো হয় না কোনদিন!
পদ্য-টদ্য এই জঙ্গলের মধ্যে রাখো কেন? ক্ষুব্ধ আবেগে বলে সুবৰ্ণলতা।
পদ্যই বলে। কবিতা বলতে হয়, বললে ভাল শোনায়, অত খেয়াল করে না!
অম্বিকা হেসে বলে, রাখি না। তো, ফেলি। কোনো কিছু ফেলার পক্ষে জঙ্গলই শ্রেষ্ঠ জায়গা।
অম্বিকাদের এই বাড়িটা জ্ঞাতিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় বাড়ির ভগ্নাংশ নয়, ছোট্ট একটু একতলা, সম্পূর্ণ আলাদা। অম্বিকার বাবা জ্ঞাতিদের থেকে পৃথক হয়ে আম-জাম-কাঁঠালের বাগানের ধারে এই ছোট বাড়িখানা করিয়েছিলেন। অম্বিকার মা বেঁচে থাকতে ছবির মত রাখতেন বাড়িটিকে, রাখতেন ধূলিমালিন্য শূন্য করে। কিন্তু ছেলের ঘরের এই সেলফটিতে হাত দেওয়ার জো ছিল না। তাঁর। হাত দিলেই নাকি অম্বিকার রাজ্য রসাতলে যেত।
এখন সারা বাড়িতেই ধুলো।
সুবালা অথবা তার মেয়েরা এক-আধাদিন এসে ঝাড়ামোছা করে দিয়ে যায়, অম্বিকা বিকাব্যকি এবং ঝাটা কড়াকড়ি করে, ব্যস!
কিন্তু সুবর্ণর তো ধুলোর দিকে দৃষ্টি নেই। সে ধুলোর আড়াল থেকে মাণিক খুঁজছে।
আরো সেই খোঁজার সূতের পেয়ে যাচ্ছে অনেক মণিরত্ন। কত বই, কত পত্রিকা! ইস, ভাগ্যিাস এল সুবর্ণ এখানে!
ঠাকুরপো, এত বই তোমার? কই বল নি তো?
অম্বিকা অপ্ৰতিভ হাস্যে বলে, বই দেখে এত খুশী হবেন, জানি না তো।
জানো না, বাঃ। সুবর্ণ বলে ওঠে, আমি কিন্তু এগুলো সব পড়বো। রয়েছি তো এখনো, পড়ে নেব তার মধ্যে। w
অম্বিকা হাসে, পড়লে তো বেঁচে যায় ওরা। ধুলোর কবরের মধ্যে পড়ে আছে, উদ্ধার হয় তার থেকে।
সুবৰ্ণ দীপ্ত প্ৰসন্নমুখে বই বাছতে থাকে, এবং বেছে বেছে প্ৰায় গন্ধমাদনই করে তোলে। আলো-জুলা মুখে বলে, এই আলাদা করা থাকলো, কিছু কিছু করে নিয়ে যাব, আবার পড়ে পড়ে রেখে যাবো।
অম্বিকা বলে, জিনিসগুলো এত অকিঞ্চিৎকর যে বলতে লজ্জা করছে, রেখে না গেলেও ক্ষতি নেই, নিয়েই রাখতে পারেন। রাখলে ওই মলাট-ছেড়া ধুলোমাখা কাগজপত্রগুলো কৃতাৰ্থ হয়ে যায়।
সুবৰ্ণ এবার হাসিমুখে বলে, অত্যয় কাজ নেই, একবার পড়তে পেলেই বর্তে যাই। এতদিন রয়েছি, জানি কি ছাই! জানলে তো রোজ এসে হানা দিতাম। উঃ, আজও যাই ভাগ্যিস এসেছিলাম!
আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুবৰ্ণলতার চোখমুখ সর্বাবয়ব।
অম্বিকা সুবৰ্ণলতার মা সত্যবতীকে দেখে নি। দেখে নি, তাই সহসা অনুভব করতে পারে না। এই আলোর উৎস কোথায়!
