1 of 2

১৭. গড়গড়া টানছেন অর্ধেন্দুশেখর

অফিস ঘরে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর জোড়া পা তুলে দিয়ে গড়গড়া টানছেন অর্ধেন্দুশেখর। আজ তাঁর মেজাজ বেশ প্রসন্ন। তার হাতে ঝিকমিক করছে একটি হিরের আংটি, টেবিলের ওপর বয়েছে একটি টাকা হোড়া। এই টাকাটার বড় প্রয়োজন ছিল। ইদানীং টিকিট বিক্রি আশানুরূপ নয় বলে থিয়েটারের মালিক বেনারসী দাস নট-নটী, কলাকুশলীদের পুরো মাইনে দেয় না। আগে অর্ধেন্দুশেখর যখন এমারাল্ড থিয়েটারের মালিক ছিলেন নিজে, তখন তিনি প্রায়ই তার সঙ্গী-সাথীদের বেতনের অতিরিক্ত পারিতোষিক দিতেন। এক একদিন টিকিটঘর থেকে এক মুঠো টাকা এনে তিনি কোনও সহকারীকে বলনে, ওরে, আজ একটা খানাপিনার বাবস্থা কর। মাঝে মাঝে ফুর্তি না প্রলে কি আর অভিনয় জমে।

এখন তিনি নিজেই বেতনভুক কর্মচারী, টিকিটঘরের টাকা যথেচ্ছ খরচ করার অধিকার তাঁর নেই। অথচ হিসেব বহির্ভূত টাকা খরচ করতে না পারলে তাঁর মনটা ছটফট করে। আজকের এই এক হাজার টাকা স্বয়ং ভগবান যেন ত্রিপুরার মহারাজের হাত দিয়ে পাঠিয়েছেন, মালিকের কাছে এই টাকার হিসেব দিতে তিনি বাধ্য নন। অর্ধেন্দুশেখর সকলের মধ্যে সমবণ্টনেও বিশ্বাস করেন না। কিংবা যে-সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর বড় বড় ভূমিকা তাদের বেশি টাকা আর ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্রদের সামান্য টাকা, তাও না। বড় থেকে ছোট সকলেরই নাড়িনক্ষত্র জানেন তিনি, তিনি বোঝেন কার প্রয়োজন কতখানি। যার মাসিক বেতন কুড়ি টাকা, সে আজ হঠাৎ অর্ধেন্দুশেখরের কাছ থেকে চল্লিশ টাকা পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হল সেই রকমই একজন তো আনন্দের চোটে অর্ধেন্দুশেখরের পা জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিল। আবার যার বেতন পঞ্চাশ টাকা, তার হাতে পনেরোটি টাকা গুঁজে দিয়ে তিনি বললেন, জগা, তোকে তো যা দেব, তার এক পয়সাও বাড়িতে পৌঁছবে না, রামবাগানে গিয়ে বিলাসিনীর ঘরে খোলামখুচির মতন মালকড়ি ছড়াবি, যা, এই পনেরো টাকা নিয়েই আজ কাপ্তেনি করগে যা!

মানুষকে দেওয়াতেই অর্ধেন্দুশেখরের আনন্দ, নিজের জন্য তিনি কিছু রাখতে চান না। হিরের আংটিটাও তিনি দু’দিন বাদে বিক্রি করে সেই টাকায় আবার কোনও বিপদাপন্ন সহকর্মীকে সাহায্য করবেন। এক একজনকে ডেকে ডেকে টাকা দিতে দিতে ছোড়া প্রায় খালি হয়ে এসেছে, সেই সময় তিনি নয়নমণিকে ভেতরে আসতে বললেন।

ঐতিহাসিক নাটকের রানির সাজগোজ ছেড়ে নয়নমণি একটা আটপৌরে শাড়ি পরে নিয়েছে। চুল পিঠের ওপর খোলা। রং তোলার জন্য সে অনেকক্ষণ ধরে মুখ ধুয়েছে, সেই সময় যে সে কান্নাও ধুচ্ছিল, তা অবশ্য কেউ জানে না। অভিনয়ের সময় ছাড়া নয়নমণির অঙ্গে থাকে না কোনও অলঙ্কার।

মখমলের তোড়াটা টিপে দেখে অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তোকে আমি কী দিই বল তো নয়ন! এ তো ফুরিয়ে এসেছে দেখছি, আরও কয়েকজনকে দেওয়া বাকি রয়ে গেল।

নয়নমণি মৃদু স্বরে বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না, আপনি বরং উদ্ধবাদাকে কিছু বেশি দিন, গত সপ্তাহে ওঁর একটি ছেলে হয়েছে, বউয়ের শরীর ভাল নয় শুনেছি–

অর্ধেন্দুশেখর চোখ পাকিয়ে বললেন, উদ্ধব দাস? সে তো একটা হারামজাদা! বাইশ টাকা মাইনে পায়, তা দিয়ে আবার জুয়ো খেলে। কত নম্বর সন্তান হল, সতেরোটা নয়? পেটে ভাত জোটে না, তবু গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চার বাবা হবার শখ। বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে দুচোর কেন? বউটাকে একেবারে মেরে ফেল্লে। আর বউটাও হয়েছে তেমনি, বছর বিউনি! উদ্ধবের এ নাটকে পার্টও নেই, ওকে আমি পাঁচ টাকার বেশি দেব না!

