কলকাতার তালতলা অঞ্চলটি বেশ প্রাচীন, এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দারা কয়েক পুরুষ ধরেই এই শহরের নাগরিক। অনেকে বলে খাঁটি কলকাতার ভাষা এখনো শুধু তালতলাতেই শুনতে পাওয়া যায়। অন্যান্য জায়গায় ভেজাল ঢুকে গেছে, বাঙালদের উপদ্রবে। তালতলার লোকেরা ট্রামে বাসে ‘এই যে দাদা’র বদলে ‘এই যে দাদু’ সম্বোধন শুনলে বিরক্তিতে নাক কুঁচকোয়। তারা এখনো নুচি, নংকা ও নেবু, এই ধরনের উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখেছে, ‘আদেখলের ঘটি হলো, জল খেতে খেতে প্রাণ গেল’, কিংবা ‘অবিয়ন্তীর ঠুনকো ব্যথা’ কিংবা ‘না বিইয়ে কানায়ের মা’ এই ধরনের বর্ণাঢ্য প্রবাদ কথায় কথায় ব্যবহার করে।
শহরের পুরনো পল্লীর যা যা অনুষঙ্গ, অর্থাৎ বেশ্যালয়, মদের আখড়া, গুণ্ডা চক্র তাও রয়েছে কাছাকাছি। অবশ্য পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের বসত বাড়িটিও অদূরে। তাঁর বাড়ির বিপরীত দিকে পরিচ্ছন্ন, সুরম্য ওয়েলিংটন স্কোয়ার উদ্যানটি সবরকম বিক্ষোভের পীঠস্থান। প্রায় প্রত্যেকদিন সেখানে ভিড়, হুড়োহুড়ি, ঠ্যালাঠেলি লেগেই আছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতিমান চিকিৎসক বিধানবাবু সকালবেলা বিনা-ভিজিটে রুগী দেখেন, সেইজন্য ভোর থেকেই এসে ভিড় জমায় দূর-দূরান্তের রুগীরা, আবার ঐ ডাক্তারবাবুর কাছেই অন্য সময়ে অনেকে আসে স্বেচ্ছায় আহত বা নিহত হতে। একটু বেলা বাড়লেই শুরু হয়, ছাত্র সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ ও বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলির মিছিল।
স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে এসেছে, দেশকে এখন আর কেউ জননী মনে করে না, দেশ নিছক গ্রাসাচ্ছাদনের পটভূমি। স্বাধীনতার পরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধ, ছাটাই ও নতুন চাকরির অভাব এবং ভোগ্যপণ্যের অনটনের জন্য ছাত্র ও যুব সমাজ জাতীয়তাবাদ ছেড়ে ইদানীং মার্ক্সবাদের দিকে ঝুঁকেছে, ভারতীয় কমুনিস্ট পার্টির ছাত্র ও যুব শাখা এখন বেশ শক্তিশালী। এইসব মিছিল-সমাবেশের ওপর প্রায়ই লাঠি-গুলি ও টিয়ার গ্যাস চলে। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে বর্তমান সরকার মাথায় রেখেছে বটে কিন্তু পুলিশ বাহিনীকে অহিংস হতে বলেনি, অন্যান্য অনেক কিছুর মতনই পুলিশ বাহিনীও চলছে পুরনো ব্রিটিশ কায়দায়। এই তো দু’এক বছর আগে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ট্রাম কম্পানির ট্রামের ভাড়া মাত্র এক পয়সা বৃদ্ধির প্রতিবাদে এখানে কী তুমুল দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল। টিয়ার গ্যাসের জ্বালায় স্থানীয় অধিবাসীরা দরজা-জানলা বন্ধ করেও নিষ্কৃতি পায়নি, অকারণে তাদের কাঁদতে হয়েছে। বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় এ পাড়ায় লোকদের বড় অশান্তি।
এই তালতলাতেই মমতার বাপের বাড়ি। মমতার বাবা-ঠাকুদারা খাঁটি পশ্চিমবঙ্গেরও নয়, পূর্ববঙ্গেরও নয়। যশোরে সাতক্ষিরার কাছে এককালে তাঁদের ছোটোখাটো একটি জমিদারি ছিল, মমতার ঠাকুর্দা এক পার্শী ভদ্রলোকের কাছ থেকে তালতলার একটি দোতলা বাড়ি কেনেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। ক্রমে জমিদারিটি হাতছাড়া হয়ে গেলেও সাতক্ষিরা শহরে তাঁদের একটি বাড়ি রয়ে গিয়েছিল এবং সেখানেও যাতায়াতে ছেদ পড়েনি।
এই বংশের ছেলেমেয়েরা গোড়া থেকেই কলকাতার স্কুল কলেজে লেখাপড়া শিখেছে, ছুটি কাটাতে গেছে সাতক্ষিরার বাড়িতে। তারা কথাবার্তা বলে কলকাতার ভাষায় কিন্তু বিয়ের সময়। তাদের পাত্রী ও পাত্র বেছে বেছে আনা হয়েছে পূর্ববঙ্গীয় ভালো বংশ থেকে। ফুটবল খেলার সময় তারা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক কিন্তু ইলিশের চেয়ে চিংড়ি মাছই তাদের বেশি পছন্দ। বোয়াল মাছ তাদের বাড়িতে ঢোকে না। দেশবিভাগের ফলে এই পরিবারটি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, মূল্যবান জিনিসপত্র সবই সরিয়ে আনার সময় পাওয়া গিয়েছিল। সাতক্ষিরার বাড়িটিও এক আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সীমান্ত থেকে সাতক্ষিরা শহরটি বেশি দূরে নয়, বিনা পাসপোর্টেই ইছামতি নদী দিয়ে দুদিকের অনেক মানুষ যাওয়া আসা করে, নানারকম দ্রব্যও আসে-যায়।
মমতার বাবা-ঠাকুদারা অবশ্য কেউ এখন বেঁচে নেই। তাঁর দাদা ত্রিদিবই সংসারের কর্তা। সংসারটিও ছোট হয়ে এসেছে।
ত্রিদিবের স্ত্রী সুলেখা যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। এ দেশে সুন্দরী বললে প্রথমেই ফর্সা রং বোঝায়। কিন্তু সুলেখার গাত্রবর্ণ পদ্মপাতার মতন। সুলেখার নাক, চোখ, ওষ্ঠরেখা কোনোটিই যে আলাদাভাবে নিখুঁত তা বলা যায় না। কিন্তু সুলেখার রূপের মধ্যে এমন একটা গভীর সুষমা আছে যেজন্য তার দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। এ যেন শিল্পের মতন। একটা কবিতা বা ছবি বা সঙ্গীত যে কেন ভালো বা রসোত্তীর্ণ তা কিছুতেই বুঝিয়ে বলা যায় না। নিখুঁত ব্যাকরণ বা নিখুঁত প্রয়োগ হলেও তো ঐ সব সবসময় মনোহরণ করে না। তার জন্য আলাদা কিছু লাগে।
বিয়ের আগে পর্যন্ত ত্রিদিব ছিলেন খুব পড়ুয়া মানুষ। সব পরীক্ষায় তিনি ফাস্ট হয়েছেন। যথাকালে তিনি তাঁর যোগ্য চাকরি পেয়েছেন, তবু পড়াশুনোর নেশা তাঁর ঘোচে নি। তিনি বিয়ে করেছেন অনেক দেরিতে। সুলেখার সঙ্গে বিয়ে হবার পর তিনি অনুভব করেন যে এতগুলি বছর তিনি শুধু বইয়ের পাতাতেই মুখ গুঁজে থেকেছেন, পৃথিবীর আর কোনো কিছু ভালোভাবে জানা হয় নি। সুন্দরের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য সুন্দরের প্রতি তাঁর আকুতি জন্মায়। তিনি সঙ্গীত ও শিল্প-সাহিত্যের জন্য তৃষ্ণা বোধ করেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিদিনই কোনো সিনেমা, থিয়েটার বা গান বাজনার অনুষ্ঠানে যান।
বিয়ের সাত বছর পরেও ত্রিদিবের এই টান একটুও কমে নি। সুলেখার সাহচর্যেই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সময় কাটে, সুলেখা কোনোদিন যেতে না পারলে তিনি সিনেমা বা থিয়েটারের আগে থেকে কেটে রাখা টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দেন।
সুলেখার এখনো কোনো সন্তানাদি হয় নি। জননী রূপের চেয়ে প্রেমিকা রূপটিই যেন তাঁকে বেশি মানায়। পুরুষের চোখে কোনো কোনো নারী চিরন্তন প্রেমিকা হয়েই থাকে। যেমন মহাভারতের দ্রৌপদী। দ্রৌপদীর অবশ্য বেশ কয়েকটি ছেলেপুলে হয়েছিল কিন্তু তাদের উল্লেখ প্রায় উহ্যই রয়ে গেছে। অত্যন্ত সুকৌশলে মহাভারতের কাহিনীকার দ্রৌপদীর প্রেমিকা রূপটিই। উজ্জ্বল করে এঁকেছেন আগাগোড়া, এমনকি মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত। সুলেখার মতন দ্রৌপদীও ফর্সা ছিলেন না।
ত্রিদিব নম্র ও ভদ্র স্বভাবের মানুষ, ছোটখাটো চেহারা। সেই তুলনায় সুলেখা বেশ দীর্ঘকায়া, ত্রিদিবকে একটু ছাড়িয়ে যান। সুলেখা কিন্তু তাঁর রূপ সম্পর্কে অনবহিতা, তাঁর মনটি ঝর্নার জলের মতন। সেই মনের স্পর্শ ত্রিদিব ছাড়া আর কেউ পায়নি।
সুন্দরী স্ত্রীর জন্য ত্রিদিবকে প্রায়ই কিছু কিছু বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। মধু-সম্ভাবনাময় প্রস্ফুটিত ফুলের চারপাশে মৌমাছি, ভ্রমর, প্রজাপতি, ফড়িং, গুবরে পোকার মতন সুলেখার জন্যও বাড়িতে নানান লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আত্মীয়, স্বজন, ক্ষীণ সূত্রের বন্ধুবান্ধব। ত্রিদিবের বিয়ের আগে তারা এ বাড়িতে আসতো না, এখন আসে, এবং অনেকক্ষণ বসে থাকে। সুলেখা লেখাপড়া জানা মেয়ে, সে পদানশীনা নয়, বাইরের লোকজনের সামনে তার ব্যবহার খুবই সাবলীল। সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন ত্রিদিব ঠিকই বুঝতে পারেন যে এইসব লোকেরা চায় যতক্ষণ বেশি সম্ভব সুলেখার আঁচলের বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে। অথচ ত্রিদিব কারুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না। কারুকে চলে যেতে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।
ত্রিদিব জানেন যে তাঁর ভগ্নীপতি প্রতাপও সন্ধের দিকে মাঝে মাঝে আসেন ঐ একই কারণে। প্রতাপ সুলেখাকে বিশেষ পছন্দ করেন এবং সেকথা তিনি নিজের মুখে অনেকবার স্বীকার করেছেন। প্রতাপ এখন বসেন শিয়ালদা কোর্টে, সেখান থেকে প্রায়ই তিনি শেষ বিকেলের দিকে আসেন শ্বশুর বাড়িতে চা খেতে। ত্রিদিবের বিয়ের আগে তিনি আসতেন। কদাচিৎ। প্রতাপ আর ত্রিদিব সববয়সী হলেও সম্পর্কের সূত্রে প্রতাপ ত্রিদিবকে দাদা বলে ডাকেন। সুলেখাকে অবশ্য নাম ধরেই ডাকেন প্রতাপ। প্রতাপের আসার সময় আর ত্রিদিবের অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় সমসময়। মাঝে মাঝেই দরজার কাছে দেখা হয়ে যায়, তখন প্রতাপ কৃত্রিম আফসোসের সুরে বলেন, ইস, দাদা, আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন? ভাবলাম কিছুক্ষণ সুলেখাকে একলা পাবো, ওর রূপসুধা উপভোগ করবো! সারাদিন খাটনির পর সুলেখার এক ঝলক হাসি দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
ত্রিদিব তখন বলেন, মজুমদার সাহেব, আমার বোনটিকে অবজ্ঞা করবেন না। আমার বোনও যথেষ্ট সুন্দরী। আমি তো মনে করি আমার বউ-এর চেয়ে আমার বোন আরও বেশি সুন্দর।
প্রতাপ উত্তর দেন, কী যে বলেন! আপনার বোনকে অবজ্ঞা করি এমন বুকের পাটা কি আমার আছে? তবে, বউ তো হাতের পাঁচ। সেই যে রবি ঠাকুর কোন্ বইতে যেন লিখেছেন না, নিজের বউ হলো আসল টাকা, আর শ্যালিকারা হলো সুদ। তা আমার একটি মাত্র শ্যালিকা, সেই বিনতাকে আপনি বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে! সেইজন্যই, মধুর অভাবে গুড়ের মতন আমি শ্যালিকার বদলে শালাজ-এর কাছে সুদ নিতে আসি।
এই বলে প্রতাপ হেসে ওঠেন হা-হা শব্দে। সে হাসিতে কোনো মালিন্য নেই।
প্রতাপ অবশ্য ইদানীং অনেকদিন আসছেন না। প্রতাপ বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেওঘর। গিয়েছিলেন এবং তারপর প্রতাপদের পরিবারে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে সে সব ত্রিদিব জানেন।
প্রতাপ এলে ত্রিদিবের ভালো লাগে, বেশ আড্ডা জমে। মুশকিল হচ্ছে অন্যান্য অনেককে নিয়ে, যারা আসে অকারণে বা মিথ্যে ছুতোয়। ত্রিদিবের সঙ্গে অবান্তর কথা বলতে বলতেও যারা আড়চোখে সুলেখার দিকে চেয়ে থাকে। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ত্রিদিবের আপন মামা। এই বীরেশ্বর মামা একসময় সেনাবাহিনীতে লিউটেনান্ট কর্নেল ছিলেন, রিটায়ার করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ইনি চিরকুমার এবং চেহারাটি এখনো ছিপছিপে সুদর্শন। প্রৌঢ় অবিবাহিত পুরুষরা মনে করে পরস্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেলায় তাদের একটা বিশেষ অধিকার বা দাবী আছে।
বীরেশ্বর মামা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইটালিতে ছিলেন বলে সাহেবী হাবভাব দেখান খুব। কথায় কথায় তিনি সুলেখাকে জড়িয়ে ধরেন, লোকজনের সামনেই সুলেখার গাল টিপে দেন, হঠাৎ হঠাৎ দুপুরবেলা এসে উপস্থিত হন। সুলেখা এই নিয়ে স্বামীর কাছে অনুযোগ করেন। বীরেশ্বর মামা কী যেন করেন, আমার ভালো লাগে না! ত্রিদিবকে অসহায়ভাবে চুপ করে থাকতে হয়। নিজের মামাকে তো বলা যায় না যে তুমি যখন তখন আমাদের বাড়িতে এসো না কিংবা আমার বউয়ের গায়ে হাত দিও না!
মাঝে মাঝে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সন্ধেবেলা সুলেখাকে অসুস্থতার ভান করে শুয়ে থাকতে হয়, বসবার ঘরে ত্রিদিব অনাহূত অতিথিদের আপ্যায়ন করেন, যারা কেউই ত্রিদিবের সঙ্গে গল্প করার জন্য আসেনি।
সেদিন ত্রিদিব বিকেলবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরছেন, ধর্মতলা স্ট্রিটে তাঁদের গাড়ি জ্যামে আটকে গেল। ওয়েলিংটন মোড়ের কাছে পুলিশ-জনতায় খণ্ডযুদ্ধ চলছে। এমনই অবস্থা যে গাড়িটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে নেবারও উপায় নেই। গাড়িতে ত্রিদিবের আরও তিনজন সহকর্মী রয়েছে, অফিসের গাড়ি প্রত্যেককে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়। অসহ্য গুমট গরম, গাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগলো না, ত্রিদিব নেমে পড়লেন। এখান থেকে তিনি হেঁটেই যেতে পারবেন। ত্রিদিব ছাত্র বয়েসে শুধু পড়াশুনোই করেছেন, কোনোরকম আন্দোলন-টান্দোলনে যোগ দেন নি, মিছিলে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। কিন্তু এ পাড়ার মানুষ হিসেবে তিনি এই রকম। গণ্ডগোল দেখতে অভ্যস্ত, তাই ভয় পান না। একদিকে পুলিশ লাঠি চালালেও অন্য দিক দিয়ে ধীরে সুস্থে হেঁটে চলে যাওয়া যায়।
ওয়েলিংটনের মোড়টা পার হবার পর ত্রিদিব বুঝতে পারলেন আজকের হাঙ্গামাটা বেশ ব্যাপক। পুলিশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাড়া করছে আন্দোলনকারীদের, ওরাও ছুঁড়ছে ইট-পাটকেল।
ত্রিদিব ঠিক করলেন ক্রীক রো দিয়ে শর্ট কাট করবেন। খানিকটা যাওয়ার পর দেখলেন পেছন দিক থেকে একদল লোক ছুটে আসছে পুলিশের তাড়া খেয়ে। আবার উল্টো দিক থেকেও এদিকে আসছে একটা দল। এরা নতুন আক্রমণকারী না পলাতক তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লোকজনের চিৎকারের মধ্যে প্রবল ভয় আছে। ফট ফট করে দুটো শব্দ হলো, গুলি না টিয়ারগ্যাস বোঝা গেল না। অবস্থা সুবিধের নয়, ত্রিদিব তৎক্ষণাৎ মন ঠিক করে একটুখানি দৌড়ে গিয়ে ডান দিকের একটি বাড়ির সদর দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজাটা ভেজানো ছিল, খুলে যেতেই ত্রিদিব ঢুকে পড়লেন ভেতরে, ত্রিদিবের দেখাদেখি আরও তিন-চারজন লোক চলে এলো।
সঙ্গে সঙ্গে দোতলা থেকে ক্রুদ্ধ গলায় একজন বলে উঠলো, কে রে? কে রে? কানাই বুঝি। দরজাটা বন্ধ করেনি? আঃ, আর পারা যায় না, উটকো লোক ঢুকে পড়েছে। যাও, বেরিয়ে যাও, নইলে আমি পুলিশ ডাকবো।
ত্রিদিবের বুকটা ধড়ফড় করছে, কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে যাবে। বাড়ি ফেরার ব্যস্ততায় এই রকমভাবে এগিয়ে আসা ঠিক হয় নি। গাড়ির মধ্যে বসে। থাকাটাই নিরাপদ ছিল। গাড়ি-চড়া লোকদের পুলিশ মারে না।
ধুতিটাকে লুঙ্গি করে পরা, খালি-গা একজন প্রৌঢ় দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আদেশ দিল, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও সব, আমি দরজা বন্ধ করবো!
এ বাড়িটা ত্রিদিবের পিসতুতো বোন ইলার শ্বশুরবাড়ি। এক পাড়ার মধ্যে হলেও কুটুম্বদের বাড়িতে ত্রিদিবের বিশেষ যাতায়াত নেই। আজ এসেছেন বাধ্য হয়ে। লজ্জিতভাবে ত্রিদিব ইলার ভাসুরকে বললেন, হরেনদা, আমিও এসে পড়েছি, রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ!
ত্রিদিবকে চিনতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর বদল করে হরেনবাবু বললেন, আরে ত্রিদিব! তুমিও আজকাল পলিটিকস করছো নাকি? এসো, এসো, ওপরে উঠে এসো! আজ তো দুপুর থেকেই গণ্ডগোল।
অন্যদের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, এই যে ভাই, বলছি না বেরিয়ে যেতে! আমার বাড়িতে এসব চলবে না!
একজন লোক দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে বললো, যাবো কী করে? বাইরে লাঠি চার্জ হচ্ছে।
হরেনবাবু বলেন, ওসব আমি জানি না! পুলিশের দিকে ইট মারার সময় মনে ছিল না? ওপর থেকে দেখছি তো সব!
একজন লোক মাথায় দু’হাত চেপে বসে পড়েছে। তার কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত।
রক্ত-দর্শনে ত্রিদিবের মাথা ঝিম ঝিম করে। মানুষ যে মানুষকে মারে, এই তথ্যটা এখনো তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। তিনি ফিসফিস করে বললেন, হরেনদা, ঐ লোকটার মাথা ফেটে গেছে! একটু জল…
হরেনবাবু বললেন, না, না, আমার এখানে আমি এসব ঝামেলা রাখবো না। পুলিশ এলে আমাকেই তখন জবাবদিহি করতে হবে। এদের জানো না তুমি, কমুনিস্টরা এদের ক্ষ্যাপাচ্ছে! আমরা তিন পুরুষ ধরে কংগ্রেসের সাপোর্টার।
আজকের বিক্ষোভ যে কিসের দাবিতে ত্রিদিব সেটাই জানেন না এখনো। তিনি দেখলেন, আহত লোকটির অবস্থা ভালো নয়, মুখখানা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে, কিন্তু কোনো শব্দ করছে না। অন্য লোকগুলি বোধহয় এর পরিচিত নয়, কারণ কোনো কথা বলছে না, প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
হরেনবাবু তর্জন গর্জন করলেও লোকগুলোকে ঠেলে বার করে দিতে পারবেন না তিনি। জানেন। সবাই ক্ষেপে আছে। তিনি ত্রিদিবকে বললেন, চলো, ওপরে চলো, কানাইকে বলছি দরজা বন্ধ করে দেবে।
ত্রিদিব তবু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
একজন লোক দরজাটা একটু খুলে মুখ বাড়িয়ে বললো, পরিষ্কার হয়ে গেছে!
সঙ্গে সঙ্গে তারা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আহত লোকটি উঠে দাঁড়ালো আস্তে আস্তে। ত্রিদিব বললেন, আজ আর ওপরে যাবো না, আমিও যাই।
হরেনবাবু বললেন, আরে না, না, চলো, চা-টা খেয়ে যাবে। একটু বিশ্রাম করে যাও, তারপর তোমার সঙ্গে আমি একজন লোক দিয়ে পাঠাবো!
ত্রিদিব বললেন, তার দরকার হবে না। এই তো এখান থেকে এইটুকু। ফিরতে দেরি করলে বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।
প্রায় জোর করেই বেরিয়ে এলেন ত্রিদিব। রাস্তাটা অদ্ভুত রকমের ফাঁকা হয়ে গেছে, একজনও লোক দেখা যাচ্ছে না। শুধু ছড়িয়ে আছে অনেক ছেঁড়া জুতো, ইট-পাটকেল, টিয়ার গ্যাসের সেল। দূরে চিৎকার ও বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে, অর্থাৎ হাঙ্গামা এখনও থামে নি, গড়িয়ে গেছে অন্যদিকে, খুব সম্ভবত গণেশ এভিনিউ-এর মোড়টায়।
দ্রুত পা-চালাতে গিয়েও ত্রিদিব থমকে দাঁড়ালেন। আহত লোকটি একটু একটু হাঁটছে আবার থেমে গিয়ে টলছে। এই অবস্থায় ও কোনো হাসপাতালে কি পৌঁছোতে পারবে? আবার যদি জনতা-পুলিশের যুদ্ধটা এদিকে চলে আসে তখন ও পালাবেই বা কী করে? এখন আর কোনো বাড়ির দরজা খুলবে না।
ত্রিদিবের মনে হলো তাঁর কিছু করা উচিত। কিন্তু দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। নিজের। ঘেরা গণ্ডির বাইরের মানুষের সঙ্গে মেশেন নি তিনি, অপরিচিত কারুর সঙ্গে প্রথম কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেন, মিছিলের লোকদের চরিত্র তিনি জানেন না।
একবার ভাবলেন, দরকার নেই এসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। আবার খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, লোকটি এক জায়গায় বসে পড়েছে।
দৌড়ে ফিরে গিয়ে ত্রিদিব লোকটির একটি হাত ধরে বললেন, উঠুন, হাঁটতে পারবেন তো? আমার সঙ্গে আসুন, কাছেই আমার বাড়ি!
লোকটি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, দরকার নাই। আপনে যান! আমারে হেল্প করতে। হবে না!
লোকটির কণ্ঠস্বর রুক্ষ ধরনের। লম্বাটে চেহারা, চোয়াড়ে মুখ, তাতে তিন-চার দিনের ছিটেছিটে দাড়ি। তার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে একটা চোখ প্রায় বুজে যাচ্ছে, হাত দিয়ে মুছে মুছেও সে রক্ত থামানো যাচ্ছে না।
ত্রিদিব জোর দিয়ে বললেন, এক্ষুনি আপনার রক্ত বন্ধ করা দরকার। চলুন, আসুন!
লোকটি আবার বললো, আমার জন্য ভাবতে হবে না। আপনে যান!
গণ্ডগোলের স্রোতটা আবার এই রাস্তার মুখে, পার্কের পাশে চলে এলো। এখন এখানে। থাকা নিরাপদ নয়। ত্রিদিব লোকটির কাঁধ ধরে টেনে বললেন, শিগগির উঠুন!
এবারে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে ত্রিদিবের পাশে পাশে ছুটতে লাগলো। ডান দিকের একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে আরও খানিকটা গিয়ে ত্রিদিব অবিলম্বে বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলেন, লোকটির হাত ধরে বললেন, ভেতরে আসুন চটপট।
দুপুর থেকেই এ পাড়ায় উৎপাত হচ্ছে বলে আজ বাড়িতে কোনো অতিথি আসেনি। ড্রয়িং রুমের পাখা খুলে দিয়ে লোকটিকে সোফায় বসিয়ে ত্রিদিব বাড়ির ঝিকে বললেন, ওপর থেকে বৌদিকে ডেকে আনো তো তাড়াতাড়ি।
লোকটি প্রথম ঝোঁকে সোফায় বসে পড়লেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো মেঝেতে। তারপর বললো, আমার রক্তে আপনের ঘরবাড়ি অপবিত্র হইয়া যাবে। আমি ছোট লোক!
ত্রিদিব বললেন, না, না, ওসব কী কথা? আপনি উঠে বসুন!
লোকটি বললো, আমি শুইয়া পড়ি।
সুলেখা উৎকণ্ঠিত হয়েই ছিলেন। খবর পেয়ে নেমে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। ত্রিদিব তাকে সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনাটি জানাতেই সুলেখা নিপুণভাবে দায়িত্ব নিয়ে নিলেন সব কিছুর। তুলে। আর গরম জল আনিয়ে প্রথমে লোকটির মাথার ক্ষত পরিষ্কার করে দিলেন ভালোভাবে তারপর ডেট্রল ঢেলে ব্যাণ্ডেজ বাঁধলেন। এক কাপ গরম দুধ লোকটির মুখের কাছে বললেন, নিন, এটা খেয়ে নিন তো!
ত্রিদিবকে তিনি বললেন, আমার মনে হয় মাথায় স্টিচ করানো দরকার। এতে রক্ত বন্ধ না।
লোকটি এক চুমুকে দুধটা খেয়ে নিয়ে বললো, নাঃ, আর কিছু লাগবে না। এখন আছি। আমাগো খুব কড়া জান, বোঝলেন!
লোকটি উঠবার চেষ্টা করতেই ত্রিদিব বললেন, আরে, এত হুড়োহুড়ি করছেন কেন? বসুন, আমার চেনা একজন ডাক্তারকে খবর পাঠাচ্ছি, সে এসে দেখে দেবে!
লোকটি ত্রিদিবের চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, আপনেরা আমার জন্য এত সব করবেন কেন? কইলাম না, আমি ছোট লোক, অতি ঘৃণ্য!
সুলেখা সরল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোটলোকতার মানে কী? নিচু জাত?
লোকটি বললো, নিচুস্য নিচু। একেবারে পায়ের তলায় থাকার মতন। আমরা হইলাম রিফুউজি। উদ্বাস্তু!
ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন, আজকের মিছিলটা বুঝি রেফিউজিদের ছিল?
লোকটি বললো, হ, সরকার আমাগো আন্দামানে যাবজ্জীবন নির্বাসনে পাঠাইতে চায়, কিংবা দণ্ডকারণ্যে রাইক্ষসদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড। আমরা তো বাংগালী না, পুব বাঙ্গলার থিকা আমরা সাধ কইরা পলাইয়া আইছি তো, তাই পশ্চিম বাঙ্গলায় আমাগো ঠাঁই নাই। তাই আমরা একটু চ্যাঁচামেচি করতে আইছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। পুলিশ সেইজন্য ডাণ্ডা মারলো আমার মাথায়, দুই একজনের বোধহয় গুলিতেও পেট ফুটা করছে।
ত্রিদিব বললেন, কিন্তু অনেক স্কুল কলেজের ছাত্রদেরও দেখলাম এর মধ্যে রয়েছে!
লোকটি বললো, বামপন্থী পার্টিগুলা আমাগো সাপোর্ট করতাছে। ক্যান যে করতাছে তা জানি না! আপনেরাও বামপন্থী নাকি?
ত্রিদিব বললেন, আমরা কোনো পার্টিতে নেই।
সুলেখা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কী?
লোকটি এতক্ষণ ভালো করে তাকায় নি সুলেখার দিকে। এবারে সে মুখ তুলে নির্নিমেষে চেয়ে রইলো। তার তিক্ত কর্কশ কণ্ঠস্বরটি নরম করে অভিভূতের মতন বললো, আপনি দেবী, সাক্ষাৎ ভগবতী, আমার মতন একজন নগণ্য মানুষরে আপনে দয়া করছেন, আপনের কাছে মিথ্যা কমু না। আমার নাম হারীত মণ্ডল। হতভাইগ্য রিকুইজিদের আমি এক অপদার্থ নেতা।
নামটা একটু চেনা চেনা লাগলো ত্রিদিবের। আগে কোথাও শুনেছেন বা ছাপা দেখেছেন। খবরের কাগজে কী?
হারীত মণ্ডল হঠাৎ সুলেখার পায়ে হাত দিয়ে বললো, আপনে আমার মা। আপনে ইচ্ছা করলে আমাকে পুলিশে ধরাইয়া দিতে পারেন।
সঙ্কুচিতভাবে তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে সুলেখা বললেন, আরে, আরে, ছি, ছি, ওসব কী বলছেন? আমরা আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে যাবো কেন?
হারীত মণ্ডল বললো, অন্য লোকের কাছে আমি আমার আসল নাম কই না। অনেকের ধারণা আমি একজন খুনী। কাশীপুরের যে-জবর দখল বাড়িতে আমরা রইছি এখন, সেই বাড়ির মালিকদের একজন ঐখানে মারা গেছেন হঠাৎ। অন্য মালিকরা রটাইয়া দিচ্ছে যে আমিই তারে খুন করছি।
ত্রিদিব আর সুলেখা পরস্পরের দিকে বাঙ্ময় চোখে তাকালেন।
যত পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, বাঙালির দুর্ভাগ্যের জ্বলন্ত বর্ণনা।