১ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রেবার সেই খালাতো বোন শামসুন্নাহার আজিম–যার স্বামীকে গোপালপুর সুগার মিলে আর্মি মেরে ফেলেছিল, তার খবর পাওয়া গেছে। শামসুন্নাহার তার তিন বাচ্চা আর ছোট ভাই সালাহউদ্দিনকে নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে পালিয়ে বহুকষ্টের ভেতর দিয়ে শেষমেষ তারা ঢাকায় এসে পৌঁছেছে গত মাসের মাঝামাঝি। ওদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই, কিন্তু রেবা-মিনি ভাইয়ের মুখে শুনলাম পুরো ঘটনাটা।
শামসুন্নাহারের স্বামী আনোয়ারুল আজিম গোপালপুর সুগারমিলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিল। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেও সাড়া দিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গোপালপুর সুগার মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ করা হয়। ২৯ মার্চ পর্যন্ত এলাকা ছিল পাক শত্রুমুক্ত। ৩০ মার্চ সকালে লোকমুখে খবর পাওয়া গেল নাটোর বনপাড়ার রাস্তা দিয়ে পাক আর্মি মিলের দিকে আসছে। তখন মিল এরিয়ার সমস্ত লোক একত্র হয়ে মিলে আসার রাস্তার ওপর যে রেলক্রসিং ছিল, সেইখানে একটা ইঞ্জিন টেনে এনে ব্যারিকেড দিল। পাক আর্মি ব্যারিকেডের ওপাশে পজিশান নিয়ে গুলিগোলা মর্টারশেল যা আছে সব বর্ষণ করল, এ ধারে মুক্তিযোদ্ধারা মান্ধাতা আমলের বন্দুক, রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়ে তার উত্তর দিল। তখনকার মতো কিছু আহত সৈনিকসহ পাক আর্মি ফিরে যায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আজিম মিলের হিন্দু শ্রমিকদের পালিয়ে যেতে বলে। নিজেরাও আধ-মাইল দূরে নরেন্দ্রপুর ফার্মে সাময়িকভাবে সরে যায়। সেখানে ওরা ১০/১২ দিন ছিল।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিল এরিয়া থেকে কিছু লোক নরেন্দ্রপুরে এসে আজিমদের বলে যে, ওরা শুনেছে কয়েকদিন আগে মুলাডোলে পাক আর্মি আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে নাকি একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। তাতে আসলাম বলে এক পাকিস্তানি মেজর আর দুজন সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনী ওদের লালপুর বলে একটা জায়গায় নিয়ে গুলি করে। কিন্তু গুজব ছড়িয়েছে ওদের লাশ নাকি মিলের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। নাটোরে পাকিস্তানি মেজর শেরওয়ানি খান খুব ক্ষেপে রয়েছে। এসব শুনে আজিম ইন্ডিয়া চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঐ এলাকার অধিবাসীরা আজিমকে অনুরোধ করে, তাদেরকে বাঘের মুখে ফেলে আজিম যেন চলে না যায়। আজিম গোপালপুরে তার তিন বছরের চাকরির সময়ে এলাকার সকলের কাছে খুব প্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠেছিল সবাই তাকে নেতার মতো গণ্য করতো। ওদের অনুরোধে পড়ে আজিমের ইন্ডিয়া যাওয়া হলো না। তবে নিরাপত্তার জন্য আরেকটু দূরে কৃষ্ণা ফার্মে গেল। সেখানে দিন সাত/আট ছিল।
ইতোমধ্যে রাজশাহীর পতন হয়েছে, সমগ্র উত্তরাঞ্চল পাক আর্মির নিয়ন্ত্রণে। মিল থেকে কিছু লোক ও আশপাশের গ্রামের আখচাষীরা এসে আজিমকে ধরল, আপনি মিলে ফিরে আসুন, আর্মি বলছে মিল চালু করতে হবে, আর কোনো ভয় নেই।
আজিমরা মিলে ফিরে গেল। কিন্তু মিল চালু করা তো মুখের কথা নয়, সময় লাগে অথচ পাক আর্মি তা বুঝতে চায় না। নাটোরে ছিল পাকিস্তানি মেজর শেরওয়ানী খান। সেখানে আজিম ও আরো কয়েকজন অফিসারকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিল চালু করার জন্য হুকুম দেওয়া হলো। গোপালপুর মিলে বিহারি শ্রমিক ছিল প্রচুর। তাদেরই এখন দিন। তারা মুখে বিনয় দেখিয়ে বলে, স্যার, আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আমরা মিল চালু করার ব্যাপারে সবরকম সাহায্য করব। এসব বলে আর পাহারার মতো করে ঘিরে রাখে। মাঝে-মাঝে একদল করে পাকিস্তানি সৈন্য মিলে আসে, বিহারিদের সঙ্গে হৈ হৈ করে–তখন আবার মিলে বাঙালিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। কোয়ার্টার্স ছেড়ে পালায়-আবার ফিরে আসে। মাঝে-মাঝে কিছু সৈন্য বাঙালিদের বাড়িতে ঢুকে টাকা পয়সা দাবি করে, দামি জিনিসপত্র উঠিয়ে নিয়ে যায়। আজিমের কোয়ার্টার্সেও একবার এই রকম হামলা হয়। সেবার ঘরে যা টাকা-পয়সা ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্কৃতি পায়। তখন আজিম ঠিক করে নিজের কোয়ার্টার্সে থাকবে না। অন্য এক স্টাফের কোয়ার্টার্সে থাকতে শুরু করে। মিল চালু করতে আজিমের টালবাহানায় পাকিস্তানিরা ক্রমে অধৈর্য হয়ে উঠছিল। দেশের সর্বত্র কলকারখানা ঠিকমতো চলছে, উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে এসব দেখানো দরকার। অথচ আজিম স্থির করেছে–মিল সে চালু করবে না। পাকিস্তানি ও বিহারিদের ধোকা দেবার জন্য প্রাথমিক কিছু তোড়জোড় শুরু করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় পাঁচ মে মিল বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা চলে যাবে।
পাঁচ মে সকালে আজিম কয়েকজন অফিসারসহ মিলের বাইরে যায়। মিলের স্টোর অফিসার সে সময় আসন্ন প্রসবা স্ত্রী নিয়ে মিল এরিয়ার বাইরে থাকত। পাঁচ মে খুব সকালে খবর আসে স্টোর অফিসারের বাসায় ডাকাতি হয়েছে। আজিম তাড়াতাড়ি কাপড় পরে সামান্য নাশতা খেয়ে সেখানে যায়। শামসুন্নাহারের সঙ্গে তার স্বামীর এই শেষ দেখা।
পরে যে আজিমরা মিলের পেছন দিকের এক গেট দিয়ে মিলে ফিরে এসে অফিসে গেছে, শামসুন্নাহার তা জানে না। বেলা প্রায় দশটার দিকে সে ছোট ছেলের গেঞ্জি খুলেছে তাকে গোসল করাবে বলে। যে ভদ্রলোকের বাসায় তারা ছিল, সেই এসিস্ট্যান্ট কেমিষ্ট রহমান সাহেবের চাকর বাইরে থেকে দৌড়ে এসে খবর দিল–মিলের মধ্যে মিলিটারি ঢুকেছে, বাড়ি বাড়ি দরজা ধাক্কা দিয়ে সবাইকে বের করছে। চারদিকে লোকজন ছুটে পালাচ্ছে। তখন মিসেস রহমান সবাইকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য একটা বাসায় (এক বিহারি ফোরম্যানের খালি বাসা) খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে বাসার সদর দরজায় একটা তালা ঝুলছিল। এই তালাই পরে ওদের বাঁচিয়ে দেয়।
শামসুন্নাহার জানতে পারে নি যে, আর্মি মিলের অফিস থেকে আজিম ও অন্যান্য বাঙালি অফিসারকে ডেকে মিল এরিয়ার ভেতরে যে পুকুরটি আছে, তার পাড়ে নিয়ে গিয়েছে। এই পুকুরের পাড়ে আজিম, অন্যান্য অফিসার ও শ্রমিক মিলে প্রায় তিনশো বাঙালিকে পাকসেনারা মেশিনগান ব্রাশ ফায়ার করে মারে। শামসুন্নাহাররা সবাই যে, বাসাটাতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে ছিল, সেটা এই পুকুর থেকে অনেক দূরে। কিছু দেখা বা শোনা যায় না। তাছাড়া সুগার মিলের বয়লারে এক ধরনের ঝিকঝিক শব্দ হবার দরুনও তারা গুলির শব্দ শুনতে পায় নি। ঐ বাড়িতে বসে শামসুন্নাহার ভাবছে, আজিম তো মিল এরিয়ার বাইরেই আছে। অতএব, সে নিরাপদ। ঘণ্টা দেড়েক পরে ওরা সবাই ঐকোয়ার্টারের পেছনের ভাঙা (আগে থেকে ভেঙে রাখা হয়েছিল) বাউন্ডারি দিয়ে বেরিয়ে মাঠের মধ্যে ছুটে আধ-মাইল দূরে এক গ্রামে যায়। দেখে চারপাশ দিয়ে লোকজন ছুটে পালাচ্ছে। মিলের ভেতরে গুলিবিদ্ধ এক লোককে তার আত্মীয়স্বজন বাঁশের ভারে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐগ্রামের লোকজনও ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। আরো মাইল খানেক হেঁটে বিলসরিয়া বলে এক গ্রামে আশ্রয় নেয় শামসুন্নাহাররা সবাই। এখানে দেখে মিলের এক অফিসার শওকত তার আসন্ন প্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এখানে এক গরিব গৃহস্থের বাড়িতে কোনমতে রাতটা কাটিয়ে পরদিন গরুগাড়ি করে পাঁচ মাইল দূরে বিলমারিয়া নামে আরেকটা গ্রামে গিয়ে এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই বাড়িতে ওরা সবাই ৰারো দিন ছিল। শামসুন্নাহার এক কাপড়ে এই বারো দিন কাটায়। ছেলে খালি গায়ে। সেই যে গোসল করার আগে জামা খুলেছিল, সেই অবস্থাতেই পালাতে হয়েছিল। পায়ে জুতো লাগাবারও সময় পায়নি। শওকত জানত যে আজিমকে গুলি করে মারা হয়েছে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সে শামসুন্নাহারকে বলতে পারে নি কথাটা। তবে মিলের বাইরে এসেও আজিমের কোন খোঁজ না পেয়ে এবং বিভিন্ন গ্রামবাসীর কথাবার্তায় সন্দিগ্ধ হয়ে শামসুন্নাহার শওকতকে চাপ দিয়ে আসল খবর বের করে ফেলে।
শামসুন্নাহার জানত–বিশ-ত্রিশ মাইল দূরে যুগীপাড়া গ্রামে তার নানাশ্বশুরের বাড়ি।
একজন লোককে কিছু টাকা কবুল করে যুগীপাড়ায় খবর পাঠায়। যুগীপাড়া থেকে লোক এসে দুটো গরুগাড়ি ভাড়া করে শামসুন্নাহারদের নিয়ে রওয়ানা দেয়। অর্ধেক রাস্তা গিয়ে গরুগাড়ির গাড়োয়ানরা আর যেতে অস্বীকার করল। তখন টমটম ভাড়া করে খানিক গেল। এক নদীর পাড়ে এসে টমটম ছেড়ে দিয়ে নৌকায় নদী পেরিয়ে হেঁটে গেল কতকদূর। এভাবে যুগীপাড়ায় পৌঁছায় ওরা। এখানে এসে শামসুন্নাহার দ্বিতীয় কাপড় পরে। ছেলের গায়ে জামা ওঠে। এখানে ওরা বিশ-পঁচিশ দিন থাকে।
রাজশাহীর রাণীনগরে শামসুন্নাহারের শ্বশুরবাড়ি। ওর শ্বশুর ইন্ডিয়ান রেডিওতে ছেলের খবর জেনে পাগলের মতো পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীদের খোঁজ করে শেষমেষ যুগীপাড়ায় খোঁজ পান। ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে যুগীপাড়া থেকে শামসুন্নাহারদের আনিয়ে নেন। আবার কিছুদূর গরুগাড়ি, কিছুদূর নৌকা, কিছুদূর পায়ে হেঁটে শেষে টমটমে ওরা সবাই রাণীনগরে পৌঁছায়।
ওদিকে শামসুন্নাহারের বাবা-মা বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা ইন্ডিয়ান রেডিওতে জামাইয়ের খবর শুনে পাগলের মত হয়ে ঢাকা চলে আসেন। মেয়ের খোঁজ বের করতে তাদের অনেকদিন লেগে যায়। তারপর বি.আই.ডিসিতে বলে-কয়ে একটা জীপ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন রাণীনগরে। সঙ্গে পাঠান বোনের ছেলেকে আর নিরাপত্তার জন্য এক বিহারি অফিসারকে।
রাণীনগর থেকে ঢাকা আসার রাস্তাও খুব সহজ ছিল না। জীপ রাণীনগর পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব হয় নি। আত্রাই নদীর এপারে জীপ রাখতে হয়েছিল। শামসুন্নাহাররা নৌকায় নদী পেরিয়ে অনেকদূরে হেঁটে তারপর জীপে ওঠে। গত মাসের মাঝামাঝি শামসুন্নাহার তার তিন ছেলেমেয়ে ও ছোট ভাই সালাহউদ্দিন এমনি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ঢাকা এসে পৌঁছেছে।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কারবালার ঘটনা কি এর চেয়েও হৃদয়বিদারক ছিল?