নয়নমণি বলল, আর একটু বেশি দিন। বাচ্চাটার দুধের বন্দোবস্ত করতে হবে। মায়ের বুকে দুধ নেই।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, জন্ম দেবার আগে সে কথা মনে ছিল না? দূচক্ষে দেখতে পারি না এসব। হ্যাঁ রে নয়ন, ওই উদ্ধবব্যাটা বুঝি তোকে ধরেছে, তোকে দিয়ে কওয়াচ্ছে? সবাই জানে তত, তোর দয়ার শরীর। আমি না দিলেও তুই নিজের থেকে ওকে দিয়ে দিবি! তুই নিজের জন্য কোনও দিন কিছু চাস না, আমি দিতে গেলেও নিবি না?

নয়নমণি বললল, আমার তো কিছুর অভাব নেই। একটা মোটে মানুষ, যা পাই তাতেই বেশ চলে যায়, কিছু জমেও।

অর্ধেন্দুশেখর বলল, তোকে দু’দশ টাকা দেবার কোনও মানে হয় না। তোকে বরং… তুই আমার এই আংটিটা নে!

জিভ কেটে একটু পিছিয়ে গিয়ে নয়নমণি বলল, না, না, ওটা আমি নেব কেন? মহারাজ আপনাকে দিয়েছেন।

আঙুল থেকে আংটিটা খুলতে খুলতে অর্ধেন্দুশেখর বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। এ আংটি কখনও আমাকে মানায়? আমি কি সে রকম কাপ্তেন? হাঁ, কাপ্তেন ছিল বটে বেলবাবু, অমৃতলাল মুখুজ্যে, তোরা তাঁকে দেখিসনি, দু হাতে আটটা আংটি পরতেন। এটা খাঁটি হিরে, কমলহিরে, তোর হাতেই মানাবে। নে—

নয়নমণি হাত জোড় করে বলল, ওটা আমি কিছুতেই নিতে পারব না। আপনার জিনিস।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তুই কিছু নিবি না, তা কখনও হয়? মহারাজ তো আজ তোর অভিনয় দেখেই খুশি হয়ে এসব দানছর করে গেলেন। নাটকটা তুই একাই মাতিয়ে রেখেছিস পাগলি। নে, আমি নিজে তোকে দিচ্ছি, না বলতে নেই, হাত পাত।

নয়নমণি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমি কিছুতেই নিতে পারব না, বিশ্বাস করুন, সোনা-রুপো-হিরে-মুক্তো আমার অঙ্গে সয় না।

একটুক্ষণ হাঁ করে নয়নমণির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অর্ধেন্দুশেখর। তারপর কপালে একটা চাপড় মেরে বললেন, তুই যে তাজ্জব করে দিলি রে বেটী! কালে কালে দেখব কত। পঁচিশ বছর থিয়েটারে কেটে গেল, কোনও দিন দেখিনি বা বাপের জন্মে শুনিনি যে কোনও থিয়েটারের মেয়েকে হিরের আংটি দিলেও নেয় না! শুধু থিয়েটারের মেয়ে কেন, গয়নার লোভ নেই এমন কোনও মেয়ে মানুষ হয়? তুই কি আগে স্বর্গের অপ্সরা ছিলি নাকি রে?

নয়নমণি বলল, না, আমি সামান্যা দাসী ছিলাম।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, হ্যাঁ, মহারাজের মুখে তা শুনলাম বটে। তা দাসীরই তো কত কদর। মহারাজ আবার তোর গান শুনতে চেয়েছেন। দেখবি হয়তো, খুশি হলে তোকে একটা গজ মুক্তোর মালা পরিয়ে দেবেন। তখন কি তুই ফেরত দিতে পারবি?

নয়নমণি জিজ্ঞেস করল, আমি আপনার সামনে একটু বসব?

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, হ্যাঁ, বোস, বোস। কতদিন তো ভাল করে কথাই হয় না। একদিন যে বেঁধে খাওয়াবি বলেছিলি? ভিণ্ডালু রাঁধতে জানিস? সর্ষে দিয়ে মাংস!

নয়নমণি খানিকটা অস্থির হয়ে বলল, হ্যাঁ, খাওয়াব, নিশ্চয়ই খাওয়াব। আপনার কাছে একটা অনুরোধ জানাতে এসেছি। আমি কাল কোথাও যাব না, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।

সচকিতভাবে সোজা হয়ে বসে সবিস্ময়ে অর্ধেন্দুশেখর বললেন, তুই যাবি না? কেন? এলেবেলে জমিদার নয়, রাজত্বহীন বাজা নয়, আস্ত একটা স্বাধীন রাজ্যের মহারাজ, তিনি নিজের মুখে হোর গান শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, তবু তুই যেতে চাইছিস না? অন্য যে-কেউ এমন ডাক পেলে ধন্য হয়ে যেত। মহারাজের যখন বাই চেপেছে, অনেক কিছু দেবে থোবে।

নয়নমণি বলল, আমার একটা শপথ আছে। আমি কারুর বাড়িতে মুজররা খাটতে যাব না। একা একা কোনও পুরুষ মানুষকে গান শোনাব না।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কারুর বাড়ি আর রাজার বাড়ি কি এক হল? ওঁদের ইচ্ছে হলে তার আর প্রতিবাদ করা যায় না। ছেলেমানুষি করিসনি নয়ন, তোর ভালর জন্য বলছি, আমাদের থিয়েটারের ভালর জন্য বলছি, কাল তুই তে যাবিই, আমিও তোর সঙ্গে যাব। মহারাজ কলকাতায় এলে অমৃতবাজার পত্রিকায় আর্টিকেল বেরোয়, তাতে তার নাম উঠে গেলে তোর আরও মান বাড়বে।

অর্ধেন্দুশেখরের সামনে কোনও দিন মুখ তুলে উঁচু গলায় কথা বলে না নয়নমণি। অর্ধেন্দুশেখর তার পিতৃতুল্য, গুরু। আজ সে দৃঢ় গলায় বলল, যদি আত্মহত্যা করতে হয়, তাতেও রাজি আছি, কিন্তু আমি কিছুতেই যাব না।

অর্ধেন্দুশেখর এবার চোখ সরু করে বললেন, তুই ত্রিপুরার মেয়ে, এক সময় মহারাজের বাড়িতে দাসী বাঁদি ছিলি, এসব আমাদের আগে কিছুই জানাসনি।

নয়নমণি বলল, আমি ত্রিপুরার মেয়ে নই, সেখানে কস্মিনকালেও যাইনি। আমার জন্ম উড়িষ্যায়। আতান্তরে পড়ে এক সময় মহারাজের কলকাতার বাড়িতে বাঁদিগিরি করেছি বটে। কিন্তু মহারাজের বাঁদি ছিলাম না। তাঁর এক কর্মচারীর সেবা করতাম।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ও একই কথা। বাড়ির সব বাঁদিই মহারাজের বাঁদি।

নয়নমণি বললেন, না, একই কথা নয়। আমি মহারাজের কাছ থেকে এক আধলাও বেতন নিইনি, উনি আমাকে কিনেও বাখেননি।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কিন্তু মহারাজ সবার সামনে নিজের মুখে বললেন, ওদের কথার ব্যত্যয় হয় না। ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাটা শোন, নয়ন। ওসব শপথ-টপথ শিকেয় তুলে দে। বাঁচতে গেলে অনেক কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মেছিস, পুরুষ জাতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কতদুর যাবি? তাও মহারাজ বলে কথা। উনি যদি ক্রুদ্ধ হন, পুলিশে এত্তালা দিলে তোকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। উনি যদি বলেন, তুই ওর বাড়ি থেকে হিরে জহরত চুরি করে পালিয়ে এসেছিলি, তখন কি পুলিশ তোর কথা বিশ্বাস করবে? ওঁদের কত ক্ষমতা, ইচ্ছে করলে আমাদের থিয়েটারটা ধ্বংস করে দিতে পারেন। একেই তো টিম টিম করে চলছে।

নয়নমণি বলল, ওসব আমি বুঝি না। পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে জেল খাটব, তবু আমি ওর কাছে যাব না। এজন্য আপনি যদি আমাকে এ থিয়েটার থেকে তাড়িয়ে দিতে চান, তাও দিন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ধেন্দুশেখর বন্সল, তোর এতখানি জেদের কারণ তো আমি বুঝছি না। তবে কি তোর পাখা গজিয়েছে! এইবার উড়বি, তাই না? তোর নাম-ডাক হয়েছে, তার জন্য এখন টিকিট বিক্রি হয়। তোকে আমি শিখিয়ে পড়িয়ে এই জায়গায় এনেছি। এখন অন্যরা তোকে নিয়ে টানাটানি করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। থিয়েটারের জগতে এটাই নিয়ম। আমি জানি, স্টার তোকে চাইছে। মিনার্ভাও তোকে বাগাবার জন্য দালাল লাগিয়েছে। আমি এখন ফুটো জাহাজ, আমার হেনস্থা দেখে সবাই হাসবে, আমার দলের লোকেরা আমায় লাথি মেরে একে একে সবাই চলে যাবে। তুই সেটা শুরু করলি, তুই পথ দেখালি।

নয়নমণি ধীর স্বরে বলল, আমি আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। বরং আমি থিয়েটার এম্বোরে ছেড়ে দেব, তবু আমি অন্য কোথাও যাব না। আপনি আমায় অবিশ্বাস করলেন? এর চেয়ে আমার বুকে একটা ছুরি বিধিয়ে দিলেও কম কষ্ট হত।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ওসব ঢংয়ের কথা রাখ। দেখলাম তো কত জীবনে! বেশ্যাপাড়ার মাগিগুলো থিয়েটার করতে এসে শেখানো ডায়ালগগুলোর কিছুই মানে না বুঝে তোতাপাখির মতন মুখস্থ বলে। ওমা, দুতিন বস্ত্র কাটতে না কাটতেই সেই ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। কাল তু যাবি কি না বল।

নয়নমণি বলল, না, আমি পারব না।

অর্ধেন্দুশেখর বলেন, তবে তোকে সাফ সাফ কথা জানিয়ে দিচ্ছি। মহারাজ এক হাজার টাকা দিয়ে গেলেন, হিরের আংটি দিলেন, আমার লোকেরা কটা দিন খেয়ে বাঁচবে। এর পর তাঁর সামান্য একটা অনুরোধ রাখতে পারব না, এত অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না। থিয়েটারের গাড়ি কাল বিকেলে তোর বাড়িতে যাবে, তুই যদি সে গাড়ি ফিরিয়ে দিস তা হলে আমি নিজে গিয়ে মহারাজকে

নিয়ে আসব যে তুই আমার কথার অবাধ্য হয়েছিস, তোর সঙ্গে এমারাল্ড থিয়েটারের আর কোনও সম্পর্ক নেই।

নয়নমণি হাত জোড় করে বলল, আমি আপনার কাছ থেকে কোনওদিন কিছু চাইনি। একবার শুধু আমাকে এইটুকু ভিক্ষা দিন। আমাকে শপথ ভাঙতে বলবেন না।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ছিলি রাজবাড়ির দাসী। তোর এত জেদ হল কী করে? এখন যা, বাড়িতে গিয়ে ভাল করে ঘুমা। কাল সকালে ভাল করে ভেবে দেখলেই বুঝবি, আমি যা বলছি, ঠিকই বলছি। বড় মানুষদের হটিয়ে থিয়েটার চালানো যায় না।

নয়নমণি পিছন ফিরে আস্তে আস্তে চলে গেল, অর্ধেন্দুশেখর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। এ মেয়েটার রহস্য তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। কী অপুর্ব ওর শরীরের গড়ন, ক্ষীণ কোমর, গুরু নিতম্ব, পিঠের দিকটা ত্রিভুজাকৃতি, ওর চলার একটা ছন্দ আছে, শ্রীবা উন্নত করে হাঁটে। নাচে-গানে ওর জুড়ি নেই। সাধারণ কথাবার্তায় ওর বেশ বুদ্ধির পরিচয় ও পরিহসজ্ঞান আছে। এমন এক বরবন্দিনী পুরুষদের এড়িয়ে চলে কেন? আর্ধেন্দুশেখর খবর পেয়েছেন যে অনেক ধনবান যুবকই ওর পেছনে ঘুর ঘুর করে, কিন্তু নয়নমণি পাত্তা দেয় না কারুকেই। থিয়েটারের কোনও পুরুষকেও ও বাড়িতে যেতে দেয় না। কেন?

রঙ্গমঞ্চে যৌবন ক্ষণস্থায়ী। থিয়েটার করে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কেউ বড়লোক হতে পারে না, মালিকদেরই ধন বৃদ্ধি হয়। নয়নমণির মতন রূপ-যৌবন সম্পন্ন খ্যাতনামী অভিনেত্রীরা কোনও-না-কোনও বড় মানুষের রক্ষিত হয়ে একটা-দুটো বাড়ির মালিকানী হয়ে যায়। সেই বাড়িই তাদের ভবিষ্যতের নিরপত্তা। বিনোদিনীকে নিয়ে এককালে কতজন ছিনিমিনি খেলেছে, কিন্তু বুদ্ধিমতী বিনোদিনী অদ্ভুত তিনখানা বাড়ি কিনে রেখেছে নিজের নামে। কুসুমকুমারী, বনবিহারিণী, তিনকড়ি এদের সকলেরই বাবু আছে, এরাও বাড়ি কিনেছে, অর্থ-অলঙ্কার জমিয়েছে থিয়েটার হাড়লেও আরামে থাকবে। আর এই নয়নমণি ওদের সমকক্ষ হয়েও আজও থাকে গঙ্গামণির ভাড়া বাড়ির একখানা ঘরে। একজন মহারাজের আমন্ত্রণও ফিরিয়ে দেয়।

অর্ধেন্দুশেখরের মনটা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল। মনের এক অংশে তিনি তারিফ করতে লাগলেন নয়নমণির এই তেজস্বিতার। কত স্ত্রীলোক নিয়েই তো ঘাঁটাঘাঁটি করলেন এ জীবনে, এমনটি আগে কখনও দেখেননি। পাঁঠা-ছাগলের যেমন স্বাভাবিক জীবন নেই, জন্ম থেকেই বন্দিদশা, তেমনি মেয়েরাও বলি প্রদত্ত। পুরুষের ইচ্ছার অধীন তাদের থাকতেই হবে। থিয়েটারের মেয়েরা সবাই নষ্ট, তাদের বিয়ে হয় না, যতদিন যৌবন থাকে ততদিন তাঁতের মাকুর মতন এক পুরুষের আশ্রয় থেকে অন্য পুরুষের কাছে যেতে বাধ্য হয়। বুড়ি হয়ে গেলে হয় বাড়িউন্সি। এই মেয়েটি তার ব্যতিক্রম। একে তো সম্মান করাই উচিত।

আবার তিনি ভাবলেন, এই জেদি মেয়েটা এক অসম্ভবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতেছে। যে কোনও দিন ওর বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। এখনকার সমাজে যা দেখা যাচ্ছে, একমাত্র উচ্চবিত্ত ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরাই কিছুটা স্বাধীন, তুই সে রকম কোনও পরিবারে জন্মাসনি কেন? তোর জন্মের ঠিক নেই, এসেছিস থিয়েটারে ঘোমটা খুলে খ্যামটা নাচতে, এখানকার নিয়ম তোকে মানতে হবে না? যে-সব ধনী উছুল যুবকদের তুই ফিরিয়ে দিচ্ছি, তারা তোকে ছাড়বে কেন? একদিন কেউ হঠাৎ গুতা দিয়ে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে, আটকে রাখবে কোনও বাগানবাড়িতে। তাঁর মনে পড়ে ঘোট হরি ওরফে কাত্যায়নী নামে একটি অভিনেন্ত্রীর কথা। অর্ধেন্দুশেখর তখন মিনার্ভায় ছিলেন, নতুন নতুন এসেছিল ছোট হরি, তার বড় দেমাক ছিল। একদিন সাজধরে একটা ছোঁড়া ঢুকে পড়ে বেলেল্লা করছিল, কাত্যায়নী রাগের মাথায় তার গালে কষিয়ে দিল সপাটে এক চড়। সে ছোঁড়াটা ছিল শেঠদের বাড়ির ছেলে, সে এই অপমান মুখ বুঞ্জে সহ্য করবে কেন? একদিন থিয়েটারের পর ছোট হরি রাত করে বাড়ি ফিরছে, কোথা থেকে দুটো পোক ছুটে এসে তার মুখে জোর করে কী যেন মাখিয়ে দিয়ে গেল। কোনও সাঘাতিক অ্যাসিড। মুখখানা পুড়ে বীভৎস দগদগে হয়ে গেল ছোট হরির, সে মুখের দিকে আর তাকানো যায় না, তার থিয়েটারের জীবনও শেষ। নয়নমণির যদি সে রকম কিছু হয়।

এমারাল্ড থিয়েটারকে চাঙ্গা করার জনাও ত্রিপুরার মহারাজের কাছে নয়নমণির যাওয়া দরকার।

জনসাধারণের মধ্যে এ খবর রটে যাবেই যে এমারান্ডের অভিনেত্রীর গান শুনতে চেয়েছেন মস্ত বড় এক মহারাজ। এতে সেই অভিনেত্রীর চটক অনেক বেড়ে যাবে। লোকে ভাববে, এক মহারাজ বহু টাকা খরচ করে যার গান শুনছেন, আমরাও মাত্র আট আনার টিকিট কেটে থিয়েটারে ওর নাচ-গান দেখি মা কেন? আবার দলে দলে মোক ছুটে আসবে। কাল নয়নমণিকে মহারাজের কাছে নিয়ে যেতেই হবে।

বাড়িতে ফিরে নয়নমণি সব কথা খুলে বলল গামণিকে। প্রথমে তো গঙ্গামণি থুতনিতে আঙুল দিয়ে থ হয়ে গেল। হেঁজি-পেঁজি জমিদার নয়, সত্যিকারের এক মহারাজ। মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের নাম কে না শুনেছে, কলকাতায় তিনি এলে সাড়া পড়ে যায়। থিয়েটারের ধড়াচুড়ো পরা রাজা ছাড়া গঙ্গামণি স্বচক্ষে এমন জলজ্যান্ত রাজাকে দেখেই নি। তিনি এত্তেলা দিয়েছেন, সু নয়নমণি যাবে না? কত সোনাদানা দেবেন তার ঠিক নেই। সাহেব পাড়ায় একটা বাড়িও দান করে দিতে পারেন।

গঙ্গামণি বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কেন যাবি না রে? হাঁ লা, আমায় একটু বুঝিয়ে বল না, কেন যেতে চাস না?

নয়নমণি বলল, আমার ঘেন্না করে। কেউ জোর করে আমায় গান শোনাতে বললে, আমার গলা দিয়ে গান বেরোয় না।

গঙ্গামণি বলল, জোর করবে কেন? তোকে তিনি সাধ করে ডেকেছেন।

নয়নমণি বলল, না গো, দিদি। তুমি ওদের চেনো না। আমি যেতে না চাইলেও জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? পুলিশ লেলিয়ে দেবে। আমি কিছুতেই যাব না।

গঙ্গামণির মুখের রেখায় পরিবর্তন ঘটে গেল। নিজের জীবনে সে যা যা করতে পারেনি, স্ত্রীলোক হয়ে যে-সব চিন্তা কোনও দিন তার মাথাতেই আসেনি, নয়নমণির কথা ও কাজে সে রকম দৃঢ়তার পরিচয় পেয়ে সে অভিভূত। বয়েসে এত ছোট নয়নমণি, তবু যেন সে গঙ্গামণির গুরু।

সে এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ইস, জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? মগের মুল্লুক নাকি? আসুক না! ঝাঁটাপেটা করে তাড়াব। পাড়ার ছেলেদের ডাকব, তারা আমার কথা শোনে। পুলিশ লেলিয়ে দেবে? এ পাড়ার কোতোয়ালির দায়োগা আমার বাড়িতে এসে মিনি মাগনায় ফুর্তি করে যায় না? তার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলব, মুখ পোড়া, এমনি এমনি ফুর্তি করে যাবি, আবার আমার বোনটির গায়ে হাত তুলবি?

গঙ্গামণির এসব কথাতেও নয়নমণি বিশেষ ভরসা পায় না।

সে জানে, রাজা-মহারাজদের লোকবল-অর্থবলের কাছে পাড়ার ছেলেদের প্রতিরোধ তুচ্ছ। এতদিন পরেও যখন মহারাজ তার গান শোনার জন্য গোঁ ধরে রয়েছেন, তখন তিনি সহজে ছাড়বেন না। কিছু কিছু পুলিশ এ বাড়ির একতলার মেয়েদের কাছে রাত কাটাতে আসে, তা বলে পুলিশের কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু আছে নাকি? ওপর মহলের চাপ এলেই তারা রুদ্রমূর্তি ধরবে।

সারারাত নয়নমণির ঘুম আসে না। আর কাঁদে না সে, বরং তার সারা শরীর জ্বলতে থাকে। ফাঁদে পড়া ইদুরের মতন সে মহারাজের কাছে ধরা দেবে? তা হলে যে তার এতগুলি বছরের সাধনা বার্থ হয়ে গেল। সে মহারাজের একপলক দৃষ্টি দেখেই বুঝেছে, মহারাজ তাকে ছাড়বেন না। আগেকার সঙ্কল্প অনুযায়ী তাঁকে ত্রিপুরায় নিয়ে যাবেন। বন্দি করবেন খাঁচায়। দুটো বছর সে অন্ধকার নরকের মতন একটা জগতে অজস্র কষ্ট সহ্য করেছে, তারপর মুক্তির স্বাদ পেয়েছে থিয়েটারের মানুষদের সংস্রবে এসে। এখানে তার একটা নিজস্ব পরিচয় আছে, তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে দাম আছে, সেসব আবার নষ্ট হয়ে যাবে এক মহারাজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য?

সারা রাত বিনিদ্র থেকে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শয্যা ছেড়ে উঠে এল নয়নমণি। স্নান সেরে এসে ঠাকুরের মূর্তির সামনে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ছোটবেলা থেকেই সে সকালের অনেকটা সময় ঠাকুরঘরে কাটায়। পাথরের মূর্তির কাছে মনের কথা বলে। সে অবশ্য জানে, দেবতার কাছ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। তবু কারুকে তো বলতে হবে!

এখানে বসেই সে সঙ্কল্প নিয়ে নিল, যদি মহারাজের দৃষ্টি এড়াবার রাস্তা সে খুঁজে না পায়, তা হলে সে আত্মঘাতিনী হবে। অপরের ইচ্ছা-দাসী হয়ে সে আর বাঁচতে চায় না।

গঙ্গামণির ঘুম ভাঙে অনেক বেলায়। তাকে কিছু না জানিয়ে সে একটি ঠিকে গাড়ি ভাড়া করে চলে এল জানবাজারে।

ব্যারিস্টার যাদুগোপাল চৌধুরীর চেম্বার এখনও খোলেনি। যাদুগোপাল সাড়ে আটটার আগে নীচে নামে না। ভাড়া গাড়ি ছেড়ে দিয়ে গাড়ি বারান্দার রকে বসে রইল নয়নমণি। একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরা, ঘোমটা টেনে দিয়েছে অনেকখানি, তার হাত দুটিও ঢাকা, দেখা যাচ্ছে শুধু ফস পায়ের পাতা দু’খানি। সে স্থির হয়ে বসে রইল একটা মূর্তির মতন।

যাদুগোপাল তখন বাড়িতেই ছিল না। সে মাঝে মাঝে ময়দানে ঘোড়া ছুটিয়ে ব্যায়াম করতে যায়। সেখান থেকে ঘর্মাক্ত দেহে ফিরে এসে বারান্দায় এক নীলবসনা নারীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

নয়নমণি মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি অতি নগণ্য এক স্ত্রীলোক। আপনার সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।

যাদুগোপাল ভৃত্যকে ডেকে চেম্বারের দরজা খুলে দিতে বলে দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করতে চলে গেল।

ফিরে এসে নিজের গদিমোড়া চেয়ারে বসে একটা চুরুট ধরিয়ে বলল, আপনার সঙ্গী সাথী কেউ নেই? আপনি একা কী করে এলেন?

যাদুগোপালের মক্কেলদের মধ্যে নারীরাও থাকে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে, মেয়েরা নিজেদের কথা ঠিক গুছিয়ে বলতে পারে না। বিধবা কিবা স্বামী পরিত্যক্তা মহিলারা অনেকভাবে বঞ্চিত হয়। কিন্তু উকিলব্যারিস্টারদের কাছে এমনই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে নিজের পরম শত্রুর নামটিও উচ্চারণ করতে পারে না।

নয়নমণি ঘোমটা খুলে বলল, আপনি আমায় আগে দেখেছেন, হয়তো আপনার স্মরণ নেই। আমি একাই এসেছি। আপনি প্রসিদ্ধ আইনজীবী, একটি ব্যাপারে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি, আপনার ফি যথাসাধ্য দেবার চেষ্টা করব।

যাদুগোপাল বলল, ভূমিসুতা! তোমাকে সেই যে একদিন বলেছিলাম, আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। আমি মানুষের মুখ ভুলি না। তা ছাড়া এর মধ্যে দু’বার আমি সস্ত্রীক তোমার অভিনয় দেখে এসেছি। তোমাকে মনে থাকবে না কেন? তোমার তো বেশ খ্যাতি হয়েছে। কী ব্যাপার বলো তো, কোনও গোলমাল হয়েছে থিযেটারে?

নয়নমণি পরিষ্কার ভাষায় সম্পূর্ণ ঘটনাটা শুনিয়ে দিল। মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের গৃহে সে যে কিছুকালের জন্য দাসী ছিল, সে কথাও গোপন করল না।

সব শুনে যাদুগোপাল বলল, হুঁ, শুধু দুটি ব্যাপার এখনও পরিষ্কার হয়নি। একজন মহারাজের আমন্ত্রণ পেলে সব নট-নটীদেরই ধন্য হবার কথা, তোমার আপত্তি কীসের জন্য?

নয়নমণি বলল, একজন মহারাজের ইচ্ছে হয়েছে তিনি আমার গান শুনরেন, আর আমার তাঁকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে গান শোনাবাব কোনও ইচ্ছে নেই। আমি নগণ্য মানুষ হলেও আমার ইচ্ছের কোনও দাম থাকবে না।

যাদুগোপাল হেসে বলল, ইচ্ছেব লড়াই? এক রাজা বনাম এক নটী! অনেকটা রূপকথার মতন শুনতে লাগছে। শুধু এই? অন্য কোনও কারণ নেই? তোমার স্বামী… তোমার বোধ হয় বিবাহ হয়নি, তোমাদের তো কোনও না কোনও রক্ষক পুরুষ থাকে, সে আপত্তি করেছে?

নয়নমণি বলল, আমার সে রকম কেউ নেই।

যাদুগোপাল বলল, কেন নেই?

শমণি বলল, আমার দুর্ভাগ্য, মনের মানুষ এখনও পাইনি। যারা শুধু টাকা দেখায়, তাদের কাছে যেতে আমার ঘেন্না করে। আপনি আমাকে বলুন, আমার কি আত্মরক্ষা করার কোনও উপায়

যাদুগোপালের ভুরু কুঞ্চিত হল। বিলেতে থাকবার সময় একটা ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে তার পবিচ্য হয়েছিল, যাবা কার্ল মার্কস নামে এক জার্মান অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকের চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। তারা সেই চিন্তার চর্চা কবে, সারা বিশ্বে এক শ্রেণীহীন, সাম্যবাদী সমাজ স্থাপনের স্বপ্ন দেখে। তাদের সংস্পর্শে এসে যাদুগোপালেব মনেও সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে বিরাগ জন্মে গেছে।

সে বলল, ত্রিপুরার রাজা, কলকাতায় এসে জোর-জুলুম ফলাবার কে? এটা ব্রিটিশ রাজত্ব, এখানে আইন-শৃঙ্খলা আছে। আইনের চোখে একজন রাজা আর একজন সাধারণ মানুষ, সবাই সমান। তুমি কোথাও যেতে না চাইলে কেউ তোমায় ধরে নিয়ে যেতে পারবে না। আইন তাকে শাস্থি দেবে।

নয়নমণি বলল, আইন কখন শাস্তি দেয়? অপরাধের আগে না পরে? কেউ যদি খুন করতে চায়, খুনের আগে কি আইন তাকে শাস্তি দেয়? মহারাজ যদি আমায় জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ত্রিপুরায় পাঠিয়ে দেন, তারপরেও কি আইন আমাকে বাঁচাতে পারবে?

যাদুগোপাল বলল, সে রকম সম্ভাবনা আছে নাকি?

নয়নমণি বলল, আমার আশঙ্কা, আমি রাজি না হলে মহারাজের সাঙ্গোপাঙ্গবা এসে আমাকে যে-কোনও প্রকারে বন্দি করে নিয়ে যাবে।

যাদুগোপাল চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।

নয়নমণি ব্যাকুলভাবে বলল, মহারাজের প্রাসাদে যাবার বদলে আমি জেলখানায় যেতেও রাজি আছি। আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।

যাদুগোপাল এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওই অপদার্থ রাজাটা যদি তোমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে আসে, আমি ওকেই জেল খাটাব। ভূমিসূতা, তুমি একটা কাজ করতে পারবে? কয়েকটি দিন তুমি

আমার বাড়িতে থাকো। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, তিনি তোমাকে আশ্রয় দেবেন।

নয়নমণি দারুণ বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার বাড়িতে? আমি থিয়েটারের মেয়ে, সবাই আমাদের নষ্ট, পতিতা বলে জানে। কোনও ভদ্র বাড়ির অন্দরমহলে তো প্রবেশের অধিকার নেই আমাদের। এ আপনি কী বলছেন?

যাদুগোপাল বলল, মেয়েরা কি একা একা নষ্ট হতে পারে, না পতিতা হয়? যে সব পুরুষ তাদের ওই পথে ঠেলে দেয়, তারা দিব্যি ভদ্র সেজে থাকে। ওসব আমার জানতে বাকি নেই। বিলেতে থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বলে শিল্পী, তাদের আর কোনও জাত-ধর্ম থাকে না। অনেক ভদ্র বাড়িতেই তাদের সাদরে নেমন্তন্ন হয়। ভূমিসূতা, তুমি থাকো আমার বাড়িতে, আমি আজকালের মধ্যেই ওই মহারাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে চরম ধাতানি দেব।

নয়নমণি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি আমাকে ভুমিসূতা বলে ডাকবেন না। আমি নয়নমণি। ভূমিসুতা মরে গেছে।

যাদুগোপাল নয়নমণিকে নিয়ে গেল ভিতর মহলে।

মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য সন্ধেবেলা ছোটখাটো একটি দরবার সাজিয়ে বসে আছেন। আজ তাঁর অঙ্গে রাজপোশাক, মাথায় মুকুট। জনা চারেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সবাই নিম্নস্বরে গল্পগুজব করছেন। মহারাজ ঘড়ি দেখছেন বারবার। দুপুরবেলাতে অর্ধেন্দুশেখরের কাছে খবর পাঠানো হয়েছিল, সন্ধে সাড়ে ছ’টার মধ্যে নয়নমণিকে নিয়ে আসার কথা। তাঁর বাড়ির এক একদা দাসী এখন থিয়েটারের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, এটা মহারাজের কাছে বেশ শ্লাঘার বিষয়। এই মেয়েটি যেন তাঁরই সৃষ্টি, তিনি সকলকে দেখাবেন। এ বাড়ির দোতলার একটি ঘর সাফ-সুতরো করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, মেয়েটি ওখানেই থাকবে।

প্রায় সাতটার সময় এক ভগ্নদূত এসে দুঃসংবাদ জানাল, যে নয়নমণিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে পালিয়েছে, আজ তাকে পৌঁছে দেবার কোনও উপায় নেই।

খবরটি শুনে মহারাজের বদনমণ্ডলে ক্রোধের বদলে বিস্ময় ও বিষাদ ফুটে উঠল। তিনি মহিমকে জিজ্ঞেস করলেন, আসবে না? পালিয়েছে? কেন?

যহিম কোনও উত্তর দিতে পারল না।

মহারাজ আপন মনে বললেন, আমি তার গান শুনতে চেয়েছি.. সে গান শিখেছে, গান শোনাবে

কেন? আমি কি তার যত্নের কোনও ত্রুটি করতাম? সে থাকত এখানে রানির মতন। থিয়েটারে বোজ রোজ ঘুরে ঘুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলার রক্ত তোলার চেয়ে এখানে নিরিবিলিতে গান শোনানো ভাল নয়? থিয়েটারে ক’পয়সা রোজগার হয়? গয়না দিয়ে মুড়ে দিতাম ওকে।

উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে করতে তিনি ওই কথাই বলতে লাগলেন বারবার। এক সময় মহিমের সামনে এসে বললেন, ও মহিম, মেয়েটা আমাকে ভয় পেল কেন? আমি কি ওকে খেয়ে ফেলতাম? আমি বাঘ না ভাল্লুক? সবাই যে বলে, আমার দয়া-মায়া আছে, তা কি মিথ্যে? ও মহিম, বল না!

মহিম বলল, তা তো বটেই। ও মেয়েটা অভাগি, আপনার দয়া পেল না। আর কোনও গায়িকা ডেকে আনব।

মহারাজ সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ! মেজাজ নষ্ট হয়ে গেছে। আজ আর কিছু হবে না। তবে জানিস, গান শুনলে আমার সারা শরীর ভাল থাকে। কলকাতা শহরেই আয় থাকব না। চল, কার্শিয়াং, কি দার্জিলিং চলে যাই। সেখানে নিরিবিলিতে একটা মাম কাটিয়ে দেব।

একটু থেমে তিনি বললেন, কিন্তু সেখানে আমাকে কে গান শোনাবে? দিনগুলি কী করে কাটাব?

মহিম বলল, সেই জন্যই বলছিলাম, থিয়েটারে আরও তো অনেক মেয়ে গান গায়, কেউ কেউ নিশ্চয়ই যেতে রাজি হবে।

মহারাজ হাত নেড়ে বললেন, না, না, ওসব থিয়েটারের মেয়েটয়ে দিয়ে কাজ নেই! ঢের হয়েছে। তুই বরং এক কাজ কব। তুই রবি ঠাকুরকে গিয়ে একবার খবর দে। ওঁর গান বড় মধুব, শুনলে শরীর জুড়িয়ে যায়। রবিবাবুকে গিয়ে বলবি, উনি যদি আমাদের সঙ্গে কার্শিয়াং-দার্জিলিং যান, আমি বড় প্রীত হব! হ্যাঁ, এই ভাল। ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা পালিয়েছে, আপদ গেছে। রবিবাবুর গান শুনব প্রাণ ভরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *