1 of 3

১. বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর

বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর উঠছে ওই। সোঁদা স্যাঁতা মেঘলা সকালের ম্যাদাটে আলোয় ও যেন বাড়ি নয়, বাড়ির ভূত। চারদিকে বড় বড় দাঁতের মতো ইটের সারি যেন খিঁচিয়ে আছে। গায়ে ভারা বাঁধা। দেড় মানুষ সমান দেয়াল খাড়া হতে বছর ঘুরে গেল। এখন দেয়ালে শ্যাওলা ধরেছে, ভারার বাঁশ পচতে চলল। গেল মঙ্গলবার গো-গাড়িতে সিমেন্টের বস্তা এসেছে অনেকগুলো। খাটের নিচে সেগুলো ডাঁই হয়ে আছে। ছাদ কি আর ঢালাই হবে? বিষ্ণুপদ যে গতকাল রাতে কালঘড়ি দেখেছে। ও একবার দেখলে আর কথা নেই। দরিয়া পেরোনোর সময় ঘনিয়ে এল।

কালঘড়ির কথা এরা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই বলেওনি কাউকে বিষ্ণুপদ। কথাটা বুকে নিয়ে, কৌটোর মুখ আঁট করে বন্ধ রেখে বসে আছে। আর কৌটোর মধ্যে প্রাণভোমরা চক্কর মারছে বোঁ-বোঁ করতে করতে। বেরোনোর পথ খুঁজছে। একটা রন্ধ্র পেলেই পগার পার।

আজ এই মেঘলা সকালে, হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটায় দাওয়ায় বসে বাদামতলার দিকে কাহিল চোখে চেয়ে আছে বিষ্ণুপদ। পারলি না তো বাপ, পেরে তো উঠলি না। তোর ঘর রোজ আমাকে মুখ ভ্যাংচায়, থাকবি বুড়ো? আয়, থাক এসে।

রামজীবনের দোষ কি? জোগাড়-যন্তর কি চাট্টিখানি কথা! এটা জোটে তো সেটা জোটে না, দুশো এল তো চারশো বেরিয়ে গেল। নাকের জলে চোখের জলে হয়ে রামজীবন তবু বাপ আর মাকে পাকা ঘরে রাখবে বলে জান বড় কম চুঁইয়ে দেয়নি। তা তার ভাগ্যটাও এমনি। এবার সব জোগাড় হল তো অলক্ষুণে বর্ষা কেমন চেপে ধরল দুনিয়াটাকে। ডাইনীর এলো চুলের মতো চেপে থাকে মেঘ। সারাদিন। একদিন একটু রোদ ওঠে তো হঠাৎ ফের ভূষোকালি মাখানো মেঘ থমথম করে ওঠে দিগন্তে। তারপর হাওয়া দেয়। রণপায়ে চলে আসে বৃষ্টি। টিনের চালে দিনরাত নাচুনে শব্দ। ঘরময় বাটি, কৌটো, ছেঁড়া বস্তা পাতা। চালের পুরনো টিন চালুনির মতো হয়ে এল। ক’টা ফুটোর জল সামাল দেওয়া যায় বাপ! নিত্যিনতুন ফুটো দিয়ে জল পড়ছে ঘরে। পাকাঘর এই হল বলে, আশায় আশায় এবার আর ঘরের টিন মেরামত হয়নি। হেমেন মিস্ত্রি কয়েক জায়গায় পুটিং ঠেসে দিয়েছিল শুধু। বর্ষার তোড়ে সে সব পুটিং কবে ভেসে গেছে।

বিষ্ণুপদ যে জীবনে ঘড়ি মেলা দেখেছে তা নয়। বিষ্ণুপদর ঘড়িই নেই। কাল শেষরাতে সে ঘড়িটা দেখতে পেল। কালো, গোলপানা, মস্ত বড়। তাতে দুখানা সাদা কাঁটা। একটা বড়, আর একটা ছোটো। কাঁটা দুখানা বাঁই বাঁই করে ঘুরে যাচ্ছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে গতিটা কমে এল। খুব কমে এল। তারপর একেবারে থেমে আসতে লাগল। বড় কাঁটা এক পাক মারলে ছোটো কাঁটা এক ঘর এগোয়, এটাই নিয়ম। বিষ্ণুপদ দেখল, বারোটা ঘরের মধ্যে একটা মাত্র বাকি। বড় কাঁটা খুব ধীরে ধীরে পাক খাচ্ছে আর ছোটো কাঁটাটা শেষ ঘরের দিকে এগোচ্ছে।

কথাটা একমাত্র যাকে বলা যায় সে হল, রামজীবনের মা। নয়নতারা রান্নাঘরে।

বুঝলে একমাত্র নয়নতারাই বুঝবে। বিষ্ণুপদর সব কথা নয়নতারাই একমাত্র বুঝতে পারে। পৌনে একশ বছর বেঁচে আছে বিষ্ণুপদ, নয়নতারা তার সঙ্গে লেগে আছে নাহোক পঞ্চাশ বছর। পঞ্চাশ বছর ধরেই কাছে। বিষ্ণুপদ নিশ্চয়ই সারাদিনে সব কথা ঠিকমতো বলে না, ঠিক কথাও বলে না। কিন্তু নয়নতারা তার সব কথাই নেড়েচেড়ে ভেবে দেখে। কালঘড়ির কথাটাও নয়নতারা ফেলবে না।

লম্বা দাওয়ার উত্তরপ্রান্তে রান্নাঘর। ভেজা ঘুঁটে আর স্যাঁতানো গুল দিয়ে আঁচ তুলতে আজ সকালে দমসম হয়েছে সবাই। খুব ধোঁয়া হয়েছিল। এখন বোধহয় আঁচ উঠেছে। রান্নাঘর থেকে দুটো গলার আওয়াজও আসছে। একটা তর্ক বেধে উঠছে। ঝগড়ায় গড়াবে। ও দুজন হচ্ছে সেজো আর মেজো বউ। দুজনে প্রায়ই লেগে যায়। হাঁড়ি আলাদা হল বলে। এইসব ঝগড়া কাজিয়ায় নয়নতারা কখনও থাকে না। মাঝখানে পড়ে মিটমাটও করতে যায় না। আসলে নয়নতারা বড্ড ভীতু মানুষ। সবসময়ে সিঁটিয়ে আছে ভয়ে। মেজো বামাচরণের বউ শ্যামলীর জিভের যেমন ধার, গলার তেমনি জোর। সেজো রামজীবনের বউ রাঙা যে খুব ভালমানুষ তা নয়। তবে কমজোরি। হাঁপানী আছে। খুব ভোগে।

নয়নতারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা বড় সোলা কচু। বর্ষায় কচুঘেঁচুই সম্বল।

নয়নতারা কাছে এসে একবার বিষ্ণুপদর দিকে তাকাল। ভারী নিরীহ চোখ নয়নতারার। গরুর চোখ। বিষ্ণুপদ জানে, সে নিজেও তেমন বুদ্ধি রাখে না। তার বউ নয়নতারাও না। ভগবান তাদের একই ছাঁচে তৈরি করেছেন।

নয়নতারার কথা কম। কথা কওয়ার ধাতটাই নেই, কায়দাও জানে না। শুধু বিষ্ণুপদর সঙ্গেই যা একটু কয়। মৃদুস্বরে বলল, বৃষ্টি হচ্ছে। গায়ে ছাঁট লাগছে না তো! ঘরে গিয়ে বসলেই তো হয়।

ঘরখানা বড় আঁধার লাগে। একটু আলোয় বসে আছি।

তাহলে থাকো। একখানা চাদর এনে দিই, জড়িয়ে বোসো।

লাগবে না। এই বেশ আছি। কফ-কাশির ধাত তো নয়।

শরীর নিয়ে বড়াই করতে নেই। হতে কতক্ষণ। যা বাদলা হচ্ছে।

বিষ্ণুপদ কথাটা কইবার আগে ভণিতা করতে গিয়ে একটু কেশে নিয়ে বলে, তোমাকে একখানা কথা কইবার জন্য মন করছে। কবো?

বলো।

শেষ রাতে আমি কালঘড়ি দেখলাম। ব্যাপার সুবিধের নয়।

কালঘড়ি দেখলে?

তোমার মনে নাই, আমার ঠাকুর্দা দেখেছিল! সেই যে মাঘের শেষে যেবার ঠাকুর্দা চলে গেল।

নয়নতারার মুখখানা কেমন আরও বোকাটে মার্কা হয়ে গেল। বলল, মনে আছে।

ঠাকুর্দা ঘুম থেকে উঠেই সে কী হাঁকডাক। ওরে তোরা সব তাড়াতাড়ি রান্না-খাওয়া সেরে নে, আজ আর কেউ বেরোবি না ঘর থেকে, সবাই আমার কাছাকাছি থাক, আর গঙ্গাজল তুলসী চন্দনপাটা সব রাখ হাতের কাছে। সব মনে পড়ে?

পড়ে।

সেদিন শেষ রাতে ঠাকুর্দাও কালঘড়ি দেখেছিল। আমি মস্করা করে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ঘড়ি ও ঠাকুর্দা? তা ঠাকুর্দা যা বলেছিল ঠিক হুবহু সেইরকম দেখলাম কাল রাতে। কালো একখানা চক্কর। তাতে দুটো সাদা কাঁটা কঙ্কালের হাতের মতো ঘুরে যাচ্ছে।

নয়নতারার চোখ দুখানা জুলজুল করছে। বেচারার এ দুনিয়াতে সব থেকেও কেউ নেই, একমাত্র বিষ্ণুপদ ছাড়া। এসব কথায় তার বুক উথাল-পাথাল হওয়ার কথাই। নয়নতারা বলে, সেই দিন তো আর ঠাকুর্দা মরেনি।

না। সাতদিনের মাথায় মরল। কি হবে কে জানে! আমিও দেখলাম।

কথাটা বলা ঠিক হল কিনা কে জানে! ও মানুষটাকে একটা উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল। নয়নতারা তো বিশেষ সুখে থাকেনি একটা জীবন।

বিষ্ণুপদ ফের বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ময়লা আলোয় রামজীবনের ঘরটার দিকে চেয়ে রইল।

রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া ঘর দাঁত বের করে খুব হাসছে। বাঁশের খাঁচায় আটকে আছে কতকাল।

ধপ করে উবু হয়ে বসে পড়েছে নয়নতারা। চোখে আঁচল। মেয়েদের কত যে কাঁদতে হয়। সংসারে রোজই এমন কিছু ঘটনা আছে যাতে মেয়েদের কাঁদতে হয়। নয়নতারাকে অনেক কাঁদতে দেখেছে বিষ্ণুপদ।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, রামজীবনের ঘরখানা শেষ হলে বেশ দেখতে হবে কিন্তু।

নয়নতারা কিছু বলল না। ঘুনঘুন করে কাঁদছে। আকাশ আরও একটু কালো হয়ে গেল নাকি? আলোটা যেন মরে এল। বৃষ্টির সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া আসছে। দমকে দমকে।

নয়নতারা ভেজা গলায় বলে, ওঠো, ঘরে যাও।

ঘরে যেতে ইচ্ছে নেই বিষ্ণুপদর। দাওয়ায় বসে এইরকম চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে আজ। জলেডোবা উঠোনের বাঁ ধারে করবী ফুলের গাছের তলা দিয়ে ওরা তাকে নেবে। তারপর আর ফিরে আসা নেই। আর ঘরবাড়ি নেই, সংসার নেই, নয়নতারা নেই। কেমন হবে তখন?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, বুঝলাম না!

কী বুঝলে না গো?

কিছু বোঝা যায় না। অজান প্রান্তর পড়ে আছে সব। কত কি বোঝা গেল না। এই বলে নয়নতারার দিকে মায়াভরে তাকায় বিষ্ণুপদ। পঞ্চাশ বছরের বন্ধু। নয়নতারাও কি কিছু বোঝে! তারা দুটো বোকা মানুষ। কত কি ঘটে যায় চারদিকে, তাদের কাছে সব আবছা আবছা, ভয়-ভয়, কেমন-কেমন। নয়নতারাকে খুব ভাল কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করে বিষ্ণুপদর। গাছের মতো ছায়া দিল এতকাল, বাসা বাঁধতে দিল, ছানাপোনা হল। এবার উড়ে যেতে দেয় কি করে? বড় মায়া যে!

তবে কালঘড়ির কথাটা এই বোকা মেয়েটাই বুঝবে। আর কেউ নয়।

মরার সময়টা চতুর্দশী পড়বে কি? ও সময়টা ভারী খারাপ। আজ কৃষ্ণপক্ষ সপ্তমী। বিষ্ণুপদর ঠাকুর্দা কালঘড়ি দেখার ঠিক সাতদিনের মাথায় গিয়েছিল। যদি সেই হিসেবে বিষ্ণুপদও মরে তা হলে চতুর্দশীই পায় সে।

চকবেড়ের হাট থেকে একখানা পকেট-পঞ্জিকা এনে দিয়েছিল রামজীবন। নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, পঞ্জিকাখানা দাও তো এনে।

কী দেখবে?

চতুর্দশীটা পাবো নাকি?

পঞ্জিকা দেখার দরকার নেই। ঘরে চলো।

আর ঘর। বলে বিষ্ণুপদ একটু হাসে। পুবের ভিটে থেকে কেতরে একটা ঢোঁড়া উঠোনের জলে নামল। গেছে শালার ঘরদোর ভেসে। বেরিয়ে পড়েছে হারা-উদ্দেশে। এইসময়ে ব্যাটারা বড্ড ঘরদোরে সেঁধোয় এসে। ঢোঁড়াই বেশী, তবে চক্করওলারাও আছেন।

দুপুর হয়ে এল। নাইতে যাও।

বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বলে, দুপুর কোথা? এই তত দশটা বাজল একটু আগে। বেলা এখনও ঢের আছে।

নয়নতারা বিনাবাক্যে ঘর থেকে পঞ্জিকাখানা এনে দিয়ে বলে, ওই দিনে আমিও যাবো।

বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বোকা মুখখানার দিকে চেয়ে বলে, কোথায় যাবে বলছ?

আমাকে একা ফেলে যাবে নাকি? এখানে কে আছে আমার?

বিষ্ণুপদ পঞ্জিকা ওল্টাল না। ভাববার মতো কথা। কারও যদি কেউ নেই তবে সংসারটা কি জন্যে? এতগুলো সন্তান, তাদের ছানাপোনা, এত থেকেও কেউ নেই নয়নতারার, সে ছাড়া?

বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আগুরি কিছু বলা ভাল নয়। যা হওয়ার যখন হওয়ার হবে। দুদিন এদিক আর ওদিক। এ তো ইচ্ছামৃত্যু নয়।

নয়নতারা কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, স্বপন দেখনি তো?

তাই। তবে স্পষ্ট দেখলাম।

কেমন দেখতে?

কি? কালঘড়ির কথা বলছ?

হ্যাঁ, সেই অলক্ষুণেটা দেখতে কেমন?

সে খুব বড়। যেন আকাশটা জুড়ে দেখা দিল। বুকটা কেমন মোচড় মেরে খাঁ খাঁ করে উঠল। আঁধার-করা বিশাল একটা চাকা। দুটো সাদা লম্বা সরু হাত ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।

ঠাকুর্দা তাই দেখেছিলেন?

অবিকল।

তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে একটু ঘুমোও। মাথাটা পরিষ্কার হবে, ওসব মনের ভূত নেমে যাবে।

মাথা পরিষ্কারই আছে।

রান্নাঘরে দুটো গলা চুপ মেরে গেছে। দিনটাই এমন স্যাঁতানো যে, মেজাজও সব ঠাণ্ডা মেরে যায়। গরম থাকতে চায় না কিছু।

ছানি কাটানো গেল না বলে বিষ্ণুপদর চোখ কিছু আবছা। পুলিন হোমিওপ্যাথির ওষুধ দিয়ে ছানিটা আটকে রেখেছে এক জায়গায়। নইলে এতদিনে চোখ একেবারেই অন্ধকার হয়ে যেত।

রামজীবন কাটাবে বলে ঠিক করেছিল। যা খরচ হত তাতে ঘরের খানিকটা ইট আর সিমেন্ট হয়ে যায়। বিষ্ণুপদ কাটাতে চায়নি। একা রামজীবন আর কত করবে?

চোখে এখনও অনেকটাই দেখতে পায় বিষ্ণুপদ। এই মেঘলা দিনের মরা আলোতেও কত কি দেখতে পায়। রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া বাড়ি, নয়নতারার চোখের জল। পঞ্জিকাটা আর খুলল না বিষ্ণুপদ। চতুর্দশী পড়লেই বা কী করার আছে? ভেবে লাভ কি?

নয়নতারা ফের তাড়া দিল, ওঠো। বসে বসে ভাবতে থাকলে তোমার আরও শরীর খারাপ করবে। ওসব নিয়ে অত ভাবতে নেই।

বিষ্ণুপদ উঠল। পাকা ঘরটার দিকে আর একবার চাইল বিষ্ণুপদ। রামজীবন পেরে উঠল না।

কেউ কেউ পেরে ওঠে না। আবার কেউ কেউ পেরে ওঠে। যেমন কৃষ্ণজীবন। সাততলার ওপর আরামে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকে। বর্ষা-বাদলা হোক, ঝড়বাতাস হোক, খরা বান হোক, পরোয়া নেই।

মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, রামজীবন বুঝি বড় ভাইয়ের সঙ্গে রেষারেষি করেই তুলতে চেয়েছিল পাকা ঘরখানা। কিন্তু তাই কি পারে? কৃষ্ণজীবনকে ধরতে পারা কি রামজীবনের পক্ষে সম্ভব! সে যে বহুদূর এগিয়ে রয়েছে। রামজীবন তার নাগাল তো পাবেই না, বরং হেঁদিয়ে মরবে। তবু চেষ্টা তো করেছিল! বুকটা সেই কারণে একটু ভরে থাকে। মাতাল হোক কি আর যাই হোক, সারা দিনমানের কোনও না কোনও সময়ে বাপ-মায়ের কথা ভাবে তো।

আজ একটু সাবান দিয়ে চান করব, দেবে?

সাবান! আবার সাবান কেন! সাবান মাখলে বেশী চান হয়ে যাবে। যা বাদলা, বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে বিপদ।

রামজীবন একখানা গন্ধ সাবান এনে দিয়েছিল না! আছে?

সে তো কবেকার কথা। আছে। মাখে কে বলো? আমাদের বাংলা সাবানেই কাজ চলে যায়।

দাও, মাখি।

সাবানটা বর্ষা-বাদলায় বের করলে খরচ হবে খুব। জলে ক্ষয়ে যাবে।

আজ অত হিসেব কোরো না। দাও।

দিচ্ছি। কুয়োতলায় গিয়ে বোসো। বাক্সের তলায় রেখেছি। বের করতে হবে।

বিষ্ণুপদর বড় জানতে ইচ্ছে করে, সাবান জিনিসটা কী দিয়ে তৈরি হয়।

কত কি জানা হল না দুনিয়াটার। সব আবছা রয়ে গেল।

এই বর্ষায় কুয়ো একেবারে টৈটম্বুর। বালতিতে দড়ি না বাঁধলেও চলে। তবে কুয়োর চাকগুলো অনেক পুরনো। জোড় আলগা হয়ে কাদামাটি ঢুকে জল ঘোলা করে দেয়। চোত-বোশেখে বড় কষ্ট গেছে। কোন্‌ পাতালে নামাতে হত বালতি। কাদাগোলা জল উঠত, আর তাতে বিজবিজ করত পোকা।

বৃষ্টিতে কুয়োর ধারে বসে আনমনে চেয়েছিল বিষ্ণুপদ। তোড় কমে ভারী মিঠে ঝিরঝিরে ঝর্ণাকলের মতো জল পড়ছে এখন। একবার কৃষ্ণজীবন নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে। সাততলায় বাঁধানো ঘরদোরে যেন আলো পিছলে যাচ্ছে। সেই বাড়ির বাথরুমে ঝার্ণা কলের নিচে বসে চান করেছিল বিষ্ণুপদ। তখন মনে হয়েছিল যেন বৃষ্টির মধ্যে বসে আছে।

মানুষ কত কল বানিয়েছে। আরও বানাচ্ছে। কলের যেন আর শেষ নেই।

উঠোনে সাইকেলের ঘণ্টি। একটা নয়, তিন-চারটে সাইকেল। একটা হেঁড়ে গলা জিজ্ঞেস করল, রামদা নেই বাড়িতে?

রামজীবনের বউ ক্ষীণ গলায় বলে, না। সকালে বেরিয়েছে।

গেল কোথায়?

বলে যায়নি।

এলে বলে দিও বটতলায় যেতে। জরুরী কাজ আছে।

আচ্ছা।

কথাগুলো মন দিয়ে শুনল বিষ্ণুপদ। এরা সব কারা মাঝে মাঝেই রামজীবনের কাছে আসে তা জানে না বিষ্ণুপদ। দেখে বড় ভাল লোক বলে মনে হয় না। চেহারাগুলোই কেমন যেন রোখাচোখা। এই বৃষ্টিতেও কারও মাথায় ছাতা নেই। উঠোনে সাইকেল এসে থামে, সাইকেলে বসে থেকেই একটা হাঁক দিয়ে চলে যায়। কখনও নামে না, বসে না, বাড়ির কারও সঙ্গে কথাবার্তা কয় না। মনে হয় খুব কাজের লোক সব। খুব তাড়া আছে।

সাইকেল ঘুরিয়ে জলের মধ্যেই চলে গেল ছোঁড়াগুলো। কুয়োপাড় থেকে গাছপালার ভিতর দিয়ে, বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ছানি-পড়া চোখে যতদূর দেখা গেল, চারজন।

এই দুনিয়াটা নিয়ে আর ভাববার কিছু নেই বিষ্ণুপদর। সে কালঘড়ি দেখেছে। সময় ফুরিয়ে এল। এখন চারদিক থেকে নিজেকে কুড়িয়ে তুলে এনে এক জায়গায় জড়ো করা ভাল। কে কি করছে, কার কোন্‌ মতলব, কে উচ্ছন্নে গেল এসব নিয়ে আর মাথা ঘামানো ভাল নয়।

রোজ বড় আশায় আশায় রামজীবনের ঘরখানার দিকে চেয়ে থেকেছে এতদিন। কৃষ্ণজীবনের ঝা-চকচকে ঘরদোরের মতো না হলেও পাকাঘর তো। এই গাঁ-গঞ্জে একখানা পাকাঘরে থাকারও একটা আরাম আছে। কিন্তু আর আশা নেই। ঘরখানা থেকে মনটাকে সরাতে হবে এইবার।

এই যে তোমার সাবান। কিন্তু বাক্স নেই, মোড়কের কাগজখানা ফেলো না। ওতে মুড়ে রাখা যাবে।

সাবানখানা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে বিষ্ণুপদ। কি দিয়ে যে কি বানিয়ে তোলে মানুষ। সাবানখান হাতে নিয়ে ভারী আহ্লাদ হল বিষ্ণুপদর। খুব হাসল সে। খুব হাসল।

সাবানের মজাই হচ্ছে তার ফেনায়। বগবগ করে ফেনা উথলে উঠবে তবে না সাবান। কিন্তু ফেনা তুলবে কি, গায়ে ঘষতে না ঘষতেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে সব। খামোখা ক্ষয়ে যাচ্ছে। নয়নতারা বুক-বুক করে আগলে রেখেছিল। থাক, মেখে কাজ নেই।

সাবানখানা কাগজে সাবধানে মুড়ে দাওয়ায় রেখে বিষ্ণুপদ হেঁকে বলল, তোমার সাবানখানা নিয়ে যাও।

নয়নতারা দৌড়ে এসে চাপা গলায় ধমক দেয়, সাবানের কথা চেঁচিয়ে বলতে আছে? বউদের কানে গেলে পাঁচটা কথা উঠে পড়বে। কে দিল, কোত্থেকে এল। রামজীবন চুপটি করে এনে দিয়েছিল।

বিষ্ণুপদ অপ্রস্তুত হয়ে বলে, তাও বটে। যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তুলে রাখো। জল ঢালতে ঢালতে আর একখানা সাইকেলের আওয়াজ পায় বিষ্ণুপদ। আওয়াজটা চেনা। পটলের ঝাঁ-কুরকুর সাইকেল। এই সাইকেল একসময়ে বিষ্ণুপদ নিজে চালাত। চালিয়ে সাত মাইল দূরে একখানা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে যেত। তারপর কৃষ্ণজীবন চালিয়েছে, বামাচরণ চালিয়েছে, রামজীবন চালিয়েছে, শিবচরণ চালিয়েছে। এখন চালায় পটল।

সাইকেলটা উঠোন অবধি এসে থামল। সেজ বউ ছুটে এল কোথা থেকে। ভয়ের গলায় বল্‌ল, ওরে শিগগির নিতাইকে গিয়ে একটা খবর দে। ওরা আবার এসেছিল।

কারা মা?

বটতলার ওরা। নিতাইকে এখনই খবর দিতে হবে।

নিতাইদাকে তো দেখলাম কলোনীর মোড় পেরিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সঙ্গে কারা সব আছে।

দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়ে আয় বাবা। কেন যে রোজ আসছে এরা কিছু বুঝতে পারছি না। এক্ষুনি যা।

যাচ্ছি। কিন্তু গিয়ে বলবটা কি?

বলিস বটতলার ওরা তোর বাবাকে খুঁজতে এসেছিল।

তাতেই হবে?

সকলের সামনে বলিস না। আড়ালে ডেকে চুপিচুপি বলিস।

কুয়োতলা থেকে সবই শুনতে পেল বিষ্ণুপদ। গায়ে জল ঢালল না অনেকক্ষণ। ভেজা গায়ে বসে রইল। সব জায়গা থেকে নিজেকে তুলে আনা কি সহজ কাজ?

রামজীবন কিছু পাকিয়ে তুলেছে। বটতলা তো এতকাল ভাল জায়গাই ছিল। শীতলার থান আছে। সবাই বলে জাগ্রত দেবী। একসময়ে এই জায়গার নামই ছিল শীতলাতলা। গাঁয়ের নাম বিষ্টুপুর বললে কেউ কেউ বলে, কোন্ বিষ্টুপুর গো! শীতলাতলা বিষ্টুপুর?

সেই শীতলাতলায় এখন আড্ডা হয়েছে। খারাপ খারাপ লোক এসে জুটেছে। কাছ ঘেঁষে বাসরাস্তা হওয়ার পর থেকেই অধঃপতন। কাঁচাপয়সার কারবার আছে।

পটল ফের সাইকেল ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল।

দাওয়ায় চালের তলায় দাঁড়িয়ে গামছাটা নিংড়ে নেয় বিষ্ণুপদ। মাথা মোছে, গা মোছে। মুছতে মুছতে অনেক কথা ভাবে। চারটে সাইকেল। চারটে আবছা লোক। হেঁড়ে গলা। সেজো বউ ভয় পেয়েছে। রামজীবনের কি কোনও বিপদ?

বৃষ্টিটা ফের চেপে এল। একরকম ভাল। বৃষ্টিতে সব ধুয়ে যাক। যত ভাবনা-চিন্তা, যত পাপ-তাপ সব ধুয়ে যাক।

আজ অনেকটা ভাত বেড়ে এনেছে নয়নতারা। বলল, ভাল ঘানির তেল আছে, একটু ভাতে মেখে খাবে নাকি?

তেল-ভাত বিষ্ণুপদর বেশ পছন্দ। সঙ্গে লঙ্কা আর নুন। বলল, দাও একটু। ভাতটা একটু বেশী মনে হচ্ছে।

খাও। কচুরমুখি সেদ্ধ, বেগুনের ঝোল আর ডাল। এই আছে আজ। হবে এতে?

খুব হবে।

খেয়ে উঠে বিষ্ণুপদ একটু ঘুমলো। শরীর কিন্তু খারাপ লাগছে না। শ্বাস ঠিক আছে। নাড়ীও ঠিক আছে। কোথাও কোনও গড়বড় টের পায় না সে। তবু কালঘড়িটা চোখের সামনে ভাসছে।

একখানা মোটে ঘর আছে আর। দুটো কাঁটাই সেদিকে ঘুরছে।

জেগে দেখল, পুলিন ডাক্তার বসে আছে জলচৌকিতে।

হল কি গো বিষ্ণুপদ? কালঘড়ি না কী যেন দেখেছ!

পুলিনের বয়স বিষ্ণুপদর সমানই হবে। বিষ্ণুপদ কথাটা পছন্দ করল না। নয়নতারার কথাটা ফাঁস করা উচিত হয়নি। এরা কেউ তো বুঝতে চাইবে না ব্যাপারটা।

বিষ্ণুপদ একটা হাই তুলে বলে, ডাক্তার কি আর সব সারাতে পারে?

সারাবার মতো কিছু থাকলে সারাতে পারবে না কেন? কিন্তু তোমার সারাটা কি? রোগটা কোথায়?

বিস্নুপদ মাথা নেড়ে বলে, রোগটোগ কিছু নেই। এ হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়া। ঘড়ির দম শেষ হয়, দেখনি?

দম দিলে ফের চলে।

বিগড়ালে দম আর নেবে কি?

তুমি কি বিগড়েছ ভাই?

মনে তো হয়।

লক্ষণ তো মিলছে না। থাকগে, হাতটা দাও, নাড়ী দেখি।

বিষ্ণুপদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাতখানা বাড়াল। পুলিন নাড়ী দেখতে জানে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ আছে বিষ্ণুপদর। এ বিদ্যে সোজা নয়। জানুক না-জানুক, পুলিন ছাড়া তাদের আর ভরসাই বা কে?

হাতখানা রেখে দিয়ে পুলিন বলে, কিছু হয়নি তোমার। নাড়ী দিব্যি টনটনে আছে।

এখনও আছে। নাড়ীটাড়ীতে কিছু বোঝা যাবে না হে।

তবে কিসে বোঝা যাবে? এটা একটা বিজ্ঞান, মানো তো!

তা মানে বিষ্ণুপদ। মানুষ কত কিছু জানে, কত খবর রাখে, কত ওষুধপত্র বের করে ফেলেছে। বিষ্ণুপদ অজান জিনিস সব মানে।

তবে কি জানো পুলিন সব জেনেও কিছু যেন অজান থেকেই যায়। এই দেহ-যন্ত্রটার মধ্যে কত কলকব্জা বলল তো! কী সাংঘাতিক সব কাণ্ড।

সেসব তো তোমাকে একদিন আমিই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।

সে কথাই তো ভাবি। দেহের মধ্যে কত কী পুরে দিয়েছেন ভগবান।

ওষুধ দিচ্ছি। খেয়ো।

কিসের ওষুধ? অসুখ তো কিছু নেই বললে?

তবু দিচ্ছি। ভাবনাচিন্তা কমবে। ঘুম হবে। খিদে হবে।

সে সব তো হচ্ছেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *