১৯২৬। বয়স ২৭ বছর
১৩৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘কালি কলম’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় [মাসিক। সম্পাদক : মুরলীধর বসু (১৮৯৭-১৯৬০), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬) ও প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪- ১৯৮৮) (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ), মুরলীধর বসু ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), মুরলীধর বসু (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ)]।
‘কালি কলম-এর অন্যতম সম্পাদক শৈলজানন্দ জীবনানন্দকে এক চিঠিতে লিখেছেন—
‘আমাদের কাগজ যদি আপনার ভাল লাগে এবং ‘কল্লোলে’ লেখা দিয়েও যদি ‘কালি কলমে আপনি লিখতে পারেন ত’ আমরা সকলেই বিশেষ আনন্দিত হব। আমাদের মধ্যে আমরা আপনাকে চাই।’
এই পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘পতিতা’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটির রচয়িতা জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। কবি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ব্যথিত হয়ে এই সময়ে আরও লিখলেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতাটি।
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৫ বছর। ৮৬ বছর বয়সী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে লক্ষ্ণৌ থেকে দ্রুত ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে বক্তৃতা দিলেন কবি। ভ্রমণ করলেন ময়মনসিংহ, আগরতলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা। কুমিল্লার অভয় আশ্রমের উৎসবে যোগদান করলেন রবীন্দ্রনাথ।
মুসোলিনীর আমন্ত্রণে ১২ মে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথ; সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী প্রমুখ। এটা রবীন্দ্রনাথের অষ্টম বার বিদেশযাত্রা। ৩১ মে মুসোলিনীর সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয়। এতে স্বদেশে ও বিদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ফ্যাসিস্ট উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করে মুসোলিনীর প্রতি বিশ্বাসে ফাটল ধরল রবীন্দ্রনাথের। ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড গেলে রোমা রোলাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বার্লিনে আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কবির। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের চিঠি ছাপা হলে অধ্যাপক তুচ্চি বিশ্বভারতী থেকে প্রত্যাহৃত হলেন।
নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল (অরিন্দম খালেদ)-এর জন্ম হয়। কেন্দ্রীয় আইন সভার প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন নজরুল। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঙে ফুল’ ও ‘সর্বহারা’, প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ও ‘রুদ্র মঙ্গল’ প্রকাশিত হয়।
এ বছর (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) বেগম রোকেয়ার ‘অভিভাষণ’ (১৯২৬-এ বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে প্রদত্ত সভানেত্রীর ভাষণটি) ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত হয়। ‘সবুজ পত্রে’ মোট তিনজন মুসলমান লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়। বেগম রোকেয়া ছাড়া অন্য দু’জন হলেন—তরীকুল আলম (১৮৮৯–১৯৩২) এবং এস. ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১)।
এ বছর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে গণিতে বিশেষ কৃতিত্বসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
পুলিশের গুপ্তচর ভূপেন চ্যাটার্জী জেলের মধ্যেই গুলিতে নিহত হল। চিৎপুরে নাখোদা মসজিদ নির্মিত হল। এপ্রিলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানে ভীষণ দাঙ্গা বাধে। এই দাঙ্গা পাবনা ও ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অধ্যাপক-উপাচার্য নিযুক্ত হলেন যদুনাথ সরকার। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে চেম্বারলেন ও এঁয়ো ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ লাভ করলেন। জন লোগী বেয়ার্ড প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে টেলিভিশন দেখালেন।
লর্ড রিডিং পদত্যাগ করলে লর্ড আরউইন রাজ-প্রতিনিধি হয়ে ভারতে আসেন। চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ইংরেজ, ফরাসি, আমেরিকান প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তিবর্গ নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করবার জন্যে চীনে সৈন্য পাঠায়।
এ বছর জন্মালেন সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সিদ্ধেশ্বর সেন, মনীন্দ্র গুপ্ত, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, উত্তমকুমার, ফতেহ্ লোহানী।
পরলোক গমন করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী ইমদাদুল হক।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান গ্রাৎসিয়া মেডেসানি দেলেদ্দা (১৮৭৫– ১৯৩৬)। কথাকার। ইতালির অধিবাসী। সাহিত্যে দ্বিতীয় মহিলা-নোবেলজয়ী
তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘For her idealistically inspired bitings, which plastic clarity picture the life on her native island and with depth and sympathy deal with human problems in general.’
দেলেদ্দার বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল—’দ্য মাদার’, ‘কোসিমা’, ‘ফ্লাওয়ার অব সার্ডিনিয়া’, ‘আরনেস্ট সোল’, ‘দ্য গড অব দ্য লিভিং’, ‘দ্য সিক্রেট অব দ্য সলিটারি ম্যান’, ‘দ্য ইভিল ওয়ে’ ইত্যাদি।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’, ‘শোধবোধ’, ‘নটীর পূজা’, ‘রক্তকরবী’, ‘ঋতু উৎসব’, ‘শেষ বর্ষণ’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ (ODBL)। [সুনীতিকুমারের মনীষার শ্রেষ্ঠ কীর্তিস্তম্ভ ODBL দু’খণ্ডে প্রকাশিত। প্রথম খণ্ডে ধ্বনিতত্ত্বের (৮টি অধ্যায়) এবং দ্বিতীয় খণ্ডে (৫টি অধ্যায়) আছে রূপতত্ত্বের আলোচনা। এই গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে ঝুল ব্লকের মারাঠি ভাষাবিষয়ক গ্রন্থটি — ‘La Formation de la Langue Marathe’ (১৯০৮)। কিন্তু সুনীতিকুমারের মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য]। বের হয় নরেন্দ্রনাথ দেবের ‘ওমর খৈয়াম’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, অমৃতলাল বসুর ‘ব্যাপিকা বিদায়’, ‘দ্বন্দ্বে মাতরম্’, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘নরনারায়ণ’, প্রেমেন্দ্ৰ মিত্রের ‘পাঁক’, দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’। প্রকাশিত হয় আঁদ্রে জিদের ‘ইফ ইট ডাই’, কাফ্ফার ‘দি ক্যাসল’।
প্রকাশিত হয় অমল বোস ও সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পাদনায় ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’, মুজফ্ফর আহমদ সম্পাদিত প্রথম বাংলা কমিউনিস্ট পত্রিকা ‘গণবাণী’, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘উত্তরা’ নামক মাসিক পত্রিকা। এ বছর ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা প্রথম পূজা সংখ্যা বের করে। ৫৪ পৃষ্ঠার এ পূজাসংখ্যার দাম ছিল দুই আনা। একই বছর ‘ভারতী’ পত্রিকাও শারদীয় সংখ্যা বের করে। দাম ছিল এক টাকা। এ সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ ছিল শরৎচন্দ্রের সম্পূর্ণ নাটক ‘ষোড়শী’। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা পূজা সংখ্যায় প্রথম উপন্যাস ছাপে ১৯৩৯ সালে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সহরতলী’।