1 of 2

১৮. হেদোর পুকুরের এক ধারে

হেদোর পুকুরের এক ধারে জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন নামে কলেজ। এই পুকুরটি পানায় মজে গিয়েছিল, সম্প্রতি তার সংস্কার করা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী জমি সাফসুতরো করে লাগানো হয়েছে কিছু ফুলের গাছ, তারপর লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়ায় বেশ একটা উদ্যানের রূপ ধারণ করেছে। কলেজের ছেলের এখানে এসে সিগারেট-চুরুট ফুকতে ফুকতে কখনও শেলী-ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য, কখনও হিউম-হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শন নিয়ে তর্ক করে, আবার যোষিৎ-সংসর্গ বিষয়ক রসের আলোচনাও কম হয় না।

আজ মেঘলা মেঘলা অপরাহ্ন, কলেজ ছুটির পর অধিকাংশ ছাত্রই বাড়ি ফিরে গেছে, এক তরুণ যুবা উদভ্ৰান্তের মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে হেদোর বাগানে। কাছেই সিমলে পাড়ায় তার বাড়ি, অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্র দত্ত, এই কলেজের এক উজ্জ্বল ছাত্র। সে আগে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ত, মাঝে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় সেখানে পরীক্ষা দিতে পারেনি, জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভর্তি হয়ে এফ. এ. পাশ করেছে, এখন বি. এ. পাঠরত। নরেন্দ্ৰ যে শুধু ছাত্র হিসেবেই চৌখস তা নয়, তার কুস্তি করা সবল শরীর, লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা, ক্রিকেট খেলায় সে দক্ষ। এক প্রদর্শনীতে মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে সে একটা রুপের প্রজাপতি পুরস্কার পেয়েছে। সে রীতিমতন সুগায়ক, গান গাইবার জন্য অনেক জায়গায় তার ডাক পড়ে, পাখোয়াজ-এস্রাজের মতন অনেকগুলি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানে, বন্ধুদের মধ্যে প্রবল তার্কিক, আড্ডাপ্রিয়। অন্যান্য যুবকদের তুলনায় তাঁর জীবনীশক্তি যেন কয়েকগুণ বেশি, পুরুষ-দৃপ্ত মুখমণ্ডল, বড় বড় চক্ষু দুটিতে কখনও কৌতুক, কখনও স্পর্ধার ঝিলিক। নরেন্দ্র সচরাচর একা থাকে না, বন্ধুরা তাকে ঘিরে থাকে।

কিন্তু আজ কী হয়েছে নরেন্দ্রর, সে বন্ধুদের সংসর্গ পরিত্যাগ করেছে, আকাশের মেঘের মতন তার মুখেও কিসের ছায়া।

অন্যান্য দিন ছুটির পর সে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে বেণী ওস্তাদের কাছে গান শিখতে যায়। আহম্মদ খাঁর শিষ্য বেণী ওস্তাদের গৃহে সৰ্বক্ষণই যেন সুর গমগম করে, নরেন্দ্রকে সেখানে নিয়ম করে গলা সাধতে হয়। কোনও কোনও দিন ওস্তাদের গুরু আহম্মদ কী স্বয়ং উপস্থিত থাকেন, সেই সব দিনে হয় খেয়াল-ঠুংরির নতুন নতুন তানের চর্চা।

কিন্তু আজ নরেনের সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় ব্যায়াম করতে যেতেও তার ভালো লাগে, সেখানে তার বন্ধু রাখালের সঙ্গে দেখা হয়, আজ সে আখড়াতেও যাবে না নরেন্দ্র। ব্ৰাহ্ম-সমাজের প্রার্থনা ও সঙ্গীতআসরে যাবারও মন নেই, বরানগরে বন্ধুদের আড্ডাও তাকে টানছে না। সে আজ কোথাও যাবে না, বাড়িও ফিরতে চায় না।

বাড়িতে এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে, এফ এ পাশ করার পর থেকেই কন্যাদায়গ্ৰস্ত পিতাদের আনাগোনা চলছে। নামজাদা সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ছেলে, রূপবান-গুণবান, বিবাহ-বাজারে সে তো সুপাত্র হিসেবে বিবেচিত হবেই। কেউ দশ হাজার, কেউ কুড়ি হাজার টাকা পণ দিতে চায়, অতি সম্প্রতি এক কন্যার পিতা নরেন্দ্রকে বিলেত পাঠিয়ে আই সি এস কিংবা ব্যারিস্টার হবার প্রস্তাব দিয়েছেন। নরেন্দ্রর বাবা মা ও পেড়াপিড়ি শুরু করেছেন, কলেজে পড়ার সময়ই তো অধিকাংশ ছেলের বিয়ে হয়ে যায়, তারা পাত্রী দেখছেন নিয়মিত। বিবাহের কথা শুনলেই নরেন্দ্রর নাকটা কুঁচকে যায়। শুধু নিজস্ব জীবিকার ব্যবস্থা নয়, জীবন সম্পর্কে একটা দৰ্শন তৈরি করে নেবার আগেই ঝাপ করে একটা বিয়ে করে সংসারী হয়ে যায় নেহাত গাড়লেরা। এ জীবন তো রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা জিনিস নয়, দুলৰ্ভ এই মানবজন্ম, এর সার্থকতার পথ অন্বেষণ করা, চিত্তবৃত্তি বিকাশের জন্য যত্নবান না হয়ে গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে পশুর সঙ্গে তফাত রইল কি!

কাজল বৰ্ণ মেঘ সংক্ষিপ্ত করে সন্ধ্যাকে এগিয়ে আনে। মাঝে মাঝে শোনা যায় গুরুগুরু গর্জন। নরেন্দ্রর কিছুই খেয়াল নেই, সে উদ্দেশ্যহারা হয়ে ঘুরছে, মাঝে মাঝে নস্যি দিচ্ছে নাকে, থুতু ফেলছে যেখানে সেখানে। সে পরে আছে পায়জামা ও গোলগলা আচকান, পায়ে মোজা ও শু। বই-খাতা মোড়া একটা কাপড়ের থলি ঝুলছে এক হাতে।

হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গিয়ে সে লোহার রেলিং-এ মাথা ঠুকতে লাগল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল কী যেন! যেন তার ভিতরে একটা সাঙ্ঘাতিক কষ্ট হচ্ছে, নিজের কাছেই উত্থাপিত কোনও প্রশ্নের সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না বলে সে শাস্তি দিচ্ছে নিজেকে।

কেউ বাধা না দিলে মাথা ঠুকতে ঠকতে একটা রক্তারক্তি কাণ্ডই হয়ে যেত। একজন এসে হাত রাখল তার পিঠে।

আসন্ন ঝড় বৃষ্টির আশঙ্কায় এখন এই বাগানে আর কোনও মানুষজন নেই। সন্ধের পর দু’চারটি গাড়ি-ঘোড়া ব্যতীত এ অঞ্চলে লোকজন বিশেষ চলাচল করে না। একটি ছাত্র কলেজের প্রিন্সিপালের বাড়ির লাইব্রেরীতে পড়াশুনো করছিল, সে এখন ফিরছে এদিক দিয়ে। শীলদের বাড়ির ছেলে এই ব্ৰজেন্দ্ৰ অত্যন্ত মেধাবী, অল্প বয়েসেই পিতৃহীন, খুবই দরিদ্র অবস্থা, তবু শুধু মেধার জোরে সে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রিয় হয়েছে। নরেন্দ্রর মতন গান-বাজনা কিংবা খেলাধুলোর দিকে তার ঝোঁক নেই, সে এক গ্ৰন্থকীট। নরেন্দ্রর চেয়ে বয়েসে ছোট হয়েও সে পড়ে ওপরের ক্লাসে, অসুখের জন্য নরেন্দ্রর একটি বছর নষ্ট হয়েছে, দু’জনের বেশ বন্ধুত্ব আছে।

ব্ৰজেন্দ্ৰ বলল, এ কী নরেন, কী করছিস, কী করছিস?

নরেন্দ্র সচকিত হয়ে মাথা তুলল, তার ঘোর লাগা দৃষ্টি স্বাভাবিক হত সময় লাগল কিছু মুহূর্ত, ব্ৰজেন্দ্রকেও যেন সে চিনতে পারছে না, তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।

ব্ৰজেন্দ্ৰ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, অমনভাবে মাথা ঠুকছিলি, কী হয়েছে তোর?

নরেন্দ্র আস্তে আস্তে বলল, মাথার মধ্যে খুব ব্যথা করছিল। তাই ভাবলাম, এতে যদি কমে।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, মাথায় ব্যথা করছে, কবিরাজের কাছে যা-

বন্ধুর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে নরেন্দ্র কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। এমনিতে সে লজ্জা পাবার পাত্র নয়। সে রঙ্গপ্রিয়, বন্ধুদের নিয়ে সে-ই কৌতুক করে অধিকাংশ সময়ে।

স্বাভাবিক হবার জন্য সে আচকানের জেব থেকে নাস্যির ডিবে বার করে অনেকখানি নস্যি নিল দু’নাকে। তারপর একটা পেন্সিল দিয়ে সেই নস্যি ঠাসে দিতে লাগল ভেতরে।

ব্ৰজেন্দ্ৰ প্ৰায় শিউরে উঠে বলল, উঃ নরেন, অত নস্য নিস না। দেখলেও কেমন যেন লাগে!

নরেন্দ্ৰ বলল, কম নিলে মাথা পরিষ্কার হয় না। মাথাটা পরিষ্কার হলে যদি ব্যথাটা কমে!

ব্ৰজেন্দ্র বলল, শোনো পাগলের কথা! ওষুধ না খেয়ে নিজে নিজে নস্য-চিকিৎসা! তোর ব্যথাটা কী ধরনের রে?

নরেন্দ্র বলল, কপালে দুই ভুরুর মাঝখানটা দপ দপ করে। মাঝে মাঝে সেখানে যেন একটা আলোর শিখা জ্বলে ওঠে। তোদের এরকম হয়?

ব্ৰজেন্দ্র বলল, না! কপালে ও রকম আলো টালো জ্বলা কাজের কথা নয়। বড় রকমের কোনও ব্যামো হতে পারে, তুই ডাক্তার বদ্যি দেখা ভালো করে।

কথা নেই বার্তা নেই, হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে গেল। ব্ৰজেন্দ্র সাবধানী, সে বাদলার দিনে বগলে ছাতা রাখে। সে পরে আছে ধুতি আর কুর্তা, পায়ে শুঁড় তোলা তালতলার চটি। তাড়াতাড়ি ছাতা খুলে সে বলল, আয়, এর নীচে আয়। নরেন্দ্র বলল, আমার ছাতা লাগবে না, তুই মাথায় দে।

— বৃষ্টি ভিজলে যে সান্নিপাতিক হবে।

— আমার হবে না, তোর হবে!

— তোর যৌবনের তেজ আছে বটে। চল নরেন, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

— আমি তো এখন বাড়ি যাব না।

– তা হলে টঙে যাবি? চল সেই পর্যন্তই যাই!

দুই বন্ধু হেদোর বাগান থেকে হাঁটতে লাগল রাস্তা দিয়ে। ঝড় বৃষ্টির জন্যই বোধ হয় আজ গ্যাসের বাতি জ্বলেনি, বিদ্যুৎ-চমক পথ চিনতে হবে। দু’পাশে খোলা নর্দমা, পা হড়কে পড়ে গেলেই বিপদ। নর্দমা থেকে অনেক ক্রিমি কীট উঠে আসে রাস্তায়, খানা-খন্দও বাঁচিয়ে চলতে হয়। ব্ৰজেন্দ্ৰ বুঝেছিল, পার্কের রেলিং-এ নরেন্দ্রর এরকম মাথা কোটা মোটেই স্বাভাবিক নয়, কিছু একটা মানসিক অশান্তি চলেছে তার, এই সময় তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, কিছুদিন থেকে তোর একটা উড়ু উড়ু ভাব দেখছি, কী হয়েছে বল তো, নরেন? আগেপ্রায়ই আমাদের রান্না করে খাওয়াতিস, মোগলাই খানা, ফরাসি খানা, এখন তো আর ডাকিস না!

নরেন্দ্র বলল, আমার রান্নার শখ মিটে গেছে।

ব্ৰজেন্দ্ৰ বলল, তোর গান-বাজনাও অনেকদিন শুনিনি।

নরেন্দ্র কোনও উত্তর দিল না। বৃষ্টি আরও ঝোপে এসেছে, নরেন্দ্র সর্বাঙ্গে সিক্ত। এমন বৃষ্টির তোড়ে এক ছাতার নীচে দু’জন মাথা দিলে দু’জনকেই ভিজতে হবে, তাই নরেন্দ্ৰ ব্ৰজেন্দ্রের ছাতার অংশ নেবে না। ব্ৰজেন্দ্ৰও বাতাসের বেগে ছাতা সামলাতে পারছে না, তার পিঠ ভিজে যাচ্ছে, সে বন্ধুকে ডেকে একটি বড় বাড়ির পোর্টিকোর নীচে দাঁড়াল।

নরেন্দ্র আবার খানিকটা নাস্যি নিল নাকে।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, হ্যাঁ রে, নরেন, তুই নাকি দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে যাতায়াত শুরু করেছিস ; কিশোরীচাঁদ বলছিল-

এ প্রশ্নেরও কোনও উত্তর দিল না নরেন্দ্র।

ব্ৰজেন্দ্ৰ বলল, ব্ৰাহ্মদের উপাসনালয় থেকে কালীমন্দিরে? অবশ্য কেশববাবুর দলও যাতায়াত করছেন। আমাদের প্রিন্সিপাল মিঃ হেষ্টি কী বলেছিলেন একদিন, শুনেছিস? ওয়ার্ডসওয়ার্থের এক্সকার্শান কবিতাটা পড়ছিলেন, ছাত্ররা কবির অতীন্দ্রির অনুভবের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছিল না। অধ্যক্ষমশাই তখন বললেন, অনুভূতির তীব্রতার ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাঝে মাঝে ভাব-সমাধি হত। তোমরা যদি সেটা বুঝতে চাও, তা হলে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখে এসো গে। তার ওই রকম ভাব-সমাধি হয়। মানুষটি খুব খাঁটি। আমাদের ক্লাসের অনেক ছাত্র রামকৃষ্ণ ঠাকুরের নামই শোনেনি। সবাই তো আর কেশববাবুদের কাগজ পড়ে না। আমি হেষ্টি সাহেবের কথাটা শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলুম। কেশববাবুদের উচ্ছ্বাসের কারণ বোঝা যায়। ওঁরা আগে পরম ব্ৰহ্মকে পিতা বলতেন, এখন মাতা বানিয়েছেন। মা মা বলে কেত্তন গান করেন। কিন্তু হেষ্টি সাহেব খ্রিস্টান হয়েও এক কালীভক্তকে প্রশংসা করলেন! আমারও একবার রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখবার ইচ্ছে আছে। তুই তো দেখেছিস, লোকটি কেমন রে!

নরেন্দ্র বন্ধুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল অপলকভাবে। তারপর দ্বিধার সঙ্গে বলল, লোকটি কেমন… লোকটি কেমন… তা আমার পক্ষে বলা শক্ত, এখনও ঠিক বুঝতে পারি না।

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে নরেন্দ্র জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ব্ৰজেন, তুই তো অনেক লেখা পড়া করেছিস, তুই একটা কথা বল তো! যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে যা বিশ্বাস করে এসেছে, আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা যে ধর্মের বিধান আর সৃষ্টিকর্তার রূপ মেনেছেন, তা কি আমরা এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারি? যদি উড়িয়ে দিই, সেই অবিশ্বাসের যে শূন্যতা, তা সহ্য করা সম্ভব?

ব্ৰজেন্দ্ৰ বলল, দেখ নরেন, তোর মনের গতি আমি খানিকটা স্টাডি করেছি, আমার কী মনে হয় বলব? তুই ডেকার্তের অহংবাদ পড়েছিস, আবার হিউমের নাস্তিকতা, ডারউইনের বিবর্তনবাদ এসবও পড়েছিস! কিন্তু তোর মাথার মধ্যে রয়ে গেছে হিন্দু ঐতিহ্য। তুই যখন তর্ক বিতর্ক করিস, তখন কখনও মনে হয় তুই নাস্তিক, কখনও সংশয়বাদী, আবার কখনও যেন বেরিয়ে পড়ে যে, তুই যেন সেই ঈশ্বরকে খুঁজছিস, যিনি এই জড় জগৎ পরিচালনা করেন।

— তোর মনে এই প্রশ্ন জাগে না?

— না। দার্শনিক মীমাংসায় আমি ঈশ্বরের কোনও স্থান খুঁজে পাই না। যুক্তি দিয়ে আমি ঈশ্বরের কোনও প্রয়োজনও বোধ করি না। কিন্তু তোর কথা আলাদা। তুই এক সময় ধ্যান-ট্যান করেছিস, আবার সাহেবদের সংশয়বাদী লেখাও পড়িস, তারপরেও জানতে চাস, কেউ স্বচক্ষে ঈশ্বর দেখেছেন কিনা! সেইজন্য দেবেন ঠাকুরের কাছে গিয়েছিলি না?

নরেন্দ্ৰ চুপ করে রইল। সত্যিই সে একদিন ঝোঁকের মাথায় ছুটে গিয়েছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। দেবেন্দ্রনাথকে সবাই পূত চরিত্র, মহর্ষি বলে মনে করে। তিনি নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলবেন না। তিনি তখন চুঁচড়োর কাছে গঙ্গার ওপরে একটা বোটে থাকেন। নরেন্দ্ৰ সোজা সেই বোটে উঠে গিয়ে প্রথমেই সরাসরি প্রশ্ন করেছিল, আপনি কখনও ঈশ্বরকে নিজের চোখে দেখেছেন? সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি দেবেন্দ্রনাথ। এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তোমার চক্ষুদুটি যোগীর মতন। তুমি সাধনা করলে নিজেই একদিন উপলব্ধি করবে।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, আসল কথাটা কী জানিস, ঈশ্বর আছেন কি নেই, এ নিয়ে মাথা ব্যথা করার দরকারটাই বা কী? এই যে এত প্রার্থনা, ধ্যান, পুজো-আচ্চা, নামাজ পড়া, উপোস, মানুষের জীবনে এর কোনও প্রয়োজন আছে? এসব বাদ দিয়েও তো দিব্যি চলে যায়। অক্ষয় দত্ত মশাই অঙ্ক দিয়ে কী প্রমাণ করেছিলেন তুই দেখিসনি? উনি একটা ফর্মুলা দিয়েছিলেন। কৃষকরা সারাদিন পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে। তা হলে পরিশ্রম=ফসল। সেই সঙ্গে যদি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাও করে, তাহলে পরিশ্রম+প্রার্থনা=ফসল। অর্থাৎ প্রার্থনা = ০।

নরেন্দ্ৰ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, দুর শালা, এসব হল ফক্কুড়ির কথা! জীবন মানে শুধু চাষবাস আর মাগ ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘর করা নয়।

ব্ৰজেন্দ্র বলল, তুই অত রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে গিয়ে তোর কি নতুন কোনও উপলব্ধি হয়েছে? আমাকে খুলে বল না!

নরেন্দ্র বলল, এ শালার বৃষ্টি থামবার নাম নেই। তামাক খাইনি কতক্ষণ। চল, ছুটে চলে যাই। তুই ছুটতে না পারিস ছাতা মাথায় দিয়ে আমার পেছন পেছন আয়।

নরেন্দ্ৰ ছুটতে শুরু করে দিল, নিজের বাড়ির দিকে নয়, টঙের দিকে। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা মনে পড়লেই তাঁর ভুরু কুঁচকে যায়, মাথার মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হয়। এ ব্যাপারটা কারুকে ঠিক বুঝিয়ে বলাও যায় না।

রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে তো সে নিজে থেকে যায়নি। সে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী, যুক্তিহীন ভক্তিবাদও তার সহ্য হয় না। রামকৃষ্ণ ঠাকুর সম্পর্কে তার কোনও আগ্রহই ছিল না, কেশববাবুদের প্রার্থনা সভাতেও সে এখন আর যায় না, সে যায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের তরুণদের দলে। তাদের পাড়ায় সুরেন মিত্তিরের বাড়িতে একদিন রামকৃষ্ণ ঠাকুর এসেছিলেন। নরেন্দ্ৰকে এখন গান গাইবার জন্য অনেকেই ডাকাডাকি করে। সেদিনও সুরেন মিত্তিরের অনুরোধে নরেন্দ্র সে বাড়ির আসরে গিয়ে কয়েকখানা গান শুনিয়েছিল। সেদিন রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখে সে তেমন কিছু আকৃষ্টও হয় নি, বিশেষ কোনও কথাও বলেনি। শ্যামলা রঙের একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ, অঙ্গে গেরুয়া-টেরুয়া পরেন না, নরুন পাড় ধুতি পরা, গায়ে একটা উড়নি, কী যেন হাসির কথা বলছিলেন। সেই ঘরের মধ্যে খুব গরম ছিল, গান শুনিয়ে চলে এসেছিল নরেন্দ্র।

তারপর এই তো শীতকালের শেষ দিকের কথা। কোনও এক বড়লোকের বাড়িতে পাত্রী দেখতে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছিলেন বাবা-মা, বিরক্ত হয়ে চোটপাট শুরু করে দিয়েছিল নরেন্দ্র। সেই সময় তাদের এক আত্মীয় রামচন্দ্র দত্ত এসে উপস্থিত।

বাড়িতে এক ওরকম হাঙ্গামা দেখে রাম দত্ত নরেন্দ্রকে বললেন, বিলে, তুই এখান থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালিয়ে থাক না। আমার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে চল। গঙ্গার পারে ভারি মনোরম জায়গা। আমার ঠাকুরের দুটো উপদেশ শুনে দেখ তোর মনে লাগে কিনা। না মানলে না মানবি। তবে ওখানে গেলে তোর খারাপ লাগবে না। সেটা বলতে পারি।

যেতে রাজি হল নরেন্দ্র, তবে একা নয়, বরানগরের আড্ডা থেকে দু’জন বন্ধুকেও তুলে নিল ঘোড়ার গাড়িতে। কাচা রাস্তার দুপাশে ঝোপ-জঙ্গল, মাঝে মাঝে একটা দুটো বাড়ি। গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যাও কম। হঠাৎ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চুড়া দেখলে বেশ বিস্ময় জাগে। অনেকখানি এলাকায় ছড়ানো মন্দির প্রাঙ্গণ। শীতকালের নির্মল আকাশ, গঙ্গা থেকে হু হু করে আসছে উত্তুরে হাওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে নরেন্দ্র ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগল। মন্দিরের জন্য রানী রাসমণি হাত খুলে খরচ করেছেন। বাধানো ঘাটে অনেকখানি চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলে প্রশস্ত চাঁদনী, সেখানে কয়েকটি খাটিয়া, আম কাঠের সিন্দুক, দু’একটা লোটা ছড়ানো রয়েছে। কিছু সাধু-ফকির-বৈষ্ণবী বসে আছে এদিক ওদিক, মনে হল তারা আগে নিয়মিত প্ৰসাদ পায়। সিমেন্ট বাঁধানো পাকা উঠোনের একদিনে রাধাকান্তের মন্দির, অন্যদিকে কালীমন্দির। কালীমন্দিরের সামনে নাট মন্দির। চাদনীর এক পাশে দ্বাদশ শিবের মন্দির। তা ছাড়া ভাঁড়ার, ভোগ ঘর, অতিথিশালা, বলিদানের হাঁড়িকাঠ। এই এলাকার মধ্যে রয়েছে দুটি পুকুর, বাসন মাজার পুকুর আর হাঁসপুকুর, কাছেই মস্ত বড় গোশালা। আর একদিকে পঞ্চবটী উদ্যান।

উঠোনের উত্তর পশ্চিম কোণে থাকেন। শ্ৰীরামকৃষ্ণ ঠাকুর। ঘরটির এক পাশে একটি অর্ধবৃত্তাকার বারান্দা, সেই বারান্দায় দাঁড়ালেই অনেকখানি বিস্তৃত গঙ্গার রূপ দেখা যায়। বাগান-টাগান ঘুরে এসে নরেন্দ্র বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এই ঘরে প্রবেশ করল। এক দিকে একটি তক্তপোশের ওপরে বসে আছেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর, একটা ঠেঙো ধুতি পরা, কোমরের কষি আলগা, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা আলোয়ান জড়ানো। মেঝেতে মাদুর পাতা, সেখানে কয়েকজন লোক বসে আছে। এক কোণে একটা বড় গঙ্গাজলের জালা, সেখানে গিয়ে বসল নরেন্দ্র।

অন্যরা একটা দুটো প্রশ্ন করছে, তার মধ্যে রামচন্দ্র দত্ত রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গে নরেন্দ্রর পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন গায়ক হিসেবে। গায়করা যেখানেই যায়, সেখানে গান গাইতেই হয়। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের নরেন্দ্রর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, নরেন্দ্ৰ প্ৰথমে গাইল :

মন চল নিজ নিকতনে

সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে

ভ্ৰম কোন অকারণে?…

দ্বিতীয় গান :

যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে

আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে…

গাইতে গাইতে নরেন্দ্ৰ লক্ষ করল, ওই গেরুয়াহীন সাধুটির চক্ষু দুটি স্থির হয়ে গেল, শরীর যেন নিস্পন্দ। একেই ভাব-সমাধি বলে নাকি? ভান, না সত্যি?

গান শেষ হবার পর রামকৃষ্ণ আপন মনে বললেন, বাঃ বেশ গায় তো ছেলেটি।

তারপর তক্তপোশ থেকে নেমে হঠাৎ নরেন্দ্রর হাত ধরে বললেন, আয় তো আমার সঙ্গে।

নরেন্দ্র অবাক হয়েও উঠে দাঁড়াল। রামকৃষ্ণ তাকে টেনে নিয়ে এলেন পাশের বারান্দায়, শীতের বাতাস আটকাবার জন্য বাইরের খোলা দিকটা ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা। রামকৃষ্ণ দরজাটাও বন্ধ করে দিলেন, যাতে ওঁদের কোনও কথা ঘরের লোকেরা শুনতে না পায়, জায়গাটা আধা-অন্ধকার হয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে রামকৃষ্ণ নরেন্দ্র দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলেন, নরেন্দ্রর গা ছমছম করতে লাগল, কামড়ে টামড়ে দেবে নাকি। তারপর ভাবল, উনি বোধহয় নির্জনে তাকে কোনও উপদেশ টুপদেশ দিতে চান। তা এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলেই হবে।

উপদেশ দেবার বদলে উনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। খপ করে নরেন্দ্রর একটা হাত চেপে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। যেন তিনি নরেন্দ্ৰকে বহু দিন ধরে চেনেন। এইভাবে বলতে লাগলেন, ওরে, এতদিন পর আসতে হয়? আমি যে তোর জন্য কতদিন ধরে বসে আছি, তা একবারও ভাবিসনি? বিষয়ী লোকদের বাজে কথা শুনতে শুনতে কান ঝলসে গোল রে! প্ৰাণের কথা কারুকে বলতে পারি না বলে আমার পেট ফুলে থাকে, কেন আসিসনি আমার কাছে!

তারপর হঠাৎই আবার কান্না থামিয়ে হাত জোড় করে গদগদ কণ্ঠে বললেন, জানি আমি প্ৰভু। তুমি পুরাতন ঋষি, নবরূপী নারায়ণ…

নরেন্দ্ৰ স্তম্ভিত হয়ে গেল। এ যে দেখা যাচ্ছে বদ্ধ পাগল! সে বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন, তাকে ইনি এ সব কী বলছেন? পাগলের প্রলাপে বাধা দিলে আবার কী হয়। সে চুপ করে শুনতে লাগল।

একটু পরে কথা থামিয়ে রামকৃষ্ণ বললেন, এখানে দাঁড়া, কোথাও যাবি না।

দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে তিনি খানিকটা মাখন, মিছরি আর সন্দেশ নিয়ে এসে বসলেন, এগুলো খা—।

নরেন্দ্র বললেন, করেন কী মশাই, এগুলো আমি একা খাব কেন? ভেতরে বন্ধুরা রয়েছে, ওখানে গিয়ে ভাগ করে খাচ্ছি, দিন।

রামকৃষ্ণ বললেন, ওরা পরে খাবে। এসব তুই আমার সামনে খা।

মহা অস্বস্তিকর ব্যাপার। এ ভাবে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ গপ করে খাওয়া যায়? তাও আবার মিছরির সঙ্গে মাখন! কিন্তু একজন বয়স্ক লোক বারবার বলছেন, নরেন্দ্র কোনওক্রমে খেয়ে নিল। রামকৃষ্ণ আবার নরেন্দ্রর একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর ওই বন্ধুগুলি যেন কেমনধারা, তুই শিগগির একদিন একা আসবি? গভীর ব্যাকুলতার সঙ্গে বলতে লাগলেন, ঠিক আসবি তো? ঠিক আসবি? ঠিক আসবি…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *