মালখানগরে প্রতাপদের বাড়ির সামনে ও পিছনে ছিল দুটি পুষ্করিণী। সামনেরটি বেশ বড় এবং বারোয়ারি, পিছনেরটি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং নিজস্ব। এই পুকুরটি চতুষ্কোণ, চারদিকে চারটি বাঁধানো ঘাট। একদিকে ধোপা ও নাপিতদের কয়েকটি ঘর, তারা মজুমদারদেরই প্রজা।
পুকুরের ঠিক মাঝখানে একটি লৌহদণ্ড পোঁতা, তার মাথায় একটি হাত-জোড় করা গরুড় মূর্তি। বর্ষার সময় জল অনেক বেড়ে গেলেও ঐ মূর্তিটি ডোবে না। কেন যে পুকুরের মাঝখানে ঐ রকম একটা মূর্তি বসানো হয়েছিল তা আজ আর কেউ বলতে পারে না।
সেই পুকুরের একদিকে ঘন গাছপালার সারি। শৈশবে প্রতাপের মনে হতো, ঐ দিকটায় রয়েছে নিবিড় বন, ঘোর রহস্যময়। আসলে এটি একটি ফল-পাকুড়ের বাগান, তেমন সুসজ্জিত নয়, অনেক গাছই অযত্নবর্ধিত, প্রায় সাত বিঘে জমিতে ছড়ানো। আগাছা-পরগাছা পরিষ্কার করা হয় না বলে সে বাগানের কিছু কিছু অংশ বেশ দুর্গম। জাম-জামরুল পাখিতে খায়। আমগা মাটিতে পড়ে থাকে, মানুষ আসে না।
কৈশোরে অজানা-অচেনা সব কিছু সম্পর্কেই রোমাঞ্চবোধ থাকে। আবার সমস্ত অজানাকে জানার ইচ্ছেটাও জাগে। গা ছম ছম করলেও এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। গোঁফের রেখা ওঠার পর প্রতাপ একটা দা হাতে নিয়ে ঐ জঙ্গল-প্রতিম বাগানের মধ্যে অনেকবার গেছে, একবার দিনদুপুরে দুটি শেয়াল ও একটি গোসাপ দেখেও নিরস্ত হয়নি। ক্রমে ঐ বাগানের মধ্যে প্রতাপের একটা নিজস্ব, নিভৃত কুঞ্জ রচিত হয়েছে। আলোক লতায় সর্বাঙ্গ ছাওয়া একটি বড় ঝুপসি আম-গাছের নিচটা পরিষ্কার করে প্রতাপ মাঝে মাঝেই সতরঞ্চি আর বই খাতা নিয়ে টেড-এর মতন। এসে সেখানে একলা সময় কাটাতো।
সেই বাগানের মধ্যে একটা সরু খালও আছে। কিছু দূরের কোনো নদী থেকে সেই খালের মধ্যে দিয়ে জল এসে পুকুরে পড়ে। প্রতাপ সেই খালটিকে ঝরনা বলে ভাবতে ভালোবাসে। বাগানের মধ্যে কোনো একটা স্থান একটু উঁচু বলে সেখানে জল-পতনের উচ্ছ্বাস শোনা যায়। সম্প্রতি দু একদিন খুব বৃষ্টি হওয়ায় জল বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দায়ুদকান্দি থেকে ফেরবার দু’দিন পর প্রতাপ তার সেই বাগানের নিরালা জায়গাটিতে গেল দুপুরবেলা। তার কল্পিত ঝরনাটির পাশে দাঁড়িয়ে জলের শব্দ শুনতে শুনতে তার মনে পড়লো গায়ত্রীর কথা।
প্রতাপের বয়স তখন উনিশ। এর আগে অনাত্মীয়া কোনো রমণীর সঙ্গে তার মেলামেশা হয়নি। নারী-জাতি সম্পর্কে তার আলাদা কোনো কৌতূহলও জাগ্রত হয়নি। যদিও প্রায় এই বয়েসেই তখন অনেক ছেলের বিবাহ হয়ে যেত, বিশেষত বামুন বাড়ি ও মুসলমান বাড়ির ছেলেদের। মালখানগরে প্রতাপের যারা বাল্য খেলার সঙ্গী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ চোদ্দ-পনেরো বছর বয়েস থেকে নানাপ্রকার অসভ্য কথা শিখেছিল। লালাসিক্ত কণ্ঠে তারা স্ত্রীলোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলে প্রতাপ তাদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। সে ঐ আলোচনায় রস পায় না। তার চেয়ে খেলাধুলোর কথা তার অনেক বেশি পছন্দ। খেলাধুলোর কথার মধ্যে যারা হঠাৎ মেয়েদের প্রসঙ্গ টেনে আনে তাদের গাড়ল মনে হয় প্রতাপের। এইজন্য নগেন নামে এক বন্ধুকে একদিন সে থাপ্পড় মেরেছিল পর্যন্ত।
বুলা অর্থাৎ গায়ত্রীর সঙ্গে টানা আটদিন কাটিয়ে আসার পর প্রতাপ যেন নারী জাতিকে নতুন করে চিনলো। মা নয়, দিদি নয়, এ যেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের প্রাণী, যার কথাবার্তা একেবারে অন্যরকম।
বুলাকে প্রথমে ঠিক পছন্দ করেনি প্রতাপ। বেশ ফাজিল ধরনের মেয়েটি। প্রতাপকে সে ভূতের ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল প্রথম দিন থেকেই। এক রাত্তিরে সে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে প্রতাপের ঘরের জানলায় উঁকি মেরে নাকি সুরে বলেছিল, এঁই প্রঁতাঁপ… সত্যসাধন বলেছিলেন, এই মাইয়াটা আগের জন্মে নির্ঘাৎ জলদস্যু আছিল!
লাজুকতার লেশমাত্র নেই বুলার চরিত্রে, কথার মারপ্যাঁচে প্রায়ই সে প্রতাপ আর মামুনকে অস্বস্তিতে ফেলে দিত। মুঙ্গেরে আড়াই বছর কটিয়েই সে এত সাবলীল, পশ্চিমের মেয়েরা বুঝি এই রকম হয়! বয়েসে বছর চারেকের ছোট হয়েও সে সব বিষয়ে প্রতাপ আর মামুনের সমান সমান হতে চাইতো।
খালের জলের কলকল, ছলচ্ছল শব্দে প্রতাপ যেন গায়ত্রীর হাসির শব্দ শুনতে পেল। প্রতাপের মন-কেমন করে উঠলো। গায়ত্রীরা মুঙ্গেরে ফিরে যাবে, আর কি কোনোদিন দেখা হবে?
আমগাছ তলায় সতরঞ্চি বিছিয়ে বসার পর বই খুলেও প্রতাপ মনঃসংযোগ করতে পারলো না। বারবার গায়ত্রীর কথা মনে পড়ছে। দুষ্টু মেয়েটা কথায় কথায় হাসে। খোঁচা দিয়ে কথা বলে। তবু সে এত আপন হয়ে গেল কা করে?
গায়ত্রীর শাড়ী পরার ধরনটা আলুথালু ধরনের। সে নিজেই বলেছিল, মুঙ্গেরে সে এখনো ফ্রক পরে, বাড়িতে ঠাকুমার আপত্তি বলেই তাকে শাড়ী পরতে হয়। কিন্তু এখনো সেটা ঠিক আয়ত্ত হয়নি। শক্ত করে কোমরে আচল জড়িয়ে বাধলেও এক সময় আবার আলগা হয়ে যায়। এখন, এতদূর থেকে গায়ত্রার কথা চিন্তা করে প্রতাপের মনে হলো, গায়ত্রার শাড়া যেন সমুদ্রের ঢেউ-এর মতন।
বাড়িতে দুর্গা পুজোর আয়োজন শুরু হয়ে গেছে, আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করেছে, অন্যান্য বছর প্রতাপ নানা কাজে, হৈ-চৈতে মেতে থাকে। এবার কী যে হলো তার, সে ফাঁক পেলেই বাগানে চলে যায়, গায়ত্রীর কথা ভাবে, তার সারা শরীরে উষ্ণতা জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে সে উচ্চারণ করে, বুলা, বুলা! গায়ত্রী, গায়ত্রী! তার বুলা নামটাই বেশি পছন্দ হয়।
প্রতাপ ঠিক রোমান্টিক বা আত্মমগ্ন ধরনের ছেলে নয়। তখনও পর্যন্ত তার কোনো গোপন জগৎ ছিল না। বুলার জন্য তার এই যে ভাবান্তর উপস্থিত হয়েছে, একথা কারুকে বলার জন্য সে ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু কাকে বলবে? মালখানগরের কোনো ছেলের সঙ্গেই তার খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা নেই। কলকাতায় পড়তে যাবার পর একমাত্র মামুনের সঙ্গেই তার অন্তরঙ্গতা হয়েছে। মামুনকে বলা যায়, ছুটির শেষ দিকে মামুন এখানে আসবে কথা আছে, কিন্তু সে তো অনেক দেরি।
দুই দিদির মধ্যে সুপ্রীতির সঙ্গেই তার বেশি ভাব। পুজো উপলক্ষে সুপ্রীতি আর অসিতবরণও কলকাতা থেকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সুপ্রীতির কোনো ছেলে-মেয়ে হয়নি, তাই এখনো তাকে কিশোরীর মতন দেখায়। কিন্তু দারুণ কাজের মেয়ে সে। সুহাসিনী এই পরিবারের কত্রী হলেও চারদিক সামলাতে পারেন না, সুপ্রীতি এসে মায়ের কাছ থেকে সব ভার নিয়ে নেয়। বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর সুপ্রীতি আর অসিতবরণ এখানেই ছিলেন, ইদানীং সম্পত্তি দেখার জন্য অসিতবরণকে বরানগরে থেকে যেতে হচ্ছে।
একদিন দুপুরে সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবার পর প্রতাপ সুপ্রীতিকে বললো, দিদি, আমার সঙ্গে ওপারের বাগানে যাবি? ওখানে আমি একটা সুন্দর জায়গা তৈরি করেছি।
সুপ্রীতি বললো, চল। দাঁড়া, আগে একটা পান খেয়ে আসি!
প্রতাপের পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। সুপ্রীতি পরে আছে একটা লালডুরে শাড়ী আর ঘটি হাতা ব্লাউজ। গ্রামের মেয়েদের মতন সে এখন আর সেমিজ পরে না। তার ঈষৎ কোঁকড়া ঘন কালো চুলে পিঠ ছেয়ে আছে। খালি পায়ে দুই ভাই বোন পুষ্করিণীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলো।
সুপ্রীতি বললো, স্নান করার সময় বললি না কেন? অনেকদিন সাঁতার কেটে এ পারে আসিনি।
প্রতাপ বললো, এ পারের ঘাট দিয়ে ওঠা যায় না। বড় পিছল!
সুপ্রীতি বললো, খোকন, তোর মনে আছে?
প্রতাপ ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ!
অনেক দিন আগে, প্রতাপের তখন বছর দশেক বয়েস হবে, একটা ঘটনা ঘটেছিল। সন্ধেবেলা দেখা গিয়েছিল, পুকুরের এই পারের ঘাটলায় নীল শাড়ী পরা একজন স্ত্রীলোক বসে আছে। কে সে? প্রতাপদের বাড়ির কেউ নয়। ধোপা-নাপিতদের পাড়ার কেউ হতে পারে, কিন্তু তাদের তো নিজস্ব ঘাট আছে। সন্ধেবেলা কোনো স্ত্রীলোক ওখানে একা বসে থাকবে। কেন? এপার থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কে ওখানে? ওগো, তুমি কাদের বাড়ির বউ? কোনো উত্তর আসেনি। অনেক ডাকাডাকাতিতেও সাড়া পাওয়া যায়নি, অথচ বধূটি ঘোমটা টেনে চুপ করে বসে ছিল। শেষ পর্যন্ত বাড়ির কয়েকজন পুরুষ ওপারে গেল খোঁজ। করতে, তার মধ্যেই সে মিলিয়ে গেল। কেউ বলে সে জলে নেমে গিয়েছিল, কেউ বলে সে ছুটে চলে গিয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে। বাড়ির সকলের চোখের সামনে ঘটেছিল ঘটনাটি। কিন্তু স্ত্রীলোকটি কে এবং কোথায় সে মিলিয়ে গেল, তা একটা রহস্যই রয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। কোনো লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর থেকেই কেউ আর সাঁতার কেটে এই ঘাটে আসে না।
সুপ্রীতি বললো, খোকন, তুই একা একা এই জঙ্গলের মধ্যে পড়তে আসিস, তোর ভয় করে না!
প্রতাপ তখন তার সেই নিজস্ব ঝরনার কাছে উপস্থিত হয়েছে। তার বুক মুচড়ে উঠলো, সে সুপ্রীতির হাত চেপে ধরে বললো, দিদি, আমার একটা অসুখ হয়েছে।
সুপ্রীতি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো প্রতাপের মুখের দিকে। সে খুবই বুদ্ধিমতী। কিছু একটা আঁচ করতে তার দেরি হলো না। সে বললো, এইখানে বোস। দায়ুদকান্দিতে কী কী হয়েছে সব খুলে বল তো।
প্রতাপ ঠিক গুছিয়ে বর্ণনা করতে পারে না। মামুনদের গ্রামে সে থাকতে গিয়েছিল, কিন্তু মামুনদের বাড়িতে তার স্থান হয়নি, পাকেচক্রে সত্যসাধন চক্রবর্তীর বাড়িতে তাকে অতিথি হতে। হলো। সেইখানে বুলার সঙ্গে পরিচয়। সে বড় অদ্ভুত ধরনের মেয়ে, তার প্রত্যেকটি কথা ফিরে ফিরে আসছে। এখানে এই জঙ্গলের মধ্যে বসে থাকলেও মনে হয় হঠাৎ যেন বুলা কোনো। গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারবে।
শুনতে শুনতে সুপ্রীতি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তার মায়ের ভয় ছিল, প্রতাপ কলকাতায় পড়াশুনো করতে গিয়ে কোনো থিয়েটারের মেয়ের পাল্লায় না পড়ে। সুহাসিনীর। এক দূর সম্পর্কের মামা কলকাতায় এক থিয়েটারের অভিনেত্রী তথা বেশ্যার অন্নদাস হয়ে পড়েছিলেন নাকি! সেই থেকে সুহাসিনীর ধারণা কলকাতার রাস্তায় থিয়েটারে মেয়েরা ডাকিনী-যোগিনীর মতন ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু প্রতাপের সে রকম কিছুই হলো না, সে বাঁধা পড়লো কুমিল্লার এক গ্রামের মেয়ের আঁচলে!
সুপ্রীতি বললো, থোকন, তুই যে দেখি মরেছিস একেবারে! ঠিক আছে, বাবাকে বলি সম্বন্ধ করতে। কী নাম বললি? চক্রবর্তী? ওমা, ছি ছি, কী কাণ্ড করেছিস তুই, খোকন? ওরা যে ব্রাহ্মণ? ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে না, জানিস না?
প্রতাপ বললো, না দিদি, আমি বিয়ের কথা বলছি না। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।
সুপ্রীতি বললো, বিয়ে করতে চাস না, তা হলে তুই একটা অবিবাহিত মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে গেলি কোন আক্কেলে? ছিঃ!
প্রতাপ অসহায়ভাবে বললো, আমি ইচ্ছে করে ভাব করিনি, সে নিজে থেকে কথা বলেছে।
–কথা বলেছে তো কী হয়েছে? তা বলে ভাব করতে হবে?
–সে আমাকে গান শুনিয়েছে। রবিবাবুর গান, ভালো গায়।
–বেশ মানলুম, গান শুনিয়েছে। গান শুনে মাথা নাড়বি। তা বলে বামুনবাড়ির মেয়ের সঙ্গে তুই ভাব করতে গেলি কেন? তুই তাকে ভাবের কথা বলেছিস কিছু?
–ওখানে থাকতে ওকে কিছুই বলিনি। কিন্তু এখন সব সময় মনে পড়ে ওর কথা। দিদি, আমি এখন কী করি?
–ও মা, অমন মুখ-চোখ করছিস কেন? পাগল হয়েছিস নাকি? ওসব কথা মনে রাখতে নেই। ঐ গ্রামে আর যাস না কোনোদিন।
–বুলার ঠাকুমা, তাঁকে আমি জেঠিমা বলেছি, বড় সুন্দর মানুষ, তাঁর কাছে যে কথা দিয়েছি আবার যাবো?
-–ঐ মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাক। তারপর যাবি। তুই আমাদের বাড়ির একমাত্র ছেলে, তুই যদি একটা কিছু অন্যায় করে ফেলিস, তা হলে মা-বাবা কত দুঃখ পাবেন বল তো?
এরপর দু ঘণ্টা ধরে সুপ্রীতির সঙ্গে এই একই বিষয় নিয়ে বারবার কথা হতে লাগলো। প্রতাপ বুঝতে পেরেছে যে তার একটা ভুল হয়েছে, এক ব্রাহ্মণ কুমারীকে পছন্দ করা তার পক্ষে অসমীচীন কাজ। কিন্তু মন যে মানতে চায় না!
পরের দিন মা তাকে একটা কাগজ দিলেন। তার জামার পকেটে ছিল, কাঁচতে যাবার সময় পাওয়া গেছে, কাগজটা ভিজে গেছে খানিকটা। প্রতাপের মনে পড়লো, এটা মামুনের সেই কবিতা, সে ভুলেই গিয়েছিল এর কথা।
ভিজে গেলেও অক্ষরগুলো পড়া যায়। কবিতাটি প্রজাপতি বিষয়ে। প্রতাপ কাব্যরসের তেমন মর্ম বোঝে না, তবু কবিতাটির প্রেরণা কোথা থেকে এসেছে তা বুঝতে তার অসুবিধে হলো না। জলের শব্দ শুনে প্রতাপের যার কথা মনে পড়ে, মামুনের কবিতার প্রজাপতিও সে।
কবিতাটি পড়ে প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলো। বুলাকে মামুনেরও খুব পছন্দ হয়েছে এবং সেই কথা জানাবার জন্যই সে প্রতাপের পকেটে শেষ মুহূর্তে কবিতাটা গুঁজে দিয়েছিল। এইবার প্রতাপের পক্ষে বুলাকে ভুলে যাওয়া সহজ হবে।
ছুটির শেষে মামুন মালখানগরে এলো না, চিঠি লিখে জানালো তার অসুবিধে আছে। প্রতাপ কলকাতায় এসেও বেশ কয়েকদিন মামুনকে দেখতে পেল না। মামুন যখন ফিরলো, তখন তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বেশ রোগা হয়ে গেছে সে, পোষাক ময়লা, মাথার চুল বড় বড়, চোখ দুটি যেন জ্বলজ্বল করছে।– মামুনের জীবনে সত্যিই একটা বিপর্যয় ঘটেছে। মামুনের বাবা তাকে কিছু না জানিয়ে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন, মামুন কিছুতেই সে বিয়েতে রাজি হয়নি। ও বাড়িতে মামুনের বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। মামুনের মা ছেলের পক্ষ নিলেও সুবিধে মান। মামুনের বাবা সৈয়দ হাকিম সাহেব স্রেফ জানিয়ে দিয়েছেন যে মামুন তার কথার বাধ্য হলে তিনি আর ছেলের পড়ার খরচ চালাবেন না। মামুনের কলকাতায় পড়াশুনোই বন্ধ ম যাচ্ছিল, তবু সে জেদ করে চলে এসেছে। একটি পত্রিকা অফিসে সে পুফ রীডারের চাকরি সংগ্রহ করেছে, তাতেই অতিকষ্টে তাকে চালাতে হবে।
উত্তরটা প্রায় জানা থাকলেও প্রতাপ মামুনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই বিয়ে করতে রাজি হলি না কেন?
প্রতাপের চোখের দিকে একদৃষ্টে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো মামুন। তারপর বললো, তুই-ই বল প্রতাপ, গায়ত্রীর মতন কোনো নারীকে দেখলে আর কোনো স্ত্রীলোককে জীবনসঙ্গিনী করতে ইচ্ছা হয়? জানি, আমি গায়ত্রীকে কোনোদিন পাবো না। কিন্তু গায়ত্রী যতদিন না ম ঘরে চলে যায়, ততদিন আমি বিয়ে-শাদী করতে পারবো না।
মামুন এ পর্যন্ত সাতান্নটি কবিতা লিখেছে গায়ত্রীকে নিয়ে। সেই সব কবিতাবলী নিয়ে সে “আশমানের প্রজাপতি” নামে পুস্তক ছাপতে চায়। প্রতাপ চলে আসার পর সে গায়ত্রীদের বাড়িতে দু দিন মাত্র গিয়েছিল, তারপর আর ভয়ে যায়নি। গায়ত্রীকে না দেখতে পেলেও সে দূর থেকে তার উদ্দেশে স্তুতি গাথা রচনা করে যাবে।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলো, কেন, ভয়ে দেখা করতে যাসনি কেন? সত্য জ্যাঠা কিছু আপত্তি করেছেন? তিনি তো সে রকম মানুষ নন!
মামুন বললো, না, না, সত্য জ্যাঠা দেবতুল্য মানুষ।
ওঁদের পরিবারের সকলেই মামুনকে পছন্দ করে। কিন্তু ঐ পল্লীর দুটি ছেলে একদিন মামুনের প্রতি ব্যাঁকা বাঁকা কথা বলেছিল।
প্রতাপ বললো, তাতেই তুই ভয় পেয়ে গেলি।
মামুন বললো, তুই জানিস না, ঢাকায় নজরুল ইসলাম প্রতিভা সোম নামে এক তরুণীকে গান শেখাতে যেতেন? কয়েকদিন খুব ঘন ঘন যেতে শুরু করেছিলেন, এক সন্ধেবেলা বনগাঁর হিন্দু ছেলেরা কবিকে ঘিরে ধরে মারতে গিয়েছিল।
একটু থেমে মামুন আবার বললো, আমি তো গান শেখাতে যেতাম না, আমি যেতাম গান শুনতে। আহা, কী মধুক্ষরা কণ্ঠস্বর!
কয়েকদিন পর বুলার একটা চিঠি এলো প্রতাপের নামে। সে চিঠিতে প্রেমের কথা নেই, আছে অভিযোগ। প্রতাপ এবং মামুন কেন তাকে চিঠি লেখেনি? কলেজে পড়ে বলে বুঝি। তাদের খুব অহংকার?
প্রতাপ সে চিঠির কোনো উত্তর না দিয়ে মামুনের কয়েকটি কবিতা খামে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছিল বুলার নামে। তারপর আর কোনো চিঠি আসেনি।
বছর আড়াই পরে বুলার স্মৃতি যখন কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে, তখন বুলার সঙ্গে আবার আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল।
প্রতাপ তখন ল কলেজের ছাত্র। বরানগরে দিদির বাড়িতে এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। সুপ্রীতি তখন পাকাঁপাকিভাবে শ্বশুরবাড়িতে এসে রয়েছে। প্রতাপকে সেখানে সপ্তাহে দুবার অন্তত আসতে হয়। অসিতদা শখ করে একটি মটোর গাড়ি কিনেছেন। এক একদিন তিনি নিজেই গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হন প্রতাপের মেসে। প্রতাপের সামনে থেকে বই সরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ওহে সম্বন্ধী, অত আইন পড়ে তুমি কি প্রিভি কাউনসিলে যাবে নাকি? চলো, মেঘলা দিন পড়েছে, ক্যানিং টাউন ঘুরে আসি!
বরানগরের বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেরার পথে, বাগবাজারে বাস বদল করার সময় প্রতাপ হঠাৎ এক বালক কণ্ঠের ডাক শুনতে পেল, প্রতাপদা!
প্রতাপ মুখ ফিরিয়ে দেখলো, দেখামাত্র চিনতে পারলো বুলার ছোট ভাই রতনকে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুলা, তাঁর পাশের প্রৌঢ় ব্যক্তিটি খুব সম্ভবত বুলার বাবা। রতন সোল্লাসে বললো, প্রতাপদা, আমরা এখন কলকাতায় থাকি!
বুলা নিজে থেকে প্রথমে কোনো কথা বলেনি। এখন আর তার শাড়ী অগোছালো নয়, চোখের দৃষ্টিতেও পূর্বেকার সেই চাঞ্চল্যমাখা দুষ্টুমি নেই। সে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রতাপের দিকে।
রতন পরিচয় করিয়ে দিতেই বুলার বাবা সত্যব্রত চক্রবর্তী বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথা শুনেছি। সেবারে আমি পৌঁছোবার আগেই তুমি চলে গিয়েছিলে।
প্রতাপের প্রথমেই মনে পড়লো, বুলার দাদার কথা, যাঁকে সে চোখে দেখেনি। সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, আপনার যে ভাইপো জেলে ছিলেন, হিতব্রত, তিনি কেমন আছেন?
মাটির দিকে চোখ করে সত্যব্রত বললেন, সে মারা গেছে। জেল থেকে পালাতে গিয়েছিল…আমার মা বলেছিলেন তোমার সঙ্গে হিতুর মুখের মিল আছে, তা খানিকটা আছে বটে–
এইবার বুলা বললো, আপনি ঠাকুমার কাছে কথা দিয়েছিলেন, প্রত্যেক বছর একবার করে যাবেন, কথা রাখেননি। কলকাতার লোকেরা এই রকম মিথ্যুক হয়।
সত্যব্রত বললেন, আহা, সব সময় কী যাওয়ার সুবিধে থাকে। এখন পড়াশুনোর চাপ।
প্রতাপ অনুতপ্ত বোধ করে চুপ করে রইলো।
সত্যব্রত একটা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে প্রতাপকে তুললেন জোর করে। ওঁরা যাবেন। ভবানীপুর। পথে বৌবাজারে প্রতাপকে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। গাড়িতে কিন্তু বিশেষ কথা হলো না। হিতব্রতর মৃত্যু-সংবাদ প্রতাপকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ হিতব্রতর কথাই বা তার মনে এলো কেন? সত্যসাধন তাঁর এই বিপ্লবী পুত্র সম্পর্কে বেশ গর্বিতই ছিলেন, এখন তাঁর মনের ভাব কী রকম? ভেঙে পড়েছেন খুব? আর সুরবালা? প্রতাপের সত্যিই ইচ্ছে করলো একবার। সরবালার সঙ্গে দেখা করতে। যদি তার মুখোনা সুরবালাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারে।
এর দিন সাতেক পরে বুলা একলা চলে এলো প্রতাপের মেসে। সত্যি সাহস আছে বুলার। কয়েকদিন ধরে ছাত্র বিক্ষোভ চলেছে, পথঘাট নিরাপদ নয়। প্রতাপদের মেসে স্ত্রীলোকেরা সাধারণত আসে না। সে রকম কোনো বিধিনিষেধ নেই অবশ্য। তবু বাড়িটিতে এত পুরুষ পুরুষ গন্ধ যে মহিলাদের যেন এখানে মানায় না। বুলা আগের দিন বাড়িটি চিনে গেছে। সোজা উঠে এলো দোতলায়। প্রতাপ খালি গায়ে বসে পড়াশুনো করছিল, তাড়াতাড়ি উঠে জামা পরে নিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ।
বুলা ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। সে উত্তেজনার বশে চলে এসেছে। এখন দুর্বল বোধ করছে।
একটু পরে মুখ তুলে সে জিজ্ঞেস করলো, আমি এসেছি বলে আপনি রাগ করেছেন?
প্রতাপ বললো, না, না!
সে ভাবলো, মামুন থাকলে কত খুশী হতো। মামুন এখনও গায়ত্রীর উদ্দেশে অনেক পদ্য লিখে যাচ্ছে। সে বুলা নামটা পছন্দ করে না। সে গায়ত্রী বলে। বাবার সঙ্গে অনেকটা মিটমাট হয়ে গেছে মামুনের, দেশের বাড়িতেও ফিরে গেছে দু একবার। অবশ্য গায়ত্রীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
মামুন এখানে নেই, সে মেদিনীপুরে কী একটা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে গেছে।
বুলা কথা বলতে পারছে না দেখে প্রতাপ বললো, জানো বুলা, মামুন প্রায়ই তোমার কথা বলে। তুমি কি ওর “আশমানের প্রজাপতি” বইটি পড়েছো?
বুলার সেই ঝলমলে ভাবটা আজ নেই। সে ম্লান মুখে মাথা নাড়লো দু’দিকে।
প্রতাপ উঠে মামুনের কবিতা-পুস্তকটি খুঁজে এনে বুলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, পড়ে দ্যাখো, অনেক কিছু চেনা চেনা লাগবে। তোমাদের গ্রামের কথা আছে, তোমার কথাও আছে।
বুলা নিঃস্পৃহভাবে দু’একটি পাতা ওল্টালো, তারপর বইটি পাশে রেখে বললো, প্রতাপদা, আপনার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এসেছি। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?
প্রতাপ হালকা গলায় বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সাহায্য করবো। তুমি হঠাৎ আপনি আজ্ঞে করে কথা বলছো কেন, সেবারে তো তুমি তুমি বলতে আমাকে! তোমার কী হয়েছে, বলো?
–আপনি আমার চিঠির উত্তর দেননি!
–চিঠি, মানে, আমার ঠিক চিঠি লেখা হয়ে ওঠে না, বাড়িতেও বিশেষ লিখি না!
–আপনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই না?
–না, না, তোমার কথা কি ভোলা যায়? মামুনের সঙ্গে প্রায়ই তোমার বিষয়ে কথা হয়। তা গান খুব গাইতে, ‘হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে…’, মামুন এখনও সেই গানটা প্রায়ই গুণগুণ করে।
বুলা মুখ নীচু করে বসে রইলো। মামুনের প্রসঙ্গে সে কোনো উৎসাহ দেখাচ্ছে না। সে একবারও মামুনের কোনো খবর জিজ্ঞেস করেনি। বুলার গালের এক পাশে রোদ এসে পড়েছে। তার হলুদ রঙের শাড়ীটি রোদ্দুরের সঙ্গে মিলে যায়।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলো, তোমার কী দরকার, সেটা বললে না?
–প্রতাপদা, আমি কলেজে পড়তে চাই!
–তুমি ম্যাট্রিক পাশ করে গেছো বুঝি? ওমা, এই কথাটাই এতক্ষণ বলোনি? এ তো দারুণ সুখবর। কেমন রেজাল্ট হলো?
–তেমন ভালো নয়। একটুর জন্য ফাস্ট ডিভিশান পাইনি।
–তাতে কী হয়েছে? এ বছর ফার্স্ট ডিভিশান খুব কম, মেয়েদের মধ্যে সেকেণ্ড ডিভিশানই বা ক’জন পায়? তুমি কলেজে পড়বে…ভর্তি হতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে নাকি?
হঠাৎ টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো বুলার চোখ দিয়ে। সে আর কোনো কথা বললো না।
প্রতাপ ঘাবড়ে গেল। এর মধ্যে আবার কাঁদবার কী আছে?
বারান্দা দিয়ে অন্য লোকজন যাচ্ছে, তারা যদি দেখে যে প্রতাপের সামনে বসে একটি তরুণী চোখের জল ফেলছে, তা হলে পরে তারা টিটকিরি দেবে।
খানিকটা অধৈর্যের সঙ্গে প্রতাপ বললো, কী হয়েছে, বুলা? এখানে তুমি এমন করলে তো মুশকিল। তুমি কলেজে পড়তে চাও, তাতে যদি আমি কোনো সাহায্য করতে পারি….
আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বুলা বললো, আমার বাবা আমাকে আর পড়াতে চান না, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন এক জায়গায়।
এবারে প্রতাপের চুপ করে থাকার পালা। বুলার বাড়িতে পড়াশুনোর ব্যাপারে আপত্তি থাকলে প্রতাপ আর কী করে সাহায্য করবে?
বুলা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, এ বিয়ে আমি করতে চাই না! কিছুতেই চাই না! আমি কলেজে পড়তে চাই! প্রতাপদা, তুমি আমার বাবাকে গিয়ে বলবে?
প্রতাপের বুকে গুড়গুড় শব্দ হতে লাগলো। এই প্রশ্নের মধ্যে কী যেন একটা ভয়ংকর ইঙ্গিত আছে।
সে বুলাকে ভালো করে দেখলো। আগের চেয়েও যেন অনেক বেশি সুশ্রী হয়েছে সে, চোখ দুটি গভীর। সে গুণবতী মেয়ে, তাদের বংশ ভালো, খুব ভালো পাত্রের সঙ্গেই তার বিয়ে হবার কথা।
শুকনো গলায় প্রতাপ বললো, আমি তোমার বাবাকে বলতে যাবো–তিনি আমার কথা শুনবেন কেন? তোমার অনেক আত্মীয়স্বজন…আমি তো…
প্রতাপের চোখের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বুলা জিজ্ঞেস করলো, তুমি বলবে না? তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও না?
সেদিন প্রতাপ বুলাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুলাকে বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে প্রতাপ বলেছিল, সে আগামীকালই বুলার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
কিন্তু প্রতাপ যায়নি। বুলার বাবাকে গিয়ে তার পক্ষ থেকে এই বিয়ে বন্ধ করতে বলার। একটাই অর্থ হয়। যে যুবক নিজে একজন পাণিপ্রার্থী, সে-ই এরকম কথা বলতে পারে। এ রকম প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা প্রতাপ জানতেও চায় না। কলকাতা শহরে সেই তিরিশের দশকে ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মধ্যে বিবাহ এমন কিছু অসম্ভব ঘটনা নয়।
প্রতাপের পরিবার থেকে প্রবল আপত্তি হতো ঠিকই, তবু প্রতাপ তা অগ্রাহ্য করতে পারতো। কিন্তু আসল বাধা অন্য জায়গায়। প্রতাপ জানতো, মামুন বুলাকে তীব্র ভাবে ভালোবাসে। বুলার কথা বলতে গেলেই মামুনের কণ্ঠস্বর গদগদ হয়ে যায়। যদিও মামুন বুলাকে কোনোদিনই পাবে না। ততখানি সামাজিক বিপ্লব ঘটানোর সাহস মামুনের নেই। তা ছাড়া মামুনের ভালোবাসা একতরফা, বুলার দিক থেকে মামুনের প্রতি সে ধরনের কোনো দুর্বলতা জন্মায়নি। মামুন প্রায়ই বলে, ব্রাহ্মণ কন্যা গায়ত্রী যত দিন না বিয়ে করে পরের ঘরে চলে যায়, ততদিন আমিও অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।
সেই পরের ঘর মানে কি প্রতাপের সংসার হতে পারে? মামুন তাতে আরও বেশী আঘাত। পাবে। একটি মেয়ের জন্য প্রতাপ কিছুতেই তার বন্ধুর মনে আঘাত দিতে পারবে না।
কাপুরুষের মতন মেস ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রতাপ প্রায় দিন পনেরো বরানগরে দিদির বাড়িতে গিয়ে রইলো।
সুপ্রীতি এবং অসিতবরণ প্রায়ই প্রতাপকে মেসবাড়ি থেকে ছাড়িয়ে এনে বরানগরে নিজেদের কাছে রাখবার জন্য পেড়াপিড়ি করেছেন আগে। প্রতাপ রাজি হয় নি। এখন প্রতাপ নিজে থেকেই এসে দিনের পর দিন থেকে যাচ্ছে দেখে সুপ্রীতি অবাক হয়েছিলেন গোপনে গোপনে। প্রতাপও প্রথম কয়েকদিন দিদিকে কিছু বলেনি। কিন্তু তার অসহ্য কষ্ট হচ্ছিল। তখন। সেই কষ্ট দুটি কারণে। নিজের কাপুরুষতার জন্য তার সর্ব অঙ্গে আলপিন দংশন হচ্ছিল। অল্প বয়েস থেকেই প্রতাপ মিথ্যে কথা বলাটাকে ঘৃণা করে। বুলাকে সে মিথ্যে বলেছে। অথচ সেদিন ক্রন্দনশীলা বুলাকে আর কী বলেই বা বাড়িতে ফেরানো যেত?
তা ছাড়া প্রতাপ ভেবেছিল, বুলা নিজে কিছু না জানুক তবু সে মামুনের মনোনীতা, সেই জন্য প্রতাপ বুলা সম্পর্কে নিজের দুর্বলতা মুছে ফেলেছে। কিন্তু এখন তার বুকটা মুচড়ে মুচড়ে ফেটে যাবার উপক্রম। বুলার মতন মেয়ে নিজে থেকে তার কাছে এসেছিল, তবু বুলাকে সে। ফিরিয়ে দিল? বুলা একজন অন্য পুরুষের কাছে চলে যাবে? অথচ প্রতাপের সমস্ত শরীর-মন বুলার জন্য হাহাকার করছে। সে একবার মুখ ফুটে চাইলেই বুলা তার হতো, অথচ সে মুখ ফুটে চাইতে পারলো না, এই চিন্তাটাই তার পৌরুষে চাবুক কষাচ্ছে অনবরত। এক একবার ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে বুলাদের বাড়িতে।
সুপ্রীতি শেষ পর্যন্ত জানতে পারলেন। সব কথা শুনে তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বলেছিলেন, তুই ঠিকই করেছিস রে, খোকন। বুলাকে তুই বিয়ে করলে সে বিয়ে সুখের হতো না। দুই পক্ষের বাবা-মায়ের মানসিক কষ্টের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু তোর বন্ধু মামুনকে, তো তুই ছাড়তে পারতি না! মামুন তোর বাড়িতে এসে বুলার দিকে চেয়ে গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। তুই যা করেছিস, ঠিকই করেছিস। বুলার সাথে আর কোনো দিন দেখা করিস না। সময় সব ভুলিয়ে দেয়। বুলাও একদিন এসব কথা ভুলে যাবে, নিজের সংসার নিয়ে সুখে থাকবে!
কিন্তু বুলার সঙ্গে তার নিয়তির কোনো যোগাযোগ আছে। এরপরেও বুলার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কয়েকবার। একবার দেশে ফেরার পথে স্টিমারে। বুলার সঙ্গে তার স্বামীও ছিলেন। তিনি বিলেত-ফেরত। সুপুরুষ ও ধনী। বুলাকে বেশ খুশী মনে হয়েছিল। যদিও প্রতাপকে দূর থেকে দেখে সে কোনো কথা বলেনি। তারপর আরেকবার, প্রতাপেরও তখন বিয়ে হয়ে গেছে মমতার সঙ্গে, উত্তর কলকাতায় নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে নতুন সংসার পেতেছে। পিকলু জন্মাবার আগে মমতা যখন বাপের বাড়ি গেছে, সেই সময় প্রতাপ একদিন দেখলো যে কাছেরই একটি বাড়ি থেকে বুলা অন্য দুটি সুসজ্জিতা মহিলার সঙ্গে বেরুচ্ছে। এত কাছে যে বুলার সঙ্গে স্পষ্ট। চোখাচোখি হলো, বুলা থমকে দাঁড়ালো, বোধহয় কিছু বলতেও চেয়েছিল। কিন্তু বলা হয়নি। প্রতাপ সেখানে দাঁড়ায়নি।
সেই বাড়িটি কোনো অভিজাত পরিবারের। সেটাই বুলার শ্বশুরবাড়ি না স্বামী পক্ষের কোনো আত্মীয়ের, তা প্রতাপ ঠিক বুঝতে পারেনি। আরও দু’চারবার সে সেই বাড়িটির সামনে দিয়ে হেঁটেছে, কিন্তু বুলাকে আর দেখতে পায়নি। কিছুদিন পরেই প্রতাপকে অন্য কারণে বাড়ি বদল করে সে পাড়া থেকে চলে যেতে হয়।
এতদিন পরে বুলার সঙ্গে আবার দেখা, এই দেওঘরে। অন্য দু’জন নারী-পুরুষের সঙ্গে বুলা এসেছে তাদেরই বাড়িতে। বুলা কি এখনো রাগ করে আছে?