সপ্তম পাঠ
পাস করণ বা হাত বুলান
ইংরাজীতে যাহাকে “পাস করণ” কহে, বাঙ্গলায় তাহাকে “হাত বুলান” বলা যায়। লোককে সম্মোহিত (hypnotise or mesmerise) করিতে তাহার শরীরে পাস করিতে বা হাত বুলাইয়া দিতে হয়। এই হাত বুলান বা পাস (laying on of hands) বিশেষভাবে কেবল রোগ চিকিৎসার জন্যই প্রাচীন এশিয়াতে উদ্ভাবিত হইয়াছিল এবং বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহার প্রচলন বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। বর্তমান সময়েও এতদ্দেশে সর্বশ্রেণীর লোকের মধ্যে ইহার খুব প্রচলন আছে। এখনও সময় সময় সাধু-সন্ন্যাসী, ওঝা-ফকির ইত্যাদি ব্যক্তিগণকে তাহাদের বিশেষ প্রণালীতে “হাত বুলাইয়া” বা “ঝাড়িয়া” (ঝাড়-ফুক্ করিয়া) অত্যন্ত কঠিন কঠিন রোগ অত্যাশ্চৰ্য্যরূপে আরোগ্য করিতে দেখা যায়। এই পাস বা হাত বুলান আমাদের দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতায় নিকট এত অধিক পরিচিত যে, কাহার শরীরের কোন স্থানে কোন রোগ হইলে বা কোন প্রকার আঘাত লাগিলে নিতান্ত অজ্ঞ ব্যক্তিরাও সেই পীড়িত স্থানের উপর হাত বুলাইয়া যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা পাইয়া থাকে। মহাত্মা যীশু খৃষ্ট এবং তাহার শিষ্য বা অনুসরণকারিগণের মধ্যেও কেহ কেহ হাত বুলাইয়া রোগ আরোগ্য করিতে পারিতেন। খৃষ্ট ধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর, বোধ হয় পাদরিগণের দ্বারাই ইহার ব্যবহার ইয়ুরোপে প্রবর্তিত হইয়াছিল। এদেশীয় জনসাধারণের মধ্যে এই পাসের বহুল প্রচলন থাকিলেও ইহার প্রকৃত অর্থ বোধহয় খুব কম লোকেরই জানা ছিল। যাহা হউক, জৈব আকর্ষণী বিদ্যাবিৎ সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার মেসমাই সর্বপ্রথম ইহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করতঃ মোহিতাবস্থা উৎপাদনের নিমিত্ত নিয়মিতরূপে ইহার প্রয়োগ আরম্ভ করেন।
ডাক্তার মেমার মোহিতাবস্থাকে (mesmerised condition) ম্যাগ্নেটিজ বা জীবনী শক্তির ক্রিয়ার স্পষ্ট ফল (direct effect) বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই জীবনী শক্তি হস্তাঙ্গুলির অগ্রভাগ হইতে নিঃসৃত হইয়া থাকে বলিয়া একটি বিশেষ প্রণালীতে অঙ্গুলি চালনা দ্বারা (অর্থাৎ পাস করিয়া বা হাত বুলাইয়া) পাত্রের শরীরে উহা প্রেরণ বণ্টন, সঞ্চালন এবং লক্ষ্যাভিমুখে পরিচালন, (transmitting, distributing, circulating and directing) ক্রিয়া সম্পাদন করিতে পারা যায়। অতএব মেস্মেরিজমে পাসের ব্যবহার অপরিহার্য।
পক্ষান্তরে হিপ্নোটিষ্টদের মত এই যে, মোহিতাবস্থা (hypnosis) ম্যাগ্নেটিজম্ এর ফল নয়; যেহেতু পাস ব্যতিরেকে কে বল আদেশের সাহায্যেও এই অবস্থা উৎপাদন করা যায়। তবে পাস দ্বারা পাত্রের স্নায়ুমণ্ডলীর ভিতর আরামপ্রদ একটি কোমল অনুভূতি জন্মে বলিয়া উহা কিয়ৎপরিমাণে তাহার নিদ্রা উৎপাদনের সাহায্য করিয়া থাকে মাত্র। এজন্য তঁাহারা সম্মোহন করিতে পাস অপেক্ষা আদেশই অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করেন এবং বেশী পরিমাণে উহাই প্রয়োগ করিয়া থাকেন।
পাস প্রধানতঃ দুই প্রকার;–“নিম্নগামীdownward) ও “উর্দ্ধগামী (upward); উহারা আবার দুই শ্রেণীতে বিভক্ত; যথা—“স্পর্শযুক্ত” (with contact) ও “স্পর্শহীন” (without contact)। সম্মোহনবিৎ যখন পাত্রের শরীর স্পর্শ করতঃ, তাহার মাথার দিক হইতে আরম্ভ করিয়া পা পর্যন্ত পাস করে, তখন উহাকে “স্পর্শযুক্ত নিম্নগামী পাস (downward pass with contact), আর যখন সে তাহার হাত দ্বারা। পাত্রের শরীর স্পর্শ না করিয়া (শরীরের এক ইঞ্চি উপর দিয়া) তাহার মাথার দিক হইতে আরম্ভ করতঃ পা পর্যন্ত পাস করে, তখন উহাকে “স্পর্শহীন নিম্নগামী পাস” (downward pass without contact) বলে। আবার যখন সম্মোহনৰিৎ পাত্রের শরীর স্পর্শ করিয়া তাহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত পাস করে, তখন উহাকে স্পর্শযুক্ত উৰ্দ্ধগামী পাস (upward pass with contact) বলে; এবং যখন পাত্রের শরীর স্পর্শ না করিয়া উক্তরূপে পাস করে, তখন তাহাকে স্পর্শহীন উৰ্দ্ধগামী পাস” (upward pass without contact } বলে। নিম্নগামী পাস পাত্রকে মোহিত করিতে, আর উর্দ্ধগামী পাস কে বল মোহিত ব্যক্তিকে প্রকৃতিস্থ করিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
পাস করিবার প্রণালী :–পাত্রকে সম্মোহিত করিতে কার্যকারক উভয় হাতের আঙ্গুলগুলি অল্প ফাঁক করিয়া হাত দুইখানা কাপাইতে কাপাইতে তাহার সমস্ত শরীরে বা উহার বিশেষ কোন অংশে, শরীরের উপর দিক হইতে আরম্ভ করিয়া বরাবর নীচের দিকে উহাদিগকে বুলাইয়া দিয়া থাকে। সর্বদাই উভয় হাত দ্বারা পাস করা হয় না। কখনও ডান হাত দ্বারা আবার কখনও বা বাম হাত দ্বারা পাস করিতে হয়; সুতরাং এ বিষয়ে নির্দিষ্টরূপে কোন উপদেশ দেওয়া কঠিন। পাত্রকে মোহিত করিবার সময় কখন কিরূপ পাস দিতে হয়, তাহ যথা স্থানে বিবৃত হইয়াছে এবং মেয়েরাইজ করিতে যে সকল পাস সর্বদা ব্যবহৃত হয়, তাহাও দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিতরূপে লিপিবদ্ধ করা গিয়াছে; সুতরাং উহাদের সম্বন্ধে বর্তমান পাঠে বিশেষ কিছু বলার আবশ্যকতা নাই।
একখানা ইজি চেয়ারে কিম্বা বিছানায় একটি লোক শুইয়া আছে, এরূপ কল্পনা করিয়া, সেই কল্পিত মনুষ্য-শরীরের উপর, মাথার দিক হইতে আরম্ভ করিয়া পা পর্যন্ত পাস করিবে, একবার করা হইলে পুনর্বার করিবে এবং ক্রমা গত দশ মিনিট উক্তরূপ পাস দিবে। পাত্রকে ঘুম পাড়াইবার আদেশের (যাহা পরে বিবৃত হইতেছে) সহিত এই অনুশীলনটি সুন্দররূপে অভ্যাস করিয়া লইলে, শিক্ষার্থী পাত্রকে শীঘ্র নিদ্রিত বা সম্মোহন করিতে সমর্থ হইবে। পাস প্রয়োগ না করিয়া কেবল আদেশ এবং মোহিনী-দৃষ্টি দ্বারা মোহিত করিতে পারা যায়। কিন্তু তৎসঙ্গে পাস ব্যবহার করিলে, উহাদের সম্মিলিত শক্তি প্রখরতর হইয়া থাকে।
শিক্ষার্থী এই অনুশীলনটি সুন্দররূপে অভ্যাস করিয়া লইবে। যেহেতু অভ্যাস না থাকিলে ক্রমাগত অধিকক্ষণ পাস দেওয়া যায়না-হাত, কোমর ইত্যাদি স্থানে বেদনা হয় এবং তজ অস্বস্তি বোধ হয়। মোহিত করিবার সময় অস্বচ্ছলতা বোধ করলে প্রখর ভাবে মন শক্তি প্রয়োগ করা যায়না। এজন্য ইহাতে তাহার এমন অভ্যাস থাকা চাই, যেন আবশ্যক হইলে, সে কিছু মাত্র কষ্ট বা ক্লান্তি বোধ না করিয়া ক্রমাগত ২৫/৩০ মিনিট কাল পাস দিতে পারে।