পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র আছে। পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমা, আয়তন, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, জনসংখ্যা, জলবায়ু, আমার বিষয় নয়—আমার বিষয় সরকার মনোনীত কিছু আইন ও অধ্যাদেশ। যে আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় অমর্যাদা পেয়েছে।
১৯৭৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে হুদুদ অধ্যাদেশের প্রবর্তন হয়, যে অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয় চুরি, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, ধর্ষণ ও মিথ্যা সাক্ষ্য। প্রচলিত ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী ব্যভিচার মানুষের ব্যক্তিগত অপরাধ, অথচ এই অধ্যাদেশের ফলে ব্যভিচারকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যভিচার, বিবাহপূর্ব যৌনাপরাধ, ধর্ষণ ও বেশ্যাবৃত্তিকে ‘জেনা’ বলা হয়। অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক নেই এমন দু’জন নর-নারীর মধ্যে যৌন মিলন ঘটলেই জেনা সংঘটিত হয়। ব্যভিচার ও বিবাহপূর্ব যৌনাপরাধের মধ্যে এই অধ্যাদেশ কোনও পার্থক্য করে না।
জেনার সর্বোচ্চ শাস্তি ‘হদ’। যা বিবাহিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পাথর মেরে মৃত্যু এবং অবিবাহিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে একশ বেত্ৰাঘাত। হদের জন্য প্রয়োজন চারজন পুরুষ মুসলমানের সাক্ষ্য। নারী বা অমুসলমানের সাক্ষ্য দ্বারা হদের শাস্তি দেওয়া যায় না। ধর্ষণকারীকে শাস্তি দেবার জন্য চারজন পুরুষ মুসলমাদের সাক্ষ্য প্রমাণের বিধান রাখবার অর্থ—অপরাধীকে রক্ষা করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করা।
এটা খুবই অস্বাভাবিক যে, কোনও পুরুষ চারজন পুরুষের সামনে ধর্ষণ করে এবং তারা সাক্ষ্য দেয়। চারজন নারীর সামনে একজন নারীকে ধর্ষণ করবার ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু নারী সাক্ষ্য দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি হদ প্রযোজ্য হয় না। এবং আইনের বিধান অনুযায়ী ধর্ষণকারী রক্ষা পায়।
নারী গর্ভধারণ করলে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। অথচ যে পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চার হয় সে রেহাই পেয়ে যায়। জারজ সন্তান জন্ম দেবার জন্য অনেক নারীকে বেত্ৰাঘাত, জেল ও জরিমানার শাস্তি দেওয়া হয় কিন্তু কোনও পুরুষ জারজের জন্মদাতা হবার অপরাধে শাস্তি পায় না। কারণ গর্ভধারণের মত জলজ্যান্ত প্রমাণ তাদের থাকে না।
এই হুদুদ অধ্যাদেশ ব্যভিচার ও ধর্ষণের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ফলে কোনও নারী নিজের উদ্যোগে ধর্ষণের অভিযোগ করলে নারী নিজে ব্যভিচারের শাস্তি ভোগ করে। আর ধর্ষণকারী সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে মুক্তি লাভ করে।
পাকিস্তানের ইসলাম মতাদর্শ পরিষদ ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে কিসাস ও দিয়াত আইনের খসড়া প্রস্তুত করে। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত হত্যা, শারীরিক ক্ষতি ও গর্ভপাতের সকল দিক এ আইনের আওতাধীন।
আইনের ২৫(বি) অনুচ্ছেদে বলা হয় কাতেল-ই-খাতা (অনিচ্ছাকৃত খুন) অপরাধের শিকারী নারী হলে দিয়াতের শাস্তি হবে একজন পুরুষ হলে যা হত তার অর্ধেক। একইভাবে শারীরিক ক্ষতির জন্য সব রকম ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে একজন ক্ষতিগ্রস্ত অথবা পঙ্গু নারী পাবে একই রকম ক্ষতির জন্য একজন পুরুষ যা পাবে তার অর্ধেক। অন্যদিকে কোনও নারী খুন বা শারীরিক ক্ষতির অপরাধে অপরাধী হলে তার শাস্তি একজন পুরুষের সমানই হবে।
আইনের চোখে একজন শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম নারী একজন অশিক্ষিত ও উপার্জন অক্ষম পুরুষের চেয়ে কম মূল্যবান।
কিসাস এই আইনের আরেকটি অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের ১০ ধারায় কিসাসের শাস্তির জন্য খুনের প্রমাণে দুজন পুরুষ মুসলমানের সাক্ষ্য দরকার হয়। তাজির বা কম শাস্তির জন্য নারী সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়। এই আইনের আওতায় নারীর সামনে খুন হলে খুনীর শাস্তি হয় না। কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তি অমুসলমান না হলে কোনও অমুসলমানের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা যায় না। এভাবে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য কোনও নারী বা অমুসলমান-সাক্ষ্যই অগ্রাহ্য করা হয়। এই আইনের ৯৬ এবং ৯৭ ধারায় যে কোনও অবস্থায় (ইসকত-ই-হামাল) গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় যার শাস্তি সাত বছরের জেল। যে গর্ভপাত ঘটায় এবং যার গর্ভপাত ঘটানো হয় দু’জনকেই শাস্তি পেতে হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রচলিত কঠোর আইনও কোনও মেয়ের শারীরিক বিপদের আশঙ্কা থাকলে গর্ভপাত ঘটানো সমর্থন করে। কিন্তু পাকিস্তানের এই কিসাস আইন তা করে না। এই আইন কোনও ধর্ষণের শিকারকেও রেহাই দেয় না।
১৯৮৪ সালের ৩ জুন জারি হয় আরও একটি অধ্যাদেশ। দক্ষিণ পাঞ্জাবে নওয়াবপুর শহরের একটি ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে অপরাধ অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশের প্রবর্তন হয়। নওয়াবপুরের এক জমিদার তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবার অপরাধে এক মিস্ত্রিকে তার বাড়িতেই পিটিয়ে হত্যা করে। মিস্ত্রির বাড়িতে মিস্ত্রি হত্যার সাক্ষী যে নারীরা ছিল তাদের উলঙ্গ করে বাড়ির বাইরে নেওয়া হয়, এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় মার্চ করতে বাধ্য করা হয়।
জমিদারের এই হিংস্রতার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ নারী সংস্থা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে। এই আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর অপরাধ অধ্যাদেশ জারি হয়। অধ্যাদেশে বলা হয় একজন নারীকে আঘাত করা অথবা তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা, তাকে উলঙ্গ করা এবং ঐ অবস্থায় তাকে জনসমক্ষে আনবার জন্য শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে নারীকে ঘরের ভেতর পেটালে, উলঙ্গ করলে, ধর্ষণ করলে এবং হত্যা করলে এ অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না অর্থাৎ শুধু প্রকাশ্যের বেলায় প্রযোজ্য হবে।
১৯৮৩ সালের ১০ জুন জেনারেল জিয়া কর্তৃক আনসারী কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের রিপোর্ট মতে রাষ্ট্রপ্রধানের অফিসকে নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয় যে একজন পুরুষের আমীর হওয়া উচিত। কমিশনের মতে নারী আমীর অনৈসলামিক।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২নং অনুচ্ছেদ মজলিস-ই-সুরার (নির্বাচিত পরিষদ) নারীদের সদস্যপদ সম্পর্কিত। ওতে বলা হয়েছে সুরার সকল পুরুষের যে যোগ্যতার প্রয়োজন, সকল নারীর জন্য সেইসব আবশ্যকীয় যোগ্যতা ছাড়াও অতিরিক্ত শর্ত হচ্ছে ৫০ বছরের কম বয়স হলে চলবে না এবং স্বামী জীবিত থাকলে স্ত্রীর সদস্যপদের জন্য স্বামীর লিখিত অনুমতি লাগবে। এসব শর্ত পূরণের পর নারী যে কোনও সাধারণ আসনে নির্বাচন করবার যোগ্য বলে গণ্য করা হবে। এই কমিশনের উদ্দেশ্য নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবার অধিকারকে অস্বীকার করা এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক করা।
পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র এইসব আইন ও অধ্যাদেশ নিয়ে ভূমণ্ডলে টিকে আছে। আমরা শুনছি, আমরা দেখছি, আমরা ঘৃণায় থুতু ফেলছি—তাতে কার কী আসে যায়। যারা আইন বানায়, অধ্যাদেশ তৈরি করে তারা এত উঁচুতে বসে থাকে যে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের তোয়াক্কা করে না।