ত্রয়োদশ পাঠ
মোহিতাবস্থা কাহাকে বলে?
ইতঃপূর্বে ইহা পরিষ্কাররূপে বিবৃত করা হইয়াছে যে, মোহিতাবস্থা মনের গ্রহণ-শক্যতা বা সংবেদনার একটি বিশেষ স্তর এবং উহা নিদ্রার সাহায্যে বা উহা ব্যতিরেকে এক ব্যক্তি কর্তৃক তাহার নিজের বা অপরের উপর উৎপাদিত হইয়া থাকে। এই অবস্থা সম্মোহনবিৎ ও পাত্রের ইচ্ছাশক্তির সহযোগিতায় উৎপন্ন হয়। যখন সম্মোহনবিৎ কাহাকেও মোহিত করে, তখন শেষোক্ত ব্যক্তি তাহার চিন্তা ও কল্পনা আদিষ্ট বিষয়ের দিকে চালনা করিয়া পূর্বোক্ত ব্যক্তিকে উত্তাবস্থা উৎপাদনের সাহায্য করিয়া থাকে। অতএব পাত্রের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সহায়তা ভিন্ন এই অবস্থা উৎপাদিত হয় না। জাগ্ৰদবস্থায় মোহিত পাত্র কেবল অল্প সময়ের জন্য আংশিকরূপে সম্মোহনবিদের বশীভূত হয়। এজন্য সে তাহাকে সমস্ত কাৰ্য্যে বাধ্য করিতে পারে না, কিম্বা তাহাকে উকাবস্থায় কয়েক মিনিটের বেশী সময় অভিভূত রাখিতেও সমর্থ হয় না। প্রকৃত মোহিতাবস্থা নিদ্রার সাহায্যে উৎপন্ন হয় এবং কেবল সেই অবস্থায়ই পাত্র সমধিক পরিমাণে সম্মোহনবিদের আয়ত্তাধীন হইয়া বশ্যতা সহকারে তাহার আদেশ সকল পালন করে। এইক্ষণ আমরা স্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিলাম যে, স্বাভাবিক অবস্থা অপেক্ষা নিদ্রিতাবস্থায়ই পাত্রকে অধিক পরিমাণে আয়ত্ত করা যায়। সুতরাং কি উপায়ে আমরা তাহাকে নিদ্রিত করিতে পারি, এখন আমাদিগকে তাহাই দেখিতে হইবে।
পাত্র সম্মোহন নিদ্রায় অভিভূত হইলে, সে বিশ্বস্ত অজ্ঞাবহের ন্যায় বিনা আপত্তিতে সম্মোহনবিদের সকল আদেশ পালন করিয়া থাকে। উক্তাবস্থায় কাৰ্যকারক নিজের ইচ্ছামত তাহার মনে যে কোন প্রকার মায়া ও ভ্ৰম জন্মাইতে পারে। তখন তাহার সম্মুখে একখানা ইট রাখিয়া যদি এরূপ বলা যায় যে, উহা একটা প্রকাণ্ড লোহার সিন্ধুক এবং সে কিছুতেই উহা উঠাইতে পারিবেনা, তবে সে তাহাই বিশ্বাস করিবে এবং সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াও উহাকে উঠাইতে সমর্থ হইবেন; কিম্বা যদি তাহাকে এরূপ আদেশ করা যায় যে, সে একজন বক্তা, নর্তকী বা মিঠাইফেরিওয়ালা, তবে সে তাহাই বিশ্বাস করিয়া উক্ত ব্যক্তি বিশেষের কাৰ্য্য, তাহার অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও ক্ষমতানুসারে সম্পাদন করিতে চেষ্টা পাইবে। আবার যদি তাহাকে এরূপ বলা যায় যে, তাহার পাশের চেয়ারে বসিয়া একটা কুকুর ঠিক মানুষের মত গড়গড়ার নলে তামাক টানিতেছে, তবে সে ঐ কল্পিত দৃশ্য দেখিয়া হাসিয়াই আকুল হইবে ইত্যাদি। উত্তাবস্থায় আদেশের সাহায়্যে যেমন তাহার মনে বহু প্রকার মায়া ও ভ্রম উৎপাদন করা যায়, ঠিক সেইরূপে তাহার শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বোগ সমূহ আবোগ্য এবং মন্দ অভ্যাস সকল বিদূরিত এবং মনের সবৃত্তি নিচয়কে বর্ধিত করতঃ তাহার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির যথেষ্ট সাহায্য করা যায়। এতদ্ব্যতীত তাহার দ্বারা সম্মোহনবিদের অভীল্পিত বহু কাৰ্য্য সাধিত হইতে পারে।
মোহিত ব্যক্তি কাৰ্যকারকের আদেশানুসারে সমস্ত কার্য সম্পাদন করে, এবং সে নিদ্রিত বলিয়াও কোন আদেশ পালন করিতে তাহার কোন অসুবিধা হয় না। কারণ কোন কাৰ্য্য করিতে যে সকল জ্ঞান ও কৰ্ম্মেন্দ্রিয়ের সাহায্য আবশ্যক হয়, সেই ইন্দ্রিয়গুলি নিদ্রিতাবস্থায়ও অল্পধিক পরিমাণে কার্যোপযোগীভাবে সজাগ থাকে। নিদ্রার সময় চক্ষু মুদিত থাকে বলিয়া কেবল দর্শনেন্দ্রিয়ের কাৰ্য্য বন্ধ থাকে, কিন্তু অপরাপর ইন্দ্রিয়গুলি অল্পাধিক পরিমাণে সজাগ ও কর্মক্ষম থাকে। নিদ্রিত ব্যক্তির ঘরে কেহ প্রবেশ করিলে সে তাহাকে দেখিতে পায় না বটে, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যদি তাহার নাম ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকে, তাহা হইলে সে উহা শুনিতে পায় এবং তাহার শরীরে কোন কঠিন আঘাত করিলেও উহা অনুভব করিতে পারে ইত্যাদি। আর কৰ্ম্মেন্দ্রিয়গুলি সকল অবস্থাতেই কর্মক্ষম বলিয়া উহার কোন কর্মের উত্তেজনা পাইলেই কাৰ্য্য করিয়া থাকে। সুতরাং মোহিত ব্যক্তি, কেবল দর্শনেন্দ্রিয়ের কাৰ্য ব্যতীত অপরাপর জ্ঞান ও কর্মেন্দ্রিয়গুলির সমস্ত কাৰ্য্যই সম্পন্ন করিতে সমর্থ। মোহিত ব্যক্তির চক্ষু মুদিত থাকে বলিয়া সে কিছুই দেখিতে পায় না বটে, কিন্তু কাৰ্যকারক আবশ্যক মত উহাদিগকে খুলিয়া দিতে পারে এবং তাহাতে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হয় না,—অর্থাৎ আদিষ্ট কাৰ্যটি সম্পাদন করিতে যদি তাহার চক্ষুর সাহায্য আবশ্যক হয়, তবে তাহার দ্বারা সেই কার্য সম্পাদনের নিমিত্ত সম্মোহনবিৎ আদেশ দ্বারা তাহার চক্ষু খুলিয়া দিলেও তাহার মোহিতাবস্থা দূরীভূত হয় না। স্বাভাবিক নিদ্রায় চক্ষু মেলিবার সঙ্গেই ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়, কিন্তু সম্মোহন নিদ্ৰায় তাহা নাও হইতে পারে। অতএব, এইক্ষণ আমরা আরও পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম যে, মানুষ জাগ্ৰদবস্থায় যে সকল কাৰ্য্য করিতে পারে, মোহিতাবস্থাতেও সে, সেই কাৰ্যগুলি সম্পাদন করিতে সমর্থ। মোহিত ব্যক্তি যে কেবল জাগ্রত মানুষের ন্যায় সমস্ত কাৰ্য্য করিতে পারে এমত নহে, কোন কোন কাৰ্য সে জাগ্রত বা সজাগ মানুষ অপেক্ষাও সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া থাকে। নিদ্রিতাবস্থায় কতকগুলি নির্দিষ্ট মনোবৃত্তি বেশ সজাগ হইয়া উঠে বলিয়া মোহিতাবস্থায় সেই সকল মনোবৃত্তির কাৰ্য্য, তাহার দ্বারা খুক দক্ষতার সহিত সম্পাদিত হইয়া থাকে। নিদ্রিতাবস্থায় চলা-ফেরা, কথা-বার্তা ইত্যাদি করিলে উক্তাবস্থাকে স্বপ্নভ্রমণ’ বলে। অনেকে হয়ত শুনিয়াছেন যে, কোন কোন ব্যক্তি রাত্রিকালে, নিদ্রিতাবস্থায় শয্যা পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক, জাগ্রত মানুষের ন্যায় চলা-ফেরা, কথা-বার্তা ইত্যাদি বহু প্রকার কাৰ্য্য করিয়া থাকে। কিন্তু নিদ্রাভঙ্গের পরেই উক্তাবস্থা সম্বন্ধে তাহাদের স্মৃতি অন্তর্হিত হয়,-কেবল কেহ কেহ উহ। অস্পষ্ট স্বপ্নের ন্যায় আংশিকভাবে স্মরণ করিতে পারে মাত্র। স্বপ্নভ্রমণকারিগণের ন্যায় সম্মোহিত ব্যক্তিদের ও কৃতকাৰ্যাদির স্মৃতি থাকে না। তবে যে সকল পাত্রের সম্মোহন নিদ্রা খুব পাতলা হয়, তাহাদের কেহ কেহ উহা আংশিক রূপে স্মরণ করিতে পারে মাত্র। যাহাদের উহা আংশিক রূপে মনে থাকে, তাহাদিগকে অবশিষ্ট কাৰ্য্য গুলি স্মরণ করাইয়া দিলে সমর সময় সমস্ত কাৰ্যের স্মৃতিই তাহাদের মানসপটে জাগিয়া উঠে। কিন্তু যাহারা গভীর সম্মোহন নিদ্রায় অভিভূত হয়, তাহারা কোন ক্রমেই উহার বিন্দুমাত্রও স্মরণ করিতে সমর্থ হয়না। অতএব, মোহিতাবস্থায় পাত্রের কৃতকাৰ্যাদির স্মৃতির বিলোপ সম্পূর্ণরূপে তাহার নিদ্রার গভীরতার উপর নির্ভর করে; নিদ্রা যত বেশী গাঢ় হয়, উক্ত কাৰ্যাদি সম্বন্ধে তাহার স্মৃতিও ঠিক সেই পরিমাণে লোপ পাইয়া থাকে। স্বাভাবিক অবস্থার সহিত স্বপ্নটন অবস্থার এরূপ সাদৃশ্য আছে যে, যখন স্বপ্নভ্রমণকারী ঐ সকল কাৰ্য্য করে, তখন যে সে নিদ্রিত, তাহা সহজে বুঝিতে পারা যায় না। চিকিৎসকগণ উহাকে এক প্রকার রোগ বলিয়া নির্দেশ করেন। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিগণ যেমন অজ্ঞাতসারে ঘুমন্তাবস্থায় শয্যা পরিত্যাগ করিয়া জাগ্রত মানুষের ন্যায় নানা প্রকার কাৰ্য্য করে, মোহিত ব্যক্তিও সম্মোহনবিৎ কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া তাহার আদেশ সকল পালন করিয়া থাকে। সুতরাং উভয় অবস্থাই তুল্যরূপ। এতদুভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই যে, রোগাক্রান্ত ব্যক্তিগণের উহা স্বতঃ, আর মোহিত ব্যক্তির উহা সম্মোহনবিৎ কর্তৃক উৎপাদিত হইয়া থাকে। অতএব প্রথমোক্ত অবস্থাকে ‘স্বাভাবিক’ আর দ্বিতীয় অবস্থাকে ‘কৃত্রিম’ বলা যাইতে পারে।
স্বাভাবিক নিদ্রার সহিত সম্মোহন নিদ্রার প্রকৃতি গত কোন পার্থক্য নাই। স্বাভাবিক নিদ্রায় যে সকল শারীরিক লক্ষণ (physiological symptoms) প্রকাশ পায়, সম্মোহন নিদ্ৰাতেও পাত্রের শরীরে সেই সকল লক্ষণই দৃষ্ট হইয়া থাকে। এখন এই স্থানে ইহা প্রশ্ন হইতে পারে যে, যদি স্বাভাবিক নিদ্রার সহিত সম্মোহন নিদ্রার স্বভাব গত কোন পার্থক্য না থাকে, তবে সম্মোহনবিৎ কোন আদেশ করিলে যেমন মোহিত ব্যক্তি তাহা পালন করে, স্বাভাবিক নিদ্রায় নিদ্রিত ব্যক্তিকে কেহ আদেশ করিলে সে তোপ তাহার আদেশ পালন করে না কেন? উহার কারণ এই যে, স্বাভাবিক নিদ্রা হইবার সময় মন কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সংলগ্ন থাকে না বলিয়া, উহা নিদ্রার সময়ও কাহার কোন আহ্বান বা আদেশের সাড়া দেয় না। আর মোহিত ব্যক্তির মন সম্মোহন নিদ্রার সময়, কাৰ্যকারকের প্রতি বিশেষরূপে আকৃষ্ট থাকে বলিয়া, উহা তাহার প্রত্যেক আদেশ পালন করিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এই নিমিত্ত পাত্র নিদ্রিত অবস্থাতেও কাৰ্যকারকের আদেশ পালন করে। নিদ্রিত ব্যক্তিকে কেহ কোন কাৰ্য্য করিতে বলিলে, যেমন সে উহা পালন করে, এবং তজ্জন্য বেশী পীড়াপীড়ি করিলে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়, সেইরূপ মোহিত ব্যক্তিকেও সম্মোহনবিৎ ব্যতীত অপর কেহ কোন আদেশ করিলে, সে তাহা পালন করেনা; এবং তন্নিমিত্ত বেশী জেদ করিলে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। নিম্নোক্ত চিত্রটি উহার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত। প্রসূতি তাহার শিশু সন্তান লইয়া শুইয়াছে, উভয়েই নিদ্রাচ্ছন্ন; ঘরে লোকজন যাতায়াত করিতেছে, কথা কহিতেছে, নানারূপ গোলমাল হইতেছে, তথাপি প্রসূতির ঘুম ভাঙ্গিতেছেনা; কিন্তু যখন তাহার শিশুটি কাঁদিয়া উঠে, সেই মুহূর্তেই সে জাগিয়া উঠে। উহার কারণ, নিদ্রা হইবার সময় প্রসূতির মন শিশুর প্রতি দৃঢ় সংলগ্ন ছিল বলিয়া কেবল শিশুর ক্রন্দনেই তাহার মন সাড়া দিয়াছে, অপর লোকের কথা-বার্তা, গোলমাল ইত্যাদিতে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই। মোহিত ব্যক্তির মানসিক অবস্থাও ঠিক শিশুর মাতার ন্যায়; অপর লোকের কথা-বার্তা বা কোন গোলমালের প্রতি তাহার কিছুমাত্র হৃক্ষেপ নাই, সে বিশ্বস্ত আজ্ঞাবহের ন্যায় নিবিষ্ট মনে কেবল কাৰ্যকারকের আদেশই পালন করিয়া থাকে।