1 of 2

১৭. শামীম আর ভুচুকে বলতেই হয়েছিল

১৭

শামীম আর ভুচুকে বলতেই হয়েছিল, মুক্কিতে লাওলেকর সাহেব এবং পারিহার সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। হাটচান্দ্রাতে ফিরে গিয়ে।

পৃথু বলেছিল, ইন্দ্রিয়সুখ তো অনেকদিনই হল। রসনা ছাড়াও তো অনেকই ইন্দ্রিয় আছে। এবং সেই সব ইন্দ্রিয়র ভজন-পূজনও তো ভাল মতোই হচ্ছে। এবার রসনাটাকে বাদ দাও। শম্বরের মাংসর আচার, শজারুর গা-মাখা গা-মাখা তরকারি, ডুমোডুমো করে কাটা আলু দিয়ে চিংকারার ডানদিকের বুকের রেজালা, চিতলের পেটের তেল, চিতলমাছের পেটিরই মতো; খরগোশের মাটি-গন্ধ বাটি-চচ্চড়ি, বড়া-তিতিরের বটি কাবাব, গুলিস্তাঁর বটেরের গুলহার কাবাব, ভাল্লুকের কবুরা, ময়ূরের কালিয়া, কৃষ্ণসারের চাঁব। অনেকেই হয়েছে। ‘ক্ষেমা দাও’ এবারে।

বলেছিল যদিও, তবু মনে মনে জানত যে, শিকারিরা শুধু মাংস খাবার জন্যেই শিকার করে না।

সেই মিটিং-এ মহম্মদ সাবীরও ছিল। মিটিং বসেছিল রাত মোহানাতে।

সাবীর মিঞা প্রচণ্ড রাম-বিরোধী। যেমন, দিগা রাম-ভক্ত। সাবীর মিঞার বদ্ধমূল ধারণা যে, শিকারে বা জঙ্গলে যে-কোনও শুভ যাত্রাতেই হৃদয়ের নয়, বোতলের রাম আর আণ্ডা এবং রাম-ভক্ত হনুমানের প্রিয় খাদ্য কলা নিয়ে গেলেই ঘোরতর বিপত্তি ঘটবে। ঘটবেই ঘটবে।

এবং আশ্চর্য ঘটেও! পৃথু দেখেছে। বিলক্ষণই ঘটে।

ভুচুও সেই মিটিং-এ উপস্থিত ছিল। কারণ, তার নামও নিশ্চয়ই বনবিভাগের নেক-নজরে আছে।

টাইগার প্রজেক্ট-এর অফিসারেরা ন্যায্য কারণে গর্বিত যে, কানহা-কোর এরিয়ার মধ্যে পোচিং একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। জে, জে, দত্ত সাহেবই বলতে গেলে মধ্যপ্রদেশের একাধিক পার্ক-এর জনক। আরও নাম করতে হয় মিস্টার এইচ, এস, পাওয়ার-এর। নামের বানান পানওয়ার। উচ্চারণে ‘ন’ উহ্য থাকে! পাওয়ার সাহেবও খুবই ডেডিকেটেড অফিসার ছিলেন। কানহা ন্যাশনাল পার্ক-এর পেছনে বড় ভূমিকা ছিল পাওয়ার সাহেবের। পৃথু আর ক’জনেরই বা নাম জানে? ও থাকে সীডল্যাক, স্টিক-ল্যাক, বাটন ল্যাক, গার্নেট ল্যাক এসব নিয়ে। ওর জগৎ অন্য জগৎ। তবে পাওয়ার সাহেবের নাম সে বিভিন্ন ফরেস্ট অফিসারদের কাছে শুনেছে বিভিন্ন জায়গায় “ব্ৰাণ্ডেরী বারাশিঙা” বাড়াতে তাঁর প্রচণ্ড পরিশ্রমের কথাও। ঊনিশশো সত্তর সনে নাকি ব্ৰাণ্ডেরী বারাশিঙার সংখ্যা কমে ছেষট্টিতে দাঁড়িয়েছিল। আর একাশিতে চারশো একান্ন হয়েছিল বেড়ে তাদের সংখ্যা।

ভুচু, সাবীর মিঞার আপত্তি সত্ত্বেও, রাতমোহানার পাথরের উপরে বসে রাম খাচ্ছিল। ভুচু যখন সাহস করে খাচ্ছিলই, তখন ভিতু পৃথুকেও একটু প্রণামী দিয়েছিল।

এই ভুচু ছেলেটার চরিত্রর মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যে, বাধা, যে-কোনও বাধাই ওকে হাঁকোয়া-করা বাঘের মতোই ক্রুদ্ধ করে তোলে। ও তখন করতে না-পারে, এমন কিছুই নেই। এ কারণে ওর জন্যে চিন্তা হয়, ওকে একরকমের ভয়ও করে পৃথু। শামীম আর সাবীরের বোধহয় পারিহার সাহেবের নামেতেই নেশা হয়ে গেছিল। লাওলেকর সাহেবের নামেতে তো হবেই।

দত্ত সাহেব, পাওয়ার সাহেব এবং বনবিভাগের আরও অনেক বড় সাহেবের কীর্তিকলাপ ও শুভ প্রচেষ্টার কথা বলে তার উপর কোনওরকম প্রভাবই বিস্তার করতে পারল না পৃথু। আজকের ভারতবর্ষে, কনসারভেশানের প্রয়োজন কতটা এবং বন এবং সবরকম বন্য প্রাণীই বাঁচানো যে কতখানি জরুরি সে কথাও অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে ওদের বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু এরা সবাই এদের নিজেদের নেশাতেই চলে। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এদের জগৎ শুধু নিজেদেরই নিয়ে। এবং ছোট্ট সে জীবনের গণ্ডি। দেশের বা দশ-এর হিতার্থে এত সব কথা শোনা এবং বোঝার মতো সময় ও ধৈর্য ওদের নেই। হয়তো, অনেকেরই মতো; মানসিকতাও নেই।

বরং, ব্ৰাণ্ডেরী-বারাশিঙার বংশবৃদ্ধির হিসেব শুনে ভুচু বলল, ঐকিক নিয়ম মনে আছে তো? ঊনিশশো সত্তরে যদি ছেষট্টিটি থেকে থাকে এবং উনিশশো একাশিতে যদি চারশো একান্নটি হয়ে থাকে তাহলে অ্যাভারেজ পার ইয়ারে ক’টা করে বেড়েছে?

বলেই, ভুচু বালির উপরে নদীতে ভেসে-আসা শুকনো ডাল ভেঙে অঙ্কটা করে ফেলল। বলল, হ্যাঁ। থার্টি-ফাইভ। বছরে, গড়ে, পঁয়ত্রিশটা। এই রেটে এইট্টি ফোরে হবে পাঁচশ ছাপান্নটা। মাইনাস, ওয়ান, ক্রুয়েলী শট বাই শামীম মিঞা দ্যাট নাইট। হাতে রইল, তাহলে, পাঁচশ পঞ্চান্নটা। অনেকই তো।

তারপর রাম-এ চুমুক দিয়ে বলল, পামেলার বাবার অফিসের বস আফ্রিকাতে গেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ইস্ট-আফ্রিকার গোরোংগোরো ক্রাটারের উপরে ফরেস্ট লজ-এর ডাইনিং রুমে, তাঁকে নাকি ওয়াইল্ড বীস্ট এর স্টেক খাইয়েছিল। বীফ-স্টেক-এর মতো। শিকার করেছিলেন গেম-ওয়ার্ডেন। নিজে। এই-ই তো সেভেনটি-নাইনের কথা। আর এখানে?

পৃথু বলল, ওখানে ওয়াইল্ড-বীস্ট-এর স্টেক খেয়ে এসেছিলেন উনি বোনা-ফিডে ট্যুওরিস্ট হিসেবে। আর এখানে তোমার স্টেকটা হচ্ছে দশ বছর জেল অথবা…।

ভুচু বলল, ওয়াইল্ড-বীস্ট এর স্টেক না খেয়ে আমি গেম-ওয়ার্ডেনের স্টেক খাব।

এত সব ইংরিজি-টিংরিজি শামীম আর সাবীর মিঞার বোধহয় ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। সাবীর মিঞা কোনও ব্যাপারেই কখনও উত্তেজিত হয়নি জীবনে। পারিহার সাহেবের ব্যাপারটি একটি চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, কারণ বারাশিঙাটাকে শামীম আদৌ মারত না; যদি-না সাবীর মিঞার তেরো-নম্বর ছেলের ছুন্নৎ-এর খাওয়া-দাওয়াটা না থাকত সেদিন। এবং ছুন্নৎটা আদৌ হত না, যদি-না তাঁর তেরো-নম্বর ছেলেটা হত। “ব্ৰাণ্ডেরী বারাশিঙা” বছরে মাত্র পঁয়ত্রিশটা করে বেড়েছে কানহাতে, সে তুলনায় হাজি মহম্মদ সাবীর মিঞার পরিবার কতটুকুই বা বেড়েছে? বিয়ে হয়েছিল আঠারো বছরে! যদি বয়স আটান্ন হয়, বিবির সংখ্যা দুই, ছেলেমেয়ের সংখ্যা তেরো। মেইন স্প্রিং এখনও ফারস্ট-ক্লাস কাজ করছে। অ্যাভারেজ-আউট করলে অঙ্কটা এই রকম দাঁড়াবে। একর্ডিং টু ভুচু—(বয়স) ৫৮-(বিয়ের বয়স) ১৮=৪০÷২ (বিবির সংখ্যা)=২০÷১৩=১·০৫০৩৮৪৬! ফুঃ।

ভুচু খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল, ডিমোক্রিসি ঝুগ ঝুগ জিও। ফ্যামিলি প্ল্যানিং করবার বেলায়, সাবীর মিঞা সাহেব কেবলই আমরা; আর পপুলেশান এক্সপ্লেশান করার বেলায় তোমরা। ডিমোক্র্যাটিক রাইট! কেস কিচাইন। তা এতই ডিমোক্রিসীতে বিশ্বাস তো জিয়াসাহেবকে একটু জিয়া-ভরলি উপদেশ দিয়ে, ভাইবিরাদরদের বলে সেখানেও ডিমোক্র্যাসীটা লাগু করে দাও না হাজি সাহেব, ইমার্জেন্সীটাকে লুঙির মতো লিফট করে?

সাবীর মিঞা হাসে। ভুচুও হাসে। ঠুঠা কিছু না বুঝেই হাসে। পৃথু তো সবসময়েই হাসে। বোকারা চিরদিনই বেশি হাসে। হাসে না শুধু শামীম।

ভুচু যখন এসব কথা বলে, প্রায়ই বলে, ভুচুর ধারণা, একই দেশে, একই আইন, একইভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত সকলের প্রতি। সকলেরই নিজের থেকে তা মেনে নেওয়া উচিত। নইলে সেকুলার স্টেট একটা ফালতু বুলি। কিছু ব্যাপারে কম্যুনাল, আর কিছু ব্যাপারে সেকুলার তা তো চলতে পারে না! ভুচু যখন এসব বলে, তখন শামীম চুপ করে, অদ্ভুত একটা মুখ করে ভুচুর দিকে চেয়ে বসে থাকে। ওই বুনো কুকুরে চোখ-খুবলানো বারাশিঙাটাকে সেদিন যখন মেরেছিল তখন ওর মুখে যেমন এক নিষ্ঠুর হিমেল ভাব ফুটে উঠেছিল, এখনকার মুখের ভাবটাও অনেকটা তেমনই।

ব্যাপারটা পৃথুর ভাল লাগে না। সাবীর মিঞা বলে, আরে, দোস্তিতে সবরকম আলোচনাই হয়। দোস্ত, দোস্ত-এর সঙ্গে মজাক উড়াহবে না তো দুশমন উড়াহবে?

কিন্তু শামীম একেবারেই চুপ করে থাকে।

ভুচুটাও অদ্ভুত ছেলে। অদ্ভুত জেদি। ও যা বিশ্বাস করে, তা ও বলবেই। সে ভালই হোক কি মন্দই হোক, প্রিয়ই হোক, কি অপ্রিয়ই হোক। ও ওর এই নির্বুদ্ধি স্বভাবের জন্যে খুবই বিপদে পড়বে একদিন। প্রায়ই পড়েও। কিন্তু কিছুকেই গ্রাহ্য করা ওর স্বভাবে নেই। জীবনে শিশুকাল থেকে ও আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছে, পৃথুর মতো নয় ও। বিপদ, কোনওরকম বিপদের ভয়ই ও করে না।

ঠুঠাকেও একটু রাম দিয়েছিল ভুচু। ঠুঠা চুপচাপ কথা শুনছিল। চুট্টা খেতে খেতে।

ও হঠাৎ বলল, আমাদের তো যা হবার হবেই। কিন্তু পারিহার সাহেব বা তাঁর কোনও ডেপুটি হাটচান্দ্রাতে এনকোয়ারিতে এলে পাগলা ঘোষষার কী হবে? পিরথু বাবার?

সকলেই একসঙ্গে হেসে উঠল ওর কথা শুনে। পৃথুও।

শামীম তবুও হাসল না।

শামীম বলল, লাল্লুকে কি শেখানো দরকার?

ডেকে ধমকাতে হবে। ঠুঠা বলল।

স্রিফ ধমকাতে? বেইমান। নিমকহারাম। আমি ওর জিভ কেটে নেব।

সাবীর মিঞা বলল, ও নিজের মুনাফার জন্যেই নিশ্চয়ই বলেছে, কিন্তু বেইমানি করার জন্যে বলেছে, না মারের চোটেই বলে ফেলেছে সে সব সম্বন্ধে খবরাখবর করো আগে। কিছু না জেনেই, “শিখলাতে হবে” বলে লুঙি তুলে দৌড়োবার দরকারটাই বা কী?

দিগার কী খবর? দিগাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করেনি তো ফরেস্ট গার্ডরা? ওর কাছ থেকেই হয়তো খবর পেয়েছে।

ভুচু বলল।

হতে পারে। ঠুঠা বলল। ও যা সত্যবাদী। মানে, আমাদের দিগা। আমাদের জন্যে মিথ্যা বলে নরকবাসের বন্দোবস্ত করবে কোন সাধু। এই শামীমটাই যত নষ্টের গোড়া। বললাম, চলো নুনীতে যাই। তা না!

পৃথু বলল, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। শামীম ভাই। তুমি তাহলে কালই সকালে একবার চলে যাও তোমার মোটর সাইকেলটা নিয়ে, দিগার খোঁজ করে এসো। সত্যিই তো। আমাদের অনেক আগেই ও বেচারার খোঁজ করা উচিত ছিল।

শামীম একটা পাতলা লম্বা ভোঁর ঘাস কাটছিল দাঁতে। ওর এই-ই এক বদভ্যাস। যখনই চুপ করে থাকে, তখনই ঘাস কাটে দাঁতে। কথা বলার সময়ও ডান হাতে ধরে থাকে ঘাসটা। কথা শেষ করেই আবার মুখে পুরে দেয়।

ভুচু বলে, গত জন্মে ও বকরি ছিল। গত জন্মে কেবলই ঘাস খেয়েই গেছে পেট ভর্তি করে। এজন্মে তাই-ই জাবর কেটে তা হজম করার ধান্দা। অজীব আদমি।

কে যে বেশি অজীব আর কে যে কম সেইটাই প্রশ্ন। অজীব এখানে সকলেই।

পৃথু বলল, আমি এবার উঠব। আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। মিলির আজ জন্মদিন। রাত তো অনেক হল। এতক্ষণে ওর বন্ধুরা চলে যাবে না? ভুচু বলল।

ওরা চলে যাওয়া অবধিই তো অপেক্ষা করছিলাম।

সে কী?

ভুচু অবাক হয়ে বলল।

আমি থাকলেই বরং ওরা বিব্রত হয়। মিলিও হয়। ওর বন্ধুরাও হয়। ওর বন্ধুরা ছোটবেলা থেকেই আমাকে তো না-দেখেই অভ্যস্ত। আমার ছেলেমেয়ের কাছে রুষাই তো সব। পড়াশুনা বল, ওদের খেলাধুলো, জামাকাপড় বানানো, ওদের গুড ম্যানার্স, ওদের ব্রিলিয়ান্স, ওদের ডায়েট, ওদের একসারসাইজ সবই ওদের মা। রুষা, ওদের মা এবং বাবাও। ওয়ান, ওনলি এণ্ড টোটাল প্যারেন্ট।

বেশ বলেছ তো কথাটা!

পৃথু বলল, তাই-ই। ওয়ান, বাট টোটাল পেরেন্ট!

তুমি তাহলে কী? নন-এগজিসটেন্ট পেরেন্ট। তুমি কি হাপিস হয়ে গ্যাছো?

পৃথু হাসল। বলল, আমার কথা আর বোলো না। আমি একটা লজ্জা। আমি একটা কিছুই নই। আ গ্রেট শেম অন দ্যা ফ্যামিলি! আ কনসেপ্ট অফ নন-এনটিটি! তাড়াতাড়ি করছি, মিলিটা ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটু চুমু দিয়ে দেব।

প্রেজেন্ট দেবে না?

ভুচু শুধোল।

আমি? আমি আবার কী দেব? আমি কী-ই বা বুঝি? তাছাড়া, আমার টেস্টও অতি বাজে। কী কিনতে, কী কিনব। পয়সার শ্রাদ্ধ। মা ও মেয়ে দুজনেই মুখ বিকৃত করবে। তাছাড়া টাকা পয়সা সব তো দিয়ে দিই আগেই। আমার হাতে আলাদা কিছু থাকলেই-না কিনতে পারতাম!

তারপর বলল, ছাড়ো, আমার কথা ছাড়ো!

তুমি তো বেশ লোক পৃথুদা। মিলির জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করলে না!

পৃথু অভিনয় করল। বলল, ঈসস একদম ভুলে গেছি।

সাবীর মিঞা, ঠুঠা শামীম ওদের কাউকে বলোনি? কোনওবারই বলো না বুঝি? আমি তো অবশ্য জানিই না। এ দলে আমিই তো নয়া-চিড়িয়া।

হ্যাঁ। বলি, আবার বলিও না…মানে,…

কথাটা এড়িয়ে গেল পৃথু। নিজে অন্যায় করলে, দায়িত্বহীনতা ঘটলে, অনেকসময় অনেককেই মিথ্যে কথা বলতে হয়। এ-কাজটা অনেকে খুব ভালই পারে। একটুও চোখের পাতা কাঁপে না তাদের। মিথ্যাটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করে তারা। অনেকে আবার একটুও পারে না। চোখের পাতা কেঁপে যায়, ঠোঁট কাঁপে, গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু কথা, সঙ্গে যখন নিজের কোনও অ্যাক্ট বা অমিশান জড়ানো থাকে না, অন্য কারও অ্যাক্ট বা অমিশানের জন্যেই যখন মিথ্যেটা বলতে হয়, পাছে খারাপ না-ভাবে সেই মানুষকে লোকে, তখন সত্যিই বড় অসহায় লাগে। অথচ নিজের অপরাধের জন্যে নয়, অন্যের অপরাধ চাপা দেওয়ার জন্যে নিজেকে মিথ্যাচারিতার অপরাধে অপরাধী করতে হয়।

ভুচুর গাড়িতে উঠল ঠুঠা আর পৃথু। সাবীর মিঞা গেল শামীম-এর মোটর সাইকেলে। ভুচু গাড়িটা স্টার্ট করার আগেই পৃথু বলল, আমরা সবাই সাবীর মিঞার দোকানে যাচ্ছি কাল বিকেলে। শামীম, তুমি সকালে গিয়ে কিন্তু লাল্লুর খবরটা নিয়ে আসছ।

বিকেলে, ক’টায়?

সাবীর মিঞা বলল।

এই চারটে-সাড়ে চারটেতে।

না, না। একটু দেরি করেই এসো। রাতের খাওয়াটা ওখানেই। কাল আমি নিজে বিরিয়ানি রাঁধব। অনেকদিন নিজে রাঁধি না।

বিরিয়ানি! বাঃ উমদা! উমদা।

না খেয়েই উমদা?

বাঃ। বিরিয়ানি যে! গন্ধ পাচ্ছি নাকে। পৃথু বলল।

পৃথুকে বাড়িতে নামিয়ে দেওয়ার সময় ভুচু হঠাৎ হিপ-পকেটে হাত দিয়ে পার্সটা বের করে বলল, পৃথুদা এই টাকাটা মিলিকে দিও। আমার নাম করে।

না, না। এ কি! টাকা কেন? এত টাকা! তাছাড়া রুষা রাগ করবে।

বৌদিকে বলবার কী দরকার?

না, না। আরে, বৌদিই তো ওদের সব। ছেলেমেয়েদের ভাল তো কিছুই আমার দ্বারা হল না, আমার জন্যে ওদের কিছুমাত্র ক্ষতি হোক, স্বভাব খারাপ হয়ে যাক আমারই প্রশ্রয়ে, তা আমি চাই না। ওরা খুব ভাল হয়েছে, পড়াশুনায়, খেলাধুলোয়, ব্যবহারে, সকলে ওদের খুব ভাল বলছে তা শুনেই খুব আনন্দ হয় রে আমার। তোর বৌদি, রুষা না, বুঝলি, দারুণই এফিসিয়েন্ট মেয়ে। খুব কম ছেলেমেয়েই এমন মা পায়। ওর কোনও তুলনা নেই।

যাই-ই হোক, টাকাটা তুমি নাও। লুকিয়ে দিতে হবে না। বৌদিকেই দিয়ো।

ঠিক আছে!

চলি, পৃথুদা। ভুচু বলল।

আচ্ছা, পিরথু বাবু। বলল, ঠুঠা।

গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *