আগে পিকলু আর বাবলু এক স্কুলে পড়তো, তাতে সুবিধে ছিল, দুই ভাই ফিরতে একসঙ্গে। এখন পিকলু কলেজে যায়, তাই বাবলুর জন্য মমতার প্রতিদিন দুশ্চিন্তা। সেন্ট্রাল এভিনিউ পার হয়ে আসতে হয়। অত বড় রাস্তা, এক মুহূর্তও গাড়ির বিরাম নেই। কিন্তু কে আনতে যাবে বাবলুকে? আগে কানুকে দিয়ে এইসব কাজ করানো হতো, এখন কানু চাকরি করে। বাবলুটা অসম্ভব দুরন্ত বলেই তো বেশি ভয়।
এ পাড়ারই সরকারদের বাড়ির একটি ছেলে শ্যামবাজার এ ভি স্কুলে পড়তে যায়। সেবাড়ির একজন চাকর যায় ছেলেটাকে আনতে, তাই মমতা একদিন যেচে সেই ছেলেটির মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন। ভদ্রমহিলা বেশ ভালো, তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, দুখীরাম তো যায়ই, ও আমার ছেলের সঙ্গে আপনার ছেলেকেও নিয়ে আসবে। এতে আর কী আছে!
কিন্তু এই ব্যবস্থাতেও সুফল পাওয়া গেল না। বাবলু ক্লাস এইটে পড়ে। তার আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে হয়ে উঠছে, সে অন্য বাড়ির চাকরের হাত ধরে বাড়ি ফিরবে কেন? দুদিন পরেই বাবলু সরকারবাড়ির ছেলেটির সঙ্গে ঝগড়া করলো, তারপর তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
স্কুল ছুটির পর বাবলু খানিকটা হেঁটে এসে সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে শ্যাম পার্কে ঢুকে পড়ে। এখানে বিভিন্ন ক্লাবের ছেলেরা খেলে, বাবলুকে তো তারা খেলতে নেবে না, তাই বাবলু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে আর মাঝে মাঝে দৌড়ে গিয়ে বল কুড়িয়ে এনে দেয়।
প্রায়ই দেরি করে বাড়ি ফেরে বাবলু। ক্ষিদে-পেটে অন্য কিছু খেতে পাওয়ার আগে বকুনি খায়। কিন্তু বকুনি বা মারও সে গ্রাহ্য করে না। একমাত্র সে ভয় পায় বাবাকে।
আদালত থেকে ফিরতে ফিরতে প্রতাপের সন্ধে হয়ে যায়। বাবলু ঠিক তার আগে ফিরে আসে। মমতা বা বাড়ির অন্য কেউ প্রতাপের কাছে বাবলুর নামে নালিশ করতে সাহস পান না। বাড়িতে প্রতাপ বড় কড়া হাকিম, তা ছাড়া এখানে আসামী পক্ষের উঁকিল নেই। তাই শাস্তি বড় গুরুতর হয়। এই বছরেই বাবলু বাবার কাছে দু’বার মার খেয়েছে।
আড়াইখানা মাত্র ঘর, এখন আর জায়গায় কুলোয় না, প্রতাপ নতুন বাড়ি খুঁজতে শুরু করেছেন। এখানে পঁচাশি টাকা ভাড়া দিতে হয়। বাড়ি ভাড়া ইদানীং যে-ভাবে হু-হুঁ করে বাড়ছে তাতে নতুন বাড়ি নিতে গেলেই অন্তত দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে। এখন প্রতি পদে পদে টাকার চিন্তা।
একটা ঘর প্রতাপ-মমতার, আর একটা ঘরে সুপ্রীতি থাকেন তুতুলকে নিয়ে, ছোট ঘরটাতে কানু-পিকলুবাবলুর ঢালা বিছানা। বাইরের লোকজন এলে বসার জায়গা দেওয়া যায় না। কোনো কোনো দিন সকালে প্রতাপের সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলে তাঁকে ছেলেদের ঘরেই বসতে হয়, ছেলেরা তখন পড়া ছেড়ে উঠে যায়।
পিকলু আর তুতুল দু’জনেই পড়াশুনোয় খুব ভালো, সকলের মুখেই তাদের প্রশংসা। বাবলুর পড়াশুনোয় মন নেই, সব সময় তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরছে। দাদা আর ফুলদির থেকে আলদা হবার জন্যই যেন সে ইচ্ছে করে পরীক্ষায় ফেল করতে চায়। এবারেই অঙ্কে সে পেয়েছে আঠাশ আর ইংরিজিতে বত্রিশ, সেই জন্য তার প্রমোশন আটকে যাচ্ছিল, পিকলু হেড মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বাবলুকে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বাবার হাতে বাবলুর মার খাওয়া সে আটকাতে পারে নি।
পিকলু খুব চেষ্টা করে ছোট ভাইটার পড়াশুনোর দিকে মন ফেরাতে। ছুটির দিনে সে তাকে হোম টাস্ক দেয়। কিন্তু বাবলু দাদাকে ভয় পায় না, হঠাৎ হঠাৎ উঠে চলে যায়। পিকলুর খেয়াল হতেই নিজের পড়া ছেড়ে উঠে পড়তে হয় বাবলুকে খুঁজতে, জোরে ডাকাডাকি করতে পারে না, বাবা শুনে ফেললে তিনি নিজেই জানতে চাইবেন বাবলু কোথায়। বাড়ির মধ্যে কোথাও দেখা যায় না বাবলুকে, বাড়ির সামনে রাস্তাতেও সে নেই, একটু এগিয়ে এসে পাশের বস্তির সামনে সে দেখতে পায় যে বাবলু ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে ডাং-গুলি খেলছে।
মহা বিস্ময়ের সঙ্গে পিকলু ডাকে, বাবলু! তুই….
তার উত্তরে বাবলু হাসে।
রাত্তিরে আলো নিবিয়ে দেওয়ার পর পাশাপাশি শুয়ে ওদের তিনজনের নানারকম গল্প হয়। কানু শোনায় তার অফিসের গল্প। সম্প্রতি আগের চাকরি ছেড়ে সে একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। যদিও তার চাকরিটা ক্লারিকাল, ক্যাশ-ঘরে ঢোকার কথা নয় তার, কিন্তু রোমহর্ষক কাহিনী বানাতে সে ওস্তাদ। শোভাবাজার রাজবাড়ির এক রানী একদিন নাকি এক ঘড়া মোহর নিয়ে এসেছেন ব্যাঙ্কে ভাঙাবার জন্য। কানুর ওপর সেই মোহর গুনবার ভার দিলেন। ম্যানেজারবাবু। সেই মোহর গুনতে গুনতে কানু দেখতে পেল এক একটা মোহরের গায়ে লেগে আছে রক্তের দাগ। সোনার ঘড়াটার গায়েও ছিটে ছিটে রক্ত শুকিয়ে আছে। মোহর-ভর্তি সোনার ঘড়া মাটিতে পুঁতে রাখার সময় একটা ছোট ছেলেকে মেরে তার দেহটাও একসঙ্গে পুঁতে রাখতো তো ওরা, যখ হয়ে পাহারা দেবার জন্য…।
এই কাহিনী শুনে পিকলু আর বাবলুর মনে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হয়।
রাজবাড়ির রানীর চেহারাটা কল্পনা করতে চায় পিকলু। চাঁপাফুলের মতন গায়ের রং, নীল রেশমী শাড়ী পরা, মুখে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব, উদাসীনভাবে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। মুখখানা কার মতন? কার মতন? অনেকটা বুলা মাসির মতন নয়!
আর বাবলু ভাবে, শোভাবাজার রাজবাড়িটা একদিন সে দেখেছে। গেটের বাইরে দুটো সিংহ মূর্তি। তাদের স্কুল থেকে বেশি দূর নয়। একদিন টপ করে ঢুকে পড়তে হবে ঐ বাড়ির মধ্যে। নিশ্চয়ই ওখানে এখনো গুপ্তধন আছে।
পিকলু স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ে। প্রত্যেকদিন সে আট আনা হাত খরচ পায়। তাছাড়া, কোনো কোনোদিন যদি সে মমতাকে বলে, মা, আজ বসন্ত কেবিনে বন্ধুদের সিঙ্গাড়া খাওয়াতে হবে, কাল একটা বাজিতে হেরে গেছি, দুটো টাকা দাও, তাতে মমতা আপত্তি করেন না। বাবলুর হাত-খরচ দু’আনা মাত্র। তা দিয়ে সে ঘুড়ি কিনবে না আলু কাবলি খাবে? এখন আলু কাবলি চার পয়সা পাতা হয়ে গেছে। বাবলু এই জন্য দারুণ হিংসে করে দাদাকে। ইস্কুলের শেষ দুটো বছর যেন সে আর সহ্য করতে পারছে না। সে এখনই এক লাফে কলেজে গিয়ে স্বাধীন হতে চায়।
একদিন এক ক্লাস-ফ্রেণ্ডের দিদির বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গেল পিকলু, বলেই গিয়েছিল যে তার ফিরতে দেরি হবে, সে ফিরলো রাত সাড়ে দশটায়। ঘুম এসে গেলেও জোর করে চোখ খুলে বাবলু জেগে রইলো ততক্ষণ। বাড়ির কেউ সঙ্গে যায় নি, দাদা একলা গেছে, একলা ফিরবে। এ এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। মা বাবা-পিসিমা মুখে কোনো উদ্বেগ না দেখালেও গল্প করছেন পাশের ঘরে, পিকলু না ফেরা পর্যন্ত তাঁরা শুতে যাবেন না।
পিকলু অত রাতে ফিরলেও কেউ বকুনি দিলেন না। মা প্রায় হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাঁরে পিকলু, এত রাত হলো? কার সঙ্গে ফিরলি!
পিকলু বললো, অনেক দূরে যে। আমি ফাস্ট ব্যাচেই খেয়ে নিয়েছি, তারপর বাসে আসতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। আমার আর এক বন্ধু সঙ্গে ছিল, সে নেমে গেল বিডন স্ট্রিটে।
–সেও তো অনেক দূর। তারপর থেকে একলা এলি?
–মা, বাসে তো আরও অনেক লোক ছিল। একলা কী করে আসবো?
পিকলু জামা-প্যান্ট বদলে শুয়ে পড়ার পর বাবলু তার দাদার মুখে সিগারেটের গন্ধ পেল। ঠোঁট লাল। পানও খেয়েছে। সব বড়দের মতন। বাড়িতে সাহস পায় না, কিন্তু পিকলু বাইরে সিগারেট খায়, তা বাবলু জানে। কানু সিগারেট টানার জন্য ছাদে উঠে যায়।
কানু জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে বাড়িতে গেলি, গোল্ড ফ্লেকের টিন আনিসনি!
পিকলু বললো, না তো! কী করে আনবো?
কানু বললো, আমি কোনো বিয়ে বাড়িতে গেলেই একটা পুরো টিন পকেটে ভরে ফেলি। অনেকগুলো থাকে তো, কেউ লক্ষ করে না।
পিকলু বললো, কত দূর গিয়েছিলুম জানো? সেই বালিগঞ্জ! কী সুন্দর জায়গা!
কানু অভিজ্ঞের ভাব দেখিয়ে বললো, আমি চিনি বালিগঞ্জ। বালিগঞ্জের কোথায় তোর বন্ধুর বাড়ি?
–রাসবিহারী এভিনিউ। কী চমৎকার রাস্তা! দু পাশে গাছ। ট্রাম চলে মাঝখান দিয়ে। রাস্তাটা পরিষ্কার তেল চকচকে, আর কত বড় বড় দোকান, কাঁচের শো-কেস দিয়ে ভেতর পর্যন্ত দেখা যায়। আর একটা কী জিনিস দেখলুম জানো, কানুদাদা, মেয়েরা চেন-বাঁধা কুকুর নিয়ে ওখানে একলা একলা বেড়াতে বেরোয়।
–হ্যাঁ, পাড়াটা ভালো। সেজদা তো বাড়ি বদলাবার কথা ভাবছে, বল না, ও পাড়ায় একটা বাড়ি নিতে।
–ওটা তো বড়লোকদের পাড়া। একটাও খালি গায়ে কিংবা নোংরা জামা পরা লোক দেখিনি।
বাবলু নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছে। যেন কোনো রূপকথার জগতের কাহিনী। সে একবার মা বাবার সঙ্গে কালীঘাটে একটা নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল, অনেকদিন আগে, ভালো করে মনে। নেই, তাছাড়া ফেরার পথে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বালিগঞ্জ কি তার থেকেও দূরে?
সে তখনই ঠিক করে ফেলোে, একদিন সে একা একা বালিগঞ্জে বেড়াতে যাবে। বড় হওয়া। পর্যন্ত সে আর ধৈর্য রাখতে পারবে না। মেয়েরা চেনা বাঁধা কুকুর নিয়ে একলা একলা বেড়াতে বেরোয়? কী রকম কুকুর, তাকে দেখতেই হবে।
ক’দিনের টিফিনের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে সে এক টাকা করলো। তারপর একদিন কার জন্মদিনের জন্য যেন হাফ-হলিডে হতেই ভালো সুযোগ এসে গেল তার। বাড়ির কেউ তো জানে না যে আজ ছুটি হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এলো শ্যামবাজার। এখানে সে বালিগঞ্জ লেখা দোতলা বাস দেখেছে।
সেরকম একটা বাসে উঠে পড়লো বাবলু। ওপর তলায় উঠে একেবারে সামনে গিয়ে বসলো। হু-হুঁ করে হাওয়া দেয় এখানে। রাস্তার ধারের গাছের ডাল জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তাটা কত দূর পর্যন্ত দেখা যায়, যেন তেপান্তরের মাঠে চলে গেছে।
এক সময় কণ্ডাক্টর এসে বললো, খোকা, তোমার সঙ্গে কে আছে!
বাবলুর বুক কেঁপে উঠলো। এরা বুঝি তার মতন বয়েসি ছেলেদের একা যেতে দেয় না?
সে রকম নিয়ম নেই? এখন তাকে নামিয়ে দেবে বাস থেকে?
বাবলু কোনো উত্তর না দিয়ে শুকনো চোখে তাকিয়ে রইলো।
কণ্ডাক্টর আবার জিজ্ঞেস করলো, তোমার টিকিট কে কাটবে?
এবারে বাবলু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, আমি! বালিগঞ্জ যাবো।
সে সব কটা খুচরো পয়সা এগিয়ে দিতে কণ্ডাক্টর তার থেকে তুলে নিল একটা সিকি।
বাবলুর পাশে বেশ হোমরা-চোমরা ধরনের বয়স্ক লোক বসেছেন। তিনি বাবলুর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খোকা, তোমার নাম কী?
–শ্রীঅতীন মজুমদার।
–ইস্কুল থেকে ফিরছো, তুমি বালিগঞ্জ থেকে এতদূর পড়তে আসো? কেন, ওখানেও তো ভালো ভালো ইস্কুল আছে!
বাবলু চুপ করে রইলো।
–বালিগঞ্জে কোথায় থাকো?
–রাসবিহারী এভিনিউ।
–হ্যাঁ, রাসবিহারী এভিনিউ-এর কোন জায়গায়–ওটা তো অনেক বড় রাস্তা! দেশপ্রিয় পার্ক? ট্রায়ঙ্গুলার পার্ক?
বাবলু দ্বিতীয়টিতে মাথা নেড়ে দিল বিনা দ্বিধায়।
কথাবার্তা আর বেশি দূর এগোলো না। ভদ্রলোক সামনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, এ কী। আজ আবার কোন্ হাঙ্গামা শুরু হলো?
বাবলু দেখলো, রাস্তার মাঝখানে অনেক লোক দাঁড়িয়ে হাত তুলে বাসটাকে থামাতে চাইছে। ড্রাইভার কিন্তু বাসটা থামালো না, পাশ কাটিয়ে এগোবার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড একটা হইচই উঠলো, বাসের গায়ে দুম দাম কিসের আঘাত পড়তে লাগলো। বাসটা তবু বেরিয়ে গেল। খুব টেনে।
বাবলুর পাশের ভদ্রলোক বললেন, যাক, খুব বাঁচোয়া! রোজ একটা না একটা কিছু লেগেই আছে। আর পারা যায় না। এই গভর্নমেন্টও হয়েছে অপদার্থ।
বাসের সব যাত্রী এক সঙ্গে যোগ দিল রাজনৈতিক আলোচনায়।
বাবলু সে সব কিছু শুনছে না। সে চোখ ভরে দেখছে এসপ্লানেডের অপরূপ দৃশ্য। এ যেন সত্যিকারের সেই তেপান্তরের মাঠ। সবুজ ঘাসে ভরা। যত দূর চোখ যায়, আর কিছু নেই। এক পাশে কী সব প্রকাণ্ড বাড়ি। আর ঐ তো মনুমেন্ট!
এক একটা জিনিস চিনতে পারছে আর বাবলুর বুকটা ধক ধক করছে। কলম্বাস, ম্যাগেলান, ডঃ লিভিংস্টোনের মতন আবিষ্কারকদের তুলনায় বাবলুর রোমাঞ্চকর উত্তেজনা এখন কিছু মাত্র কম নয়। একটি সাড়ে তের বছর বয়স্ক কিশোরের চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে অচেনা জগৎ।
বাসটা আর বেশি দূর যেতে পারলো না। এলগিন রোডের কাছে ক্রুদ্ধ জনতা রাস্তার ওপর ব্যারিকেড বানিয়েছে। ট্রাম ভাড়া আন্দোলনের সময় কয়েকটি ট্রাম পোড়াবার পর এখন যে-কোনো আন্দোলনেই বিক্ষোভকারীরা ট্রামবাস পোড়াবার খেলায় মেতে ওঠে।
ওপরের সব লোক দুদ্দাড় করে কেন নেমে গেল, তা বুঝতে পারলো না বাবলু। কেউ তাকে ডাকলোও না। বাবলু বসেই রইলো। নিচে তুমুল গোলমাল হচ্ছে, এসব তার একটুও ভালো লাগছে না। এখনো নিশ্চয়ই বালিগঞ্জ আসেনি, একটিও মেয়েকে চেনবাঁধা কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেনি সে।
বুম বুম করে দুটি বোমা ফাটার আওয়াজ ও বাসের গায়ে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠতেই বাবলু বিপদের গন্ধ পেয়ে গেল। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে সে। দেখলো শুধু ধোঁয়া। কিন্তু সে ভয় পেল না। গোঁয়ারের মতন সেই ধোঁয়ার মধ্য দিয়েই সে লাফিয়ে চলে এলো। তার গায়ে সামান্য আঁচ লেগেছে, আর বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি।
জ্বলন্ত বাস থেকে একটা ছেলেকে বেরিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো অনেকে। কেউ বললো, এই খোকা, আর কে আছে? আর কেউ আছে? কেউ বললো, পালা, শিগগির পালা। তোকে পুলিশে ধরবে।
খানিকটা ছুটে আসবার পর তার খেয়াল হলো, যে তার স্কুলের সব বই-খাতা ফেলে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ফিরলো। এইবারে তার সত্যিকারের ভয় করছে। বই-খাতা–নিয়ে সে বাড়ি যাবে কী করে?
জ্বলন্ত বাসটার কাছে বাবলু আর পৌঁছোতে পারলো না, এক পলায়নপর জনতার ঢেউ তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল অন্য দিকে। শোনা যাচ্ছে দমকলের ঘণ্টাধ্বনি, এক গাড়ি পুলিশও এসে পড়েছে।
একটা ঢেউ তাকে নিয়ে গেল পাশের রাস্তায়। তারপর আর একটা রাস্তায়। তারপর সে হয়ে গেল হারিয়ে যাওয়া ছেলে। ট্রামবাস-গাড়ি-ঘোড়া সব বন্ধ হয়ে গেছে, এক একটা রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ চলছে পুলিশ-জনতায়, কী করে বাড়ি ফিরতে পারা যায় এখান থেকে, তা বাবলু জানে না। যাকেই সে জিজ্ঞেস করে বাগবাজারের কথা, সে-ই বলে, ওরে বাবা, সে তো অনেক দূর, আজ আর সেখানে যাবে কী করে?
বাবলু তবু হার স্বীকার করে না। মারামারির জায়গা থেকে সে অন্য দিকে ছুটে যায়, আবার রাস্তা হারিয়ে ফেলে, আবার রাস্তা খোঁজে। এক বেলাতেই সে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে।
রাত প্রায় পৌনে আটটার সময় বাবলু বাড়ি পৌঁছোলো। স্কুলের বই-খাতা নেই, পায়ের চটি খুলে গেছে কোন্ সময়, জামার খানিকটা অংশ পোড়া, কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অচেনা বিপদসঙ্কুল জায়গা থেকে সে একলা একলা ফিরে আসতে পেরেছে, এই জয়ের আনন্দ তার চোখে।
শহরের নানা অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে গোলমাল হয়েছে শুনে প্রতাপ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছেন, সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। তখনো বাবলু ফেরেনি। পাড়ার সরকারবাড়ির ছেলেটির কাছ থেকে খবর নিয়ে জানা গেল, স্কুলে সেদিন হাফ-ছুটি হয়েছে। অর্থাৎ বেলা দুটো থেকে বাবলুর পাত্তা নেই। অথচ শ্যামবাজার বাগবাজার পাড়ায় তো কোনো গোলমাল হয়নি! তাহলে কী। সাঙ্ঘাতিক দুশ্চিন্তার কথা!
কানু আর পিকলু হাসপাতাল আর থানায় গিয়ে খবর নিয়েছে। প্রতাপ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন অনেকক্ষণ। তারপর স্কুল থেকে বাবলুর যে-পথ দিয়ে বাড়ি ফেরার কথা, সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছেন স্কুল পর্যন্ত, মাঝে মাঝে পাড়ার ছেলেদের জিজ্ঞেস করেছেন, সেদিন বাবলুর বয়েসী কোনো ছেলের অ্যাকসিডেন্টের খবর তারা জানে কি না।
বাবলু যখন ফিরলো তখনো কানু আর পিকলু গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিল। ছোট ভাইকে ফিরতে দেখে পিকলু খুশী হবার বদলে শিউরে উঠলো।
বাবলুকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর মমতা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। সুপ্রীতি বললেন, ওকে হাত-মুখ ধুইয়ে আগে কিছু খেতে দাও। দেখেছো চোখ মুখের অবস্থা!
প্রতাপ বললেন, দাঁড়াও, আমি আগে ওর সঙ্গে কথা বলবো।
প্রতাপ বাবলুকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে যেতেই সুপ্রীতি বললেন, ওকি, দরজা বন্ধ করছিস কেন?
প্রতাপ বললেন, দিদি, এ ছেলে কুসঙ্গে পড়ে একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। তুমি আর মমতা আস্কারা দিয়ে দিয়ে ওর সর্বনাশ করছে। আমাকে এখন বাধা দিও না।
সুপ্রীতি তবু দৃঢ়ভাবে বললেন, না, দরজা বন্ধ করতে পারবি না। আমি আর মমতাও থাকবো, আমরাও শুনবো!
দূরে দাঁড়িয়ে পিকলু সুপ্রীতির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলো। আজ মায়ের কথাও বাবা শুনতেন না। বাবলু যা কাণ্ড করেছে, এরকম আগে আর কখনো হয়নি। আজ বাবা রাগের চোটে যে কী করবেন তার ঠিক নেই। কলেজের বন্ধুরা বলে, বাঙালদের রাগ বেশী হয়!
বাবলুকে টেনে এনে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি? বল, সত্যি করে বল!
সুপ্রীতি বললেন, খোকন, এখন থাক না। ছেলেটা আগে একটু জিরিয়ে নিক। নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছিল। ফিরে যে এসেছে এই-ই তো ভাগ্য!
প্রতাপ এবারে গর্জন করে বললেন, দিদি! এখন আমার ওপর কোনো কথা বলো না। একটু সরে দাঁড়াও! বাবলু, বল কোথায় গিয়েছিলি?
বাবলু মুখ গোঁজ করে নিরুত্তর রইলো। বাবার রাগ দেখেও তার ঠিক ভয় হচ্ছে না। বরং অভিমানে বুক ভরে যাচ্ছে। সে যে কীভাবে বাড়ি ফিরে এসেছে, তা কেন কেউ আগে জানতে, চাইছে না! তার চেয়ে মরে গেলে বেশ হতো!
প্রতাপের আরও তিনবার জিজ্ঞাসার উত্তরে বাবলু বললো, এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
-–কেন না বলে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলি? কোথায় সেই বন্ধুর বাড়ি?
বাবলু একদিকে হাত দেখিয়ে বললো, ঐদিকে।
–ঐদিকে মানে? কত দূরে? সে জায়গার নাম কী?
–জানি না।
–বইপত্তর কোথায় গেল। বল্! সত্যি কথা বল!
–হাত থেকে পড়ে গেছে।
–হারামজাদা ছেলে, হাত থেকে এমনি এমনি বইখাতা পড়ে যায়?
প্রতাপ প্রথম থাপ্পড়টা এত জোরে কষালেন যে বাবলুর মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে। তারপর প্রতাপ লাফিয়ে এসে বাবলুর চুলের মুঠি চেপে ধরে হিংস্রভাবে বললেন, এরকম কুলাঙ্গার ছেলে। থাকার চেয়ে না-থাকা ভালো। আজ আমি একে শেষ করে দেবো।
সুপ্রীতি ও মমতা দুদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নেবার আগেই প্রতাপ মারতে মারতে বাবলুকে প্রায় আধমরা করে ফেললেন। মমতা এক সময় সরে গিয়ে বললেন, মারো, যত ইচ্ছে মারো, মেরে ফেলো ছেলেটাকে! সুপ্রীতি হাল ছাড়লেন না, বাবলুকে মারার জন্য প্রতাপ একটা ছড়ি তুলতে সুপ্রীতি বললেন, ওটা দিয়ে তুই আগে আমাকে মার।
সুপ্রীতি বাবলুকে নিজের ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তোয়ালে ভিজিয়ে গা-মুখ মুছে দিতে লাগলেন। বাবলুর হেঁচকি উঠছে অনবরত, চোখে এক ফোঁটা জল নেই, চোখ বোঁজা। কিন্তু পিকলু তার নিজের চোখের জল সামলাতে পারছে না। তুতুলও কাঁদছে। তুতুলের ধারণা, এত মার খেলে কেউ বাঁচে না।
সুপ্রীতি এক গেলাস দুধ বাবলুকে খাওয়াতে যেতেই সে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। সে খাবে না। খাবে না তো কিছুতেই খাবে না। মা, পিসি, দাদা, দিদির হাজার কাকুতি-মিনতিতেও সে এক দানা খাদ্যও মুখে তুলো না। এমন জেদী ছেলে, দাঁতে দাঁত চেপে রইলো।
সে রাতে সুপ্রীতির ঘরেই শুইয়ে রাখা হলো বাবলুকে। নিজেদের ঘরের বিছানায় পিকলু ছটফট করছে, তার ঘুম আসছে না। বাবলুর কি হাড়-গোড় কিছু ভেঙে গেছে? ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? মায়ের ওপরেই যেন তার বেশি রাগ। মমতা কিছু দিতে এলে সে দু’হাত ছুঁড়ে বাধা দেয়।
অনেক রাত, বোধহয় সাড়ে বারোটা-একটা হবে, মমতা নিজের ঘর থেকে উঠে এসে। সুপ্রীতির ঘরের দরজাটা ঠেলে খুললেন। বাবলুর বিছানার পাশে বসে পড়ে বললেন, বাবলু, তুই আমার কাছে আসবি না? তুই আমার কাছে আর কোনোদিন আসবি না?
মা বলে একটা আর্ত চিৎকার করে বাবলু উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো মমতার বুকে। তারপর ফোঁপাতে লাগলো।
পাশের ঘর থেকে পিকলু সব শুনতে পাচ্ছে। কানুও জেগে আছে। সে হাসতে হাসতে এই সময় বললো, কাল বাড়িতে মাংস আসবে। বাবলুটাকে কোনোদিন মারলেই সেজদা পরের দিন অনেক পয়সা খরচ করে। আমায় মারলে কিন্তু কিছু করে না!
পিকলু কাতরভাবে কানুর দিকে তাকালো। কানুকাকাটা কী নিষ্ঠুর। এই সময় ঐ কথাটা না বললে চলতো না?
পরদিন বাবলুকে স্কুলে পাঠানো হল না, তার সারা গায়ে ব্যথা। প্রতাপও আদালতে গেলেন না, শুয়ে শুয়ে শুধু খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, যেন কতদিনের পুরোনো সব কাগজ তাঁর পড়া বাকি ছিল।
বিকেল চারটের সময় তিনি পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে বাবলুকে ডেকে বললেন, বাবলু, তুই চল আমার সঙ্গে!
মমতা অমনি শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ওকে তুমি কেথায় নিয়ে যাবে?
প্রতাপ গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাচ্ছি বলে তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি? আমি কি ওকে মেরে ফেলবো?
বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বড় রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সি ধরলেন। ড্রাইভারকে বললেন, চলো গড়ের মাঠ।
অনেকক্ষণ পিতাপুত্রে একটিও কথা নেই। দু’জনে তাকিয়ে আছে দু’দিকে।
তারপর ট্যাক্সি ময়দানের কাছাকাছি আসবার পর প্রতাপ বললেন, বাবলু, কাল কোথায় গিয়েছিলি? বল আমাকে! তুই যতক্ষণ না বলবি ততক্ষণ আমার খুব কষ্ট হবে। আমি আমার বাবার কাছে কোনোদিন মিথ্যে কথা বলিনি! তুই কোথায় গিয়েছিলি, বল, বাবলু! বল, কোথায় গিয়েছিলি, বাবলু, বল বল।
বাবলু তবু কোনো কথা বললো না। বাবার সঙ্গে সে সারাজীবনে আর কথা বলবে না ঠিক করেছে। বাবা তাকে মেরে ফেললেও সে মুখ খুলবে না!
ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে প্রতাপ বাবলুর হাত শক্ত করে ধরে গম্ভীর ভাবে বললেন, চল আমার সঙ্গে!
যেন তিনি আদি বাইবেলের কোনো চরিত্রের মতন সন্তানকে পাহাড় শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন বলি দেবার জন্য। আকাশে জমাট কালো মেঘ, অসময়ে নেমে আসছে অন্ধকার। ঘাসের ওপর দিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটবার পর প্রতাপ একটা রেইনট্রি গাছের নীচে দাঁড়ালেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত তীব্র ভাবে চেয়ে রইলেন ছেলের মুখের দিকে। অকস্মাৎ ধরা গলায় তিনি বললেন, বাবলু, তুই কি ভাবিস, তোকে মারলে আমার ভালো লাগে? বাবা-মাদের কত কষ্ট হয়, বড় হয়ে এক সময় বুঝবি! জানিস তো আমি মিথ্যে কথা সহ্য করতে পারি না, সত্যি কথা বললে রাগ করবো না, আমাকে সব সময় সত্যি কথা বলবি….কাল কী হয়েছিল, ঠিক করে বল…
বাবাকে হঠাৎ এ রকম নরম হয়ে যেতে দেখে বাবলু যেন খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! বাবার এ রকম গলার আওয়াজ সে আগে কক্ষনো শোনে নি। সেও খুব দুর্বল হয়ে পড়লো, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললল, দাদা একা একা বালিগঞ্জে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল…তাই আমি বালিগঞ্জ দেখবার জন্য…বাসে আগুন লেগে গেল…
সন্তানের প্রতি দুর্বলতা প্রতাপ মমতা-সুপ্রীতিকে দেখাতে চান না বলেই বোধহয় প্রতাপ বাবলুকে নিয়ে এসেছেন এত দূরের ময়দানে। এখন এই নিরালায় কান্না সামলাতে সামলাতে তিনি পুত্রকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে লাগলেন।