1 of 4

১.১৯ উজির সামস অল-দিন তার ভাই নূর অল-দিন ও হাসান বদর অল-দিন

উজির সামস অল-দিন তার ভাই নূর অল-দিন ও হাসান বদর অল-দিন

এক সময়ে মিশরে পরম দয়ালু। ধর্ম পরায়ণ এক সুলতান প্রজাপালন করতেন। তার এক উজির ছিলো নানা বিদ্যায় বিশারদ। চাঁদের মতো সুন্দর দেখতে তার দুই যমজ পুত্র ছিলো। একটির নাম সামস-আল-দীন, আর একটির নাম নূর-আল-দীন। বড়টি ছিলো যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি ছিলো তার আচার ব্যবহার। এক কথায় রূপ গুণে অসাধারণ। আর ছোটটি ছিলো আরও সুন্দর, আরো গুণবান। সারা দুনিয়ার সেরা ছেলে। মিশরে যে সব বিদেশীরা আসতো তারা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতো তার রূপ।

উজিরের মৃত্যুর পর সুলতান সাদরে ডেকে নিলো দুই ভাইকে। তার দরবারে দু’জনকেই সমমর্যাদায় উজিরের আসন দিলো। নানা ধরনের মূল্যবান উপটৌকন দিয়ে বললো, তোমরা আজ থেকে আমার দরবারে উজিরের কাজে বহাল হলে। বাবার স্মৃতির উদ্দেশে শোকপালন করে এক মাস বাদে তার কাজে এলো দরবারে।

একদিন দুই ভাই দরবারে যাবার পথে এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চলছিলো : বড়ভাই বলছিলো, এবার আমাদের বিয়ে শাদী করা দরকার। সুলতানের দরবারে পাকাপাকি চাকরী হয়ে গেলো। সুতরাং খাওয়া পরার ভাবনা তো আর থাকবে না।

তাছাড়া সময় মতো শাদী না করলে বালবাচ্চাদের মানুষ করে যাবো কী করে? তাদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ভালোভাবে বিয়ে শাদী দিতে হবে। আমার মনে হয়, এখনই শাদীর প্রশস্ত সময়। আর শাদী যখন করবো-দু’ভাই একসঙ্গে একই দিনে করবো। তুমি কী বলে?

ছোটভাই নূর-আল-দীন বললো, তুমি যেরকম বলবে, তাই হবে।

বড়ভাই সামস-আল-দীন তখন বললো, ধরে শাদীর পর একই সঙ্গে আমাদের দু’জনের দুটি বাচ্চা হলো; আচ্ছা ধরো, আমার মেয়ে আর তোমার ছেলে হলো। তা হলে তো আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলের শাদী দিতে হয়।

ছোট বললো, উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু বলো, তোমার মেয়ের জন্যে কী দেনমোহর দিতে হবে আমার ছেলেকে?

বড়ভাই বলে, আমি ভাবছি, তোমার ছেলের কাছ থেকে তিন হাজার সোনার দিনার নেবো। আর নেবো তিনটি খামার। আর জায়গীর নেবো তিনটি বড় গ্রাম। আমার মনে হয়, আমার মেয়ের জন্যে খুব বেশী কিছু একটা চাওয়া হবে না। অবশ্য তোমার ছেলে যদি না রাজী হয় তবে আর কথা বাড়িয়ে কাজ নাই। এখানেই প্রস্তাব খারিজ করে দেবো।

ছোট ভাই বললো, ভাই-এ ভাই সম্পর্ক হবে। ওরা ভাই-এ বোনে শাদী করবে। তা এর মধ্যে যৌতুক নিয়ে অতো দরকষাকষি কি আছে, দাদা? কেউ আমরা কম নই। দুজনেই উজির। কার কী অভাব থাকবে। আমার তো মনে হয়, তোমার মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের শাদী হয়ে যাবে-এইটাই সব চেয়ে বড় কথা হওয়া উচিত। যৌতুকপত্র সেখানে নগণ্য। তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, টাকা পয়সাই যেনো সব। কি করে ধন সম্পত্তিকে রাতারাতি দুগুণ চারগুণ করে বাড়াবে সেই সব সুদখোরদের মতো কথাবার্তা তোমার মুখে মানায় না, দাদা।

বড়ভাই বললো, তোমার কি ধারণা হচ্ছে, তোমার ছেলে আমার মেয়ের চেয়ে রূপেগুণে আরও বড়ো হবে? সে অহঙ্কার যদি করো তা হলে তোমার ছেলের সঙ্গে কিছুতেই আমি শাদী দেবো না আমার মেয়ের। তা যদি তাকে পাল্লায় ওজন করে সোনা ঢেলে দাও, তবু না। আমারটা মেয়ে বলে কি ফেলনা?

সামস-আল-দীন রাগে। কাঁপতে কাঁপতে বললো শেষের কথাগুলো। নূর-আল-দীনও ভীষণ ক্ষেপে গেলো দাদার কথায়। বললো, আমার ছেলেও ফেলনা নয়। আমি এই বলে রাখলাম, তোমার মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের শাদী দেবো না, দেবো না। ব্যাস, এখানেই সব খতম হয়ে গেলো। এ নিয়ে আর কখনও কথা হবে না।

বড়ভাই বললো, কাল সকালে সুলতানের সঙ্গে বেরুবার পালা আমার। আমি তাকে বলবো তোমার এই অসভ্যতার কথা। তারপর দেখো কি হয়?

নূর-আল-দীন রাগে গরগর করতে করতে চলে গেলো। আর কোনো কথা বললো না।

পরদিন সকালে সুলতানের সঙ্গে সামস-আল-দীন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে নীল নদের ধারে এলো। একটা পানসি নৌকো করে ওপারে জিজা যাওয়ার ইচ্ছা করলো। জিজায় অনেক পিরামিড আছে!

এদিকে সারারাত রাগে ক্ষোভে অনিদ্রায় কাটিয়ে ভোর না হতে উঠে পড়ে নূর-আল-দীন। দাদার সঙ্গে তার সেই কথা কাটাকাটি ও তার কটুবাক্যে মনটা বিষিয়ে গেছে। সে ঠিক করলো দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।

তার নফরকে ডেকে বললো, আমার সেই ছাই রঙের খচ্চরটা বের করে জীন লাগা। এই খচ্চরটা দেখতে খুব বাহারী। শখের জনোয়ার। সোনার কাজ করা মখমলের গদি পাতা দামী জীন লাগালো নফরটা। এমন কায়দায় সাজালো যেন মনে হয় শাদী করতে যাবে কোন বর। একটা দামী রেশমী গালিচা আর একখানা কম্বল সঙ্গে নিলো। খচ্চরের পিঠে চেপে নফরকে উদ্দেশ করে বললে নূর-আল-দীন, আমি চললাম রে, তোদের দেশে আর থাকবে না।

নফরটা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন, হুজুর?

–আগে যাবো কালিব শহরে। সেখানে দু-তিন দিন থাকবো। তোদের এই পচা শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটু খোলামেলা আলো-হাওয়ায় মনটা সাফা করবো সেখানে। তারপর ভাববো, কোথায় যাবো। তোদের কিন্তু বারবার বারণ করে যাচ্ছি। আমার কোন খোঁজখবর করার চেষ্টা করবি না। আমি একটু একা থাকতে চাই। এই হিংসা কুটিলতা স্বার্থপরতার নোংরামি থেকে পালিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাই।

নূর-আল-দীন রওনা হয়ে গেলো। কাইরো ছাড়িয়ে বুলবেশ-এ যখন পৌঁছলো তখন ঠিক দুপুরবেলা। খচ্চরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। তার নিজেরও বেশ খিদে পেয়েছে। একটা সরাইখানার সামনে নেমে খচ্চরটাকে ছেড়ে দিয়ে একটু কিছু খেয়ে নিলো সে। তারপর শহরের ভিতরে ঢুকে টুকিটাকি দরকারী দু-চারটে জিনিসপত্র কিনলো।

আবার যাত্রা শুরু হয়। দুদিন বাদে জেরুজালেমে এসে পৌঁছলো নূর-আল-দীন। পথশ্রমে বড় ক্লান্ত হয়েছে দেহ। এবার সে গালিচা আর কম্বলটা নামিয়ে খচ্চরটাকে চরতে পাঠিয়ে দিলো। কাছেই একটা কাফে খানা। হাত মুখ ধুয়ে খানাপিনা সেরে গালিচাটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো।

ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলো দাদাকে। দুজনে ঝগড়া কথা কাটাকাটি করছে। ঘুম ভাঙতেই মনটা বিষিয়ে গেলো। সংসারের নীচতা-হীনতা থেকে সরে থাকবে বলে দেশ, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এসেছে সে। কিন্তু এতো দূর এসেও তাকে সেই চিন্তাই হনন করছে এখনও।

পরদিন সকালে আবার রওনা হয়ে পড়ে নূর-আল-দীন। কোথায় যাবে তার কোন ঠিকানা নাই। যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে। সন্ধ্যে হয়ে এলো। এবার থামতে হয়। দেখলো আলেপ্পো শহরের কাছে এসে পড়েছে। একটা সরাইখানায় আশ্রয় নিলো। জায়গাটা বড় সুন্দর। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়ে নূর-আল-দীন। বেশ খুশি খুশি মেজাজে ভরে যায় মন। প্রকৃতির মনোরম শোভা দেখতে দেখতে তিনটি দিন কেমন করে কেটে যায় খেয়াল করতে পারে। না সে। মনের প্রসন্নতা এমনই বস্তু-তার প্রসাদে বিশ্বসংসার সব সুকুমার সুন্দর মনে হয়।

আলেপ্পোর মেঠাই-মিষ্টি খুব নাম করা। ছেলেবেলা থেকেই অনেক প্রশংসা শুনে এসেছে সে। মাঝে মাঝে খেয়েছেও। বিদেশীরা এখানে এলে হাঁডি ভরে নিয়ে যায় নিজের দেশে। এখানকার সবচেয়ে নামকরা পেস্তার বরফী কিনলো খানিকটা। আরও নানারকম মেঠাই মণ্ডা ভরে নিলো একটা পাতিল-এ।

আবার পথযাত্রা নিরুদ্দেশের পথে। খুশিতে নেচে উঠেছে তার মন প্রাণ। আজ আর কোন মোহ মায়া নেই তার। সে এক যাযাবর। সমাজ সংসারের দ্বন্দ্ব কোলাহল, স্বার্থ সংঘাত তাকে বিচলিত করতে পারছে না। উন্মুক্ত আকাশের পাখীর মতো ডানা মেলে দিয়েছে সে। যেদিকে যায় যাক না।

এ আর এক আনন্দের জগৎ। এ রসের স্বাদ যে পায়নি তাকে কখনও বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। বন্ধনহীন হরিণের মতো ছুটে চলার যে কি আনন্দ তা সংসার সীমাবদ্ধ প্ৰাণী বুঝবে কি করে?

দিনের পর দিন একটানা চলতে চলতে একদিন এসে পৌঁছলো সে বসরাহ শহরে। নূর-আল-দীন কিন্তু জানে না বসরা হয় পৌঁছে গেছে সে। চলার পথে প্রতিদিন কত ছোট বড় গ্রাম শহর পেরিয়ে চলেছে—কে মনে রাখে সে সব নাম। আর কিই বা দরকার। সে তো

আর ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখার মতলব করে পথে বেরোয়নি। সে এক পথভোলা পথিক। পথ চলাতেই তার আনন্দ। অন্য কোন উদ্দেশ্য তার নাই। যা দেখলো যা জানলো তা যে সবই মনে ধরে রাখতে হবে তার কি মানে আছে। যা মনের পাতায় দাগ কাটে তা মন থেকে মুছে ফেলতে চাইলেও মোছা যায় না। আবার যাকে মনে ধরে রাখবো বলে অনেক চেষ্টা করা হয় তাও কখন হারিয়ে তলিয়ে যায় বুঝতে পারা যায় না।

একটা সরাইখানায় নামলো নূর-আল-দীন। খানসাহেবের কাছে জানতে পারলো, সামনেই যে শহর-ওটাই বসরাহ। নাম অনেক শুনেছে। এই প্রথম প্রত্যক্ষ করবে। সে। বিরাট বন্দর। দেশবিদেশের সওদাগররা আসে এখানে বাণিজ্য করতে। বহু দূর দেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক আসে। কেনাকাটার জন্যে।

খানাপিনা সেরে নূর-আল-দীন খানসাহেবকে বললো, আপনার একটা লোক দিন আমার সঙ্গে। খচ্চরটা ধরে নিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। আমি পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখবো শহরটা। ছেলেবেলা থেকে অনেক গল্প কাহিনীতে এই বসরাহর কথা পড়েছি। আজ যখন এসেই পড়েছি একবার ভালো করে দেখে যাই।

পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পথ। কখনও বা খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে, আবার কখনও বা তরতর করে নিচে নেমে গেছে। খচ্চরের পিঠে চড়ে চলা নতুন লোকের পক্ষে একেবারে অসম্ভব। কিন্তু শহরের ভিতর ভাগ অতোটা উচুনিচু নয়। ছোকরাটা বললো, মালিক, এবার আপনি উঠে বসতে পারেন। কোন ভয় নাই। আমি লাগাম ধরে দেখে শুনে নিয়ে যাবো।

ছোকরার কথা মতো নূর-আল-দীন খচ্চরের পিঠে উঠে বসলো। ছেলেটা পাকা ওস্তাদ। এমনভাবে সামাল দিয়ে খচ্চরটাকে নিয়ে যেতে লাগলো-যাতে নূর-আল-দীনের কোন বাঁকানি না লাগে।

বসরাহর উজির সাহেব তখন তার প্রাসাদের গবাক্ষ পাশে বসে শহরের শোভা প্রত্যক্ষ করছিলো। হঠাৎ নজর পড়লো নূর-আল-দীনের ওপর। তার রূপ-জাঁকজমকে মুগ্ধ হলো সে। একটা নফরকে ডেকে বললো, যাতো, দেখে আয়, কে যায়, ঐ খচ্চরটার পিঠে? ডেকে নিয়ে আয় ওর সহিসটাকে।

যখন সে এলো বৃদ্ধ উজির জিজ্ঞেস করলো, তোমার মনিব কোন দেশের লোক, তার পরিচয় কিছু জানো?

—আজ্ঞে তাতো বলতে পারবো না। তবে মনে হয়, খুব খানদানী ঘরের আদমী। কোনও সওদাগরের লোড়কা হতে পারে।

—এখানে কোথায় উঠেছে সে?

সহিস ছোকরা বললো, আজ্ঞে আমাদের খান সাহেবের সরাইখানায়। কী সব দামী দামী সামানপত্তর। সুলতান বাদশাহর ঘরে আমনটা দেখা যায়।

উজির আর বিশেষ কোনও কথা বললো না ছেলেটার সঙ্গে। ওর খানসাহেবের সরাইখানার ঠিকানাটা নিয়ে দু’টো দিনার বকশিস দিয়ে বললো, ঠিক আছে, যাও।

বিকেলের দিকে সেই সরাইখানার সামনে এসে থামালো| উজির। খানসাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার এখানে যে বিদেশী এক যুবক এসেছে তার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

উজিরকে দেখে তো খানসাহেবের দফা রফি। না জানি কি বিপদ আপদ ঘটলো। শশব্যস্ত হয়ে করজোড়ে বললো, মেহেরবানী করে আমার গরীবখানায় হুজুরের পায়ের ধুলো দিতে আজ্ঞা হোক।

কিন্তু উজির ঘোড়া থেকে নামলো না।–তুমি তাকে একবার খবর পাঠাও।

নূর-আল-দীন ছুটে এলো। আপনি নিজে কষ্ট করে কেন এলেন, জনাব? আমাকে ডেকে পাঠালেই হাজির হতাম।

–তোমাকে তো হাজির করার জন্যে নিতে আসিনি, বাবা। আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি একটু।

উজিরকে সাদর অভ্যর্থনা করে ঘোড়া থেকে নামিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলো নূর-আল-দীন। প্রাথমিক আলাপ পরিচয় হলো খানিকটা। তার পরেই উজির বললো, আমাদের দেশে এসে তুমি এই নগণ্য এক সরাইখানায় পড়ে থাকবে তাতো হয় না বাবা। চলো, আর এক মুহূর্তও তোমাকে এখানে থাকতে দিতে পারি। না আমি। আমারবাড়ি চলো তুমি। তার পর অন্য কথা হবে।

নূর-আল-দীনের কোন ওজর আপত্তিই টিকলো না। দুজনে ঘোড়ার পিঠে চেপে উজিরেরবাড়ি এসে পৌঁছলো তারা। যথাযোগ্য আদর ষ্টুঞ্জ আপ্যায়ণ করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালে নূর-আল-দীনকে। বৃদ্ধ উজির এবার প্রশ্ন করে। এবার বলে বাবা, আমাদের এই বসরাহ-তে কেন এসেছে। কোনো কাজে কামে কী?

–জী না, স্রেফ বেড়াতে। আমি আজ অনেক দিন হলো আমার স্বদেশ, আমার জন্মভূমি কায়রো থেকে বেরিয়ে পড়েছি। আমার বাবা মিশরের সুলতানের উজির ছিলেন। সম্প্রতি তিনি গত হয়েছেন। আমরা দুভাই-ই সুলতানের দরবারে উজিরের পদে বহাল হয়েছিলাম। কিন্তু সংসারের স্বার্থপরতা নীচতা দেখে আমি অস্থির অশান্ত হয়ে উঠলাম। মনে হলো এ আমার জায়গা নয়। এখান থেকে অনেক দূরে চেনা জানার বাইরে অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে উধাও হয়ে যেতে হবে আমাকে। তাই একদিন সবার অগোচরে পথে বেরিয়ে পড়েছি। আমার মনে হচ্ছে, আমি ঠিক পথের সন্ধান করেছি। সারা দুনিয়ায় ঘুরে ঘুরে মানুষের মেলা দেখে বেড়াবো। আর দেখবো প্ৰাণ ভরে আল্লাহর অপার সুন্দর সৃষ্টি-প্রকৃতির বহু বিচিত্র রূপ। এর মধ্যেই আমার জীবনের আনন্দ, পূর্ণতা খুঁজে পাবো, এই আমার বিশ্বাস।

যুবকের এই উদাস বিবাগী হওয়ার সঙ্কল্প শুনে চমকে ওঠে উজির।—বাবা, তুমি যে পথ বেছে নিয়েছে, আপাতভাবে তোমার কাছে একমাত্র শ্রেষ্ঠ পথ মনে হলেও আসলে কিন্তু চিরদিন তোমার ভালো লাগবে না। এখন প্রথম যৌবনের রঙ আছে তোমার চোখে। দেহে আছে সামর্থ্য। পথ চলার ক্লান্তি অগ্রাহ্য করার যথেষ্ট ক্ষমতা এখন তোমার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এমন একদিন আসবে, যেদিন নিজের দেহকে মনে হবে অসহ্য, অতিরিক্ত এক বোঝা। তখন চোখেও এই রং থাকবে না। শোনো বাছা, এই দুনিয়াটা বিরাট। একটা কেন দশটা জীবনের পরমায়ু পেলেও তুমি তাকে দেখে নিঃশেষ করতে পারবে না। আমি বুঝতে পারছি তুমি সুদূরের এবং সুন্দরের পিয়াসী। তুমি প্রকৃতির অপোর সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে দাও, তাও আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু বাবা, এই অরূপরতনের সন্ধানে কি তোমাকে তামাম দুনিয়া টুড়ে বেড়াতে হবে। একটা বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু প্রমাণ সৌন্দৰ্য আছে, তাকি তোমার চোখে পড়েনি? সকালবেলায় দুয়ার খুলে ঘরের বাইরে এসে যে প্রথম শিশির কণােটা চোখে পড়ে তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছে কখনও? প্রভাত কিরণের প্রতিসরণে সাতরঙা রঙে সে কি অপরূপ রূপবান হয়? তার তুল্য অপার সৌন্দর্যের সন্ধান তুমি কোথায় পাবে?

উজির সাহেব শুধু বয়সে নয় জ্ঞানেও বৃদ্ধ। তার মতো প্রজ্ঞ ব্যক্তি সচরাচর মেলে না, সুলতানের দরবারে তার নাম যশখ্যাতি প্রতিপত্তি প্রচুর। নূর-আল-দীনকে ঘরমুখো করার জন্যেই এতো যুক্তি প্রমাণ তুলে ধরে উজির। মনে বাসনা, তার একমাত্র কন্যার সঙ্গে শাদী করিয়ে দিয়ে সুলতানকে ধরে তার দরবারে তাকে উজির করে কাছে রাখবে সে।

খানসাহেবের সরাইখানা থেকে নূর-আল-দীনের খচ্চর আর সামানপত্র নিয়ে আসার জন্য নফর পাঠিয়ে দিলো| উজির। একখানা সুসজ্জিত কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করলো তার। উজিরের কাছে প্রতিদিন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি আসে। তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো তার। এইভাবে বেশ কয়দিন কাটে। একদিন নূর-আল-দীনের কাছে প্রস্তাব রাখলো, বাবা, আমি বৃদ্ধ হয়েছি। ভাবছি আমি অবসর নেবো সুলতানের দরবার থেকে। তার আগে আমার একমাত্র কন্যার শাদী দিতে চাই। দেশবিদেশের বহু পাত্রের সন্ধানও এসেছে আমার কাছে। তাদের অনেকেই জ্ঞানে গুণে ধন-দৌলতে উপযুক্ত পত্র। কিন্তু আমার কাউকেই তেমন মনে ধরেনি। নিজের মেয়ের রূপগুণের ব্যাখ্যান করতে চাই না। তা করাও ভালো দেখায় না। কিন্তু লোকে বলে, আমার মেয়ের মতো রূপ যৌবন নাকি সারা দেশে নাই। আমার যেটুকু বিদ্যাবুদ্ধি আছে মেয়েকে শেখাবার চেষ্টা করেছি। তার অসাধারণ মেধা আমাকে অবাক করেছে। তোমাকে দেখে, বাবা, আমি মুগ্ধ হয়েছি। রূপ যৌবন তোমার অসাধারণ। কিন্তু তার চেয়েও বড় তোমার জ্ঞানগরিমা। আমি এই রকম পোত্রই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। তোমার যদি অমত না হয় তবে আমার কন্যাকে গ্রহণ করো, বাবা। আমি খুব সুখী হবো। তুমি তোমার দেশে ফিরতে চাও না, যেও না। আমি সুলতানকে বলে তোমাকে তার দরবারের উজির-এ বহাল করে দেবো। তোমাকে পেলে আমার অভাব পূরণ হবে সুলতানের। আমি দরবার থেকে অবসর নেবো। এই বুড়ো বয়সে খাটতে আর ভালো লাগে না। শেষ কটা দিন আল্লাহর নামগান করে কাটাবো, এই ইচ্ছে।

সলজ্জভাবে মাথা নত করে বসে থাকে নূর-আল-দীন। কোন কথা বলে না। বলতে লজ্জা করে। একটু পরে মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনি যা বলবেন, তাই হবে, জনাব।

উজিরের আনন্দ আর ধরে না। সাজো সাজো রব পড়ে গেলো বাহির অন্দরমহলে। আলোর মালায় সাজানো হলো সারা প্রাসাদ। প্রশস্ত প্রাসাদ কক্ষে অভ্যাগত আমিরদের বসার ব্যবস্থা করা হলো। সুগন্ধী আতরের খুশবুতে মন্দির হয়ে উঠলো সারা বাড়ি। খানাপিনার সেকি এলাহী আয়োজন।

একে এক অভ্যাগতরা আসতে লাগলো। উজিরের ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধব, সুলতানের পারিষদ বৃন্দ, শহরের গণ্যমান্য সওদাগর প্রভৃতি আরো বহু মাননীয় ব্যক্তির সমাগমে সরগরম। য় উঠলো প্রাসাদকক্ষ। সবারই সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো নূর-আল-দীনের। সবাই এক বাক্যে তারিফ করতে লাগলো। উজিরের পাত্র নির্বাচনের।

উপস্থিত অভ্যাগতরা খুব আমোদ আহ্বাদ করে খানাপিনা করলো। দামি দামি শরাব। শাস্মিকাবাব, শাহী কোপ্তা, মোঘলাই বিরিয়ানী, আলেপ্পোর মিঠাই, ইরানী হালওয়া, আপেল, আঙুর, বেদানা, পেস্তা বাদাম, আখরোট, আলুবখরা আরও হরেক রকম মুখরোচর খানাপিনা খুব তৃপ্তি করে খেলো সবাই। আন্তর গুলাবের খুশবুতে মেতে উঠলো সকলে। সব শেষে গুলাবোজল ছিটানো প্রচলিত প্রথা। এর পর আর কেউ সেখানে থাকে না। যে যার মতো বিদায় নেয়।

সবাই চলে গেলে উজির নফরদের হুকুম করলো, নূর-আল-দীনকে হামামে নিয়ে যাও।

শাদীর সময় এও এক প্রচলিত নিয়ম। হবু জামাতাকে হামামে নিয়ে গিয়ে মূল্যবান আন্তর দেওয়া জলে গোসল করাতে হয়। কন্যার পিতা তার সবচেয়ে সেরা পোশাক নিয়ে দাঁড়াবে। সেই পোশাক পরে বাইরে আসবে বর। তার জন্যে অপেক্ষমান বহু রত্নখচিত সবচেয়ে দামী খচ্চরের পিঠে চেপে শহর পরিক্রমায় বেরুবে সে। এ সবই চিরাচরিত প্রথা।

রাস্তার দু’ধারে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হতে লাগলো। উজিরের হবুজামাই শাদীর সাজে শহর পথে ঘুরবে। পথঘাট আলোর মালায়, তোরণ দ্বারে সাজানো হয়েছে। নূর-আল-দীন-এর রূপ আর তার সাজের বাহার দেখে মনে হলো, আসমানের চাঁদ বুঝি মাটিতে নেমে এসেছে। শহর পরিক্রম শেষ করে যখন ফিরে এলো নূর, উজির তখন অভ্যর্থনা করে নামিয়ে নেবার জন্য সদর দরজায় অপেক্ষা করছিলো। খচ্চর থেকে নেমে উজিরের হাতে চুম্বন করলে সে। এবং তারপর…

এই সময় শাহরাজাদ হঠাৎ চুপ করে গেলো। দেখা গেলো রজনী অতিক্রান্ত হতে চলেছে।

পরদিন রাত্ৰে।

তারপর শুনুন শাহজাদা, উজির বুকে জড়িয়ে ধরে নূরকে। বিংশ রজনীতে কাহিনী শুরু করলো শাহরাজাদ।

আল্লাহ তোমার কল্যাণ করবেন। বাবা, উজির আদর জানিয়ে বললো, যাও ওপরে যাও। তোমার বিবি তোমার প্রতীক্ষায় বসে আছে।

নূর-আল-দীন উপরে উঠে এলো। সুসজ্জিত পালঙ্কে ফুলের সজ্জা। আজ তাদের পরিণীত জীবনের প্রথম রাত্ৰি। বহু মূল্যবান রত্নালঙ্কারে অপরূপ সেজেছে তার বিবি। তার দেহের অপরূপ রূপ লাবণ্যে তা আরও মনোহর আরও সুন্দর করে মানিয়েছে। দুজনে দুজনের হৃদয়। বিনিময় করলো প্রথমে। অনেক কথা অনেক গল্প অনেক গান হলো অনেক রাত অবধি। তারপর রাত্রির দ্বিতীয় যামে দু’জনের দেহ মন প্ৰাণ দু’জনের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেলো।

পয়লা প্রহর মে সবকেই জাগে
দোসর প্রহর মে ভোগী।
তিসরা প্রহর মে তস্কর জাগে
চৌঠা প্রহর মে যোগী।।

এর চেয়ে বেশী কিছু কাম্য ছিলো না নূর-আল-দীনের।

এদিকে বড়ভাই সামস-আল-দীন সুলতানের সঙ্গে পিরামিড দেখে যখন ঘরে ফিরলো দেখে, ভাই নূর নাই। নফররা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। ওরা বললো, ছোট মালিক সুবা না হতেই হুকুম করলেন, খচ্চর-এর পিঠে জিন লাগাও। আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে দিলাম। তিনি কালিবের পথে চলে গেলেন। বললেন, বাইরের খোলা আলো হাওয়া পেলে তার বুকের জ্বালা যন্ত্রণার হয়তো উপশম হবে। এর বেশী আমরা আর কিছু জানি না, মালিক।

ভাইয়ের শোকে ভেঙে পড়লো সামস-আল-দীন। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে লাগলো। রাগের মাথায় ঐ সব কটু কথা বলে সে মহা অন্যায় করেছে। ছোটবেলা থেকেই সে শান্ত মেজাজের ছেলে। ওই সব কথায় নিশ্চয়ই খুব আঘাত পেয়েছে সে।নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ হতে লাগলো তার। যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে তাকে।

সুলতানের কাছে সব খুলে বললো সামস-আল-দীন। তিনিও ব্যথিত হলেন খুব। নানা দেশের দরবারে দূত পাঠানো হলো। সন্ধান জানার জন্য। কিন্তু সব দেশ থেকেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে দূত। না, কোথাও তার সন্ধান পাওয়া গেলো না।

কিন্তু দূতরা কেন বসরাহতে গেলো না, কেন তার খোঁজ করলো না সেখানে সে প্রশ্ন কারুর মনে জাগলো না। সামস-আল-দীন বুক চাপড়াতে লাগলো। শুধু আমার নিজের দোষে ভাইকে হারালাম আমি। তাকে দেশান্তরী করলাম? তার মনে দুঃখ দিয়েছি—আঘাত করেছি। সে আঘাত ভাই আমার সহ্য করতে পারেনি।

পুত্র বিয়োগের শোকও একদিন থিতিয়ে আসে। সেইরূপ সামস-আল-দীনও একদিন শোকতাপ অন্তরের এককোণে সরিয়ে রেখে আবার হেসে গেয়ে দিন কাটাতে লাগলো। কইরোর এক সম্ভ্রান্ত সওদাগরের সুন্দরী কন্যাকে শাদী করে সংসারী হলো।

যোগাযোগই বলা যায়, তা না হলে একই দিনে-যেদিন ছোট ভাইয়ের শাদী সেদিনই তারও শাদী হয় কী করে! এবং শাদীর প্রথম রাতে দুজনের বিবিই অন্তঃসত্ত্বা হলো। এও কি যোগাযোগ?

এদিকে শাদীর সব পর্ব শেষ হয়ে গেলে উজির একদিন সুলতান সমীপে হাজির হলেন জামাতা নূর-আল-দীনকে সঙ্গে নিয়ে। যুবকের রূপে মুগ্ধ হলো সুলতান। দু-হাত মাটিতে ছুঁইয়ে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানালো নূর। উদাত্ত কণ্ঠে সুন্দর করে আবৃত্তি করলো একটা শায়ের।

সবই ভালো লগে তার,
মনে হয় সবই অপরূপ।
হৃদয় মথিত করে,
জ্বলে উঠে কামনার ধূপ।
আমার এ তরুমূলে
সিঞ্চন করে সে বারী।
স্বৰ্গসুখে তৃপ্ত হই,
আমি সেই নারী।।

সুলতান মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে নূর এর দিকে। কি সুন্দর রূপ! আর কী অপরূপ তার বাচনভঙ্গী। উজির এগিয়ে এসে বলে, আমার জামাতা। রূপে গুণে সেরা ছেলে।

সুলতান আরও খুশি হয়।–কিন্তু উজির, এ যুবক তোমার জামাতা না হলেও আমি তাকে সমোনই আদর করতাম। ওকে আমার পাশে বসিয়ে দেওয়ানের কাজকর্ম বুঝিয়ে দাও! তুমি বয়সে ও জ্ঞানে অনেক বৃদ্ধ। তোমার যোগ্য সম্মান দিতে গেলে তোমার সহকারী হিসাবেই তাকে স্থান দেওয়া দরকার। তা না হলে ওকে আমি আজ থেকেই উজিরের পদে বহাল করতাম। তুমি যতদিন আছো, তুমিই উজির থাকবে। তোমার পর ওকে আমি উজির করবো।

একথা শুনে উজিরের মনে আহ্বাদ হলো।

সুলতান এই নবাগত যুবককে দেওয়ানের পদে বহাল করে নানারকম দামী দামী সাজপোশাক, এক হাজার সূক্ষ কারুকর্মের যোগ্য সূচ, দামী দামী সেরা খচ্চর এবং প্রচুর দাসদাসী ও নাফর উপটৌকন দিলো।

এর কিছুদিন পরে নূরের এক পুত্র সন্তান হয়। ঠিক সেইদিনই কায়রোতে তার দাদার এক পরমা সুন্দরী কন্যা জন্ম গ্রহণ করে। নূর তার ছেলের নাম রাখলে হাসান বদর-আল-দীন। তার রূপের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য কারো নাই। বেহেস্তে হয় কিনা জানা নাই, ধরায় এরূপ কেউ প্রত্যক্ষ করেনি।

হাসলে পরে মুক্ত ঝরে
কান্নাতে তার পান্না।
এমন ছেলে কোথায় পেলে,
ও বিবিজান, বলো না।

নূর-আল-দীন নিয়মিত দরবারে যায়। তার কাজে মুগ্ধ হয় সুলতান। বাসরাহ শহরের পরিচালন ভার দেওয়া হলো তাকে। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সব সমস্যার সমাধান করে দেয় নূর। এমন একজন দেওয়ান পেয়ে গর্ব হয় সুলতানের। নূরের মর্যাদা আরও বেড়ে যায় দরবারে। শুধু তার বেতনই বাড়ে না, সেই সঙ্গে তার সৈন্যসামন্ত, লোকলস্কর, নফর চাকর, ক্রীতদাসের সংখ্যাও অনেক বাড়িয়ে দেয় সুলতান। নুর আসার পর থেকে খাজনা আদায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এর পর থেকে সবচেয়ে দুরূহ সমস্যাগুলো সমাধানের ভার পড়ে তার উপর। শহরবাসীরাও খুব খুশি। নূর আসার পর সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্যে রাস্তাঘাট সংস্কার করা হয়। জল সরবরাহ, নতুন নতুন বাসগৃহ নিৰ্মাণ অনেক বেড়ে যায়। আরও বেশী লোকের রুজি রোজগারের জন্য ক্ষেত-খামার, জাহাজ নির্মাণ, বাঁধ, সড়ক তৈরি করে দেয় সে।

হাসান-বদর-আল-দীনের বয়স যখন চার বছর সেই সময় উজির দেহ-রক্ষা করে। যথাযোগ্য মর্যাদায় তার শোক পালন করে নূর। এবার সে দরবারে উজিরের আসন পায়।

হাসানের লেখাপড়া শিক্ষাদীক্ষার দিকে প্রখর দৃষ্টি দিতে থাকে নূর। মাদ্রাসার প্রধান মৌলভীকে শিক্ষক নিযুক্ত করে। বৃদ্ধ মৌলভী প্রতিদিন এসে হাসানকে পড়াতে লাগলো। দিনে দিনে বড় হতে থাকে হাসান। ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলায় সেরা ছাত্র হয়ে ওঠে সে। হাসানের বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ মৌলভী সাহেব। গর্বোবুক ফুলে ওঠে নুর-এর। মনে হয়, বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে সে।

হাসানের বয়স যখন পনেরো তখন মৌলভী সাহেব বললেন, সারা জীবন ধরে আমি যে বিদ্যা আহরণ করেছি। তার সবই তোমার পুত্র শিখে নিয়েছে মাত্র এই বারো বছর বয়সে। আমার আর কিছু শেখাবার নাই, বাবা।

নূর খুশি হয়ে মূল্যবান সাজপোশাক, এক হাজার সোনার মোহর এবং সবেচেয়ে সেরা একটা খচ্চর উপহার দিলো মৌলভীকে। হাসানকে সঙ্গে নিয়ে সুলতানের দরবারে যাওয়ার পথে হাজার হাজার নারীপুরুষ হাসানের রূপের হাট অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো আর বললো, বাপ কা বেটা। এই প্রথম সে ঘর ছেড়ে শহরের পথে বেরিয়েছে। এতোদিন ছেলেকে প্রাসাদের বাইরে কখনও যেতে দেয়নি নূর।

হাসানকে দেখে সুলতান বিস্মিত হয়। একদিন সে নুরকে দেখে বলেছিলো, এতে রূপ ধরায় হয় না। কিন্তু আজ তার ছেলের রূপ দেখে মুখে কোনও ভাষা জোগালো না। শুধু মুগ্ধ নয়নে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো তার মুখের দিকে। একটুক্ষণ পরে শুধু বলতে পারলো, তোমার মতো নসীব আমার যদি হতো, উজির.প্রথম দর্শনেই তোমার ছেলের প্রেমে পড়ে গেলাম। আর তো ওকে না দেখে থাকতে পারবো না। রোজ তুমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আমার হুকুম। বুঝলে উজির।

নূর আর কি বলবে।-জো হুকুম জাঁহাপনা।

প্রতিদিন হাসান বাবার সঙ্গে দরবারে যায়। সুলতান আদর করে সারাক্ষণ তার পাশে বসিয়ে রাখে। এইভাবে সুলতানের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। শুধু সুলতানের নয়, সারা দরবারের আমির ওমরাহ-সবারই পরম প্রিয়পাত্র হয়ে পড়ে সে।

এইভাবে সুখের সমুদ্রে সাঁতার কেটে দিন গড়িয়ে চলছিলো। হঠাৎ একদিন নূর-আল-দীন অসুখে পড়লো। কঠিন অসুখ। অনেক বড় বড় হেকিম ডাকা হলো। অনেক দাওয়াই দিলো তারা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে হেকিমরা জবাব দিয়ে গেলো। তাদের বিদ্যায়। আর কিছু করার নাই। এবার আল্লাহ ভরসা।

পুত্র হাসানকে কাছে ডেকে নূর বললো, বাবা, আমার ডাক এসেছে। যেতে হবে। তোমরা অবশ্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করলে-যদি আরও কিছু কাল ধরে রাখা যায়। কিন্তু তা হয় না। আমি যে কদিনের জন্য তাঁর কাছ থেকে ছুটি করে এসেছিলাম তোমাদের এই হাসি-খেলায়, তা আমার ফুরিয়ে এলো। এবার যেতে হবে। আমরা মায়াবদ্ধ প্রাণী। এ সংসারে এসে ভাবি এই আমাদের চিরকালের আবাসস্থল। কিন্তু তা তো একদম ভুল, বাপজান। পথ চলতে চলতে সরাইখানায় যেমন দু’টো দিন কাটিয়ে যাই, এও তো তেমনি। আসল ঠিকানায় তো সবাইকে একদিন পৌঁছতে হবে। সেখানে পৌঁছে গেলে আর কোন দুঃখ তাপ কিছুই থাকে না। শোকতাপ দুঃখ-দুৰ্দশা যা পাওয়ার তা এ সংসারেই পাবে। তার কাছে পৌঁছতে পারলে খালি সুখ আর সুখ। নূর-আল-দীন চুপ করলো। একটানা অনেক কথা বলে ফেলেছে। দুর্বল শরীরে হাঁপ ধরে যায়। একটু পরে আবার বললো, বাবা, আমার যা করার ছিলো সবই প্রায় নিখুঁতভাবে আমি সমাধা করেছি। শুধু একটি কাজ বাকি রয়ে গেলো। তোমাকে তার ভার দিয়ে যাচ্ছি, তুমি আমার হয়ে সেটুকু করে নিও। খুব ভালো করে মন দিয়ে শোনো। কাইরোতে আমার বড়ভাই সামস-আল-দীন সেখানকার সুলতানের উজির। আমিও সেখানকার আর এক উজির ছিলাম। কিন্তু তুচ্ছ একটা কারণে দাদার সঙ্গে আমার একদিন কলহ বাধে। আমি রাগ করে দেশত্যাগ করে এই বসরা হতে চলে আসি।

নূর একটু দম নেবার জন্য থামলো। হাসানকে বললো, কাগজ কলম নিয়ে এসো।

হাসান একটা সোনার দোয়াত কলম আর তুলেটি কাগজ নিয়ে এসে বসলো। নূর যা বলে গেলো হুবহু লিখে নিলো হাসান। বসরাহতে কবে সে এসেছিলো, কবে তার শাদী হয়েছিলো, সুলতানের দরবারে উজিরের পদ, হাসানের জন্ম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী সন তারিখ সহ বিস্তারিত বিবরণ লিখে নিলো সে। তারপর নূর বলতে লাগলো তার বংশ পরিচয়। তার বাবার তরফ আর মায়ের তরফ। তাদের শাখা প্রশাখা-যে যেখানে থাকে সব ঠিকানাপত্র। তারপর বললো, ভালো করে কাগজখানা রেখে দিও। সময়ে কাজে দেবে। আমার মৃত্যুর পর তুমি তোমার স্বদেশ কইরোতে যেও একবার। আমার বড়ভাই তোমার চাচা ওখানকার উজির। তার সঙ্গে দেখা করে বলবে, এ জীবনে তার সঙ্গে আর দেখা হলো না। আমার! আমাকে যেন মাফ করে সে।

নূর-আল-দীনের গাল বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কাগজখানা পড়ে শোনায় হাসান। নুর ঘাড় নেড়ে জানালো ঠিক আছে। বাবার মোহর একে দিলো কাগজটার ওপর। তারপর ভাঁজ করে একখানা মোমকরা কাপড়ে জড়িয়ে বাধলো। এইভাবে রাখলে নষ্ট হবে না। সহজে। বাইরের সাঁতসেতে হাওয়া ঢুকতে পারবে না। এবার কাপড়ে জড়ানো কাগজখানা তার পাতলুনের কোমরবন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে সূচী সুতো দিয়ে সেলাই করে দিলো। আর হারাবার ভয় থাকলো না।

এরপর একটা দিন মাত্র বেঁচে ছিলো সে। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সারা শহর ভেঙে পড়লো। হাজার হাজার নরনারী কালো পোশাক পরে শোকমিছিলে সামিল হলো। সুলতান শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লো। তার ডান হাতখানা আজ চলে গেলো।

যথাযোগ্য শাহী মর্যাদায় সমাহিত করা হলো তাকে। হাসান আজ পিতৃহারা। শোকের সায়রে ভাসতে থাকে। দু’নিয়নে জলের ধারা। বাবার সেই কথাগুলো মনে করে নিজেকে কিছুটা সাত্মনা দিতে পারে। এ দুনিয়াটা পান্থশালা, দুদিনের জন্যে আসা এখানে। সবাইকেই তো একদিন সব ফেলে চলে যেতে হবে।

দু’মাসব্যাপী মৌন হয়ে শোক পালন করলো হাসান। তারপরও সে বড় একটা করে সঙ্গে কথা বলে না। বাবার শোকে সে মূহ্যমান। সুলতান তাকে খবর পাঠালো। তার দরবারে উজির করবে তাকে। কিন্তু হাসানের কোন হাঁশ নাই। ঘর ছেড়ে বেরোয় না। সে; নাওয়া খাওয়া একরকম বন্ধ করে দিয়েছে। দিনে দিনে শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গেলো তার শরীর। সুলতান বারবার লোক পাঠায়। কিন্তু হাসান গেলো না। তার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘোরাফেরা করে। তাকে যেতে হবে কাইরো। তার বাবার শেষ আদেশ।

সুলতান কুপিত হলো।—কী ওর এতো বড় স্পর্ধা! আমার হুকুম অমান্য করে সে। ধরে বেঁধে নিয়ে এসো তাকে। আমি তাকে শায়েস্তা করবো।

সুলতানের পরোয়ানা নিয়ে ছুটলো সিপাই বরকন্দাজ। শহরবাসীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। সর্বনাশ! না জানি, কী সাজা দেবে তাকে সুলতান। হাসানের এক বিশ্বস্ত নফর এসে খবর দিলো, শিগ্‌গির পালিয়ে যান হুজুর। সুলতান ক্ষেপে গেছে। আপনাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। এখুনি পাইক বীরকন্দাজ এসে পড়বে।

হাসানের চৈতন্য হয়। তাই তো, সুলতানের আদেশ অমান্য করেছে সে। তার পরিণাম তো মারাত্মক। হয়তো তার গর্দান যাবে। সুলতান ভেবেছে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করে তার ডাকে সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু কী করে বোঝাবে সে, তার বাবার মৃত্যু কত বড় শেল হেনেছে তার বুকে।

হাসান বললো, আমাকে কিছু টাকাকডি দাও, জলদি করে।

নফর বললো, টাকা পয়সা বের করার সময় নাই। আপনি আর এক পলক দেরি করবেন না, হুজুর। বেরিয়ে যান। এখান থেকে। না হলে জানে বাঁচবেন না। সুলতানের লোক এসে পড়বে এখুনি। আপনাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে। আপনার ঘরবাড়ি বিষয় আশয় সব বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে সে। আপনি পালান।

হাসান কি করবে বুঝতে পারে না। এক মুহূর্ত। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। নিজের গায়ের দামী শালখানা ফেলে দিয়ে নফরের কাঁধের ময়লা চাঁদরখানা টেনে নিয়ে মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে সারা দেহটা ঢেকে নিলো। আপাতভাবে দেখে মনে হয়, কোন দীন ভিখারী। খিড়কীর দরজা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো।

প্রথমে ঠিক করলো বাবার গোরস্তানে গিয়ে আজকে রাতের মতো আশ্রয় নেবে সেখানে। তারপর কাল সকালে ভাববে কী করে কইরোর পথে রওনা হওয়া যায়।

বাবার কবরের পাশে বসে ভাবছে এমন সময় সেখানে এলো এক জু। বসরোহর নামকরা ধনী সওদাগর। এক অদ্ভুত হাসিতে নেচে উঠলো তার চোখ —হুজুর এখানে? আহা কী দশা হয়েছে আপনার। একেবারে চেনা যায় না। তা সবই ভাগ্যের খেলা। আজ যে উজির কাল সে ফকির এই তো মালিকের খেলা।

হাসান সত্য গোপন করে বানিয়ে বললো, আজ দুপুরে আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, বাবা বলছেন, আমার কবরের পাশে যাস। তোকে একটা কথা বলবো। তাই এসে বসে আছি এখানে।

জু বললো, আপনার বাবা বড় সজ্জন ছিলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেক দিন ধরে আপনাকে একটা ব্যবসার কথা বলবো বলবো করেও বলার সময়-সুযোগ পাইনি। আপনি তো জানেন, আপনার বাবার বড় জাহাজের কারবার আছে। আপনার বাবার কাছ থেকে একখানা জাহাজ কিনবো এইরকম একটা কথাবার্তা আমার হয়েছিলো এক সময়। কিন্তু তারপরই তিনি অসুখে পড়লেন। ব্যাপারটা ওখানেই থেমে গেলো। এখন আপনি যদি ইচ্ছা করেন, আমাকে বিক্রী করতে পারেন একখানা জাহাজ। আমি আপনাকে এক হাজার দিনার দাম দিচ্ছি।

সওদাগরের কথায় না করতে পারলো না হাসান এক এক করে এক হাজার দিনার গুণে দিলো সওদাগর। তার সঙ্গে একটা সাদা কাগজ আর কলম তুলে দিলো হাসানের হাতে। বললো, নামকে ওয়াস্তে একটা রসিদ করে দিন হুজুর।

হাসান লিখে দিলে : আমি মৃত উজির নূর-আল-দীনের একমাত্র পুত্র হাসান বদর-আল-দীন আপনার নিকট হইতে এক সহস্ব দিনার গ্রহণ করিয়া আমার পিতার (বর্তমানে আমার) একখানি সওদাগরী জাহাজ বিক্রয় করিলাম। বন্দরে প্রথম যে জাহাজ নোঙর করিবে সেই জাহাজই আপনি পাইবেন।

নাম স্বাক্ষর করে জুয়ের হাতে তুলে দিলো হাসান। ‘হুজুরের অশেষ কৃপা—হুজুর আমার মা-বাপ।’ এইরকম অনেক সৌজন্য দেখিয়ে বিদায় নিলো সে। বাবার সমাধির পাশে বিষণ্ণ মনে বসে রইলো সে। রাত্ৰি গম্ভীর হতে হতে গভীরতর হয়। এক সময় ঘুমে ঢুলে পড়ে সে।

চাঁদ তখন মাথার ওপরে। হাসানের সারা দেহে চাঁদের আলোর লুটোপুটি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। দিনের বেলার আতঙ্কভােব আর নাই। এক অপরূপ প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। সারা মুখে।

এই গভীর রাতে গোরস্তানে আসে অশরীরী আত্মারা, জীন, পরীরা। এক খুবসুরৎ জিনিয়াহ তখন আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো। চাঁদের আলোয় হাসানের সুন্দর চেহারা দেখে সে নেমে আসে। এমন রূপবান যুবক সে তো কখনও দেখেনি। কে সে? এলো কোথা থেকে? আল্লাহ তাকে কি দিয়ে গড়েছেন? প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেলে সে। জিনিয়াহ ভাবে, গায়ের রঙ তার কালো হলে কি হয়, মুখের চেহারা কি তার খারাপ? ছেলেটা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। এখন ওর ঘুম ভাঙাবো না, বরং আকাশের নীলিমায় একটা চক্কর দিয়ে আসা যাক।

আবার শোঁ শোঁ করে অনেক উপরে উঠে যায় জিনিয়াহ। একেবারে মেঘের মেলায়। ওখানে দেখা হয়ে গেলো এক চেনাজানা জিনের সঙ্গে। দুজনেই দুজনকে হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। জিনিয়াহ, জিজ্ঞেস করে কোথা থেকে আসছে ভাই?

জিনি বলে কইরো। সোজা কইরো থেকে আসছি।

—ওখানকার খবর কী? আমাদের জাতভাইবোনেরা কেমন আছে সব?

–ভালো। সবাই বেশ ভালো আছে, বোন। তোমার খবর কী?

—চলছে ভালোই। চলো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। নিচে একটা গোরস্তানে একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে ঘুমুচ্ছে। তুমি দেখলে তাজ্জব বনে যাবে। অমন রূপের বাহার আমি কখনো দেখিনি, ভাই।

জিনি বললো, চলো তো দেখি।

ওরা দুজনে নেমে নিলো নিচে। গোরস্তানের ওপরে। সত্যিই অবাক করার মতো চেহারা বটে। জিনি বললো, লোকে বলে, তামাম দুনিয়ায় নাকি উজির নূর-আল-দীন-এর ছেলে হাসানের মতো রূপ আর কারো নাই। কিন্তু এ ছেলের রূপই বা কম কিসে? আমি কইরোর উজির সামস-আল-দীনের মেয়েকে দেখেছি। অমন হুরীর মতো রূপ কোন মেয়ের হয় না। একমাত্র সেই মেয়ের সঙ্গেই মানায় একে।

জিনিয়াহ বললো, আমি তাকে দেখিনি কখনও।

—তাহলে শোনো, জিনি বললো, সেই হতভাগ্য মেয়েটার কাহিনী শোনাই তোমাকে। সামস-আল-দীনের মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে সুলতান একদিন প্রস্তাব করলো, দেখো উজির, তোমার মেয়ে রূপেগুণে সেরা হয়ে উঠেছে। আমি ইচ্ছা করি তুমি আমার সঙ্গেশাদী দাও তোমার মেয়ের।

সুলতানের কথায় আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়।—জাঁহাপনা, অধমের গোস্তাকি মাফ করবেন। আপনি তো জানেন, আপনাকে অনেক আগেই বলেছি, আমার ছোটভাই দেশত্যাগী হয়েছে। এবং কী কারণে হয়েছে তাও আপনাকে বলেছি। আমাদের কথা ছিলো, আমার মেয়ে আর তার ছেলে হলে দুজনের শাদী দিয়ে দেবো। আল্লার দয়ায় তাইই হয়েছে। নূরের ছেলে এখন বসরাহতে বড় হচ্ছে। আমার ভাই সম্প্রতি দেহ রেখেছে। এখন আমি ঠিক করেছি তাকে এনে আমার মেয়ের সঙ্গে শাদী দিয়ে দেবো। এ যদি না করি আমার ছোটভাই বেহেস্তে গিয়েও শান্তি পাবে না। আপনি, হুজুর খুঁজলে এই মিশরে আরো অনেক খুবসুরৎ লেড়কী পাবেন! এবং আপনি চাইলে যে কোন মেয়েই বর্তে যাবে। শুধু এইটুকু অনুগ্রহ আমাকে করুন, আমার সত্যরক্ষা করতে দিন আমাকে।

কিন্তু সুলতান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। কী এইভাবে অপমান? আমাকে প্রত্যাখ্যান? এতো বড় স্পর্ধা! দাড়াও মজা দেখাচ্ছি! আমি সুলতান হয়ে তোমার কাছে হাত পাতলাম। কোথায় তুমি ধন্য হবে তা না, আমাকে অবজ্ঞা করলে? আমাকে তুমি মেয়ে দেবে না, ঠিকই করে রেখেছে। খালি ফালতু বাহানা দেখাচ্ছে। দাঁড়াও মজা টের পাইয়ে দিচ্ছি। আমার ঘোড়ােশালে একটা কুঁজো বামন আছে। সহিসের জোগানদার। বান্দরের বাচ্চার মতো। ওর মুখ, পায়রার মতো ওর বুক। খুব মানাবে ভালো তোমার মেয়ের সঙ্গে। আজ রাতেই শাদীর সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি। ঐ বাঁদর মুখো কুঁজোটার সঙ্গে তোমার মেয়ের শাদী হবে।–আমার হুকুম। সারা দেশে ঢ্যাড়া পিটে দাও। ঢাক ঢোল, সানাই বাজিয়ে কুঁজে যাবে শাদী করতে। তাকে সাজানো হবে জাঁকজমক করে। যত টাকা লাগে দেবো আমি। কোনো চিন্তা নাই। আজকের দিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলো, উজির। যতো ভালো পাত্বই তোমার হাতে থাক তাদের কারো সঙ্গে শাদী দিতে পারবে না। আমার পছন্দ করা পাত্বকেই তোমার জামাই করতে হবে। আজ রাতে তোমার মেয়েকে নিয়ে মধুযামিনী করবে ঐ কুঁজোটা। এই তোমার সাজা।

আমি যখন কায়রো ছেড়ে আসি সে সময়ে দেখলাম, দাসদাসী নফর। চাকরীরা ঐ বাঁদর মুখো কুঁজোটাকে ঘিরে খুব হাসি মাস্করা করছে। শাদীর দিনের লোকাচার, কাম কাজ শুরু হয়ে গেছে তখন। দল বেঁধে মেয়েরা সুর করে শাদীর গান করছে, দেখে এলাম। কুঁজোটাকে ধরে বেঁধে একটা চৌবাচ্চার খুশবু গোলা পানিতে ডোবাচ্ছে আর তুলছে। ঠাট্টা মজাক-এ মশগুল হয়ে গেছে দাসদাসীরা। এমন কাণ্ড তো তারা কখনও দেখেনি জীবনে। সত্যি বলতে কি বোন, লোকটাকে দেখলাম, আমন কদাকার কুৎসিৎ মানুষ আমি কখনো দেখিনি। জানোয়ারও ওর চেয়ে দেখতে ভালো হয়।

দাঁত মুখ সিটিকে বিকট মুখভঙ্গী করে সেই কুঁজোটার কদাকার চেহারার একটা ছবি ফোটাবার চেষ্টা করে জিনি।

দুঃখ করে আবার বলতে থাকে, আহা, বেচারী! অমন খুবসুরৎ লেড়কী, তার কী নসীবা! আমার মনে হয়, সামস-আল-দীনের মেয়ে সিৎ-অল-হুসন তোমার এই মন ভোলানো ছেলেটার চাইতেও সুন্দর। শাদীর সাজে সাজানো হয়েছে তাকে অপরূপ করে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার গাল। সুরমা কাজল ধুয়ে গেছে। প্রাসাদের মাঝখানের বড় ঘরে বসানো হয়েছে তাকে। তার চারপাশে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে-গান বাজনা হৈ হল্লা হাসি মাসকরায় মত্ত হয়ে গেছে। একটু পরেই ঐ বাঁদর মুখো কুঁজোটা বর সেজে আসছে। সবাই তার অপেক্ষায় আছে।

এই সময় শাহরাজাদ দেখলো রাত্রি প্রভাত হতে চলেছে। বলা থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

 

একুশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়। শাহরাজাদ বলে, তারপর শুনুন শাহজাদা, সেই জিনিয়াহ বললো, তুমি কিন্তু বাড়িয়ে বলছে ভাই। এই ছেলের মতে রূপ সারা দুনিয়ায় কারো নাই। আমি ভাবতেই পারছি না, তোমার সেই সিৎ-অল-হুসেন এর চেয়ে সুন্দর কি করে হতে পারে। অসম্ভব।

আফ্রিদি বললো, তুমি বিশ্বাস করো, বোন। আমি এতোটুকু বাড়িয়ে বলছি না। সত্যি, তার মতো রূপসী যুবতী হয় না। বিশ্বাস না হয়, চলো, নিজের চোখেই দেখবে। আর যেতেও হবে আমাকে। আমি বেরিয়েছি তার উপযুক্ত একটা পাত্রের সন্ধানে। তা তোমার ছেলেটার সঙ্গে মানাবে ভালো। একেবারে শাহী জুটি। ওই বাঁদর মুখে কুঁজোটা মেয়েটার পাপড়ীির মতো দেহটাকে ছিঁড়ে খাবে এ আমি বরদাস্ত করবো না কিছুতেই। যেমন করেই হোক শাদীর নামে এই বাঁদরামী বন্ধ করতেই হবে। চলো, আর দেরি না, এই ছেলেটাকে নিয়ে এখুনি আমরা উড়ে যাই কায়রো।

জিনিয়াহ বললো, হ্যাঁ তাই চলো, বান্দরের বাচ্চাটা মেয়েটার শয্যাসঙ্গী হবে এ কিছুতেই হতে পারে না।

অকাতর ঘুমে আচ্ছন্ন হাসানের দেহটাকে সন্তৰ্পণে নিজের পিঠে তুলে নিলো আফ্রিদি। জিনিয়াহকে বললো, তুমি আমার পাশে পাশে থাকে।

প্রায় উল্কার গতিতে শোঁ শোঁ করে ছুটে চললো তারা। অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে নামলো কায়রো শহরের এক প্রান্তে। কাছেই উজিরের প্রাসাদ। আলোর মালায় সাজানো হয়েছে চমৎকার করে। সদরে বসানো হয়েছে নহবৎ। সানাই-এ বাজছে বেহাগ। নিমন্ত্রিত অভ্যাগতরা মোমবাতি হাতে চলেছে দলে দলে। রাস্তার পাশে একটা পাথরে-তৈরি চকুতরার উপরে ওরা শুইয়ে দিলো হাসানকে। এবার তার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে দেখে, অচেনা জায়গা। সে তো শুয়েছিলো তার বাবার গোরস্তানে বসরা হয়। কিন্তু এতো একটা অজানা অচেনা শহরের রাস্তার চবুতরা। অবাক হয়ে উঠে বসে সে। আরও অবাক হয় বিশালাকৃতির দাঁড়িগোঁফহীন একটা মানুষকে দেখে। ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে-মুখে তর্জনী চেপে কোন কথা না বলতে ইশারা করছে।

হাসান ভয়ে চুপ করে থাকে।

সেই বিরাট মানুষটা ওর হাতে ধরিয়ে দেয় একটা জ্বালানো মোমবাতি।–ধরো, এই বাতিটা নিয়ে ঐ নিমন্ত্রিতদের ভিড়ে মিশে যাও। তুমি অবাক হয়ে ভাবছো, আমি কে? আমি হচ্ছি এক জীন। আল্লাহ আমার একমাত্র উপাস্য। তোমার কোন ভয় নাই। আমি তোমার ভালো করার জন্যেই তোমাকে এ শহরে নিয়ে এসেছি। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে বসরোহর এক গোরস্তানে। এখন তুমি বসে আছো কায়রো শহরে। আজ রাতে এখানকার উজির সামস-আল-দীনের লেড়কীর শাদী হবে। একটা বাঁদর মুখো কুঁজের সঙ্গে। ঐ যে প্রাসাদটা দেখছো, আলোয় ঝলমল করছে, কাতারে কাতারে লোকজন যাচ্ছে মোমবাতি হাতে ওখানেই আছে সেই উজিরের মেয়ে। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে সে। যাও আর দেরি করো না। উঠে পড়ে। মোমবাতিটা হাতে ধরে মিশে যাও ভিড়ে। নহবৎখানা পেরিয়েই দেখবে বঁদিকে হামাম ঘর; ওখানে ঐ বাঁদর মুখো কুঁজোটাকে গোসল করাচ্ছে দাসদাসীরা। কুঁজোটা যখন বরের ছাঁদে সেজেগুজে এসে খচ্চর-এর পিঠে চাপবে তখন তুমি তার পুরোভাগে থাকবে। যেন সবাই মনে করে তুমিই বরকর্তা। যে সব মেয়েছেলেরা গান বাজনার মুজরো করতে এসেছে—ওরা মাঝে মাঝেই নাচ গান থামিয়ে বরের সামনে ওড়না পেতে ধরবে প্যােলা পাওয়ার জন্যে। তুমি তোমার জেবে হাত ঢোকাবে, আমার যাদুতে দেখবে, তোমার মুঠো ভরে উঠে আসবে সোনার মোহর। কোন অবাক না হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে সবটাই ছুঁড়ে দেবে ওদের দিকে। হয়তো বা দু-চারটে মাটিতেও পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তুমি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনবে না। তোমার কোন ভাবনা নাই, যতোবার দরকার জেবে হাত ঢোকালেই পেয়ে যাবে মুঠিভরা মোহর। ফুরাবে না। এইভাবে হামাম থেকে প্রাসাদের মাঝখানের বড় ঘরের দরজা অবধি মুড়িমুড়কীর মতো মোহর বিলিয়ে যাবে, যাকে তাকে। ওই বড় ঘরে শাদীর আসর। ওখানে জড়ো হয়েছে। শহরের উজির আমির ওমরাহ সওদাগরদের বিবিরা। সবাই পরে এসেছে দামী দামী সাজপোশাক, রত্ন আভরণ। সেখানে একমাত্র বর ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের প্রবেশ নিযেধ। কিন্তু তোমাকে কায়দা করে ঢুকে পড়তে হবে। এবং সেটা তোমার পক্ষে তখন আর খুব শক্ত কাজ হবে না। কারণ পয়সার প্যালা এমন একটা বস্তু যাতে সবাই থ হয়ে যাবে। তোমাকে ঘিরে ধরবে সকলে। মাথায় করে নাচতে চাইবে।

জিনি অদৃশ্য হয়ে গেলো। জ্বালানো মোমবাতিটা হাতে ধরে মিছিলে সামিল হয়ে যায় সে। বুঝতে অসুবিধা হলো না একটুও। নহবৎখানার বাঁ-পাশেই হামাম। তার চত্তরে অনেক দাসদাসী  মুজরো করা মেয়ে মানুষ। ওরা পয়সা নিয়ে নাচগান করে বেড়ায়।

হামাম থেকে বেরিয়ে এলো সেই বাঁদরমুখো কুঁজে বর। মুক্তোর মালা গলায় পরেছে। সূক্ষ্মকারুকার্য করা বহু মূল্যবান বাদশাহী পোশাকে সাজানো হয়েছে তাকে। কয়েকজন মিলে চ্যাংদোলা করে তুলে খচ্চরটার পিঠে বসিয়ে দিলো কুঁজোটাকে। এ নাচনেওয়ালীরা খ্যামটা নাচ নাচতে লাগলো। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে কাওয়ালী ধরলো কিছু মেয়ে। আর কতকগুলো বাজাতে লাগলো ঢোল নহবৎ। হাসির হুন্নোড় উঠলো প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। হাসান গিয়ে ধরলে খচ্চরের লাগাম। আগে আগে চলে সে। পিছে পিছে আসে খেমটাওয়ালীরা।

রূপবান হাসানকে দেখে সবাই মুগ্ধ হলো। মনে করলো, শাহ-পরিবারের কেউ। বরপক্ষের লোক। মেয়েগুলো মাঝে মাঝেই নাচগান থামিয়ে এগিয়ে এসে ওড়না পেতে ধরে। প্যাল চায়। বড় ঘরে বিয়ে শাদীর সময় এইরকম রেওয়াজই চালু। হাসান পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠো ভরে তুলে আনে সোনার মোহর। ছুঁড়ে দেয় একটা মেয়ের আঁচলে। আর একটি মেয়ে এগিয়ে আসে তখন। তাকেও দেয় এক মুঠো। তারপর আরও একজন। এমনিভাবে যে আসে, যে হাত পাতে তাকেই মুঠো ভরা মোহর দিতে লাগলো সে। সবাই অবাক। একেবারে আদৎ খানদানি ব্যাপার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সবারই নজর গিয়ে পড়লো হাসানের উপর। কুঁজে বরের দিকে তখন আর কেউ তাকায় না।

এইভাবে প্রাসাদের প্রধান কক্ষের দরজায় এসে পৌঁছলো তারা। এবার বর এক যাবে সেই অন্দরমহলে। সেখানে গণ্যমান্য উজির আমিরের বিবিরা ঘিরে আছে সিৎ-অল-হুসনাকে। কুঁজোটার একটা হাত ধরে প্রায় হিড় হিড় করে টেনে ভিতরে ঢুকে পড়ে হাসান। কেউ কিছু বলার বা বাধা দেবার চিন্তাই করলো না।

ভিতরে ঢুকেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় হাসানের। শহরের খানদানি পরিবারের লেড়কী বিবিরা এসে জড়ো হয়েছে সেই বিশাল কক্ষে। তাদের বাহারী সাজপোশাকের জেল্লায় সারা ঘরটা ঝকমক করছে।

একরাশ মেয়ে, তার মধ্যে ওরা দুটি মাত্র পুরুষ। মেয়েরা সবাই নাকাব নামিয়ে মুখ ঢাকিলো। প্রত্যেকে মোমবাতি হাতে, দুটি সমান্তরাল রেখায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বরকে স্বাগত জানাবার জন্য। দুই সারির মাঝখান দিয়ে হাসান কুঁজোটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বসালো শেষ প্রান্তের মঞ্চের উপরে। নিজেও বসলো তার পাশে। এবারে মেয়েরা বিবিরা নাকাবের জাফরি দিয়ে ভালো করে দেখলো দু’জনকে। হাসানের রূপের চমক দেখে চোখের পলক পড়ে না কারো। দেখে আর ভাবে, এতো সুন্দর চেহারার পুরুষ মানুষ হয় নাকি। মেয়েদের মধ্যে অস্ফুট গুঞ্জন ওঠে। সবারই ইচ্ছে হয় ছেলেটার কাছে যায়। পাশে গিয়ে বসে। একটু আদর করে। তার হাত দু’টো টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। কারও ইচ্ছে করে গলা জড়িয়ে ধরে প্ৰাণ ভরে চুমু খেতে! সবাই কেমন উষ্ণ রোমাঞ্চ অনুভব করে হাসানকে দেখে। কেউ ভাবে, যে যা বলে বলুক যে যা ভাবে ভাবুক ছুটে গিয়ে তার কোলের ওপর বসে পড়বে সে। কামনায় উদ্বেল হতে থাকে উপস্থিত মেয়ে বিবিদের দেহ মন। নিজেকে সামাল দিয়ে রাখা দায় হয়ে ওঠে। ষোল থেকে ষাট-সব মেয়ে বিবিদেরই তখন একই দশা। লাজলজার বালাই আর রইলো না। এক এক করে সবাই নাকাব মাথার ওপরে তুলে দিয়ে হাসানকে দেখতে থাকলো। নাকাব খোলার উদ্দেশ্য অন্য। মেয়েরা বিবিরা তাদের নিজেদের চেহারা হাসানকে দেখাতেই মরিয়া হয়ে তুলে দিয়েছে মুখের ঢাকনা। যদি হাসান চেয়ে দেখে, যদি তার নজরে ধরে যায় তার রূপ যৌবন—ধন্য হতে পারবে সে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ওদের। হুড় পাড় করে গিয়ে ছেকে ধরে হাসানকে। সবাই হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর চাঁদপনা মুখের দিকে। কেউ জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে থাকে। কেউ বা একটা চোখ ঈষৎ চোখ করে ইশারা করে। আবার কেউ নিজের ঠোঁটে নিজের দাঁত বসিয়ে রক্ত বের করে চোষে। আর এক রূপসী তেরছা চোখের বান মেরে বলে, তুমি কোন আশমানের চাঁদ, নাগর? কোথায় তোমার ঘর? কে বা তোমার মেহেবুবা?

হাসান বলে : যে আশমানের সিতারো তোমরা, সেই আশমানেই আমার ঘর। আর মেহেবুবা? তাকেই তো টুড়ে বেড়াতে বেরিয়েছি। তোমরা যদি কেউ রাজি হও? এ বান্দা রাজি আছে।

হাসির হুল্লোড় ওঠে। মেয়েটা গালে হাত রেখে বলে, ওমা, কী ফাজিল? শরমে মরমে মরে যাই…

খেমটাওয়ালীরা তখন মেয়ে বিবিদের কাছে হাসানের দু’হাত ভরে মোহর ছড়ানোর কথা বলতে থাকে। ওদের কথাবার্তা শুনে মেয়ে বিবিদের মনে হয়, এ তো তবে সাধারণ ঘরের ছেলে না। নবাব বাদশাহর খানদানি ঘরানা-না-হলে এমন দিলাদরিয়া শেরিফ, মেজাজ-হয় না করো। সবাই তখন হা হুতাশ করতে লাগলো, হায় আল্লাহ, এমন একটা মানানসই বর হাতের কাছে থাকতে বাঁদর মুখে ঐ কুঁজোটার সঙ্গে শাদী হবে বেহেস্তের হুরী সিৎ-অল-হুসন-র। আল্লাহ বোধ হয় দু’জনকে দুজনের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু আমাদের বাদশাহবাদ সোধেছেন। কি উপায়!

সবাই যখন হাসানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আর কুঁজোর পিণ্ডি চটকাতে ব্যস্ত সেই সময় হঠাৎ সামনের একটা দরজা খুলে গেলো। পাশের ঘর থেকে এসে দাঁড়ালো মৌলভী আর সিৎ-অল-হুসন। সঙ্গে একদঙ্গল পরিচারিকা, দাসী, খোজা। আর এলো বাজনাদাররা। কামনার হিল্লোল জাগানো, বুকে আগুন ধরানো বাজনা বাজাতে লাগলো তারা। হুসন এসে দাঁড়ালো সেই প্রশস্ত কক্ষের ঠিক মাঝখানে। চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালো সব মেয়ে বিবিরা। মনে হতে লাগলো, মেঘশূন্য নীল আকাশে লক্ষ তারার মাঝখানে এক পূৰ্ণচন্দ্রের হাট। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো এক জ্যোতির জোয়ার। তার পাশে দাঁড়িয়ে শহরের সম্ভ্রান্ত খানদানি পরিবারের পরমাসুন্দরী সব মেয়ে বিবিরা ঝরে পড়া কুসুমের পাপড়ির মতো মুহ্যমান ম্লান দেখাতে লাগলো। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তার দেহের খুশবু। মসলিনের ওড়নার নিচে যত্নে পাট করা রেশমের মতো তার ঘন চুলের অরণ্যে লুকিয়ে আছে এক মুকুলিত যৌনের যাদু। তার নিচে চাঁপার পাপড়ির মতো পেলাব কোমল মরাল গ্রীবায় পরেছে তারার মতো ছোট ছোট হিরে জহরৎ-এর এক জড়োয়া মানতাশা। টকটকে লাল সালোয়ার কামিজ পরেছে পরনে। সোনার জডিতে সূক্ষ্ম কারুকার্যকরা-নিপুণ শিল্পীর হাতে নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছে নানা ধরনের পশু পাখীর বিচিত্র ভঙ্গী। দুটো খুদে সাপ তার দুই বাহুকে আড়াই প্যাঁচ দিয়ে চেপে ধরে ফনা বাগিয়ে ধরেছে। সোনার সেই সাপ দু’টোর গায়ে চুনী পান্না বসানো। আর তাদের ফনার মাথায় জুলজুল করছে দু’টো চন্দ্রকান্তমণি। গলায় সাতনরী হার। পায়ে মল। বঁহাতের অনামিকায় ইয়া বড় হীরা বসানো ংটি। কপালে টিকলি। মাথায় সোনার টায়রা-ছন্দোবদ্ধভাবে বসানো অসংখ্য হিরে-জহিরৎ। আর তার মাঝখানে পাখীর ডিমের মতো একটা কোহিনূর। জানি না-কত লক্ষ লক্ষ দিনারের রত্নাভারণে সাজানো হয়েছে তাকে। তবু তার রূপের জেল্লার কাছে ঐ সব রত্ন আভরণ-এর চমকছটা তেমন কিছু না! কোন অলঙ্কার না পরলেও তার রূপের বাহার কি কিছু কম হতো? একদম না। সিৎ-অল-হুসন’র দেহে শোভা পেয়ে অলঙ্কার-আভরণ-ই আজ ধন্য হয়েছে।

হুসন এগিয়ে গেলো হাসানের দিকে। হাসান তখনও তেমনিভাবে বসে ছিলো মঞ্চের উপর। কুঁজোটা উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে নানা অঙ্গভঙ্গী করে ধেই ধেই নোচে কুদে স্বাগত জানাতে লাগলো হুসনকে। হুসন এক ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলো কুঁজোটাকে। হাসানের কাছে এসে দাঁড়ালো। এমন রূপের জৌলুস কোন পুরুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেনি হুসন। তার বাবার মুখে শুনেছিলো তার চাচার ছেলে হাসান নাকি দেখতে এমনি চাঁদের মতো সুন্দর। হুসন ভাবে এ সেই চাচার ছেলে হাসান না তো!

হুসনকে মুগ্ধ নয়নে হাসানের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে উপস্থিত সব মেয়ে বিবিরাফিক ফিক করে হাসতে লাগলো। হুসন ততক্ষণে হাসানের গালদু’টো দু’হাতে চেপে ধরে আবেগ উদ্বেলিত কণ্ঠে বলতে থাকে। ইয়া আল্লাহ, এই তো আমার স্বামী-আমার বুকের কলিজা-আমার মেহেবুব। তোমার পায়ে আমার হাজারো সালাম, তুমি আমাকে এর হাতে তুলে দাও। ঐ বাঁদরমুখো কুঁজোটার থাবা থেকে আমাকে মুক্ত করো খোদা।

হাসান তার জেবে হাত ঢোকালো। মুঠো মুঠো মোহর ছড়িয়ে দিলো মেজের উপর। নফর চাকর আর মুজরোওয়ালীরা হুড়োহুডি করে কুড়িয়ে নিলো-যে যতটা পেলো। সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, এই আমাদের পাত্র। [এখানে বলে রাখা দরকার নবাব বাদশাহদের শাদীর বাসরে, নফর-চাকরদের মধ্যে, পাত্র নিজে হাতে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করে থাকে।]

কুঁজোটা রাগে গর গর করতে থাকে। বাঁদরগুলো রাগলে যেমন নিজের মাথার চুল ছিড়ে, দীত মুখ খিচিয়ে, নিজের গালে নিজে থাপ্পড় মারতে থাকে, তেমনি সব হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করতে লাগলো সে। মেয়েরা হেসে লুটোপুটি হতে লাগলো। কেউ বা ওর কাছে এগিয়ে যায়। কুঁজোটা শূন্যে মুঠি ছেড়ে—ঘুসি মারার ভয় দেখায়, আরও মজা পায় মেয়েরা। নানাভাবে ক্ষেপিয়ে দিতে থাকে। একটি মেয়ে কাছে এসে বলে, আহা, তোরা হাসছিস কেন রে। দেখছিস না, আমাদের কুঁজে বোনই বিবির শোকে কাঁদছে। তা বোনাই সাহেব কী আর করবে বলে। তোমার হবু বিবি তো আশমানের চাঁদ হাতে পেয়েছে। তোমাকে তার মনে ধরবে কেন?

আহা দুঃখুকরো না বাঁদর বোনাই।
নাইবা হলো শাদী, নাইবা এলো পাশে,
নাইবা পেলে খাটে।
কিন্তু সে স্বপ্নে যাবে কোই!
ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে তাকে পাবেই।

হাসির ফোয়ারা ছোটে। একজন বলে, একটা ফিতে নিয়ে আয়তো রে, মেপে দেখি। আমাদের কুঁজে বোদরটা লম্বায় কয় ইঞ্চি। হুসনর মেহেবুব-এর চাইতে কতটা বেঁটে।

আর একটি মেয়ে বলে, ফিতে টিতের কি দরকার। মেহবুব-এর হাঁটুর চাইতেও খাটো হবে কুঁজোটা।

-লোকে বলে না-বামন হয়ে চাদে হাত। তা—এ দেখছি, তারও বাড়া। বামনতো বটেই, তারপর আবার কুঁজো-বাঁদরমুখো। বাঁদরটার কলা ছেড়ে আপেল খাওয়ার শখ হয়েছে। মারো ঝাড়ু।

এবার পাত্রীর প্রদক্ষিণ পর্ব শুরু হলো। প্রতিবার নতুন সাজে। সেজে এসে এক এক করে সাতবার সারা কক্ষটার চারপাশ-প্রদক্ষিণ করলে হুসন। প্রতিবার ঘুরে এসে দাঁড়ালো হাসানের মুখোমুখি। শাদীর প্রথা অনুসারে এইটাই প্রধান রীতি। এই সময় উপস্থিত মেয়েরা, ভালোবাসার মিলনের এবং খিস্তি খেউড়ের গান ধরে। যারা নাচে তাদেরও অঙ্গভঙ্গীতে কামকলার প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বাজনার তালে তালে রক্তে নাচন শুরু হয়। মেয়েরা জড়ােজডি কামড়া কামডি শুরু করে। তখন সবাই এক অন্য নেশায় মেতে ওঠে। কেউ শুয়ে পড়ে আর একজনকে বুকের উপরে টেনে নেয়। ঠোট-এ ঠোঁট রাখে। আর চোখ রাখে হাসানের দিকে। দেখে মনে হয়, যেন এক জোড়া মেয়ে পুরুষ মেতে উঠেছে কাম কলায়।

এ সবই লোকচার। শাদীর রাতের প্রচলিত রীতি। নানা ভাবে পাত্ব-পাত্রীকে কাম ভাবে উত্তেজিত করাই এর আসল উদ্দেশ্য।

ইতিমধ্যে পাত্রীর সাত পাক ঘোরা শেষ হয়। এক এক করে সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। শুধু থাকে হাসান, বাঁদরমুখে কুঁজে বড়, হুসন আর তার দাসী পরিচারিকোরা। তারা এবার পাত্রী নিয়ে যায় পাশের ঘরে। শাদীর সাজ পোশাক ছাড়ানো হবে তার।

বিশাল কক্ষের শাদী মঞ্চে তখনও দুটি প্রাণী বসেছিলো। একজন হাসান, আর একজন সেই বাঁদরমুখো কুঁজে পাত্র। মঞ্চের উপরে উঠে দাঁড়ালো কুঁজোঁটা। বললো, তুমি আজ আমাদের শাদীর বাসরে মেলাই আনন্দ দিয়েছে মালিক। সেজন্যে বহুত সুক্ৰিয়া। দু’হাতে অনেক মোহর ছড়িয়ে আমাকে অনেক ঋণী করেছে। তোমার এ ঋণ শোধ করতে পারবোনা আমি। যাই হোক, এবার তো আমাদের আসল কাজ-কাম আরম্ভ হবে।তা তোমাকে কি চ্যাংদোলা করে বাইরে বের করে দিয়ে আসতে হবে। যদি বলো, লোকজন ডাকি।

লোকটার কথায় হাসানের চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। কি এর উত্তর দেবে ভেবে পায় না। আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু বেরোন আর হয় না। সেই দুষ্ট আফ্রিদি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দরজা-ঘিরে।—কোথায় যাচ্ছে হাসান? দাঁড়াও, আমি যা বলি, শোনো। আমি ঐ কুঁজোটাকে এখান থেকে সরিয়ে ক্তি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি যাও পাত্রীর পালঙ্কে। তাকে বলবে, তুমিই তার কানুন সম্মত শাদী-করা স্বামী। মজা করবার জন্যে কুঁজোকে বর সাজিয়ে পাঠিয়েছিলো সুলতান। এরপর দেখো, তোমার কথায় খুশি হবে সে। তারপর তাকে নিয়ে শাদীর রাতে যা করতে হয় করবে। সে সব আর আমি তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে চাই না।

হাসান ফিরে এলো শাদীর মঞ্চে। কুঁজোটা গিয়ে ঢুকেছে পাশের ‘ছোট ঘরে।’ পায়খানা প্রস্রাব সেরে হাত মুখ ধুয়ে পাত্রীর শয্যা সঙ্গী হওয়ার বাসনায় কল ঘরে ঢুকেছে সে। জিন এক ধেড়ে ইদুরের রূপ ধরে তার এপাশ-ওপোশ কখনও বা তার পায়ের তলা দিয়ে হুটোপটি করতে থাকে। তখন সবে সে বসেছে দাস্ত করতে। ভয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ে। ইদুরটা তখন জলের নর্দমার গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে ঝিক ঝক আওয়াজ তুলতে থাকে। কুঁজেটা হিসহিস করে তাড়াতে যায়। জোরে জোরে হাততালি বাজায়। হঠাৎ একটা বিরাট কালো বিড়াল মেউ মেউ করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে। চোখ দু’টো তারার মতো জুলজুল করছে। কুঁজোটা হ্যাট হ্যাট করে তাড়া করতে থাকে বিড়ালটাকে। এমন সময় একটা জাহাবাজ কুকুর হয়ে গেলো বিড়ালটা। ঘেউঘেউ করে তেড়ে যায় ওকে। কুঁজোটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। এই, যা ভাগ, পালা, পালা এই রকম আওয়াজ করতে থাকে। একটু ক্ষণের মধ্যে কুকুরটা-গাধায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। গাধার কর্কশ ধ্বনি কানে তালা ধরিয়ে দেয়। নাক মুখ দিয়ে প্রচণ্ড বেগে হাওয়া আর থুথু ছেটাতে থাকে কুঁজোটার মুখ বরাবর। ভয়ে থর থর কাঁপতে থাকে শরীর। হাড় হাড় করে পায়খানা করে ফেলে মেজের উপর। প্রাণভয়ে পালাবার জন্যে দরজার দিকে এগোবার চেষ্টা করে। কিন্তু গাধা তখন একটা বিরাট মোষের রূপ ধরে দরজা আড়াল করে দাঁড়ায়। এই সময়ে মানুষের গলায় বলতে থাকে মোষটা –ওরে হতচ্ছাড়া নচ্ছার বাঁদর, চাঁদের মতো বিবি বাগাবার বাসনা হয়েছে তোর? তার আগে আমার-শিং-এর গুতো খেয়ে নে আগে একটা।

এই বলে তেড়ে যায় মোষটা। কুঁজোটা তখন শিউড়ে উঠে পিছে হঠতে গিয়ে হড়কে পড়ে মেজের উপর। সারা গায়ে একাকার হয়ে যায়। তার পেট ছেড়ে দেওয়া বিষ্ঠায়।

মোষটা গর্জে ওঠে, ওরে মুখপোড়া বাঁদরের বাচ্চা দুনিয়াতে তোর যোগ্য পাস্ত্রী খুঁজে পেলি না। যার তুই নফর হতে গেলে সাত জন্ম তপস্যা করতে হবে তোকে তাকে কি না তুই বিবি বানাতে চাস। বলো এমন আশা তোর হলো কি করে।–বাল-না হলে এবার তোর বিষ্ঠা তোকেই খাওয়াবো।

কুঁজোটা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে, আমার কোন দোষ নাই, বাবা। আমাকে জোর করে ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। এ সব ঝামেলায় যেতে চাইনি আমি। কিন্তু কি করবো সুলতানের হুকুম। না মানলে গর্দান যাবে যে। আর তা ছাড়া আমি তো আদপেই জানতাম না—লেড়কীটার ‘ভালোবাসা’ আছে। দোহাই মহিষ সম্রাট; তোমার চারখানা পায়ে পড়ি, আমার গোস্তাকি মাফ করে দাও। আর কখনও এমন কাজটি করবো না।

মোষ তখন বলে, তা হলে আল্লাহর নামে হলফ করে বল-আমি যা বলবো তা শুনবি।

–তার নামে হলফ করে বলছি যা বলবে, তাই করবো।

–তা হলে শোন, সকাল না হওয়া পর্যন্ত এইখানে ঠিক যেমনি ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস তেমনি দাঁড়িয়ে থাকবি। এক পা যদি নডিস বা শাদীর বাসর ঘরে উকি ঝুকি মারিস, তোকে আর আস্ত রাখবো না। একটা গাড়ায় মাথা গুডিয়ে ছাতু করে দেবো। আর এই সব ব্যাপারে কারো সামনে যদি মুখ খুলিস, কাউকে যদি একটা কথাও বলিস তা হলে প্রাসাদের গম্বুজের উপর থেকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দেবো! তুমি ভেবো না। আমি কিছু জানতে পারবো না। যত লুকিয়ে ছুপিয়ে বলো আমি সব টের পাবো। আর একটা কথা এর পরে কখনও যদি দেখি তুই এই প্রাসাদ মুখো হয়েছিস তা হলে রাস্তার পাশের ঐ বড় নর্দমায় ডুবিয়ে মেরে ফেলবো তোকে। যা বললাম সব ঠিক ঠিক মনে থাকবে?

কুঁজোটা সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নেড়ে বললো, যে আজ্ঞে, তা আর মনে থাকবে না!

মোষটা বললো, ওদিকে দেওয়ালের দিকে মুখ করে নর্দমার গর্তের মধ্যে একটা পা ঢুকিয়ে দাঁড়া—। ওই ভাবে বাকী রাত দাঁড়িয়ে থাকবি। সূর্য ওঠা পর্যন্ত। একটু নড়া চড়া করেছিস কি মরেছিস।

—না-না; তা করবো কেন? এই আমি গর্তের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দাঁড়ালাম।

তখন মোষটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। কুঁজোটা ঐ ভাবেই ছোট ঘরে গর্তের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চলুন আমরা এবারে যাই হাসান বদর-আল দীনের কাছে।

এতক্ষণ হাসান একা একা বসে সিৎ-অল-হুসনর দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো। বুড়ি ধাই হুসনাকে সঙ্গে করে দরজার কাছে ডাকলো, কই গো কুঁজে বড় এদিকে এসো! তোমার সোহাগের বিবিজানকে কোলে করে তুলে নিয়ে যাও পালঙ্কে। আল্লাহ তোমাদের সুখে রাখুন। বাছা।

হুসন-এর বুক দুর দূর করে ওঠে। নিজে নিজেই বলতে থাকে, ওই খুদে বামন কুঁজো বাঁদরটাকে নিয়ে শোবার আগে যেন মৃত্যু হয় আল্লাহ!

কিন্তু দু-পা এগিয়ে আসতেই হাসানকে দেখতে পেয়ে আনন্দে দিশাহারা হয়ে পড়ে সে। —প্রিয়তম আমার সোনা, তুমি? তুমি একা বসে আছো আমার জন্যে? আমি ভেবেছিলাম। ওই কুঁজোটার সঙ্গে হয়তো বা একটু ভাগ নেবে। আমার দেহটার।

—ছিঃ আমন কথা ভাবলে কি করে বিবিজান?

আগাগোড়া ব্যাপারটাই একটা মজার। আর তা ছাড়া কুঁজে। বামনটাকে আনার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিলো। শয়তানের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করা; জানোতো প্রবাদ আছে বামন আর কুঁজে থাকলে—শয়তান আসতে পারে না। তোমার বাবা দশ দিনার দিয়ে ভাড়া করে এনেছিলো ওটাকে। সে এখন তার আস্তানায় আবার ফিরে গেছে।

হুসন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। হাসানের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করলে সে। হেসে গলা জড়িয়ে ধরে সোহাগ চাইলো। — সোনা আমাকে ধরো, আদর করো, আমাকে তোমার কোলে বসিয়ে নাও। আমার এই সতের বছরের যৌবন আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম। শুধুমাত্র একখানা শালে ঢাকা ছিলো তার দেহ। হাসানের ধমনীতে রক্তের প্রবাহ দ্রুত হতে দ্রুততর হতে লাগলো। ক্ষিপ্র হাতে পাতলুনটা খুলে ছুঁড়ে দিলো ডিভান-এর উপর। টাকা পয়সার বটুয়াটা রাখলে চেয়ারে, আর সেটা চাপা দিয়ে দিলো সোনার কাজ করা মাথার টুপিটা দিয়ে। শোবার সময় পরার জন্যে একটা সাদা মাঠা কাপড়ের টুপি তুলে নিয়ে মাথায় পরলো। টুপিটা পরার কথা ছিলো কুঁজোটার। কিন্তু তার নসিবে নাই, কি হবে। খালি ইজেরটা সোনার রশি দিয়ে বেশ আঁটো করে কোমরে বাঁধা। হুসন হাঁটু গেড়ে ওর কোমরের সোনার রশিটা ধরে এমন জোরে এক হাঁচকাটান মারলো যে পটাং করে ছিঁড়ে গেলো! আর সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেলো। সে মখমলের শয্যার উপর। হো হো করে হেসে উঠলো হাসান। হাসির তুফান তুললে হুসন-ও। সেই তুফানের সমুদ্রে ওরা কে যে কোথায় তলিয়ে গেলো তার কোন হদিশ পাওয়া গেলো না।

যখন শান্ত অবসন্ন। অথচ প্রসন্ন হয়ে ঢলে পড়লো দুজনে তখন হাসান শুধু বলতে পারলো, বুঝলাম, আমিই তোমার জীবনে প্রথম পুরুষ।

সেই রাত্রেই হুসন অন্তঃসত্ত্বা হলো। তার পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো, সে কাহিনী আপনাকে পরে বলবো, জাঁহাপনা। সেই রাতের সল্পকালের মধ্যে মোট পনেরো বার তারা মিলিত হলো। হাসান বললো, আজকে রাতের মতো এখানেই ইতি করা যাক। এবারে একটু ঘুমতে হয় কী বলো?

হুসন বলে ঘুমে আমারও চোখ জড়িয়ে আসছে।

একটু ক্ষণের মধ্যে অসাড় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দুজনেই।

‘ছোট ঘর’ থেকে বেরিয়ে এসে জিনি দেখে জিনিয়াহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের সুখ নিদ্রা। জিনি বললো, নাও আর দেরি করো না, ছেলেটাকে তুলে নাও। যেখান থেকে এনেছিলাম—সেই বসরোহর গোরস্থানে রেখে আসতে হবে।

জিনিয়াহ নিজের পিঠে তুলে নিলো ছেলেটাকে। গায়ে একটা জামা মাত্র সার। ইজের পাতলুন কিছুই পরনে নাই। শোর্শে করে আকাশ পথে উড়ে চললো। পাশে পাশে চলতে থাকে জিনি। এইভাবে চলা কালে জিনির মধ্যে বদ চিন্তা চাড়া দিয়ে ওঠে। জিনিয়াহর উপর বলাৎকার করতে উদ্যত হয়। অন্য সময় হলে জিনিয়াহ খুব একটা গররাজি হতো না। কিন্তু তখন তার পিঠে হাসান। এ অবস্থায় রতি বিহার করতে গেলে ছেলেটা পড়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কায় জিনিকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আফ্রিদিদের সঙ্গম চিন্তা একবার চেগে উঠলে ক্ষান্ত করা অসম্ভব। বাধা পেলে তখন সে ভয়াল-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সমস্ত কিছু-ভেঙেচুরে খানখান করে ফেলে। তেমনি কিছু একটা অঘটনই হয়তো ঘটতো কিন্তু উপরে আল্লাহ আছেন, তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রচণ্ড শব্দে একটা বাজ পড়লো জিনির মাথায়। ব্যাস, সব শেষ। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা জিনির সেই প্রকাণ্ড বপুটা তীর বেগে নেমে গেলো মাটির দিকে। জিনিয়াহ শুনতে পেলো, আকাশ-বাতাস কাঁপয়ে এক আর্তনাদ উঠলো। মাটিতে পড়ে খান খান হয়ে গেলো জিনির দেহটা। পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সব। জিনিয়াহ আস্তে আস্তে নেমে এলো জিনির জ্বলন্ত চিতার পাশে। সিরিয়ার দামাসকাস শহরের প্রবেশ মুখে নেমে পড়েছে সে। হাসানকে পিঠ। থেকে নামিয়ে রাস্তার এক পাশে শুইয়ে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একেই বলে নিয়তি।

তখন বেশ বেলা হয়েছে, প্রবেশ দ্বার খুলে দিয়েছে দ্বারী। শহরের পথে লোকসমাগম হতে থাকে। আর সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো নবাবপুত্রের মতো দেখতে সুন্দর এক অর্ধউলঙ্গ যুবক ঘাসের উপর শায়িত। ঘুমে আচ্ছন্ন। গায়ে শুধু কামিজ আর মাথায় একটা রাতে পরার টুপি। পাতলুন ইজোর-কিছু নেই পরনে। একজন পথচারী বললো, আহা, বেচারা বোধহয় বড়ই ক্লান্ত এবং বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আর একজন বলে, কী সুন্দর চেহারা। অন্যজন প্রশ্ন তোলে, কিন্তু ছেলেটা উলঙ্গ হলো কি করে। কেউ কি পাতলুন ইজের খুলে নিয়েছে? আবার কেউ বা বঁকা করে ফোড়ন কাটে দেখগে, বেহেড মাতাল হয়ে কোথায় কোন নর্দমায় পড়েছিলো।

যখন তারা এইরকম আজগুবি কল্পনায় মশগুল সেই সময় সকালবেলার একটা হাল্কা হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো তার কামিজ। সবাই দেখে অবাক হলো তার দেহের গোপন অঙ্গের অপূর্ব মনোহর সৌষ্ঠব। এই সময় হাসানের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে অচেনা অজানা এক নতুন জায়গা। একটা শহরের প্রবেশমুখে রাস্তার একপাশে তৃণশয্যায় শুয়ে আছে সে। আর তাকে ঘিরে একপাল লোক জটলা করছে। চিৎকার করে উঠলো, আপনারা বলুন, আমি কোথায়? আর আপনারাই বা আমাকে এমন ভাবে ঘিরে ধরেছেন কেন? কী ব্যাপার?

একজন জবাব দিলো, তুমি এই অবস্থায় এখানে পড়ে আছো দেখেই আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। তুমি কি জানো না জায়গাটা দামাসকাস শহরের ঢোকার প্রধান দরজা? কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলো? আর কী করেই বা তোমার পরনের পাতলুন খোয়া গেছে?

হাসান প্রায় কঁদো কঁদো হয়ে বলে, এ সব কী ব্যাপার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কাল রাতে ছিলাম। আমি কইরো। আর তোমরা বলছে, আমি এখন দামাসকামে?

হাসানের কথা শুনে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো। কয়েকজন। একজন বললো, চরসের মাত্রা বোধ হয় একটু বেশি হয়ে গেছে সাহেবের?

দামাসাদকাস থেকে কইরোর দূরত্ব অনেক। এক রাতে কেন দশদিন দশরাত হাঁটলেও পৌঁছানো সম্ভব নয়। সুতরাং গাঁজাখুরি কথা শুনে এ-ধরনের মন্তব্য তো করবেই লোকে।। আর একজনের মনে হলো, লোকটা বোধ হয় বদ্ধ পাগল।

অন্য একজন বলে, আহা, এমন সুন্দর চাঁদের মতো ছেলে-মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একেই বলে নসীবের লেখা।

একজন বয়স্ক ভারিক্কিচালের লোক তার কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, বাপু খোলসা করে বলে দেখি, কি তুমি বলতে চাও?

হাসান বলে, গতকালে মাঝরাতে আমি কাইরোতে ঘুমিয়েছিলাম আর সন্ধ্যাবেলায় ছিলাম আমি আমার নিজের শহরে-বসরা হয়।

এবারে আর সেই বয়স্ক ভারিব্ধিচালের লোকটিও হাসি চাপতে পারলো না। ওর কথা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি? ঐ লোকটি বলে নাঃ, কোন আশা নাই। একেবারেই গেছে।

একজন সম্ভ্রান্ত গোছের শিক্ষিত লোক এগিয়ে এসে বলে, তোমার মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করো। আমন বোকার মতো কথা বললে তো লোক হাসাহসি করবেই।

—আমি বেশ সুস্থ। ভেবেচিন্তেই বলছি সব কথা। গতরাতে কইরোতে আমার শাদী হয়েছে। চমৎকার কেটেছে রাতটা।

একজন ঠাট্টা করে ওঠে, সাহেব বোধ হয় স্বপ্নের ঘোরে শাদীর মজা লুটেছে রে! তা বাবা পাত্রীটা দেখতে কেইসা? হুরী পরী হবে নিশ্চয়ই।

হাসান বেশ রুষ্টই হয় তার কথা শুনে। বলে, ঠাট্টা করছে কেন? তা সে হুরীর কম কিসে? তার মতো রূপ যৌবন কোন মানুষের হয় না। আর স্বপ্ন বলে তামাশা করছে কেন? যা করেছি তা ঘুমুবার আগেই করেছি। একটা বাঁদরমুখে কুঁজে বামন-এর সাধ হয়েছিলো, শাদী করতে এসেছিলো তাকে। তার বাঞ্ছা আর পূরণ হয়নি। ভাগিয়ে দিয়েছি তাকে। আমার মাথায় এই যে রাতের টুপিটা দেখছো—এটা তার জন্যেই আনা হয়েছিলো।

এই বলে আশেপাশে এদিক ওদিক কি যেন খুঁজতে থাকে হাসান। তারপর কঁদো কঁদো হয়ে বলে, হায় খোদা, আমার-টুপীটা গেলো কোথায়? আমার টাকা পয়সার বটুয়াটা? ইজের আর পাতলুনই বা কি হলো?

আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে তাড়াৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে শহরের প্রবেশ দরজা পেরিয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলো। হাসানের তখন এক চিন্তা—তার টুপী তার বটুয়া আর পাতলুম। তার পিছন পিছন এক দঙ্গল ফচকে চেংড়া যে তাড়া করে চলেছে সে দিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্বক্ষেপ নাই। ছেলেগুলো মজা করে আওয়াজ তুলছে-পাগল পাগল.

হাসান দেখলো নিরুপায়। যতো সে এগোচ্ছে তত বেশী ফাজিল ফক্কড় ছোড়া এসে দল ভারী করে তুলছে। একটা রুটীর কারখানার দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে সে। এই দোকানের মালিকটা দারুণ বদমেজাজী লোক। তার ভয়ে ছোকরাগুলো কেটে পড়লো যে যার মতন।

এবার হাসানকে এখানে রেখে আসুন আমরা যাই সিৎ-অল-হুসনর কাছে।

সকালে ঘুম ভেঙে গেলে হুসনার। পাশে দেখে হাসান নাই। ভাবলো, হয়তো ছোটোঘরে ঢুকেছে। যখন হাসানের প্রতীক্ষায় সে বসে আছে, ঘরে ঢুকলো তখন তার বাবা সামস-আল-দীন। জিজ্ঞেস করলো, কেমন কাটলো, বেটী?

তার মন বড় বিষণ্ণ, মুখে হাসি নাই। সুলতানের কোপে পড়ে মেয়েটার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেলো। একটা কদাকার কুঁজোর সঙ্গে তার শাদী হলো। হয়তো মনের দুঃখে মেয়েটা তার আত্মঘাতী হবে। আবার প্রশ্ন করলো, তোর কোন অসবিধে হয়নি তো মা?

বাবা ভেবেছিলো, মেয়েকে দেখবে বিষণ্ণ কাতর। কিন্তু একি তার টসটসে চেহারা। আনন্দে ডগোমগো হয়ে উঠেছে। ওর মুখ চোখ। রাগে গর্জে উঠে সে, বেশরাম বেহায়া লেড়কী? বংশের। খানদানী মর্যাদার কথাও কি সব ভুলে গেছিস তুই। একটা নীচ নফরকে নিয়ে আমোদ ফুর্তি করেছে। সারারাত? তার চেয়ে গলায় দড়ি জুটলো না?

—আব্বাজান! হুসন বাবাকে জড়িয়ে বলে, তুমি ভুল করেছে। কাল রাতে আমার সঙ্গে যার শাদী হয়েছে তার পায়ের নখের যুগ্নিও না তোমার ঐ বান্দরমুখে কুঁজে বামনটা। আমরা সবাই মিলে লোকটাকে বঁদের নাচ নাচিয়েছি। সারাক্ষণ। ভারি মজা করেছি। তুমি মজাক করে কুঁজোটাকে নিয়ে এসে অবশ্য ভালোই করেছে, কিন্তু আমার অবস্থা বোঝ, তখন? আমি তো কেঁদে সারা। তখন কী করে বুঝবো, ওটা আসলে আমার বর না-তোমরা তামাশা করার জন্যে পাঠিয়েছো? যাক গে? এখন অন্য কথা বলে।

হুসনর কথায় আরো রেগে উঠলো সামস-আল-দীন–কথাবার্তা যখন বলবে, একটু হিসেব করে সভ্য-ভব্য ভাবে ব’লো। এ সব কি অনা-সৃষ্টি কথা তোমার মুখে? তুমি কি বলতে চাও, ঐ কুঁজোটাকে নিয়ে রাত কাটাওনি?

হুসন আদুরে মেয়ের মতো ন্যাকা সুরে বলতে থাকে, আবার সেই হতচ্ছাড়া কুঁজোটার নাম মুখে আনছো আব্বজান? বলছি, ওসব অলক্ষুণে কথা থাক এখন। তা হলে গোড়া থেকেই বলি, শোনে।

গতরাতের আগাগোড়া সব কাহিনী বিবৃত করলে হুসন! আঃ কী আমার বরাত আব্বাজান। আজ আমার মতো সুখী আর কোন মেয়ে নাই দুনিয়ায়। কী তার রূপ কী তার যৌবন। সারা দেশ ঢুড়লে তার জুডি পাবে না। তুমি। যেমন রূপ তেমনি তার ব্যবহার। সারারাত ধরে কত ভাবে কত আদর সোহাগ করেছে—সে তোমাকে তো খুলে বলা যায় না, আব্বাজান!

–তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি? কই, কোথায় সে ছেলেটা? হুসন বলে, দেখো, হয়তো ছোটঘরে গেছে। আর দেরি সহ্য হলো না। ক্ষিপ্র পায়ে উঠে গিয়ে ছোটঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো। একটা বেটে কুঁজোলোক গর্তের মধ্যে পাঢুকিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

—কে তুমি? উজির গর্জে ওঠে।—তুমি সেই কুঁজোটা, না?

কিন্তু লোকটা এমনই ভীতিসন্ত্রস্ত যে কোন জবাব দিতে পারলো না। কেবলই তার মনে হতে লাগলো, জিনিটাই বুঝি আবার ফিরে এসেছে।

এই সময় রাত্রি অবসান হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পরদিন বাইশতম রাত্রি। আবার সে গল্প শুরু করে।

তারপর শুনুন শাহজাদা, জাফর তার গল্প বলে যাচ্ছে আর খলিফা হারুন-অল-রাসিদ তন্ময় হয়ে শুনছেন।

সেই ভীত সন্ত্রস্ত কুঁজোটা কোন উত্তর দিতে পারলো না। শুধু তার মনে হতে থাকে, জিনি এসে পড়েছে আবার।

উজির এবার আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে, কে তুমি বলো শিগ্‌গির। জবাব দাও। না হলে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেবো।

এই ওষুধে কাজ হলো।-দোহাই বাবা, জিনি সাহেব, তুমি অগতির গতি, জগতের পতি, অনাথের নাথ, পরম পিতা, তোমাকে গড় করি। আমার কোনো দোষ নিও না, আমি তোমার কোন কথার অবাধ্য হইনি।

–কী যাতা বক বক করছে। আমি কোন জিনি-ফিনি না, আমি মেয়ের বাবা-সুলতানের উজির।

তখন সেই কুঁজোটা তড়ফে উঠলো, ওঃ আপনি? আপনি বেরিয়ে যান। এখান থেকে। আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি; আমার জীবনটাই বরবাদ করে দিয়েছেন আপনি। শিগ্‌গির। এখান থেকে কেটে পড়ুন। না হলে, এক্ষুণি সেই আফ্রিদি এসে পড়লে ঠ্যালা বুঝবেন। আপনার মুখ দেখতে চাই না। আমি, চলে যান। যত নষ্টের গোড়া আপনি! আমার এতো কষ্ট খালি আপনার জন্যে। আপনি আমাকে একটা নষ্ট মেয়েছেলের ঘাড়ে চাপাবার মতলবে ছিলেন। আপনার মেয়ে মহব্বত করে একটা মোষ-একটা গাধা-মানে মানে-একটা আফ্রিদি দৈত্যর সঙ্গে। আপনি নিজেও যতটা আপনার মেয়েও ঠিক ততটা খারাপ বদমুইশ।

—তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ, উজির বললো, এদিকে একবার বেরিয়ে এসো, তারপর তোমাকে মজা বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কুঁজে তখন সেয়ানার মতো বলে, হঁ বাবা, ওটি হচ্ছে না। আফ্রিদির হুকুম ছাড়া একপাও এখান থেকে নড়বো না, অতোটা পাগল এখনও হইনি আমি। যতক্ষণ না সূর্য উঠছে ততক্ষণ একপা নড়ছি না। এখান থেকে। আপনি সরে যান। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। আচ্ছা, বলুন তো, এতক্ষণে সূর্য উঠেছে কি ওঠেনি?

উজির বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করে, আফ্রিদি কী কী করেছে, কী কী বলেছে তোমাকে?

কুঁজো তখন সমস্ত খুলে বললো তাকে।

উজির পায়খানার ওপাশের আর একটা দরজা খুলে দিয়ে বললো, রোদ উঠে গেছে, যা পালা এখান থেকে।

দরজার ওপারে পা দিয়েই চো দৌড় দিয়ে নিমেষে হাওয়া হয়ে গেলো কুঁজোটা। দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির হলো প্রাসাদের দরবার মহলে–একেবারে সুলতানের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সব বৃত্তান্ত। কালকের রাতের সব কাহিনী।

এদিকে সামস-আল-দীন সিৎ-অল-হুসনর কাছে এসে দিশাহারা ভাবে বললো, বেটা মনে হচ্ছে আমার মাথাটা বোধ হয়। খারাপই হয়ে গেছে।

–কোন আব্বাজান?

–এ যে সব ভুতুড়ে আজগুবী কাণ্ডকারখানা আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। একটু খোলসা করে বলতো, মা।

হুসন বাবার হাত ধরে কাছে বসায়। বলে, এতো জলের মতো পরিষ্কার, ঈর্স্যু আব্বজনে! সেই প্রিয় দর্শন যুবক গত রাতে উপস্থিত সবারই খুব প্রিয়পাত্র পূর্বসু, পিণ্ড হয়ে উঠেছিলো। তার সঙ্গেই আমি মধুয়ামিনী যাপন করেছি। তোমাকে বলতে লজ্জা করছে, আব্বাজান, আমার বিশ্বাস, তার সঙ্গে গতরাতে সহবাসের ফলে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। এই দেখো তার প্রমাণ-তার মাথার বাদশাহী টুপী, তার টাকা পয়সার বটুয়া, আর ঐ দেখো তার পাতলুন আর ইজের।

চেয়ারের উপরে রাখা টুপীটা হাতে তুলে নিলো সামস-আল-দীন। এ টুপী তো বসরোহর উজির আমিররা পরে। দেখেই চিনতে পারলো। সোনার পাতে মোড়া। নানা লতাপাতার নক্সা করা চার পাশে। হুসন বসলো, বাবা দেখো, ওর পাতলুনের কোমর বন্ধনীতে কি একটা শক্ত জিনিস।

পাতলুনটা বাবার হাতে এগিয়ে দিলো হুসন।

ক্ষিপ্রহাতে উজির সেলাইট ছাড়িয়ে ফেললো কোমরবন্ধনীর। একখানা কাপড় জড়ানো তুলেটি কাগজ। কাগজখানার ভাজ খুলতে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সে। হুসন, মা পেয়েছি। এই তো আমার জানের ভাই নুর-এর সই কার দস্তাবেজ। টাকা পয়সার বটুয়াটা খুলে দেখলো, এক হাজার সোনার মোহর-সেই সওদাগরের দেওয়া। সেই সঙ্গে একখানা কাগজে কয়েকটা ছত্র লেখা। বসরোহর সেই সওদাগর একহাজার মুদ্রার বিনিময়ে নূর-আল-দীনের পুত্র হাসান বদর-আল-দীন-এর কাছ থেকে একটা জাহাজ ক্রিয় করেছে। এবং নগদে সেই মুদ্রা হাসানের হাতে তুলে দিয়েছে। তারই বয়ান লিখে সওদাগর। সই করে দিয়েছে ঐ কাগজে। সামস-আল-দীন পড়ে উল্লাসে ফেটে পড়লো।—আমার ভাই নূর-আল-দীন। তার ছেলে হাসান বদর-আল-দীন। তারপরে বুক চাপড়াতে লাগলো। উজির।-হায়রে আমার আদরের অভিমানী ভাই। রাগ করে চলে গেলে জন্মের মতো। আর দেখা হলো না, আর দেখা হবে না। জানো মা-এই নূর-আল-দীন তোমার আপনি চাচা, আমার সহোদর ভাই। হাসান বদর-আল-দীন তার ছেলে। তোমার চাচার ছেলে-তোমার ভাই। এর সঙ্গেই তোমার শাদী হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু একটা তুচ্ছ কারণে আমাদের ঝগড়া বাঁধে। আর তার জন্যে ভাই আমার চিরকালের মতো দেশান্তরী হয়ে গেলো। সে যাই হোক, আজি আঠারো বছর বাদে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। হাসানকেই আমি চেয়েছিলাম জামাই করতে। তা এই নাও, তোমার একহাজার দেনমোহর। শাদীর যৌতুক রেখে গেছে সে।

তুলেটি কাগজখানা ভালো করে আর একবার পড়লো, উজিরা। নূর-আল-দীনের জীবনের মোটামুটি রোজনামচা। তার শাদী এবং হাসানের জন্ম তারিখ দেখে অবাক হয় সে। সে কি, এ যে তারও শাদীর তারিখ। হাসানের জন্মতারিখে তার মেয়ে হুসনও তো জন্মেছে। আশচর্য খোদার লীলা! উজির আর অপেক্ষা করে না। তডিঘডি সুলতানের কাছে গিয়ে কাগজখানা হাতে তুলে দেয় তার আদ্যোপান্ত সব কাহিনী খুলে বলে তাকে। সব শুনে হতবাক হয়ে পড়ে সুলতান। এমন আশ্চর্য যোগাযোগ-যেন আল্লাহরই অভিপ্ৰায় বলে প্রতিভাত হয় তার কাছে। নকল নবীশদের ডেকে বলে, কাহিনীর সব বিবরণ হুবহু লিখে রাখে।

উজির আবার ফিরে আসে মেয়ে হুসনর কাছে। কিন্তু তখনও হাসান ফিরে আসে না। এদিকে বেলা বাড়তে থাকে। উজির উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তবে কি চলে গেছে?

হুসন বলে, কিন্তু বাইরে সে যাবে কি করে আব্বাজান! ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে না পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম। সে বাইরে কোথাও গেছে। কিন্তু দরজাগুলো সব যেমন বন্ধ করা হয়েছিলে-তেমনি বন্ধই ছিলো। আমি নিজে হাতে দরজাগুলো খুলেছি। তার খানিকবাদে তুমি এলে আমার কাছে।

উজির ভাবলো, এও আল্লাহরই এক লীলা। এর অর্থ উদ্ধার করা মানুষের কর্ম নয়।

এই সময়ে শাহরাজাদ দেখলো রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

 

তেইশতম রজনী। আবার কাহিনী শুরু হলো; শাহরাজাদ বললো, জাঁহাপনা, আপনার তো খেয়াল আছে নিশ্চয়ই, জাফর গল্প শোনাচ্ছে আর খলিফা মাঝে মাঝে তারিফ করে উঠছে।

উজির বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের ছেলে-তার জামাত উধাও হয়ে গেছে। কবে ফিরবে: কে জানে। কিন্তু দুনিয়ার সব কিছু এতো দ্রুত বদলায় যে আজকের মানুষকে দু’বছর বাদে চেনা দায় হতে পারে। তাছাড়া কত রকমের ঠগ জোচ্চোর আছে—তাদের কত রকম ফন্দী, কে ধরতে পারে। একটিমাত্র রাত—তাও সারাক্ষণ নয়—তার মধ্যে কতটুকু সময়ই বা হুসন তাকে কাছে পেয়েছে? তাকে যদি সে পরে ঠিকঠাক চিনতে না পারে, দোষ দেওয়া যায় না। তাই শাদীর বাসর সজ্জা ভেঙে ফেলার আগে তার একটা নিখুঁত চিত্ব ফুটিয়ে তুলে বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখার সিদ্ধান্ত করলো। দোয়াত কলম নিয়ে একখানা তুলেটি কাগজে ঘরের খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্রের হুবহু বৰ্ণনা লিখে নিতে লাগলো। কোনখানে মঞ্চ—কী ভাবে কী কী জিনিস দিয়ে তাকে সাজানো হয়েছিলো, ঘরের কোথায়, কোথায় ছিলো ঝাড়বাতি, কোথায় মোমবাতি, কোথায় ছিলো ফুলদানি, কোথায় ছিলো টেবিল, কোথায় কখানা চেয়ার ইত্যাদি সব বিবরণ লিখে গেলো। উজির। লেখা শেষে কাগজখানা ভাঁজ করে পাতলুন, টুপী, ইজের বটুয়া সব চাঁদরের সঙ্গে সিন্দুকে ভরে রাখলো। মেয়েকে বললো দরকার হলে কাগজখানা পড়ে দেখো, মা। কাজে লাগতে পারে।

সিৎ-অল যা ভেবেছিলো। তাই। শাদীর প্রথম রাতেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলো। নামাস পরে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিলো সে। ছেলের বাবার মতো সেও অনিন্দ্যসুন্দর। ধাত্রী এসে বাচ্চাকে গোছল করিয়ে, কাজল পরিয়ে নাড়ী কেটে ধাইমার কোলে তুলে দিলো। নাম রাখা হলো আজীব–অর্থাৎ আজব, মানে চমৎকার। যখন আজীবের বয়স সাত, কইরোর এক নাম করা মাদ্রাসায় ভর্তি করা হলো তাকে। প্রতিদিন সে সেজেগুজে দাদামশায়ের এক পুরোনো বিশ্বস্ত নফরের সঙ্গে মাদ্রাসায় যায়। দুপুর বেলায় খানা খেতে আসে। আবার ফিরে যায়। আসে। সেই বিকেলে। কিন্তু পাঁচটা বছর পরে মাদ্রাসার পাঠে ইতি করে ঘরে ফিরে আসতে হয় তাকে।

আজীব ভীষণ দুরন্ত ছিলো। তার সহপাঠীদের মানুষ বলেই গণ্য করতো না। সব সময় তার অহঙ্কার ভাব। সে উজিরের নাতি। কথায় কথায় সহপাঠীদের শুনিয়ে দিতে সে কথা। যাই হোক, এই ভাবে পাঁচ বছর কেটে গেলো। একদিন ছেলেরা দল বেঁধে মৌলভীর কাছে নালিশ করলো। মৌলভী সাহেব বড় সদাশয় ব্যক্তি। তিনিও পছন্দ করতেন না। আজীবের ডেপোমী। ছেলেদের শান্ত করে বললেন, তোমরা এখন চুপচাপ থাকে। কাল আমি এর বিধি ব্যবস্থা করবো। যাতে আর কখনও সে তোমাদের পিছনে না লাগে। কাল যখন তোমরা সবাই খেলার সময় এক জায়গায় জড়ো হবে, তোমাদের মধ্যে কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আজ একটা ভারি মজার খেলা দেখাবো আমি। কিন্তু তার আগে তোমরা সবাই চেঁচিয়ে তোমাদের মা বাবার নাম বলবে-যাতে প্রত্যেকে শুনতে পায়। যদি কেউ তার মা বাবার নাম না বলতে পারে, তবে সে জারজ। তার সঙ্গে আমরা আর কখনও খেলবে না।’

পরদিন সকালে যথারীতি আজীব মাদ্রাসায় গিয়ে পৌঁছলো। খেলার সময় ছেলেরা তাকে ছেকে ধরে বললো—আজি আমরা একটা মজার খেলা খেলবো। কিন্তু তার আগে ভাই সবাইকে তার মা বাবার নাম বলতে হবে। যে বলতে পারবে না তাকে আমরা খেলায় নেবো না। কী, সবাই রাজি।

রাজি-রাজি-রাজি বলে সবাই সমস্বরে আওয়াজ তুললো।

–আচ্ছা তা হলে আরম্ভ করা যাক।

একটি ছেলে সামনে এগিয়ে এসে বললো, আমার নাম নবী, মার নাম নবীহাহী। আর আমার বাবার নাম ঈজ-আল-দীন। আর একজন এসে বললো, আমার নাম নাবীজ, আমার মায়ের নাম জামিলাহ, বাবার নাম মুসতাফা। এইভাবে একে একে প্রায় সকলেই সবার মা-বাবার নাম বলতে লাগলো। যখন আজীবের পালা এলো, গর্বভরে সামনে এসে বলতে লাগলো, আমার নাম আজীব, আমার মার নাম সিৎ-অল-হুসন আর আমার বাবা মিশরের উজির সামস-আল-দীন।

তৎক্ষণাৎ সব ছেলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠে।—দুয়ো দুয়ো, কিছু জানো না। তিনি তোমার বাবা কি করে হবেন?

আজীব ক্রুদ্ধ হয়।–তোমাদের ডাণ্ডা মেরে মাথা গুডিয়ে দেবো। উজিরই আমার বাবা।

ছেলেরা সবাই প্রতিবাদ করতে থাকে।–না না না। কিছু জানো না তুমি। উজির তোমার বাবা নন। তিনি তো তোমার মায়ের বাবা তোমার দাদু। দুয়ো, বাবার নাম বলতে পারে না। তোমার সঙ্গে আর কেউ খেলবো না।

ছেলেরা কেউ বা মাথায় টোকা মেরে পালায়, কেউবা জামা ধরে টানে আবার কেউ চিমটি কেটে চম্পট দেয়। আজীব এক অতোগুলো ছেলের টিটকিরিতে নাস্তানাবুদ হয়ে ওঠে। এক পাশে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে থাকে, ব্যাপারটা কী?

মৌলভী সাহেব কাছে এসে সস্নেহে বলেন, ওরা ঠিক কথাই বলেছে, বাবা। উজির সাহেব তোমার বাবা নন। উনি তোমার দাদু হন। তুমিও জানো না—আমরাও জানি না তোমার/বাবা কে? সুলতান তোমার মার সঙ্গে এক কুঁজো বামনের শাদী দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কখনও তোমার মার সঙ্গে সহবাস করেনি। সে অবশ্য গল্প বলে বেড়ায় শাদীর রাতে বাসরঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নাকি জীন এসে তোমার মার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে গেছে। আচ্ছা তুমিই বলো, বাবা এসব গাঁজাখুরি গল্প না? সুতরাং তোমার সহপাঠীরা যা সব বলে ঠাট্টা বিদ্রহ্মপ করছে তা মোটেই অন্যায্য নয়। ওরা তোমাকে জারজ বলেছে, আমি শুনেছি। যার বাবার ঠিক নাই তাকেই তো আমরা জরজ বলি। সে দিক থেকে তারা তো কিছু অন্যায় বলেনি? রাস্তার একটা নামগোত্রহীন ক্রীতদাসকে আমরা অতো অবজ্ঞা অশ্রদ্ধা করি কেন? কারণ ওর মা-বাবার ঠিক নাই। তাই বলছি, বাবা দেমাকটা একটু কমাও, একটু নরম হয়ে মিলেমিশে চলো দেখবে সবাই তোমাকে ভালোবাসবে, মাথায় করে রাখবে।

আজীব কিন্তু মৌলভীর উপদেশে কর্ণপাত করলো না। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো, তার মা-সিৎ-অল-হুসন-এর সামনে–মা, কে আমার বাবা। কী তার নাম? বলো।

ছেলের এই মূর্তি কখনও দেখেনি সে। চোখের জলে বুক ভেসে গেলো তার। বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, কে আবার, উজির তোমার বাবা।

—না না, মিথ্যে কথা। উজির সামস্-আল-দীন আমার বাবা না। সে তোমার বাবা। আমার বাবা কে বলো?

সিৎ-অল চুপ করে থাকে। উত্তর দিতে পারে না। আজীব কিন্তু নাছোড়বান্দা। চিৎকার করেবাড়ি ফাটিয়ে ফেলে, বলবে কিনা বলো? যদি না বলো, এক্ষুণি আমি তারোয়াল দিয়ে গলা কেটে ফেলবো। আমার।

সিৎ-অল আঁতকে ওঠে।-না না, বাবা, না। অমন কথা মুখে এনে না। বলছি, তোমার বাবার কথা। বলছি, শোনো।

শাদীর প্রথম রাতে এসেছিলো সে।
তার লকলক করা রূপের আগুনে
পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম আমি–নিমেষে।
আমার সকল সত্ত্বা; আমার সকল সঞ্চয়,
দেহ মন প্রাণ
নিয়ে সে উধাও হলো জানি না কোথায়।
অনেক শীতের রাত,
ফাল্গুনের মাস
একে একে পার হয়ে যায়,
আজও বসে আছি প্রতীক্ষায় তার—দিবস শর্বরী,
আমি এক নিন্দিত শবরী।

মা যত কাঁদে ছেলে আরও বেশী কাঁদে। হুসনর প্রাণ হুহু করে যায়। আজ বারোটা বছর তুষের আগুন জুলছে তার বুকে। মুখ ফুটে বলতে পারে না কাউকে। আজ পেটের সন্তান আজীবকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার দুঃখের কাহিনীর কিছুটা বলতে পেরে, ভার কিছুটা লাঘব হয়।

উজির-এর কাছে খবর পৌঁছয়, আজীব অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে তার জন্ম পরিচয় জানতে চায়। তাড়াতাডি ছুটে আসে হুসনর মহলে। দেখে মা বেটা দুজনে আকুল নয়নে কেঁদে চলেছে।

—কী হয়েছে মা, তোমরা কাঁদছো কেন?

হুসন বললো, আজ মাদ্রাসা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘মা আমার বাবা কে? আমি কী উত্তর দেবো, আব্বাজান? মাদ্রাসার ছেলেরা তাকে অনেক মন্দ কথা বলেছে। তাই বোধহয় ওর মনে আঘাত লেগে থাকবে।

নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে উজির বলতে থাকে, সেই সব অতীত কাহিনী। তার ছোট ভাই নূর-আল-দীন কী কারণে দেশত্যাগী হয় এবং বসরা হয় গিয়ে কবে সে সেখানকার উজিরের কন্যাকে শাদী করে। তারপর হাসানের জন্ম, নূর-এর লোকান্তর এবং শাদীর রাতে হাসানের অলৌকিক আবির্ভােব এবং শাদীর রাত শেষে তার রহস্যজনক অন্তর্ধান-সব সবিস্তারে বর্ণনা করলে সে। অবাক বিস্ময়ে শুনতে থাকে আজীব।

—আমার বাবা কবে ফিরে আসবে, দাদু?

উজির এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে-তা তো বলতে পারবো না ভাই। চলো আমরা বসরাহ-য় যাই। তাকে খুঁজে নিয়ে আসি।

উজির সুলতান সমীপে হাজির হয়ে নিবেদন করলো সব বৃত্তান্ত।

—হজুর, এ ধরনের গুঞ্জন বে-ইজতের ব্যাপার। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যেতে পারে না। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।

সুলতান বললো, এক কাজ করো, উজির। কিছুদিনের জন্য ছুটি দিচ্ছি। তোমাকে। যাও, একবার খোঁজ করে দেখে এসো তাকে। আমার মনে হয়, বসরাহতেই বা তার কাছাকাছি কোথাও আছে সে। আমি তার নামে হুলিয়া করে দিচ্ছি। আমার হুলিয়া সঙ্গে থাকলে যে কোন দেশের সুলতান তোমাকে তার সন্ধান দেবার সাধ্যমতো ব্যবস্থা করবে। এবং যেখানে খুশি তুমি যেতেও পারবে।

সুলতানের বদ্যান্যতায় মহা খুশি হলো উজির। আভুমি আনত হয়ে কুর্নিশ করে দরবার থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। হুসন ও আজীবকে সঙ্গে নিয়ে সেই দিনই বসরোহর পথে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদিন পরে তারা এসে পৌঁছলো দামাসকাস শহরে। কাইরো থেকে দামাসকাস। ‘. . যতোটা পথ দামাসকাস থেকে বাসরাহও ততোটা। এখনও অর্ধেক বাকী। পথের ক্লান্তি কাটাবার জন্য সেখানে দু’টো দিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত করে উজির। শহরের প্রবেশ তোরণের সামনে তাবু গাড়লো সে।

উজিরের সঙ্গে যতো নফর চাকর এসেছিলো সবাই দামাসকাস দেখার জন্য ব্যাকুল হলো। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শহর পরিক্রম শুরু করলো উজির। সেখানাকর নানারকম মনোহারী জিনিসপত্র সওদা করলো ওরা। নিজেদের দেশের কিছু কিছু বাহারী জিনিস বিক্রিও করলো কেউ কেউ। শহরের বনেদী হামাম-এ গোছল করলো। ওখানকার বহুপ্রাচীন মসজিদ উম্যাদ-এ নামাজ পড়লো। লোকে বলে দোমাস্কাসের এই মসজিদ দুনিয়ার সেরা। এতো প্রাচীন, এতো বিশাল মসজিদ নাকি আর কোথাও নাই।

সবাই যখন এই সব করছে, আজীব তখন শহরের পথে পথে নানা রঙের মজার মজার জিনিসের সন্ধান করে চলেছে। উজিরের পুরাতন ভূত্য খোজা সাইদ রয়েছে তার পাশে পাশে। তার হাতে একখানা লম্বা লাঠি।

দামাস্কাসের দামাল ছেলেরা আজীবের পিছনে পিছনে ধাওয়া করে। এমন খুবসুরৎ লোড়কা জীবনে দেখেনি। তারা। কিন্তু আজীবের বা সাইদের এসব ভালো লাগে না। একটু স্বচ্ছন্দে পথ চলার যো নাই। সাইদ লাঠি উচিয়ে ভয় দেখায়—’হট যাও, হট যাও হিঁয়াসে!’ কিন্তু ভিড় আরো বাড়তেই থাকে। শুধু ছেলেরাই না, শহরের হাজার হাজার মেয়েপুরুষ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। আজীবের অসাধারণ রূপের কথা চাউর হয়ে গেছে সারা শহরে। কেউ বলে, এমন রূপের বাহার কোন মানুষের হয় না। নিশ্চয়ই কোন বেহেস্তের দূত মাটিতে নেমে এসেছে। আবার কেউ বলে আসমানের শুকতারার মতো আলো ঠিকরে পড়ছে তার শরীর থেকে।

ভিড় ক্রমশই বাড়তে থাকে। জনতার চাপে আজীবের দেহে আঘাত লাগতে পারে আশঙ্কায় সাইদ চিৎকার করে ওঠে। —কী; হচ্ছে কি? তোমরা কি ছেলেটাকে পিষে মেরে ফেলবে নাকি? এতো দেখবার কি আছে? আসমানের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে বুঝি। যত্তোসব.

কিন্তু কেউ তার কথায় কৰ্ণপাত করে না। সাইদ তখন লাঠি নিয়ে তাড়া করে। কিন্তু এভাবে আর কঁহাতক পারা যায়। দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে ওরা এক সময় এক খাবার-এর দোকানের সামনে এসে পড়ে। সাইদ ভাবে, জনতার হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়া ছাড়া বোধহয় আর গতি নাই।

এই খাবারের দোকানের সঙ্গে আপনাদের একবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। হাসান বদর-আল-দীন একদিন চেংড়া ছোঁড়াদের তাড়া খেয়ে এই দোকানেই আশ্রয় নিয়েছিলো। তারপর থেকে সে আর এ দোকান থেকে চলে যায়নি। দোকানের মালিক তাকে আদর করে। আশ্রয় দিয়েছিলো। পরে তাকে নিজের ছেলের মর্যাদায় দোকানের কাজে বসিয়ে তার হাতেই চাবি তুলে দেয়। আজ বারো বৎসর এই দোকানেই আটকে পড়ে আছে হাসান। মালিক আজ তিন বছর হলো দেহ রক্ষা করেছে। এখন সেই পুরোপুরি মালিক। সে-দিন নানারকম খাবারের মধ্যে একটা খুব মুখোরোচক খাবার বানিয়েছিলো সে। বেদোনার হালওয়া। সারা দামাসকাস শহরের আর কোন দোকানে এ খাবার পাওয়া যায় না। দামাসকাস শহরেই বা বলি কেন, তামাম দুনিয়ার কেউ এ খাবার বানাতে পারবে না। শুধু একজন ছাড়া। সে তার মা। ছোটবেলায় প্রায়ই সে এই হালওয়া তৈরি করে খাওয়াতো তাদের। মা-র কাছ থেকেই তার শেখা।

আজীবকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসানের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তার নিখুঁত চেহারা-রূপ। এ ছেলে তো কোনো সাধারণ ঘরের না।–খোকা ভেতরে এসো, না! এসো, ভেতরে এসে বসে। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে! তোমার চাঁদের মতো সুরৎ দেখে আমার কেমন যেনো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যেনো তোমাকে দেখেছি, বাবা। কিছুতেই মনে করতে পারছি নে। অথচ মনে হয়, খুবই চেনা, খুবই আপনার। ভেতরে এসে বসো, বাবা। তোমাকে একটু মিষ্টি-মুখ করাতে চাই। আমি নিজে হাতে বানিয়েছি।

হাসানের কথা শুনে আজীবের ভালো লাগে। সাইদের দিকে চেয়ে বলে, দেখো, বাবা-সাইদ, মনে হয়, লোকটা বড় দুঃখী। বোধহয় আমার মতো একটা ছেলে ছিলো তার। হয়তো বা সে বেঁচে নেই। অথবা থাকলেও তার কাছে নেই। চলো লোকটা যখন অতো করে ডাকছে ভেতরে গিয়ে বসি। সে যেমন তার ছেলের জন্যে পাগল আমিও তো তেমনি আমার বাবাকে খুঁজতেই পথে বেরিয়েছি। তার কথা শুনলে আল্লাহ খুশি হবেন। তিনি হয়তো আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেবেন।

কিন্তু সাইদ সঙ্গে সঙ্গে না না করে ওঠে। ওরে সব্বোনাশ উজিরের ছেলে হয়ে তুমি এই বাজারের দোকানের খাবার খাবে, তা ককখনো হয় না। উজির জানতে পারলে আমার গলা কেটে ফেলবে। তোমার কিছু ভয় নাই। তোমাকে এই লোকগুলো যারা ঘিরে ধরেছে তাদের আমি এক্ষুণি লাঠি-পেটা করে ভাগিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তাই বলে তুমি দোকানের ভিতরে গিয়ে বসবে।–তা হতে পারে না। তোমার কত মান ইজ্জত। উজিরের ছেলে তুমি। একটু তুচ্ছ মেঠাইওলার দোকানে বসে যা তা খাবে, তা হয় না।

সাইদের কথা সবই শুনতে পায় হাসান। চোখে ভরে আসে জল। কাকুতি মিনতি করে বলে, মেহেরবানী করে একটিবার আমার দোকানে তোমার পায়ের তুলে দাও, মালিক-। আমি মনে একটু শান্তি পাবো। আমাকে এইটুকু অনুগ্রহ করো, বাবা। আল্লাহ তোমাকে সুখে রাখবেন। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করবেন।

সাইদ বলে, সে হয় না দেকানি। আমার মালিক তোমার দোকানে বসে বারোজনে যা খায়। সে জিনিস খেতে পারে না। কত বড় ঘরের ছেলে সে। তার বনেদীয়ানা নষ্ট হয়ে যাবে, না!

হাসান এবার সাইদের মন ভিজাতে বলে, তোমার বাইরেটা বুনো নারকেলের মতো অতো শক্ত হলে কি হবে, আমি বুঝেছি, ভেতরটা ধবধবে সাদা মিষ্টি শাসে ভরা।

হাসানের কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ঝুনো নারকেল সাইদ।-আচ্ছা! তাই নাকি? :, বেশ মজার কথা বলতে জানো তো!

হাসান আবৃত্তি করে :
একান্ত সে অনুরক্ত, সুলতানের বিশ্বস্ত নফর।
জুড়ি তার পাবে নাকো, করে এসে দুনিয়া সফর।।
আপন মাথার মণি—অন্তরের ধন।
তার হাতে তুলে দেয়, নিশ্চিন্ত নির্ভর অনুক্ষণ।।

যাদু মন্ত্রের মতো কাজ হলো এই কবিতার কাঁটা ছত্রে। প্রশংসায় কে না খুশি হয়! আজীিবের হাত ধরে দোকানে ঢুকে পড়ে সাইদ।

হাসান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। বাদশাহ সুলেমানের সমস্ত সঞ্চিত ধনরত্ন হাতের মুঠোয় পেলেও এতো আনন্দ হতো না তার। অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে আজীবকে। দেখে দেখে যেনো আর আশ মেটে না।

দু’খানা তামার রেকবী করে বেশ খানিকটা বেদনার হালওয়া এনে রাখলো আজীবের সামনে! —আজ আমার বড় আনন্দের দিন, তোমাকে মিষ্টিমুখ করাতে পারছি। আজকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে, বাবা। যতো দিন বাঁচবো।

আজীব আর সাইদ প্রাণভরে তৃপ্তি করে খেলো। বেদানার দানাগুলোর সঙ্গে চিনি, দুধ, বাদাম, পেস্তা, মনাক্কা এবং আরও অনেক কিছু দিয়ে তৈরি এই বেদানার হালওয়া। এমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ-সারা দোকান ঘরটা ভরপুর হয়ে গেছে। সবটুকু চেটেপুটে খেলো দুজনে। আজীব মহা খুশি। বাঃ বেড়ে মজার জিনিস। আমাদের হালুইকররা তো বানাতে পারে না, বাবা-সাইদ?

সাইদ বলে, আমি বুড়ো হয়ে মরতে চলেছি। অনেক সুলতান বাদশাহর নেমস্তন্ন খেতেও গেছি তোমার দাদুর সঙ্গে। কিন্তু কই, কোথাও তো এমন খাবারের নামও শুনিনি কখনও!

খাওয়াদাওয়া শেষ করে আজীব বললো, বড় চমৎকার তোমার হালওয়া দোকানি। তা তুমি নিজে একটু খাও। সারা দিন রাত শুধু খেটেই চলেছে, একটু বসো আমাদের পাশে, গল্প করি।

হাসান পিস্তার বরাকী বানাচ্ছিলো। হাতটা ধুয়ে এসে আজীবের পাশে বসলো।—ঠিক আছে আজ আর কোন কাজ নয়, বলো, আজ তোমার কথাই শুনবে শুধু!

আজীব বললো, জানো আমিও বড় দুঃখী। আমার বাবা কোথায় চলে গেছে সেই কবে, আর ফেরেনি। আমি আমার মা আর দাদু দেশে দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছি তাকে। হয়তো এমনি করে খুঁজতে খুঁজতে সারা দুনিয়াটাই ঘুরে বেড়াতে হবে। জানি না, খোদার কি ইচ্ছা! তুমিও একটু আল্লাহর কাছে দেয়া মাঙ্গো না, দোকানি। আমার বাবাকে যেনো আমরা তাড়াতাডি খুঁজে পাই। আজীবের চোখে জল এলো। হাসানও রুদ্ধ করতে পারে না তার অশ্রু। এই দশা দেখে সাইদের বুকটা টনটন করে ওঠে। ভাবে, শুধু মেঠাই মণ্ডাতে পেট ভরলেও প্ৰাণ ভরে না।

যাইহোক, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর নয়, এবার তারা উঠে পড়ে তাবুর পথে রওনা হয়ে পড়ে।

আজীব চলে যেতেই হাসানের প্রাণ হাহাকার করে ওঠে। সব যেন কেমন ফাঁকা শূন্য হয়ে যায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। চটপট দোকানের বাঁপ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দামাসকাসের প্রধান তোরণ দ্বারের কাছে চলে আসে। সামনে অদূরে দেখতে পেলে ওরা দুজনে চলেছে। চলার গতি মন্থর করে ওদের পিছনে পিছনে অনুসরণ করতে থাকে। হাসানের কিন্তু কখনও মনে হয়নি, আজীব তার নিজের ঔরসের সন্তান।

সাইদের সন্দেহ হয়, কে যেন তাদের পিছন পিছন ধাওয়া করে আসছে। হঠাৎ পিছন ফিরে দু’পা পিছিয়ে এসে হাসানকে প্রশ্ন করে, আমাদের পিছনে পিছনে আসছে। কেন, তুমি? কী মতলব তোমার?

হাসান বলে, শহরের বাইরের একটু কাজে যাচ্ছি। তা তোমরাও এই পথে যাচ্ছে দেখে একটু পাচলিয়ে কাছে এলাম। একই যখন পথ, একটু গল্পসল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

সাইদ কিন্তু ক্ষেপে গেলো তার কথায়—তুমি কি ভেবেছো একটু হালওয়া খাইয়ে আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে? মনে হচ্ছে, এখনি বমি করে দিই।

কিন্তু আজীব দেখলো, সাইদের এই কথায় হাসানের মুখা কালো হয়ে গেলো! বললো, তা আসুক না, কি হয়েছে? খোদার তৈরি পথে সব সাচ্চা মুসলমানেরই সমান অধিকার। ওর পথে ও চলবে, আমাদের কি ক্ষতি? তবে যদি সে আমাদের তীবুর দিকেও যেতে থাকে তা হলে মজা টের পাইয়ে দেবো বাছাধনকে।

প্রধান তোরণ দ্বার পর হয়ে ওরা হাসাবার দিকে পা বাড়ালো। হাসাবার সমতলে তাবু গেড়েছে ওরা। হাসানও বঁদিকে বেঁকে ওদের পিছু নিলো। এবার আজীব রেগে আগুন। তা হলে তো সাইদ ঠিকই বলেছে। লোকটার মতলব খারাপ। একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ে মারলো হাসানকে। অব্যৰ্থ লক্ষ্য। পাথরটা গিয়ে আঘাত করলা হাসানের কপালে। আর সঙ্গে সঙ্গে হাত চেপে বসে পড়লো পথের উপর। রক্তে ভেসে যেতে লাগলো। ওর সারা মুখ। আজীবের হাত ধরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে তাঁবুতে এসে পৌঁছলো সাইদ।

নিজের হঠকারিতার জন্যে নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগলো হাসান। কেন-বা সে তার দোকান বন্ধ করে তাদের পিছু ধাওয়া করতে গেলো। ওরা তো তাকে বারণ করেছিলো। সে তো তা শুনলো না, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে তাদের পিছু নিলো কেন? ফিরে এসে আবার দোকান খুলে বেচাকেনা করতে লাগলো হাসান। আজ তার মা-র একটা কথা বারবার মনের মধ্যে নাড়া দিতে লাগলো। নিয়তি কখনো এড়ানো যায় না।

দুদিন দামাসকাসে কাটাবার পর তৃতীয় দিনের শেষে তাঁবুগুটিয়ে আবার বসরোহর পথে যাত্রা করলো সামস-আল-দীন। চলার পথে হীম, হামাহ, আলেপ্পো, দিয়ার, বাকর, মরিদীন, মসুল প্রভৃতি নানা ছোট বড় গ্রাম-শহর পেরিয়ে চললো। অবশেষে একদিন বসরা হয় এসে পৌঁছলো তারা।

সব আগে গিয়ে উঠলো সুলতানের দরবারে। যথাযোগ্য শাহী কায়দায় কুর্নিশ জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলো সুলতানের কাছে।

—আপনার পূর্বতন উজির নূর-আল-দীনের বড়ভাই আমি। মিশরের উজির পদে বহাল আছি।

সুলতানও খুব খাতির যত্ন করে বসালে তাকে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলো। বললো, নূর-আল-দীন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি তার কথা আজও ভুলতে পারি না। সে আমার বড় প্রিয় ছিলো। তার কাজে কামে, আচারে ব্যবহারে আমি কেন, আমার সালতানিয়তের প্রতিটি মানুষ মুগ্ধ ছিলো। তার মতো মানুষ লাখে একটা মেলে। আর তার হীরের টুকরো ছেলে-হাসান, সে আমার চোখের মণি ছিলো। তাকেও হারিয়েছি। আমি আজ তেরো বছর। কোথায় যে চলে গেলো-কেউ বলতে পারে না। তার মা—নূর-আল-দীনের বিধবা বিবি এখনও এই বসরাহতেই পড়ে রয়েছে। ছেলের প্রতীক্ষায়। যদি কখনও সে ফিরে আসে—সেই আশায়। নূর-আল-এর শ্বশুরও বিচক্ষণ উজির ছিলো আমার দরবারে। অনেক আগেই সে দেহ রক্ষা করেছে।

হাসানের মা-র কথা শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যগ্র হলো সামস-আল-দীন। লোকজন সঙ্গে দিয়ে সামস-আল-দীনকে হাসানের মা-র কাছে পৌঁছে দিলো সুলতান।

প্রশস্ত প্রাঙ্গণ পেরিয়ে নূর-এর প্রাসাদোপম বিরাট ইমারাৎ। নানা বিচিত্র রঙের মারবেল পাথরে তৈরি। সদর দরজায় ঢুকতেই সোনার ফলকে উৎকীর্ণ করা নূর-আল-দীনের নামের ফলক চোখে পড়লো। সামস-আল-দীন নামটার উপর হাত বুলিয়ে কি যেন অনুভব করলো। চোখ জলে ভরে এলো।

রুদ্ধকণ্ঠে অনাগল আওড়াতে থাকলো :

সকালবেলায় সূর্যকে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করেছি
তোমার কথা। সন্ধ্যাবেলার শুকতারাকেও।
হায়রে আমার নসীব। কেউ তো জবাব দেয়নি!
কিন্তু ওরা তো সবাই জানতো তোমার ঠিকানা—
তুমি এখানেই আছো।
কত হাজারো স্বপ্ন দেখেছি, কতো সব!
কিন্তু ভাই আমার—
তোমাকে তো কখনও পেলাম না। আমার খোয়াবে?
একবার ফিরে এসো, দেখে যাও,
এখনো আমার মন তেমনি সবুজ আছে–
তেমনি কোমল। সেই যখন দুভাই একসাথে
ঘুরে বেড়াতাম নীলের তীরে-ঠিক তেমনি।
আবার যদি ফিরে আসে একবার!
আবার যদি তেমনি করে হাসো!
সেই আকাশ ফাটানো দিলখোলা হাসি–
জলপ্রপাতের মতো উচ্ছল–নির্ঝর।
লোকে বলে, কত নাম যশ, কত বড় দিল আমার।
কিন্তু ওরা তো জানলো না, শুধু তোমার জন্যে
খাটো হয়ে মাথা হোঁট করতেও দ্বিধা ছিলো না আমার।

চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলো সামস-আল-দীন। হাসানের মা-র রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করতে খুলে গেলো। হাসান উধাও হওয়ার দীন থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে শোকানলে জুলছে সে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা তাজিয়া সাজিয়ে রেখেছে। তার ধারণা, হাসান-তার আদরের দুলাল আর বেঁচে নাই। তাই তার স্মৃতি হিসাবে এই তাজিয়াটা তৈরি করিয়েছে। সারা দিন রাত তাজিয়াটার সামনে বসে ছেলের কথা ভাবে সে।

তাজিয়া, তুমি কি বলতে পারো সে আর এ জগতে নাই!
সে কি তোমার কোলেই মাথা রেখেছে?
আর কি তাকে দেখতে পাবো না কোনদিন?
দুনিয়াটা আমার কাছে আজ শুকনো এক সাহারা,
খালি ধূ ধূ করা ধুলো আর বালি।
ঐ দূর আশমানের তারাদের ভীড়ে,
এক নওজোয়ান শাদীর পাত্রের সাজে,
সে তো তোমার কোলেই শুয়ে আছে…

হাসানের মা-র এই শোকগাথা শুনে দরজার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সামস-আল-দীন। একটু পরে হাসানের মা উঠে এসে স্বাগত জানায়। ভিতরে এসে বসে সামস-আল-দীন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে পরে আগাগোড়া সমস্ত কাহিনী সবিস্তারে বললো তাকে। কীভাবে তার কন্যার শাদীর রাতে সে বাসর ঘরে ঢোকে, কীভাবে তার সঙ্গে শাদী হয়। এবং কীভাবে তার সঙ্গে রাত্ৰিবাস করে সকাল হওয়ার আগেই রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান হয়—সব কাহিনী। তারপর আজীবকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই নাও তোমার নাতি—আমার নাতি। এই-ই এখন আমাদের একমাত্র শুকতারা। একে বুকে জড়িয়ে মনের শোকতাপ কিছুটা হাল্কা করো।

সামস-আল-দীনের কথায় বুঝলো তার ছেলে হাসান তাহলে বেঁচেই আছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।

ওরা যারা বলেছিলো ম’রে গেছে সে;
বিশ্বাস করি না-করি না সে কথা।
বহুকাল পরে আজ আমি ক্ষুধার্ত জননী,
খানা দাও খাবো, প্ৰাণ খুলে গাবো
আজ উৎসবের গান। নানা সাজে সাজাও আমাকে।

আজীব এগিয়ে এসে দাদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েকাঁদতে  থাকে। সামস-আল-দীন বলে, এখন তো। কান্নার সময় নয়, মা। অনেক কাজ বাকী আমাদের। নাও, তৈরি হয়ে নাও, আর দেরি না, এখুনি আমরা রওনা হয়ে যাবো মিশরের পথে। হাসানকে খুঁজে বের করতেই হবে।

হাসানের মা চটপট তৈরি হয়ে নিলো। সামান-পত্ব বাধা-ছাঁদা হয়ে গেলো। পথের খানাপিনা যোগাড় যন্তর করলো। জনকয়েক নফরদাসী নিয়ে সামস্‌-অল-দীনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো পথে।

বাসরাহ ত্যাগ করার আগে সুলতানের কাছে বিদায় নিতে গেলো তারা। নানারকম সুন্দর সুন্দর বাহারী জিনিস উপহার দিলো সুলতান। মিশনের সুলতানের জন্যেও দিলো আরও অনেক মূল্যবান উপটৌকন। এর পর আজীব, হুসন, হাসানের মা আর নফরচাকিরদের সঙ্গে নিয়ে বাসরাহ ছেড়ে ফিরে চললো সামস্-আল-দীন।

কয়েকদিন পরে আবার তারা এসে পৌঁছলো দামাসকাসে। দু’একদিন একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে আবার তারা তাঁবু গাড়লো ঐ একই জায়গায়। সামস-আল-দীন বললো, এখানে কয়েকটা দিন থাকবো আমরা। সুলতানের জন্যে কিছু কেনাকাটা করবো। এখানকার বাজারে।

পরদিন উজির গেলো বাজারে—সওদাগরী দোকানে। আজীব তখন আব্দার ধরলো, বাবা সাইদ চলো আমরা শহরে এদিক ওদিক একটু ঘুরে আসি। মজার মজার কত কি দেখা যাবে। তা ছাড়া ওই হালুইকর লোকটা কেমন আছে তাও একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। আহা, লোকটাকে সেদিন অমন করে ঘায়েল না করলেই হতো। কি সুন্দর মেঠাই খেতে দিয়েছিলো আমাদের।

সাইদ বললো, যা বলবে, মালিক।

আজীব আর সাইদ দামাসকাসের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। কত সুন্দর সুন্দর সাজানো গোছানো দোকানপাট কত মজার মজার উট, গাধা, আর ঘোড়ার মিছিল। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। সূর্য পাটে বসেছে। দেখলো দলে দলে মুসলমানরা চলেছে বানু য়ুমায়াদ মসজিদে সন্ধ্যাকালীন নামাজ পড়তে। আজীবের চিনতে অসুবিধা হলো না, সেই হালুইকরের দোকানের সামনে এসে পড়েছে তারা। দোকানের বাইরে থেকেই দেখতে পেলো, আজও সে সেই বেদনার হালওয়া বানিয়েছে। খুশবুতে ভরে গেছে চারপাশ। দোকানের ভিতর উকি দিয়ে দেখলো দোকানি আছে কিনা। তার মাথার ঘাটা শুকিয়েছে কিনা, তাও একবার দেখতে চায় সে। দেখলো, ঘা শুকিয়েছে কিন্তু দাগটা মিলায়নি।

-কেমন আছো গো, হালুইকর। সারাটা পথ তোমার কথাই ভাবতে ভাবতে আসছি। আমাকে চিনতে পারছে তো! আহা, সেদিন জকবর লেগেছিলো তোমার।

হঠাৎ আজীবকে সামনে দেখে হাসান কেমন হতভম্ব হয়ে পড়ে। জল ভর্তি গামলাটা হাত থেকে পড়ে যায়। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। মাথাটা বঁই বঁই করে ঘুরতে থাকে। জীভটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারে না। মুহুর্তমাত্র। তার পরে নিজেকে সংযত করে বলে, ভিতরে এসো, মালিক। যদি মেহেরবানী করে আজকেও একটু মিষ্টি-মুখ করো খুব খুশি হবো। আল্লাহ জানেন কেন, সেদিন তোমাকে দেখা অবধি দিন রজনী তোমার কথা মন থেকে সরাতে পারি না। কী যাদু আছে তোমার ঐ চোখে। ঘুমের ঘোরেও তোমার ঐ চোখ দু’টো ভেসে ওঠে আমার সামনে। তোমাদের পিছু ধাওয়া করা আমার খুব বোকামী হয়ে গিয়েছিলো। স্ত্ৰে জন্যে পরে আমাকে অনেক অনুতাপও করতে হয়েছে।

আজীব বলে, তুমি তো ভারি সাংঘাতিক লোক! আদর করে ডেকে মেঠাইমণ্ডা খাইয়ে আবার আমাদের জানে ভয় ধরানোর জন্যে পিছু ধাওয়া করেছিলে! কিন্তু কেন? আজ আর তোমার দোকানে ঢুকবো না। আগে হলফ করো আমাদের পিছু নেবে না, তবে তোমার হালওয়া খেতে পারি। না হলে আর ককখনো আসবো না তোমার দোকানে। আমরা এবার এক হাপ্ত থাকবো দামাসকাসে। আমার দাদু সুলতানকে ভেট দেবার জন্যে হরেক রকম বাহারী সওদা করবে।

—আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, বাছা। আর কখনও তোমাদের পিছু নেবো না। এসো ভিতরে এসো।

আজীব আর সাইদ খুব মৌজ করে খেতে থাকলো সুন্দর মিষ্টি আর মধুর সেই বেদানার হালওয়া। আজীব বললো, ও হালুইকর, কই তুমিও এসো, তুমিও খাও আমাদের সঙ্গে। আল্লাহর কাছে দেয়া মাঙ্গো, যাতে আমার বাবাকে খুঁজে পাই।

হাসান ওদের সামনে এসে বসলো; অপালক ভাবে আজীবকে দেখতে থাকে। কোন কথা বলতে পারে না। তার একভাবে চেয়ে থাকার ভঙ্গটা ভালো লাগে না আজীবের। একটু বিরক্ত হয়েই বলে, হাঁ করে কি আমন দেখছো, বলে তো। আমার মুখে কি বেদনার হালওয়া মাখানো আছে~~ চেটে চেটে খাচ্ছে? দোহাই বাপু, তোমার চোখ দুটো সরাও। গিলে খাবে নাকি আমার মুখটা।

হাসান হাসে। রাগ করে না। ওর কথায়, কবিতা করে বলে?

তোমার ইশারায় সূর্য যদি নিভে যায়—যেতে পারে,
রূপোলী তারারাও খসে যেতে পারে হয়তো বা,
চাঁদকেও ছিঁড়ে নিলে নিতে পারো—হতে পারো আরও শক্তিধর।
তবু বলি শোনো বন্ধু,
আন্দাজ পাবে না। আমার অপার আনন্দ উৎসর।

এছাড়াও হাসান আরও সুন্দর সুন্দর ছড়া, শায়ের শোনাতে লাগলো। আজীব আর সাইদকে। কথা আর কবিতায় ভুলিয়ে রাখলে তাদের খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরেও প্রায় এক ঘণ্টা। তারা বুঝতেই পারে না, কিভাবে এতোটা সময় কেটে যায়। মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে দুজনে। একটা বাটিতে ঈষৎ গরম জল এনে নিজে হাতে আজীবের হাত ধুইয়ে দেয়। তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেয় হাত আর মুখ। কুলুঙ্গী থেকে গুলাবজলের পিচকারীটা নামিয়ে এনে পিচকারী করে দেয় তার গায়ে। তারপর দু’ গ্লাস সরবত এনে সামনে রাখে।–নাও, খাও।

সুন্দর সুমিষ্ট গুলাবের সরবৎ। খেয়ে মন ভরে যায় দুজনের। খাওয়াদাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে তারা, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তাঁবুতে ফিরে দেখে মা দাদী সবাই চিন্তিত হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বিদেশ বিভূঁই জায়গা-কি জানি কি হয়। আজীব ছুটে গিয়ে প্রথমে মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। তারপর দাদীকে। দাদী তো কেঁদে আকুল। বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি, ভাই?

—বাজারে দাদী।

—তবে তো খিদে পেয়েছে খুব। আয়, খেতে দিই।

উঠে গিয়ে একটা সুদৃশ্য চীনামাটির পিরিচে করে খানিকটা বেদানার হালওয়া এনে রাখে আজীবের সামনে। বসরাহতে প্রায়ই করে খাওয়াতো সবাইকে। খেয়ে সবাই তারিফ করতো তাকে। এমন সুন্দর মেঠাই শহরের কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যেতো না। বানাতে পারতো না কেউ। হাসানের মারি এটা নিজস্ব আবিষ্কার বলা যায়। সাইদকেও বলে, তুমিও তোমার মনিবের সঙ্গে বসে যাও, খেয়ে দেখো, আমার তৈরি বেদনার হালওয়া কেমন লাগে। তোমাদের মিশরে কেন, দুনিয়ার কোথাও কেউ বানাতে পারবে না এ জিনিস।

হতভাগ্য খোজা সাইদ হাসতে চেষ্টা করে।–জী আজ্ঞে এখন দেবেন না। হুজুরের সঙ্গে বসে খাবো, তাকি হয়?

আজীব খানিকটা হালওয়া মুখে পুরে এগাল ওগাল করতে থাকে। কিন্তু বিচ্ছিরি স্বাদ। চিনি কম, খুশবু নাই। কেমন এক অদ্ভুতভাবে মুখবাদান করে আজীব বলে, এ কেমন হালওয়া, দাদী, একদম ভালো হয়নি।

-কী বলছিস, দাদু। আমি বানাতে জানি না? এক সময়ে এই বেদানার হালওয়া খেয়ে তোর বাবা কি তারিফ করতো। কেমন করে কি কি মসলাপাতি দিয়ে আমি বানাই-সব শিখে নিয়েছিলো আমার কাছে। পরে আমাকে করেও খাওয়াতো মাঝে মাঝে। তা আমার চেয়ে খারাপ হতো না। তাই বলে আমার হালওয়ার নিন্দে তো শুনিনি তার কাছে। তুই তার ব্যাটা হয়ে আমার নিন্দে করছিস আজ?

আল্লা সাক্ষী, দাদামা, আমি কোন বানিয়ে বলছি না। সত্যিই তোমার মেঠোঁই-এ মিষ্টি কম হয়েছে। আর সেই খুশবু কোথায়—নাকে লাগলেই জিভে জল আসে? তাহলে তোমাকে সত্যি কথাটা বলেই ফেলি, দাদী। কিন্তু খবরদার মা আর দাদু যেনো জানতে না পারে। তাহলে একেবারে কোতল করে ফেলবে। আমি আর বাবা-সাইদ এইমাত্র বাজারের একটা হালুইকরের দোকানে খেয়ে এসেছি। এই বেদানার হালওয়া। এই—সা চমৎকার খেতে, কী বলবো তোমাকে। গন্ধ পেলে মরা মানুষ উঠে বসে খাবে। এখনো মুখে লেগে আছে তার স্বাদ। তাই তোমারটা আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, ওর কাছে একেবারে পানসে। তুমি বোধ হয়, ঠিক ঠিক মশালা-পাতি যা লাগে, দিতে পারেনি।

তখন দাদীমা রেগে আগুন হয়ে সাইদকে বললো…

এই সময় প্রায় সকাল হয়ে যাচ্ছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

দুনিয়াজাদ বললো, তোমার বলার কি মিষ্টি কায়দা, দিদি! আর কী করেই বা বলো এমন সুন্দর কিসসা।

শাহরাজাদ বলে, এখনো তো গল্পটা শেষ হয়নি। কাল রাতে বাকীটা যখন শুনবে, আরও ভালো লাগবে। নাও, এখন ঘুমিয়ে পড়ে।

শারিয়ার ভাবে, মেয়েটার গল্পগুলো সব শুনতে হবে। তারপর ওকে মারবো। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে ওরা। দরবারের সময় হলে উঠে শাহজাদার সাজে-সজ্জিত হয়ে দরবারে যায়। এক এক করে হকুমতের সব কাজ সমাধা করে দিনের শেষে আবার অন্দর মহলে ফিরে আসে। শারিয়ার। রক্তে ধরেছে গল্প শোনার নেশা। শাহরাজাদও প্রতীক্ষায় ছিলো তারই।

 

চব্বিশতম রজনী। ওদের দৈনন্দিন কাম কলা শেষ হবার পর নিচের কাপেট থেকে উঠে আসে দুনিয়াজাদ। বলে, এবার তোমার কাহিনী শোনাও, দিদি।

শাহরাজাদ বলতে থাকে : শুনুন, জাঁহাপনা, তখন আজীবের দাদীমা আগুন হয়ে সাইদকে বললো, হতভাগা কোথাকার এই ভাবে ছেলেটার সর্বনাশ করেছে? এতো বড় স্পর্ধা তোমার কি করে হলো, একটা তুচ্ছ হালুইকরের দোকানে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়েছিলে তাকে। মান ইজ্জত কিছুই গ্রাহ্য করেনি। এতো বড়ো শয়তান তুমি।

সাইদ বেমালুম অস্বীকার করে। —না দাদীমা, ওর কথা ধরবেন না। হালুইকরের দোকানে যাইনি। আমরা দোকানটার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছি শুধু।

কিন্তু হাঁদা গঙ্গারাম আজীব এর গুঢ়াৰ্থ বুঝলো না। চিৎকার করে তাবু মাথায় করলো। —হেই আল্লাহ, কি বলে শোনো, আমরা বলে যাইনি দোকানে। আমরা দোকানে বসলাম। দোকানী কত আদর করে বেদানার হালওয়া খেতে দিলো। আমি খেলাম, তুমিও খেলে। আবার বলে দোকানে যাই-ই নি। একেবারে সব ভুলে মেরে দিয়েছে? তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে বাবা-সাইদ। হেকিম দেখাও। দাদীমা ওর কথা শুনো না, আমরা সত্যিই গিয়েছিলাম। আর পেট পুরে খেয়েছিও দুজনে।। আঃ, কী সুন্দর হালওয়া দাদী, কী তার বাস, আর কী তার স্বাদ। গন্ধেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়।

হাসানের মা এবারে উজিরের কাছে ছুটে যায়। নালিশ জানায়, ঐ কালো কুৎসিৎ খোজটা কি সাংঘাতিক কাণ্ড করেছে, আপনি একবার শুনুন।

হাসানের মার কাছ থেকে সব শোনার পর উত্তেজিত হয়ে সাইদকে ডেকে পাঠায় উজির। উইিকেত যা শুনেছি, সব ঠিক? আজীবকে নিয়ে তুই হালুইকরের দোকানে গিয়েছিলো।

—জী হুজুর, না।

ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সাইদ। কিন্তু আজীব বলে ডাহা মিথ্যে কথা, দাদু। ও আর আমি দু’জনেই খেয়ে এসেছি। হালুইকরের দোকানে। পেট পুরে বেদনার হালওয়া খাওয়ার পর আবার এক গেলাস করে গুলাবের সরবৎও খেতে দিয়েছিলো আমাদের। ভারি সুন্দর। দিল ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

সাইদ কিন্তু তখনও বলে, না তারা সেখানে যায়নি, বা খায়নি।

উজির বলে, ঠিক আছে, এক্ষুণি প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। এখানে বোস। আমার ভাইয়ের বিবি যা বানিয়েছে পেট ভরে আজ খেতে হবে তোকে। একটুও নষ্ট করতে পারবি নে। তাতেই বোঝা যাবে, খেয়েছে কি খাওনি।

সাইদ প্ৰাণপণে পেটে পুরে নেবার চেষ্টা করলো। যতটা সম্ভব। কিন্তু প্রথম গ্রাসটাই গিলতে পারলে সে। বমি করে ফেললো। পেটে আর জায়গা থাকলে তো ঢুকবে। মিথ্যে করে আবার একটা গপ্পো বানিয়ে বলে, গতকাল নফরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোগ্রাসে অনেক কিছু খেয়ে ফেলেছিলো সে। তাই আজ সারাটা দিন পেটের গোলমাল চলছিলো। বদহজম।

কিন্তু উজির বুঝতে পারলো, আগাগোড়া পুরোটাই মিথ্যে বলে যাচ্ছে! অন্য একটা নফরকে ইশারা করতেই দোমাদম পেটাতে শুরু করলো সাইদকে। পিটুনির ঠেলায় কবুল করলো, হ্যাঁ, সে আর আজীব হালুইকরের দোকানে খেয়ে এসেছে। এবং তার কথা থেকে এও বেশ বোঝা গেলো, সেই বেদনার হালওয়া সত্যিই অপূর্ব। তার কাছে দাদীমার হালওয়া এককথায় অখাদ্য’।

উজির হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু হাসানের মা আরও আহত, আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। তার অহঙ্কারে আঘাত লেগেছে। —মিথ্যেবাদী। বিশ্বাস করি না, আমার চেয়ে ভালো বেদোনার হালওয়া কেউ বানাতে পারে। আমার হাতের জিনিস খেয়ে দুনিয়াশুদ্ধ লোক বাহবা দিয়েছে এতোকাল। আর ওরা বলছে আজ, আমার হালওয়া মুখে তোলা যায় না। যা, নিয়ে যা একটা বাটি, নিয়ে আয় দেখি, তোর কেমন সে হালওয়া। আমার স্বামীর বড়ভাই খেয়ে বিচার করবেন, কারটা ভালো।

সুতরাং সাইদ একটা চিনেমাটির বাসন আর আধলা দিনার নিয়ে রওনা হয়। হালওয়া আনতে। দোকানে এসে হালুইকরকে বললো, দেখো ভাই, আমাদের বাড়ির একজন খানদানি আদমি তোমার ঐ বেদানার হালওয়া খাবে। আমাকে এই বাটিটায় আধ দিনারের মতো দাও। বাড়িতেও আজ এই হালওয়া বানানো হয়েছে। দু’টো একসঙ্গে খেয়ে যাচাই করা হবে, কোনটা বেশী ভালো। সেই জন্যে বলছি, ভালো জিনিস দিও আমি আর খেয়ে দেখতে চাই না, কারণ তোমাকে আমার বিশ্বাস আছে।

–ঘাবড়াও মাৎ। এমন জিনিস দেবো, খেয়ে তাক লেগে যাবে। এ জিনিস এক আমার মা ছাড়া সারা দুনিয়ায় কেউ বানাতে জানে না। আজ সে এখন অনেক দূর দেশে থাকে।

বাটিটা ভর্তি করে হালওয়া দিয়ে তার উপরে ছিটিয়ে দিলো একটু গুলী/বজল। সাইদ নিয়ে এসে দিলো দাদীমার হাতে।

বাটিটা হাতে নিয়েই চোখে দেখার জন্য একটুখানি তুলে মুখে দিলো সে। আর তৎক্ষণাৎ আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেলো হাসানের মা।

হালওয়ার এক টুকরো জিভে ঠেকাতেই বুঝতে পারলো, এ আর কারো নয়, তার পুত্র হাসানের নিজের হাতের জিনিস। উজির এবং আর যে যেখানে ছিলো, ছুটে এলো। জলের ঝাপটা দেওয়া হলো চোখেমুখে। একটু পরে জ্ঞান ফিরলো। বললো, এ হালওয়া আমার ছেলে হাসানের তৈরি। দুনিয়াতে সে ছাড়া এর কৌশল আর কারো জানা নাই। আমি নিজে হাতে তাকে শিখিয়েছি। আর আমি কারো কাছ থেকে শিখিনি। নানা রকম খাবার তৈরি করা আমার শখ ছিলো। নানা রকম মাল-মশলা দিয়ে বানাতে বানাতে একদিন হঠাৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো এই বেদনার হালওয়া। আমি শুধু তাকেই শিখিয়েছিলাম, আর কাউকে নয়।

উজিরের তখন অবস্থা কাহিল। হারানো মণি খুঁজে পাওয়ার অদ্ভুত এক আনন্দে কাঁপয়ে জ্বর এসে গেলো তার। —শেষে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন।

কিন্তু তখন কী করা যায় কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারে না উজির। একটু ভেবে সাইদকে বললো, জনা-বিশেক নফর সঙ্গে নিয়ে এক্ষুণি যাও সেই দোকানে। যেমন করে পারো বেঁধে ছেদে তুলে নিয়ে আসবে তাকে। কিন্তু দেখো, তার যেনো কোন চোট না লাগে।

উজির নিজে একটা ঘোড়ায় চাপলো। মিশরের সুলতানের দেওয়া পরোয়ানাখানা সঙ্গে নিয়ে ফামাসকাসের কাইরেনি হুকুমদারের দপ্তরে গিয়ে পৌঁছালো। হুকুমদার আদর অভ্যর্থনা করে বসালে তাকে। জিজ্ঞেস করলো কাকে আপনি কয়েদ করতে চান?

—এই বাজারের এক হালুইকরকে।

—এ আর এমন বেশী কি কথা, আমি এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জনা কয়েক সিপাই বীরকন্দাজ পাঠিয়ে দিলো তখনি। তাদের বলে দিলো, উজির সাহেবের লোকজন সেখানে গেছে, তোমরা গিয়ে দেখো, যদি দরকার হয়। সাহায্য করবে তাদের।

সামস-আল-দীন তখন হুকুমদারের দপ্তর থেকে সোজা তাঁবুতে ফিরে এলো।

একদল লোক লাঠি-সোটা কোদাল গাইতি নিয়ে হাজির হলো কালুইকরের দোকানের সামনে। নিমেষে ভেঙে চুরমার করে দিলো সব। মেঠাই মণ্ড যা তৈরি হয়েছিলো সব ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারা। তারপর হাসানকে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে চলে আসতে থাকলো। নফরের পিঠে চেপে আসতে আসতে ভাবে হাসান, খানিকটা বেদনার হালওয়া যে এমন বেদনাদায়ক হতে পারে স্বপ্নেও ভাবেনি সে।

হাসানকে যখন উজিরের সামনে নামানো হলো, তখন সে কান্নায় ফেটে পড়লো।–কী আমার গুনাহ, হুজুর?

—তুমি তৈরি করেছিলে সেই বেদানার হালওয়া?

—জী হুজুর। কেন, বে-আইনী কোনো কাজ করেছি আমি?

–বে-আইনী? তাতে আর কী শাস্তি তোমার হতে পারে। তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।

একজন নফরকে একটা বড় কাঠের বাক্স কিনে আনতে বললো| উজির। হাসানকে সেই কাঠের বাক্সে ভরে উটের পিঠে চাপিয়ে কইরো নিয়ে যেতে হবে।

উজির ভাবে, এখন ওর মা, হুসনকে কিছু বলা হবে না। মিশরে পৌঁছনোর পর জানাবে সব।

তাঁবু গোটানো হলো। উজির তার দলবল নিয়ে কইরোর পথে রওনা হয়ে পড়লো। দিনের পর দিন তারা চলতে থাকে। আহারের সময় হলে হাসানকে নামানো হয় কিছুক্ষণের জন্য। খানাপিনা শেষ হলে আবার বাক্সে পুরে চাপানো হয়। উটের পিঠে। এইভাবে আরও কয়েকদিন কাটে। হাসানকে মাঝে মাঝে নামিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে উজির। —তুমি নিজে হাতেই কি বানিয়েছিলে সেই বেদনার হালওয়া?

হাসান জবাব দেয়, জী হুজুর।

উজির তখন হুকুম দেয়, লোকটাকে বাক্সে পুরে আবার উটের পিঠে চাপাও।

অবশেষে তারা কইরোর সীমানায় এসে পৌছয়। শহরের এই শেষ প্রান্তে জায়দানিয়াহ ময়দানে সেনা বাহিনীর ছাউনি। উজিরের নির্দেশে ময়দানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো তার দলবল। হাসানকে নামিয়ে আনতে বললো। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামিয়ে উজিরের সামনে দাঁড় করানো হলো। পিছমোড়া করে বাঁধা হাসান। বুঝতে পারে না সে, কী তার অপরাধ। আর কী সাজাই বা তাকে পেতে হবে। মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে উজিরের সামনে। উজিরের নির্দেশে একজন ছুতোর মিস্ত্রি এলো। উজির বললেন, এই লোকটার মাপে একটা কাঠের ক্রুশ বানাও। জলদি। তারপর সেই ক্রুশে তার হাত পা কোমর গলা রশি দিয়ে বেঁধে একটা মোষের গাডির পিছনে বেঁধে দাও।

হাসান কেঁদে ওঠে, একি করছেন হুজুর।

উজির হুঙ্কার ছাড়ে, আমি তোমাকে ক্রুশে গেঁথে মারবো। এখন তোমাকে গাডির পিছনে বেঁধে ছেচড়াতে ছেচড়াতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। শহরবাসীরা আগে দেখুক তোমাকে। তারপর ক্রুশে গাঁথা হবে তোমাকে।

–কিন্তু আমার কি অপরাধ?

—অপরাধ? তুমি সেই বেদানার হালওয়াতে ঠিকমতো মরিচের গুড়ো মেশাওনি। এই তোমার অপরাধ।

এই কথা শুনে নিজের গাল নিজে থাবড়াতে থাকে হাসান।–হায় আল্লাহ, এই একটা তুচ্ছ ব্যাপারে একেবারে ফাঁসীর হুকুম। এই জন্যে আপনি আমাকে এতোদিন ধরে হাত পা বেঁধে বাক্সে পুরে রেখেছেন? সারা দিনে দানা পানি বলতে গেলে নামে মাত্র একবার দিয়েছেন? এতো অত্যাচার করেছেন, এতো কষ্ট দিয়েছেন তাতেও আপনার সাধ মিটলো-না। তাতেও আমার অপরাধের সাজা হলো না? এরপর আমাকে ক্রুশে গেঁথে মারলে তবে আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হবে?

—ঠিক, ঠিক, ধরেছে। তবেই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। ঠিক মতো কেন দাওনি তুমি মরিচের গুড়ো? কেন দাওনি? সেজন্যে এই-ই তোমার যোগ্য সাজা!

হাসান মাটির উপর বসে পড়ে। দু’ চোখে জলের ধারা। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে ভেবে আকুল হয়।

একটু পরে উজির প্রশ্ন করে, কী, ভাবছ কী?

–নাঃ, কিছু না। শুধু ভাবছি, আপনার মতো মাথা মোটা লোকগুলো দেশের শির-মণি হয়ে আছে বলেই দুনিয়ার আজ এই দশা। আপনার মতো গর্দভের হাতে যদি দেশের শাসনভার না থাকতো তাহলে আমার মতো নির্দোষ নিরীহ লোকের এইরকম তুচ্ছ কারণে এইভাবে জান খোয়াতে হতো না। ইহঁ! অপরাধ কী? না, ঠিক মতো মরিচের গুড়ো মেশানো হয়নি—বেদনায় হালওয়ায়। এই না হলে কাজীর বিচার।

উজির তখন গম্ভীর চালে মাথা দুলিয়ে বলে, আমাকে তো দেখতে হবে, আবার যাতে তোমার কাজে তুমি ফাকি না দাও!

—কিন্তু, হাসান বলে, লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখলে তবে তো বোঝা যাবে-পরে সে তার কাজে ফাকি দেবে কি দেবে না?

উজির বলে, সে হয় না। তোমার তো আর একদিনের দোষ না। রোজই তুমি এই বেদানার হালওয়া বানিয়েছে আর রোজই লোককে ফাকি দিয়েছে। ঠিক মতো মরিচের গুড়ো মেশাওনি। প্রত্যেক দিনের অপরাধ তিলতিল করে জামে এখন পাহাড় হয়ে গেছে। তা একদিনের ফকির জন্যে যদি এক ঘা বেতের সাজা হয় তবে তুমিই ভেবে দেখো, এক সঙ্গে জমা হলে এতো কালের অপরাধের সাজার পরিমাণ কী দাঁড়ায়। মৃত্যুদণ্ড তো কমই হলো, আমার হিসাবে আরো বেশী সাজা পাওয়া উচিৎ তোমার।

হাসান ভাবে, প্রতিবাদ করে, কথা কাটাকাটি করে কোন লাভ নাই। শুধু বলে, উন্মাদের সঙ্গে তর্ক করা যায় না।

হাসান আর উজিরের মধ্যে যখন এইসব তর্ক বিতর্ক চলছিলো, ছুতোর তখন তার কাজ করে চলেছে। আর মাঝে মাঝে হাসানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আহা, বেচারা, আর একটু বাদেই ক্রুশটা তৈরি হয়ে যাবে। তখন কি আর ও অমনিভাবে উজিরের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করতে পারবে?

সন্ধ্যা নেমে এলো। হাসানকে আবার সেই কাঠের বাক্সে ভরা হলো। উজির গর্জে ওঠে, কাল তোমাকে ক্রুশে গাঁথা হবে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো, উজির। অন্য দিনের মতো আজ আর তাড়ফানি নাই হাসানের। বাক্সের মধ্যে ভরার পরই নেতিয়ে পড়লো। তার পর যখন দেখলে সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, লোকজনদের বললো, এবারে চলে আমার ইমারতে।

ঘরে ফিরে আসার পর এই প্রথম সিৎ-অল-হুসন আর হাসানের মা-র কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললো, উজির।

প্রথমে সে গেলো কন্যা হুসন-র ঘরে। মেয়েকে আদর করে বললে, বেটা, এতো দিন তোর দুঃখ কাটলো। এবারে তোর মুখে হাসি দেখবো। ওঠামা, উঠে বোস, ভালো করে সাজগোজ কর। আমি তোদের বলিনি। হাসানকে আমি খুঁজে পেয়েছি। তাকে নিয়ে এসেছি। সঙ্গে করে। নে, ওঠ। আনন্দ করা। শাদীর রাতে যেভাবে বাসর সাজানো হয়েছিলো, মনে আছে?

আছে আব্বাজান। —ঠিক ঠিক সেই ভাবে সাজাতে হবে। আবার আজ হুবহু সেই ভাবে যেখানে যেমনটি ছিলো। যদি অসুবিধে হয়, সিন্দুক খুলে কাগজখানা বের কর। সব নিখুঁত করে লেখা আছে।

আনন্দের ঢেউ খেলে গেলে হুসন-র মনে। নফরদাসী লোকজন ডাকা হলো তখুনি। হুসন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করে তাদের দিয়ে বাসরঘর সাজাতে লাগলো। ঠিক যেমনটি সাজানো হয়েছিলো শাদীর রাতে। যদি কোন ভুলচুক হয়ে যায়। সেজন্যে সিন্দুক থেকে বাবার লিখে রাখা সেই কাগজখানা বের করলো। চেয়ার টেবিল খাট পালঙ্ক যেখানে যা ছিলো ঠিক তেমনি করে সব সাজানো হলো। শাদীর রাতে যারা উপস্থিত ছিলো তারা যদি দেখে, তো তাজ্জব বনে যাবে।

সব সাজানো গোছানো হয়ে গেলে উজির সিন্দুক খুলে বের করলো হাসানের সেই পাতলুন, ইজের, টুপী আর মোহরের বটুয়া। চেয়ারের উপর রাখলে টুপী। আর টুপীর নিচে রাখলে সেই বটুয়া—যার মধ্যে আছে এক হাজার সোনার মোহর আর সেই ইহুদী সওদাগরের লেখা একখানা চিরকুট। খাটের বাজুতে রাখলো পাতলুন ঠিক শাদীর রাতে যেমনটি রেখে ছিলো হাসান। আর এলোমেলো বিছানার উপর ফেলে রাখলে তার দড়ি ছোড়াইজেরখানা। সব শেষে উজির নিজে হাতে পাতলুনের কোমর বন্ধনীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো সেই নূর-আল-দীনের সই করা ঠিকুজী পত্বখানা। সূচসুতো দিয়ে সেলাই করে দিলো—ঠিক যেমনটি ছিলো তেমনিভাবে। তারপর হুসনকে বললো, মা, ঠিক শাদীর রাতে হাসানের সঙ্গে পালঙ্কশয্যায় শোবার আগে যে অবস্থায় ছিলে তেমনি বিবস্ত্রা হয়ে শয্যায় শুয়ে পড়ে তুমি। হাসানকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে এলে সেদিন যেভাবে তাকে আদর অভ্যর্থনা করে কাছে নিয়েছিলে ঠিক তেমনিভাবে গ্রহণ করো। হুসন-র ঘর ছেড়ে হাসানের কাছে চলে গেলো। উজির। সেই কাঠের বাক্সর ভিতরে হাসান তখন ঘুমে অচৈতন্য। উজিরের ইশারায় নফররা টেনে বের করলে তাকে। কিন্তু ঘুমে গলে গেছে সে। পরনের কামিজ পাতলুন সব খুলে ফেলে উলঙ্গ করা হল। শুধু একটা দামী রেশমীর কোর্তা আর মাথায় একটা সাদা পাড়ের টুপী পরিয়ে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রেখে এলো হুসনা-র ঘরের মেজেয়-গালিচার উপর।

এক সময় হাসানের ঘুম ভাঙ্গে। চোখ মেলে অবাক হয়। সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি। আবার চোখ বন্ধ করে। না, স্বপ্ন তো নয়। এই তো সেই ঘর। সেই পালঙ্ক। সেই হুসন শুয়ে আছে। ঠিক যেমনটি সেই শাদীর রাতে দেখেছিলো। সব-সব হুবহু একই রকম। কিন্তু তা কি করে হয়! সে তো কতকাল আগের কথা! নাঃ, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে থাকে। পায়ের আঙুল দিয়ে টিপে গালিচার মসৃণতা অনুভব করে। না না, তা কি করে হয়? এই বাসর-শয্যা এই ঝাড়বাতি, এই ফুলদানি, এই আতরের খুশবু এ যেমন সত্যি তেমনি সে যে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় একটা কাঠের বাক্সে বন্দী হয়েছিলো তাও তো আরো সত্যি। কিন্তু দুটোর মধ্যে আশমান-জমিন ফারাক। কী করে সম্ভব হতে পারে?

একবার মনে হয়, সে বুঝি পাগল হয়ে গেছে। তা বিচিত্র নয়। উজির তাকে যে অত্যাচার করেছে এবং যে সাজা দেবার ফরমান দিয়েছে, তাতে যে কোন সুস্থ লোকই পাগল হয়ে যেতে পারে?

হঠাৎ চোখ পড়লো, চেয়ারের উপরে রাখা তার বাহারী সেই বসরোহর টুপী। সোনার পাতে মোড়া। নানা কারুকার্যকরা। টুপীটো তুলে দেখলো, হাঁটা ঠিক তেমনি রাখা আছে সেই মোহরের থলিটা। খুলে দেখলো, সব ঠিক আছে। সেই ইহুদী সওদাগরের চিরকুটটা দেখে মনে পড়লো, একখানা জাহাজ কেনার পাল্টা রসিদ করে দিয়েছিলো সে। ওপাশে খাটের বাজুতে রাখা পাতলুনটা তুলে নিলো। হ্যাঁ, এও তারই। কোমর বন্ধনীতে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো, সেই তুলেটি কাগজে লেখা, তার বাবার সই করা, সেই কুলজীপত্বখানা-ঠিক যেমন ছিলো তেমনি আছে। যতই দেখতে থাকে ততই কেমন গোলমাল হয়ে যায়। হিসাব মেলাতে পারে না কিছুতেই।

একপা একপা করে পালঙ্কের পাশে এগিয়ে আসে হাসান। পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে হুসন। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক পাওয়ার প্রশান্তি। দু-চারটে খুচরো চুল এসে পড়েছে গালে। অধরে মৃদু মিষ্টি হাসির রেখা। বন্ধ চোখের কোণে কাজল আর সুরমার মাখামাখি। রাত্রির অত্যাচারে মুখের প্রসাধন মুছে গেছে। ভয়ে ভয়ে বিছানায় বসে ওর কপোলের চুলগুলো সরিয়ে দিলো হাসান। আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকালো হুসন।-বাব্বাঃ সেই কখন গোসল খানায় ঢুকেছো, আর এই এখন বেরুলে! ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি, সোনা?

দু’হাত বাড়িয়ে হাসানকে বুকে টেনে নিতে চায় হুসন।—আরো কাছে এসো না? অমান হা করে কী দেখছো আমাকে। এতো করে দেখলে তবু আশ মিটলো না? সকাল হয়ে গেছে। এখন অর হবে না।

হুসনির কথা শুনে বোকার মতো হাসে হাসান। হিহিহি। হো হো হো। ভারি মজার খোয়াব তো? আবার ভাবে, নাঃ, নিশ্চয়ই সে হাসিস গাঁজা কিছু একটা খেয়েছে। না হলে এমন অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা কখনো হতে পারে। হুসনকে ছেড়ে দিয়ে তড়াক করে উঠে পড়ে সে। ছানাবড়ার মতো চোখ করে, হাত দু’টো কানের দু’পাশে তুলে ধরে, একপা একপা করে পিছু হটতে থাকে। যেন কোন সাপটপ তাড়া করেছে। হঠাৎ দাড়াম করে আছড়ে খেয়ে পড়ে যায় গালিচার উপর। হুসন আর হাসি চাপতে পারে না। বিছানায় উঠে বসে বলে, আহা, লাগলো নাকি! তা তুমি আমন করছে কেন সোনা। কোনো নেশাভাঙা করেছে নাকি?

–নেশা ভাঙ? কি নেশা ভাঙ? হাসিস? গাজা? আফিং?

—তা আমি কেমন করে বলবো। ভালো মানুষ, ফুর্তি করলে কত, কাজকাম সেরে ছোটাঘর-এ গেলে। তারপর তো আমি কিছু জানি না। তুমি ওখানে নেশা করেছে বা ঘুমিয়ে পড়ে খোয়াব দেখেছে। আমি জানবো কি করে? তবে তোমার দেরি হয়েছে বেশ। তা ঘণ্টাখানেক হবে।

—ঘণ্টা খা-নেক। তা হলে তো মনে হয় আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি সব যাতা স্বপ্ন দেখেছি। দেখছি, দেখছি, দামাসকাসে আমি একটা হালুইকরের দোকান করেছি। নিজে হাতে মেঠাই মণ্ডা বানিয়ে বিক্ৰী করি।

হুসন হেসে লুটিয়ে পড়ে।-ওমা তুমি হালুইকর-এর কাজ জানো নাকি?

–ছোট বেলায় আমার মার কাছ থেকে বেদানার হালওয়া তৈরি করা শিখেছিলাম। খেতে খুব মজাদার। তোমাকে করে একদিন খাওয়াবো। তা শোনো, সেই দোকানে একদিন একটা বাচ্চা ছেলে এলো। কি সুন্দর দেখতে, তোমায় কি বলবো, যেন বেহেস্ত থেকে নেমে এসেছে। তাকে আদর করে ডেকে আমার নিজের হাতের তৈরি সেই বেদনার হালওয়া খাওয়ালাম। আর সেই আমার কাল হলো।

হুসন চোখ বড় বড় করে শুনছে। বলে, কী হলো?

হাসান বলে সন্ধ্যাবেলা ছেলেটাকে আর তার নফরটাকে হালওয়া খাইয়ে ছেড়ে দিলাম। তার খানিক পরে একদল লোক এসে আমার সেই দোকানটা ভেঙে চুরে তছনছ করে দিলো। রাস্তায় ছুঁড়ে দিলো মিঠাই-মণ্ডাগুলো। আমাকে পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধলো।

হুসন অবাক হয়।—কেন, কেন বাঁধলো?

—কি করে বলবো, বলে। যারা বাঁধলো তারাও বলতে পারলো না। উজিরের হুকুম, তাই। যাই হোক উজিরের সামনে হাজির করা হলো আমাকে। আমাকে দেখেই উজির হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, হুম, তুমি বানিয়েছে বেদানার হালওয়া?

হুসন বলে, তা বানিয়েছে তো হয়েছে কি? কেন, খেয়ে কি সেই ছেলেটার অসুখটসুখ করেছিলো নাকি?

—আরে নানা, সে সব কিছু না। যাইহোক শোনো, উজির তার লোকজনদের হুকুম করলো, আমাকে একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে পুরে উটের পিঠে চাপিয়ে কইরো নিয়ে যেতে হবে।

হুসনর মুখ শুকিয়ে যায়। কাঠের বা-ক-সে পুরে? তোমাকে? দেখি দেখি, তোমার হাত-পা ছড়ে গেছে কিনা!

হাসান হেসে বলে, দূর বোকা মেয়ে, স্বপ্নে হাত-পা ছড়ে যাবে কি করে? এতো আর সত্যি সত্যি না। তারপর শোনো, আমাকে তো কাঠের বাক্সে ভরে উটের পিঠে চাপিয়ে কইরো আনা হলো।

হুসন জিজ্ঞেস করে, খেতে টোতে দেয়নি?

–খেতে? সারা দিনে মাত্র একবার।

—আহারে, সেই জন্যে শরীরটা শুকিয়ে গেছে, সোনা।

–তোমার মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি? বলছি না—স্বপ্নে দেখেছি সব।

–না গো, না, সত্যিই কেমন রোগা হয়ে গেছো তুমি।

—তোমার যেমন কথা! এই একঘণ্টা আগে শরীরটা তাগড়াই ছিলো, আর এর মধ্যেই রোগ হয়ে গেলাম? তোমাদের-মেয়েদের কাছে শরীর স্বাস্থ্যের কথা একবার উঠলে হয়—। যাকগে ওসব, এবার উজির সাহেবের হুকুম হলো, একটা ক্রুশ-এ গেঁথে আমাকে হত্যা করা হবে। ছুতোর ডেকে আমার মাপ নিয়ে কাঠের ক্রুশ বানানো হতে লাগলো।

হুসন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনছিলো হাসানের কথা। এবার কঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু কি তোমার গোস্তাকি?

—বেদনার হালওয়াতে মরিচের গুড়ো একটু কম হয়ে গিয়েছিলো, এই আমার অপরাধ!

–এ্যাঁ?

হুসন হাসবে কি কাঁদবে, ঠাওর করতে পারে না। হাসলেই সব মাটি হয়ে যাবে। তাই সে কেঁদেই ফেললো। হায় আল্লাহ, এমন স্বপ্ন মানুষে দেখে! তুমি ‘ছোটাঘরে’ গেলে। দেরি হচ্ছিলো। আমি ঘুমিয়ে গেছি। তুমিও যে গোসলখানায় ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝবো কি করে?

হাসান বললো, কিন্তু সোনা, আমার যনে মনে হলো, বারো তেরোটা বছর পার হয়ে গেছে আমার জীবনে।

—স্বপ্নে ঐ রকমই হয়। ও নিয়ে আর মন খারাপ করো না। নাও। এসো একটু জড়িয়ে ধরে শুই। শরীরটা গরম হলে দুঃস্বপ্নের ঘোরটা কেটে যাবে।

হুসন দু হাতে হাসানকে টেনে নিলো বুকের মধ্যে চুলের মধ্যে হাত বুলাতে লাগলো। এক সময় আঁৎকে উঠে বললো, একি তোমার কপালে এতো বড় একটা কাটা দাগ কিসের?

হাসান কপালে হাত বুলালো-তা হলে তো ব্যাপারটা স্বপ্ন না, হুসন। ঐ ছেলেটাকে ধাওয়া করে যাওয়ার সময় রেগেমেগে সে একটা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। কপালটা কেটে দরদরি করে রক্ত ঝরছিলো। ঘাটা শুকোতেও সময় লেগেছিলা বেশ কয়দিন? কিন্তু সে যাক, সব যে আমার কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তবে কি…

আর ভাবতে পারে না হাসান। হুসনর বুকে মুখ গুজে চুপ করে শুয়ে থাকে।

হুসন আদর করে বলে, ছাড়ো, ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নাই। যাই হয়ে থাক, তুমি তো এখন আমার কাছেই ফিরে এসেছে?

কেমন একটা তন্দ্রার ভাব হাসানকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিড়বিড় করে আপন মনেই বলতে থাকে। স্বপ্ন-সবটাই কি স্বপ্ন?

অনেক বেলায় ঘুম ভঙ্গে হাসানের। তখনও সে হুসনর কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলো। চোখ মেলতেই দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই উজির—যে তাকে ক্রুশে গেঁথে মারার হুকুম দিয়েছিলো। এই লোকটার হুকুমেই তার দোকানটা ভেঙে গুডিয়ে দিয়েছিলো তার লোকজন। হাসান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। উজিরের দিকে। কোন কথা বলতে পারলো না।

সামস-আল-দীনই কথা বললো।-শোনো, বাবা, তুমি আমার ছোট ভাই নূর-আল-দীনের ছেলে। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ক্রুশে গেঁথে হত্যা করার হুমকী দিয়েছি। বেদানার হালওয়ায় মবিচের গুড়ো কম দিয়েছিলে এই অজুহাতে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবো বলে ভয় দেখিয়েছিলাম। কিন্তু আসল কারণ তা নয়। আমার প্রাণপ্রতিমা কন্যা হুসনকে শাদী করে তার গর্ভে সস্তান দিয়ে সেই রাতেই তুমি উধাও হয়ে গিয়েছিলে। আর আমার মেয়ে বারোটা বছর কেঁদে কেঁদে সারা হলো। সেই রাগে তোমাকে ঐ সাজা দিয়েছি। আর আমার খুব কষ্ট হয়েছে বাবা। যাক, মনে আর কোন ক্ষোভ রেখে না। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। শাদীর রাতে বা তার আগে তোমাকে কখনও দেখিনি! তুমিই যে আমার মেয়ের প্রকৃত স্বামী, তোমার ঔরসেই আমার নাতি আজীবের জন্ম হয়েছে তা নিশ্চিত হবার জন্যেই এই চাতুরি আমাকে করতে হয়েছে। গতকাল রাতে আমি পাশের ঘরে ছিলাম। তোমাদের কথাবার্তা সব শুনে আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেছি। আর কোন সংশয় সন্দেহ নাই। তুমিই আমার জামাতা-আজীবের বাবা। এতো সব কাহিনী কেচ্ছার কিছুই হতো না। নূর-এর সঙ্গে আমার সেই সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্যেই যতো সব অনাসৃষ্টি কাণ্ডকারখানা ঘটে গেলো।

উজির আবার সেই সব পুরোনো কাহিনী শোনালো হাসানকে। কি নিয়ে নূর-এর সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়—যে কারণে মনের দুঃখে দেশত্যাগী হয়ে বসরা হয় চলে যায় সে। সব শেষে উজির বলে, বাবা, তোমার মাকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি বসরাহ থেকে। এখুনি তাকে দেখতে পাবে। তোমার ছেলে আজীব-তাকেও আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এই বলে বৃদ্ধ উজির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। একটুক্ষণ পরেই আজীব ছুটতে ছুটতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। হুসন বলে, এই তোর আব্বাজান।

আজীব দেখলে সেই দামাসকাসের হালুইকর। অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো এক মুহুর্ত। তারপর আকুল আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো হাসানের বুকে।

তারপর এলো হাসানের মা। আনন্দে আত্মহারা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে। কাঁদতে লাগলো। তার এতোকালের ব্যথা বেদনা কান্না শোক আজি এই আনন্দ কান্নার তলায় চাপা। পড়ে মরে গেলো। সব দুঃখ আজ নিমেষে উধাও হলো। এখন থেকে তার আহ্লাদের দিন শুরু হলো।

ক্ষত শুকিয়ে গেলো। যন্ত্রণার উপশম হলো। কিন্তু দাগটা স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরকাল।

শাহরাজাদ চুপ করলো। একটুক্ষণ। তারপর বলে, উজির জাফর বারম্যাকীর গল্প এখানেই শেষ। খলিফা হারুন-অল-রসিদ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলো এতক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে বললো অপূর্ব তোমার কাহিনী, জাফর। এতো ভালো কিসসা শুনিনি কোথাও। নকলনবীশদের ডেকে বললো জাফরের কাহিনীটা লিখে রাখো। ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েরা পড়ে অনেক আনন্দ পাবে। আর জাফর, তোমার ওপর খুশি হয়ে তোমার পিয়ারের নফর রাইহানকে রেহাই করে দিলাম আমি। আচ্ছা! সেই হতভাগ্য খুনী স্বামীটাকে একবার ডাকে। বেচারা আমন ভালো বিবিটাকে ভুল করে হত্যা করে কি অনুতাপেই না দিন কাটাচ্ছে। একটা ভালো ডাগর দেখে মেয়েকে রক্ষিতা করে দাও ওর। যা মাসোহরা লাগে আমি দেবো।

শাহরাজাদ বললো, এ কাহিনী আপনার কেমন লাগলো জানি না, শাহজাদা। হয়তো আমার বলার দোষেই খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু জাঁহাপনা যদি শুনতে ইচ্ছা করেন তবে আরও একটা মজার গল্প শোনাতে পারি। হুজুরের হয়তো ভালোই লাগবে।

শারিয়ার প্রশ্ন করে, কী গল্প?

শাহরাজাদ বলে, সে এক অদ্ভূত গল্প।

শারিয়ার অধৈর্য হয়, আঃ, গল্পের নামটা কী?

শাহরাজাদ বলে, গল্পের নামটা বেশ বড়সড়—বাগদাদের এক কুঁজে দর্জি, ইহুদী, খ্রীস্টান, আর নাপিত-এর কাহিনী।

শারিয়ার বলে, ঠিক আছে, বল দেখি, শুনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *