সত্যেন ভাদুড়ীর গায়ের পাঞ্জাবীটি গিলে করা, ধুতিটি কোঁচানো, কাঁধের শালটির পাড় প্রায় এক বিঘৎ চওড়া এবং মুখে হরতনের গোলামের মতন পাকানো গোঁফ, হাতে একটি রূপো। বাঁধানো ছড়ি। এই সবই তাঁর বনেদীআনার সূচক। দেশবিভাগে তাঁরা বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হননি, জমি-জমা অনেক গেছে বটে, কিন্তু নারায়ণগঞ্জে তাঁদের যে বিশাল বাড়ি ছিল সেটি আইনসঙ্গতভাবে বদল করে কলকাতার উপকণ্ঠে টালিগঞ্জের দিকে এক মুসলমানের একটি বেশ বড় বাড়ি পেয়েছেন। পূর্ববঙ্গে তাঁদের পাটের ব্যবসা ছিল, সেই অভিজ্ঞতায় পশ্চিমবঙ্গেও একটি চটকলের অংশীদার হয়েছেন, মূলধনও যথেষ্ট সরাতে পেরেছিলেন। বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপায় এদিকে এসে বরং তাঁদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে।
সত্যেন ভাদুড়ীর গান বাজনার শখ আছে, সেই সূত্রে বিশ্বনাথ গুহের সঙ্গে পরিচয়। নন্দন। পাহাড়ের কাছে এরা একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে হাওয়া পরিবর্তনে এসেছেন। বাজারে যাওয়া-আসার পথে মাঝে মাঝেই তিনি বিশ্বনাথের কাছে আসেন গল্প-গুজব করতে।
দু’জন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এ বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢুকে আজ বেশি মানুষজন দেখে থমকে গেলেন। বিশ্বনাথ এগিয়ে এসে বললেন, আসুন, আসুন, ক’দিন দেখিনি যেন?
সত্যেন ভাদুড়ী বললেন, একটু গিরিডি ঘুরে এলাম। শুনেছিলাম ওখানকার জল খুব ভালো, অ সত্যিই কিন্তু, খাবার হজম হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। আপনার বাড়িতে অতিথি এসেছে বুঝি? আমরা অসময়ে এসে পড়লাম…
বিশ্বনাথ বললেন, আরে কী যে বলেন! আমার বাড়িতে কোনো সময়ই অসময় নয়।
প্রতাপকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়ে সহাস্যে বললেন, এই দুনিয়াটাই শ্যালকে ভর্তি, তবে এটি আমার একমাত্র আপন শ্যালক। কলকাতায় জজিয়তি করেন।
সত্যেন ভাদুড়ী প্রতাপকে নমস্কার করে বললেন, আপনাদের মালখানগরে বাড়ি ছিল না? আমি গেছি সেখানে, নামকরা জায়গা!
দেশ-বিভাগ এখনো যেন বাস্তব হয়ে ওঠেনি। তাই ফেলে আসা গ্রাম-শহরের কথাও খুব। আপন আপন সুরে উচ্চারিত হয়, অন্যকথার আগে দেশের কথা চলে কিছুক্ষণ।
মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার প্রথা নেই। দুই নারী একটু পাশ ফিরে বাগানের গাছপালা নিরীক্ষণ করছেন। প্রতাপ আড়চোখে দেখতে লাগলেন গায়ত্রীকে। নিজের বয়েস বাড়ার কথা মানুষের মনে থাকে না, প্রতাপ গায়ত্রীর বয়েস বাড়াটাই লক্ষ্য করলেন। মাঝখানে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান, গায়ত্রীর অনেক বদল হয়েছে, কিন্তু মুখের আদলটা একই রকম, চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না।
গায়ত্রী একবার একটু মুখ ফেরাতেই প্রতাপ বললেন, কেমন আছো, বুলা?
গায়ত্রী প্রতাপের চোখের দিকে স্থিরভাবে দৃষ্টিপাত করে রইলো। সে দৃষ্টির মর্ম বোঝা বড় শক্ত। সে কোনো উত্তর দিল না।
কথা থামিয়ে অবাকভাবে সত্যেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওকে চেনেন?
প্রতাপ সহাস্যে বললেন, হ্যাঁ। ছাত্র বয়েসে ওদের বাড়িতে গিয়ে ছিলাম একবার। ওর মা বাবা এত যত্ন করেছিলেন, তা কোনোদিন ভুলবো না। তবে আপনার শ্যালিকাটি বোধহয় আমায় এখন চিনতে পারছে না।
সত্যেন বললেন, আমার শ্যালিকা নয়।
প্রতাপ তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন তাঁর ভুল হয়েছে। গায়ত্রীর তো কোনো দিদি বা বোন ছিল না।
সত্যেন বললেন, ইনি সম্পর্কে আমার বৌদি, যদিও আমার স্ত্রীর চেয়ে বয়েসে ছোট। আমার খুড়তুতো ভাই নরেন আর আমি একেবারে পিঠোপিঠি, নরেন আমার চেয়ে মাত্র এগারো দিনের বড়। কোনোদিন আমি তাকে দাদা বলিনি অবশ্য। সেই নরেনের স্ত্রী।
একটু থেমে তিনি আর একটি তথ্য যোগ করলেন, নরেন এখন বিলেতে আছে।
বিশ্বনাথ বললেন, বারান্দায় উঠে আসুন। এই বাবলু, তোর শান্তিপিসিকে ডাক তো!
শান্তি এসে সত্যেনের স্ত্রী বিভাবতী আর গায়ত্রীকে নিয়ে গেলেন অন্দরমহলে। পুরুষরা বারান্দায় চেয়ারে বসে রোদ্দুরে পা দিয়ে গল্প করতে লাগলেন। চা ও পাঁপড় ভাজা এলো। সত্যেন যে টাঙ্গায় এসেছেন, সেটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেপুলেরা হুটোপাটি করছে। বাগানে। অলস ভাবে গড়িয়ে যাচ্ছে বেলা।
সত্যেন ভাদুড়ী আগামীকাল সন্ধেবেলা সবাইকে নেমন্তন্ন করে গেলেন তাঁর বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া, গানবাজনা হবে।
দুপুরবেলা প্রতাপ যখন ঘরে এসে দিবানিদ্রার উদ্যোগ করছেন তখন পান খাওয়া ঠোঁটে হাসি টিপে মমতা জিজ্ঞেস করলেন, এই তোমার সেই বুলা?
প্রতাপ স্ত্রীর কাছে বুলা-বৃত্তান্ত গোপন করেন নি। অনেক সময় মৃদু দাম্পত্য কলহে প্রতাপ রঙ্গ করে বলেছেন, আমাকে এরকম খোঁটা দিয়ে কথা বলছো? জানো, একজন ব্রাহ্মণ কন্যা নিজে সেধে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! যেমন তার রূপ, তেমন ছিল তার গুণ!
মমতাও অনেক সময় ঠাট্টা করে বলেছেন, তুমি সব সময় আমার ওপর এত মেজাজ দেখাও। সেই বামুনের মেয়েকে বিয়ে করলে জব্দ হতে। সে শুনেছি একে সুন্দরী, তার ওপরে ভালো গান গায়, সে এত কিছু সহ্য করতো না!
মমতার খুব ইচ্ছে ছিল গায়ত্রী নাম্নী সেই মেয়েটিকে একবার দেখবার।
প্রতাপও হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলে? আমি কি বাড়িয়ে বলেছি কিছু?
মমতা একটা পাট করা শাড়ী অকারণে খুলে আবার পাট করতে করতে বললেন, তোমার বুলা তো কথাই বলতে চায় না। স্বামী বিলেতে থাকে বলে বুঝি খুব অহংকার? আমার ছোট কাকাও তো বিলেতে থাকেন। তার জন্য আমার ছোট কাকীর তো কোনোদিন অহংকার। দেখিনি!
প্রতাপ বললেন, অনেকদিন পর দেখা তো, বুলা বোধহয় আমাকে ঠিক চিনতে পারে নি।
মমতা ঝংকার দিয়ে বললেন, ঠিকই চিনেছে। তুমি সব সময় তার কথা ধ্যান করো, আর সে তোমাকে ভুলে যাবে? আমার দিকে কীরকম রাগ রাগ ভাব করে তাকাচ্ছিল!
প্রতাপ হা-হা করে হেসে উঠলেন।
একটু পরে তিনি ঘুমের ভান করে পাশবালিশটা জড়িয়ে নিলেন বটে, কিন্তু ঘুম এলো না। বুলার কথাই মনে পড়ছে। সেই প্রথম যৌবনের চমৎকার দিনগুলির স্মৃতি। সত্যেনের কাছে তিনি জেনেছেন যে সত্যসাধন আর সুরবালা এপারে চলে আসেন নি, তাঁরা রয়ে গেছেন কুমিল্লায় সেই বাড়িতেই। আর কেউ নেই, শুধু বুড়োবুড়ি। মরতে হয় তাঁরা ওখানেই মরবেন। সুরবালা অত করে বলেছিলেন তবু আর কোনোদিন যাওয়া হলো না প্রতাপের।
মামুনের সঙ্গেও অনেকদিন যোগাযোগ নেই। মামুন পূর্ব পাকিস্তানে বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি চালনায় চারজনের মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে পড়ে প্রতাপ শিউড়ে উঠেছিলেন। পরে নিহতদের নাম প্রকাশিত হলো কিন্তু সব আহতদের নাম জানা যায়নি। প্রতাপ একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন মামুনের নামে, তারও উত্তর আসেনি। কানাঘুষোয় শুনেছিলেন মামুন কারাবন্দী। এ বছর ফজলুল হক যে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন তো মামুনের ছাড়া পাওয়ার কথা।
বাইরে একটা ঘুঘু ডাকছে। কলকাতার তুলনায় এই সব স্থান অনেক নির্জন, দুপুরবেলা গাড়ি ঘোড়াও চলে না। ঘুঘুর ডাকটি কী স্পষ্ট! মনে পড়ে যায় মালখানগরের দুপুরগুলোর কথা। শৈশব, কৈশোর। ঘুঘুর ডাকের মধ্যে ফুটে ওঠে একটা কথা : ঠাকুর গোপাল, ওঠো, ওঠো, ওঠো! ছেলেবেলায় এই রকম মনে হতো, এখনও সেই রকম শুনতে লাগে।
একটা সিগারেট ধরাবার জন্য পাশ ফিরতেই প্রতাপ দেখলেন মমতা এসে বসে আছেন জানলার ধারে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি শোবে না একটু?
মমতা বললেন, তোমার ঐ বুলা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও আমি রাগ করি নি। বরং আমার দুঃখই হলো ওর জন্য। ওর একটা খারাপ খবর শুনেছো?
–কী?
–ওর স্বামী ওকে নেয় না।
মেয়েরা তাড়াতাড়ি অনেক কিছু জেনে যায়। সত্যেন ভাদুড়ীর সঙ্গে অতক্ষণ গল্প হলো, তিনি বুলা সম্পর্কে আর একটি কথাও উত্থাপন করেননি। প্রতাপ বুলার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
প্রতাপ উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার কাছে শুনলে?
মমতা বললেন, খেতে বসে ছোট ঠাকুরঝি বললেন সব কথা। বুলার বর বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, তুমি জানতে?
–হ্যাঁ জানতুম। একবার দেখেছিও তাকে। খুলনা থেকে যাওয়ার পথে স্টিমারে। বুলাকে তখন তো খুব খুশী মনে হয়েছিল। ওর স্বামীটিকে দেখতে একেবারে সাহেবদের মতন।
-সাহেব না ছাই! আসলে একটি বিলিতি লাল মুলো! এখানে নাকি একদম প্র্যাকটিস জমাতে পারেনি, বাড়িতে বসে পায়ের ওপর পা দিয়ে আলস্য করতো। এদিকে গুণধরটি যে বিলেতে আগে একটা বিয়ে করে এসেছে সে কথা কারুকে জানায়নি। একদিন সেই মেম বউ এসে হাজির। সে একটা চাকরানী না ম্যাথরানী কিছু একটা হবে। আমার ছোটকাকা বলেছিলেন, বিলেতে গিয়ে আর তো কারুর সঙ্গে মেশার সুযোগ পায় না, ঐ। চাকরানী-ম্যাথরানী দেখলেই অনেক ছেলের মাথা ঘুরে যায়। আর টপ টপ বিয়ে করে ফ্যালে!
-–ছোড়দি এসব কথা কার কাছে শুনেছে?
–ঐ সত্যেনবাবুর বউই বলেছে। উনিও নাকি বুলাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না।
–মেম বউ এসে কী করলো?
–চ্যাঁচামেচি, ঝগড়া-ঝাঁটি, চুলোচুলি, শেষ পর্যন্ত কোর্ট কাছারি অবধি গড়িয়েছিল। সে বউ-এর নাকি দুটি বাচ্চা আছে। তার বিয়েটাই আগে, আর খ্রীষ্টান মতে বিয়ে হয়েছিল, সে ছাড়বে কেন? নাকে দড়ি দিয়ে নরেন ভাদুড়ীকে সে টানতে টানতে আবার বিলেতে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে নরেন ভাদুড়ী আর কোনো চিঠিপত্রও লেখে না।
–এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
–দশ এগারো বছর আগেকার। বুলার একটা ছেলে আছে শুনলাম। মেয়েটা এখন না বিধবা না-সধবা। সেই ক্ষ্যান্তগদানী মেম না মরলে নাকি নরেন ভাদুড়ীর দেশে ফেরার উপায় নেই।
–কেন ফিরতে পারবে না? দেশ এখন স্বাধীন হয়েছে, এখন তো আমাদের ওপর ব্রিটিশ আইন খাটবে না। হিন্দু মতে দুটি বিয়ে অসিদ্ধ নয়।
–কী জানি!
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন দু’জনেই। তারপর মমতা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার খুব খারাপ লাগছে, না?
প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, খারাপ লাগবে না? একটি মেয়েকে ছোটবেলায় চিনতাম, মেয়েটার অনেক গুণ ছিল, তার একটা সুন্দর জীবন প্রাপ্য ছিল। একটা তঞ্চক তার জীবনটার সর্বনাশ করে দিল।
–তুমি যদি ওকে বিয়ে করতে তা হলে ওর এসব কিছুই হতো না। একটা সুন্দর জীবন। পেত, তুমিও সুখী হতে।
–আরে যাঃ! আমার সঙ্গে বিয়ের তো কোনো প্রশ্নই ওঠেনি।
–অসুবিধে ছিল বলেই তুমি ওকে বিয়ে করতে পারোনি। জাতের অমিল না থাকলে তুমি ওকেই বিয়ে করতে। আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় যে তুমি সুখী হয়েছে, সে কথা একবারও বলো না।
প্রতাপ উঠে এসে জানলা দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললেন, তারপর মমতার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, পাগল! আমি এখন তিন ছেলেমেয়ের বাবা, এখনও এইসব কথা! তুমি নাটক-নভেল পড়তে ভালোবাসো, নাটকনভেলে কে কাকে বিয়ে করলো না তাই নিয়ে হা-হুঁতাশ থাকে। আমি তো ওসব পড়ি না! আমার মনের মধ্যেও ওসব নেই। বুলাকে বিয়ে করার কথা আমি কোনোদিনই ভাবি নি। ওকে আমি পছন্দ করতাম ঠিকই। ছোট বোনের মতন দেখতাম বললে ভুল হবে, একটু অন্যরকমের ভালোলাগা। ব্যস সেইটুকুই, আর কিছু না। বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করা, একটা গোলমাল পাকানো, আলাদ থাকা, আজকালকার ছেলেমেয়েরা যা করে, ওসব চিন্তা আমার মাথায় কোনোদিন আসেনি। …আর তুমি?
প্রতাপ মমতার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বললেন, ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং, ত্বমসি মম ভবজলধি রত্নম!
প্রতাপ সচরাচর সত্যি কথা বলেন। এসবই তাঁর মনের কথা। কিন্তু মানুষের মন তো একানো অনড় পাথর নয়, তা বাষ্পময় বস্তুর মতন, ক্ষণে ক্ষণে তার বদল হতে পারে। পরদিন রাতেই প্রতাপের ভাবান্তর হলো।
ঠিক হয়েছিল যে সত্যেন ভাদুড়ীদের বাড়ির নেমন্তন্নতে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হবে না, মা বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু পরদিন সন্ধেবেলা ও বাড়ি থেকে দু’খানা টাঙ্গা এসে উপস্থিত, পত্যেন ভাদুড়ী চিঠি পাঠিয়েছেন যে নিমন্ত্রণ সকলের। ছেলেমেয়েদের তো বটেই, এমনকি প্রপের মাকেও নিয়ে যেতে হবে। রাত্রে ফেরার ব্যবস্থাও তিনি করবেন।
চিঠি পড়ে বিশ্বনাথ বললেন, বড়লোকদের কায়দাই অন্য রকম। নেমন্তন্ন করলে যাওয়া-আসার ব্যবস্থাও ওদের। তা হলে কে কে যাবে?
কানু-পিকলুবাবলুর বেশ আপত্তি। ওরা নিজেরা খেলাধুলো নিয়ে থাকে, অচেনা বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যেতে ওদের ইচ্ছে নেই। মমতা দু একবার বলায় পিকলু রাজি হয়ে গেল, বাবলু মুখ গোঁজ করে রইলো, আর কানু পালিয়ে পালিয়ে রইলো দূরে।
প্রতাপের মা সুহাসিনীর কিন্তু বেশ যাবার ইচ্ছে। তিনি বললেন, ওরে ছেলেরা, তোরা যেতে চাস না কেন? চল্। ওরা নারায়ণগঞ্জের লোক, খুব ভালো খাওয়াবে-দাওয়াবে।
সুহাসিনী ঠাকুরঘরে গিয়ে ঝটপট মন্ত্র পড়ে এসে একখানা গরদের শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিলেন। তাঁর তাড়নাতেই ছেলেরা বাধ্য হয়ে রাজি হলো যেতে।
নন্দন পাহাড়ের দিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। খানিকটা করে ব্যবধানে এক একটি বেশ বড় বাড়ি, সঙ্গে অনেকখানি বাগান। আজ সন্ধেবেলাতেই চাঁদ উঠেছে, এদিককার আকাশ অনেক বেশি নক্ষত্রময়, পাতলা ঝিরঝিরে শীতের বাতাস বইছে। এখানে আসার পর একদিনও সন্ধের পর বেড়াতে বেরুনো হয়নি, তাই ভালো লাগছে সকলেরই।
সত্যেন ভাদুড়ী কোনো জমিদারের বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, সামনের দিকে এত বড় বড় গাছপালা যে ভেতরের বাড়িটি রাস্তা থেকে দেখাই যায় না। মস্ত বড় লোহার গেট, তারপর লাল সুরকির টানা পথ। ভেতরের পোর্টিকোতে একটি পাঁচ শো পাওয়ারের বা জ্বলছে। সত্যেন নিজে বেরিয়ে এসে অতিথিদের অভ্যর্থনা করলেন। সুহাসিনীকে তিনি ভুল করে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, সুহাসিনী তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে বললেন, আরে করো কী, করো কী, তোমরা তো ব্রাহ্মণ।
সত্যেন হাত জোড় করে বললেন, মা, আপনি এসেছেন তাতে আমি যে কী খুশী হয়েছি। আমি অতি অল্প বয়েসে মাকে হারিয়েছি, মায়ের স্মৃতিই নেই, আপনাকে প্রথম দিন দেখার পরই আমার নিজের মায়ের মতন মনে হয়।
সুহাসিনী আশীর্বাদ করে বললেন, শতায়ু হও বাবা। ধনে-পুত্রে লক্ষ্মী লাভ হোক। এ বাড়িখানি তো বড় সুন্দর। তোমার নিজের নাকি?
সত্যেন বললেন, না। তবে, বাড়িটি আমাদেরও খুব পছন্দ হয়েছে। ভাবছি যদি কিনে রাখা যায়। আসুন, ভেতরে আসুন!
সামনের দিকে একটি বেশ বড় হল ঘর, তাতে ঝাড় লণ্ঠন বসানো। প্রতাপ আর বিশ্বনাথ সেই ঘরে বসলেন, অন্যরা অন্দর মহলে চলে গেল। এই ঘরটিতে কাপেৰ্টের ওপর তাকিয়ে ছড়ানো, মাঝখানে একটি হারমোনিয়াম ও এস্রাজ। এক কোণে একজন তবলচি আড়ষ্টভাবে বসে আছে।
বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, হারমোনিয়াম জোগাড় করলেন কোথা থেকে? আগেরবার তো দেখিনি?
সত্যেন মুচকি হেসে বললেন, ইচ্ছে করলে সবই পাওয়া যায়। ভাড়া করার চেষ্টা করেছিলাম, না পেয়ে কিনেই ফেললাম ওটা।
বিশ্বনাথ বসে পড়ে হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, কেনার আগে আমাকে একবার দেখালেই পারতেন। এটা বেশ বেসুরো।
সত্যেন বিস্মিতভাবে বললেন, সে কি! লোকটা যে বললো কলকাতা থেকে কোন্ মুসলমান গায়ক এসে এটাই ব্যবহার করেছিল? বিশ্বনাথ বললেন, সে কবে করেছিল কে জানে! যাই হোক, কাজ চলে যাবে।
সত্যেন বললেন, মেয়েদের আর বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি পাঠিয়ে দেবো। আমন একটু বেশিক্ষণ থাকবো, কী বলেন?
বিশ্বনাথ বললেন, সারা রাত হলেও আপত্তি নেই, কী বলো ব্রাদার?
গান বাজনা শুরু হবার আগে সত্যেন একটি সাদা ঘোড়া মাকা স্কচের বোতল ও গেলাশ আনালেন। গেলাসের সংখ্যা তিন। সত্যেন প্রতাপের মুখের দিকে তাকাতেই বিশ্বনাথ বললেন, আমার ব্রাদারটি আবার ও রসে বঞ্চিত। উনি সুর পছন্দ করেন, তার সঙ্গে আকার যোগ করলেই মুখ ফিরিয়ে নেন।
সত্যেন বললেন, আমরা…আমরা যদি খাই, তাতে আপত্তি নেই তো?
প্রতাপ দু’দিকে মাথা নাড়লেন। বিশ্বনাথ যে মাঝে মাঝে সুরা সেবন করেন তা তিনি আগেই জানেন। যারা গান বাজনার চর্চা করে তাদের বোধহয় ওসব লাগে। প্রতাপের কোনোদিন মদ স্পর্শ করার প্রবৃত্তি হয়নি। মুনসেফগিরি করার জন্য তাঁকে অনেক মফস্বলে ঘুরতে হয়েছে। কোনো কোনো জায়গা এমন সৃষ্টিছাড়া যে সন্ধের পর আর কিছুই করার থাকে না, এমনকি ব্যাডমিন্টন-টেনিস খেলারও ব্যবস্থা নেই, সেখানে তিনি তার সহকর্মী বা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারদের মধ্যে মদ্যপানের চল দেখেছেন। প্রতাপ কখনো তাঁদের সঙ্গ পরিহার করেন নি। আবার অন্যদের শত অনুরোধেও গেলাস ধরেন নি।
মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে টুকটাক খাবার আসছে। এ বাড়িতে মনে হয় একটা প্রথা আছে, চাকরবাকরদের হাতে খাবার পাঠানো হয় না। খাবারের প্লেটগুলি নিয়ে আসছেন কখনো সত্যেনের স্ত্রী, কখনো বুলা।
প্রতাপ ঠিক করেছেন, বুলা নিজে থেকে কথা না বললে তিনি আর কিছু বলবেন না। সেটা ভালো দেখায় না।
আসর যখন বেশ জমে উঠেছে, সেই সময় বুলা একবার এলো কিছু মাছ ভাজা নিয়ে। একটি প্লেট সে প্রতাপের সামনে রাখলো। প্রতাপ বুলার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলেন সেখানে কোনো বিষাদের চিহ্ন আছে কি না!
সত্যেন খপ করে বুলার হাত ধরে বললেন, বড় গিন্নি, এখানে একটু বসো না! গান শোনো!
তারপর মুখ তুলে তিনি বললেন, আমার বৌদিটি প্রায় আমার বড় গিন্নি, বুঝলেন! উনি কিন্তু ভালো গান করেন! আপনারা শুনলে মোহিত হয়ে যাবেন। শোনাও না তোমার একটা গান, ঐ যে সেই গানটা, রবি ঠাকুরের, মরি হায়, চলে যায়…
কথাগুলো শোনার সময় প্রতাপের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি। তিনি শুধু বুলার মুখটাই দেখছিলেন। বুলা অবশ্য গান শোনালো না, সেখানে দু’মিনিটের বেশি থাকলেও না।
একটু পরে, বিশ্বনাথ বিভোর হয়ে গান গেয়ে চলেছেন, সত্যেন বাজাচ্ছেন এস্রাজ, তখন সত্যেনের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রতাপ অনুভব করতে লাগলেন, সত্যেনকে তিনি পছন্দ করতে পারছেন না কিছুতেই! বুকটা ঈষায় জ্বলছে। এই চালিয়াৎ ধনী ব্যক্তিটি বুলার হাত ধরলো কেন? কেন বললো বড় গিন্নি! ও কি সেই রকমই ব্যবহার করে বুলার সঙ্গে?
বুলা তাঁর কেউ নয়, বুলার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই নেই, তবু প্রতাপের মনে হলো বুলার ওপর তাঁর একটা অধিকার আছে।