1 of 2

১৬. মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন

মন্দাকিনী খবর পাঠিয়েছেন, বড়বাবু সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন ভবানীপুরে, ভবানীপুর তখন ঠিক কলকাতা নয়, হাইকোর্টের অরিজিনাল সাইডের বাইরে, রীতিমতন মফস্সল।

মন্দাকিনীর এখন উঠে বসার ক্ষমতা নেই, কানে একদম শুনতে পান না। ঘরে কেউ ঢুকলেই ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখের কাছে এনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখেন। মৃত্যু খুবই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, তবু এখনও মন্দাকিনীর চেহারায় এক ধরনের অপ্রাকৃত সৌন্দর্য আছে। মাথায় চুল ধপধপে সাদা, মুখখানা মোমের পুতুলের মতন, ঠোঁটে পান কিংবা রক্তের লাল লাল ছোপ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর এই, চোখদুটো দেখলেই মনে হয় সব সময় সেখানে যেন কিছু একটা কৌতুক খেলা করছে। ময়লা পোশাক কিংবা কম দামি পোশাক তিনি কখনও ব্যবহার করা পছন্দ করেন না, এখনও তিনি পরে আছেন ঝকঝকে গরদের থান, গলায় হিরে-বসানো সাতনরী হার। বিছানায় আরও অনেক গয়না ছড়ানো মনে হয় মন্দাকিনীর হুকুমে তার গয়নার বাক্সগুলো কেউ খুলে বিছানায় উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে।

সব গেছে, কিন্তু গলার আওয়াজটা এখনও নষ্ট হয়নি, অনেকটা শিশুর মতন। হাতের ইশারায় বড়বাবুকে কাছে ডাকলেন। ঘর-ভরতি লোকজন, সবাই নিঃশব্দ, সুরেশ্বরের স্ত্রী শান্তিলতা পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মন্দাকিনীর।

বড়বাবু কাছে এগিয়ে গেলেন, মন্দাকিনী পাশে জায়গা দেখিয়ে বললেন, বোস।

বড়মা, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

নিষ্ফল এই প্রশ্ন। মন্দাকিনী কিছুই শুনতে পারেন না। বড়বাবুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, অমর, তুই নিমোখারাম, ইতর, তুই ছোটলোক!

বড়বাবু একটু হেসে বললেন, বড়মা, আমি কী দোষ করেছি? তোর মুখে আমি মুড়ো ঝাঁটা মারব। মারো!

তোর গায়ে জলবিছুটি দিয়ে বাঁদর নাচালে তবে ঠিক হয়।

কী দোষ করলুম?

তুই এইখানে চুপটি করে বসে থাকবি, যতদিন না আমি মরি। যদি এক পা কোথাও যাস তো আমার মাথার দিব্যি রইল!

থাকব। কোথাও যাব না। কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি মরবে কেন?

আমার রত্নেশ্বর ঠিক তোর বয়সি ছিল। আজ সে বেঁচে থাকলে সে তার মাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে পারত? সে মরে গেল, আর তুই বেঁচে রইলি কেন? হারামজাদা, তার বদলে তুই মরতে পারলি না?

বড়মা, এত কথা বলা তোমার পক্ষে উচিত নয় এখন।

তোর মা-টা ডাইনি ছিল। তোকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সরে পড়ল। পরের ছেলে মানুষ করতে গিয়ে আমি নিজেরটাকে বাঁচাতে পারলুম না। মানুষের কপালে এও থাকে! কী পাপ যে করেছিলাম।

আমাকে বাঁচিয়েছিলে বলে এখন তোমার অনুতাপ হচ্ছে?

তোকে আমার বুকের দুধ খাইয়েছি। নিজের হাতে তোর গু-মুত পরিষ্কার করেছি, নাইয়েছি, ঘুম পাড়িয়েছি–নিজেরটাকে যত্ন করতে পারিনি তাই আমার নিজের ছেলেটা অকালে মারা গেল! কী লাভ হল তোকে বাঁচিয়ে?

বড়বাবুর মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে মন্দাকিনী এ রকম কথা বলবেন, তিনি প্রত্যাশাই করতে পারেননি। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপশোস করছেন মন্দাকিনী জীবনের একষট্টি বছর পার হবার পর এই কথা শুনতে হল। এখন তো আর কিছুই ফেরত দেওয়া যায় না! আস্তে আস্তে বললেন-বড়মা, আমিও তো তোমার ছেলের মতন।

মন্দাকিনী কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না বলে তার সমস্ত কথাই একতরফা। অনেক সময় বড়বাবুর কথার মাঝখানেই তিনি কথা বলছেন। তীব্র ভাবে বললেন, কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! বিয়ে করে একবার বউকে নিয়ে পেন্নাম করতেও আসেনি। সেই ছেলেকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি।

সুরেশ্বর কাছে এগিয়ে মন্দাকিনীর দিকে ঝুঁকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করার ইঙ্গিত করলেন। কথা বলা এই সময় সত্যিই ক্ষতিকর। সেই ইঙ্গিত দেখে মন্দাকিনী যেন নতুন রকম কৌতুক পেয়ে গেলেন। চারদিক তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ঘরে কতকগুলো শকুন বসে আছে। আমি মরলেই আমার গয়নাগাঁটি, কোম্পানির কাগজ সব ছোঁ মেরে নেবার জন্য রয়েছে। কারোক্কে কিছু দেব না। কাঙালিদের বিলিয়ে দেব!

অত্যন্ত আঘাত লাগার মতন কথা! সুরেশ্বরের মুখখানা পাংশু হয়ে গেল। দু-এক জন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বড়বাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, ছি ছি, বড়মা, এসব কী বলছ! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! সুরেশ্বর তোমার নিজের ছেলে, আর এমন ভালো ছেলে–

সত্যি কথাই। সুরেশ্বর মোটেই লোভী প্রকৃতির মানুষ নন এবং তাঁর মাতৃভক্তিতে কোনও খাদ নেই। মায়ের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ছেলে পাবে–এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

সারা জীবন মন্দাকিনী তার তেজে সবাইকে কাঁপিয়ে রেখেছেন। তাঁর মুখের ওপর কেউ কোনও দিন কথা বলতে পারেনি। ডার্বি লটারিতে ফাস্ট প্রাইজ পাওয়ার পর সেই টাকায় স্বামীর সঙ্গে বিলেতেও বেড়াতে গিয়েছিলেন একবার। সেই সময়কার একটা ছবি টাঙানো আছে দেওয়ালে–লাউঞ্জ সুট-পরা স্বামীর পাশে কালো শাড়ি-পরা চেহারা, কাঁধের কাছে একটা ব্রোচ আঁটা। শুধু রূপসি নয়, কতটা তেজস্বিনী ছিলেন, তাও ছবি দেখলে বোঝা যায়।

এখন মৃত্যুর কাছাকাছি এসে মন্দাকিনী যেন ছটফট করছেন। কিছুতেই হার স্বীকার করতে চান না–অথচ জেনে গেছেন হেরে যেতে হবেই এবার। তাই বুঝি সবাইকে আঘাত করে নিজের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিতে চান।

কিছুক্ষণ সবাই নিস্তব্ধ। সূচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে। এই সময় আলমারির মাথায় রাখা সুদৃশ্য কারুকাজ করা ঘড়িটা টুংটাং করে বেজে উঠল। যেন সময় মনে করিয়ে দিল, সময় নেই।

মন্দাকিনী শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, বউমা, তোমরা এখন একটু যাও তো। অমরের সঙ্গে আমার কথা আছে।

সবাই বেশ স্বস্তির সঙ্গেই চলে গেল ঘর থেকে। সুরেশ্বর বড়বাবুকে ফিসফিস করে বলে গেলেন, হঠাৎ শ্বাস কষ্ট হলে কোন ওষুধটা কী ভাবে দেওয়া হবে।

ঘরে এখন শুধু দু’জন। উনআশি বছরের একজন রমণীর পাশে একষট্টি বছরের একজন পুরুষ। মন্দাকিনী অবশ্য এমন ভাবে কথা বলছেন যেন অমরনাথ একটি তিন-চার বছরের শিশু।

বিছানার ওপর ছড়িয়ে থাকা অলংকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে মন্দাকিনী একটা হার তুলে নিলেন। চোখের সামনে এনে সেটা পরীক্ষা করলেন ভালো ভাবে। তারপর বড়বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন নে, এটা তোর বউকে দিবি!

বড়মা, আমার স্ত্রী মারা গেছে অনেক দিন আগে।

এই হারটি দিল্লিতে গড়িয়েছিলুম। তোর বউয়ের পছন্দ হবে। নে!

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পরে সুরেশ্বরকে দিয়ে দিলেই হবে, এই ভেবে বড়বাবু হাত বাড়িয়ে নিলেন হারটা। খুব মুল্যবান জিনিস, হাতে নিলেই বোঝা যায়।

মন্দাকিনী এবার একজোড়া বালা তুলে নিয়ে বললেন, এ দুটো দিবি তোর ছেলের বউকে। নে, ধর!

সে দুটোও বড়বাবুকে নিতে হল।

এবার ষড়যন্ত্র করার মতন ফিসফিসিয়ে বললেন, আরও নে। তোর যা খুশি বেছে নে, যত ইচ্ছে নে!

বড়বাবু হাতের গয়নাগুলো বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে বললেন, আমি কিচ্ছু চাই না! তুমি আমাকে এইজন্য ডেকেছ? আমি তোমার কাছ থেকে কখনও কিছু নিয়েছি?

তুই আমার বুকের রক্ত শুষে খেয়েছিস।

তা তো আর ফিরিয়ে দেবার উপায় নেই।

তুই আমার বড় ছেলে। আমি মরলে তুই আমার মুখে আগুন দিবি। রত্নেশ্বর নেই, তুই আছিস! কাল রাত্তিরে সরো-কে স্বপ্ন দেখলাম!

বড়বাবুর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। সরোজিনী বড়বাবুর নিজের মায়ের নাম–যাঁর চেহারাটাও তিনি কল্পনা করতে পারেন না।

মন্দাকিনী বলে চললেন, সরো ঠিক তেমনি ছেলেমানুষটি আছে, আমিই শুধু বুড়ি হয়ে গেছি। সেই রকম শ্যামলা রং, বড় বড় টানা টানা চোখ, নাকছাবি-পরা–আমায় কী বললে জানিস? আমার বললে, গঙ্গাজল, তুই আমার ছেলেকে মানুষ করেছিস–আমিও এখন তোর ছেলে রত্নেশ্বরের দেখাশুনো করি। তার কোনও কষ্ট হয় না। সে পানবসন্তে মরেছিল কিন্তু এখন তার গায়ে কোনও দাগ নেই। সররা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়! আমি বললুম, সরো, আমি কি তোর ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছি? সে অমানুষ হয়েছে! সে বিধবা বিয়ে করেছে, সে আমার মুখ দেখতেও আসে না!

মন্দাকিনীকে অনেক রকম প্রশ্ন করবার জন্য বড়বাবুর মনের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে লাগল। অথচ কোনও উপায় নেই। ব্যগ্র ভাবে তাকিয়ে রইলেন ওঁর মুখের দিকে।

সরো বললে, বিধবা বিয়ে করুক, ম্লেচ্ছ বিয়ে করুক, যা খুশি করুক। তবু তো সে বেঁচে আছে। ওকে তুই বাঁচিয়ে রাখিস। ও ছেলে যদি তোর কথার অবাধ্য হয়, তা হলে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনতে পারিস না!

বড়বাবু অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। তারপর মাথাটা নুইয়ে এনে মন্দাকিনীকে বললেন, এই তো এখন এসেছি। আমার কান ধরো!

মন্দাকিনী শীর্ণ হাতখানি তুলে বড়বাবুর মুখে বোলাতে লাগলেন। বড়বাবু চোখ বুজে ভোগ করতে লাগলেন সেই আদর। জীবনে তিনি নারীসঙ্গ পেয়েছেন, কিন্তু প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর তিনি তার শরীরে পেলেন স্নেহের স্পর্শ। তার শরীর জুড়িয়ে গেল। মন্দাকিনী বড়বাবুর থুতনিতে হাত রেখে বললেন, তুই রোগা হয়ে গেছিস! আমি যখন থাকব না–।

বড়বাবু গঙ্গার ঘাটে গিয়ে মাথা ন্যাড়া হলেন। এককোমর জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করলেন মন্দাকিনীর নামে। তখন তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল। ধর্মে তার বিশ্বাস নেই, নিজের বাবা-মায়ের পারলৌকিক কাজ তাকে করতেও হয়নি কিন্তু মন্দাকিনীর মৃত্যুর প্রতিটি আচার অনুষ্ঠান তিনি মেনে চললেন অক্ষরে অক্ষরে। সুরেশ্বরের সঙ্গে একসঙ্গে বসে তিনিও শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়লেন–মধুবাতা ঋতায়তে, মধুক্ষরন্তি সিন্ধবঃ বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ে।

এগারো দিনের দিন খুব ধূমধাম করে নেমন্তন্ন খাওয়ানো হল। ন্যাড়া মাথা, কোরা কাপড়-পরা, মুগার চাদর গায়ে বড়বাবু নিমন্ত্রিতদের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে আপ্যায়ন করতে লাগলেন। খোয়া ক্ষীর পরিবেশন করার সময় বলতে লাগলেন, এটা একটু চেখে দেখুন। এটা আমার মায়ের খুব প্রিয় ছিল। সুরেশ্বরের অনেক আত্মীয়স্বজন বড়বাবুকে চেনেই না–তারা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

মন্দাকিনীর মৃত্যুতে বড়বাবুর জীবনে একটা ইন্দ্রপতন হয়ে গেল। মন্দাকিনীর সঙ্গে তার দেখা হত খুব কম। মাঝখানে তো বেশ কয়েক বছর কোনও যোগাযোগই ছিল না–তবু মন্দাকিনীর অস্তিত্বই যেন ছিল তার কাছে একটা সান্ত্বনার মতন। এ-পৃথিবীতে বড়বাবুকে দেখা হলেই গালমন্দ করার কিংবা তুই সম্বোধন করার আর কেউ রইল না। প্রথম কয়েক দিন তিনি সর্বক্ষণ গুম হয়ে থাকতেন। চিররঞ্জন কোনও সান্ত্বনা দিতে এলেও অবুঝের মতন বলতেন, আমার কেউ নেই, আমার আর কেউ নেই। বড়বাবু এবার যেন সত্যিই একটু বুড়ো হয়ে গেলেন। তার চরিত্রে দু’-একটা পরিবর্তন দেখা দিল।

যেমন তিনি হঠাৎ তার ছেলের দিকে খুব ঝুঁকে পড়লেন। এর আগে তার সঙ্গে সূর্যর কথাবার্তাই হত খুব কম। ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করার স্বভাব তার নয়। সূর্যও একাচোরা ধরনের, গম্ভীর প্রকৃতির। কিছুদিন আগে সূর্যকে মারধর করার পর বড়বাবুর সঙ্গে তার কথাবার্তা প্রায় একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এখন বড়বাবু সূর্যকে বার বার ডেকে পাঠান, তাকে সামনে বসিয়ে নানা রকম কথা বলতে চান। কখনও কখনও নিজ থেকে সূর্যর ঘরে চলে আসেন, তার খাটের ওপর বসে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ভেবে দেখ, তুই পড়াশুনোই করবি, না ব্যবসায় লেগে যাবি? আমি কিছু জোর করব না। প্রেসিডেন্সি কলেজের ফর্ম আনিয়ে রেখেছি। সকালে উঠে এক্সারসাইজ করিস? ভোরে যদি উঠতে না-পারিস, আমি তোকে ডেকে দেব। কল-তোলা ছোলা খাবি, পেট ভালো থাকে।

যেন বড়বাবু তার রক্ত সম্পর্কের একমাত্র আত্মীয়টিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। তার কাছাকাছি আসতে চাইছেন। না হলে এ পৃথিবীতে তিনি সত্যিই একা হয়ে যাবেন।

কিন্তু সূর্যর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এর আগেই। কথাবার্তায় সে সহজ হতে পারে না। মুখ গোঁজ করে বসে থাকে, একটা-আধটা উত্তর দেয়।

তা ছাড়া ওইটুকু বয়সে সে বুকের মধ্যে সব সময় একটা গোপন ব্যাপার বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্যের কাছে সে সহজ হবে কী করে? হরকুমারের মৃত্যুর কথা সে কারোকে বলেনি, তার কোলের ওপর মাথা রেখেই মুখে রক্ত তুলতে তুলতে হরকুমারকে সে মরতে দেখেছে। সূর্য হরকুমারের একটা হাত সর্বক্ষণ চেপে ধরেছিল–পুলিশের অত্যাচারে যে হাতের দুটো আঙুল থেঁতলানো। তা ছাড়া হরকুমারের রিভলবারটাও তখন সূর্যর কাছে–সেটার কথাও কারোকে বলা যাবে না। এই গোপনীয়তা পাষাণভার হয়ে তার বুকে চেপে ছিল। মন্দাকিনীর মৃত্যুসংবাদে সূর্যর মনে একটুও দাগ কাটেনি কারণ মন্দাকিনীর অস্তিত্ব সম্পর্কেই সে আগে অবহিত ছিল না। খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে দুটি মৃত্যুতে পিতা ও পুত্রের মধ্যে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

মন্দাকিনীর উইলে বড়বাবুর নামে পঁয়তিরিশ হাজার টাকা ছিল। সে-টাকা বড়বাবু ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুরেশ্বর কিছুতেই নিলেন না। তখন বড়বাবু সেই টাকা বাগবাজারের একটি অনাথ আশ্রমে দান করলেন। দানের একটি শর্ত হল এই যে, পিতৃ পরিচয় নেই, এমন অনাথ শিশুকেও যদি কেউ পাঠায়, তা হলেও তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হবে।

শুধু তাই নয়, বড়বাবু নিজেও সেই অনাথ আশ্রম সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। আশ্রমের পরিচালনা, কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি সম্পর্কেও খোঁজ নিতে লাগলেন, রোজ বিকেলবেলা গিয়ে বসতে লাগলেন সেখানে।

ক্রমশ দেখা গেল, সন্ধ্যাবেলা আশ্রমের মাঠে একগাদা ছেলে বড়বাবুকে ঘিরে বসে থাকে বড়বাবু তাদের নানা রকম গল্প শোনান। এই সময়ে বড়বাবুকে বেশ হাসিখুশি দেখা যায়। নিজের ছেলেকেও কাছে টানতে না-পেরে বড়বাবু অনাথ ছেলেদের সঙ্গে মিশে আনন্দ পাবার চেষ্টা করছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *