পড়ন্ত বেলার রোদ সরতে সরতে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমেছে, ফুলেশ্বরীও তার সেলাইয়ের সুগ্নসহ সরতে সরতে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমেছেন। এরপর ছাদে উঠবেন।
প্ৰদীপের আলোয় আর চোখ চলে না। আজকাল, তাই দিনের আলোর শেষ বিন্দুটির পিছনেও ছুটোছুটি।
ছেলে নিষেধ করে। বলে, মা, তুচ্ছ ওই কথা কাঁথা করে চোখের মাথাটা আর খেও না। জীবনভোর তো কাঁথায় ফুল তুললে, আর কেন?
অমূল্যর মা ফুলেশ্বরী ছেলের এই বকুনিতে হাসেন। বলেন, জীবনভোর তো ভাত খাচ্ছি, তবু আবার খাই কেন?
তার সঙ্গে এর তুলনা! না মা না, তুমি এবার ক্ষ্যামা দাও। নইলে শেষ অবধি অন্ধ হয়ে যাবে–
ফুলেশ্বরী সতেজে বলেন, অন্ধ অমনি হলেই হল? ভগবানের লীলা নিয়ে কাজ করছি—
সুবৰ্ণ শুনতে পায়।
সুবৰ্ণ অবাক হয়।
সুবৰ্ণ প্রশ্ন না করে পারে না।
প্রশ্ন করে, কিসের কাজ করছেন?
সুবালা হেসে ওঠে, জানো না? আর জানবেই বা কোথা থেকে? আমার শাশুড়ীর এই এক বাতিক! বারো মাস কাঁথা সেলাই করছেন। কে শোবে, কার দরকার, সেসব চিন্তা নেই। ওই সেলাই! আর তাই কি সোজাসুজি ফুল-লতা যে, হলো না হলো মিটিয়ে নিলাম? তা নয়, কাঁথায়। এখন মধুসূদার ননী মন্থন লীলাটি সেলাই করে করে তুলছেন!
সে কি?
তবে আর বাতিক বলছি কেন! ওই লীলার যাবতীয় খুঁটিনাটি সব বসে বসে সিলোচ্ছেন। যতক্ষণ আকাশের আলো থাকবে, ততক্ষণ তাকে কাজে লাগাবেন। আমি বলি তা একরকম ভালো। পাড়ার অন্য গিন্নীদের মতন পরকুচ্ছে না করে বসে বসে কথা সিলোন, তা ভাল।
সুবৰ্ণ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে।
সুবালার ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়ে গেছে, ও কাঁথায় শোবে কে?
শোবে কে?
ও বাবা, ও কি শোবার কথা? মা যশোদার মূর্তি আঁকা! ও শুধু গায়ে দেবার। গায়ে দেবে সুবালার ভবিষ্য-কালের নাতি! ফুলেশ্বরী তো আর থাকবেন না তখন, হাতের কাজটুকু রেখে যাবেন। লোকে সোনাদানা রেখে যায়, ওঁর তো সেসব নেই, তাই—
সুবৰ্ণ ভাবে, কী সুন্দর!
বাড়ির গিন্নী বাড়ির সকলের ওপর চোখ ফেলে ফেলে তাদের খুঁত বার করে করে গালমন্দ করে না বেড়িয়ে ছুঁচের ওপর চোখ ফেলে সুতোয় আঁকা ছবিটিকে নিখুঁত করছেন বসে বসে।
সুবালা কী সৌভাগ্যবতী!
সুবৰ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে।
সুবৰ্ণ বলে, সোনাদানা থেকে ঢের দামী! আচ্ছা, ছুঁচে সুতো পরতে পারেন?
ও বাবা! আমার থেকে ভাল। পঞ্চাশটা ছুঁচে পঞ্চাশ রকম সুতো পরাচ্ছেন চব্বিশ ঘণ্টা। নেশা নেশা!
নেশা! নেশা মাত্রেই কি ক্ষতিকর?
অপর মানুষের গায়ে ছুঁচ বিঁধবার প্রবৃত্তির থেকে তো অনেক ভাল নেশা এই কাঁথায় ছুঁচের ফোঁড় তোলা!
কী অদ্ভুত নিষ্ঠা!
বিশ্বাস রাখেন দেবতার লীলা আঁকতে বসে চোখ নষ্ট হতে পারে না!
ওই কাঁথার ফুল থেকেই মুক্তি মানুষটার!
নামটিও তেমনি সুন্দর, ফুলেশ্বরী!
সুবালা তারি ভাগ্য সম্পর্কে কৃতজ্ঞ কিনা কে জানে!
কিন্তু সুবর্ণ যদি ওই ফুলেশ্বরীর বৌ হতো!
সুবালা আরো বলেছে, কারুর সাতে-পাচে নেই, জগৎ আছে কি নেই জ্ঞান নেই, ওই শিল্পকন্ম নিয়েই মশগুল।
তবু বলবে না। সুবর্ণ, সুবালা কী ভাগ্যবতী?
সুবৰ্ণ আস্তে আস্তে ফুলেশ্বরীর কাছের গোড়ায় গিয়ে বসে।
ফুলেশ্বরীর ছুঁচে সুতো পরাতে পরাতে বলেন, কে? কলকাতায় বৌমা? এসো বসো! ছেলেরা?
এদিক-ওদিক ঘুরছে।
আহা, শহুরে বেচারাদের কী কষ্ট!
কষ্ট কি মাউ-ই মা, সুখ বলুন। এমন খোলামেলা, আলো-বাতাস জীবনে দেখেছে ওরা?… আচ্ছা মাউ-ই মা, ছেঁড়া কাপড়ের কথা, তাতে এত খেটে কি হয়? এত ফুল কেটে কি হয়?
সুবৰ্ণর কি এ কথা নিজের কথা?
না, ওই বৃদ্ধার মর্মকথা আদায় করতে চায় সে?
তা মৰ্মকথাই বলেন ফুলেশ্বরী। হেসে ফেলে বলেন, ফুল কাটি কি আর ছেঁড়া কাঁথার গায়ে মা, ফুল কাটি মনের গায়ে। জীবনভোর তো শুধু ধান সেদ্ধ করছি, গোবর কুড়োচ্ছি, কাঠ কাটছি, জল তুলছি, ভাত রাঁধছি, ভাল কাজের তো কিছুই করলাম না, তবু একটা ভাল কাজ—
হঠাৎ গলা নামান ফুলেশ্বরী।
বলেন, তোমার কাছে ছেঁড়া পাড় আছে কলকাতায় বৌমা? রগরগে ঝকঝকে পাড়? যাতে সুতো ভাল ওঠে—
গলা নামালেও কথাটা সুবালার কানে ওঠে।
সুবালা বলে ওঠে, মার যেমন কথা! কদিনের জন্যে এসেছে মেজবৌ, ও বুঝি ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এসেছে!
সহসা সুবর্ণ বলে ওঠে, এনেছি, এনেছি মাউ-ই মা, এক্ষুনি দিচ্ছি!
ফুলেশ্বরী বলে ওঠেন, রাজরাণী হও, হাতের নোয়া বজ্জর হোক।… কী পাড় আছে? লাল আছে?
লাল কালো দুই-ই আছে।
আহা, আমার সোনার মেয়ে! ওই দুটো রঙের জন্য কাজ আটকে পড়ে আছে। …তা হ্যাগা কলকাতার বৌমা, বিলিতি কাপড়ের পাড় নয় তো? তা হলে কিন্তু অম্বিক আস্ত রাখবে না। আমায়া!
সুবৰ্ণ একবার ফুলেশ্বরীর মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয়। বলে, এই কাপড়, এই সব সুতো, সমস্ত দিশী জিনিস?
ফুলেশ্বরী মৃদু হাসেন।
বলেন, মিছে কথা বলব কেন, এ কাপড়ও বিলিতি, এর সুতোও অর্ধেক বিলিতি। আরম্ভ যখন করেছি, তখন দেশী বিলিতির ধুয়ো ওঠেই নি। দেখছি না, আগের সেলাই সব ঝকঝকে, এখনকার সব ম্যাড়মেড়ে! মন ওঠে না। কিন্তু কি করবো, ছেলেটা মনে কষ্ট পায়। বলে, ওইটুকু চকচকেটাই বড় হল তোমার? বলে, নেহাৎ নাকি মা যশোদা এঁকে বসে আছ তাই, নইলে পুড়িয়ে দিতাম! তা স্বদেশী পাড়ের সুতো থাকে যদি—
এই যে এক্ষুনি দিচ্ছি—, উঠে যায় সুবর্ণ।
সুবালা বলে, সাধে বলেছি বাতিক! যাকে পাবেন তাকেই বলবেন, ছেঁড়া কাপড়ের পাড় আছে? তুমি ছেঁড়া পাড় কোথায় পাবে বল তো?
পাবো পাবো, এই যে আছে গো!
সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়, ট্রাঙ্ক খুলে আস্ত আস্ত দুখানা শাড়ি বার করে ফ্যাসফ্যাস করে তার পাড় ছিঁড়ে স্তুপাকার করতে থাকে। পাড়ের রং একটু ম্যাড়মেড়ে, সেটাই রক্ষে।