১৯১০। বয়স ১১ বছর
জীবনানন্দ অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। ছেলেবেলায় খুব একটা বন্ধুবান্ধব ছিল না তাঁর। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য দু’একজন বন্ধুর নাম—প্রমথনাথ দে, নগেন মুখোপাধ্যায়, হরিজীবন ঘোষ, বিমলেন্দু সেন, চন্দ্রবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে বিমলেন্দু সেন, চন্দ্রবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরিজীবন ঘোষ জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন।
সংসারের ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে কুসুমকুমারী কবিতা লিখতেন। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন- এখনই কবিতা লাগবে একটা। কুসুমকুমারী হয়তো তখন সাংসারিক কাজে খুব ব্যস্ত, ওদিকে আবার মনোমোহন নাছোড়বান্দা। রান্নাঘরে বাম হাতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে ডান হাতে কবিতা লিখে দিলেন তিনি।
মায়ের কবিত্বশক্তি থেকে জীবনানন্দ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনিও কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। কৈশোরের সেসব কবিতা রক্ষা করা হয়নি।
সেই সময়ের একটা ছড়া এরকম—
এল বৃষ্টি বুঝি এল
পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো।
এল বৃষ্টি বুঝি এল
ছেলেদের খেলা মাঠে মুহূর্তেই সাঙ্গ হয়ে গেল!
এল বৃষ্টি বুঝি এল
ছিপ ফেলে বাথানের দিকে ঐ চলে যায় কেলো!
এল বৃষ্টি বুঝি এল
জল ধরে গেলে মাসী, তারপর কাঁথাগুলো মেলো!
এল বৃষ্টি বুঝি এল
গেল গেল আমসত্ত্ব পোড়ামুখ বৃষ্টি সব খেল!
এল বৃষ্টি বুঝি এল
হরির মা কতগুলো ডাঁটো আম পেল।
(বাল্যস্মৃতি, অশোকানন্দ দাশ, পৃ. ১৩৫)
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪৯ বছর। বাবার মতো ২২ বছর বয়সে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। পাত্রী বালবিধবা প্রতিমা, গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়নী দেবীর মেয়ে। ঠাকুর পরিবারে এই প্রথম বিধবা বিয়ে হয়। এই বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উদ্যোগী ছিলেন।
শান্তিনিকেতনে কেবলমাত্র মেয়েদের দিয়ে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ অভিনয় করান রবীন্দ্রনাথ। এতে পুরুষ দর্শক ছিল না। কারণ তখনও পর্দাপ্রথা প্রকট।
‘গীতাঞ্জলি’ পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ৯০ দিনে ‘গীতাঞ্জলি’র ১৩৭টি কবিতা- গান রচনা করেন। ৮ মে শান্তিনিকেতনে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালিত হয়।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নজরুলের পড়াশোনায় বাধা পড়ে। নজরুল মক্তবে শিক্ষক হিসেবে এক বছর পূর্ণ করেন। হাজি পালোয়ানের মাজার শরীফের খাদেমগিরি এবং পীরপুকুর মসজিদের ইমামতির কাজও করেন। এ সময় কিছুদিন বাসুদেব কবিয়ালের লেটোদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নজরুল।
এ বছর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
হিন্দুসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাভারকর গ্রেপ্তার হন। জলে ঝাঁপ দিয়ে যুদ্ধজাহাজ থেকে পলায়ন করেন সাভারকর। পরে ধৃত হয়ে ৫০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পুলিন দাস গ্রেপ্তার হন। বিপ্লবী বীরেন সেন বাংলা পুলিশের ডি.এস.পি শামসুল আলমকে হত্যা করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। সৈয়দ আমির আলী লন্ডন প্রিভি কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় সদস্য নির্বাচিত হন।
তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা পালিয়ে এসে কলকাতায় আশ্রয় নেন। ভারত-সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড ব্রঙ্কাইটিস্ রোগে প্রাণত্যাগ করেন। সম্রাট হন তাঁর পুত্র পঞ্চম জর্জ।
দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভোটে জয়লাভ করে জেনারেল বোথা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ফ্রান্সে শ্রমিকদের বার্ধক্য ভাতার প্রবর্তন হয়।
ভারতের দ্বাদশ রাজপ্রতিনিধি লর্ড মিন্টো পদত্যাগ করেন। উক্ত পদে নিযুক্তি পান দ্বিতীয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। ১৯১০ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের ভাইসরয় ছিলেন।
এ বছর জন্মেছেন অশোকবিজয় রাহা, বিমলচন্দ্ৰ ঘোষ।
মারা গেলেন রজনীকান্ত সেন, রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন ঘোষ। মৃত্যুবরণ করেন লিও টলস্টয়, মার্ক টোয়েন।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান পল জোহান লুডউইগফন হেসে (১৮৩০ – ১৯১৪)। জার্মানির এই সাহিত্যিক একাধারে কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিক।
প্রাইজ দেওয়ার পক্ষে নোবেল কমিটি তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেন-
‘As attribute to the consummate artistry, permeated with idealism which he has demonstrated during his long productive carrier as a lyric poet, dramatist, novelist and writer of world renowned short stories.’
তাঁর বিখ্যাত রচনা হল—’দ্য অ্যাংরি ওমান’, ‘স্প্রিং টাইম’, ‘বার্থ অব ভনাস’, ‘এগেইনস্ট দ্য স্ট্রিম’।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ (৯-১১), ‘গোরা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ও ‘রাজা’ এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘তীর্থরেণু’। প্রকাশ পায় মনীন্দ্রনাথ বসুর উপন্যাস ‘সোফিয়া বেগম’, পূর্ণচন্দ্র দাসের ‘বন্দনা’ কাব্য। গলস্ওয়ার্দির ‘জাস্টিস’ ও বের্গস- এর টাইম অ্যান্ড ফ্রী উইল’ প্রকাশ পেল।
সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার প্রকাশ।
এ বছর দু’টি বাংলা বই নিষিদ্ধ হয়। বই দু’টি হল—সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’ ও তিলকের ‘মোকদ্দমা ও সংক্ষিপ্ত জীবনকথা’।