অম্বিকা অবাক হয়।
অম্বিকা বোধ করি অপ্ৰতিভাও হয়।
যেন সুবৰ্ণলতা যে এতদিন টের পায় নি। অম্বিকার ঘরের সেলফে চারটি মলাট-ছেড়া সেলাইঢ়িলে পত্রিকা আছে, সেটা অম্বিকারই ক্রটি। সেই অপ্ৰতিভা অপ্ৰতিভা মুখে বলে, আমারই উচিত ছিল আপনাকে দিয়ে আসা-
সুবৰ্ণলতা সরল আনন্দে হেসে ওঠে।
ওমা! তুমি কী করে জানবে যে তোমাদের মেজবৌদি এমন বই-হ্যাংলা! কিন্তু তা তো হলো, যার জন্যে এলাম তার কি! তোমার পদ্যের খাতা কোথায়?
কী মুশকিল! বললাম তো, খাতাটাতা নেই, কদাচ কখনো প্ৰাণে জাগলো কিছু, হাতের কাছে যা পেলাম তাতেই লিখলাম, তারপর কোথায় হারিয়ে গেল!
কখনো না, তুমি ঠিকাচ্ছ।
আরে না, বিশ্বাস করুন।
অম্বিকা হাসে, এই যে তার সাক্ষী–
হঠাৎ বালিশের তলা থেকে টেনে বার করে কয়েক টুকরো বালির কাগজ।
হেসে হেসে বলে, কাল রাত্রে হচ্ছিল খানিকটা কবিত্ব।
কই দেখি দেখি–
সুবৰ্ণ পুলকিত মুখে হাত পাতে।
অম্বিকা চৌকির ওপর রাখে।
হেসে বলে, যা হস্তাক্ষর, তার ওপর আবার কাটাকুটি–
সুবৰ্ণ অবশ্য ততক্ষণে টেনে নিয়ে দেখেছে এবং হস্তাক্ষর সম্পর্কে যে অম্বিকা অতি বিনয় করে নি তা অনুভব করেছে। তাই কুণ্ঠিত হাস্যে বলে, বেশ, তবে তুমিই পড়া।
সুবৰ্ণলতা অবোধ বৈকি।
প্ৰস্তাবটা যে অশোভন, অসামাজিক, এ জ্ঞান হয় না কেন তার? হলেই বা পাঁচটা ছেলে-মেয়ের মা, তবু বয়েস যে তার আজো ত্রিশেও পৌঁছয় নি, এ খেয়াল নেই? একটা সম্পূর্ণ অনাত্মীয় যুবাপুরুযের একক গৃহে এসে বসে তার মুখে কবিতা শুনতে চাওয়ার কথা উচ্চারণ করলো সে কী বলে?
আর অম্বিকা?
সেও কি বাংলার গ্রামের ছেলে নয়?
হয়তো এ একটা নতুন উত্তেজনা বলেই লোভটা সামলাতে পারছে না। তা লোভই। লেখে সে ছেলেবেলা থেকেই, কিন্তু তার কবিতা সম্পর্কে কে কবে আগ্ৰহ দেখিয়েছে! কে কবে এমন আলোেভরা উৎসুক মুখ নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে শোনোও বলে!
তাছাড়া আর পাঁচজনের থেকে তফাত বৈকি অম্বিকা। তার পরিমণ্ডলে একটা নির্মল পবিত্রতা, তার অন্তরে একটা অসঙ্কোচ সরলতা। তার কাছে সুবালা এবং সুবৰ্ণলতা একই পর্যায়ের গুরুজন। সুবালার প্রতিও তার যেমন একটি সশ্রদ্ধ ভালবাসা, সুবর্ণর প্রতিও তেমনি একটি সশ্রদ্ধ প্ৰীতি।
তাই সেই খুচরো কাগজ কটা গুছিয়ে নিতে নিতে হেসে বলে, শুনে বুঝবেন বৃথা সময় নষ্ট। এটা হচ্ছে দেশের এখনকার এই পরিস্থিতি নিয়ে—
মা! ভানু ডেকে ওঠে। আমি যাই!
সুবৰ্ণলতা চমকে ওঠে।
ভানু যে এখনো এখানেই ছিল তা খেয়ালই ছিল না। বই দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিল।
এখন ঈষৎ চঞ্চল হয়ে বলে, কেন, চলে যাবি কেন? অম্বিকাকার লেখা পদ্য শোন না!
পদ্য সম্বন্ধে ভানু যে বিশেষ উৎসাহী, ভানুর মুখ দেখে তা মনে হল না। বললো, আমাকে ওরা দেরি করতে বারণ করেছে।
কেন, তুই আবার কী রাজকাৰ্য করে দিবি ওদের?
এমনি।
হঠাৎ সুবৰ্ণলতা ছেলের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় তৎপর। হয়। লেখাপড়া তো সব শিকেয় উঠেছে, কর এবার! এরপর যেতে হবে না ইস্কুলে?
অম্বিকা হেসে ওঠে, না, আপনি বড় সাংঘাতিক! একে বেচারাকে জোর করে কবিতা গোলাবার প্ৰস্তাব, তার উপর আবার পড়ার কথা মনে পড়িয়ে দেওয়া। যেতে দিন ওকে। চলুন, বরং ও-বাড়ি গিয়েই পড়া যাক। আমার লাজলজ্জার বালাই নেই। দিব্যি ছাত ফাটাবো!
অম্বিকা স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই সুবৰ্ণলতার সঙ্কোচ বোঝে, তাই ও-বাড়ির কথা তোলে।
কিন্তু সুবর্ণ সহসা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।
ছি ছি, কী মনে করলো অম্বিকা ঠাকুরপো!
মনে করলো তো, সুবর্ণ একা তার ঘরে বসতে ভয় পাচ্ছে, অস্বস্তি পাচ্ছে।
ছি ছি!
সুবৰ্ণলতা সেই অস্বস্তিকে কাটালো।
সুবৰ্ণলতা দৃঢ় হলো।
বলে উঠল, না না, আবার এখন এ-বাড়ি ও-বাড়ি। পড় তুমি।… এই মুখুটা, যা তুই, পিসি জিজ্ঞেস করলে বলিস, আমি এখানে আছি।
সুবৰ্ণ বলেছিল, বলিস। আমি এখানেই আছি। কিন্তু সত্যিই কি তা ছিল সে?
না, আর এক জগতে এসে পড়েছিল!
তা মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল বটে।
আর এক জগতের-!
অম্বিকা পড়ছিল।
ওই শোনো শোনো সাড়া জাগিয়েছে
কালের ঘূর্ণিপথে—
ভাঙনের গান গেয়ে ছুটে আয়
মরণের জয় রথে।
ওই দেখ, কারা আসে দলে দলে,
দেশজননীর পূজাবেদীতলে,
অক্লেশে প্ৰাণ করে বলিদান
হোমের আহুতি হতে।
তাই দ্বারে দ্বারে ডাক দিয়ে যাই
চল চল ছুটে চল—
কে ওরা ভাঙিছে বন্দিনী মা’র
চরণের শৃঙ্খল।
ওদের সঙ্গে দে মিলায়ে হাত,
বৃথা পশ্চাতে কর আঁখিপাত,
বাঁধিবে কি তোরে শিশুর হাস্য,
প্রিয়ার অশ্রু জল?
এখনো না। যদি ভাঙিতে পারিস-
পড়তে পড়তে থেমে যায় অম্বিকা। কুণ্ঠা-কুষ্ঠা হাসি হেসে বলে, দূর, নিশ্চয় আপনার ভাল লাগছে না।–
ভাল লাগছে না!
সুবৰ্ণ উত্তেজিত গলায় বলে, ভাল লাগছে না। মানে? কে বলেছে ভাল লাগছে না? পড়ো— পড়ে যাও। যে লাইনটা পড়লে, আবার ওইট থেকে পড়ে যাও।
অম্বিকার অস্বস্তি হচ্ছিল।
অম্বিকার নিজের মন যতই উদার আর নির্মল হোক, পাড়াগায়ের ছেলে সে। অনাত্মীয় তো দুরের কথা, নিকট-আত্মীয় পুরুষের ঘরেও এমন একা বসে গল্প করলে যে মেয়ের ভাগ্যে ভর্ৎসনা জোটে, তার নামে নিন্দে রটে, তা তার জানা।
তার ওপর আবার কবিতা শোনা!
তবু সুবর্ণর ঐ আবেগ-আবিষ্ট ভাল লাগার মুখটা বেশ একটা নতুন আনন্দের স্বাদ এনে দিচ্ছে। সত্যি এমন করে এমন একটা আগ্রহ-উৎসুক। মনের সামনে কবে অম্বিকা নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে পেরেছে?
তাছাড়া অস্বস্তি যেমন ওদিকে, তেমনি এদিকেও। অম্বিকার অস্বস্তি ভাবটা যদি মেজবৌন্দির মুখ ধরা পড়ে যায়। তাতেও লজ্জার সীমা নেই। উনি স্ত্রীলোক হয়ে সাহস করে বসে রইলেন, আর অম্বিকা–
দূর, উনি কত বড় গুরুজন, ওঁর কাছে আবার—
অতএব আবার গলা ঝেড়ে শুরু করে দেয় অম্বিকা,
এখনো না। যদি ভাঙিতে পারিস,
কখনো কি হবে আর?
লৌহনিগড় গড়িবে আবার
প্ৰবলের অনাচার।
মরণকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে এসে,
নতশিরে কি করে ফিরে যাবি শেষে?
মস্তকে বহি কাঁটার মুকুট
ললাটে অন্ধকার!
বিশ্বজগৎ টিটকারি দেবে
ধিকৃত উপহাসে,
ষষ্টি-আহত পশুর সমান
কাপুরুষ ক্রীতদাসে। ভা
বী তনয়ের ললাটে কি ফেরা
দিয়ে যাবি এই কলঙ্ক-জের—
এই সেরেছে!
অম্বিকা হাতের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে। বিপন্নমুখে বলে, এর পরের পৃষ্ঠােটা আবার কোথায় গেল?
নেই!
সুবৰ্ণ চমকে ওঠে।
আশা ভঙ্গের উত্তেজনায় বলে, কি করে রাখো কাগজপত্ৰ! কি করলে ছাই! রয়েছে তো কাগজ তোমার হাতে-
অম্বিকা অপ্রতিভা মুখে বলে এটা শেষ পৃষ্ঠা। মাঝখানটা একটা টুকরো কাগজে ছিল—
আশ্চর্য! সুবৰ্ণর মনে আসে না, সুবর্ণ অম্বিকার অভিভাবক নয়। মনে আসে না, ওকে তিরস্কার করবার তার অধিকার আছে কিনা। প্রায় অভিভাবকের ভঙ্গীতেই ক্রুদ্ধ তিরস্কার করে ওঠে, ধন্যি ছেলে! আমন-ভাল জিনিসটা হারিয়ে ফেললে?
অম্বিকা অপরাধী-অপরাধী ভাবে বালিশের তলায় হাত বুলোয়, তোষক উল্টে দেখে। সুবৰ্ণও চৌকির তলায় উঁকি মারে হেট হয়ে, তারপর বিফলমনোরথ হয়ে বলে, নাঃ! সে নির্ঘাত হাওয়ায় উড়ে বনেজঙ্গলে চলে গেছে। মুখস্থ নেই?
অম্বিকা কুণ্ঠিত হাসি হাসে, নাঃ! এই তো মাত্ৰ কাল রাত্রে লিখেছি—
যাক গে, শেষটাই পড়। এত ভাল লাগছিল!
অম্বিকা আবার পরের পাতাটায় চোখ ফেলে। বোধ করি নিজের ওই মুখস্ত না থাকার জন্যে মরমে মারে। সেই কুণ্ঠিত গলাতেই পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই—
কালিমাখা মুখে পৃথিবীর বুকে
টিকে থেকে কিবা ফল,
অকারণ শুধু ধ্বংস করিতে
ধরার অন্নজল?
যে মাটি আগুলি রহিবি বসিয়া–
দাবিদাওয়াহীন সে মাটির ঋণ
শোধ দিবি কিসে বল?
নাড়া দিয়ে ভোঙ। পুরনো দেওয়াল,
কতকাল রবে খাঁড়া?
মাথা তুলে আজ দাঁড়া!
বীরদাপে যারা করে অন্যায়,
তারা যেন আজ ভাল জেনে যায়,
বিষবৃক্ষের উচ্ছেদ লাগি,
মাটিতেও জাগে সাড়া!
অম্বিকা ঠাকুরপো!
সহসা যেন একটা আৰ্তধ্বনি করে ওঠে সুবৰ্ণলতা। কী ভাগ্যি অম্বিকার হাতটাই চেপে ধরে নি!
অম্বিকা ঠাকুরপো, ওইখানটা আর একবার পড়ো তো—
অম্বিকা বিস্মিত হয়।
অম্বিকা বিচলিত হয়।
তাকিয়ে দেখে সুবর্ণর মুখে আগুনের আভা, সুবৰ্ণর চোখে জল।
আশ্চর্য তো!
মানুষটা এত আবেগপ্রবণ?
একটু যেন ভয়-ভয় করছে।
কই পড়ো?
সুবৰ্ণর কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা, এ তো শুধু এই পরাধীন দেশের কথাই নয়। এ যে আমাদের মতন চিরপরাধীন মেয়েদের কথাও। কী করে লিখলে তুমি? পড়ো, পড়ো আর একবার—
অম্বিকা যেন বিপন্ন গলায় আর একবার পড়ে—
নাড়া দিয়ে ভোঙ পুরোনো দেওয়াল–
কতকাল রবে খাঁড়া?
মাথা তুলে আজ দাঁড়া!
বীরদাপে যারা করে অন্যায়,
তারা যেন আজ–
নাঃ, সুবৰ্ণলতার আজকের দিনটা বুঝি একটা অদ্ভুত উল্টোপাল্টা দিয়ে গড়া!
ভালো আর মন্দা!
আলো আর ছায়া!
পদ্ম আর পঙ্ক!
তা নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে?
যখন সুবৰ্ণলতা মুগ্ধ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা পরপুরুষের মুখের দিকে, যখন সুবর্ণর মুখে আলোর আভাস আর চোখে জল এবং যখন এই অনাসৃষ্টি দৃশ্যের ধারে-কাছে কেউ নেই, তখন কিনা সে দৃশ্যের দর্শক হবার জন্যে দরজায় এসে দাঁড়ায় সুবৰ্ণলতার চিরবাতিকগ্ৰস্ত স্বামী! যে নাকি এযাবৎকালে আপন চিত্তের আগুনেই জ্বলে-পুড়ে খাক হলো!
সেই জ্বলে-পুড়ে মরা মানুষের সামনে জ্বলন্ত দৃশ্য!
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
থিয়েটারি ঢঙে বলে উঠেছে, বাঃ বাঃ—কেয়াবাৎ! এই তো চাই!
পুরনো দেওয়াল অটুট রইল, বিষবৃক্ষেত্র পাতাটি মাত্র খসলো না, মাটির সাড়া মাটির মধ্যেই স্থির হয়ে রইল, সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি মাথার কাপড়টা একটু টেনে দিয়ে বলে উঠলো, তুমি হঠাৎ? চাঁপা ভালো আছে তো?
হ্যাঁ, যে মুহূর্তে আচমকা দরজায় প্ৰবোধের মূর্তিটা ফুটে উঠেছিল, সেই চকিত মুহূর্তটুকুতে চাঁপার কথাটাই মনে এসেছিল সুবৰ্ণলতার।
হঠাৎ ও কেন এমন বিনা খবরে? চাঁপার কোনো রোগবালাই হয় নি তো?
কিন্তু সেই চকিত চিন্তার পরমুহূর্তেই দূর হয়ে গেল সে আশঙ্কা! তেমন হলে ঐ থিয়েটারি ঢঙে কোয়াবাৎটা হতো না নিশ্চয়। এ আর কিছু নয়, গোয়েন্দাগিরি!
ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলো মাথা, সারা শরীরের মধ্যে বয়ে গেল বিদ্যুৎপ্রবাহ, তবু ফেটে পড়তে পারা গেল না। সামলে নিতে হলো নিজেকে। মাথায় কাপড় টেনে উদ্বিগ্ন গলায় বলতে হলো, তুমি যে হঠাৎ? চাপা ভালো আছে তো?
বিদ্যুৎপ্রবাহকে সংহত করতে শক্তিক্ষয় হচ্ছে বৈকি, তবু উপায় কি? ঐ সভ্য ভদ্র উদার ছেলেটার সামনে তো আর সুবর্ণ তার স্বামীর স্বরূপটা উদঘাটিত করতে পারে না, তাদের ভিতরের দাম্পত্য সম্পর্কের স্বরূপ!
কিন্তু সুবর্ণর শক্তিক্ষয়ে কি রক্ষা হলো কিছু?
সুবৰ্ণর স্বামী কি মহোল্লাসে নিজের গায়ে কাদা মাখল না? নিজের মুখে চুন-কালি?
মাটিতে মিশিয়ে দিল না। সুবর্ণর সমস্ত সম্ভ্রম? দিল। সুবর্ণর জীবনের সমস্ত দৈন্য উদঘাটিত করে দিল সুবর্ণর স্বামী। বলে উঠলো, চাপা? ওসব নাম মনে আছে তোমার এখনো? আশ্চয্যি তো!-চাঁপার খবর জানি না, তবে চাঁপার মা যে খুব ভালো আছে, তা প্রত্যক্ষ করছি। বাঃ! চমৎকার! সাধে কি আর শাস্ত্ৰে বলেছে, সাপ আর স্ত্রীলোক এই দুইকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই।
সুবৰ্ণ হঠাৎ অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে যায়।
শান্ত-শান্ত ভাবেই হেসে ওঠে। হেসে উঠে বলে, শাস্ত্ৰে বলে বুঝি? দেখছো অম্বিকা ঠাকুরপো, আমার স্বামীর কী শাস্ত্ৰজ্ঞান! তা বলেছ ঠিকই, ভালই আছি। খুব ভাল আছি। তোমার এই বোনের দেশ থেকে যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না-
যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না! প্ৰবোধ নিমপাতা গেলা গলায় বলে, তা অনিচ্ছে তো হবেই, এখানে যখন এত মধু!… কী মশাই, আপনিই না। আমার বোনাইয়ের সেই দেশোদ্ধারী ভাই? তা দেশোদ্ধারের পথটা দেখছি ভালই বেছে নিয়েছেন! নির্জনে পরস্ত্রীর সঙ্গে রসালাপ—
আঃ মেজদা, কী বলছেন যা তা—, অম্বিকা যেন ধমক দিয়ে ওঠে, ছোট কথা বলবেন না। ছোট কথা আর কারো ক্ষতি করে না, নিজেকেই ছোট করে!
মেজদা! ধমক!
প্ৰবোধ একটু থিতামত খায়, কারণ প্ৰবোধ এই উল্টো ধমকের জন্যে প্ৰস্তৃত ছিল না। তবে থতমত খাওয়াটা তো প্ৰকাশ করা চলে না, তাই সামলে নেয়। তবে গলায় আগের জোর ফোটে না।
ফিকে ফিকে গলায় বলে, ছোট! ই, আমরা ক্ষুদ্র মনিষ্যি, আমাদের আবার ছোট হওয়া!
ক্ষুদ্ৰই বা ভাববেন কেন নিজেকে? অম্বিকা ধীর গলায় বলে, নিজেকে ক্ষুদ্রও ভাবতে নেই, অধমও ভাবতে নেই। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বিকাশ!
ওঃ, লম্বাচওড়া কথা! উপদেশ! শুরু এসেছেন! প্ৰবোধ এবার নিজ মূর্তিতে ফেরে। বলে, ওঃ, নিরালায় ঈশ্বরসাধনাই হচ্ছিল তা হলে? আমি এসে ব্যাঘাত ঘটালাম! কী আর বলবো, আপনি কুটুমের ছেলে, বোনাইয়ের ভাই, আপনার অপমান তার অপমান। তাই পার পেয়ে গেলেন। এ অন্য কেউ হলে তাকে জুতিয়ে পিঠের ছাল তুলতাম। আর এই যে বড়সাধের মেজবৌদি! চল তুমি, তোমাকে আমি দেখে নিচ্ছি গিয়ে। অবাক কাণ্ড! একঘর ছেলেপিলে, বয়সের গাছপাথর নেই, তবু কুবাসনা ঘোচে না? তবু ইচ্ছে করে পরপুরুষের দিকে তাকাই? যাক, তার জন্যে ভাবি না। মেয়েমানুষকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে।
অবাক কথা বৈকি, তবু সুবর্ণ ফেটে পড়ে না। বরং প্রায় হেসেই বলে, জানো নাকি? তা তবু তো শায়েস্তা করে উঠতে পারলে না। আজ অবধি।… নাও চলো, এখন দেখ শায়েস্তা করে শূলে দেবে কি ফাঁসি দেবে! এই ভালমানুষ ছেলেটাকে আর ভয় পাইয়ে দেব না বাপু, পালাই। … অম্বিকা ঠাকুরপো, ওই পদ্যটা কিন্তু আমার চাই ভাই। একটু কষ্ট করে ওর একটা নকল করে দিও আমায়।
তা প্ৰবোধ দেবতা নয়!
রক্তমাংসের মানুষ সে।
অতএব গোড়ার জিনিস ঐ রক্তটাই তার টগবগিয়ে ফুটে ওঠে স্ত্রীর ঐ প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের দাহে। সুবৰ্ণ যদি ভয় পেত, যদি গুটিয়েসুটিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো, আর ঐ পাজী লক্কা ছেলেটা যদি প্ৰবোধকে দেখে বেত-খাওয়া-কুকুরের মত ঘাড় নিচু করে পালিয়ে প্ৰাণ বাঁচাতো, তা হলে হয়তো প্ৰবোধ এত ফেটে পড়তো না।
কিন্তু সেই স্বাভাবিক হলো না।
হলো একটা অভাবিত বিপরীত।
ছোঁড়াটা এলো বড় বড় কথা কয়ে উপদেশ দিতে, আর সুবর্ণ কিনা স্বামীকেই ব্যঙ্গ করলো!
অতএব প্ৰবোধও ফেটে পড়লো।
উগ্ৰমূর্তিতে বলে উঠলো, শূল কেন, ফাঁসি কেন? পায়ে জুতো নেই। আমার? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার মতন বেহায়া মেয়েমানুষের মুখ বন্ধ করা যাবে না! বেরিয়ে এসো! বেরিয়ে এসো বলছি! এতদিন পরে স্বামী এলো, ধড়ফড়িয়ে উঠে আসবে, তা না, পরপুরুষের বিছানায় বসে বসে স্বামীকে মস্করা! আর তুমি শালা-
তা অনেক সামলেছে নিজেকে প্ৰবোধ। স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে নি, এবং শালা শব্দটা উচ্চারণ করেই থেমে গেছে।
সুবৰ্ণ এবার উঠে আসে।
কেমন একটা অবিচলিত ভাবেই আসে।
আর সব চেয়ে আশ্চর্য, এর পরেও সেই পরপুরুষের সঙ্গে কথা কয়। বলে, মিথ্যে তোমরা দেশ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখছো অম্বিকা ঠাকুরপো। দেশকে আগে পাপমুক্ত করবার চেষ্টা করো। …এই মেয়েমানুষ জাতটাকে যতদিন না। এই অপমানের নরককুণ্ডু থেকে উদ্ধার করতে পারবে, ততদিন সব চেষ্টাই ভস্মে ঘি ঢালা হবে।
প্ৰবোধের সঙ্গে এসেছিল সুবালার ছোট ছেলেটা। তাকেই বলেছিল সুবালা, এই যা। যা, ছুটে যা, তোর মেজমামীকে ডেকে নিয়ে আয়, অম্বিকা কাকার বাড়িতে আছে বোধ হয়।
প্ৰবোধ সেই মাত্র খুলে রাখা জুতোটা আবার পায়ে গলিয়ে বলেছিল, চল, আমিও যাচ্ছি!
সুবালা প্ৰমাদ গনেছিল।
সুবালা তার মেজদাকে অনেকদিন না দেখলেও একেবারে চেনে না তা তো নয়! তাই বলে উঠেছিল, তুমি আবার কি করতে যাবে গো! এই তেন্তেপুড়ে এলে, তুমি বোসো, হাতমুখ ধোও, ও যাবে আর আসবে! তুমি ততক্ষণ একটু মিছরির পানা খাও—
প্ৰবোধ বোনের এই সহৃদয় আতিথ্যের আহবানে কর্ণপাত করে নি। গাঁট গট করে এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেটাকে চল বলে একটা হুমকি দিয়ে।
সুবালা কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মেজদার পিছু পিছু গেলে যে ভাল হতো, সেটা তখন মনে পড়ে নি। তার।
মনে পড়িয়ে দিলেন ফুলেশ্বরী। বললেন, তুমিও গেলে পারতে বৌমা, মনে হচ্ছে মেজ ছেলে একটু রাগী মানুষ-
একটু রাগী? সুবালাও রেগে ওঠে, বলে, আজন্মের গোয়ার! বেঁটাকে কি তিলার্ধ স্বস্তি দেয়! রাতদিন সন্দেহ, ওই বুঝি বৌ মন্দ হলো! তার ওপর আবার—মেজবৌই বা মরতে একা মেয়েমানুষ পদ্য শুনতে ওর ঘরে গেল কোন ছাই, তাও জানি না।
পদ্য শুনতে!
হ্যাগো, বললো তো তাই কানু। মা অম্বিকা কাকার বাড়ি আছে পিসি, পদ্য শুনবে! পদ্যটদ্য লেখে তো ঠাকুরপো, আর মেজবৌও তেমনি পাগলী! জানিস যখন বর ওইরকম—
ফুলেশ্বরী আস্তে বলেন, সংসারে এই পাগলদেরই সবচেয়ে বিপদ বৌমা। সুবর্ণর মতন মেয়ে সংসারে দুর্লভ। কিন্তু সবাই তো ওকে বুঝবে না। একা বেটাছেলের বাড়িতে যেতে নিন্দে, এ বোধই নেই। ওর, গঙ্গাজলে ধোওয়া মন ওর।
তা তো ধোওয়া! এখন জানি না কি খোয়ার হয়। যা আগুন হয়ে গেল মেজদা!
তাতেই বলছিলাম, তুমি সঙ্গে গেলে পারতে!
তাই দেখছি। কিন্তু এখন আবার গেলে—
তা হোক বৌমা, তুমিও যাও। রাগের মাথায় যদি ছেলে সুবৰ্ণকে একটা চড়া কথা বলে বসেন, ভারী লজ্জার কথা হবে। অম্বু আমাদের আপনি, ওদের তো কুটুম!
তবে যাই। উনুনে যে আবার দুধ বসানো।
দুধ আমি দেখছি। তুমিও যাও। আমার মন নিচ্ছে দাদা তোমার বকাবিকি করবে।
সুবালা অতএব দাওয়া থেকে নামে।
আর মনে মনে ভাবে, মেজদার এই দুম করে আসাটাই ফন্দির। জানি তো সন্দেহবাতিক মানুষ। আর মজা দেখ, কোনোদিন মেজবৌয়ের এ খেয়াল হয় না, মরতে ছাই আজই! মেজদাকে বলিহারি! আমন পরিবার, মর্ম বুঝল না। বুঝবে কি, মৰ্ম বস্তু নিজের থাকলে তো!
দ্রুত এগোতে থাকে সুবালা।
হয়তো সুবালা ঠিক সময় পৌঁছতে পারলে ব্যাপার সমে আসতো। হয়তো সুবালাই গিয়ে বলে উঠতো— কী জ্বালা! মেজবৌ, তুই এখানে বসে বসে পদ্য শুনছিস? আর মেজদা যে ইদিকে মনকেমনের জ্বালায় ছুটেপুটে চলে এসে তোকে না দেখে বিশ্বভুবন অন্ধকার দেখছে!
হয়তো যা হোক করে কেটে যেত ফাঁড়া।
কিন্তু কাটবার নয়, তাই কাটল না।
সুবালা বেরিয়ে দুপা যেতেই গরুর রাখালটা কাঁদো কাঁদো হয়ে ধরলো, অ মা, মুংলির বাছুরটা পেলে গেছে—
পালিয়ে গেছে!
হিঁ গো মা! ক্যাতো খুঁজানু—, বরে বিবরণ দিতে বসে তার খোঁজা পর্বের।
আচ্ছা তুই দাঁড়া, আমি আসছি—, বলে সুবালা এগিয়ে যায়, কিন্তু যখন পৌঁছায়, তখন তার মেজদা শেষ বাণী উচ্চারণ করছে।
জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে না দিলে যে মেয়েমানুষ শায়েস্তা হয় না, সেই অভিমত ব্যক্ত করছে।
সুবালার মরমে মরে যায়।
অম্বিকা ঠাকুরপোর সামনে এইসব কথা! তা-ও সুবালারই দাদার মুখ থেকে! নিরুপায় একটা আক্ষেপে হঠাৎ চোখে জল আসে তার। যেমন এসেছিল তেমনি দ্রুতপায়ে ফিরে যায়।
সুবৰ্ণলতা টের পায় না, তার এই অপমানের আরো একজন সাক্ষী রয়ে গেল।
কিন্তু অত অপমানের পর আবার সুবৰ্ণ সেই স্বামীর পিছু পিছু সেই স্বামীর ঘরে ফিরে গেল? সুবৰ্ণলতা না। সত্যবতীর মেয়ে?