পত্র-পত্রিকায় যাঁকে দুরন্ত ঝঞ্ঝা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেই স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির কিছু কিছু বিড়ম্বনা তো থাকেই, তা বোঝা যায়, কিন্তু এই তরুণ সন্ন্যাসীটি বুঝতে পারেননি যে, তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবার জন্য এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী তাঁকে কুক্ষিগত করে ফেলবে।
শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের শুধু উদ্বোধনী ভাষণে নয়, আরও অনেকগুলি আলোচনা চক্রে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতায় এক দারুণ আকর্ষণী শক্তি আছে। যে-সব সভায় অনেক বক্তা, সে-সব সভায় বিবেকানন্দেব ডাক পড়ে সবচেয়ে শেষে। অন্যান্যদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে শ্রোতাবা যখন ঝিমিয়ে পড়ে, অনেকে উঠে চলে যেতে শুরু করে, তখন উদ্যোক্তারা ঘোষণা করে, আপনারা বসুন, বসুন, এর পরে বলবেন স্বামী বিবেকানন্দ! অমনি সভামণ্ডপে নতুন উৎসাহের সঞ্চার হয়।
বিবেকানন্দ লিখিত ভাষণ পাঠ করেন না, তাঁর সমস্ত কথাই স্বতঃস্ফূর্ত। ইংরিজি উচ্চারণে কিছুটা আইরিশ টান থাকলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, অহেতুক উদ্ধৃতি বা পাণ্ডিত্যের কচকচি নেই, তাঁর চোখের দৃষ্টির মতনই তাঁর মুখেব বাক্যও প্রবল আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ধর্মীয় দর্শন এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবন, এই ধরনের গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও তিনি উৎকট গুরুগম্ভীর ভাব করেন না। তাঁর গুরুর নির্দেশ মতনই তিনি রসেবশে থাকেন, শুকনো সন্ন্যাসী নন।
শুধু প্রকাশ্য জনসভায় নয়, বিভিন্ন ঘরোয়া আসরেও তাঁর ডাক পড়ে, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাঁব কথা শোনে।
আমেরিকায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই সময়ের দাম আছে। যে যে কাজই করুক, সে প্রতিটি মিনিটের জন্য দাম পায়, কিংবা তাকে দাম দিতে হয়। বক্তৃতা, বিনা পয়সায় হয় না, বক্তা যেহেতু সময় ব্যয় করছেন, তাই সেই সময়ের দাম তাঁর প্রাপ্য, যারা শুনতে আসে, তারাও দাম দিতে দ্বিধা করে না।
স্বামী বিবেকানন্দের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে দেখে শিকাগোর শ্লেটন লাইসিয়াম ব্যুরো নামে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে তিন বৎসরের একটা চুক্তি করে ফেলল। তারা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই ভারতীয় সন্ন্যাসীর বক্তৃতায় ব্যবস্থা করবে, টিকিট বিক্রির টাকা বক্তা ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।
আপাতদৃষ্টিতে বিবেকানন্দের পক্ষে বেশ উপযোগী। তিনি ভারতের ধর্ম ও বাণী প্রচার করার জন্য এ-দেশে এসেছেন, সহসা ফিরে যাওয়ার জন্য কোনও মানে হয় না। তাঁর পক্ষে নানা শহরে ঘুরে ঘুরে হল ভাড়া করা, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে শ্রোতা সংগ্রহ কিংবা টিকিট বিক্রির ভার নেওয়া সম্ভব নয়। সে সব দাযিত্ব অন্যের ওপর চাপানোই শ্রেয়। তিনি বক্তৃতা দেবার পর কোথাও আশি ডলার, কোথাও একশো সাতাশ ডলার পেয়ে মনে করতে লাগলেন বেশ ভালই উপার্জন হচ্ছে। ডেট্রয়েটে এক দিনের বক্তৃতায় পেলেন ন’শো ডলার! ডলারের দাম এখন ভারতীয় মুদ্রায় তিন টাকা, সেই অনুযায়ী হিসেব কষলে এ তো অনেক টাকা! ভারতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি সারা বছরেও সাতাশ শশা টাকা রোজগার করে না।
কিন্তু সন্ন্যাসীর পক্ষে এবকম ভাবে অর্থ উপার্জন করা কি নীতিসম্মত? চুক্তিটি করার সময় বিবেকানন্দ আমেরিকায় তাঁব নবলব্ধ বন্ধুদের কার সঙ্গে পরামর্শ করেননি, দেশেও কারুকে জানাননি।
দেশের সঙ্গে, বিশেষত বাংলাব গুরু-ভাইদের সঙ্গে তাঁর অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ নামে এক হিন্দু সন্ন্যাসীর জয়বার্তা যখন একটু একটু করে কলকাতায় পৌঁছায়, তখনও শ্রীরামকৃষ্ণেব গৃহী বা সংসারত্যাগী শিরা কেউ বুঝতে পাবেননি যে, এই দিগ্বিজয়ী তাঁদের সেই নরেন। বিবেকানন্দ নামটাও তাঁদের কাছে অপরিচিত, নরেনের সমুদ্র পাড়ি দেবার ঘটনাও ছিল তাঁদের কাছে অজ্ঞাত। বিবেকানন্দ চিঠিতে যোগাযোগ বাখতেন শুধু তাঁব মাদ্রাজি ভক্ত আলাসিঙ্গা, খেতড়ির রাজা অজিত সিং ও আর দু একজনের সঙ্গে। এখন অবশ্য বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর গুরু-ভাইদের যোগাযোগ হয়েছে।
অর্থ উপার্জন করার ব্যাপারে বিবেকানন্দ একটা যুক্তি তৈরি করে নিয়েছেন। ভারতে একজন সন্ন্যাসী গাছতলায় শুয়ে বাত কাটিয়ে দিতে পারে, এই শীতের দেশে তা সম্ভব নয়। ভারতে সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখলে সাধারণ মানুষ পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় তাঁদের আহার্যের ব্যবস্থা করে দেয়। সে রকম প্রথা নেই এদেশে। এর মধ্যে বিভিন্ন পরিবারে তিনি আতিথ্য নিয়েছেন বটে। কিন্তু দিনের পর দিন তা সম্ভব নয়। মাঝে মাঝেই তিনি হোটেলে থাকতে বাধ্য হন। তাও সাধারণ হোটেল তাঁকে স্থান দেয় না, দামি হোটেলেই উঠতে হয়, সে খরচ কে দেবে! কিছু কিছু ব্যক্তিগত ব্যয়ও আছে, তামাকের নেশা তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না, দেশে হুঁকো টানা বেশ সস্তার ব্যাপার ছিল, এ দেশে চুরুটের খুব দাম, তেরো ডলার দিয়ে একটা পাইপ কিনে ফেলেছেন। তিরিশ ডলার খরচ হয়ে গেল একটা কালো রঙের কোট কেনার জনা। তা ছাড়া অনেক টাকা জমাতে হবে, সেই টাকা তিনি দেশে পাঠাবেন। শিল্প স্থাপন করতে না পারলে ভারতের দারিদ্র্যদশা কোনও দিন ঘুচবে না। তিনি এ-দেশীয় বন্ধুদের বলেন, আমি এ দেশে এসেছি দেশ দেখতে নয়, তামাশা দেখতে নয়, নাম করতে নয়, আমার দেশের দরিদ্র মানুষদের জন্য উপায় দেখতে। মনে মনে তিনি দেশে গিয়ে মানুষের সেবার জনা প্রতিষ্ঠান গড়ার কথাও ভাবছিলেন, তার জন্যও অর্থের প্রয়োজন।
কিন্তু দু-এক মাস যেতে না যেতেই বিবেকানন্দ বুঝলেন, ওই রকম একটা চুক্তির জালে আবদ্ধ হওয়া মারাত্মক ভুল হয়েছে। এদেশের ব্যবসায়ীরা ধর্ম বোঝে না, মানুষের সেবাকার্য নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা বোঝে শুধু মুনাফা। আর বিবেকানন্দের মতন একজন বিদেশি, অসংসারী, অনভিজ্ঞ মানুষকে ঠকিয়ে অতিরিক্ত লাভ করাও তাদের পক্ষে সহজ। বিবেকানন্দকে তারা চরকির মতন ঘোরাতে লাগল এক শহর থেকে আর এক শহরে, দিনের পর দিন বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হতে লাগলেন, কিন্তু তাতে পকেট ভরতে লাগল ওই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানেরই। এক সময় তিনি টের পেয়েও গেলেন যে, তিনি প্রতারিত হচ্ছেন। প্রশংসা ও নিন্দে দুটোই বাড়ার ফলে তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক জমছে, ততই তাঁর সম্পর্কে লোকের কৌতূহল বাড়ছে, দলে দলে লোক ছুটে আসছে তাঁর বক্তৃতা শুনতে। এক জায়গায়-টিকিট বিক্রি হল আড়াই হাজার ডলার, তার থেকে স্বয়ং বক্তা পেলেন মাত্র দুশো ডলার।
অথচ এই চুক্তির জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই, তা হলে তাকে অসম্ভব ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিন বছর ধরে যদি তাঁকে এরকম পরাধীন ভাবে বক্তৃতা দিয়ে ছুটে বেড়াতে হয়, তা হলে তাঁর জীবনীশক্তির কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
শিকাগো থেকে ম্যাডিসন ও মিনিয়াপোলিস, আয়ওয়া সিটি ও ডিময়েন, মেমফিস, সেখান থেকে একবার শিকাগোয় ফিরে আবার ঘোর শীতের মধ্যে ডেট্রয়েট, ওহায়োর আড়া নামে শহর, মিশিগানের বে সিটি ও স্যাগিননা, তারপর দক্ষিণের কিছু কিছু শহরে ঝার মতনই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এই তরুণ সন্ন্যাসী। তাঁর জীবনীশক্তি অপরিমিত হলেও এত পরিশ্রম সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ বলে বক্তৃতা দিয়েই যেতে হবে।
বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে তাঁর, ভারতের শাশ্বত বাণী এ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া তাঁর জীবনের ব্রত, তবু এক এক জায়গায় শ্রোতারা এমনই অদ্ভুত যে, সেখানে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলাই যায় না। আমেরিকার অধিবাসীরা জাগতিক ব্যাপারে প্রভূত উন্নতি করেছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ আমেরিকানই জগৎ সম্পর্কে অতিশয় অজ্ঞ। ভারতবর্ষের মতন এতবড় একটি দেশ সম্বন্ধে দু’চাবটি খারাপ কথা ছাড়া কিছুই জানে না। সম্রাট অশোক বা আকবর কিংবা রাজা রাজমোহনের নাম শুনেছে, এমন লোকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। ভারতীয়রা দরিদ্র, অতিশয় দরিদ্র, এইটুকু তারা জানে। কিন্তু এককালের ঐশ্বর্যময় ভারত এখন কেন দরিদ্র, তাদের জাতভাইরা যে ভারতের শোষণকারী, তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। এই ভারতেরই অনেক মানুষ যে স্বেচ্ছায় সংসারের সুখ সম্ভোগ ছেড়ে সন্ন্যাসীর জীবন বরণ করে, সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই।
বিবেকানন্দের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে প্রায় কেউই পারে না। কেন একজন মানুষের এরকম নাম, তা বোঝারও চেষ্টা করে না। তাদের ধারণা, এই লোকটির নাম হচ্ছে বিব। এবং এর পদবি কানন্দ্। এরা মিঃ কানন্দ্ মিঃ কানন্দ্ বলে ডাকে। বিবেকানন্দ অনেকবার বোঝাবাব চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে কোনও খনি বা কল কারখানা নিকটবর্তী অঞ্চলে বক্তৃতার ব্যবস্থা করে। এরা প্রাচ্যদেশীয কোনও মানুষ দেখেইনি, মাথায় পাগড়ি পরা একটি অদ্ভুত প্রাণী দেখার জন্যই এ দলে দলে এসে টিকিট কাটে। এদের সামনে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করাই যায় না।
বক্তৃতা শুরু কবতে না করতেই এই সব শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ চেঁচিয়ে বলে ওঠে, হেই মিঃ কানন্দ্, ওসব বড় বড় কথা শুনতে চাই না। তোমাদের দেশে শুনেছি, মায়েরা সন্তানের জন্মের পর নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কুমিরদের খাওয়াবার জন্য! একথা সত্যি?
বক্তৃতা থামিয়ে বিবেকানন্দ একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর স্মিতমুখে বলেন, আমার মা যে আমাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেননি, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন!
আর একজন বলল, ছেলেদের ছুড়ে দেয় না, শুধু মেয়েদের ফেলে দেয়।
বিবেকানন্দ বললেন, তাই নাকি। তা হলে নিশ্চয়ই কুমিররা মেয়ে সন্তানদেরই বেশি পছন্দ করে। মেয়েদের মাংস খুব নরম আর সুস্বাদু লাগে বোধহয় ওদের কাছে।
এতে একদল হেসে উঠলেও অনাদল সন্তুষ্ট হয় না। তারা বলে, হ্যাঁ, তোমাদের দেশের বাচ্চা মেয়েদের জলে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা জানি। তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।
বিবেকানন্দ বললেন, না, এড়িয়ে যাচ্ছি না। আমি ভাবছি, সব মেয়েই যদি কুমিরের পেটে যায়, তা হলে পুরুষ সন্তানরা জন্মায় কী করে?
অন্য একজন উঠে দাঁড়িয়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, বাচ্চা মেয়েদের জলে ফেলে দেওয়া হোক বা না হোক, স্বামী মরে গেলে তোমাদের দেশের বিধবাদের জোর করে পুড়িয়ে মারা হয়, এটা সত্যি। নিশ্চয়ই সত্যি। আমি অনেক বইতে ছবি দেখেছি।
বিবেকানন্দ বললেন, হ্যাঁ, এটা মিথ্যে নয়। এখন আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এক সময় কিছু কিছু বিধবা স্বামীর চিতায় পুড়ে মরেছেন, এ কথা সত্যি। দু চার জায়গায় জোর করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা হত। তবু কোনও বিধবা মোহের বশে জিদ ধরলে তাঁকে আগে আগুনে হাত দিয়ে পরীক্ষা দিতে হত। আমি এ ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছি। এবার প্রশ্ন করি, আপনারা জোন অব আর্কের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? এই তো মাত্র সেদিন ফরাসিদেশে তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল! তাই না?
এরা কেউই জোন অফ আর্কের নাম শোনেনি, তাই চুপ করে যায়।
বিবেকানন্দ আবার বলেন, মধ্যযুগের ইওরোপের খ্রিস্টানরা কত শত শত অসহায় মেয়েদের ডাইনি বলে কাঠের দণ্ডে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের কথা শোনেননি?
দর্শকদের মৃদু গুঞ্জনের মধ্যে তিনি আবার জোর দিয়ে বলে ওঠেন, এই ধরনের ধর্মান্ধতা সব দেশেই আছে শুধু এবম দু’ একটি ঘটনা দিয়ে কোনও দেশকে বিচার করা যায় না। একজন ফরাসি বা ইংরেজকে দেখলেই কেউ এখন জোন অব আর্কের কথা জিজ্ঞেস করে না। একজন ভারতীয়কে দেখলেই বা কেন সতীদাহের প্রসঙ্গ ভোলা হবে!
শুধু খনি-শ্রমিক বা কারখানার মানুষরাই নয়, অনেক গিজায়, অনেক উচ্চাঙ্গের ক্লাবে, অনেক শিক্ষিতদের সমাবেশেও এই ধরনের প্রশ্ন নিক্ষিপ্ত হয় তাঁর দিকে। একদল লোক এই সব প্রশ্নের উত্তরও চায় না, ভারত সম্পর্কে কুৎসাগুলি অন্যদের শোনানোই তাদের উদ্দেশ্য। একদিন বিবেকানন্দ এই রকম একটি সমাবেশে বলে ফেললেন, পশ্চিমি দেশগুলির একদল অত্যুৎসাহী প্রাচ্যদেশ সম্পর্কে যত নিন্দা আর অপপ্রচার করেছে, ‘ভারত মহাসাগরের তলদেশের সমস্ত কাদা পাশ্চাত্যের দিকে ছুঁড়ে মারলেও তার যথেষ্ট প্রতিশোধ হয় না। কিন্তু আমি এ দেশে কাদার বদলে কাদা ছুঁড়তে আসিনি।
বহু যথার্থ ভোগবাদবিমুখ নারী-পুরুষ অবশ্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিবেকানন্দের অধ্যাত্মবাদের কথা মন দিয়ে শুনেছে এবং তাঁর ভক্ত হয়েছে। ভক্তের সংখ্যা বাড়লে শত্রুর সংখ্যাও বাড়ে।
শিকাগোর ধর্মসভায় অন্য যে-সব ভারতীয় যোগ দিতে এসেছিলেন, তাঁরাও বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছেন এবং শ্রোতাও পেয়েছেন। কিন্তু বিবেকানন্দের মতন তাঁরা এমন স্পষ্ট বক্তা নন, তাঁরা উচ্চাঙ্গের কথা বলেছেন বটে কিন্তু বিবেকানন্দর মতন এমন মতবিরোধের সৃষ্টি করেননি, এমনভাবে মিশনারিদের সঙ্গে জ্বালা ধরাননি। বিবেকানন্দ পত্র-পত্রিকায় সবচেয়ে বেশি আলোচ্য, আমেরিকার প্রায় সব গির্জায় গিজায় তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার চলছে। এই সবই জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে, এবং তাতে অন্য বক্তাদের ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন অনেক। প্রতাপ মজুমদার প্রথম দিকে বিবেকানন্দের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করেছিলেন, পরে বিবেকানন্দকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি তাঁর ঠিক সহ্য হল না। তিনি তাঁর কাছাকাছি মানুষদের বলে বেড়াতে লাগলেন যে, ও ছেলেটা তো গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, ওর কথাগুলি তো সমস্ত ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাবের প্রতিফলন হতে পারে না, কারণ হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে ওকে তো প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়নি। ও একটা ভূঁইফোড়!
প্রতাপ মজুমদার দেশে ফিরে যাবার পর সেখানকার দু’একটি পত্র-পত্রিকায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে কটু কথা প্রকাশিত হতে লাগল। নরেন দত্ত নামে একটি ছোকরা ব্রাহ্মদের থিয়েটারে গান গাইত, ওর আবার ধর্মীয় নেতা হবার যোগাতা হল কী করে? কেশবচন্দ্র সেনও থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, তাঁর ধর্মগুরু হতে কোনও আপত্তি ওঠেনি, সে কথা এঁরা মনে রাখলেন না। বিবেকানন্দ সম্পর্কে আরও বলাবলি হতে লাগল যে, সন্ন্যাসীর ভেক ধরে সে আমেরিকায় ব্যভিচারী হয়েছে, সর্বদা চুরুট ফোঁকে। পানাহারের কোনও বাছ-বিচার নেই, অখাদ্য কুখাদ্য খায়, নারীঘটিত দুর্বলতাও আছে।
এসব খবর বিবেকানন্দের কাছে এসে পৌঁছোয়, তিনি প্রতিবাদ করতে চান না, কিন্তু ব্যথিত হন। তাঁর মনে পড়ে, বৃদ্ধা মায়ের কথা। মা শত আপত্তি সত্ত্বেও ছেলেকে ব্রহ্মচারী হতে দিয়েছেন, এই জ্যেষ্ঠ সন্তানটির প্রতি তাঁর অনেক আশা-ভরসা, এখন যদি মা শোনেন যে সেই ছেলে দূর বিদেশে গিয়ে অনাচারী হয়েছে, তা হলে তিনি কষ্ট পাবেন। মা কি বিশ্বাস করবেন শেষ পর্যন্ত?
আর একজন ভারতীয় এই সময় আমেরিকায় বেশ প্রভাব বিস্তাব করেছেন। তিনি একজন মহিলা, সবাই তাঁকে বলে পণ্ডিতা রমা বাঈ। মহারাষ্ট্রের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে এই রমা বাঈয়ের জন্ম, তাঁর বাবা তাঁকে উত্তমরূপে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন এবং যৌবন উদগমেই রমা বাঈ উন্নত মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে তিনি একটি বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়েন, সে যুবকটি ছিল অব্রাহ্মণ। এক অব্রাহ্মণ তনয়ের সঙ্গে এক ব্রাহ্মণ কন্যার প্রণয় বিবাহে এক সময় বেশ শোরগোলের সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু ওদের বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, যুবকটি অকালে মারা যায়। বিধবা রমা বাঈ কিছুদিন পরে ইংল্যান্ডে চলে আসেন এবং সেখানে আরও বিদ্যাচর্চা করে তাঁর পণ্ডিতা উপাধিটি সার্থক করেন এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। দেশে ফিরে এসে তিনি হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থা নিবারণের কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দেন।
রমা বাঈয়ের এই সেবামূলক কাজ অবশ্য মহারাষ্ট্রের অনেকে সুনজরে দেখেনি। বিধবা আশ্রম গড়ার জন্য তাঁকে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হত, এবং মিশনারিদের প্রভাবে অনেক বিধবাই হিন্দু ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ এটাই প্রতিভাত হতে লাগল যে, হিন্দু বিধবাদের দুঃখ-কষ্ট মোচনের একমাত্র উপায় ধর্মান্তর। মহারাষ্ট্রের গোড়া হিন্দুদের এটা পছন্দ হবার কথা নয়। বাল গঙ্গাধর তিলক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ওকে সবাই পণ্ডিতা বলে কেন, ওর নাম হওয়া উচিত রেভারেন্ডা রমা বাঈ!
আমেরিকায় রমা বাঈয়ের কাজের সমর্থনে ও সাহায্যকল্পে অনেকগুলি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। রমা বাঈ সার্কল নামে এ রকম পঞ্চান্নটি প্রতিষ্ঠান। তারা ঘন ঘন প্রকাশ্য জনসভা ও আলোচনাচক্রে ভারতীয় বিধবাদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে চাঁদা তুলত ভারতে পাঠাবার জন্য। চাঁদা তুলতে গোলে নানারকম মর্মন্তুদ কাহিনীর অবতারণা করতে হয়। সেইসব কাহিনীর মধ্যে অনেক রগরগে গল্পও এসে পড়ে। শুনতে শুনতে উপস্থিত জনসাধারণ শিউরে ওঠে, তারা মনে করে, ভারত এমনই এক বর্বরদের দেশ, যেখানে লক্ষ লক্ষ বালবিধবা পুরুষদের পায়ের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে।
বিবেকানন্দর বক্তৃতার আসরে কিছু লোক কুমিরের মুখে শিশু বিসর্জন, সতীদাহ, ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিধবাদের প্রতি অত্যাচারের প্রসঙ্গও তোলে। এগুলো তো মিথ্যে হতে পারে না, বিবেকানন্দর স্বদেশবাসীরাই তো এইসব কথা বলেছে, শুধু রমা বাঈয়ের দল নয়, ব্রাহ্মরাও বলে।
বিদেশে এসে স্বদেশের নানান দূর্বলতার কথাই শুধু তুলে ধরা বিবেকানন্দর ঘোর অপছন্দ। নিজের দেশের কিছু কিছু কুৎসিত রীতিনীতির কথা স্বীকার করতে তাঁর লজ্জা নেই, সেই সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও তো কত খারাপ প্রথা আছে, তাও বলা হবে না কেন? যিশুর নামে করুণার বাণী যারা প্রচার করে, সেই খ্রিস্টানরা বর্বর শক্তি দিয়ে এক একটা দেশকে পদানত করেনি? ধর্মের নামে বারবার রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেয়নি? এই খ্রিস্টানরাই বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা দেয়নি? গ্যালিলিও-কে বন্দি করেছিল কারা? এরাই ভারতে মদ আর চিনে আফিং-এর প্রচলন করায়নি বাবসার স্বার্থে?
আমেরিকানরা ধনমদে মত্ত হয়ে চূড়ান্ত নীতিহীনতার পরিচয় দেয়, তারাই আবার অন্য দেশের ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের নিন্দা করে কোন মুখে! বিবেকানন্দ এক এক সময় তীব্র ভাষায় বলে। উঠেছেন হ্যাঁ, আমাদের দেশে ধর্মান্ধতা আছে, কুসংস্কার আছে। আমরা যখন ধর্মান্ধ হই, আমরা জগন্নাথদেবের বিরাট রথের চাকার সামনে লাফিয়ে পড়ে নিজেরাই নিষ্পেষিত হই, নিজেদের গলায় ছুরি দিই কিংবা কণ্টকশয্যায় শুই। আর তোমরা যখন ধর্মান্ধ হও, তখন তোমরা অপরের গলায় ছুরিচালাও, অন্যদের আগুনে পোড়াও, তাদের জন্য কণ্টকশয্যা তৈরি করো। নিজেদের চামড়া তোমরা সাবধানে বাঁচিয়ে চলো।
বিধবাদের প্রসঙ্গেও বিবেকানন্দ বললেন, হ্যাঁ, বহুকাল ধরে ভারতের বিধবাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তা মিথ্যে নয়। কিন্তু তা বলে অতিরঞ্জন আমি সহ্য করব না। অবস্থা কি কিছু পাল্টায়নি? আইন অনুযায়ী বিধবাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে কোনও বাধা নেই। অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে স্বামীর সম্পত্তিতেও তাদের জীবনস্বত্ব থাকে। সমাজের উঁচু শ্রেণীতে বিধবাদের বিয়ে হয় না, কারণ সেখানে পুরুষদের সংখ্যা বেশি, পুরুষের ক্ষমতাও বেশি, কিন্তু নিম্নস্তরে বিধবাদের আকছার বিয়ে হয়। এখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবা বিবাহ কি সারাদেশেই আইনসম্মত হয়নি? উঁচু-নিচু যে-কোনও স্তরের বিধবাদেরই আবার বিয়ে হতে পারে। বিধবাদের অবস্থা বর্ণনা করার সময় এসব কথাই বা বলা হবে না কেন?
রমা বাঈ চক্রের সঙ্গে বিবেকানন্দর বিরোধ শুরু হয়ে গেল।
বিধবাদের অবস্থা যদি অতটা ভয়াবহ ও বীভৎস মনে না হয়, তা হলেই চাঁদা কম ওঠে। সুতরাং ওই বিবেকানন্দ নামে উটকো লোকটা, ভারতে যার নাম কেউ কোনওদিন শোনেনি, ওর মুখ বন্ধ করা দবকাব। বিবেকানন্দর বিরুদ্ধে অপপ্রচার বাড়তে বাড়তে চুড়ান্ত জায়গায় পৌঁছল। এমনও বলা হল যে ওই লোকটা একটা বোহেমিয়ান, আত্মসংযম বলতে ওর কিছু নেই। শ্রীমতী ব্যাগলি শিকাগোর এক বিশিষ্ট পরিবাবের বর্জী, তিনি বিবেকানন্দকে কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ এমনই দুশ্চরিত্র যে ও-বাড়ির একটি যুবতী চাকরানি ওর অত্যাচারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
শ্রীমতী বাগলি অবশ্য এই অভিযোগ শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলেন। একাধিক চিঠিতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে ওই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে তো বটেই, বিবেকানন্দের মতন এমন উন্নত চবিত্রের মানুষ আর তিনি দেখেননি। তার দাস-দাসীরা কেউ কোনওদিন তাঁদের ছেড়ে যায়নি, অভিযোগকাবরা যে তরুণীর নাম করেছে, ওই নামে কারুকে তিনি চেনেন না, ওরকম কোনও দাসী ও তাঁর বাড়িতে কখনও কাজ করেনি।
অর্থই যত অনর্থের মূল। মিশনারিরাও যে বিবেকানন্দের ওপর খঙ্গহস্ত হয়েছিল, তার কারণ তাদেরও চাঁদা কমে যাচ্ছিল হু হু করে। বিবেকানন্দর বক্তৃতা শুনে অনেকেরই ধারণা হচ্ছিল যে, যে-দেশে এমন উচ্চ ধর্মীয় ভাব আছে, সে দেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য মিশনারি পাঠাবার কী দবকার? চাঁদার পরিমাণে এক বৎসরে কমে গিয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। খ্রিস্টান মিশনাবিদের আয় কমে যাচ্ছে, আর বিবেকানন্দ ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে প্রচুর ডলার পকেটস্থ করছে! লোকটাকে প্রাণে মারলেও যেন গায়ের ঝাল মেটে না। একজন সন্ন্যাসীকে বাতিল করার শ্রেষ্ঠ উপায় তার চরিত্রহনন। পাদ্রিরা বিভিন্ন পরিবারে বেনামি চিঠি পাঠাতে লাগল, খবরদার ওই দুশ্চরিত্র লোকটাকে তোমাদের বাড়িতে স্থান দিয়ো না।
অন্যরা ভাবছে বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করছেন, কিন্তু তিনি নিজে যে এ কাজ আর একেবারেই পছন্দ করছেন না, তা কেউ জানে না। সাকসের ক্লাউনের মতন ব্যবসায়ী তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাচ্ছে। বক্তৃতার পর বক্তৃতা, যেন মুখে রক্ত উঠে আসছে। আবার একটা নতুন শহরে গিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে ভাবলেই বিভীষিকা জাগে। রাত্রে ভাল ঘুম হয় না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি পরবর্তী বক্তৃতার বিষয় আওড়ান। চুক্তির হাত থেকে রেহাই পাবার কি কোনও উপায় নেই?
বক্তৃতা দেবার সময় শুধু যে উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তাই-ই নয়, অন্য রকম বিপদও ঘটে। একবার পশ্চিমের একটি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার সময় বিবেকানন্দ বলেছিলেন, প্রকৃত সত্যের উপলব্ধি যার ইয, তিনি পারিপার্শ্বিকের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করেন, বাইরের কিছুতেই তিনি বিচলিত হন না। ছাত্রদের মধ্যে ছিল কিছু কাউ বয়। তারা ওই কথা শুনতে শুনতে বলল, বটে! তাই নাকি?
পরীক্ষা করার জন্য তারা বিবেকানন্দকে নিজেদের র্যাঞ্চে নিয়ে গেল বক্তৃতা দেওয়াবার জন্য। একটা মস্ত বড় কাঠের টক উল্টে দিয়ে বলল, মশাই, এটার ওপর দাঁড়িয়ে আপনার ওই সব বড় বড় ভাবেব কথা শোনাতে পাববেন?
আপত্তি করে লাভ নেই। মোগলের হাতে পড়লে যেমন এক সঙ্গে বসে খানা খেতেই হয়, সেই রকমই কোমরবন্ধে পিস্তল ঝোলানো কাউবয়দের কথা অগ্রাহ্য করা চলে না। টাটার ওপর উঠে ঢািলে সেটা ঢকঢক করে নডে। এই অবস্থায় মনঃসংযোগ করে কথা বলা যায় না। বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন যে এই দুর্দান্ত প্রকৃতির ছেলেগুলি তাঁকে আরও কিছু বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। বক্তৃতা শোনার জন্য এবা পয়সা দিয়েছে, তা উশুল না করে ছাড়বে না।
তিনি দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে শুরু করলেন ভাষণ।
হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ হল, তাঁর কানের পাশ দিয়ে একটি পিস্তলের গুলি বেরিয়ে গেল। বিবেকানন্দ বিচলিত হবার কোনও লক্ষণ দেখালেন না। এরা যদি তাকে মেরে ফেলতে চাইত, তা হলে একটি গুলিই যথেষ্ট ছিল, কাউবয়দের হাতের টিপ অব্যর্থ। ভয় দেখানোই এদের উদ্দেশ্য, ভয় পাওয়া মানেই পরাজয়।
কিছুদিন আগে রবার্ট ইঙ্গারসোল নামে এক প্রসিদ্ধ বক্তার সঙ্গে বিবেকানন্দের আলাপ হয়েছিল। ইঙ্গারশোল প্রচণ্ড নাস্তিক এবং মানুষের মন থেকে ধর্মের নামে নানাবিধ সংস্কার দূর করাই তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর এই ধরনের বক্তব্য প্রচার করতে গিয়ে বহুবার তাঁকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি আমেরিকান, এদেশের বুকে দাঁড়িয়ে তিনি মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের দাবি করতে পারেন সদর্পে। বিদেশি হয়ে বিবেকানন্দ কখনও আমেরিকানদের জীবনযাত্রা পদ্ধতির সমালোচনা করেন শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন, স্বামীজি, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। পঞ্চাশ বছর আগে হলে আপনাকে এর ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিত কিংবা পুড়িয়ে মারত। এখনও অনেক জায়গায় লিঞ্চিং হয়। অশ্বেতকায়দের দক্ষিণাঞ্চলে পাথর ছুড়ে মারে যখন তখন।
বিবেকানন্দ হেসে বলেছিলেন, আমি আপনার মতন ধর্মদ্বেষী নই। যিশুখ্রিস্টকেও আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। আমাকে এরা মারবে কেন?
মুখের একটি রেখাও কুঞ্চিত হল না, বিবেকানন্দ সেই বেপরোয়া কাউবয়দের সমাবেশে ভাষণ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বক্তব্যকে তিনি সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে আনলেন না, তিনি বলতে লাগলেন উচ্চ মার্গের জীবনদর্শনের কথা। এরা কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, তিনি বিচ্যুত হবেন না তাঁর কেন্দ্র থেকে।
আরও কয়েকবার বিকট শব্দে গুলি ছুটে গেল তাঁর মাথার দুপাশ দিয়ে। শেষের দিকে তিনি যেন সে শব্দ আর শুনতেই পেলেন না, গুরুর নাম স্মরণ করে একাগ্র হয়ে রইলেন তিনি।
বক্তৃতা শেষ হবার পর সেই যুবকরা পিস্তল খাপে খুঁজে ছুটে এল এই হিন্দু স্বামীজির সঙ্গে করমর্দন করার জন্য। প্রকৃত সাহসীর তারা সম্মান দিতে জানে।
তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বিবেকানন্দ মৃদু হাস্য করতে লাগলেন। আর কত পরীক্ষা দিতে হবে?