মেঘনা নদী পার হয়ে দায়ুদকান্দির ফেরীঘাট থেকে হাঁটা পথ। প্রতীপের মনে আছে, কী সাংঘাতিক মেঘ ছিল সেদিন। আকাশ ও জল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নদীতে সমুদ্রের মতন ঢেউ, গয়না নৌকোর মাঝিরা গাজী গাজী রব তুলেছিল। প্রকৃত ঝড় শুরু হলো ফেরীঘাটে পৌঁছোবার
তখন দুপুর তিনটে, কিন্তু ঝড় এলো যেন এক রেলগাড়ি ভর্তি অন্ধকার নিয়ে। চৈত্র-বৈশাখ মাস হলেও কথা ছিল, আশ্বিনে এমন ঝড় যেন অবিশ্বাস্য! প্রতাপ আর মামুন দাঁড়ালো না, ছুটলো বাড়ির দিকে। মামুনের হাতে গোলাপ ফুল আঁকা টিনের সুটকেশ, প্রতাপের হাতে একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ। প্রতাপ তার বাকি জিনিসপত্র স্টিমারের এক সহযাত্রীর হাত দিয়ে ঢাকায়। এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেই দিনটির অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভোলার নয়। ঝড় যে মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা বিশ্বাস করা সহজ নয়, কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল তা অসম্ভব নয় মোটেই। মাঠের মধ্যে এসে প্রতাপ আর মামুন ঝড়ের ধাক্কায় পড়ে যাচ্ছিল বারবার। আকাশে মেঘের ডাক যেন মহাকালের গর্জন, আর বাতাস যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির হাত, ওদের চুলের মুঠো ধরে টানছে। প্রতাপ সত্যিকারের মৃত্যু ভয় পেয়েছিল সেদিন, বিশেষত সেই মুহূর্তটায়, যখন কিছু যেন একটা জীবন্ত জিনিস প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারলো তার মাথায়। সেটা ছিল একটা শঙ্খচিল, ঝড়ের দাপটে সে একটা গুলির মতন ছিটকে এসেছিল।
গাছতলায় দাঁড়াবার উপায় নেই, মড় মড় করে ভেঙে পড়ছে গাছ, ডালপালা উড়ে যাচ্ছে ওপর দিয়ে। বজ্রপাত হলে উঁচু গাছের ওপরই পড়বে তাই ওরা ফাঁকা মাঠের দিকে চলে যেতে চায়। আউস ধান কাটা হয়ে গেছে, শুকনো খড়ের গোড়া পায়ে বেঁধে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কায় ওরা দুজনে দু’জনের হাত শক্ত করে ধরে আছে, তবু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। পারে না। বসে পড়লেও ঝড় ওদের ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়। সুটকেস আর ব্যাগ আগেই ফেলে দিতে হয়েছে, মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতেও ওরা পরস্পরকে ছাড়লো না।
তারপর এক সময় বৃষ্টি নামলো।
দু’জনেই শক্ত-সমর্থ যুবক, তবু সেই ঝড় যেন ওদের প্রাণশক্তি অনেকখানি নিঙড়ে বার করে নিয়েছিল। বৃষ্টির মধ্যেও অনেকক্ষণ ওরা উঠে দাঁড়াতে পারেনি। দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে, সেই দৃষ্টিতে পুনর্জীবন প্রাপ্তির আনন্দ।
বাড়ি পৌঁছোলো জলকাদা মেখে ভূত হয়ে। বৃষ্টি থামার পর ওরা ব্যাগ ও সুটকেস উদ্ধার করেছে, ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি বিশেষ; প্রতাপের ঘাড়ের কাছটা চিলের আঁচড়ে ছড়ে গেছে, মামুনের বাঁ পাটা একটু মচকেছে।
পুকুরঘাটে পা ধুতে ধুতে মামুন বললো, তোকে আগে বলিনি, আমার বাবা একটু কড়া ধরনের মানুষ, কথায় কোনো মিষ্টতা নেই। তুই যেন কিছু মনে করিস না। তবে আমার আম্মুকে তোর খুব ভালো লাগবে। আমাদের বাড়িতে গোরু-গোস্ত ঢোকে না, সেদিক দিয়ে তোর চিন্তা নাই।
প্রতাপ বললো, তোদের বাড়িটা তো ভারি সুন্দর রে? ঠিক ছবির মতন।
মামুন বললো, অনেকগুলো ঘর আছে, তোকে যে ঘরটা দেবো, তাতে কী চমৎকার চাঁদের আলো আসে দেখিস। কাল তো পূর্ণিমা…ও হ্যাঁ, প্রতাপ, তুই আমার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করিস না।
–কেন? আমি যে কাজী নজরুলকে–
–কবিদের কোনো জাত নাই। কিন্তু আমার বাবা খুব কট্টর, উনি হিন্দুদের ছোঁয়া সহ্য। করেন না।
একটু হেসে মামুন আবার বললো, আমরা সৈয়দের বংশ তো, আমরা হিন্দুদের ছোট জাত মনে করি!
ঝড়ে এ বাড়ির একটি জন্ধুরা গাছ উপড়ে পড়ে গেছে। গাছটি ফলে ভর্তি। কতকগুলি শিশু ফলগুলি ছেঁড়ার জন্য দাপাদাপি করছে সেখানে। প্রতাপদের বাড়িতেও অনেকগুলি ঐ গাছ। আছে। অত ফল কে খাবে! প্রতাপের মনে পড়লো, শৈশবে সে বড় বড় বাতাবি লেবু গাছ। থেকে পেড়ে ফুটবল খেলতো।
মামুনদের বাড়িটি সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো। একটি বেশ বড় চৌকো উঠোনের তিন দিকে সারি সারি ঘর। অন্য দিকটি খোলা, তার পাশেই আর একটি দীঘি। উঠোনের এক পাশে দুটি ধানের গোলা। ঘরগুলির মধ্যে দুটি মাত্র পাকা দালান, সামনে চওড়া বারান্দা, অন্য ঘরগুলি মাটি ও টিনের।
বারান্দাটিতে একজন শীর্ণ, দীর্ঘকায় মানুষ নামাজ পড়ছিলেন, মামুন আর প্রতাপ কাছাকাছি। আসতেই তাঁর নামাজ শেষ হলো, তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দু’জনকে দেখে প্রতাপের দিকেই। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মামুন এগিয়ে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে বললো, আব্বা, এ আমার সহপাঠী, কলেজে আমাকে অনেক সাহায্য করে, আমাদের গ্রাম দেখতে এসেছে।
সৈয়দ আবদুল হাকিমকে দেখলেই বোঝা যায় তাঁর আলাদা ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে। তাঁর চেহারায় বৈশিষ্ট্য নেই, তাঁর পোশাকও প্রায় সর্বক্ষণের জন্যই লুঙ্গি ও ফতুয়া, শুকনো মুখোনিতে বার্ধক্যের ছাপ পড়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব তাঁর চোখে। তাঁর চোখের মণি দুটি ঠিক কালো নয়, ধূসর বর্ণের, তিনি অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রখর এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
মামুনের কথা শুনে তিনি প্রসন্নভাবে বললেন, গ্রাম দ্যাখতে আইছো। আমাগো গ্রামে আর কী দ্যাখবা, চাইর দিকেই তো শুধু পানি…আসো, বসো। হিন্দুবাড়ির ছাওয়াল মনে হয়? শাকিন কোথায়?
প্রতাপ বললো, আজ্ঞে, আমাদের বাড়ি বিক্রমপুরে, মালখানগরে।
একটুক্ষণ ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে চিন্তা করে হাকিম সাহেব বললেন, মালখানগর? তুমি জাতিতে কায়স্থ? মালখানগর তো আরও সুন্দর জায়গা, আমি গেছি।
মামুন আর প্রতাপ যে এই প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এসে পৌঁছোলো সেজন্য তিনি কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতাপের বাড়ির খবর নিতে লাগলেন। প্রতাপের বাবার পরিচয়, পেশা, কত বিঘে ধান জমি এসবও তিনি জানতে চাইলেন। এদিকে প্রতাপ আর মামুনের গায়ে ভিজে পোশাক, এখন ঠাণ্ডা হাওয়ায় ওদের শীত শীত লাগছে।
এক সময় মামুন বললো, আব্বা, আমরা কুর্তা বদলিয়ে আসি?
হাকিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বন্ধুটি থাকবে কোথায়?
মামুন বললো, পশ্চিমের শেষের ঘরখানায় শোবে। ঐ ঘরখানা ভালো, রাত্তিরে বাতাস আসে।
থুতনিতে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে সৈয়দ আবদুল হাকিম তাঁর ছেলের দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তুই ভিতরে যা। ও আমার ঘরে পোশাক বদল করে নিক। এসো বাবা, এসো–।
তিনি প্রতাপকে নিয়ে এলেন পার্শ্ববর্তী পাকা ঘরটিতে। নিজে প্রতাপের ক্যাম্বিসের ব্যাগটি বয়ে এনে বললেন, দরজা বন্ধ করে লও, গামছা আছে তো সঙ্গে, না দেবো? আছে, তো মাথা মুছে লও ভালো করে, যা প্রয়োজন হবে চাইবে, কোনো সঙ্কোচ করো না…।
ঘরটিতে একটি পুরোনো আমলের পালঙ্ক, একটি মর্চে পরা লোহার সিন্দুক রয়েছে। সেই সিন্দুকের ওপর অনেকগুলি ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার কপি। এটি মামুনের বাবার নিজের শয়নকক্ষ, উনি কি প্রতাপকে এই ঘরে রাখতে চান? প্রতাপ ঠিক করলো, তাতে সে ঘোরতর আপত্তি জানাবে। ইটের দেয়ালের ঘরে থাকার তার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই, কলকাতায় তো সেরকম ঘরেই থাকতে হয়, গ্রামে এসে তার মাটির ঘরই পছন্দ। প্রতাপদের বাড়িটাও কিছুটা পাকা, কিছুটা কাঁচা, বাল্যকাল থেকেই সে তার এক পিসীমার সঙ্গে একটা কাঁচা ঘরেই শুয়েছে।
তাড়াতাড়ি ভিজে পোশাক পরিবর্তন করে প্রতাপ বাইরে বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে বারান্দায় কয়েকটি জলচৌকি পাতা হয়েছে, মামুনের বাবা একটি জলচৌকিতে বসে হুঁকো টানছেন, প্রতাপকে দেখে বললেন, বসো, বাবা, বসো, মামুন আসতেছে।
বেশ কিছুক্ষণ তিনি নীরবে হুঁকো টেনে চললেন। নেমে এসেছে অকাল-সন্ধে, এ বাড়িতে এখনো বাতি জ্বলেনি, দূরের একটা ঘরে শোনা যাচ্ছে বাচ্চাদের কলকণ্ঠ, একজন কেউ কয়েকটি গরু ও বাছুর নিয়ে চলে গেল গোয়ালঘরের দিকে। প্রতাপদের বাড়িতে নতুন কেউ এলে বাড়ির অনেকেই এক সঙ্গে ভিড় করে তার কাছে আসে। এ বাড়িতে সেরকম প্রথা নেই দেখা যাচ্ছে।
একটু পরে একটি বালক এক কাঁসার বাটি ভর্তি মুড়ি, দুটি সবরি কলা ও গরম দুধ এনে রাখলো প্রতাপের সামনে। ক্ষণিকের জন্য হুঁকো টানা থামিয়ে হাকিম সাহেব বললেন, খাও বাবা, খাও, ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়, কত দূর থেকে এসেছো।
খিদে সত্যিই পেয়েছে, প্রতাপ লজ্জা করলো না, খেতে শুরু করে দিল। দুধে তার অভক্তি, বাড়িতে মা অনেক জোর করলেও সে দুধ খেতে চায় না, কিন্তু এখানে মামুনের বাবার সামনে সে আপত্তি জানাতে সাহস পেল না। ওঁকে সে কী বলে সম্বোধন করবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। চাচা বলা যায় না, কারণ উনি প্রতাপের বাবার চেয়ে বয়েসে ঢের বড়। মামুন বলেছিল। তারা আট ভাই-বোন, সে-ই সর্বকনিষ্ঠ। জ্যাঠামশাইকে এরা যেন কী বলে?
একটু পরে মামুনও একটা মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে এলো, তার মুখ গম্ভীর, প্রতাপের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ফিরিয়ে নিল মুখ।
কোটা নামিয়ে রেখে সৈয়দ আবদুল হাকিম দু’বার কাশলেন। পাশে রাখা একটা ঘটি তুলে আলগোছে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছলেন। তারপর প্রতাপের দিকে চাইতেই প্রতাপ বললো, জ্যাঠামশাই, আপনার ঘর…
প্রতাপকে থামিয়ে দিয়ে হাকিম সাহেব বললেন, শোনো, বাবা, তুমি আমার বাড়িতে মেহমান হয়ে এসেছো, তোমাকে একটা কথা বলতে আমার বড় কষ্ট লাগতেছে, তবু বলতেই হবে। আমার বাড়িতে কোনো হিন্দুরে আমি স্থান দিতে পারি না। আমার পিতার নিষেধ আছে। মামুনটা এ বৃত্তান্ত জানে না তাই তোমারে নিয়ে এসেছে। আমরা যেমন কোনো হিন্দু বাড়ির ত্রিসীমানায় রাত্রিবাস করি না, সেই রকম আমাদের বাড়িতেও …
মামুন বললো, আব্বা!
হাকিম সাহেব বললেন, তুমি থামো! শোনো বাবা, প্রতাপ, তুমি মামুনের সহপাঠী, তুমি এখানে এসে পড়েছো, বাড়িতে অতিথি এলে ফিরিয়ে দেওয়াটা বড় খারাপ, কিন্তু পারিবারিক প্রথা তো অমান্য করতে পারি না। তা বলে তুমি পানিতে তো পড়োনি, তোমার ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবেই। পাশের গ্রামের সত্যসাধন চক্রবর্তী আছেন, অতি সজ্জন, আমরা এক সাথে জেলা ইস্কুলে পড়েছি, উনি দু ক্লাস উঁচুতে পড়তেন। তাঁর বাড়িতে তুমি ভালোই থাকবে। আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাবো…
রাগে-অভিমানে প্রতাপের বুক উদ্বেল হয়ে উঠলো। সে মামুনের সঙ্গে থাকবে বলে এতদূর এসেছে, তার বদলে কোন্ এক অচেনা লোকের বাড়িতে তাকে আশ্রয় নিতে হবে? কেন, সে কি ভিখিরি নাকি? এতক্ষণে নিজের বাড়ি পৌঁছোলে তাকে ঘিরে হইচই পড়ে যেত। তার মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জোর করে কতরকম খাবার খাওয়াতেন, দিদিরা এসে জিজ্ঞেস করতো। কলকাতার খবর, বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে উৎসুকভাবে চেয়ে থাকতো। প্রত্যেকবার তার বাড়ি ফেরাই একটা উৎসবের মতন। আর এখানে।
প্রতাপ দপ করে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বললো, আমি ফিরে যাচ্ছি।
মামুন সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরলো তার হাত। কাতরভাবে শুধু বললো, প্রতাপ, প্রতাপ!
প্রতাপ ঝটকা দিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করলো। মাত্র দু’এক ঘন্টা আগে তারা দু’জনে ঝড়ের মুখে আত্মরক্ষার জন্য পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে ছিল।
প্রতাপ রুক্ষভাবে বললো, ছাড় মামুন, আমি বাড়ি ফিরে যাবো!
মামুন বললো, এখন ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে, এখন যাওয়া যাবে না।
প্রতাপ বললো, অন্য নৌকো দেখবো, যত টাকা লাগে লাগুক, না পেলে সাঁতরে আমি ভয় পাই নাকি!
হাকিম সাহেব শান্তভাবে তামাক টানছেন। এবারে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, শোনো বাবা, রাগ করো না, বুঝে দেখো। তোমাদের বাড়িতে হঠাৎ অন্য জাতের কোনো অতিথি এলে তোমার পিতা-মহাশয়ও হয়তো অসুবিধায় পড়তেন।
প্রতাপ জ্বলন্ত চোখে হাকিম সাহেবের দিকে তাকালো। সে প্রায় বলতে যাছিল, আমার বাবা মোটেই সংস্কারগ্রস্ত নন, সুলেমন চাচা নিয়মিত আমাদের বাড়িতে দাবা খেলতে আসেন, আজিজ চাচা একবার টানা সাতদিন ছিলেন আমাদের বাড়িতে…। কিন্তু নিজেকে সে সামলে নিল। পিতৃস্থানীয় কারুর মুখে মুখে কথা বলা স্বভাব নয় তার।
সে আবার জোর দিয়ে বললো, আমি ফিরে যাবো!
হাকিম সাহেব বললেন, না, না, তুমি ফিরে গেলে বড় দুঃখ পাবো! তোমার থাকার ভালো ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, সে বাড়ি মোটেই দূর নয়। সারাদিন তুমি এখানেই কাটাবে মামুনের সাথে, রাত্তিরটা শুধু শুতে যাবে সেখানে। ওরে, একটা হ্যারিকেন আন্।
প্রতাপ বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে একটা দৌড় লাগালো। মামুনও ছুটলো তার পিছু পিছু। মামুনের বড় এক ভাই আনিসুল আড়ালে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ, সে-ও এবার বেরিয়ে এলো। মামুন আর আনিসুল একটু দূরেই দু’দিক থেকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরলো প্রতাপকে।
মামুন বললো, প্রতাপ, আমি ক্ষমা চাইছি, ক্ষমা চাইছি, তোর পায়ে ধরছি।
আনিসুল বললো, ভাই, আমার আব্বা বড় জেদী, তাঁর ওপরে আমরা কথা বলতে সাহস পাই না। তুমি এমনভাবে যদি চলে যাও, তা হলে আমাদের দুঃখের শেষ থাকবে না। মামুনকে তো তুমি চেনো। ও বড় নরম, ও যে কী করবে তার ঠিক নাই। আজ রাত্তিরটা অন্তত চক্রবর্তীদের ওখানে থাকো, তারপর কাল যদি যেতে চাও আমি নিজে গিয়ে তোমারে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
হাতে একটি হ্যারিকেন নিয়ে হাকিম সাহেবও সেখানে এসে গেলেন। ধীর স্বরে বললেন, বাবা প্রতাপ, তোমার মনে দুঃখ দিয়েছি, তাতে আমারও দুঃখ হয়েছে। কিন্তু পিতার আজ্ঞা তো অগ্রাহ্য করতে পারি না। তোমার পিতা যদি কোনো নির্দেশ দেন, তুমি কি তা অমান্য করতে পারো?
প্রতাপ মনে মনে খুঁসতে ফুসতে বললো, আমার বাবা কোনো অন্যায় নির্দেশ দিলে তা আমি কোনোদিনই মানবো না!
মামুন আর আনিসুল তার দু হাত ধরে একপ্রকার টেনেই নিয়ে চললো তাকে। বাকি রাস্তা কেউ কোনো কথা বললো না। বৃষ্টির পর পথ একেবারে পিচ্ছিল। মেঘলা রাত, অদূরের কিছুই দেখা যায় না। কু–উক, কু—উক–ক শব্দে কী একটা অদৃশ্য রাত-পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে শুধু।
চক্রবর্তীদের বাড়ি বেশি দূর নয় ঠিকই। মিনিট পনেরোর মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া। গেল। বাড়ির মধ্যে একটা হ্যাঁজাক জ্বলছে। বাইরে থেকে হাকিম সাহেব ডাকলেন, সত্যদা, সত্যদা!
কে? বলে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ। ফর্সা, মাঝারি ধরনের উচ্চতা, শুধু ধুতি পরা, বুকে পৈতে। খড়ম খটখটিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে রে? হাকিম নাকি রে?
হাকিম সাহেব বললেন, হ্যাঁ, সত্যদা। আপনার পূজো-আচ্চা সারা হয়ে গেছে? ব্যাঘাত করলাম না তো?
সত্যসাধন বললেন, না, না, আয়, ওপরে উঠে আয়। মামুন ফিরেছে বুঝি? সঙ্গে ওটি কে? ওরে ভোলা, একটা মাদুর নিয়ে আয়।
হাকিম সাহেব বললেন, আপনার বাড়িতে একজন অতিথি এনেছি।
সত্যসাধন চক্রবর্তীরও পাকা দালান। উঠোনে তুলসীর মঞ্চ, এক কোণে দেব-দেউল। তাঁর প্রসন্ন মুখোনিতে আর্থিক সচ্ছলতার ছাপ।
সামনের বাঁধানো চাতালে মাদুর পেতে বসা হলো। হাকিম সাহেব সংক্ষেপে প্রতাপের পরিচয় জানালেন। প্রতাপের মনের মধ্যে এখনো রাগ রয়ে গেছে বলে সে সত্যসাধন চক্রবর্তীকে প্রণাম করতে ভুলে গেল। সে তখনো চিন্তা করে যাচ্ছে যে আজ রাতটা কোনো মতে কাটিয়ে কালই সে মালখানগরে ফিরে যাবে।
হাকিম সাহেবের সঙ্গে সত্যসাধনের বেশ সৌহার্দ, হালকা তামাসার সুরে কথা বলতে লাগলেন দু’জনে। সত্যসাধন প্রতাপকে দেখে খুশী হয়েছেন। তিনি বললেন, বড় ভালো করেছিস হাকিম, ওকে এনেছিস, বাড়িতে আর দ্বিতীয় পুরুষ মানুষ নেই। তবু কথা বলার একজন লোক পাওয়া যাবে।
একটু পরেই হাকিম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ অনেক ধকল গেছে, ওরা ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এসেছে, এবার বিশ্রাম করুক। চলরে মামুন, আমরা যাই!
ওদের খানিকটা এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসার পর সত্যসাধন প্রতাপকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কথা কম কও বুঝি?
প্রতাপ নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সে চেষ্টা করে ফ্যাকাসেভাবে হেসে বললো, আজ্ঞে না, এমন ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম যে সারা শরীর ব্যথা হয়ে গেছে।
সত্যসাধন বললেন, খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। শোনো, তোমারে। আগেই একটা কথা বলে দেই। আমাদের বাড়িতে অতিথি আসা নতুন কিছু নয়। অতিথি আসলে আমরা খুশী হই। তুমি নিজের বাড়ি মনে করে থাকবে এখানে। ছাদে একখানা ঘর আছে, সেখানে তুমি থাকবে, যদি পড়াশুনা করতে চাও, ব্যাঘাত হবে না।
এ বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ মানুষ নেই, কথাটা একেবারে সঠিক নয়। সত্যসাধনের পিতা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর বয়েস প্রায় নব্বই, তিনি শয্যার সঙ্গে সাঁটা এবং প্রায় বারহিত। সত্যসাধনের ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন বরিশালের বি এম কলেজের অধ্যাপক। আর একজন মুঙ্গেরে সরকারি কর্মচারি। সত্যসাধনের পাঁচটি সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ের বিবাহ হয়ে গেছে। এক পুত্র বিলেতের ম্যানচেষ্টারে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাঠরত, আর এক পুত্র জেলে। এই ছেলেটির নাম হিতব্রত, সে চট্টগ্রামে পড়াশুনা করতে গিয়ে সূর্য সেনের দলে ভিড়ে যায়। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে সে ধরা পড়ে আহত অবস্থায়। এখন সে সুস্থ শরীরে কারাদণ্ড ভোগ করছে।
প্রতাপের বাড়ির খবর জানার ফাঁকে ফাঁকে সত্যসাধন নিজের পারিবারিক ইতিহাসও জানিয়ে দিলেন। তাঁর ছেলে হিতব্রত যে স্বদেশী করতে গিয়ে জেল খাটছে, সেজন্য খুব একটা উদ্বিগ্ন বা শোকার্ত মনে হলো না তাঁকে।
এ বাড়িতে পর্দা প্রথা নেই। সত্যসাধন প্রতাপকে নিয়ে এলেন অন্দরমহলে। তাঁর স্ত্রী প্রতাপকে মুহূর্তে আপন করে নিলেন। সুরবালার কণ্ঠস্বরটি এমন কোমল যে মনে হয় তাঁর বুকে ক্রোধ-হিংসা জাতীয় উগ্র অনুভূতিগুলির বিন্দুমাত্র স্থান নেই। প্রতাপের মুখের সঙ্গে নাকি তাঁর ছেলে হিতুর খুব মিল আছে। সে কথা বলতে বলতে তিনি একবার চোখে আঁচল চাপা দিয়ে পরমুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, প্রতাপের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।
পুজোর ছুটিতে সত্যসাধনের প্রবাসী দুই ভাই-ই বাড়িতে আসবে। যে-ভাই মুঙ্গেরে থাকে, তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা বলে আগে থেকেই এখানে এসে রয়েছেন। তাঁর তিনটি ছেলেমেয়ে।
খাওয়ার সময় দেখা হলো সকলের সঙ্গে। চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি কিশোরী মেয়ে। ওদের পরিবেশন করছিল। সত্যসাধন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এটি আমার মেজো। ভায়ের মেয়ে, ওর নাম বুলা। ভালো গান করে। রবিবাবুর গান, কাজী সাহেবের গান বেশ। শিখেছে। কাল সকালে বুলা তোমাকে গান শুনাবে।
বুলা মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। সে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কলকাতায় কোথায় থাকেন? আমি দু’বার কলকাতায় গেছি। কলকাতা ভালো চিনি।
প্রতাপ আহমাস্ট স্ট্রিটে থাকে শুনে বুলা আবার বললো, আপনি রোজ গঙ্গায় স্নান করেন? আপনার বাড়ির কাছেই তো!
প্রতাপ ঠাট্টার সুরে বললেন, হ্যাঁ, পাশেই গঙ্গা। জানলা দিয়ে দেখা যায়!
বুলা বললো, বাবা বলেছেন, আমিও কলকাতার কলেজে পড়বো।
খাওয়া-দাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ গল্প হলো। তারপর প্রতাপকে যখন ওপরের ঘরে পাঠানো হবে তখন বুলা বললো, আপনি ছাদের ঘরে একা থাকবেন, ভূতের ভয় পাবেন না তো? আমাদের ছাদে কিন্তু ভূত আছে!
সত্যসাধন সস্নেহে ভর্ৎসনা করে বললেন, এই ছেমরি, তুই শুধু শুধু ওরে ভয় দ্যাখাস ক্যান রে?
বুলা চোখ বড় বড় করে বললো, সত্যি ভূত আছে, রোজ রাতে খড়মের শব্দ হয়!
সত্যসাধন বললেন, ওরে, আমিই তো সেই ভূত!
ভূতের জন্য নয়। এমনিতেই প্রতাপের সারা রাত ভালো করে ঘুম হলো না। তার মস্তিষ্ক উত্তেজনায় উত্তপ্ত হয়ে আছে। মাঝে মাঝেই তন্দ্রা ভেঙে যায় আর মনে পড়ে মামুনের বাবার কথাগুলো। তার জীবনে এরকম অপমানের অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। কত সাধ করে সে। মামুনের সঙ্গে এসেছিল, মামুনের সঙ্গে একঘরে থাকবে, শুয়ে শুয়ে গল্প করবে..মামুনের বাবা তাকে বাড়িতে স্থান দিলেন না?
প্রতাপের ঘুম ভাঙলো মামুনের ডাকে। মামুন একেবারে ছাদের ঘরে উঠে এসেছে। প্রতাপের গায়ে ঠ্যালা দিয়ে ঘুম ভাঙালো। তারপর বিছানায় বসে পড়ে প্রতাপের পিঠে হাত রেখে বললো, তুই এখনো রাগ করে আছিস, প্রতাপ? আমার আম্মা কাল কত রাত পর্যন্ত কেঁদেছেন তোর জন্য। সেই কান্না দেখলে তুই-ও চোখের পানি আটকাতে পারতিস না।
প্রতাপের বুকে এখনো অভিমান জমে আছে। সে মামুনের সঙ্গে তখনই কথা বলতে পারলো না। উঠে বসে চোখ রগড়াতে লাগলো। ভোর রাতে ঠাণ্ডা বাতাসে তার শীত শীত লাগছিল, সেই জন্য শরীর ভারী হয়েছে।
মামুন বললো, তোকে এখনো চা দেয়নি? আমি সাত-সকালে চলে এলাম, কারণ আমাদের বাড়িতে চায়ের পাট নেই, এ বাড়িতে চা হয়। আমিও একটু চা খাবো।
প্রতাপ এবারে জিজ্ঞেস করলো, মামুন, তোদের বাড়িতে যে কোনো হিন্দু থাকতে পারে না, তা তুই আগে জানতি না, না?
–সত্যি জানতুম না, বিশ্বাস কর।
–এখন জেনেছিস নিশ্চয়, তার কারণটা?
–হ্যাঁ, জেনেছি। আম্মার কাছে কাল রাতে শুনেছি।
–কী?
–তা তোর শোনার দরকার নাই।
–আমি শুনতে চাই।
–আমার দাদা, মানে আমার বাবার বাবা একবার সিলেটে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে খুব অপমানিত হয়েছিলেন। সেই বামুনবাড়ির বৈঠকখানায় তিনি বসেছিলেন বলে বামুন রেগে চ্যাঁচামেচি করে তাঁকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। সে বাড়ির সব পানি ফেলে দেওয়া হয়, পানির কলসী পর্যন্ত ভেঙে ফেলে। সেই থেকে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন…
–কবে কোন্ এক ব্রাহ্মণ তোর ঠাকুদাকে অপমান করেছে, তার ফলভোগ করতে হবে আমাকে?
–ওঁরা সব প্রাচীনপন্থী। আমার আব্বা কিন্তু তোকে পছন্দ করেছেন।
–অনেক বামুন তো কায়স্থদের হাতের ছোঁওয়াও খায় না! বামুনদের দোষের জন্য আমি কেন দায়ী হবো?
— প্রতাপ, তুই এখনো রেগে আছিস! এসব তো আমাদের ব্যাপার নয়!
— নবাব-বাদশাদের আমলে কত বামুনকায়েতকে জোর করে গোরুর মাংস খাইয়ে জাত মেরে দেওয়া হয়েছে। সেই সব আমরা মনে রাখবো? একজনের পাপে আর একজন শাস্তি পাবে?
প্রতাপের কণ্ঠস্বর ক্রমশ উচ্চগ্রামে চড়ছিল, এমন সময় বাইরে বুলার গলা শোনা গেল। সে চা চাই? চা? বলে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার এক হাতে দুটি কাপ,অন্য হাতে একটি চিনেমাটির চা-পাত্র। একটা গোলাপি ডুরে শাড়ী গাছ-কোমর করে পরা। এই সকালেই স্নান হয়ে গেছে বুলার, মাথার চুল ভিজে। চোখের পাতা গাঢ় কৃষ্ণ, গ্রামের গণ্ডি ছেড়ে সে বাইরের জগৎ অনেকখানি দেখেছে, তাই তার মুখে ভীতু-ভীতু লজ্জার ভাবটা নেই।
মামুনকে সে আগেই আসতে দেখেছে নিশ্চয়ই, তাই দুটি কাপ এনেছে। চা ঢালতে ঢালতে সে বললো, সকালবেলাতেই দুই বন্ধুতে কিসের তর্ক হচ্ছে? কাল রাত্তিরে ভূত দেখেছিলেন।
মামুন নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলো বুলার দিকে।
প্রতাপ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেজাজ শান্ত করলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, চা কে বানিয়েছে, তুমি?
বুলা বললো, আমি আর আমার মা ছাড়া এ বাড়িতে কেউ চা বানাতে জানেই না। কলকাতার চায়ের মতন হয়েছে?
প্রতাপ বললো, মন্দ না।
–আপনি ভূত দেখেছেন কি না, বলুন না। আমি কাল রাত্তিরেও ছাদের স্বপ্ন দেখেছি!
প্রতাপ বললো, ভূত-পেত্নী কেউ তো এলো না। মামুন, এই মেয়েটির নাম বুলা। পশ্চিমা মেয়ে, খুব টর টর করে কথা বলে।
বুলা বললো, আমার ভালো নাম গায়ত্রী চক্রবর্তী। মোটেই পশ্চিমা মেয়ে নই। মাত্র দু’ বছর আগে মুঙ্গেরে গেছি!
মামুন বললো, অনেক ছোটবেলা দেখেছি ওকে, এখন চিনতেই পারিনি। তখন অন্য রকম ছিল। যেন শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে এসেছে!
বুলা তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে উঠলো। তারপর বললো, আপনি কী মজার কথা বলেন! আমি প্রজাপতি! ডানা মেলে উড়ে যাবো?
ছাদের পাশেই একটি পেয়ারা গাছ, এ দেশে পেয়ারাকে বলে গোইয়া। সেই গাছের বেশ কয়েকটি ডালপালা ঝুলে আছে ছাদের ওপর, তাতে পেয়ারা ফলেও আছে। হাত বাড়িয়েই পাওয়া যায়। পটাপট কয়েকটা পেয়ারা ছিঁড়ে এনে বুলা বললো, নিন, এই দিয়ে ব্রেক ফাস্ট শুরু করুন।
মামুন একটা পেয়ারায় কামড় দিয়ে বললো, বাঃ, বেশ মিষ্টি তো। তোমাদের বাড়ির গোইয়ার খুব সুনাম আছে।
প্রতাপ অবাক হলো। আকারে মোটামুটি বড় হলেও বেশ শক্ত, কষা কষা, এখনও ভালো করে স্বাদই আসে নি। এই পেয়ারাকে মামুন মিষ্টি বলছে? প্রতাপ নিজেরটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ধুৎ, এ খাওয়া যায় না। তুমি আমাদের আর এক কাপ করে চা খাওয়াবে?
বুলা আবার চা আনতে চলে গেল।
মামুন বললো, প্রতাপ, তুই আমাদের বাড়িতে আর একবার যাবি না? আমার আম্মা কিরে দিয়েছেন, তুই যদি একবার দেখা না করিস, খুব কষ্ট পাবেন।
প্রতাপ চুপ করে রইলো। নিজেকে সে ধর্ম-নিরপেক্ষ মনে করে বটে, তবু তার মনের মধ্যে কোথাও একটা হিন্দু-গরিমা আছে, সেখানে আঘাত লেগেছে। বাল্যকাল থেকেই সে দেখেছে যে মুসলমানরা হিন্দুদের কাছে বিনীত থাকে,উদার হিন্দুদেরও কথার সুরে ফুটে ওঠে। একটা পিঠ-চাপড়ানির ভাব। এই প্রথম সে শুনলো যে কোনো মুসলমানের বাড়িতে হিন্দুর স্থান নেই। কাল রাতে সে অন্তত পঁচিশ তিরিশবার মনে মনে বলেছে, সে জীবনে আর কখনো কোনো মুসলমানের বাড়িতে পা দেবে না! কিন্তু মামুন তো শুধু মুসলমান নয়, মামুন তার বন্ধু!
মামুন বললো, বুলাকেও নিয়ে যাবো তোর সাথে, সত্যজ্যাঠা আমাদের ওখানে প্রায়ই যান।
একটু পরেই বুলা আবার চা নিয়ে ফিরে এলো। দুটি কাপে চা ঢালার পর সে প্রতাপের দিকে চোখ পাকিয়ে বললো, আপনি আমাদের গাছের পেয়ারা ফেলে দিলেন? দাঁড়ান, আপনাকে আর একটা দিচ্ছি, গাছপাকা, ঐ যে উপরের ডালে, খেয়ে দেখবেন, একেবারে গুড়।
আচলটা কোমরে জড়িয়ে বুলা একটা ডাল বেয়ে উঠতে যেতেই সেই ডালটা এমন দুলে উঠলো যে প্রতাপ ভয় পেয়ে গেল। এই দস্যি মেয়েটা পড়ে যাবে নাকি! ওপরের ডালটা বেশ সরু। প্রতাপ দৌড়ে এসে বুলার হাত চেপে ধরে বললো, এই, এই, নামো, তোমাকে উঠতে হবে না। আমি পেয়ারা খাবো না!
ইচ্ছে করে গাছের ডালটা আরও দোলাতে দোলাতে বুলা হেসে বললো, এই এই করছেন কেন? বললাম না, আমার নাম গায়ত্রী। আমি এর থেকে কত উঁচু আম গাছে উঠতে পারি।
সেই প্রথম প্রতাপ এক অনাত্মীয়া কিশোরীর শরীর স্পর্শ করেছিল।
মোট আট দিন সেইখানে থেকে গেল প্রতাপ। তারপর তাকে মালখানগরে ফিরতেই হবে। এর মধ্যে সত্যসাধনদের পরিবার এবং হাকিম সাহেবের পরিবারের সকলের সঙ্গে তার গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে। দু জায়গাতেই তাকে প্রতিজ্ঞা করে যেতে হলো যে আবার আসবে।
মামুনের মা তাকে মাতৃস্নেহেরও অধিক কিছু দিয়ে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত হাকিম সাহেবকেও খারাপ লাগে নি প্রতাপের। তিনি কট্টর লীগপন্থী, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সে সব কিছু আনেন না। প্রতাপ আরও লক্ষ করেছিল, হাকিম সাহেব হিন্দুদের আচার-আচরণ, ধর্ম ও বেদ-পুরান সম্পর্কে যতখানি জানেন, অনেক শিক্ষিত হিন্দুই মুসলমানদের ধর্ম, রীতি-নীতি, কোরান-হাদিস সম্পর্কে তার সিকিভাগও খবর রাখে না।
দায়ুদ কান্দিতে নৌকোয় তুলে দিতে এসে একেবারে শেষ মুহূর্তে মামুন তার পাঞ্জাবির একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বললো, একটা কবিতা…বাড়িতে গিয়ে পড়িস।