1 of 2

১৭. শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়

 সতের

শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় ছাড়াতেই অনিমেষ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ওখানে কি হচ্ছে, পাতাল রেলের রাস্তা?’

মাধবীলতা বলল, ‘হ্যাঁ। সমস্ত পথটাই খুঁড়ে একসা হয়ে গেছে। চট করে দেখলে চিনতে পারা যায় না।’ বলতে না বলতে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক মুখ বের করে দেখল রাজবল্লভ পাড়া পর্যন্ত ঠাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো। সে ড্রাইভারকে বলল, ‘ডানদিকের রাস্তাটা ধরুন। মনি কলেজের সামনে দিয়ে।’ লোকটা অজানা পথে গাড়ি নিয়ে যেতে নারাজ, একবার সেদিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বসে রইল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এত রাস্তা তুই চিনলি কখন?’

অর্ক জবাব দিল না। মাধবীলতা বলল, ‘এই রাস্তায় ঢোকা আমাদের ভুল হয়েছে। সোজা সার্কুলার রোড দিয়ে গেলে সুবিধে হত। কথাটা শুনে ড্রাইভার ঘাড় নাড়ল। সে-ও ভুল বুঝতে পেরেছে। অনিমেষ চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। কি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে শহরটা। এই পথে একদিন সে নিজেও ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ এখন আর সে-পথটাকে চেনা যাবে না। রাস্তার একটা দিক বন্ধ করে বিরাট বিরাট যন্ত্র দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সশব্দে। সামনের গাড়ির ড্রাইভার দরজা খুলে মাটিতে নেমে চিৎকার করে উঠল, ‘পাতাল রেল হচ্ছে গুষ্টির পিণ্ডি হচ্ছে। শালা টাকা ঝাড়বার কল। এখন দাঁড়িয়ে থাক এখানে।’

ওদের গাড়ির ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন দাদা। এর চেয়ে সার্কুলার রেল হলে কত ভাল হত। বিধান রায় তাই চেয়েছিলেন।’

‘চাইবেন না কেন? উনি তো আর নাড়ি-টেপা ডাক্তার ছিলেন না!’ সামনের ড্রাইভারটি জানাল। অনিমেষ দেখল, এরা দুজনেই বয়স্ক। দুজনেই পাতাল রেল প্রকল্পকে অপছন্দ করছে। যে কোন পরিবর্তনে বয়স্কদের সমর্থন দেরিতে পাওয়া যায়। অথচ এই পথের তলা দিয়ে যখন পাতাল রেল ছুটবে তখন এই মানুষগুলোই গর্ব করে বলবে, ‘ওঃ, কি কষ্টই না করেছিলাম আমরা সেদিন। কথাটা ভাবতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। নতুন কোন উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি বলেই এই দেশের মানুষ সাতষট্টির আগে যেমন ছিল এখনও তেমনই রয়েছে। শুধু ওই উদ্যোগটাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারলে নিশ্চয়ই এমনটা হত না। অনিমেষ দেখতে পেল একটি লোক মনি কলেজের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে গাড়িদের আটকে-পড়া দেখছে। খুব মজা পেয়েছে যেন। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল লোকটকে সে চেনে। অনেক বছর পার হয়ে গেলেও একটুও পাল্টায়নি। শুধু মুখের গড়ন আরও গোল হয়েছে। না, তার ভুল হয়নি । ওই দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওই আকৃতি এবং ধুতি পরা দেখে ভুল হবার কথা নয়। সে উত্তেজিত হয়ে হাত নাড়ল। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে হাত নাড়া তার নজর অন্যদিকে। অনিমেষের খুব আফসোস হচ্ছিল। এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে শোনা যাবে না। মাধবীলতা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল? চেনা কেউ?’ বলে উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করল।

‘চিনতে পারছ!’ অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা তখনও ঠিক লোকটিকে বুঝে উঠতে পারছে না। অনিমেষ চাপা গলায় অর্ককে বলল, ‘চট করে নেমে ফুটপাথ থেকে ওই লোকটিকে ডেকে নিয়ে আয় তো। দেখিস, গাড়ি না ছেড়ে দেয়। ভাগ্যিস জ্যামে আটকালাম।

অর্ক দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে গেল ফুটপাথ ধরে। এদিকের ফুটপাথ এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে পাতাল রেল-ওয়ালারা। অনিমেষ দেখল অর্ক মনি কলেজের সামনে গিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। তারপর গাড়ির দিকে মুখ করে জানতে চাইল কাকে বলবে? অনিমেষ হাতের ইশারা করতেই অর্ক উল্টো মুখ করে দাঁড়ানো লোকটাকে ডাকল, ‘শুনুন।’

লোকটা চশমার আড়ালে চোখ বড় করে ওর দিকে তাকাতেই অর্ক হাত নেড়ে গাড়িটা দেখাল, ‘আপনাকে ডাকছে।’

‘আমাকে ডাকছে? গাড়ি থেকে?’

অনিমেষ দেখল ওরা এগিয়ে আসছে। ড্রাইভার শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভোর হয়ে যাবে বাড়ি ফিরে যান।’ অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, ‘কি আশ্চর্য, এখনও চিনতে পারছ না?’ সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা আন্তরিক হাসিতে দুটো ঠোঁট দীর্ঘতর, ‘ওমা পরমহংস!’

ততক্ষণে গাড়ির পাশে এসে চোখ ছোট করে পরমহংস এদের দেখছে। অনিমেষ হাত বাড়াল, ‘কেমন আছিস?’ বলতে বলতেই তার খেয়াল হল য়ুনিভার্সিটিতে সে ওকে তুমি বলত। কিন্তু এখন তুই বলতে খুব ভাল লাগল।

প্রায় লাফিয়ে উঠল পরমহংস, ‘আই বাপ! গুরু তুমি বেঁচে আছ!’ ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে মাধবীলতার হাসি বাঁধ ভাঙল। অনিমেষ ওর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থাক, চিনতে পারলি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমি মরতে যাব কোন দুঃখে।’

এবার একটু আমতা আমতা করল পরমহংস, ‘আমি সেরকমই শুনেছিলাম। আঃ, কদ্দিন বাদে দেখা হল! আরে বাবা, আপনিও সঙ্গে আছেন। ওঃ, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি আমি।’ এই সময় একসঙ্গে অনেকগুলো হর্ন বাজতে থাকল। সামনের গাড়িগুলো এবার নড়ছে। ড্রাইভার দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই অনিমেষ বলল, ‘উঠে আয়, উঠে আয়।’

পরমহংস বলল, ‘কি আশ্চর্য, আমি উঠব কেন?’ সে অর্কের দিকে তাকাল। মাধবীলতা মুখ বের করার চেষ্টা করে বলল, ‘আগে উঠুন তারপর ভাবা যাবে কেন উঠবেন, উঠে পড়ুন।’

তখন আর দ্বিধা করার সময় ছিল না। সামনের গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। অর্ক দৌড়ে ড্রাইভারের পাশে জায়গা নিতে পরমহংস তাকে অনুসরণ করল। গাড়ি চলতে শুরু করলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোর হাতে এখন কোন কাজ আছে? কোথাও যাচ্ছিলি?

‘হ্যাঁ। ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিলাম। ছেড়ে দে এসব কথা, আজ আমি ডুব মারছি।’ বলে উল্টো দিকে ঘুরে বসল সে, ‘তোরা মাইরি একদম বুড়িয়ে গেছিস। তোর তো মুখচোখে পঞ্চাশ বছর আর, তোকেও তুই বলচি, আপনি টাপনি বলতে পারব না, হ্যাঁ তুইও বুড়ি হতে চলেছিস। অথচ লাস্ট যখন দেখেছিলাম তখন কি ছিলি মাইরি, শালা য়ুনিভার্সিটি কেঁপে যেত।’

অনেক অনেকদিন বাদে মাধবীলতা ব্লাস করল, ‘যাঃ, কি অসভ্য।’

‘অসভ্য মানে? ইয়ার্কি। বিখ্যাত নকশাল নেতা অনিমেষ মিত্তির যদি তোকে তুলে না নিত তাহলে অ্যাদ্দিনে—।’ পরমহংস পাছে বেফাঁস কিছু বলে বসে তাই মাধবীলতা দ্রুত বলে উঠল, ‘কি হচ্ছে কি, সামনে কে বসে আছে জানো?’ তারও সম্বোধন আপনি থেকে কখন তুমিতে পৌঁছে গেছে।

পরমহংস একটু সোজা হবার চেষ্টা করে অর্ককে দেখল। তারপর চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, কে? মাধবীলতা হাসল, ‘পুত্র।’

‘অ। পরমহংসের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, ‘এত বড় ছেলে তোর? অসম্ভব। এই যে ভাই, কি নাম তোমার বল তো?’

‘অর্ক মিত্র।’ অর্ক ঠিক বুঝতে পারছিল না তার বিরক্ত হওয়া উচিত কিনা।

‘মিত্র? ওরা যা বলছে তা ঠিক?’ চোখ সরাচ্ছিল না পরমহংস।

ঠোঁট টিপে অর্ক মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল এমন ভঙ্গী করল পরমহংস, ‘এটা কি করে হল?’

অনিমেষ হাসল, ‘বিয়ে করেছিস? কথা ঘোরানো দরকার।

‘আমি? খ্যাপা! শুধু হংস নই পরমহংস। জলটুকু ফেলে দিয়ে দুধ গিলে নিই। যা রোজগার করি নিজেরই পেট ভরে না তো বিয়ে। পরমহংস যখন কথা বলছিল তখন অর্ক দেখছিল ওঁর দাঁত বেশ উঁচু, এমনিতেই মনে হয় হাসি হাসি মুখ। পরমহংস বলল, ‘কিন্তু ব্যাপারটা কি বল তো? এই গাড়িতে তোকে কখনও দেখব ভাবিনি। কিনলি কবে?’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘এটা আমার গাড়ি নয়।’

‘যাচ্চলে! তাহলে এটা কার গাড়ি?’

‘আমার ছোট কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা ওঁর কাছে যাচ্ছি।’

‘ও। তাহলে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

‘ছোট কাকার সঙ্গে দেখা করার কথা অর্ক আর ওর মায়ের। আমি বাইরে তোর সঙ্গে বসে গল্প করব। অনিমেষ ওকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

‘বাইরে মানে? কারও বাড়িতে গিয়ে—।’

‘বাড়ি না, হোটেল। পার্ক হোটেল।’

‘উরে ব্বাস! নামিয়ে দে নামিয়ে দে, অতবড় হোটেলে আমি যেতে পারব না। তোর ছোট কাকা পার্ক হোটেলে থাকে। সেই কাকা নাকি রে যার সিগারেট আমাদের খাইয়েছিলি। তখনও তো হোটেলে থাকত।’ পরমহংস মনে করার চেষ্টা করছিল। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ সেই কাকাই। তবে এবার তিনি ওদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমার পক্ষে হাঁটাচলা অসম্ভব তাই—।’

বোধহয় এতক্ষণ উত্তেজনায় পরমহংসর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল, এবার সে ক্রাচটাকে দেখতে পেল। সে আর একটু ঝুঁকে অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল। পাজামা পরা সত্ত্বেও একটা পায়ের অস্তিত্ব যে নেই তা বুঝতে অসুবিধে হল না। এসব দেখার সময় ওর মুখ গম্ভীর হয়ে আসছিল। তারপর অদ্ভুত চোখে অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। সেই হাসিখুশি ভাবটা এখন উধাও হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে পরমহংস। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরল, ‘এখন এসব অভ্যাস হয়ে গেছে রে।’

‘পুলিস?’ কোন রকমে প্রশ্নটা উচ্চারণ করল পরমহংস। মাধবীলতা তখন জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে। অনিমেষের মনে হল অনেকদিন বাদে একটা উষ্ণ আত্মীয়তার স্পর্শ পাচ্ছে সে। পরমহংসের মুখ এখন মাধবীলতার দিকে, ‘বিয়ের আগেই পুলিস এই অবস্থা করেছিল?’

মাধবীলতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ‘না। বিয়ের পরে।’

অনিমেষ একবার সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, ‘ছেড়ে দে এসব কথা। একটা লোক হাঁটতে পারল কি পারল না তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না।’

‘একদম ফালতু, একদম ফালতু কারণে তুই নিজের জীবনটা দিলি অনিমেষ। তোদের নকশাল আন্দোলনে দেশের কি হাল পাল্টেছে বল।’ পরমহংসের গলাটা ধরে এল, ‘অবশ্য আবার দ্যাখ, এখন তো আমরা সমস্ত শরীরে বিকলাঙ্গ হয়ে বাস করছি চলছি ফিরছি কেউ দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আমাদের হাত পা মেরুদণ্ড সব বেকানো। তোর হয়তো শুধু পা দুটো গিয়েছে কিন্তু মনে মনে সান্ত্বনা পাস যে একদিন প্রতিবাদ করেছিলি। কিন্তু আমি তো তাও পাই না। সারা দিন রাত কেঁচো হয়ে আছি। বাবার অফিসে ঢুকেছিলাম, সেখানে কোন প্রমোশন নেই। চারধারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে, বাস ট্রামে ওঠা যাচ্ছে না কিন্তু ভাড়া দ্বিগুণ হচ্ছে। আর এসবের প্রতিবাদ করলেই বলা হবে সমাজ বিরোধী। তোকে বলব কি, আমারই রকে বসে আমার ভাইপো যে খিস্তি করে তা আমাকেই মুখ বুজে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করার সাহস হয় না ওদের চেহারা দেখে। কেমন ক্ষয়াটে বাবরি চুল। এসব বিকলাঙ্গ না হলে কেউ সহ্য করে?

অনিমেষ তো বটে মাধবীলতাও অবাক হয়ে পরমহংসর কথাগুলো শুনছিল। য়ুনিভার্সিটির সেই হাসিখুশি ছেলেটা যে ক্রিকেটের পরিভাষায় জীবন নিয়ে ঠাট্টা করত, রাজনীতি থেকে সযত্নে সাত হাত তফাতে থাকাটা শ্রেয় বলে মনে করত সে কি উপলব্ধি থেকে এই কথাগুলো বলছে! আবার ঘাড় ঘোরাল পরমহংস, ‘তুই ওটা ছাড়া একদম হাঁটতে পারিস না, না?’

‘না। এটা নিয়েও খুব বেশিদূর নয়। তুই এখন কোথায় আছিস?’

‘সেই পৈতৃক ভবনেই। তুই?’

‘বেলগাছিয়ায়।’

‘ঠিকানাটা বল। অ্যাদ্দিন জানতাম না, এখন যখন জানলাম তখন যোগাযোগটা থাক। আমি শুনেছিলাম তোকে নাকি নর্থ বেঙ্গলে পুলিস মেরে ফেলেছে। তোদের যে বিয়ে হয়ে গেছে, এতবড় ছেলে হয়েছে তা কি করে জানব বল। ঠিকানা কি?’

‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। ওটা বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর কাছে একটা বস্তি। ওখানে গিয়ে আমাকে না খুঁজে অর্ককে খুঁজলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবি। জানি না খোঁড়া লোক বললে কেউ দেখিয়ে দেবে কিনা। অনিমেষ কথাটা শেষ করা মাত্র অর্ক মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল।

‘তোরা বস্তিতে আছিস? পরমহংস অবাক হয়ে গেল।

‘একটা ভাল ফ্ল্যাট দেখে দাও না। দেড়খানা ঘর হলেই হবে। বেশি ভাড়া দিতে পারব না। আমি স্কুলে পড়াই, সেই আয়ে চলে আমাদের।’ মাধবীলতা অনুরোধ করতেই অনিমেষ হেসে উঠল। মাধবীলতা অপ্রতিভ মুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসলে কেন?’

অনিমেষ বলল, ‘অনেকদিন আগে আমি পরমহংসকে ওই রকম গলায় বলেছিলাম, আমাকে একটা টিউশনি যোগাড় করে দাও না, যা মাইনে দেবে দিক! বেচারাকে আবার আজ শুনতে হল ফ্ল্যাট দেখে দিতে হবে। তুই সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলি অবস্থা খুব টাইট? আজ জিজ্ঞাসা করলেও একই উত্তর শুনবি, হ্যাঁ।’

পরমহংস কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, ‘ঠিক আছে, দরকার নেই।’

পরমহংস বলল, ‘কোলকাতায় চাকরি পাওয়া যত সোজা ফ্ল্যাট তত নয়। যদি রাইটার্সে ধরাধরি করার কেউ থাকে তাহলে সরকারী ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। ওহো জানিস কি সুদীপ এখন মন্ত্রী হয়েছে। য়ুনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্টেন্ট জি এস ছিল, চুরুট খেত! মাইরি কি কপাল। অথচ ওর চেয়ে বিমান কি শার্প ছিল, সেই বিমানের এখন আর পাত্তা নেই। সুদীপকে বলবি?’

‘আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘ঠিক আছে, তুমি একটা দরখাস্ত লিখে দিও, আমি ওটা নিয়ে যাব। অত আদর্শ টাদর্শ নিয়ে থাকলে চলে না। দাঁড়াও। দেড়খানা ঘর হলেই হবে? আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক সল্ট লেকে উঠে যাচ্ছে। বাড়িওয়ালি যদি হেভি সেলামি চায় তো হয়ে গেল। দেখি। পরমহংস এবার অর্কর দিকে তাকাল, তুমি কি পড়ছ?’

‘ক্লাস নাইন।’

‘ও, তাই বল। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয় কলেজে টলেজে পড়ছ। আমার অবশ্য ভুল হয়েছে, তোমার অত বয়েস হতেই পারে না। আরে, আমরা যে পার্ক স্ট্রীটে চলে এসেছি। গাড়ি তখন পার্ক হোটেলে ঢুকছে। গলি দিয়ে ঠিক সদর দরজার সামনে পৌঁছে ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। মাধবীলতা নিচে পা রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নামবে না?’ অনিমেষ বলল, ‘ওকে জিজ্ঞাসা কর তো আমাদের পৌঁছে দেওয়ার হুকুম পেয়েছে কি না?’

ড্রাইভার কথাটা শুনতে পেয়েছিল, বলল, ‘হ্যাঁ সার।’

অনিমেষ বলল, ‘তাহলে আর কষ্ট করে কি হবে। পরমহংস, তুই বরং পেছনে চলে আয়, ওরা ঘুরে আসুক। তুমি ভাই গাড়িটাকে কোন নিরিবিলি জায়গায় রেখে দাও।’

পরমহংস পেছনের সিটে বসতে বসতে বলল, ‘তাই ভাল। আমার আবার এসব জায়গায় এলেই কেমন অস্বস্তি হয়।’

মাধবীলতার হাঁটতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। হোটেলে যারা ঢুকছে বের হচ্ছে তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা কোন তলার মানুষ। অর্কর অবশ্য সে ধরনের কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। সে আগ্রহ নিয়ে চারধারে চোখ বোলাচ্ছিল। সামনেই রিসেপশন। ওরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই এক ভদ্রলোক ওপাশ থেকে বললেন, ‘ইয়েস।’

ঠিক দু মিনিট পরে ওরা নির্দিষ্ট ঘরের দরজায়। মাধবীলতা লক্ষ্য করছিল অর্ক একটুও আড়ষ্ট নয়। এই ঝকঝকে হোটেলের কোন কিছুই যেন ওর কাছে ভীতিকর নয়। বরং সে নিজে অসুবিধে বোধ করছিল। দরজার কাছে এসে মনে হচ্ছিল যার সূত্রে এই ভদ্রলোকের কাছে আসা সে-ই রইল নিচে গাড়িতে বসে আর ওরা উঠে এল।

দরজা খুলে প্রিয়তোষ বললেন, ‘এসো এসো। আমার এমন কয়েকটা জরুরী কাজ রয়েছে যে আজ তোমাদের ওখানে যেতে পারলাম না, ফলে তোমাকেই ডেকে আনলাম বউমা, তুমি কিছু মনে করো না। ওই সোফায় বসো।

প্রিয়তোষ হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিতেই মাধবীলতা সন্তর্পণে বসল। অর্ক দেখল কি নরম যেন ডুবে যাচ্ছে শরীর। এই ঘরটাই এত তরিবত করে সাজানো যে চোখ টেরা হয়ে যায়। প্রিয়তোষ বললেন, ‘ব্যাপারটা কি জানো, আমি এদেশে থাকি না, বয়সও হচ্ছে। কবে চট করে চলে যাব কে বলতে পারে তাই তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছি।’

মাধবীলতা আঁচলটা আর একটু টেনে বসল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রিয়তোষ উল্টোদিকের সোফায় শরীর এলিয়ে বসলেন, ‘বউমা তোমাকে বুদ্ধিমতী বলে আমার মনে হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে কিছুটা, কিছুটাই বা বলি কেন প্রচণ্ড ইমোশনাল। আমি তোমার সব কথা আজ সকালেই জেনেছি। আমাদের বংশ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’

মাধবীলতা মুখ নামাল, ‘এসব কথা বলছেন কেন?’

‘বলছি তার প্রয়োজন আছে। তুমি শুনেছ কিনা জানি না, জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের যে বাড়ি বাবা করে গিয়েছিলেন সেটার দাবি নিয়ে অনেকেই সোচ্চার হয়েছে। আমি যখন গেলাম তখন অনিমেষের জ্যাঠামশাই আমাকে ধরেছিল যাতে আমি আমার অংশ তার নামে লিখে দিই। ওদের ধারণা অনিমেষকে পুলিস মেরে ফেলেছে অতএব দাদা মারা গেলে পুরো সম্পত্তি ওরাই পাবে। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম দিদিকে আমার অংশ দিয়ে দেব যাতে তাঁকে কেউ হেনস্থা না করতে পারে। এখানে এসে যখন তোমাদের সন্ধান পেলাম তখন মনে হচ্ছে, ভালই হল। তোমরা যদি ওখানে চলে যাও তাহলে সমস্ত ব্যাপারটার একটা সুরাহা হয়। আমি আমার অংশ তোমার নামে লিখে দিচ্ছি এবং বিশ্বাস করছি যে তুমি দিদিকে দেখাশোনা করবে। প্রিয়তোষ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালেন।

মাধবীলতা বলল, ‘আপনার জিনিস আপনি দিতে যাবেন কেন?’

‘ওই যে বললাম। তাছাড়া ওখানে তো আমি কখনও থাকতে যাব না।’

‘তা হোক। আমি এই দায়িত্ব নিতে রাজি নই।’

‘কেন? তুমি দিদির দায়িত্ব নিতে রাজি নও?’

‘আমি সেকথা বলিনি। ওঁর সেবা করার সুযোগ পাওয়া আমার ভাগ্যের কথা। আপনাদের ছেলের কাছে আমি সব শুনেছি। কিন্তু কোন সম্পত্তি আমি নিতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

‘কেন?’

মাধবীলতা হাসল মুখ নিচু করে কিন্তু জবাব দিল না। প্রিয়তোষ খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর নিজের মনে বললেন, ‘তুমি আমাকে সত্যি অবাক করলে। তোমরা কি খাবে, চা কফি? কফিই বলি।’ রিসিভার তুলে রুম সার্ভিসকে হুকুমটা জানিয়ে প্রিয়তোষ অর্কর দিকে তাকালেন, ‘তোমরা যে পরিবেশে থাকো তাতে ওর উন্নতি করা খুব মুশকিল। শুধু ওর জন্যেই তোমাদের জলপাইগুড়িতে চলে যাওয়া উচিত। ওখানে আর যাই হোক এখনও পড়াশুনার আবহাওয়া আছে।’

মাধবীলতার মনে তখন কফি ঘুরছে। অনিমেষকে নিচে রেখে এই ঘরে বসে ওরা কফি খাবে? কিন্তু উনি এমন ভঙ্গীতে বললেন যে মুখের ওপর না বলতে পারা গেল না। সে প্রিয়তোষের কথার উত্তরে বলল, ‘দেখি কি করা যায়!’

‘দেখাদেখি নয়, যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। আমি তোমাদের কথা আজই দাদাকে লিখে দিয়েছি।’

‘ও যদি যেতে রাজি হয়—।’

‘রাজি হবে না কেন? তোমার ওপর সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিতে ওর সঙ্কোচ হয় না? বাই দি বাই, তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?’

মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ালো। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণ করল, আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আমাকে ওরা মেনে নিতে পারেন নি।

‘তুমি তো দারুণ মেয়ে!’ প্রিয়তোষ গর্বিত ভঙ্গীতে বললেন, ‘তোমার জন্যে আমি খুব খুশি। অনিটা সত্যিই ভাগ্যবান।’

কফি এল। মাধবীলতা ভেবেছিল তাকেই হাত লাগাতে হবে কিন্তু এখানকার বেয়ারাগুলো বোধহয় খুবই কেতাদুরস্ত। কফিতে চুমুক দিয়ে প্রিয়তোষ বললেন, ‘এবার তাহলে চলি। আমি মনে মনে যা ঠিক করেছি তা তোমার কথায় আরও জোর পেল ‘দ্যাখো বউমা, সারাজীবন আমি বাইরে বাইরে। বাবার জন্যে ইচ্ছে হলেও আমি কিছু করতে পারিনি। শুনেছি শেষ বয়সে ওঁকে খুব অর্থকষ্টে কাটাতে হয়েছে। জলপাইগুড়িতে গিয়ে দেখে এলাম ওঁদের অবস্থাও ভাল নয়। দাদার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়, দিদি অশক্ত, বউদিকে আমি আগে দেখিনি। এই অবস্থায় বড় কিছু করার ব্যাপারে আমার দ্বিধা ছিল। তোমাকে দেখার পর অনিকে ফিরে পাওয়ার পর এবং এই শ্রীমানকে আবিষ্কার করে মনে হচ্ছে আমি আমার বংশের প্রতি কিছুটা কর্তব্য করে যাই। আমার যা ঋণ তা এবার শোধ করার সুযোগ দাও।

অর্ক কফি শেষ করে ফেলেছিল, মাধবীলতার হাতের কাপ নড়ে উঠল। সে ধীরে কাপটা নামিয়ে রাখল। প্রিয়তোষ বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেন নি। নিজের সঙ্গে কথা বলছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন ‘অনেক তো হল, এবার পেছনে তাকানো যাক। বউমা মানুষের জীবনে একটা সময় থাকে যখন শুধুই সামনে তাকানো। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ যখন মনে হয় এই যে পেছনটাকে আমি ফেলে এলাম সেটা কি রকম দেখি তখনই বুঝবে সামনে আর তাকানোর কিছু নেই। আর বোধহয় আমার ভারতবর্ষে আসা সম্ভব হবে না। তাই, আমি এখানে আমার যা আছে তা তোমার আর তোমার ছেলের নামে ট্রান্সফার করে যেতে চাই। মোটামুটি দু লক্ষ টাকার মত হবে। শুধু ওই টাকায় তুমি আমার বুড়ি দিদি আর দাদাকে দেখো, এই ছেলেটাকে মানুষ করো।’

মাধবীলতা বুঝল অর্ক চমকে উঠেছে। এই বৃদ্ধ এখন এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে! সেই দৃষ্টিতে আত্মসমর্পণ পরিষ্কার। একটুও দানের অহঙ্কার নেই। দু লক্ষ টাকা। মাধবীলতা অর্কের দিকে তাকাল। কি আশ্চর্য! ছেলে মুখ নামিয়েছে। প্রিয়তোষ মিনতি করলেন, ‘বউমা তুমি আবার না বল না। এই বুড়োর অনুরোধ রাখ।’

মাধবীলতা খুব সতর্ক গলায় কথা বলল, ‘ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখি।’

‘কার সঙ্গে? অনির সঙ্গে? ওর সঙ্গে কথা বলে কি হবে। একটা বিকলাঙ্গ মানুষ তোমাকে কি যুক্তি দিতে পারে?’

‘না।’ মাধবীলতা প্রায় স্থানকাল ভুলে গেল, ‘এভাবে বলবেন না।’

প্রিয়তোষ বললেন, ‘তুমি কেন বুঝতে চাইছ না অনিমেষের নিজে থেকে কিছু করার সামর্থ্য নেই। তুমি যা করবে ও তাই মেনে নেবে।’

মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, ‘আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার চলে যাওয়ার দিন তো এখনও আসেনি।’

‘আসেনি কিন্তু আসবে। তাছাড়া আমাকে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই টাকায় আমাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী মানুষ হবে।’

মাধবীলতা বলল, ‘আপনাকে আমি জানাবো। আর অর্কর কথা যদি বলেন তাহলে বলি, আমি যদি নিজের রোজগারে ওকে মানুষ না করতে পারি তাহলে ওই টাকা ওকে অমানুষ হতে দ্রুত সাহায্য করবে। আমরা চলি।’

দরজায় এসে প্রিয়তোষ শেষবার বললেন, ‘তুমি হ্যাঁ বলে যাও।’

মাধবীলতা হাসল, ‘আপনি গুরুজন। আপনার মুখের ওপর এত কথার পর না বলতে বাধে। কিন্তু দোহাই, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নেবেন না! আপনি তো জানেন আমি খুব ইমোশনাল, এটুকু নিয়েই বেঁচে থাকি।’

লিফটে নয়, সিড়ি ভেঙ্গে ওরা নিচে নেমে এল। নামতে নামতে প্রচণ্ড বিস্ময়ে অর্ক বলল, ‘তুমি দু লাখ টাকা ছেড়ে দিলে মা, কেন?’, মাধবীলতা বলল, তোর বাবাকে জিজ্ঞাসা কর।’

‘তুমিই বল না। ওই টাকা থাকলে তোমাকে আর কষ্ট করতে হতো না, আমরা অনেক ভাল জায়গায় থাকতে পারতাম। অর্ক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সেই মুখ থমথম করছে। ড্রাইভার ওদের পথ চিনিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। অনিমেষ আর পরমহংস পেছনের সিটে বসে গল্প করছে। ওদের দেখে পরমহংস ঠাট্টা করল, ‘ওঃ, এত দেরি করলে, খুব খেয়েছ মনে হচ্ছে। আমাদের এক ভাঁড় চা জোটেনি।’

মাধবীলতা অনিমেষের মুখোমুখি হল, ‘উনি জলপাইগুড়ির বাড়ির অংশ লিখে দিতে চান।’

‘সেকি! না, না, তুমি রাজি হওনি তো!’ অনিমেষ আঁতকে উঠল।

‘উনি অর্ক এবং তোমার বাবা মায়ের জন্যে আমাকে দু লক্ষ টাকা দিতে চান। আমি এড়াতে চেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত—।’

‘তুমি পাগল হয়েছ লতা! শেষ পর্যন্ত দান নেবে?’ অনিমেষের গলায় অবিশ্বাসের সুর।

মাধবীলতা পরমহংসকে বলল, ‘এই যাও না, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনো। তোমাকে আমি ভাঁড়ের চা খাওয়াবো কথা দিচ্ছি। এদের গাড়িটা আর আটকে রাখা উচিত নয়।’

অর্ক অবাক হয়ে মায়ের মুখ দেখছিল। এত সুন্দর, দুর্গার মত মা কি করে দেখতে হয়ে গেল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *