তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাই করতে গেল বোধহয়।
মল্লিনাথের এই ঘরখানায় বসে হারানো বহু স্মৃতিই মনে পড়ার কথা। আশ্চর্য, দীপনাথ একবারও মল্লিনাথের কথা ভাবল না! তার শরীর বার বার কাঁটা দিল এক শিহবনে। মণিদীপা তার খোঁজ করছে।
সত্য বটে দীপনাথের ভিতরে এক সময় ইস্পাত ছিল। তাদের সব ভাইবোনের মধ্যেই কিছুটা করে আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে মেজদা শ্রীনাথ। কিন্তু দীপনাথের সেই ইস্পাতই বা কোথায় গেল?
ভিতর থেকে দীর্দাশ্বাস ফেলে অন্য এক দীপনাথ বলল, জং ধরে গেছে হে!
দীপনাথ বলল, অত সস্তা নয়। আমি সহজে হার মানি না।
হার মেনেছ কে বলল? বরং তথ্য বিশ্লেষণ করে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, তুমি ভয় করেছ! হার মেনেছে অন্য পক্ষ।
ইয়ারকি নয়! আমি কারও প্রেমে পড়িনি।
তাও বলা হচ্ছে না। ঘুরিয়ে বলতে গেলে অন্য পক্ষই পড়েছে। তাতে তো তোমার দোষ ধরা যায় না।
অন্য পক্ষের দায়-দায়িত্ব তো আমি নিতে পারি না। কে কবে কার প্রেমে পড়বে আর দোষটা আমার ঘাড়ে চাপাবে–
ধীরে বন্ধু, ধীরে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবব। মণিদীপার বয়স কত বলো তো?
কে জানে? কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে বোধহয়।
তা এ বয়সে আজকালকার মেয়েদের খুকিই বলা যায়।
যত খুকি ভাবছ তত নয়।
তবু বলছি ততটা পাকেনি এখনও। মনটা কাঁচা আছে। জাম্বুবান স্বামীটার জন্য একটা আনহ্যাপি লাইফ লিড করতে হচ্ছে বলে রাগে আক্রোশে প্রতিহিংসায় মাথাটাও ঠিক নেই কিনা।
মিস্টার বোসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই মহিলাও যে সাংঘাতিক বিপ্লবী।
স্বামী সিমপ্যাথিটিক হলে বিপ্লবটা এমন চাগিয়ে উঠত না মাথার মধ্যে। যাকগে যা বলছিলাম, মিসেস বোসের কাচা মাথাটা খাওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না। তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলেও খেতে পারত।
এই কথায় দীপের একটু অভিমান হল। বলল, তা হতে পারে। তবে মাথাটা আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই।
একেবারেই নেই কি?
মোটেই নেই।
তা হলে বা তুমি মুক্ত পূৰুয। অত লজ্জা শরম পাচ্ছ কেন?
আমি মুক্ত পুরুষই।
তবু বলছি, ভিতরকার মরচে-পড়া ইস্পাতে একটু শান দাও। শক্ত হও। নইলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। চাকরিও নট, মণিদাপাও নট।
যায় যাক। পরোয়া করি না।
চাকরিব পরোয়া কবো না করো, মণিদীপার পরোয়া একটু-আধটু করছ, উনিও করছেন। বউদির চোখে ধরাও পড়ে গেছে। এখন বেশ সাবধানে পা ফেলো।
আমার কোন দুর্বলতা নেই। এই মুহূর্তে সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
বলে দীপনাথ খুব বুক চিতিয়ে উঠে এল। আর সেই মুহূর্তেই মল্লিনাথের বার্মা সেগুনের বিশাল আলমারির গায়ে লাগানো খাঁটি বেলজিয়াম আয়নায় তার আপাদমস্তক প্রতিবিম্ব সামনে দাঁড়াল।
ব্যায়াম-ট্যায়াম করে এবং দৌড়ঝাপের মধ্যে থেকে তার চেহারাটা হয়েছে গুন্ডা শ্রেণির। খুবই শক্তপোক্ত। লম্বাটে আখাম্বা। মুখশ্রীতে কিছু রুক্ষত সত্ত্বেও বংশগত লাবণ্য কিছু রয়ে গেছে। চেহারাটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সে। বেশ খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে মন থেকে এক বিচারপতি রায় দিল, এই চেহারার পুরুষ মানুষের প্রেমে পড়তে কোনও মেয়েরই বাধা নেই।
ভালই গো ভালই। অত দেখতে হয় না নিজেকে।–বলে তৃষা পিছন দিকে একটা টুলের ওপর খাবারের রেকাবি রাখল।
খুবই চমকে গিয়েছিল দীপনাথ। হেসে ফেলে বলল, চেহারা নয়। আয়নাটা দেখছিলাম। খাঁটি বেলজিয়াম গ্লাস।
তৃষা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ, আজকাল আর এসব জিনিস পাওয়া যায় না।
দীপনাথ আবার একটু অস্বস্তিতে পড়ে। জিনিসটা বড়দার। বউদি আবার ভাবল না তো, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব জিনিসের ওপর দাবিদাওয়া রাখছি?
সে তাড়াতাড়ি বলল, অত সব কী এনেছ? লাঞ্চ আছে যে!
তৃষা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, এসে থেকেই তো বাপু কেবল শুনছি লাঞ্চ আর লাঞ্চ। ওসব সাহেবি কেতার লাঞ্চ কী রকম হয় তা একটু-আধটু জানি বাপু। ওখানে তুমি কম খেলে না বেশি খেলে, ফেললে না রাখলে তা কেউ খেয়ালও করবে না। এসব আমাকে শিখিয়ো না।
কথাটা ঠিক। দীপনাথ যদি বুফে লাঞ্চে একটা পদ নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তা হলেও কেউ লক্ষ করবে না। তা ছাড়া লাঞ্চের আগেই সকলে নিরাপদ রকমের মাতাল হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। তাই সে প্লেটের সামনে বসে বলল, তা বটে। খেয়াল ছিল না।
তৃষা মুখ টিপে হেসে বলে, ভেবো না, উনিও পেট ভরে খেয়েছেন। লাঞ্চ নিয়ে মণিদীপার একটুও মাথাব্যথা নেই। এমনকী যেতে চাইছেন না।
সর্বনাশ! না গেলে পরস্ত্রী হরণের দায়ে পড়ে যাব, বউদি।
পড়ে যাবে কেন ভাই? পড়ে অলরেডি গেছ।
তার মানে?
ভাল চাও তো এদের কনসার্নে চাকরি আর কোরো না।
দীপনাথ আবার লাল হয়ে একটা লুচি ছিড়ে দুই টুকরো করে বলে, তুমি না একদম বাজে।
তৃষা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, তুমিই বা কেন এরকম কিম্ভূত? দেশে কুমারী মেয়ের তো অভাব নেই, তবে এই কচি বউটার মাথা খেয়ে বসে আছো কেন?
দীপনাথ এবার স্পষ্টতই একটু বিরক্ত হয়। তেতো গলায় বলে, এ যুগটা তোমাদের যুগের মতো নয় বউদি। এখনকার মেয়েরা অত সহজে প্রেমে পড়ে না। মণিদীপার তুমি কী বেহেড অবস্থা দেখলে?
তৃষা হেসে ফেলে বলে, ঠাট্টা বোঝো না, তুমি কেমন হয়ে গেছ বলো তো!
ঠাট্টা! হতেও তো পারে। দীপনাথ আবার লাল হয়। বলে, বসের বউ নিয়ে ইয়ারকি নয়। কানে গেলে সর্বনাশ।
তৃষা নীরবে একটু হাসে। বলে, প্রেমে পড়েছে এমন কথা কিন্তু একবারও বলিনি। বরং বলছিলাম, বসের বউকে ভাল জপিয়ে নিয়েছ। টক করে প্রোমোশন পেয়ে যাবে।
জপিয়েছি তাই বা বলছ কী করে?
ওসব বোঝা যায়।
তবে তুমিই বোঝো যাও।
রাগ করলে নাকি গো!–বলে তৃষা আবার গা জ্বালানো হাসি হাসে। বস্তুত একমাত্র এই দেওরটির কাছেই সে বরাবর একটু তরল। শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ির আর কারও সঙ্গে তার কোনও ঠাট্টা বা ইয়ারকির সম্পর্ক নেই। দীপনাথকে বরাবরই তার ভাল লাগে। এই এক সংসার-উদাসী মানুষ। বড় ভাল মানুষ। কখনও কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না, কারও কাছে কোনও প্রত্যাশাও নেই তার। বিয়ের পর হয়তো বদলে যাবে। বেশির ভাগ ভাল পুরুষই বিয়ের পর সেয়ানা হয়। দীপনাথ যতদিন বিয়ে না করছে ততদিন তৃষার তাকে বোধহয় এইরকমই ভাল লাগবে।
দীপনাথ বলল, না, রাগ করব কেন? অনুরাগের কথাই তো বলছ। তবে তুমি বরাবরই ফাজিল।
তৃষা স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে বলে, আমি যে ফাজিল সে শুধু দুনিয়ায় একমাত্র তুমিই বললে! আর কেউ কিন্তু বলে না।
আর সবাই কী বলে তোমাকে?–খেতে খেতে চোখ তুলে দীপনাথ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে।
সে অনেক কথা। সোমবাবু তো নাকি বলে, আমি দেবী চৌধুরানি হওয়ার চেষ্টা করছি। এখানকার লোকেও বলে, আমি মেয়ে গুন্ডা, নারী ডাকাত।
বলে নাকি?
শুনি তো।
ঠিকই বলে।–দীপনাথ গম্ভীর মুখে বলল।
তৃষা মৃদু হাসল। বলল, কেন, তোমারও কি তাই মনে হয়?
ডাকাত না হলে ভিলেজ-পলিটিকসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারতে না, বউদি। ডাকাত তো তুমি বটেই।
তোমার মেজদাও আমাকে খুব ভাল চোখে দেখেন না। ওঁর ধারণা আমি ইচ্ছে করে এখানকার লোকেদের সঙ্গে পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করছি।
করছ নাকি? সর্বনাশ! লোকাল লোকদের খুব সমীহ করে চলবে। এরা গ্রাম্য হোক, অশিক্ষিত হোক, খেপলে কিন্তু নাজেহাল করে ছাড়বে।
কঠিন হয়ে গেল তৃষার মুখ। ঠাট্টা-ইয়ারকির ভাবটা একদম রইল না আর। বলল, সহজে আপস করি না। করবও না।
দীপনাথ চোখ তুলে বউদির মুখটা একবার দেখে নিয়ে বলল, মামলা-মোকদ্দমা চলছে নাকি?
চলছে।
আচমকাই দীপনাথের মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল, সোমনাথকে কারা মেরেছিল জানো?
তৃষা এক ঝলক তাকিয়ে বলল, না। জানলে চুপ করে থাকতাম নাকি?
তা বলিনি। এইটুকু ছোট একটা জায়গায় ক্রিমিন্যাল ধরতে পুলিশের এত দেরি হচ্ছে কেন সেইটেই বুঝতে পারছি না।
সে পুলিশ জানে।
সে তো ঠিকই। দীপনাথ আবার মাথা নিচু করে। তারপর একটু ধীর গলায় বলে, সজলকে কি এখানেই বরাবর রাখবে?
তৃষা অবাক হয়ে বলে, কেন বলো তো! এখানে রাখব নাই বা কেন?
দীপনাথ বিজ্ঞের মতো বলে, এই পরিবেশটা হয়তো তেমন ভাল নয়, বউদি।
তা তো নয়ই।
তা হলে সজলকে কোনও ভাল স্কুলে দিয়ে দাও। হোস্টেল বা বোর্ডিং-এ রাখো।
তৃষা বোকা নয়। সে স্থির দৃষ্টিতে দীপনাথের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, সজলের সঙ্গে তোমার কথা হল বুঝি?
হুঁ।
কী বুঝলে?
বুঝলাম সজল এখানে খুব হ্যাপি নয়। ওকে বাইরে পাঠানোই ভাল।
হ্যাপি নয় কেন? কিছু বলল?
অনেক কিছু বলল। সেগুলো কিছু খারাপ কথাও নয়। তবে বুঝতে পারলাম ওর একটা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি গ্রো করছে।
তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সেটা আমি মাঝে মাঝে টের পাই, আগে আমাকে যমের মতো ভয় পেত। আজকাল কেমন যেন ভয়ডর কমে যাচ্ছে।
বাইরে পাঠিয়ে দাও। ঠিক হয়ে যাবে।
দেখব।
যদি বলো তো আমিও ভাল বোর্ডিং স্কুল দেখতে পারি।
তৃষা খুবই অন্যমনস্ক ছিল। জবাব দিল না।
রওনা হওয়ার আগে পর্যন্ত সোমনাথ বাবাকে নিয়ে এল না। একটা বেজে গেল। রওনা না হলে নয়।
বিদায়ের সময় বড় ফটকের কাছে বাড়ির সবাই জড়ো হল। সমস্বরে বলল, আবার আসবেন।
খুব অকপটে মণিদীপা ঘাড় হেলিয়ে বলল, আসবই। আমার এরকম একটা স্পট দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।
গাড়ি চলতে শুরু করার বেশ খানিকক্ষণ পর দীপনাথ সাবধানে বলল, একটু দেরি করে ফেললাম আমরা! মিস্টার বোস ভাবছেন।
একটু ভাবুক না! রোজ তো ভাবে না, আজ ভাবুক।
আপনার যা মানায়, আমাকে তো তা মানায় না। দোষটা বোধহয় আমার ঘাড়ে এসে পড়বে।
কেন? আপনার দোষ কিসের? আমিই তো আসতে চেয়েছিলাম।
দীপনাথ একটু শ্বাস ফেলল। সব কথা মণিদীপা বুঝবে না। বোঝানো যাবেও না।
মণিদীপা আবার তার স্বভাবসিদ্ধ শ্লেষের হাসি হেসে বলে, ইউ আর এ স্লেভ। বন্ডেড লেবারার। বোসের মতো একজন কাকতাড়ুয়াকেও ভয় পান।
আমিই যে সেই কাক।
মণিদীপা সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, কথাটা মিথ্যে নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, দীপনাথবাবু, আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কারও কাছে দাসখত লিখে দিইনি, দেবও না। আমি কোথায় যাব না যাব সেটা আমিই ঠিক করতে ভালবাসি এবং তার জন্য কোনও জবাবদিহি করতে ভালবাসি না।
মণিদীপা যে মোটেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েনি সেটা হঠাৎ চোখের দৃষ্টির খর বিদ্যুৎ এবং স্বরের কঠিন শীতলতায় হাড়ে হাড়ে টের পেল দীপনাথ। তার ভিতরে যে প্রত্যাশা, লোভ ও তরল এক রকমের আবেগ তৈরি হয়েছিল তা চোখের পলকে কেটে গেল। সে সচেতন হয়ে নড়েচড়ে বসল। তার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে সে মোটেই মেয়েছেলে নয়। একজন দৃপ্ত কমরেড, একজন নির্বিকার বিপ্লবী। যদি কারও প্রেমে কখনও পড়ে থাকে মণিদীপা তবে সে দীপনাথ •ায়। সেই ভাগ্যবান বা দুর্ভাগা একজন স্কুলমাস্টার, স্নিগ্ধদেব।
দীপনাথ কথার তোড়ে একটু কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলতে পারল, আমার দাদা-বউদি একটু সেকেলে। আপনার বোধহয়–
মণিদীপা কথাটার জবাব দিল না। বাইরের দিকে চেয়ে শিথিল শরীরে বসে ছিল। মুখ গম্ভীর।
দীপনাথ আর কিছু বলার সাহস পেল না।
বাগানবাড়িতে তাদের অনুপ্রবেশ বিন্দুমাত্র আলোড়ন তুলল না। কেউ জিজ্ঞেস করল না কিছু। শিকারের পার্টি এখনও ফিরে আসেনি।
দীপনাথ এতক্ষণ মনে মনে এই এক ভয়ই পাচ্ছিল। বোস সাহেব ফিরে এসে যদি শোনে—
দীপনাথ নিশ্চিন্ত হল। মণিদীপা গাড়ি থেকে নেমে তাকে কোনও কথা না বলে সেই যে গটগট করে হেঁটে কোথায় চলে গেল তাকে আর দেখতে পেল না সে। খুঁজতেও সাহস হল না। মুহুর্মুহু মেয়েটার মেজাজ পালটে যায়।
দীপনাথ চারদিকে চেয়ে দেখল, দুপুরের রোদে উঁচু সমাজের গৃহিণীরা গাছতলার টেবিলচেয়ারে থ ভঙ্গিতে বসে আছে। দুটো তাসের আড্ডা বসেছে। কয়েকজন পুরু আনাড়ির মতো ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছেন। বেয়ারারা বিয়ারের ট্রে নিয়ে ঘুরছে।
দীপনাথ একটা নিরিবিলি গাছতলা বেছে নিয়ে মাথার ওপর হাত রেখে শুয়ে পড়ল। বউদি অঢেল খাইয়েছে। লাঞ্চে সে আজ অব কিছু খাবে না। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল সে।
স্বপ্নের মধ্যে মণিদীপা এসে সামনে দাঁড়াল। পিছনে চাবুক হাতে বোস সাহেব। বোস সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ডে মণিদীপাকে আরও কঠিন ও সাংঘাতিক দেখাচ্ছে।
মণিদীপ বলল, দীপনাথবাবু।
দীপনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল, জানি।
কী জানেন?
আপনি আমাকে অপমান করবেন এইবার। অপমানটা আমি সবার আগে টের পাই।
কী করে বুঝলেন?
কারণ আমি সবসময়েই অপমানই প্রত্যাশা করি বলে। জীবনে আমি এতবার এত মানুষের অপমান সহ্য করেছি যে, আমাকে আর অপমান করার দরকারই নেই কারও। প্লিজ, আপনিও করবেন না।
যারা কাপুরুষ তারাই অপমানিত হয়। কই, করুক তো স্কুলমাস্টার স্নিগ্ধদেবকে কেউ অপমান! এমন রুখে উঠবে যে যত বড় লোকই হোক না কেন, ওর চোখের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না।
জানি।
স্নিগ্ধর আপনি কতটুকু জানেন?
স্নিগ্ধদেবকে জানি না। কিন্তু চরিত্রবান মানুষদের জানি। তাদের কেউ অপমান করতে সাহস পায়। ব্যক্তিত্বওলা লোকদের চেনা শক্ত নয়। আপনার চোখের দৃষ্টি দেখেই আমি স্নিগ্ধদেবকে অনুমান করতে পারি। আমি তার চেয়ে বোধহয় অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান, কিন্তু তার জোর অন্য জায়গায়। আমি জানি।
মণিদীপা হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, স্নিগ্ধদেবের জোরটা কোথায় জানেন?
না, বলুন শুনি?
স্নিগ্ধদেব কখনও আমাকে কামনা করেনি। আর করেনি বলেই সে আমাকে কিনে রেখেছে। আর আপনি?
আমি করেছি।–চোখ নামিয়ে দীপ বলল।
আর কী জানেন?
কী?
স্নিগ্ধদেব কখনও তার বসকে খুশি করে জীবনে উন্নতি করতে চায়নি। স্নিগ্ধদেব কখনও টাকা-পয়সায় বড়লোক হতে চায় না। স্নিগ্ধদেব একা বড় হতে চায় না। তাই স্নিগ্ধ অত বড়।
মানছি। আমি বড় নই।
কেন বড় নন?
সারা জীবন আমার কেটেছে বড় ভয়ে-ভয়ে। আতঙ্কে। নৈরাশ্যে। অনিশ্চয়তায়।
স্নিগ্ধরও কি তার চেয়ে বেশি ভয়, আতঙ্ক, নৈরাশ্য বা অনিশ্চয়তার কারণ নেই?
আছে। মানুষ যত বড় হয় তার সমস্যার বহরও তত বাড়ে।
তা হলে? স্নিগ্ধদেব পারলে আপনি পারবেন না কেন?
আমি যে বড় নই।
ওটাও কাপুরুষের মতো কথা।
আমার যে স্নিগ্ধদেবের ট্রেনিংটা নেই। আমার জীবনের তেমন কোনও লক্ষ্যও নেই।
হতাশ হয়ে মণিদীপা বলে, কোনও লক্ষ্যই নেই?
দীপ একটু ভেবে বলে, একটা লক্ষ্য আছে হয়তো। কিন্তু বললে আপনি হাসবেন। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। একদিন স্বর্গের সমান উঁচু মহান এক পাহাড়ে উঠব। উঠব, কিন্তু চুড়ায় পৌছোব না কোনওদিন। পাহাড়ের ওপর উঠলে তাকে ছোট করে দেওয়া হয়। আমি পাহাড়ের চেয়ে উঁচু নই। আমি চাই উঠতে উঠতে একদিন সেই পাহাড়ের কোলেই ঢলে পড়ব।
রোমান্টিক ইডিয়ট। সেন্টিমেন্টাল ফুল।
শুনুন মিসেস বোস, আমার কথাটা একটু শুনুন। যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা হারমাদ ছেলের সঙ্গে আমার লড়াই বাধে। খুবই সাংঘাতিক ছেলে। তার নাম ছিল সুকু। সে অসম্ভব ভাল সাইকেল চালাত, ছিল খুবই ভাল স্পোর্টসম্যান। তার গায়ে ছিল আমার দ্বিগুণ জোর। কী নিয়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম লেগেছিল মনে নেই। বোধহয় বেঞ্চে জায়গা দখল করা নিয়ে। প্রথমে ছোটখাটো তর্কাতর্কি। একদিন মনে আছে, সে সামনের বেঞ্চে বসে পিছনের ডেস্কে আমার বইয়ের ওপর ইচ্ছে করে কনুই তুলে দিয়ে ভর রেখেছিল। আমি তার কনুই ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সে নির্বিকারভাবে পিছনে ফিরে আমার বইগুলো টান মেরে নীচে ফেলে দিল। ক্লাসে তখন মাস্টারমশাইও ছিলেন। কিন্তু আমি তার বেপরোয়া নির্ভীক হাবভাব দেখে নালিশ করারও সাহস পেলাম না। কিন্তু ঝগড়াটার শেষ সেখানেও হল না। আমার মধ্যে অপমানবোধ বড় তীব্র কাজ করছিল। পরদিন আমি সকলের আগেই স্কুলে পৌঁছে সুকুর সামনের বেঞ্চে বসলাম এবং মাস্টারমশাই ক্লাসে আসার পর ইচ্ছে করেই সুকুর বইয়ের ওপর কনুই তুলে দিলাম; কী হল জানেন? সুকু তার বইগুলো এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল। আমি পিছনে হেলে ধড়াস করে ডেস্কে ধাক্কা খেলাম। ডেস্কের তলা দিয়ে সুকু একটা লাথিও মেরেছিল কোমরে। সেদিনও কিছু বলিনি ভয়ে। কিন্তু ক্লাসে সবাই সুকুর আর আমার ঝগড়ার কথা জেনে গেল। সবাই তাকাত, হাসত, মজা পেত। বলা বাহুল্য, নামকরা স্পোর্টসম্যান বলে সবাই ছিল সুকুরই পক্ষে। এরপর থেকে ক্লাসে প্রায়ই সুকু আর তার কয়েকজন চেলাচামুন্ডা, আমাকে হাবা বলে ডাকতে শুরু করেছিল। অঙ্ক কষছি, ট্রানস্লেশন করছি, ফাঁকে ফাঁকে শ্বাসবায়ুর শব্দের সঙ্গে কানে আসত, এই হাবা! এমন কিছু খারাপ কথা নয়, এখন বুঝি। কিন্তু তখন পিত্তি জ্বলে যেত শুনে। উলটে কিছু বলতে হয় বলে আমি গালাগাল দেওয়া শুরু করি। প্রথম বলতাম শালা, গাধা, গোরু, এইসব। পরে একদিন বেশি রাগ হওয়ায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, শুয়োরের বাচ্চা। হেডসারের ক্লাস ছিল। উনি চলে যেতেই রাগে টকটকে রাঙা মুখে উঠে এল সুকু। কোনও কথা না বলে আমার জামা ধরে এক ঝটকায় পঁড় করিয়ে কী জোর এক চড় মারল যে তা বলে বোঝানো যাবে না। মাথা ঘুরে গেল চড় খেয়ে। আর চড় খেয়ে যখন আমার বুদ্ধিনাশ হয়ে গেছে তখনই সুকুর সাঙাতরা এসে আমার পরনের হাফপ্যান্ট খুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে এল। সম্পূর্ণ গাড়লের মতো হতবুদ্ধি হয়ে আমি বসে ছিলাম। গায়ে শুধু শার্ট, পরনে আর কিছু নেই। ক্লাসসুদ্ধ ছেলে হাততালি দিয়ে চেঁচাচ্ছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি যেন আর অপমান নেই। দু’হাতে লজ্জা ঢেকে আমি হতভম্বের মতো তখন জানালা দিয়ে বাইরে চাইলাম। সেই প্রথম যেন আবিষ্কার করলাম উত্তরের হিমালয়কে। দেখলাম পৃথিবীর সব তুচ্ছতাকে অতিক্রম করে কত উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই মহান পর্বত। জানালা দিয়ে সে যেন হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বিড়বিড় করে বড় অভিমানে আমি বললাম, এরা তো কেউ আমার নয়। এরা বড় যন্ত্রণা দেয় আমাকে। আমি একদিন তোমার কাছে চলে যাব। সেই থেকে, মিসেস বোস, সেই থেকে ওই পাহাড় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেউ অপমান করলেই আমি পাহাড়ের কথা ভাবি। কেবলই মনে হয়, আমি একদিন সব ক্ষুদ্রতা ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যাব। যখন যাব তখন আর কোনও অপমানই আমার গায়ে লেগে থাকবে না।
ঘুমের মধ্যেও দীপের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই কাজ করছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কলের পুতুলের মতো সোজা হয়ে বসল সে। সূর্যের শেষ একটু আলো গাছের গাঢ় ছায়া ভেদ করে ঘোলা জলের মতো ছড়িয়ে আছে এখনও। লাঞ্চ কখন শেষ হয়ে গেছে।
যে জায়গায় দীপ শুয়ে ছিল সেটা বাগানের শেষ প্রান্তে, একটা পুকুর পেরিয়ে। এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না।
প্রচণ্ড শীত করছিল তার। মাটির ওপর শুয়ে থাকায় জামা কাপড়ে একটা ভেজা-ভেজা ভাব। শুকনো মরা ঘাস লেগে আছে গায়ে।
উঠে সে দ্রুত পায়ে বাড়ির সামনের চাতালে চলে আসে।
দেখে কোনও লোক নেই। একটা গাড়িও নেই। সবাই চলে গেছে।
দীপনাথ একটু হতবুদ্ধি হয়ে যায়। পার্টি সন্ধে পর্যন্ত চলার কথা ছিল। তবে কি সাহেবরা মদ খেয়ে বেশি মাত্রায় বেচাল হয়ে পড়েছিল?
তাই হবে।
রাস্তায় এসে সে দেখতে পায়, একটা ভ্যানগাড়িতে কোরারের লোকেরা মালপত্র তুলছে।
সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, পার্টি ভেঙে গেল ভাই?
একটা ছেলে খুব সুন্দর করে হেসে বলে, হ্যাঁ! সাহেবরা মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন।
দীপনাথ মনে মনে হিসেব কষছিল। তাকে ফিরতে হবে। কেউ তাকে ফেলে গেছে বলেই তো সে আর পড়ে থাকতে পারে না।
সে বলল, আমি বোস সাহেবের সেক্রেটারি। একটা জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। তোমাদের গাড়িতে আমাকে একটু পৌঁছে দাও।
কেটারারের লোকেরা রাজি হচ্ছিল না। সন্দেহ করছে।
পাঁচটা টাকা কবুল করে এবং প্রায় হাতে-পায়ে ধরে অবশেষে জায়গা পেয়ে গেল দীপ। ড্রাইভারের পাশেই। খুব ঠাসাঠাসি চাপাচাপির মধ্যে বসে সে বন্দুকগুলোর কথা ভাবছিল। বন্দুকগুলো ঠিকঠাকমতো ওরা নিয়ে গেছে তো? ফেরার সময়ে বন্দুকগুলো ধরে বসে ছিলই বা কে?