দ্বাদশ পাঠ
জাগ্ৰদবস্থায় মোহিত করা সম্বন্ধে বিশেষ উপদেশ
পূর্বোক্ত পাঠ সমুহে যে পরীক্ষাগুলি প্রদত্ত হইয়াছে, উহাদিগকে “শারীরিক পরীক্ষা” (Physical Tests) বলে। উহাদিগকে সম্পাদন করিতে কাৰ্য্যকারক নিম্নোক্ত বিষয়গুলির উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিবে।
(১) কোন লোককে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মোহিত করা কঠিন; এজন্য সে মোহিত হইতে ইচ্ছুক কিনা, তাহা পূর্বে জানিয়া লইবে। যদি সে মোহিত হইতে ইচ্ছুক না হয়, তবে কাৰ্যকারক তাহাকে পরিষ্কাররূপে বুঝাইয়া বলিবে যে, এই পরীক্ষাগুলি সম্পূর্ণ নির্দোষ ও আমোদজনক ক্রীড়া মাত্র; সুতরাং উহাদের দ্বারা তাহার শারীরিক বা মানসিক কোন প্রকার অনিষ্টেরই সম্ভাবনা নাই। এরূপ বলিলে হয়ত সে আর মোহিত হইতে অনিচ্ছুক হইবে না।
(২) পরীক্ষা করিবার সময় পাত্র স্থির ও গম্ভীর ভাব অবলম্বন পূর্বক মনাযোগের সহিত আদিষ্ট বিষয়ের চিন্তা করিবে এবং কদাপি কথা-বার্তা বলিয়া বা হাস্য-কৌতুক করিয়া কোনরূপ চপলতা প্রকাশ করিবেনা।
(৩) কয়েকটি বিভিন্ন লোকের উপর এই পরীক্ষাগুলি সম্পাদন করিয়া কৃতকাৰ্য্য না হওয়া পর্যন্ত কাৰ্যকারক কাহারও সম্মুখে কোন পরীক্ষা করিবেন। কারণ দর্শকগণের কথা-বার্তা, নড়া-চড়া ইত্যাদিতে অনেক সময় একাগ্রতা ভগ্ন হয় এবং তাহার ফলে পরীক্ষা বিফল হইয়া থাকে।
(৪) যে সকল ব্যক্তি স্বভাবতঃ চঞ্চল চিত্ত, ভীরু স্বভাব, অনুসন্ধিৎসু* অথবা যাহারা সম্মোহনবিংকে ঠকাইবার অভিপ্রায়ে শক্তির গতি রোধ করিতে আগ্রহান্বিত, শিক্ষার প্রারম্ভে, তাহাদিগকে কখনও পাত্র মনোনীত করিবে না। যদি কাৰ্যকারক পরীক্ষার জন্য অপর লোক সংগ্রহ করিতে পারে তবে, প্রথম প্রথম তাহার আত্মীয়-বন্ধুদিগের উপরও চেষ্টা করিবেনা; কারণ তাহারা তাহাকে শিক্ষানবীস ভাবিয়া ঠাট্টা-তামাসা দ্বারা তাহার চেষ্টা বিফল করিয়া দিতে পারে। যে সকল লোকের সহিত তাহার বিশেষ ভাব নাই, বা যাহারা তাহার অপরিচিত, তাহারা তাহার শক্তির প্রতি সহজে আস্থাবান হইবে ও বশ্যতা সহকারে নিয়ম-প্রণালীগুলি অনুসরণ করিবে। এজন্য সে অল্পায়াসেই তাহাদিগকে এই পরীক্ষাগুলিতে অভিভূত করিতে সমর্থ হইবে।
(৫) কাৰ্যকারক আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া উৎসাহের সহিত শান্ত ভাবে কাৰ্য্য করিবে। সে যে একজন শিক্ষানবীস তাহা সে পাত্রদিগের নিকট কখনও প্রকাশ করিবেনা; বরং এ বিষয়ে তাহার বেশ দক্ষতা আছে, সৰ্ব্বদা এরূপ ভাবই প্রকাশ করিবে।
(৬) শিক্ষার্থী মোহিত পাত্রের প্রতি সর্বদা সদয় ব্যবহার করিবে এবং তাহাকে কখনও কঠোর ভাবে বা অসাবধানে নাড়া-চাড়া করিবে না; কিম্বা অপর কাহাকেও তাহা করিতে দিবে না। সে নিজে মোহিত জাগ্ৰদবস্থায় মোহিত করা সম্বন্ধে বিশেষ উপদেশ হইলে সম্মোহনবিদের নিকট হইতে যেরূপ ব্যবহার পাইবার আশা করিবে, সে পাত্রের প্রতি সর্বদা ঠিক সেইরূপ ব্যবহার করিবে।
কাৰ্যকার সময় সময় এমন লোকের সাক্ষাৎ পাইতে পারে, যাহাকে মোহিত হইতে অনুরোধ করিলে, সে হয়ত বলিবে—“আপনার ইচ্ছাশক্তি অপেক্ষা আমার ইচ্ছা শক্তি প্রখর; সুতরাং আপনি আমাকে মোহিত করিতে পারিবেন না। এই সকল লোক নিৰ্ব্বন্ধশীলতা বা একজ্ঞায়িতাকে (একগুয়েমি) ইচ্ছা শক্তি মনে করিয়া বড় ভুল করিয়া থাকে। তাহাদিগকে, মোহিত করা কঠিন হইতে পারে, কিন্তু একজ্ঞায়ি ইচ্ছাশক্তি নহে। যাহারা ইচ্ছাশক্তির গৰ্ব করে, তাহাদের মধ্যে যথার্থরূপে উহার পরিমাণ অতি অল্প। সে তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবে যে, মোহিতাবস্থা সম্মোহনবিৎ ও পাত্রের ইচ্ছাশক্তির সহযোগিতায় উৎপন্ন হয়–বিরোধে হয় না। সুতরাং যাহারা বলে যে, কেবল দুর্বল ব্যক্তিই সবল ব্যক্তি কর্তৃক সম্মোহিত হয়, তাহারা ভ্রান্ত। এই অবস্থা ইচ্ছাশক্তির সংঘর্ষণে উৎপন্ন হয় না বলিয়া এবং প্রখর ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি সহজে মন একাগ্র করিতে পারে বলিয়া সে, অন্যান্য লোক অপেক্ষা শীঘ্র মোহিত হইয়া থাকে।
সম্মোহন আদেশ, হাত বুলান ও দৃষ্টিক্ষেপন সম্বন্ধে যাবতীয় বিষয় যথা স্থানে বিশদরূপে বিবৃত হইয়াছে; সুতরাং এখানে বিশেষ কিছু বলিবার নাই। উহাদের সম্বন্ধে আসল কথা এই যে, উহাদিগকে তুল্যরূপে প্রয়োগ করিতে হয়। চক্ষু বন্ধের পরীক্ষা ব্যতীত আর সকল পরীক্ষাতেই পাত্র কাৰ্যকারকের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিবে এবং যতক্ষণ প্রক্রিয়াটি শেষ না হয়, ততক্ষণ সে সাধ্যমত চোখের সমস্ত প্রকার গতি বন্ধ রাখিয়া মনোযোগের সহিত আদিষ্ট বিষয়ের চিন্তা করিবে। বলা বাহুল্য যে, ঐ সময় কাৰ্যকারকও নিজের চক্ষু উঠা-নামা করিতে কিম্বা কাপাইতে পারিবে না। পাত্রের মন যত বেশী একাগ্র হইবে, আদেশ তত দৃঢ়রূপে কার্য করিবে এবং সম্মোহনবিৎ সাফল্যের জন্য যত অধিক আগ্রহান্বিত হইবে, সে তত শীঘ্র পাত্রকে অভিভূত করিতে সমর্থ হইবে। দৃষ্টি স্থাপন ও আদেশ প্রদানের সঙ্গে এক বা উভয় হাত দ্বারা শরীরের অংশ বিশেষের উপর (যে প্রত্যঙ্গকে অভিভূত করিতে ইচ্ছা করিবে। মৃদুভাবে হাত বুলাইবে এবং যখন বলিবে “তোমার হাত অত্যন্ত দৃঢ়রূপে বন্ধ হইয়া যাইতেছে,” “তোমার চোখ খুব কঠিনরূপে জোড়া লাগিয়া গিয়াছে,” “তুমি কিছুতেই কথা বলিতে পারিবেনা” ইত্যাদি, তখন শব্দ বিশেষের উপর জোর দিয়া কথাগুলি প্রকাশ করিবে এবং তৎসঙ্গে পাত্রের হাত, চোখ, গলা ইত্যাদি জোরের সহিত (অবশ্য সে ব্যথা না পায়) মাঝে মাঝে টিপিয়া দিবে। যখন সে হাত খুলিবার জন্য চেষ্টা করিতে থাকিবে, তখনও মাঝে মাঝে এক একবার কিছুতেই পারিবেনা, “কখনও পারিবেনা,” “প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও পারিবেনা” ইত্যাদি বলিবে।
কোন কোন শিক্ষার্থীর নিকট এই পরীক্ষাগুলি কঠিন বলিয়া বোধ হইতে পারে; কিন্তু বাস্তবিক ঐ সকল প্রক্রিয়া কঠিন নহে। সে একবার কাহারও হাত বন্ধ করিতে পারিলেই, তখন আর তাহার পক্ষে *চক্ষু বন্ধ করা, বাক্য বোধ করা ইত্যাদি পরীক্ষাগুলি কিছুমাত্র কঠিন বলিয়া বোধ হইবে না। অনেক শিক্ষার্থী দুই-তিন বারের চেষ্টায় এই পরীক্ষাগুলি করিতে সমর্থ হইয়াছে এবং কিছুদিন পূর্বে একটি যুবক শিক্ষার্থী আমাকে লিখিয়াছিল যে, সে কেবল নিয়ম-প্রণালীগুলি একবার মাত্র পাঠ করিয়াই এক ব্যক্তিকে সমস্তগুলি শারীরিক পরীক্ষায় অভিভূত করিতে পারিয়াছিল। সুতরাং নিয়ম-প্রণালীগুলি যথাযথরূপে অনুসরণ করিতে পারিলে শিক্ষার্থী প্রথম বারে না হউক, অন্ততঃ দুই-তিন বারের চেষ্টায় উক্ত প্রক্রিয়াগুলি সম্পাদন করিতে পারিবে। সে একটি বা দুইটি লোকের উপর দুই-চারিটি পরীক্ষা করিয়া কৃতকার্য হইলে, তাহাতেই সন্তুষ্ট না থাকিয়া সৰ্ব্বদা নূতন নূতন লোক লইয়া চেষ্টা করিতে থাকিবে। এই পরীক্ষাগুলি দ্বারা সে যত অধিক সংখ্যক লোক অভিন ভূত করিতে পারিবে, তাহার ইচ্ছাশক্তি তত বেশী পরিমাণে বর্ধিত হইবে। প্রতি দিন নুতন নুতন লোক লইয়া নিয়মিতরূপে কয়েক সপ্তাহ অভ্যাস করিলে তাহার ইচ্ছাশক্তি এরূপ বর্ধিত হইবে, যাহা সে অন্য কোন সহজ উপায়ে লাভের আশা করিতে পারে না।
————-
* অনুসন্ধিৎসা প্রশংসনীয় মনোবৃত্তি হইলেও মোহিত হইবার সময় কেমন করিয়া হয়? কি করিয়া হয়? ইত্যাদি জানিবার জন্য ব্যগ্র হইলে উহা একাগ্রতা নষ্ট করিয়া মোহিতাবস্থা উৎপাদনের বিঘ্ন জন্মাইয়া থাকে।