১৫. মাহেশ

১৫. মাহেশ

‘তবু ভরিল না চিত্ত’!

দীর্ঘদিন ভাগীরথীর দুই তীরে তীর্থ পরিক্রমা করে রূপেন্দ্রনাথ ফিরে চললেন মাহেশে।

অনেক-অনেক কিছু দেখলেন। বর্ধিষ্ণু গণ্ডগ্রাম, আলিবর্দীর শাসনে ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে নির্বিঘ্নে। তাঁতিরা তাঁত চালায়, কুম্ভকারেরা চাকা ঘোরায়, রেশমশিল্পীরা কাপড় বোনে। চাষীরা মাঠে মাঠে ফলায় সোনার ফসল। গ্রামজীবনের মধ্যমণি ব্রাহ্মণ- সমাজ- মহামহোপাধ্যায়েরা ন্যায়ের ভাষ্য নিয়ে চুলচেরা বিচার করেন। পাঠশালা, টোল, চতুষ্পাঠী—কিন্তু যে ‘পরশপাথর’ খুঁজছেন তার দেখা পেলেন না। কোন পাঠশালায় নজরে পড়ল না বেণী-দোলানো ডাগর-চোখো কোনও বালিকা অথবা কিশোরী। ওদের অক্ষর-পরিচয় হওয়া মানা, খাগের কলম স্পর্শ করায় নিষেধ, এমনকি কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোতেও আপত্তি। সেসব নিষিদ্ধ কাজ তো শুধু বারবণিতাদের জন্য। ভদ্রঘরের মেয়ে গান গাইবে কী? পুঁথির পাতা ওল্টাবে কী? বড়জোর মুখে মুখে শিখতে পারে কিছু শুভঙ্করীর আর্যা, কড়াকিয়া, গণ্ডাকিয়া, নামতা।

জল-অচল অচ্ছুতেরা বাস করে অন্তেবাসীর মতো ভদ্রপল্লীর বাহিরে। তারাও গঙ্গাস্নান করে, তবে বামুন-ঘাটে নয়। পথেঘাটে সতর্ক হয়ে চলে, যেন তাদের ছায়াপাত না ঘটে বামুন-গায়ে।

সে নীরন্ধ্র অন্ধকারে রাজা-রাম, বিদ্যাসাগর বা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের আভাসমাত্ৰ নাই। প্রায় তিনশ বছর আগে যে বিদ্রোহী গৌড়মণ্ডলকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমের বন্যায়, তাঁর প্রভাবও লুপ্ত হতে বসেছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায় সমৃদ্ধিলাভ করেছে সন্দেহ নেই, শাক্ত-গৌড়রাজ্যের পরিমণ্ডলে সে ধর্ম এতদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত; কিন্তু তা আচার-সর্বস্ব! মূল তত্ত্ব থেকে তারা সরে গেছে। তারা মাথা কামায়, তিলক সেবা করে, খঞ্জনী বাজিয়ে মাধুকরী করে ফেরে আর কিশোরী-ভজনের তাল খোঁজে। চৈতন্যদেবের যে ঋজু ধর্মমত–আচণ্ডালকে কোলে টেনে নিয়ে হরিনাম বিতরণ করা—তা থেকে ওরা সরে গেছে। কূপমণ্ডূক ব্রাহ্মণ্যসমাজের টুলো-পণ্ডিতদের বিধানে অথবা প্রতিপত্তিশালীদের ষড়যন্ত্রে যাদের জাত গেছে তারাই হয়েছে বোষ্টম; ঠিক যেভাবে প্রাক্-শঙ্করাচার্য যুগে জাত খুইয়ে দিশেহারা মানুষগুলো ঝুঁকেছিল বৌদ্ধধর্মের দিকে, নাথ-সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে। মুষ্টিমেয় কিছু সাত্ত্বিক বৈষ্ণর—প্রভু নিত্যানন্দের প্রভাবে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, ত্রিবেণী, তেঘড়া, ভাটপাড়ায়, আর বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীর প্রভাবে তাঁদের উত্তরসাধকেরা গাঙ্গেয় উপত্যকায় আজও সেই প্রেমের ঠাকুরের পবিত্র দীপশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাঁদের প্রভাবক্ষেত্র সীমিত—আখড়ার চৌহদ্দীতে, আশ্রমের সীমান্তে অথবা নিজ নিজ ভদ্রাসনে।

রূপেন্দ্র অনেক কিছু দেখলেন—বর্তমানের স্বরূপ, অতীতের উত্তরাধিকার; কিন্তু যা খুঁজছেন তার কোনও ইঙ্গিত নেই। এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় ‘তিনি’ এখনো এসে পৌঁছাননি—সেই যাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করছেন : ‘পরিত্রাণায় সাধূনাম, বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম্।”

এতদিনে মনে পড়ে যাচ্ছে অতীত জীবনের কথা। দেশঘরের কথা। ফেলে আসা পথপ্রান্তের নানান স্মৃতি। দেশ ছাড়ার পর গঙ্গা-কাতু অথবা জগুপিসির কোন খবর পাননি। মৃন্ময়ী? হিসাবমতো এতদিনে তার সেই পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কী হয়েছে তার? পুত্রবতী হতে পেরেছে কি?

পরিচিত মানুষ বলতে একটি মাত্র লোকের সঙ্গে ঘটনাচক্রে সাক্ষাৎ হয়েছিল একদিন। গঙ্গার পারানি-ঘাটে : নবা বায়েন। দূর থেকে ওঁকে দেখতে পেয়েই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। ছুটে এগিয়ে এসেছিল কাছে। ঘাড় থেকে ঢাকটা নামিয়ে ঘাটের পাষাণ রানায় রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। স্পর্শ বাঁচিয়ে। হঠাৎ গাঁয়ের মানুষকে দেখে রূপেন্দ্রও আনন্দে ওকে বুকে টেনে নেন। নবা লজ্জিত হয়ে বলে, ছুঁয়ে ফ্যাললেন ঠাকুর।

—দূর বোকা। এ যে “মা গঙ্গার ঘাট! এখানে কি ছোঁয়াছুয়ি হয়? এক অঞ্জলি গঙ্গা মাথায় ছিটিয়ে দিলেই তো সব শুদ্ধি! তারপর? তুই কোথায় যাচ্ছিস?

নবা জানায় সে ঢাক নিয়ে শহর কলকাতার দিকে চলেছে। কর্মসংস্থান মানসে। শুনেছে, অনেক-অনেক ধনাঢ্য-ব্যক্তি নতুন-নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করছেন। বাঁধা-মাহিনার ঢাকী কি কারও প্রয়োজন নেই?

কেন যে সে গ্রাম ত্যাগ করে কর্মসংস্থানে এ-ভাবে বার হয়ে এসেছে সেটা স্বীকার করল না। এমনকি রূপেন্দ্র যখন জানতে চাইলেন—ওর ভাই হয়েছে না বোন, তখনও মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললে, জান্নে ঠাউরমশাই। গাঁয়ের খবর মোরে শুধোবেননি!

কী একটা বেদনার ভারে সে দেশত্যাগী। স্বীকার করতে পারছে না। রূপেন্দ্র পীড়াপীড়ি করেননি।

ওরা তো সব দূরগ্রামের মানুষ, হাতের কাছে রাধা-বোষ্টমীর কী শেষগতি হল সে খবরটাও জানতে পারেননি। পরদিন ফরাসডাঙার সেই যাত্রী-আবাসে সংবাদ নিতে গিয়ে চৌকিদারের কাছে খবর পান, তারা চলে গেছে—একত্রে, অথবা পৃথক পৃথক, তাও জানে না চৌকিদার। কোন গীর্জায় কি যুগলে গিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজে ছিল? না কি ভাঙা পাত্রের দুটি অংশ জোড় বাঁধেনি? জানেন না। মঞ্জুকে রাধা-বোষ্টমীর অন্তিম সংবাদটা আর জানাননি।

সেই ‘মা ব্রুয়াৎ…’ সূত্র অনুসারে।

.

সূর্য এখন বৃষরাশিতে। দেশভ্রমণের উপযুক্ত সময় এটা নয়। নির্মেঘ আকাশে অনলবর্ষী দাবদাহ। সমস্ত প্রকৃতি রুদ্ধশ্বাসে প্রহর গণে, কোন শুভ মুহূর্তে নৈঋত-কোণ থেকে ধেয়ে আসবে পুষ্কর মেঘের ‘কালবৈশাখী’ আশীর্বাদ। ক্লান্ত ঘুঘুর ঘুমজড়ানো কূজন, মাঝে-মাঝে ফটিক-জলের আর্তি।

রূপেন্দ্র মাহেশে ফিরে এসে কদিন বিশ্রাম নিলেন।

মঞ্জুর এখন অন্য এক রূপ—আসন্ন মাতৃত্বের : অপর্যাপ্তপুষ্পস্তবকাবনম্রা—যেন পুষ্পমঞ্জরীর ভারে নুয়ে-পড়া পল্লবশাখা। গতি হয়েছে শ্লথ, মুখাবয়বে একটা দীপ্তি। রূপেন্দ্র ওকে বিস্তারিত বর্ণনা দেন—এ কয়দিন কী দেখেছেন, দে-গাঁর রাজার সেই করুণ কাহিনী, যুগল-পারাবতের; রামপ্রসাদের কর্মচ্যুতির বিবরণ; জগদীশ পণ্ডিতের অসাধ্যসাধন : দারুময় ব্রহ্মকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্র থেকে গৌড়মণ্ডলে বহন করে নিয়ে আসা। করলগ্নকপোলে মঞ্জু নিশ্চুপ শুনে যায়।

রূপেন্দ্র বলেন, অনেকদিন দেশের খবর পাইনি। তোমার তো এখনো মাস দুই-তিন বাকি, একবার চট্ করে সোঞাই ঘুরে আসব?

মঞ্জু বললে, তা যদি বল, তাহলে বলব, অনেক আগেই তোমার যাওয়া উচিত ছিল। যখন মীনুদি তোমার পথ চেয়ে ছিল।

রূপেন্দ্র লজ্জা পান। বস্তুত মঞ্জুর এই আসন্ন-মাতৃত্বের মূর্তিটাতেই তিনি কিছু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল সেই নিভৃত সন্ধ্যাটির কথা। প্রায়ান্ধকার নির্জন কক্ষ ওঁরা শুধু দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুর্গা-খুড়ো এগিয়ে গেছেন পাল্কি বেয়ারাদের সন্ধানে। অনবগুণ্ঠিতা মীনু-খুড়িমা অস্ফুটে সেদিন বলেছিল—সোনাদা! শেষ সময়ে আমি যদি তোমার পায়ের ধুলো নিতে হাত বাড়াই, তুমি পিছিয়ে যেও না যেন!

রূপেন্দ্র সলজ্জে বলেন, আমি কি শুধু মীনু-খুড়িমার জন্যই ব্যস্ত হয়েছি?

—হলেও লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। সে বেচারি তোমার ভরসাতেই ছিল তো?

—মানে?

মঞ্জু চোখে-চোখে তাকায়। বলে, দেখ, আমি লেখাপড়া শিখিনি। মুখ্যু! কিন্তু তা বলে এটুকুও কি বুঝব না?

—কোনটুকু?

—মীনুদি তোমাকে কী-চোখে দেখে! কেন শোভারানী আমাদের সেই ফুলশয্যার রাতে অমনভাবে বিঁধেছিল মীনুদিকে, আর কেনই বা সে ম্লান হয়ে গেছিল।

রূপেন্দ্র অনেকক্ষণ জবাব দিলেন না। তারপর কথা ঘোরাতে বলেন, জান, সেদিন নবা বায়েনের সঙ্গে হঠাৎ গঙ্গার ঘাটে দেখা হয়ে গেল।

মঞ্জু জানতে চায় নবা বায়েন লোকটা কে। রূপেন্দ্র বিস্তারিত সব কথা জানালেন। যমুনার সেই সতী হতে যাওয়ার কাহিনী। মঞ্জু সে-কথা ভাসা-ভাসা জানত। আজ বিস্তারিত জানল। দুজনে অনেক আলোচনা করেও স্থির করে উঠতে পারলেন না—কেন নবা বায়েন গাঁ-ছেড়ে বার হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে। শেষে মঞ্জু বলে, আমার সঙ্গেও একজন চেনা লোকের হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। দিন পনের আগে। ওরা যুগলে এসেছিল তোমার খোঁজে।

—ওরা! মানে? কাদের কথা বলছ?

—রাধাদি আর রাম-রহিম!

—রহিমও এসেছিল?

—রহিম নয় গো, ‘রাম-রহিম দরবেশ!

বিচিত্র সংবাদ! রহিম অথবা রাধা প্রভু যীশু বা মেরী মাতার শরণ নিতে যায়নি। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুদার, কূপমণ্ডূকদের নির্দেশে চলে; তবু ব্রাহ্মণ্যধর্ম উদার, সর্বংসহা, যুগে-যুগে ঐ কূপমণ্ডূকদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছেন সাধকবৃন্দ! সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে এই ভারতে! রাম-রহিম তার সঙ্গিনীর হাত ধরে রূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, জানাতে এসেছিল তার কৃতজ্ঞতা। তার পরিধানে তাপ্পি-দেওয়া আলখাল্লা, হাতে একতারা, চূড়ো করে বাঁধা তার বাবরি চুল। পাঁজর ঘেঁষে ওর সাধনসঙ্গিনী : রাধা।

ওরা কবীরপন্থী। জাত-পাত মানে না। সত্যসুন্দরের দিশারী।

গুরু রামানন্দের দ্বাদশ শিষ্যের মধ্যে কবীর সর্ববিখ্যাত। তিনি হিন্দুশাস্ত্রের গোঁড়ামি আর মোল্লাদের ধর্মান্ধতাকে তুল্যভাবে তিরস্কার করেন। সম্ভবত জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন জোলা। তাঁর দোঁহা—

“প্রথম হি রূপ জোলাহা কীন্থা।।
চারি বরণ মোহি কানুন চীন্থা।
রামানন্দ গুরু দীক্ষা দেহু।
গুরুপূজা কছু হম সো লেহু।।” [১]

[১. প্রথমে আমি ছিলাম জোলা। চারি বর্ণের মধ্যে কেউ আমাকে চিনত না। গুরু রামানন্দ! তুমি আমাকে দীক্ষা দাও! আমাকে গুরুদক্ষিণা প্রদানের অনুমতি দাও।]

মহাত্মা কবীর যে ধর্মমত প্রচার করেন তা না-হিন্দুর, না-মুসলমানের। তা মিলিত হিন্দু-মুসলমানের। জাত-পাতের বিভেদ তিনি মানেননি। অথচ তাঁর দেহাবসানের পর বিবাদ দেখা দিল দুই সম্প্রদায়ের—কীভাবে তাঁর মরদেহের সৎকার হবে। অলৌকিক ভাবে সে লৌকিক বিবাদের মীমাংসা হয়ে যায়। তাঁর মৃতদেহ রূপান্তরিত হয়ে যায় এক মুঠি পদ্মফুলে। সে ফুলের অর্ধাংশ নিয়ে কাশীনরেশ বীরসিংহ মণিকর্ণিকার ঘাটে দাহ করেন, বাকি অর্ধেক গোরক্ষপুরে সমাধিস্থ করেন মুসলমান-নেতা বিজলিখান। কবীর বলেছিলেন :

“জাতি পাঁতি কুল কাপড়া যেহুঁ শোভা দিন চারি।
কহে কবীর শুনো হো রামানন্দ যেউ রহে ঝকমারি!!
জাতি হমারি বাণী কুল করতা উর মাহি
কুটুম্ব হমারে সন্ত হায় কোই মুরখ সমঝল নাহি”।।[১]

[১. জাতি, পাঁতি, কুল, কাপড় এসব শোভা তো দু-চার দিনের। কবীর বলেন, শুন গুরু রামানন্দ! এসব বিলকুল ঝকমারি! আমার বচনই আমার জাতি; আমার হৃদয়েশ্বরই আমার কুল, আর সাধুজন আমার কুটুম্ব। কবে যে মূর্খগুলো এ-কথা বুঝবে!]

তা বটে! বেদ-বেদান্ত গুলে খেয়েছেন রূপেন্দ্রনাথ, তবু সন্ধান দিতে পারেননি। ঐ রাম-রহিম আর রাধাকে বলেছিলেন হিন্দু-মুসলমান ধর্মে ওদের আশ্রয় হতে পারে না। বিদেশী ধর্মের দ্বারস্থ না হলে ওদের সমস্যার সমাধান নাই। অথচ ঐ অর্ধশিক্ষিত রাম-রহিম আর তার সঙ্গিনী সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছে এই ‘মহাভারতের’ ধর্মে। সন্ত কবীর ওদের দিশারী!

রাম-রহিম নাকি মঞ্জুকে বলেছিল, কই গো বৌঠান? আমার গুরু-মুর্শেদ কই? তারে ডেকে দিন। সেলাম-পেন্নাম দুটোই তো করতে হবে।

মঞ্জু হেসে বলেছিল, তিনি তীর্থদর্শনে গেছেন।

রাম-রহিম দরবেশ বলেছিল, সে কী! গুরু-মুর্শেদ মন্দির-মসজিদে গেছেন মালা-টপকাতে? শুনুন বৌঠান :

“মকা ফেরৎ জনম গয়ো, গয়ো ন মকা ফের।
করকা মন্‌কা ছোড় কর মনকা মন্কা ফের!!”[২]

[২. জপমালার গুটিক ঘূর্ণন করতে করতে জীবন বিকিয়ে গেল, অথচ মনের ঘোর কাটল না। ওরে ভাই, হাতের মালা টপকানো বন্ধ করে মনের মালা টপকানো অভ্যাস কর!]

রূপেন্দ্রনাথ অনেকক্ষণ স্থির হয়ে কী-যেন ভাবতে থাকেন। তারপর মনস্থির করে বলেন, আজ তোমাকে একটা কথা বলব মঞ্জু। ভেবেছিলাম এ-কথা কোনদিনই জানাব না; কিন্তু মনে হচ্ছে তা গোপন করে যাওয়া অন্যায় হবে। তুমিও এতদিন বিস্তারিত জানতে চাওনি। আমি ঐ রাধা-বোষ্টমী আর রাম-রহিমের কথাটা বলতে চাইছি।

ভারী মিষ্টি করে হাসল মঞ্জু। বললে, থাক! তোমাকে বলতে হবে না। আমি তা জানি। আর একথাও জানি, কেন সঙ্কোচে সে-কথা এতদিনে আমার কাছে বলনি!

রূপেন্দ্রনাথ অবাক হয়ে যান। বলেন, কে বলেছে? রাধা?

—শুধু রাধাদি বলবে কেন? আমি নিজের চোখেই তো দেখেছি!

বিস্তারিত জানায়। সেই প্রথম দর্শনেই রাধা এসে যখন আচমকা রূপেন্দ্রনাথের হাত চেপে ধরে তখনই বুঝতে পেরেছিল মঞ্জু। মেয়েরা এ বিষয়ে ভুল করে না। তারপর সেই হাটতলার চণ্ডীমণ্ডপে শেষ রাত্রে যখন রাধা শয্যাত্যাগ করে ঘনিয়ে এসেছিল রূপেন্দ্রর কাছে তখনও সে সব কিছু দেখেছে, শুনেছে। সাড়া দেয়নি। তারপরেও নানান ছোট ছোট ঘটনা।

রাধা ওকে বাকিটা জানিয়ে গেছে। অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। কোনও সঙ্কোচ করেনি। এমনকি ফরাসডাঙার নাকা-দরওয়াজা অতিক্রম করার পর নির্জন সাঁকোর ধারে ওদের ঘনিষ্ঠ প্রেম-বিনিময়। রাধা অসঙ্কোচে জানিয়ে ছিল, সে আত্মসংবরণ করতে পারেনি। রূপেন্দ্রনাথকে সবলে আকর্ষণ করে মুখচুম্বন করেছিল!

তারপর ওদের ফরাসডাঙার অতিথিশালায় আশ্রয় লাভ। কীভাবে রূপেন্দ্র তাকে তুলে দিয়েছিলেন রাম-রহিমের হাতে। নিঃশব্দে সরে গিয়েছিলেন অন্তরালে!

রূপেন্দ্রনাথ রীতিমতো অবাক হয়ে বলেন, আশ্চর্য! তুমি সব জান! কই আমাকে তো কিছু বলনি?

মঞ্জু হাসি লুকিয়ে বলে, তুমিও তো আমাকে কিছু বলনি!

—আমার গোপন করার একটা অর্থ হয়। বলতে পার, সঙ্কোচ, অথবা তোমাকে দাগা দিতে চাইনি বলে। কিন্তু তোমার ঈর্ষা হল না কেন? তুমি আমার কৈফিয়ৎ চাইলে না কেন?—ঈর্ষা হবে কেন? গৌর তো ইচ্ছে করলে আমাদের ভাগ্যটা বদলে দিতেও পারতেন! তা তিনি দেননি, এতে কি ঈর্ষা হওয়ার কথা? এ তো আমার সৌভাগ্য!

—ভাগ্য বদলানো মানে?

—রাধাদির মূর্ছা রোগ হতে পারত, তাকেই গো-গাড়ি করে সেই মোহান্ত তোমার কাছে পাঠাতে পারতেন। আমি, আমি হয়তো সে ক্ষেত্রে…

রূপেন্দ্রনাথ ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, তোমার আজ অন্য এক রূপ দেখলাম মঞ্জু। ‘এ-তুমি’ আমার অচেনা ছিলে এতদিন!

মঞ্জু আবেশে ওঁকে জড়িয়ে ধরে।

রূপেন্দ্র বলেন, তুমি আমাকে সন্তান দিয়েছ, তোমার একটা পুরস্কার পাওনা! বল, কী নিয়ে আসব তোমার জন্যে এবার তীর্থ করে ফেরার সময়।

ভারী সুন্দর জবাব দিল মঞ্জু। বললে, তুমি না প্রথম দিনই বলেছিলে স্বামী আর স্ত্রীর সমান অধিকার! তাহলে ও-কথা বলছ কেন? ‘আত্মদীপ’ আসছে; কিন্তু কে-কাকে উপহার দিল তার তো হিসাব হয়নি আজও!

তা বটে! তবু রূপেন্দ্রনাথ বলেন, তা হোক, তুমি আজ যে উদার মনের পরিচয় দিলে সেটাকে পুরস্কৃত করা আমার কর্তব্য।

মঞ্জু বললে, তাহলে আমি যা চাইব তা দেবে?

–দেব, যদি আমার সাধ্যের মধ্যে হয়। বল?

—আমার বড় সাধ—ঐ বড়মার মতো তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার। তুমি আমাকে লেখাপড়া শেখাবে? লুকিয়ে লুকিয়ে?

রূপেন্দ্র শয্যাপ্রান্তে উঠে বসেন। এমন একটি গোপন বাসনা যে মঞ্জুর অন্তরে লুকিয়ে আছে তা আন্দাজ করতে পারেননি। অবাক হয়ে বলেন, তোমার ভয় হয় না? লোকে বলে, লেখা-পড়া শিখলে …

মঞ্জু তার হাতটা বাড়িয়ে চাপা দেয় ওঁর মুখ। বলে, ও কথা বল না! বড়মা তো প্রমাণ করে দিয়েছেন সেটা ভুল। তুমিও তো তাই বলে থাক।

—তা বলি। কিন্তু বড়মাকে জেঠামশায়ের সঙ্গে কখনো তত্ত্বকথা বলতে শুনেছ?

—না, শুনিনি; কিন্তু রাধাদি তোমার সঙ্গে কীভাষায় কথা বলত তা তো শুনেছি। আমি গান গাইতে পারি না, কেউ শেখায়নি, কিন্তু ..

—বুঝেছি। তাই হবে মঞ্জু। শেখাব, তোমাকে বাঙলা পড়তে-লিখতে শেখাব। সংস্কৃতও শিখবে। কিন্তু এখানে তো তা সম্ভবপর নয়। এখানে সুযোগ হবে না। জানাজানি হয়ে যাবে। গুরুজনেরা কেউ যদি একবার নিষেধ করেন ….

—না, না, এখানে নয়। সোঞাই ফিরে গিয়ে।

–সেই ভাল। কথা দিচ্ছি, আত্মদীপের হাতেখড়ি দেবে তার মা, বাবা নয়। অক্ষর পরিচয়ও করাবে তার মা। সেই যেমন কাশী-রাজমহিষী মদালসা করিয়েছিলেন রাজপুত্র অলকের। কিন্তু এটা তো আমার ইচ্ছাপূরণ হল না, মঞ্জু?

—হল না? তুমি চাও না আমি লেখাপড়া শিখি?

—তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ। সে-কথা বলছি না। আমি তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাইলাম, আর উল্টে তুমিই তা আমাকে করে দিলে!

মঞ্জু আবার মিষ্টি করে হাসল। বলে, কিন্তু সেটাই তো নিয়ম। দেওয়া আর নেওয়ার আনন্দ যদি সমান না হয় তবে কিসের এই স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক!

বাঃ! মাতৃত্ব-গৌরবে মঞ্জু আজ অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *