1 of 3

১৫. ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর

॥ ১৫ ॥

বাইরে ঝিমঝিম করে ভরা দুপুর। ভারী নির্জন, নিরিবিলি, অথচ রোদে ঝলমলে। কুয়াশা কেটে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উত্তরে অতিকায় মহিষের মতো গারো পাহাড় পর্যন্ত। ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে গলন্ত রূপো এসে মেশে। ঝিরঝির করে অবিরল কথা বলে মহানিম। মস্ত মস্ত ঘরের ঘুলঘুলি, বারান্দার ওপরের কড়ি বর্গায় নানান জাতের হাজারো পায়রা নড়াচড়া করে আর ডেকে ওঠে। ভরন্ত দুপুরে পায়রার গদগদ স্বরের ডাক এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে।

শব্দের কি কোনো আকার আছে? প্রশ্নটা মাথায় আসে, কিন্তু জবাবটা ভেবে পান না হেমকান্ত। শব্দ সম্ভবত নিরাকার। তবু হেমকান্তর মন বলে, ওই পায়রার বুকুম বুকুম শব্দ ওর আকার গোল। তুলোর বলের মতো। স্টিমারের বাঁশির শব্দকে কি কখনো তাঁর সরু ও দীর্ঘ আকারবিশিষ্ট বলে মনে হয়নি? সেতারের ঝনৎকার যেন ফুলঝুরির বহুবর্ণ কেন্দ্রাতিগ অগ্নিবিন্দু। মাঝে মাঝে এই দুপুরবেলা তাঁর এসরাজ নিয়ে বসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বসেন না। লজ্জা করে। এসরাজের শব্দ শুনলে ছেলে মেয়ে অবাক হবে। হয়তো দৌড়ে আসবে মনু। লোকটার হল কী? কিন্তু এসরাজের ছড় টানলেই তাঁর চোখে ভেসে ওঠে তন্তুজালের মতো একটা আকৃতি। অদৃশ্য এক মাকড়সা অদ্ভুত দ্রুততায় বুনে চলেছে। জ্যোৎস্নারাত্রে বিরহী হরিপদ মাঝে মাঝে পুকুরের ঘাটলায় বসে আড়বাঁশি বাজায়! তখন দীঘল চিত্রময় এক সাপের আকার খেলা করে হেমকান্তর চোখের সামনে। এসবই ভ্রম হয়তো। শব্দের বাস্তবিক কোনো আকার নেই। কিন্তু হেমকান্তর ভিতরে তারা আকার পায়।

পায়রারা গদগদ স্বরে কী বলে? ভালবাসার কথা? কিন্তু পশু-পাখির আত্মজন নেই, সংসার নেই। নিতান্ত সংস্কারবশে তারা কখনও কখনও দলবদ্ধভাবে বাস করে বটে, কিন্তু সমাজ গড়তে জানে না। ভালবাসা তারা কোথায় পায়? তুলোর বলের মতো অবিরল তাদের বুকুম বুকুম ডাক এই নির্জন দুপুরে হেমকান্তর চারদিকে নেমে আসে। উড়ে উড়ে বেড়ায়। ভালবাসার কথা বলে।

দক্ষিণের সূর্য একফালি সাদা কারপেট বিছিয়ে দেয় বারান্দায়। তাতে রেলিঙের নকশাদার পুষ্পিত ছায়া। ভারী ভাল লাগে হেমকান্তর। ঘুলঘুলির রঙিন কাচ দিয়ে রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে যায় দেয়ালে। পায়রার ময়ূরকণ্ঠী গায়ে খেলা করে রোদের বর্ণালী। চিকের ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখেন, শতভাগে ভাগ হয়ে গেছে বাইরের দৃশ্যাবলী। কী চমৎকার!

এইসব শব্দ ও দৃশ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব ঘটনা হেমকান্তকে বার বার অবাক করে দেয়। বেঁচে থাকতে আজকাল তাঁর দ্বিগুণ ভাল লাগে কেন? এই আলো ও ছায়া, এইসব অর্থহীন শব্দ, এসব মৃত্যুর পর কি পৌঁছাবে তাঁর কাছে কোনো দিন? কে জানে কেমন সেই চির প্রদোষের জগৎ! কিংবা কে জানে মৃত্যুর পর হয়তো কোনো অস্তিত্বই থাকে না কারো। সে এক স্বপ্নহীন অনস্তিত্বের অন্তহীন ঘুম।

কখন নিজের অজান্তে চলে আসেন দোতলার বারান্দা ঘুরে ছেলে-মেয়েদের মহলে। এমনিতে আসেন না। স্নেহশীলা দাসী ও বিশ্বাসী যত্নশীল চাকরদের পরিচর্যায় ছেলে-মেয়েরা ভালই আছে, তিনি জানেন। নিজের উপস্থিতির গুরুভার কখনো ওদের ওপর চাপিয়ে দিতে তাঁর ইচ্ছে হয় না।

একটু চমকে উঠে শোনেন, কৃষ্ণকান্ত বিশাখাকে বলছে, দেখ দিদি, আজ যদি দুপুরে ঘুমোই তো গরু খাই।

গরুই তো খাস। কালও ঘুমিয়েছিস। টাস্‌ক করেছিলি মাস্টারমশাইয়ের?

কাল? ওঃ, রাত জাগতে হয়েছিল না?

তোকে কে রাত জাগতে বলেছে?

কে আবার বলবে?

তবে জাগিস কেন?

মনুপিসি যে বলে শশীদা বাঁচবে না!

তাতে তোর কী?

আমি সেইজন্যই তো বসে থাকি।

কেন বসে থাকিস?

কমপাউনডার কাকা বলে, মরার সময় আত্মাটা শরীরের কোন ফুটো দিয়ে বেরোবে তার ঠিক নেই। কারো নাক দিয়ে, কারো কান দিয়ে, কারো মুখ দিয়ে, কারো নাভি দিয়ে, আবার গুহ্যদ্বার দিয়েও বেরোয়।

কী অসভ্য রে! ছিঃ ছিঃ ভাই, দাঁড়া মনুপিসিকে বলব।

বাঃ, কমপাউনডার কাকা বলে যে আত্মাটা ধোঁয়ার মতো জিনিস। এক বিঘৎ লম্বা। সুট করে বেরিয়ে আসে। আমি সেইটে দেখার জন্য বসে থাকি। শশীদার আত্মা কোথা দিয়ে বেরোবে জানিস?

আমি জানব কী করে?

ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে। মহাপুরুষদের আত্মা ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে বেরোয়।

তোর শশীদা কি মহাপুরুষ নাকি?

শশীদা স্বদেশী না!

তাতে কি?

স্বদেশীরা তো আর যা তা লোক নয়। ইংরেজ মারে। শশীদা এক পাদ্রীকে মেরেছে জানিস? বোম দিয়ে।

খুব বীরত্বের কাজ করেছে, না। বাবা শুনলে দেবেখন তোমাকে। স্বদেশীদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে নেই।

কৃষ্ণকান্তা একটু যেন অবাক হয়ে বলে, বাবা স্বদেশীদের পছন্দ করে না?

একদম না। আমরা ইংরেজদের পক্ষে।

তবে বাবা শশীদাকে বাড়িতে থাকতে দিল কেন?

মোটেই থাকতে দেয়নি। আটক রেখেছিল। পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে।

তবে এখনো দেয়নি কেন?

লোকটার অসুখ করল বলে।

যদি শশীদা সেরে যায় তাহলে দেবে?

নিশ্চয়ই দেবে। দেওয়াই উচিত।

কৃষ্ণকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, তাহলে শশীদার মরাই ভাল।

হেমকান্ত খুবই অবাক হলেন। তাঁকে ইংরেজের সমর্থক ও স্বদেশীদের বিরোধী বলে কবে চিহ্নিত করা হল, এবং কেন তা তিনি জানেন না। একটু কৌতুক বোধ করলেন তিনি। শশিভূষণকে ধরিয়ে দেবেন বলে আটক রাখা হয়েছে এ কথাই বা কে রটাল? বিশাখাই বা এসব কথা জানল কোথা থেকে? তিনি তো মেয়েকে এসব প্রসঙ্গে কখনো কিছু বলেননি। স্বদেশীদের প্রতি বিশাখার এই জাতক্রোধের কারণটাও তাঁর অজানা। বরং উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। রঙ্গময়ীর শাসনে এবং ছায়ায় ওরা মানুষ। রঙ্গময়ীর নিজের একটু স্বদেশীপ্রীতি আছে। কাজেই বিশাখার এরকম উল্টো মত হওয়ার কারণ নেই। তবে?

অনুচ্চ স্বরে তিনি ডাকলেন, কৃষ্ণ। বিশাখা।

ভাইবোনের ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ।

হেমকান্ত ঘরে ঢুকলেন।

কৃষ্ণ ও বিশাখা উঠে দাঁড়ায়। তটস্থ, সন্ত্রস্ত। মুখচোখে বিহ্বল ভাব। হেমকান্তর সামনে ওদের কেন যে এরকম একটা রূপান্তর হয়! তিনি তো শাসন তর্জন করেন না কখনো!

দু’দিকে দুটি প্রকান্ড খাট। জানালা ঘেঁষে মস্ত ডেস্ক। তার ওপর সাজানো বইখাতা, দোয়াতদান ও কলম। একটি বিলিতি মহার্ঘ টেবিল ল্যাম্প। দুই খাটের পাশেই শ্বেতপাথরের তেপায়া। দেয়াল আলমারি, আয়না বসানো বারমা সেগুনের আলমারি, কাচের বাক্সে সাজানো বিদেশী পুতুল আর খেলনা। দেয়ালে এয়ারগান।

চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন হেমকান্ত। এ ঘরে তিনি কদাচিৎ আসেন।

মেয়ের দিকে একটু সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। লোকচরিত্র অনুধাবনের অভ্যাস তাঁর নেই। মুখশ্রী দেখে চরিত্রের ঠিকানা পাওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। কিন্তু তাঁর মেয়েটি যে ভারী শ্রীময়ী তাতে সন্দেহ নেই! তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়।

কিন্তু মানুষের মুখশ্রীকে কি বিশ্বাস আছে? তাঁর অন্য মেয়েরাও সুন্দরী। অপাপবিদ্ধ মুখশ্রী। কিন্তু তবু গোপনে মায়ের গয়না সরাতে তো তাদের বাধেনি। বিশাখা যে অন্য রকম হবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

হেমকান্ত মেয়ের দিকে চেয়ে সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, তুমি স্বদেশীদের পছন্দ করোনা?

বিশাখা খুবই ঘাবড়ে গেছে। কী বলবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ মাথা নত করে নখ দেখতে লাগল। ব্রীড়ার সেই ভঙ্গিটুকুও ভারী অপরূপ।

মেয়েকে আর অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে ইচ্ছে হল না তাঁর। মেয়ে মাত্রই কিছুটা নির্বোধ, কুচুটে, পরশ্রীকাতর, ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের দোষও নেই। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব গঠনে কোনো চেষ্টাও যে সমাজে নেই। দেশে সম্প্রতি একটা নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেটা ভাল কি মন্দ এবং কাজ কতদূর এগিয়েছে তা হেমকান্ত জানেন না। তবে তাঁর বিশ্বাস স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের মনের জানালা-কপাট খুলে বাইরের উদার মুক্ত আলো-হাওয়ার পথটুকু অবারিত করে দিলেই যথেষ্ট। সি এ টি ক্যাট শেখার চেয়ে থানকুনিপাতার আরোগ্য গুণ জানাটা অনেক বেশী কার্যকরী শিক্ষা। লোকে বলে, এদেশের মেয়েরা ভারী সহনশীলা। কথাটা সত্যি বলে মনে হয় না হেমকান্তর। সহনশীলতা এক অনবদ্য গুণ, তা শিক্ষা করতে হয়। এদেশের মেয়েরা সয় বটে, কিন্তু সে দায়ে পড়ে। ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের আগুন ফুঁসতে থাকে, আর সে আগুন বেরোবার পথ পায় না বলেই অন্যবিধ রন্ধ্র খোঁজে। হেমকান্ত আজ একটু একটু টের পান, সুনয়নীর মধ্যেও সেই বিদ্রোহ ছিল। তাই আজ মেয়ের ওপর রাগ হল না. হেমকান্তর। করুণা হল। ওকে তিনি কোনো শিক্ষাই দিতে পারেননি। শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া সুন্দর মুখশ্রী ও ফর্সা রঙটুকুই ওর সম্বল।

বোধ হয়! হ্যাঁ, বোধ হয় কথাটা যোগ করে রাখা ভাল। কারণ বিশাখা তাঁর উরসজাত হলেও ওকে তো তিনি ভাল করে চেনেন না। সম্ভবত বিশাখা রঙ্গময়ীকে অপছন্দ করে। আর তাই রঙ্গময়ীর ঝোঁক যেদিকে, বিশাখার ঝোঁক ঠিক তার উল্টোদিকে। নইলে স্বদেশীদের প্রতি অত আক্রোশ থাকার কথা ওর না। কিন্তু রঙ্গময়ীর প্রতি ওর বিরাগের কারণটা কী? কারণ কি তিনি নিজেই?

ছেলের দিকে চেয়ে হেমকান্ত একটু স্বস্তি পেলেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখে তটস্থ বটে, কিন্তু ভীত নয়।

হেমকান্ত গাঢ়স্বরে প্রশ্ন করলেন, স্বদেশীদের তুমি পছন্দ করো?

কৃষ্ণ একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

হেমকান্ত বললেন, তুমি তোমার দিদির কাছে যা শুনেছো তা ঠিক নয়। আমি শশিভূষণকে ধরিয়ে দেব না। স্বদেশীদের প্রতিও আমার আক্রোশ নেই। ভয় পেও না। বলো।

কৃষ্ণকান্ত হেসে মাথা নোয়াল। বলল, হ্যাঁ বাবা। ওরা খুব সাহসী।

হেমকান্ত কেমন যেন একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। তাঁর আর কোনো ছেলেই স্বদেশীদের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। দেশে যে সব আন্দোলন হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা নির্বিকার। তিনি নিজেও তাই। তাঁর এই ছেলেটি যদি স্বদেশ নিয়ে ভাবে তো ভাবুক।

হেমকান্ত বললেন, তোমার কাকা স্বদেশী করতেন। অবশ্য শশিভূষণের মতো ইংরেজ মারেননি। জানো বোধ হয়?

জানি। কাকাকে ইংরেজরা মেরেছিল।

বিস্মিত হেমকান্ত বললেন, একথা কে বলল?

মনুপিসি।

কথাটা সম্ভবত সত্য নয়। তবু প্রতিবাদ করলেন না হেমকান্ত। শুধু বললেন, হতে পারে। তবে কে মেরেছিল বা আদৌ মেরেছিল কিনা তা এখনও আমরা সঠিক জানি না। একটা নৌকোডুবি ঘটেছিল, এটাই জানা আছে।

মনুপিসি বলে, কাকাকে মারার পর প্রমাণ লোপ করতে নৌকোটা ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ ছেলের মনের মধ্যে কিছু জিনিস শিকড় গেড়ে বসেছে। তা সহজে পড়ানো যাবে না। বোধ হয় বীজটা ছড়াচ্ছে মনুই। তবু অসন্তুষ্ট হলেন না হেমকান্ত। আকস্মিক এক দুর্বলতাবশে ছেলের মাথায় একবার হাত রাখলেন। স্নেহের স্বরে বললেন, পড়াশোনা হচ্ছে তো ঠিকমতো?

আমি ফার্স্ট হই বাবা।

হও? হেমকান্ত বিস্মিত। বলেন, কই, আমাকে কেউ বলেনি তো!

এবার বাৎসরিক পরীক্ষায় হয়েছি।

বলোনি কেন?

দিদি জানে।

হেমকান্ত হাসলেন। ছেলের পরীক্ষার ফলটুকু পর্যন্ত তাঁর কানে কেউ পৌঁছে দেয় না। নির্বাসন কি একেই বলে না? এই নির্বাসন দণ্ডের দাতা তিনিই, গ্রহীতাও তিনিই।

কিন্তু আর নয়। বাইরে রোদ ম্লান হয়ে এল। একটু বাদেই কুঞ্জবনে এক অদ্ভুত ছায়া নামবে। ফার্ন জাতীয় গাছগুলির ছায়া আলপনার মতো পড়ে থাকবে ঘাসে। ভাঙা গাড়িটার পাদানীতে বসে চারদিকে এক নিবিড় রূপের রাজ্যে ডুবে যাবেন তিনি। সময় নেই।

হেমকান্ত ঘরে এসে পোশাক পরতে লাগলেন।

কিন্তু বাধা এল। একজন কর্মচারী এসে খবর দিয়ে গেল, স্বয়ং দারোগা কাছারিঘরে অপেক্ষা করছেন। হেমকান্তর দর্শনপ্রার্থী।

হেমকান্ত বিরক্ত হলেন। একটু উদ্বেগও বোধ করতে লাগলেন। দারোগার আগমন কেন তা অনুমান করতে কষ্ট নেই। শশিভূষণ।

দারোগা রামকান্ত রায়ের সঙ্গে হেমকান্তর পরিচয় সামান্য। শুনেছেন লোকটা দুঁদে এবং প্রভুভক্ত।

হেমকান্ত কাছারিঘরে ঢুকতেই রামকান্ত তাঁর হ্যাটটা বগলে করে উঠে দাঁড়ালেন। বিশাল ভুঁড়িদার চেহারা। কাছারির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর ঘোড়াটিও বিশালদেহী এবং তেজী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঠুকে নালের বিকট শব্দ করছে।

রামকান্ত বললেন, একটু বিরক্ত করতে এলাম হেমবাবু। সরকারী কাজ।

বসুন।

রামকান্ত বললেন, বসা টসা পরে। অনেকক্ষণ বসে আছি। একবার সেই ছেলেটিকে দেখতে চাই।

হেমকান্ত ন্যাকা নন। বুঝলেন। তবু একটু বিস্ময়ের ভান করে বললেন, কোন ছেলেটি?

শশিভূষণ। যে ছেলেটিকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন।

কেন বলুন তো।

একটু খবর আছে। এই ছেলেটিকে বরিশালের পুলিস খুঁজছে। খুনের মামলা।

হেমকান্তর উপস্থিত বুদ্ধি ভাল খেলেনা। তিনি কী করবেন বুঝতে পারলেন না। শেষে হতাশার গলায় বললেন, তাকে আর দেখার কিছু নেই। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে।

তা জানি। তবু সরকারী কর্তব্য তো করতেই হবে। জানা দরকার এই ছেলেটিই সে কিনা।

হলে কী করবেন?

রিমুভ করার মত অবস্থা দেখলে পুলিস গার্ডে হাসপাতালে ট্রানসফার করতে হবে।

হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, বোধ হয় তা সম্ভব নয়।

দেখা যাক। একটু অধৈর্যের ভাব প্রকাশ করলেন রামকান্ত। বললেন, আপনার বাড়ি সার্চ করার ওয়ারেন্ট আমার সঙ্গেই আছে। তবু আমি তা করিনি। আপনি মান্যগণ্য লোক, যা করার আপনার অনুমতি নিয়েই করতে চাই।

হেমকান্ত বললেন, চলুন।

দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে রামকান্তকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে আজ নিজের ওপর একটু ঘৃণা হচ্ছিল হেমকান্তর। চিরকাল সুখের জীবনই কাটিয়েছেন তিনি। নির্বিকার, আত্মসুখী। নিজস্ব জগতেই তাঁর বাস। বাইরে একটা অচেনা পৃথিবী আছে। সেখানে আছে অচেনা, অদ্ভুত চরিত্রের কিছু লোকজন। তাদের ভাল চেনেন না তিনি। এই শশিভূষণ সেই বাইরের দুনিয়ার লোক। কীই বা বয়স, তব স্নেহের বন্ধন কেটে উধাও বেরিয়ে পড়েছে। খুনও করেছে হয়তো। কাজটা ভাল না মন্দ তার বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু নিজের অস্তিত্বের একটা জানান তো দিতে পেরেছে। হেমকান্ত তা পেরে ওঠেননি।

বিছানায় শশিভূষণ শয়ান। অচৈতন্য। গালে এ-কয়দিনে দাড়ি আরও কিছু বেড়েছে। শরীরটা বড়ই বিবর্ণ, শীর্ণ। মাথায় জলপটি দিচ্ছিল রঙ্গময়ী। তাঁদের দেখে উঠে দাঁড়াল।

রামকান্ত শশিভূষণের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে বললেন, আপনি রুগীর কেউ হন?

না। দেখাশোনা করছি।

অবস্থা কেমন?

ভাল নয়।

একটু বাদে হাসপাতালের ডাক্তার এসে ওকে দেখবে। দুজন পুলিস গার্ড থাকবে বাইরে।

রঙ্গময়ী একটু ক্লান্ত ও কটু গলায় বলল, রুগী কি পালাবে?

তা হয়তো নয়। তবু সাবধান হওয়া ভাল।

ডাক্তার বলে গেছে, রুগী বেশীক্ষণ নয়।

কোন ডাক্তার দেখছে?

তিনজন দেখছে।

তাদের স্টেটমেন্টও আমরা নেবো। রুগীর অবস্থা যদি সত্যিই খারাপ হয়ে থাকে তবে তার জন্য আপনারা কষ্ট পাবেন কেন? সরকারই ওর ভার নেবে।

সরকার ভার নেবে কেন?

শশিভূষণ সাসপেকট।

ক্লান্ত রঙ্গময়ী চুপ করে রইল।

হেমকান্ত মৃদুস্বরে জিজ্ঞাস করলেন, এই কি সেই?

রামকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, হ্যাঁ।

হেমকান্ত একটা শ্বাস গোপন করলেন।

রামকান্ত বারান্দায় বেরিয়ে এসে বললেন, কীভাবে ছেলেটি আপনার বাড়িতে আশ্রয় পেল সে সম্পর্কে আপনি একটা স্টেটমেন্ট লিখে রাখবেন। দরকার হবে।

আমার স্টেটমেন্ট? কেন?

যাতে আপনাকে ঝামেলায় পড়তে না হয়।

দারোগা রামকান্ত বারবাড়িতে এসে দুজন সিপাইকে ইশারা করতেই তারা শশিভূষণের ঘরে থানা গাড়তে রওনা হয়ে গেল। রামকান্ত ঘোড়ায় ওঠার আগে হেমকান্তর দিকে চেয়ে বললেন, শশিভূষণের অবস্থা আমার কাছে খুব খারাপ বলে মনে হল না।

বলেন কি? হেমকান্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ডাক্তারও যে জবাব দিয়ে গেছে!

সে তো শুনলাম। কিন্তু মুমূর্ষ রুগী আমি কিন্তু কম দেখিনি।

আমরা কি মিথ্যে বলছি? হেমকান্ত একটু রুষ্ট হয়ে বললেন।

তা বলিনি। এমনও হতে পারে ডাক্তাররা ঠিক বলছে না। সে যাই হোক, হাসপাতালের ডাক্তার এসে দেখলেই সব বোঝা যাবে। আমাদের এই কাজই করতে হয় হেমবাবু, মনটাও তাই কেমন সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা ওই মহিলাটি কে? আপনার আত্মীয়া?

হ্যাঁ। ছেলেবেলা থেকেই এ বাড়িতে আছে।

ওঁকে আমার কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে, আপনি অনুমতি দিলে। তবে সে পরে হলেও হবে।

হেমকান্তর কেমন বিভ্রান্ত লাগছিল। তাঁর সুরুচি ও সূক্ষ্ম অনুভূতির জীবনে এ যেন এক দৈত্যের হাত এসে মসীলেপন করতে লেগেছে। এ সব ওই বাইরের জগৎটা থেকে এসে হানা দেয়।

রামকান্ত রেকাবে পা রেখে ঘোড়ায় উঠলেন। তাঁর দেহের ভারে ঘোড়াটা কেৎরে গিয়ে আবার সোজা হল। রামকান্ত বললেন, স্টেটমেন্টটার কথা কিন্তু ভুলবেন না। দরকার মনে করলে আপনার উকিলকে ডাকিয়ে তার পরামর্শ মতো লিখবেন। ফাঁকফোকর রাখবেন না।

রামকান্ত ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সেই অশ্বক্ষুরধ্বনি একটা বিপদ সংকেতের মতো বাজতে লাগল। ওঁর কথাগুলির মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল তাও টের পাচ্ছিলেন হেমকান্ত। কিন্তু কী করবেন? বরাবরই তিনি খানিকটা অসহায়। আজ আরও বেশী অসহায় লাগছিল। না, নিজের বিপদের কথা ভেবে নয়। আজ তিনি শশিভূষণের বিপদের কথা ভাবছিলেন। বোকা রঙ্গময়ী ওর অসুখটাকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে রটনা করেছিল বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

হেমকান্ত কাছারির খাটেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথার ওপর মশার পাল উড়ছে উস্‌স্‌স্‌ একটা একটানা শব্দ করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের জলে মিশে যাচ্ছে গারো পাহাড়ের মহিষ প্রতিম ছায়া।

একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। সরকারী ডাক্তার তাড়াতাড়ি নেমে এলেন। কাছারির বারান্দায় চিত্রার্পিতের মতো কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে। হেমকান্ত তাদের দিকে একটু ইশারা করে মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জবনের দিকে এগোতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ ভূতের মতো বসে রইলেন ভাঙা গাড়ির পাদানীতে। অন্ধকার তাঁকে ছেঁকে ধরল। ছেঁকে ধরল মশা। শিশিরে ভিজতে লাগল পোশাক। জোনাকি পোকারা উড়তে লাগল চারদিকে পরীর চোখের মতো। কিছুই তেমন ভাবতে পারছেন না হেমকান্ত। মাথাটা অস্থির, এলোমেলো।

তীব্র একটা টর্চের আলো সেই একাকীত্ব আর প্রস্তরীভূত অন্ধকারকে ছুরির ফলার মতো কেটে পায়ের কাছে এসে পড়ল।

আর্তনাদের মতো গলায় রঙ্গময়ী বলল, ওকে নিয়ে গেল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমকান্ত বললেন, তুমি বড় বোকা মনু। অথচ তোমাকে আমি বরাবর বুদ্ধিমতী ভাবতাম।

টর্চটা নিবিয়ে রঙ্গময়ী কাছে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ আবার শান্ত শোনাল তার গলা, ঘরে যাও। ঠাণ্ডা লাগবে।

লাগুক। সেটা বড় কথা নয়। শশীর ফাঁসি হবে, তার কথা ভাবো।

আমাকে সকলের কথাই ভাবতে হয়। ওঠো। ঘরে চলো।

ঘর ভাল লাগছে না।

রঙ্গময়ী একটু চুপ করে থেকে বলল, শশী তো মরতেই চায়। বেঁচে থেকে আর কী করবে বলো। ওকে মরতে দাও।

আর আমি মরলে?

তুমি? মরলে এখনও যে একজনকে বিধবা হতে হয়। তার বড় জ্বালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *