১৯২০। বয়স ২১ বছর
প্রেসিডেন্সি কলেজেই এমএ পড়া শুরু করলেন জীবনানন্দ। একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগেও ভর্তি হন তিনি। অনুমান করা যায় তাঁর মতো লাজুক প্রকৃতির ছাত্র আইন পড়তে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র হার্ডিঞ্জ ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পাওয়ার ভরসায়। মা চেয়েছিলেন কাকা ব্রহ্মানন্দ বা পিসতুতো বোন অমিয়ার স্বামী ব্রজসুন্দর রায়ের বাড়িতে থেকে জীবনানন্দ এমএ এবং ল’ পড়ুন। কিন্তু জীবনানন্দের এটা পছন্দ হয়নি। মাকে গোপন ইচ্ছের কথা লিখলেন—
‘বাবা আসিয়া এখানে একটা বাড়ি ভাড়া করিয়া থাকিতে পারিতেন কি না তা-ই ভাবিতেছিলাম। কিন্তু সেসব স্বপ্ন সুদূরপরাহত।’
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৫৯। বিশ্বভারতী সংগঠনের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে ব্যস্ত। পশ্চিম ভারত সফর করতে গিয়ে সরবমতীতে গান্ধীজীর আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ একদিন থাকলেন।
১১ মে তিনি রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমী দেবীকে নিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিদেশ ও চতুর্থবারের মতো ইউরোপ সফরের উদ্দেশ্যে কলকাতা ত্যাগ করলেন। জাহাজে সহযাত্রী ছিলেন মহামান্য আগা খাঁ। আগা খাঁর সঙ্গে হাফিজ ও সুফিধর্ম বিষয়ে আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথ আনন্দ লাভ করলেন।
ইংল্যান্ডের প্লিমাউথ বন্দরে অবতরণ করলে দীর্ঘ ৪ বছর পর বন্ধু পিয়ার্সনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে কবির। ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করার কারণে লন্ডনের ইংরেজ বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথকে আন্তরিকভাবে সমাদর করলেন না। ক্ষুব্ধ চিত্তে ইংল্যান্ড ত্যাগ করে ফ্রান্সের প্যারিসে উপস্থিত হলেন কবি। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমাকে লন্ডনে রেখে গেলেন। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ‘ফাউস্ট’-এর অভিনয় দেখলেন।
পরে পিয়ার্সন ও কেদারনাথ দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আমেরিকায় গেলেন। সেখানেও রবীন্দ্রনাথের প্রতি ঠাণ্ডা আচরণ প্রদর্শিত হল। কোথাও থেকে কোনো আহ্বান নেই। নভেম্বরে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী ইউরোপ থেকে নিউইয়র্কে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলিত হলেন।
বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দিলে নজরুল কর্মহীন হয়ে পড়েন। কলকাতায় ফিরে শৈলজানন্দের সঙ্গে মেসে বসবাস শুরু করেন নজরুল। কিন্তু মুসলমান বলে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেস থেকে বিতাড়িত হন নজরুল। এরপর মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন তিনি। পারিবারিক কারণে চুরুলিয়ার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু। ৬০ টাকা বেতনে ‘নবযুগে’ নজরুলের কর্মজীবনের সূচনা।
খিলাফৎ ও জালিয়ানওয়ালাবাগ এ দু’টো অন্যায়ের প্রতিবাদে গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। এতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় সাড়া দিল।
লর্ড সিন্হা উড়িষ্যা-বিহার অঞ্চলের ছোটলাট নিযুক্ত হলেন। এ পদে প্রথম ভারতীয় তিনিই। বিদেশের মাটি তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্থাপিত হল। প্রধান উদ্যোক্তা মানবেন্দ্রনাথ রায়। সুভাষচন্দ্র বসু আইসিএস হলেন। ভারতের প্রসিদ্ধ জননেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যু হয়।
বাণিজ্যিকভাবে রেডিওর উৎপাদন শুরু হয় এ বছর।
তৎকালীন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পশ্চিম ভারত থেকে প্রায় ৫০ হাজার মুসলমান আফগানিস্তানে চলে যায়। ইউরোপীয় খ্রিস্টান শক্তিপুঞ্জ তুর্কি সাম্রাজ্যকে খণ্ড-বিখণ্ড করে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। ফলে ব্রিটিশরা ইরাক ও দার্দানেলিসের এবং ফরাসিরা সিরিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করে।
মৌলানা মুহম্মদ আলী ও অন্যান্য নেতা ইউরোপ গিয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির রাজশক্তির সঙ্গে কথা বলে ‘খেলাফত’ রক্ষা করার চেষ্টা চালান এবং ব্যর্থ হন।
৭২ দিন কঠোর অনশনব্রত পালন করে ‘সিন্ফিন্’ নেতা লর্ড ময়ের কারাগারে প্রাণ ত্যাগ করলে আইরিশ বিদ্রোহ ভীষণাকার ধারণ করে।
এ বছর জন্মালেন তরুণ কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আবদুল আহাদ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
আর পরলোক গমন করলেন দেবেন্দ্রনাথ সেন, বাল গঙ্গাধর তিলক।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ন্যুট হ্যামসুন (১৮৫৯–১৯৫২)। নরওয়ের অধিবাসী, ঔপন্যাসিক।
ন্যুট হ্যামসুনকে যে কারণে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল, তা এ রকম—
‘For his monumental work ‘Growth of the Soil.
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল—’গ্রোথ অব দ্যা সয়েল’, ‘হাংগার’, ‘দ্য মিসটিরিয়াস ম্যান’, ‘দ্য রিং ইজ ক্লোজড’, ‘ভিক্টোরিয়া’, ‘নিউ আর্থ’, ‘গেম অব লাইফ’।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : রবীন্দ্রনাথের ‘অরূপ রতন’ ও ‘পয়লা নম্বর’ প্রকাশিত হল। প্ৰকাশ পেল দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নানা চিন্তা’, ‘প্রবন্ধমালা’ ও ‘কাব্যমালা’। বের হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’, শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’, নগেন্দ্রনাথ সেনের ‘মধুস্মৃতি, অনুরূপা দেবীর ‘মা’, সরোজিনী নাইডুর কাব্য ‘The Bird of Time’, এইচ.জি. ওয়েলসের ‘দি আউটলাইন অব হিস্ট্রি’।
‘নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশিত হল মুজফ্ফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রণোদনায়। এটি সান্ধ্য দৈনিক, মালিক ছিলেন এ.কে. ফজলুল হক। ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার কারণে ‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রকাশ পরে স্থগিত হয়ে যায়।