বাড়ির দারোয়ানের সঙ্গে তুতুলকে ইস্কুলে পাঠিয়ে সুপ্রীতি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন গেটের সামনে। চোদ্দ বছর বয়েস হয়েছে তুতুলের, এখনো সে ফ্রক পরেই স্কুলে যায়। ঠিক এই বয়েসেই সুপ্রীতির বিয়ে হয়েছিল, অথচ তখন সুপ্রীতি তুতুলের মতন এত ছোট ছিলেন না। সব কিছু বোঝার মতন জ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
সুপ্রীতির বয়েস এখন চুয়াল্লিশ, কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য নিভাঁজ। তাঁর মনে প্রসন্নতা আছে, তাই আধকাংশ সময়েই তিনি সহাস্য থাকেন। তবে আজ সকাল থেকেই তিনি উদ্বিগ্ন, মুখে বার বার একটা ছায়া এসে পড়ছে।
তুতুল পথের বাঁকে মিলিয়ে যাবার পর সুপ্রীতি গেট বন্ধ করে বাড়ির মধ্যে এলেন। সামনে ঢাকা বারান্দা, তারপর বসবার ঘর। এ ঘরের সোফা-সেটগুলোর স্প্রিং নষ্ট হয়ে গেছে, ঢাকনাগুলি বিবর্ণ, কোনোটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোবড়া। মেঝের কার্পেটটা শতচ্ছিন্ন, ওটাকে রাখার আর কোনো মানেই হয় না। কিন্তু এ ঘরের কোনো কিছুই পরিবর্তনের অধিকার সুপ্রীতির নেই।
ঘরের এক কোণে নোংরা জামা কাপড়ের স্থূপ, সেদিকে তাকিয়ে সুপ্রীতি থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ডাকলেন, মানদা, মানদা!
ভেতরের উঠোনের খোলা কলতলায়, মানদা বাসনপত্তর ধুচ্ছিল, ডাক শুনে সে জল-হাতে এসে দাঁড়ালো। সুপ্রীতি কাপড়ের স্তূপটির দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন, এগুলো এখানে কে রেখেছে?
মানদা বললো, আমি রাখিনি তো, ভূষণের মা ফেলে গেছে নির্ঘাৎ!
সুপ্রীতি বললেন, তাকে ডাকো!
ভূষণের মাকে ডেকে আনতে একটুক্ষণ দেরি হলো, সুপ্রীতি সেখানেই অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। আজ ভোরবেলাই একটা খারাপ খবর এসেছে। তাঁদের কাশীপুরের বাগানবাড়িটা বিক্রির জন্য সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, কাল মাঝ রাত্রে এক দঙ্গল রিফিউজি ঢুকে পড়েছে সেখানে। সে বাড়ির দারোয়ানকে নাকি তারা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, কোনোক্রমে ছাড়া পেয়ে সে ছুটতে ছুটতে ভোরে এসে দুঃসংবাদ জানিয়েছে। এ বাড়ির বয়স্ক পুরুষরা সবাই গেছেন কাশীপুরে। কী হবে কে জানে! এদিকে তুতুলের সঙ্গে আজ বাড়ির কোনো একজনকে পাঠানো উচিত ছিল। কাল স্কুল থেকে ফিরে তুতুল তাঁকে একটা চিঠি দেখিয়েছিল, একটা ছেলে রাস্তায় তুতুলের হাতে ঐ চিঠি গুঁজে দিয়েছে। ভুল বানান, খারাপ। চিঠি। এ পাড়াটাও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুতুলের পরীক্ষা চলছে, আর দু’দিন মাত্র বাকি আছে। তাকে স্কুলে না পাঠাবারও উপায় নেই।
ভূষণের মা এসে বললো, কী বলছো, বউদি?
সুপ্রীতি বললেন, এইসব জামাকাপড় এখানে কে রেখেছে? তুমি?
ভূষণের মা কোনো জরুরী কাজ করছিল, এত সামান্য কারণে তাকে ডাকা হয়েছে বলে সে বেশ অবাক হয়ে বললো, ওগুনো তো কাঁচতে যাবে, ধোপা আসবে বলে আমি রেখিচি!
সুপ্রীতি বললেন, কাঁচতে যাবে, ভেতরের বারান্দায় রাখতে পারোনি? বসবার ঘরে নোংরা। কাপড় কেউ রাখে? বাইরের লোকজন যদি আসে?
ভূষণের মা বললো, বারান্দায় রাখলে আবার কার সঙ্গে মিশে যাবে, সব গুণে-গেঁথে রাখা আচে–
তার কথা মাঝপথে থামিয়ে সুপ্রীতি জোর দিয়ে বললেন, বাইরে নিয়ে যাও ওগুলো, আর কোনোদিন এখানে রাখবে না!
সুপ্রীতির বকুনিতে ঝাঁঝ নেই কিন্তু নিশ্চিত আদেশ আছে। ভূষণের মা অন্য তরফের ঝি হলেও সুপ্রীতির কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না। এ বাড়িতে ঝি-চাকরদের তুই-তুকারি করাই। প্রথা। একমাত্র সুপ্রীতিই তার ব্যতিক্রম।
ইদানীং এই বসবার ঘর ব্যবহারই হয় খুব কম। এই বাড়ির সমস্ত পুরনো সৌষ্ঠবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আদব-কায়দা বদলে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি, তবু সুপ্রীতি যথাসাধ্য সব বজায় রাখতে চান। কার্পেট বদলাতে না হয় খরচ লাগে, তা বলে ঝি-চাকররাও সহবৎ ভুলে যাবে?
তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন তিনতলায়। দোতলায় দুই নারী কণ্ঠের ঝগড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, সুপ্রীতি সেদিকে কান দিলেন না। পুরুষরা বাড়িতে না থাকলেই মেয়েদের সময় কাটাবার প্রধান খেলা, জিভের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। সুপ্রীতি প্রথম প্রথম অবাক হতেন। এখন আর গ্রাহ্য করেন না। অনেক সময় তাঁর উদ্দেশেও দূর থেকে শর বর্ষণ হয়। কিন্তু কেউ সামনা-সামনি কিছু না বললে উত্তর দেন না সুপ্রীতি, সেই জন্য তাঁর আড়ালের ডাক নাম হয়েছে দেমাকী।
কাশীপুরে এতক্ষণ কী ঘটছে কে জানে! তাঁর স্বামী অসিতবরণকে সেখানে পাঠাবার ইচ্ছে ছিল না সুপ্রীতির, কিন্তু খুড়শ্বশুর জোর করে নিয়ে গেলেন। ব্যাপার অতি গুরুতর। এই বনেদী যৌথ পরিবারটি এখন নানান ঋণভারে জর্জর। শরিকে শরিকে মামলা শুরু হয়ে গেছে। বসত বাড়িটির মেরামত- প্রসাধন হয়নি অনেকদিন। কাশীপুরের সেভেন ট্যাঙ্কস লেনের তাঁদের সম্পত্তিটা অনেকদিন এমনিই পড়ে ছিল। সেটা বিক্রি করে টাকাটা সকলে ভাগাভাগি করে নেবার প্রস্তাবে মতের মিল হয়েছিল। এখন যদি সেখানে রিফিউজি বসে যায়, তাহলে তো আর সেটা বিক্রি হবে না! এক পাঞ্জাবী, কার্ডবোর্ড ফ্যাক্টরির মালিক, ঐ জমি-পুকুরসমেত বাড়িটি কিনতে চেয়েছিল, এখন সে পিছিয়ে যাবে।
এক পুরুষ যদি আশাতিরিক্ত উপার্জন করে, তাহলে পরবর্তী দু’তিন পুরুষ তা ওড়ায়। পরিশ্রমের সম্পদ আলস্যে মিলিয়ে যায়। অসিতবরণের ঠাকুদার বাবা জানকীবল্লভ সরকার সাহেবদের বেনিয়ানগিরি করে কলকাতা শহরে বাড়ি-জমি কিনেছিলেন। ছোটখাটো পাতলা চেহারার মানুষ ছিলেন তিনি, সারা জীবন কৃচ্ছতা সাধন করে গেছেন, সামান্য সুতলি-দড়িটুকুও কখনো ফেলতেন না, পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে জমিয়ে রাখতেন। অর্থলোভ তাঁকে অর্থপিশাচ করে তুলেছিল। কেন এবং কার জন্য, কিসের জন্য যে তিনি বহু লোককে বঞ্চিত করে এই বিপুল সঞ্চয় রেখে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে তাঁর মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগেনি। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে সব সময় বোধহয় একটা বিপরীত শক্তি কাজ করে। শেষ জীবনে, জানকীবল্লভ সরকার যখন পক্ষাঘাতে পঙ্গু, তখন তাঁর নাকের ডগার ওপর দিয়েই তাঁর গুণধর পুত্র বাঈজী নাচ, পায়রা ওড়ানো, মোসাহেব পোষার প্রতিযোগিতা দিয়ে টাকা উড়িয়েছে। পিতার বিলাস ব্যসনে অনাসক্তি সুদে-আসলে উসুল করে নিয়েছে তাঁর ছেলেরা।
জানকীবল্লভ চা ও পাটের দালালির ফার্ম খুলে গিয়েছিলেন, এক পুরুষেই তা উঠে যায়। তারপর থেকে এই পরিবারটির প্রধান আয় সম্পত্তি বিক্রি করা। খাস কলকাতায় তিনটি বাড়ি, ঢাকুরিয়ার জমি, ব্যারাকপুরের জমি, রাঁচীর জমি, বৈঠকখানা বাজারের অংশ, সব একে একে বিক্রি হয়ে যেতে লাগলো। এ তো বড় আরামের পেশা, পরিশ্রম নেই, অফিস যাওয়া নেই। মাথা ঘামানো নেই। শুধু কয়েকটি দলিলে উঁকিলের নির্দেশ মতন সই করলেই টাকা আসে।
অসিতবরণের বাবার আমল পর্যন্ত এই রকমভাবেই চলে এসেছে, কোনো কিছুই আটকায়নি। সম্পত্তি বিক্রি করা ছাড়াও তখনও পর্যন্ত বেশ কিছু কোম্পানির কাগজের সুদ আসতো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সেই সব কিছু কিছু কম্পানি ফেল পড়ে। ছোট ছোট ব্যাংকগুলির মড়ক শুরু হয়ে যায়।
কাশীপুরের বাগানবাড়িটিই ছিল এ পরিবারের শেষ ভরসা। ঐ প্রমোদ ভবনটি ছিল অসিতবরণের জ্যাঠামশাই বরদাকান্তর অতি প্রিয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, উনবিংশ শতাব্দীর রাতিনীতি যে এখন আর চলে না তা তিনি মানতে চাইতেন না, পঞ্চ ম-কার নিয়ে মচ্ছব তিনি ৩খনো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গান্ধীজী যেদিন দিল্লিতে গুলি খেয়ে মারা গেলেন সেদিন সন্ধেবেলা সেই খবর পেয়ে বরদাকান্ত ঐ কাশীপুরের বাগানবাড়িতে একটি বিশাল পার্টি দিলেন। ঐ নেংটি পরা, রোগা টিং টিং-এ জাতির পিতাটিকে তিনি ঘোরতরভাবে অপছন্দ করতেন; গেঁধো, ঐ মা মুদির ছেলে ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন। অবশ্য কেন যে তাঁর এই বিরাগ তা বোঝা যেত না। সেদিনই মাঝরাতে মত্ত অবস্থায় দুটি বাজারে বারাঙ্গনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে হঠাৎ পুকুরে পড়ে তিনি মারা যান।
বরদাকান্তর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই সরকার পরিবারে পুরনো যুগের সমাপ্তি। তারপর আর হাতে খাঁটি ঘি-এর গন্ধও রইলো না, সবাই ডালডা জোটাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঐ কাশীপুরের বাগানবাড়ি আর কেউ ব্যবহার করেনি, অপয়া বিবেচনায় পরিত্যক্ত হয়েছিল। ঐদিকে জমির দাম কম বলে বিক্রির কথাও আগে মনে আসেনি। ইদানীং পূর্ববঙ্গীয় মধ্যবিত্তরা কলকাতার প্রান্তসীমাগুলিতে উইপোকার মতন ঢিবি গড়ে তুলছে। তাই জমির দামও তেজী হচ্ছে। পাঞ্জাবী কার্ডবোর্ড ফ্যাক্টরির মালিকটি নিজের থেকেই খোঁজ-খবর করে ঐ বাড়িটি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল মাস দু’এক আগে।
কিন্তু পূর্ববঙ্গীয় মধ্যবিত্তদের চেয়েও যে অনেক গুণ বেশি সংখ্যক নিঃস্ব উদ্বাস্তুরা আসছে, তারা যেখানে সেখানে তাঁবু গাড়ছে, পতিত জমি, ভুতুড়ে বাড়িগুলিতে তো বটেই, ধনীদের সাজানো-গোছানো প্রমোদ ভবনেও ঢুকে পড়ছে পঙ্গপালের মতন, সে সংবাদ প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে বের হয়, তবু কর্তাদের হুঁস হয়নি। ঐ বাড়িতে ভালো পাহারার ব্যবস্থা। করেননি। একটা মাত্র রোগা-পটকা ধূর্ত, ঠগ দারোয়ানের ওপর সব ছেড়ে রাখা ছিল। দারোয়ানটি মাঝে মাঝে কয়েক কাঁদি ডাব আর মৌসুমী আম-লিচু দিয়ে যেত। তাতেই খুশী ছিলেন সবাই।
সকালবেলা খবরটা শোনার পর সুপ্রীতি বুঝেছিলেন, ঝাঁপটাটা তাঁর ওপরেই পড়বে বেশি। দোতলার মহিলাদের বাক্যবাণ তাঁর প্রতি আরও বেশি করে বর্ষিত হবে। তিরিশ বছর আগে বিয়ে হলেও এখনো কেউ ভুলতে পারে নি যে, সুপ্রীতি বাঙাল বাড়ির মেয়ে। ঐ জবরদখলকারী, হাড়-হাভাতে, বদমাইশ রিফিউজি গুলো তো সুপ্রীতিরই জাত ভাই!
মালখানগরের সচ্ছল, গোষ্ঠী-অধিপতি ভবদেব মজুমদার তাঁর বড় মেয়ে সুপ্রীতির বিয়ে দিয়েছিলেন এক পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে। প্রায় অভূতপূর্ব ঘটনা বলা যেতে পারে। সেই সময় ব্রাহ্ম বা বৃহৎ ধনী বংশ ছাড়া, সাধারণ হিন্দু বাঙালীদের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্বিবাহ খুব একটা সহজ স্বাভাবিক ছিল না। বাঙাল-ঘটি ভেদাভেদ ছিল হাসিঠাট্টার চেয়েও অনেক গভীরে। প্রায় দ্বিজাতিগত বিভেদের মতন। দেশ বিভাগের পরই বরং পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুরা প্রাথমিক তিক্ততা কাটিয়ে ওঠবার পর বুঝতে পারলো, প্রতিবেশী মুসলমানদের সঙ্গে তাদের ব্যবহারিক অমিল ছিল যৎসামান্য, মিলই বেশি, প্রায় আত্মীয়ের মতন। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গীয়দের সঙ্গে তাদের মানসিক ব্যবধান অনেকখানি। দেশ বিভাগ হলো ধর্মের ভিত্তিতে, কিন্তু দেখা গেল ধর্ম কোনো বাধা নয়, আবার শুধু ধর্ম মানুষের মধ্যে মিলন ঘটাতেও পারে না।
অসিতবরণের বাবা উমাপতি সরকারের সঙ্গে ভবদেব মজুমদারের পরিচয় হয় শিলং পাহাড়ে। দু’জনেই সপরিবারে একই হোটেলে উঠেছিলেন। উমাপতি একদিন দেখলেন যে, ভবদেব একা লাউঞ্জে বসে দাবা খেলছেন। উমাপতিরও সাঙ্ঘাতিক দাবার নেশা, বিনা আলাপেই তিনি উল্টোদিকে বসে পড়লেন, শুরু হয়ে গেল খেলা, তারপর টানা চারদিন ধরে। সেই খেলা চললো, কেউ আর মাতই হয় না, খেলা শেষ হবে কী করে? দাবার খেলার যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে দু’জনেই দু’জনকে বেশ পছন্দ করে ফেললেন। অন্তরঙ্গতা এত দূর। গড়ালো যে, ভবদেব প্রায় জোর করে উমাপতি সরকারের পরিবারের সকলকে নিয়ে এলেন। মালখানগরে। উমাপতির সেই প্রথম পূর্ববঙ্গে আগমন। পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে তাঁর ভুল ধারণা ছিল, ভয়ের ভাব ছিল, তিনি জানতেন যে, ওসব হলো বিশ্রী জলকাদা ভরা জায়গা, আঁশটে গন্ধ, অধিবাসীদের মুখের ভাষা বর্ববসুলভ। ওখানকার লোকেরা কলকাতায় এসে সভ্য হয়। তিনি নিজে ওখানে গিয়ে দেখলেন দিব্যি পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি, চতুর্দিকে অজস্র ফল-পাকুড়, মানুষগুলি অতিথিপরায়ণ এবং নিজেদের মধ্যে এরা দুবোধ্য ভাষায় কথা বললেও বাইরের লোকের সঙ্গে মোটামুটি সাধারণ বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে জানে।
বিয়ের প্রস্তাবটা উমাপতিই দিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁদের পরিবার যেমন পড়তির দিকে, ভবদেবের অবস্থা তেমনই এখন বর্ধিষ্ণু। এ বাড়িতে লেখাপড়ার চল আছে, এমন কি স্ত্রীলোকেরা পর্যন্ত বই পড়ে। তাঁর ছেলে অসিতবরণের বয়েস তখন উনিশ, গৌরবর্ণ, লম্বা-চওড়া যুবক, পারিবারিক রীতি অনুযায়ী সদ্য বখামিতে দীক্ষা নিয়েছে, এক কাকার প্ররোচনায় ইতিমধ্যেই একটি সোনার হাতঘড়ি গোপনে বিক্রি করেছে। উমাপতির নিজের চরিত্রও এমন কিছু গঙ্গাজলে ধোয়া পূত পবিত্র নয়, বউবাজারে তাঁর একটি রক্ষিতা আছে সবাই জানে। তবু তিনি অনুভব করেছিলেন, নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে তাঁর ছেলেটিকে অন্য পথে চালনা করতে হবে। তাঁর এই একমাত্র বংশধরকে সংশোধন করার উপায় হলো বরানগরের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা।
তিনি অসিতবরণকে ভর্তি করে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ভবদেবকে বললেন, ভাই, তোমার বড় কন্যাটিকে আমায় দাও!
লাখ কথার কমে বিয়ে হয় না, এক্ষেত্রেও আলাপ-আলোচনা ও চিঠিপত্র চলেছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। ইতিমধ্যে অসিতবরণ ঢাকার হস্টেল থেকে মাঝে মাঝেই চলে আসে মালখানগরে। যতই পড়ন্ত হোক তবু বনেদিবাড়ির ছেলেদের সাজ-পোশাকের একটা বৈশিষ্ট্য থাকে, কথাবার্তা ও ব্যবহারে অন্য ধরনের মার্জিত ভাব থাকে, অসিতবরণেরও সেসব ছিল, তাছাড়া সে ছিল স্বভাব-লাজুক। এই রূপবান, নম্র যুবকটিকে সুহাসিনীর খুব পছন্দ হয়ে গেল। ভবদেব অভিজ্ঞ, বিষয়ী মানুষ, তিনি কলকাতায় এসে বরানগরের সরকার বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন, তখনও ও বাড়ির বাইরের ঠাট অনেকটা বজায় থাকলেও অন্তঃসারশূন্যতা ভবদেব ঠিকই টের পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই তাঁর আপত্তি ছিল, কিন্তু সুহাসিনীর উৎসাহে সেই আপত্তি ভেসে গেল।
সুহাসিনী আর ভবদেব দু’জনেই চান সবাইকে কাছাকাছি রাখতে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে পুরের বাড়ি পাঠানোতে তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন না, জাত কুল মিলিয়ে সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াটাই যথেষ্ট। অসিতবরণও প্রায় ঘর-জামাই হয়েই রইলেন বছর পাঁচেক। দু’বারের চেষ্টায় বি-এ পরীক্ষাতেও পাস করলেন ঢাকা থেকে। তারপর উমাপতির অকস্মাৎ মৃত্যুতে তাঁকে বরানগরে চলে আসতে হলো সম্পত্তির ভাগ নেবার জন্য। কিন্তু পুরনো সম্পত্তির ভাগ নেওয়াও সহজ কথা নয়, অধিকার রক্ষার জন্য সর্বক্ষণ জাঁকিয়ে বসে থাকতে হয়। তাই বসত বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকার আর উপায় রইলো না।
স্বামীর সংসারে এসে সুপ্রীতি প্রথম দিকে পদে পদে অবাক হয়েছেন। বিরাট যৌথ পরিবার, অসিতবরণের কাকা-জ্যাঠা-পিসিরা সবাই একই বাড়ির বিভিন্ন অংশে থাকেন, কিন্তু সবাই যেন সবার শত্রু। সামনাসামনি কলহ নেই কিন্তু আড়ালে প্রত্যেকে অপরের নামে নিন্দে করে। এবং সে নিন্দের মধ্যে ফুটে ওঠে নির্দয়তা। সুপ্রীতি এ রকম কখনো দেখেননি। তিনি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে স্নেহ পেতেই অভ্যস্ত ছিলেন।
সুপ্রীতি আরও দেখলেন, এ বাড়িতে পড়াশুনোয় কোনো গুরুত্বও নেই। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, তাদের জন্য মাস্টারও রাখা হয়, কিন্তু তারা কী শিখছে, পাস করছে না ফেল করছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পট পট করে খারাপ ভাষা ব্যবহার করে, কেউ নিষেধ করে না তাদের। বড় ননদের ছেলে, যার বয়েস মাত্র এগারো, সে বাড়ির একটি ঝি-কে মাগী বলে সম্বোধন করছে অথচ তার মা নির্বিকার, এই দেখে-শুনে সুপ্রীতি শিউরে উঠেছিলেন!
বিয়ের পরই সুপ্রীতি একদিন তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার নামটা কে রেখেছিল?
অসিতবরণ বলেছিলেন, আমার দাদু। কেন, আমার নামটা খারাপ?
সুপ্রীতি বলেছিলেন, তোমার চেহারার সঙ্গে তো তোমার নামের কোনো মিলই নেই। অসিত মানে তো কালো। তুমি কি ছোটবেলায় কালো ছিলে?
অসিতবরণের গায়ের রং কাশ্মীরীদের মতন গৌর। কোনো কালো রঙের বালক পরবর্তী জীবনে এ রকম টকটকে ফর্সা হতে পারে না।
অসিতবরণ দারুণ অবাক হয়ে বলেছিলেন, অসিত মানে কালো? কে বললে তোমাকে? আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে,অসিতবরণ নিজে তো তার নামের অর্থ জানতোই না, এমনকি তাঁর বাবা কাকা-জ্যাঠাদের কারুরই কখনো মনে আসেনি যে, এই ছেলের ভুল অর্থে নাম রাখা হয়েছে।
এখানে এসে সুপ্রীতি বিশেষ যত্ন করে কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর কথার বাঙাল ভাষার টান মুছে ফেলেছিলেন। অবশ্য, গেসলুম, বলেছিলিস, করগে যা, মরগে যা এই ধরনের ভাষা শিখতে তাঁর দীর্ঘকাল লেগে গেছে। সামনে কুচি দিয়ে শাড়ী পরতে তিনি আগেই শিখে এসেছিলেন, চিনি দিয়ে রান্না ডাল আর ঝালবিহীন মাছের ঝোল খেতে তিনি অতি দ্রুত রপ্ত হয়ে। গেলেন, তবু বাঙাল বাড়ির মেয়ে, এই নাম তাঁর ঘোচেনি।
সুপ্রীতির প্রথম সন্তান হয়েছে বিয়ের দীর্ঘকাল পরে। এক সময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, তাঁর ছেলে-মেয়ে হবে না, তাঁর ভাসুর অসিতবরণের আবার একটি বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সেই উপলক্ষে কিছুদিন মন কষাকষিতে সুপ্রীতি চলে গিয়েছিলেন বাবা-মায়ের কাছে। টানা আট মাস মালখানগরে থাকার সময় সেখানেই তুতুলের জন্ম হলো। অসিতবরণ। গিয়েছিলেন স্ত্রী কন্যাকে ফিরিয়ে আনতে।
সুপ্রীতি যে বাঁজা নন তা প্রমাণিত হলো বটে কিন্তু তুতুলকে এ বাড়িতে কেউ সানন্দে বরণ করে নেয়নি। অনেকেই প্রায় প্রকাশ্যে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, আবার মেয়ে! এ বাড়িতে মেয়েদের বড় অবহেলা। মেয়েরাও মেয়েদের অপছন্দ করে, বরং তারাই বেশি অপছন্দ করে। অসিতবরণের কাকা-জ্যাঠাদেরও কোনো পুত্র সন্তান হয়নি, সকলেরই দু’তিনটি করে মেয়ে।। অথচ তাঁর পিসিদের ও এক বিধবা বোনের সব মিলিয়ে সাতটি ছেলে। সরকার পরিবারের। এখন বংশ রক্ষা করাই দায়।
সুপ্রীতির দ্বিতীয় সন্তানটি সাত দিনের বেশি বাঁচেনি। সেও মেয়ে ছিল, তাই তার অকালমৃত্যুতে কেউ শোক করেনি। রাগে-দুঃখে সেই সময়েই সুপ্রীতি চেয়েছিলেন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।
সুপ্রীতি অনেকবার অসিতবরণকে বুঝিয়েছেন, এ বাড়িতে তোমার অংশ বিক্রি করে দিয়ে চলো আমরা কোনো ভাড়া বাড়িতে থাকি!
অসিতবরণ ততদিনে চাকরি নিয়েছেন, অনেকটা স্বাবলম্বী। তাঁর কর্মস্থল বেশ দূরে, বরানগর ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে থাকতে তিনি খুব একটা অরাজি নন, কিন্তু বাড়ি নিয়ে মামলাই যে মিটতে চায় না, তার আগে তাঁর অংশ বিক্রি হবে কী করে? একবার ছেড়ে চলে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না।
সুপ্রীতি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর দৃষ্টি শূন্য। কাশীপুরের বাগানবাড়ি উদ্ধার করতে গিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। অসিতবরণের সেজো কাকা ঐসব ব্যাপারে খুব দক্ষ। কিন্তু অসিতবরণ যদি জড়িয়ে পড়েন, তিনি সামলাতে পারবেন না। কয়েক মাস হলো অসিতবরণ হঠাৎ বদলে গেছেন, তাঁর কথা ও ব্যবহার অসংলগ্ন। এই সময় প্রতাপ থাকলে তার সাহায্য নেওয়া যেত, কিন্তু প্রতাপ তো চলে গেছে দেওঘরে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সুপ্রীতির যাওয়া হলো না…..
জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে স্বামীর চেয়ে মেয়ের জন্যই সুপ্রীতি বেশি চিন্তা করতে লাগলেন। তুতুল দেখতেই বড় হয়েছে, কিন্তু তার মনটা এখনো অতি সরল। এ বাড়ির অন্য ছেলে-মেয়েদের সংস্পর্শ থেকে তুতুলকে তিনি যত দূর সম্ভব আড়াল করে রেখেছেন। কাল তুতুল বাড়ি ফিরে চিঠিখানা সুপ্রীতিকে দিয়ে বলেছিল, মা, আমাকে এইসব কথা লিখেছে। কেন? আজ দারোয়ানকে বলে দেওয়া হয়েছে, সর্বক্ষণ যেন স্কুলের সামনে বসে থাকে। দারোয়ানটা আবার যা বোকা, তার ওপর আফিংখোর।
বিরলে ছাড়া সুপ্রীতি কখনো কাঁদেন না। আজ তাঁর চোখে জল। সম্ভব হলে সুপ্রীতি নিজেই আজ তুতুলের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু এ বাড়ির বউদের তা করবার উপায় নেই। হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে সুপ্রীতি বললেন, ঠাকুর, মেয়েটা যেন ভালোয় ভালোয় আজ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসে। ঠাকুর, রক্ষা করো; আমার যে এখন দেখার আর কেউ নেই!