১৯ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
মালু মিয়া আজ আবার বারেককে নিয়ে এসেছে। এ কদিনে কাজের ঠেলায় আমারও মন নরম হয়ে এসেছে। মালু মিয়ার কাকুতি-মিনতি এবং বারেকের মাফ চাওয়ার পর ওকে আবার ফিরিয়ে নিলাম। কাসেমের অন্য বাসায় চাকরি হয়ে গেছে, বারেকের হয় নি। জামী বলল, ভালোই হল। এই দুর্দিনে গ্রামে গিয়ে না খেয়ে মরত।আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ বারেক না এলে তুমিও মরতে দাদার ডিউটি করতে করতে।
পারভেজ এসেছে সন্ধ্যার পর। ও আগামীকাল রওনা দেবে। আমি আগেই বেলেডোনা–৬ কিনে রেখেছি অনেক কয়টা শিশি, আরো কিনেছি কয়েকটা নেইল কাটার, গোটা তিনেক সানগ্লাস। একটা সান গ্লাস, একটা নেইল কাটার রুমীর জন্য। বাকিগুলো তোমরা ব্যবহার করো। বেলেডোনা যখন যার লাগবে। পারভেজকে দুশো টাকা দিলাম, একশো তুমি নিয়ে, একশো রুমীকে দিয়ো।
এসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ গুলিগোলার শব্দে চমকে উঠলাম। পারভেজ বলে উঠল, কাছাকাছি কোথাও মনে হচ্ছে? বলতে না বলতেই বাতি চলে গেল। আমি হেসে বললাম, ওই বুঝি শুরু হলো। মোমবাতি জ্বালতে জ্বালতে চিন্তা করতে লাগলাম, গুলির শব্দটা ঠিক কোন জায়গা থেকে এলো? উত্তর-পূর্বদিক থেকেই তো মনে হচ্ছে। ওদিকে কোথায়? শরীফ বলল, কেন পি.জি. হাসপাতালে যাবার রাস্তাটায় পুকুরটায় এপাশে যে পাওয়ার সাবস্টেশনটা আছে, ওখানে হতে পারে।
জামী লাফ দিয়ে উঠল, হা, হা রেললাইন পার হয়েই ঐ যে মেইন রোডের বাঁ হাতে উঁচু দেয়াল আর কাটা তার দিয়ে ঘেরা সাব-স্টেশনটা–কথার মাঝখানেই জামী হঠাৎ ইয়া হু- বলে এক চিল্কার এবং আরেক লাফ–ঐটাকে ধানমন্ডি সাব-স্টেশন বলে না? মার দিয়া কেল্লা! জয় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা।
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে ধমকে উঠলাম, থাম্ থাম। অত চেঁচাস্ নে। কে কোথায় শুনে। ফেলবে।
পারভেজ উসখুস করে বলল, আমাকে এবার যেতে হয়।
আরেকটু পরে যাও। রাস্তায় অন্ধকারে কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কে জানে?
না, অন্ধকারেই বরং সুবিধে। গুলির শব্দ তো শাহবাগের দিক থেকে এসেছে, আমি নিউ মার্কেটের দিক দিয়ে চলে যাই। কিছু হবেনা খালাম্মা। এর চেয়ে ঢের বেশি ঝুঁকি নিয়ে আমরা চলফেরা করি।
ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ বাতি জ্বলে উঠল। মনটা দমে গেল, এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে ফেলল? তবে ভোল্টেজ খুবই কম, এত কম যে মোমবাতির মতো আলো।
রাতে ভাত খেতে খেতে আবার কারেন্ট চলে গেল। আমরা মোমবাতি জ্বেলে বাকি কাজ সেরে শোবার ঘরে গিয়ে রেডিও নিয়ে বসলাম। একটু পরেই ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শুরু হবে। আজকাল রেডিওতে ব্যাটারিই ব্যবহার করি সব সময়। কারণ কখন কোন জায়গায় বসে রেডিও শুনব, তার ঠিক নেই। বাড়ির সর্বত্র ইলেকট্রিক তার বয়ে বেড়ানো সম্ভব না। আর এখন তো কারেন্টই নেই।
আজ ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ঢাকার রাস্তায় পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গান-ফাইট। বলে কি? একেবারে মুখোমুখি সংঘর্ষ গুলি বিনিময় কই, আমরা তো ওরকম কিছু টের পেলাম না? গুলি গোলার শব্দ শুনেছি বটে তবে দুদলে একেবারে গান-ফাইট হবার মতো অত সাংঘাতিক বলে মনে হয়েছে কি?
জামী বলল, কি জানি হয়তো এখানে সামান্য হয়েছে, ঢাকার অন্য এলাকায় বেশি হয়েছে। আমরা বাড়ি বসে সেটা টের পাচ্ছি না।
শরীফ বলল, আপাতত চারদিক বেশ সুমসামই মনে হচ্ছে। এটুকু ঠিক যে এখন অন্তত কোন গান-ফাইট হচ্ছে না। এখন শোয়া যাক। কাল খবর নেব কোথায় কি হলো।
আমি বললাম, ভোয়া বি. বি. সি.র বরাত দিয়ে বলল। বি.বি.সি.তে আগেই বলেছে নাকি? আজ আমাদের বি.বি.সি. শোনা হয় নি। কিন্তু বি.বি.সি. বাংলা অনুষ্ঠান তো পৌঁনে আটটা থেকে সোয়া আটটা। ঘটনাটা তো ঐরকম সময়েই ঘটেছে। তাহলে?।
শরীফ বলল, কেন বি.বি.সি. ইংরেজি খবরেও তো দিতে পারে। বি.বি.সি ঘন্টায় ঘন্টায় ইংরেজি খবর বলে না? দেখি কাল খোঁজ নেব. আর কেউ শুনেছে কি না।
রাতে ভালো ঘুম হলো না। উত্তেজনায় সারা শরীর মন চনমন করছে। গুজব সত্যি হতে চলেছ নাকি? রাজধানী ঢাকা শহরে ইলেকট্রিসিটি থাকবে না। কিন্তু কাল দিনের আগে জানবার কোনো উপায় নেই।