১৭ জুলাই, শনিবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যারও পরে ডাক্তারের ছেলে খোকন আর খোকনের ছোট খালা মঞ্জু এনায়েতপুর থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছে। ডাক্তার পরশুদিনই সকালে রাজশাহী রওনা হয়ে গেছেন। অল্পের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে ওদের দেখা হল না।
আজ সকালে রান্নাঘরে তরকারি কুটতে কুটতে মঞ্জুর কাছে শুনছিলাম ওর ঢাকা আসার পথের আতঙ্কিত, লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কাহিনী।
মঞ্জুররা এনায়েতপুর থেকে যমুনা নদীর ঘাটে লঞ্চে ওঠে। লঞ্চ সিরাজগঞ্জ ঘাট ছুঁয়ে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর ঘাটে এসে থামে। এখানে মঞ্জুর এক দুলাভাই শাজাহান ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে গাড়িতে ঢাকা।
লঞ্চে থাকার সময় নদীর বুকে এমন একটা ঘটনা ঘটে, যেটার কথা মনে করে মঞ্জু এখনো মাঝে-মাঝে শিউরে উঠছে।
বুঝলেন আপা, সিরাজগঞ্জ ঘাট ছাড়ার পর হঠাৎ একটা আর্মি ভর্তি স্টিমার। আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে আসতে আসতে চিৎকার করে লঞ্চ থামাতে বলল। আমরা তো ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু। আর বুঝি কারো রক্ষা নেই। কিন্তু ওরা শুধু একজন। লোককেই খুঁজছিল। সে হলো সিরাজগঞ্জ কওমী জুট মিলের এক ইঞ্জিনিয়ার। তাকেই ধরে নিয়ে গেল। অন্য যাত্রীদের কাউকে কিছু বলল না।
তুমি চিনতে ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে?
না আপা, আমি কি করে চিনব? উনাকে ধরে নিয়ে যাবার পর লঞ্চের অন্য লোকেরা বলাবলি করছিল–তাই থেকে জানলাম। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল আর্মিগুলো যেভাবে ঐ দ্রলোককে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করছিল, তা শুনে। ওরা বলছিল, তোমার মতো এরকম মশহুর আদমির এত ছোট লঞ্চে যাওয়া কি মানায়? এই খে, তোমার জন্য আমরা কতো বড়ো স্টিমার নিয়ে এসেছি।
আমার বুক ফেটে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঐ ইঞ্জিনিয়ারটি নিশ্চয় গোপনে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওর কপাল মন্দ, ব্যাপারটা কোনভাবে পাক আর্মির কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁস করে দেবার মতো দালাল, রাজাকারদের তো অভাব নেই দেশে। নাকি, দেশের কাজ করতে গেলে এভাবে জীবন দিতেই হবে? কপাল মন্দ বলছি কেন? এতো ঐ লোকটির জন্য গৌরবের কথা।
গৌরবের কথা?
হঠাৎমনে হলো দম আটকে আসছে। লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাঁজর চেপে ধরেছে।
আর তরকারি কুটতে পারলাম না। বসার ঘরে এসে ডিভানে শুয়ে পড়লাম, মঞ্জুর ভয় পেয়ে জামীকে ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি বললাম, ও কিছু না। শরীরটা। কিছুদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। খাটনি বেশি হয়ে গেছে। রান্নার লোক নেই তো, তাই। একটু পরে ঠিক হয়ে যাব।