আসাম রোড যেখানে চা-বাগানের সীমা ছাড়িয়ে বা দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে গতরাত্রে বাঘ এসেছিল। দু-তিনঘর মদেশিয়া সেখানে বাসা বেঁধেছিল। এরা এককালে চা-বাগানেই কাজ করত। চাকরি শেষ হবার পর সাহেব দয়া করে ওই জমিতে তাদের ঘর তুলতে দিয়েছিলেন। তাদেরই একজনের দুধেল গরুকে মেরে চলে গেছে বাঘাটা। বিশু খোকনরা সেই জায়গাটা দেখতে যাচ্ছিল।
এ অঞ্চলে বাঘ বলতে চিতাকে বোঝায়। গঞ্জের শিকারিরা এবং সাহেব নিজে সকালে ঘুরে এসেছেন। নির্দেশ দিয়ে এসেছেন। গরুটা যেভাবে পড়ে আছে সেইভাবেই থাকবে। বাঘ নিশ্চয়ই আছে ধারে কাছে। দিন ফুরালেই সে শিকার খেতে আসবে। সেইসময় তাকে হত্যা করা হবে। কিছুদিন আগে একটা হরিণকে আধখাওয়া অবস্থায় চা-বাগানের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল। সাহেব খবর পেয়ে পৌঁছবার আগেই যারা দেখেছিল তারা হরিণের অবশিষ্টাংশ তুলে নিয়ে গিয়েছে রান্না করে খেতে। সেটাও বাঘের কীর্তি প্রমাণিত হয়েছে তাই এবার সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না। চা-বাগানে অজগর ধরা পড়ে, বুনো শুয়োর, হরিণের ছানা, খরগোস মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়। কিন্তু চিতাবাঘকে কাজ করা খুব শক্ত। থাবা দেখে সাহেবের সন্দেহ হয়েছে। এ চিতা খুব বড়সড়। গঞ্জের শিকারিরা বলছে চিতা ন, সাক্ষাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যাই হোক না কেন খবরটা নিস্তরঙ্গ চা-বাগান আর বাজার এলাকাকে গরম করে তুলেছে। দিন থাকতে থাকতেই লোক যাচ্ছে সেই জায়গাটা একবার স্বচক্ষে দেখতে। বিশুরাত যাচ্ছিল।
বিশু খোকনের সঙ্গে আজ অজিত ছিল। ওরা হেঁটেই যাচ্ছিল। এখন দুপুর। সরে খাওয়া শেষ হয়েছে। অঞ্জলি মনোরম যে যাঁর রান্নাঘরে। অমরনাথ আহারান্তে দুপুরের ঘুম দেবার তোড়জোড় করছেন। ঠিক একঘণ্টা ঘুমিয়েই তিনি আবার ফ্যাক্টরিতে চলে যান। স্নান করার আগে তিনি নতুন একটা খবর দিলেন, কাল রাত্রে যখন বাঘ, গরুটাকে ধরেছিল। তখন একজন নাকি বল্লম ছুঁড়ে মেরেছিল। বাঘ সেই বল্লম শরীরে নিয়েই উধাও হয়েছে। আহত বাঘ খুব সাংঘাতিক হয়। অতএর সন্ধের মধ্যেই গোয়ালঘরের দরজা ভাল করে বাঁধতে তো হবেই, কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যায়।
অথচ আসাম রোডে মানুষের মিছিল দেখে দীপার মনে হল কেউ তেমন ভয় পাচ্ছে না। যেভাবে লোকে মেলা দেখতে বা রামলীলার গান শুনতে যায়। সেইভাবেই সাইকেলে হেটে চলেছে। এইসময় সে বিশুদের দেখতে পেল। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করল, কোথায় যাচ্ছিস?
বিশু জবাব দিল, সিনেমা দেখতে।
দীপা হেসে ফেলল। তারপর শাড়ি সামলে রাস্তায় এসে বলল, চল, আমিও দেখে আসি। একই যাব। কিনা ভাবছিলাম, তোদের পেয়ে ভাল হল।
খোকন অবাক হয়ে বলল, তুই যাবি?
দীপা বলল, যাব বলেই তো এলাম।
বাড়িতে বলে এসেছিস?
নাঃ দীপা হাঁটতে শুরু করে আড়চোখে দূরে নিজেদের কোয়ার্টার্সের সামনেটা দেখে নিল। কেউ বাইরে নেই। এখন অন্তত ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে কেউ তার খোঁজ নেবে না।
বিশু গম্ভীর গলায় বলল, সবাই দেখবে তুই আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিস। ব্যাপারটা ভাব।
তার মানে? আমাকে সঙ্গে নিচ্ছিস নাকি তোরা? আমি যাচ্ছি। আমার মত। কথা বললে যদি মানে লাগে তাহলে সেটা খুলেই বল। রাগী মুখে তাকাল দীপা।
আশ্চর্য! মানে লাগার কথা কে বলেছে। অ্যাদিন তো আমাদের সঙ্গে মেশা দূরের কথা কথাও বলতিস না। নিশ্চয়ই তোকে বাড়ির লোকজন মানা করেছিল। কিছু হলে আমাদের কি! আমরা ছেলে! তোকেই সামলাতে হবে। বিশু কডা গলায় বলল।
ছেলে বলে সাতখুন মাপ?
ওরা জবাব না দিয়ে হাঁটতে লাগল। এইসময় অজিত গায়ে পড়ে কথা বলল, কোন মেয়েছেলে তো যাচ্ছে না, তাই বোধ হয়—!
দীপা চট করে বলে উঠল, এই যে, তোমার নাম অজিত, তাই তো?
হকচকিয়ে গেল অজিত, হ্যাঁ।
আমাকে তুমি মেয়েছেলে বলবে না।
আচ্ছা! অজিত মুখ ঘুরিয়ে নিল।
খোকন হাসল, তুই খুব পাল্টে গিয়েছিস দীপা।
বড় হলে সবাই পাল্টে যায় একটু আধটু। এনিয়ে কথা বলার কি আছে।
কোয়ার্টার্সের সীমা ছাড়িয়ে বা দিকে কুলি লাইন আর ডানদিকে চা-বাগান রেখে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে বাজার এলাকাব্য যেসব মানুষ আগে পেছনে যাচ্ছিল তারা দীপাকে খুব লক্ষ্য করছে। দুপাশে আম-কাঁঠালের সাবি, মাঝখানে পিচের সক রাস্তা। অনেকদিন বাদে দীপার হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল। হঠাৎ খোকন বলল, এ্যাই, তোর মনে আছে, আমরা হাতির তাডা খেয়ে এই জায়গাটা দিয়ে চা-বাগান ছেড়ে উঠে এসেছিলাম।
দীপা ঘাড় নাড়ল, মনে আছে। যাবি সেখানে?
বিশু বলল, না।
দীপা জানতে চাইল, কেন?
এখন তুই বড় হয়ে গিয়েছিস। তোকে নিয়ে চা-বাগানের ভেতর ঢোকা ঠিক হবে না। তোর মাথা মোটা তাই বুঝতে পারছিস না।
সত্যি পারছি না। ছেলেবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে খেলেছি, বড় হয়ে গেছি বলে সেসব বেঠিক হয়ে, যাবে কেন? তুই ঠাকুমার মত কথা বলছিস।
বিশু জবাব দিল না। বাঁক অবধি পৌঁছনোর আগে চিৎকার চেঁচামেচি আর মানুষজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। বিশু বলল, কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই। একপাশে সরে দাঁড়া।
ব্যাপারটা জানা গেল। আঙবাভাসা নদীর জঙ্গলে বাঘেব ডাক শোনা গেছে। আহত বাঘ যখন হুঙ্কাব দেয় তখন বুঝতে হবে সে খুব মরীয়া হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় শিকারিরা সবাইকে জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে বলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আসাম রোড ফাঁকা হয়ে গেল। ভয় মানুষেবা কৌতূহলকে মৃত করে ফেলে। একমাত্ৰ চলন্ত বাস আর কিছু গাড়ি ছাড়া দুপুর গড়ানো আসাম রোডে এখন মাঝে মাঝে টিয়াপাখির ঝাঁকের চিৎকার আর ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। খোকন বলল, চল, ফিরে যাই।
বিশু ধমকে উঠল, ভ্যাট। আঙরাভাসা এখানে নাকি? আর বাঘটা গরু ছেড়ে তোকে খেতে এ্যাদ্দূরে আসবে ভেবেছিস?
অজিত বলল, শুনেছ এক রাতে বাঘ তিরিশ মাইল যেতে পারে।
বিশু একটু ভাবল, আমার খুব ইচ্ছে করছে যেখানে গরুটা মরে পড়ে আছে তার কাছাকাছি কোন গাছে উঠে। রাতটা কাটাতে। বাঘটাকে দেখা যেত তাহলে।
খোকন বলল, আমি নেই।
চা-বাগানের তারের বেড়া ডিঙিয়ে রাস্তায় আসার জন্যে সিঁড়ির ধাপ করে দেওয়া হয়েছে। দীপা তার চূড়োয় উঠে বসতে ওরাত চলে এল। এবার অজিত বলল, খাবি তো?
বিশু আড়চোখে দীপাকে দেখে নিল, জবাব দিল না। খোকন ইশারা করে না বলল। অজিত একটু বিরক্ত হল, তাতে কি হয়েছে। ও তো বলল মেয়েছেলে না বলতে। মেয়েছেলে না হলে নিশ্চয়ই মেয়েছেলের মত ব্যবহার করবে না।
দীপা কথাবার্তার অর্থ ধরতে পারছিল না। সে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?
বিশু উত্তর না দিয়ে অজিতকে বলল, দে সিগারেট।
অজিত পকেট থেকে একটা কাঁচি সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তাতে পাঁচটা সিগারেট আছে। দীপা দেখল খোকন তার দিকে চোরের মত তাকাচ্ছে। দুটো দেশলাই কাঠি নিভিয়ে সিগারেট ধরাল বিশু। তারপর অজিত। খোকন বলল, আমি পুরো খাব না, আমাকে পরে একটা টান দিতে দিস। বিশু ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমি দিতে পারব না।
দীপা বলল, লজ্জা করছিস কেন? খেতে ইচ্ছে করলে পুরোটাই খা।
খোকন সিগারেট নিল, বাবাকে বলে দিবি না তো?
কথাটা শোনামাত্র একসঙ্গে বিশু আর অজিত হেসে উঠল। খোকন লজ্জিত মুখে সিগারেট ধরাল। দীপা বলল, তাহলে তোরা এখন বড় হয়ে গেছিস।
বিশু মুখ ফিরিয়ে বলল, আশ্চর্য! দীপা দুপাশের রাস্তা দেখতে দেখতে বলল, এইজন্যে সত্যসাধনবাবু তোদের বদ বলছিল। কথাটা শেষ করে হেসে ফেলল সে।
অজিত বলল, ওই বুড়োটাকে মাইরি একদিন টাইট দিতে হবে। সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকে। মুখের ওপর বলল থার্ড ডিভিসনও পাব না।
চুপ কর। পেয়ারের ছাত্রী বসে আছে। বিশু ফুট কাটল।
সত্যি কথা তোদের খারাপ লাগবেই। নিজের পয়সায় সিগারেট খাচ্ছিস না কেন? তাহলে কেউ তোকে কিছু বললে জবাব দিতে পারতিস।
নিজের পয়সা না তো কার পয়সা?
ইস। তুই রোজগার করিস?
নিশ্চয়ই। বাবা বাজারের টাকা দেয়। লিখে দেয় এই আনবে সেই আনবে। নিজে ওজন দেখে নেয় মাঝে মাঝে। বাজার দর যাচাই করে বাজারে ঘুরে ঘুরে। এক পয়সা মারার উপায় নেই। আমি যদি দোকানদারকে পটিয়ে দু-চার আনা দাম কমাই সেটা আমার কৃতিত্ব। বাবা ঠকছে না, আমি রোজগার করছি।
তাহলে তুই বাজার থেকে টাকা চুরি করিস।
ফালতু জ্ঞান দিবি না। বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েরা কেমন জ্ঞান দিতে শুরু করে। বিশু চোখ বন্ধ করে সিগারেটে টান দিল। আর শক্ত হয়ে গেল দীপা। তার চোখ স্থির হল বিশুর। মুখের ওপর। সে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করতে চাইল, তোদের সঙ্গে আমার আর বন্ধুত্ব নেই, নারে?
বিশু থতমত হয়ে গেল, আমি কি তা বলেছি?
খোকা বলল, আমরা তোর জন্যে খুব কষ্ট পেতাম দীপা। তোর বিয়ের পরদিন দুপুরে আমি ভাত খাইনি, জানিস?
বিশু বলল, কিছু মনে করিস না। দীপা, তোর বাবা লোক খুব খারাপ।
মানে?
খারাপ লোক না হলে একটা অসুস্থ ছেলের সঙ্গে কেউ মেয়ের বিয়ে দেয়? স্রেফ টাকা পয়সা লাগবে না বলে পার করে দিয়েছে। সেই রাত্রে আমরাই বরকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম অসুখ-বিসুখ আছে। বেশ চড়া গলায় বলল বিশু।
তুই বুঝতে পেরেছিলি? খোকন জানতে চাইল।
মাথা নেড়ে না বলল দীপা। সেটা লক্ষ্য করে খোকন জিজ্ঞাসা করল মারা গেল কি করে? বিয়ের পরের পরদিনই তো মরেছে!
জানি না।
মরে যাওয়ার আগেই তুই জ্বর গায়ে চলে এসেছিলি কেন? খোকন প্রশ্ন শেষ করছিল না। তার যেন অনেক কৌতূহল জমা আছে।
এসেছিলাম। দীপা নিঃশ্বাস ফেলল।
বিশু উঠে দাঁড়াল, চমৎকার। তুই জিজ্ঞাসা করছিলি বন্ধুত্ব নেই। কিনা? থাকবে কি করে! তোর ব্যাপারটা যদি আমাদের বলতে না চাস তাহলে আমরা কি করে তোকে বন্ধু বলে মনে করব?
আমি ওসব ঘটনা ভুলে যেতে চাই।
তোর বাড়ির লোক তো ভুলতে দিতে চাইছে না। তুই নিরামিষ খাস না? বিধবাদের মত কাপড় পরিস না?
দীপা মাথা নাড়ল, করতে হচ্ছে। কারণ আমি নাবালিকা নই। এখনও যাদের ওপরে নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের আমি অপছন্দের কথা বলতে পারি। কিন্তু অবাধ্য হতে পারি না।
বিশু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর জানতে চাইল, তুই যে আজ আমাদের সঙ্গে এখানে এলি, বাড়ির লোক তো জানে না, তার বেলায়?
দীপা চুপ করে বাইল। ওরাও কথা বলল না। বিশু আবার সিঁড়ির নিচের ধাপে বসল। হঠাৎ খোকন বলল, তোকে বাবা ডিম খেতে বলেছে?
দীপা উত্তর দিল না। ডাক্তারবাবু কি বাড়িতে গিয়ে গল্প করেছে? তাহলে তো খবরটা ঘুরে ঠাকুমার কানেও আসতে পারে। ওর অস্বস্তি হল। এইসময় বিশু বলল, যাঃ শালা, এবার ঝামেলা করবে। তার সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। চট করে পেছনে ফেলে দিয়ে চাপা গলায় বলল, সিগারেট ফেলে দে খোকন।
খোকন বলল, সর্বনাশ। চল পালাই।
পালানো যাবে না। সোজা রাস্তা। দেখতে পারেই। বিশু জবাব দিল।
চা-বাগানে ঢুকবি? খোকন জানতে চাইল।
এবার দীপা কথা বলল, তোরা তো কোন দোষ করিসনি, ভয় পাচ্ছিস কেন?
বিশু বলল, আজেবাজে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলবে। কোথায় যাচ্ছে বল তো? বাঘ বেরিয়েছে জানে না? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে?
যাঁকে নিয়ে ওরা কথা বলছিল। তিনি ততক্ষণে আসাম রোড ধরে কাছাকাছি এসে গিয়েছেন। দূর থেকেই যে দেখেছিলেন তা এখন মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, কি ব্যাপার? পঞ্চপাণ্ডবের বাকি দুজন কোথায়?
ওরা জবাব দিল না। চারজন চারদিকে তাকিয়ে রইল। তেজেন্দ্ৰ পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যিমাখা রুমাল বের করে নাক মুছলেন, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল যেন?
প্রশ্নটি অজিতের দিকে তাকিয়ে। সে সরাসরি জবাব দিল, কলোনিতে।
সেটা তো দেখেই বুঝতে পেরেছি। দেশ কোথায় ছিল?
যশোর। মাইকেল মধুসূদন দত্তর গ্রামে।
যশোর? সেখান থেকে এতদূরে কেউ এসেছে বলে শুনিনি।
আমরা তো এসেছি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামটা বলার কি দরকার ছিল? খুব গর্বের বিষয় নাকি? সারাজীবন নকল ইংরেজ সেজে একটার পর একটা মেম বিয়ে করে যাওয়া খুব কৃতিত্বের কথা? ফট করে একটা নাম বলে দিলেই হল?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি।
কবি? চার লাইন কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায়? আর কবি যদিও বা বলা যায় চরিত্র ঠিক না থাকলে কিসের কবি? দিনরাত শুনেছি মদ গিলত। হ্যাঁ, কবি হলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। নাম শুনেছ? বর্ধমানের মানুষ। তেজেন্দ্র আবার নাক মুছলেন। তাঁর চোখ দীপার ওপর থেকে সরছিল না।
তুমি এদের সঙ্গে কি মনে করে? ক বছর দেখিনি তো? তেজেন্দ্র প্রশ্ন করে গলায় জমে থাকা কফ শব্দ করে ছুঁড়ে দিলেন একপাশে। দীপা জবাব দিল না। তার মুখ অন্যপাশে ফেরানো ছিল। বিশু বলল, দীপা তোকে বলছেন উনি।
দীপা মুখ ফেরাতে বাধ্য হল। তেজেন্দ্ৰ ডাকলেন এদিকে এস। নেমে এস।
কেন? দীপা জানতে চাইল।
তুমি একে যুবতী তায় বিধবা। এইসময় উঠতি বয়সের ছেলেদের সঙ্গে মিশতে নেই। লোকে বদনাম করবে। বিধবার বদনাম হলে খুব খারাপ হয়। তেজেন্দ্ৰ আঙুল নেড়ে ডাকলেন। দীপার মুখ লাল হয়ে উঠল, কোথায় যাব?
বাড়িতে। তোমার ঠাকুমাকে আমি কতটুকু দেখেছি, তোমার বাবার বিয়ে দেখলাম। আমার একটা কর্তব্য তো আছে। তেজেন্দ্র রুমাল পকেটে বাখলেন।
আমি বাঘ দেখতে এসেছিলাম।
তা দ্যাখো। কিন্তু এইসব বকাটে ছোকরাদের সঙ্গে মোটেই আড্ডা দেবে না।
আপনি আমাকে বাঘ দেখাবেন? দীপা সরল গলায় জানতে চাইল।
বাঘ?
হ্যাঁ। ওই আংরাভাসার নদীর ধারে বাঘ বেরিয়েছে জানেন না?
তা শুনেছি।
আপনি এদিকে এসেছিলেন কেন? বিশু জিজ্ঞাসা করল।
বারান্দায় বসে দেখলাম দীপা তোমাদের সঙ্গে এদিকে এল। তোমাদের ওপর আমার কোন ভরসা নেই। এইসব নির্জন জায়গায় আগে কত কি কাণ্ড হয়েছে!
দীপা নেমে আসছিল সিঁড়িতে পা দিয়ে বিশুদের শরীর বাঁচিয়ে। তাকে জায়গা দেওয়াও জন্যে অজিত উঠে দাঁড়াতেই কাঁচি সিগারেটের প্যাকেটটা দেখা গেল। অজিত সেটাকে পকেটে ঢোকাবার সুযোগ পেল না। আর। তেজেন্দ্রর নজর পড়ল প্যাকেটটার ওপর। তিনি দীপাকে বললেন, ওই প্যাকেটটা নিয়ে এস তো!
দীপা বলল, এটা অজিতের প্যাকেট।
তেজেন্দ্র মাথা নাড়ালেন, জানি জানি। বাঙালিরা এসেই তো দেশের সর্বনাশ করছে। গোঁফ উঠতেই সিগারেট ফুকতে শুরু করেছে আজকাল আমাদের ছেলেরা কেন করছে তা জানি না ভেবেছ? নিয়ে আসতে বলেছি। যখন তখন নিয়ে এস।
বিশু কথা না বাড়িয়ে প্যাকেটটা তুলে দীপার হাতে তুলে দিল। দীপা সেটাকে নিয়ে এগিয়ে এসে তেজেন্দ্রর হাতে দিল। তেজেন্দ্র প্যাকেট খুলে দেখলেন, দুটো পড়ে আছে। তার মানে আটটা খতম। তুমিও খেয়েছ নাকি?
মাথা নেড়ে না বলল দীপা। তেজেন্দ্রর চোখ ছোট হল। তিনি প্যাকেটটা পকেটে রেখে দিয়ে বললেন, চল। দীপা বলল, কিন্তু আমি যে বাঘ দেখতে এসেছিলাম। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না?
তেজেন্দ্ৰকে চিন্তিত দেখাল। তিনি মাথা ঘুরিয়ে আসাম রোডের ওপাশটা দেখলেন। দীপা বলল, চলুন না। এরা খুব ভীতু, এরপর আর এগোতে চাইছে না। আপনি এসে ভাল হল। আমাকে নিয়ে চলুন না।
তেজেন্দ্ৰ মাথা নাড়লেন, বেশ, বলছ যখন। বাঘকে আমি মোটেই ভয় পাই না। এখন যেখানে চাঁপা ফুলের গাছ, কালীপুজো হয়, সেখানে একসময় সন্ধে হলেই কেঁদো কেন্দো বাঘ আসত। এই শম টর্চ জ্বেলে এক ফিরে আসত কোয়ার্টার্সে। বুঝলে? বাঘ-টাঘ আমাকে দেখিও না। চল।
দীপা অবলীলায় হাঁটতে লাগল। তেজেন্দ্র তার পাশে। পেছনে বসে থাকা তিনজন কোন কথা বলল না। একবার মুখ ফিরিয়ে দীপা দেখল ওরা সিঁড়ি ছেড়ে উঠে যায়নি। সে বলল, জানেন, ডাক্তারবাবু না আমাকে ডিম খেতে বলেছেন। আমার শরীর খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছে তো!
দুর্বল? তুমি? তেজেন্দ্ৰ লুঙ্গি ধরে হাটছিলেন।
বাঃ! আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল না?
ও। বিধবার তো ডিম খাওয়া ঠিক নয়। না, তুমি এক কাজ করতে পার। রোজ সকালে এস আমাদের বাড়িতে। বউমা একটা মুরগী পুষেছেন, সেটা মোরগ ছাড়া রোজ একা একাই ডিম দেয়। সেই ডিম খেতে পারো তুমি। মোরগ ছাড়া মুরগী যখন ডিম দেয় তখন তাকে আর আমিষ বলে না! এসব যাদের বিয়ে হয়েছে তারা ছাড়া কেউ বুঝবে না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। তেজেন্দ্ৰ হাসলেন।
মুরগী মোরগ ছাড়াই ডিম দেয়? অবাক হল দীপা।
দেয়। তবে সেই ডিমে বাচ্চা হয় না। তুমি কাল আমাদের বাড়িতে এসো না। তবে আমি ভাবতে পারছি না তোমার ঠাকুমা এই ডিম খাওয়া মেনে নেবেন কিনা। আমি তো অনেকবার ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি, ভদ্রমহিলা খুব গোঁড়া। তেজেন্দ্ৰ পকেটে হাত দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকটা দূর চলে এসেছিল। আসাম রোড যেখানে বাঁক নিয়ে চা-বাগান ছাড়িয়ে চাষের ক্ষেত ভেদ করে আংরাভাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে জিপটা দাঁড়িয়েছিল। জিপে বসেছিলেন বড়সাহেব। তিনি নেমে এলেন রাস্তায়। ইংরেজিতে বললেন, আপনারা এখানে কেন?
তেজেন্দ্ৰ জবাব দিলেন, এই মেয়েটি বাঘ দেখতে চায়।
বড়সাহেব বললেন, সরি। এটা চিড়িয়াখানা নয়। আপনারা ফিরে যান। কোথায় থাকেন আপনারা?
তেজেন্দ্র বললেন, আপনার বড়বাবুর বাবা আমি। এই চা-বাগান আমার হাতেই তৈরি হয়েছিল।
আচ্ছা। বড়সাহেব হাসলেন, মনে পড়েছে। কিন্তু আপনারা এখানে আর থাকবেন না। উন্ডেড চিতা খুব ভয়ঙ্কর হয়।
তেজেন্দ্র বিচলিত হলেন এবার, উন্ডেড? সর্বনাশ। চল, ফিরে চল। চলি স্যার। আপনার প্রশংসা আমার ছেলের মুখে খুব শুনি। এখন বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি কিন্তু সারাজীবন ব্রিটিশ ম্যানেজারদের কাছে কাজ করে অ্যাপ্রিসিয়েট করার ক্ষমতা পেয়েছি। আমিও আপনার সাহসের প্রশংসা করছি। চল হে। দীপার হাত ধরে পিছু ফিরলেন তেজেন্দ্ৰ।
দীপা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, বাঘ দেখা হবে না?
তেজেন্দ্র একটু হাঁপিয়ে পড়েছিলেন, উন্ডেড বাঘ দেখতে নেই। উন্ডেড বাঘারাই ম্যান-ইটার হয়ে যায়। দৌড়োদৌড়ি করে শিকার ধরতে পারে না তো! সাহেবটার চেহারা দেখলে? শুটকি মাছের মত। আমাদের সময়ে যেসব সাহেব আসবেন তাঁদের কি চেহারা ছিল! বাপস। যেমন লম্বা তেমন চওড়া। নাইনটিন টোয়েন্টি ওয়ানে লুইস নামের একটা সাহেব এল। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, ছাতি অন্তত বাহান্ন ইঞ্চি, হাতের কজি ইয়া মোটা। চারটে মুরগি দিয়ে ব্রেকফার্স্ট করত। স্কচ খেত জল না মিশিয়ে ঢাক ঢক করে। আর যা খাটতে পারত তা না দেখলে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ওই চেহারাটাই বেচাবার কাল হয়েছিল।
নিঃশ্বাস ফেললেন তেজেন্দ্ৰ।
কৌতূহলী হল দীপা, কেন?
কোন মেমসাহেব ওকে বিয়ে করতে চায়নি। যোগ্য পার্টনার খোঁজে তো। ওরা। অতবড় চেহারার সঙ্গে পাল্লা দেবে কে? তেলিপাড়া বাগানের ম্যানেজার হেস্টিংস সাহেবের বোন–ছিল খুব লম্বা, বাঁশের মত। তবে সাদা চামড়া বলে কথা। দেখে অবশ্য আমার হিজড়ে বলে মনে হত। হিজড়ে বোঝা? ওই যে যারা বাচ্চা হলে কি হাল গো বলে মাদল বাজিয়ে পয়সা নিতে আসে! তা হেস্টিংস সাহেবের বোন এল লুইসের সঙ্গে কোটশিপ করতে। রাত বারোটায় সেই বাঁশনি তেলিপাড়ায় ফিরে গিয়ে প্ৰাণ বাঁচালেন। একেই চা-বাগানে ব্রিটিশ মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় বেশি থাকে না তার ওপর খবরটা চাউর হল। একেবারে আসাম থেকে দাৰ্জিলিং। লুইসের ভাগ্যে আর মেয়ে জোটে না। তা এতদূরে একটা হুমন্দো গোরা কি একা থাকতে পারে। অতএর হুকুম হল কুলি লাইন থেকে কামিন চাই রাত কাটানোর জন্যে। তখন অবশ্য এটা রেওয়াজের মধ্যেই ছিল। তিন তিনটে কামিন অসুস্থ হয়ে পড়ল এমন যে তারা মাসখানেক বিছানা থেকে উঠতেই পারল না। শেষ পর্যন্ত তুরা বলে একটা কামিন সাহেবের সঙ্গে থেকে গেল। তার তিনটে সাহেব বাচ্চা হল। এখনও দু-একটা লোককে দেখবে গায়ের রঙ সাদা। তারা সব তুরার বংশধর। লুইস আমাকে একদিন বলেছিল, বাবু, ইন্ডিয়ান ওমেন আর ফার বেটার দ্যান ব্রিটিশ গার্লস। তা সেরকম লোক আর কোথায়, সেইসব মেয়েছেলেও তো নেই। তেজেন্দ্ৰ আর একবার ফৌত করে নিঃশ্বাস ফেললেন। দীপার খুব রাগ হচ্ছিল। ঠাকুর্দার বয়সী লোকটা তাকে এসব গল্প শোনাচ্ছে কেন? ওরা ততক্ষণে সেই জায়গায় চলে এসেছিল যেখানে একটু আগে বিশুদের ছেড়ে গিয়েছিল। তেজেন্দ্র সেখানে দাঁড়ালেন, ছোঁড়ারা কোথায়?
আমি কি করে জানব?
হুম। ভেরি ব্যাড। ওরা তোমাকে কি বলছিল?
মানে?
খারাপ কথা কিছু বলছিল? লাভ টাভের কথা?
না। দীপা ঠোঁট কামড়াল তারপর ফট করে মিথ্যে কথা বলল, ওরা আপনাকে নিয়ে আলোচনা করছিল। আমি নিষেধ করছিলাম।
আ-আমাকে নিয়ে? তেজেন্দ্ৰ এবার অবাক। হ্যাঁ। ওরা একটা ক্লাব করবে। প্রেসিডেন্ট কাকে করা হবে এনিয়ে তর্ক হচ্ছিল। খোকনকে আমি বললাম আপনাকে প্রেসিডেন্ট করতে।
প্রেসিডেন্ট? আমি? নিজের বুকে হাত রাখলেন তেজেন্দ্র।
হুঁ। অজিত রাজি হচ্ছিল না। ও তো বাইরের লোক, এসেই আপনার সম্পর্কে আজেবাজে কথা শুনেছে। সেসবই বলছিল।
আজেবাজে কথা! কি কথা?
আমি বলতে পারব না।
আহ, বল না। এখানে তো কেউ নেই।
আপনার বউ মারা যাওয়ার পর আপনি কি সব করেছিলেন সেসব কথা। বিশু অবশ্য খুব আপত্তি করেছে। বলেছে প্রেসিডেন্ট আপনাকেই করতে হবে।
ক্লাবটা কিসেব?
সাংস্কৃতিক ক্লাব।
ছেলেমেয়ে একসঙ্গে?
হ্যাঁ।
আমার অবশ্য আপত্তি নেই প্রেসিডেন্ট হতে। তবে ওই অজিতটাকে দলে রাখবে কিনা ভেবে দ্যাখো। বাঙালগুলো এদেশে আসার পর ভক্তিশ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে মানুষের। নিয়মশঙ্খলা বলে কিছু থাকছে না। আর স্বাধীনতা! এ স্বাধীনতা কে চায়? তোমাদের জন্যে খুব দুঃখ হয়, তোমরা ব্রিটিশ আমলে বড় হলে না। তাহলে দেখতে পেতে ডিসিপ্লিন কাকে বলে? সাধে কি ওরা এত বড় হয়েছে। ওরা যদি ভারতবর্ষে না আসত তাহলে এই চা-বাগান হোত? এত ব্রিজ, এত শহর, এত কলকারখানা তৈরি হোত? কিসু না। আমরা সেই সিরাজৌদ্দলার যুগেই থেকে যেতাম। ব্রিটিশদের তাড়িয়ে আমরা আমাদের সর্বনাশ করলাম। তা বলে দিও ওদের, আমার কোন আপত্তি নেই প্রেসিডেন্ট হতে। তোমাদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করা যাবে। তাতে তোমরাই লাভবান হবে। তেজেন্দ্ৰ আবার নিঃশ্বাস ফেললেন।
দীপা হাসার চেষ্টা করল, খুব ভাল হল। ওদের বলব। কিন্তু দাদু, আমার একটা কথা আপনি রাখবেন? এখন তো আপনি আমাদের প্রেসিডেন্ট!
হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলে ফ্যালো।
ওই সিগারেটের প্যাকেটটা দিন। ওদের মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।
তেজেন্দ্ৰ কপালে আরও ভাঁজ ফেললেন। দীপা সেটা লক্ষ্য করে বলল, ওরা খুব ভয় পাচ্ছে যে আপনি নিশ্চয়ই বড়দের বলবেন ওরা সিগারেট খাচ্ছিল।
সেটা তো বলার মত কথাই। খুব অন্যায়।
কিন্তু আপনি প্রেসিডেন্ট হয়ে ওদের নিন্দে করবেন?
তেজেন্দ্ৰ আকাশের দিকে তাকালেন একটু। তারপর বললেন, কিন্তু তোমাকে নিয়ে এই যে ওরা হুটহাট জঙ্গলে চলে আসছে এটা করা আর চলবে না। তোমার যদি এদিকে আসতে ইচ্ছে করে তাহলে আমার সঙ্গে আসবে।
দীপা চটপট নিপাট ভালমানুষের মত ঘাড় নাড়তেই তেজেন্দ্ৰ পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন। সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে বললেন, যাঃ, এবার তোমার কথায় ওদের ছেড়ে দিলাম। আচ্ছা, তুমি সিগারেট খাও না তো?
না। দীপা ঘনঘন ঘাড় নাড়ল।
গুড। মেয়েছেলে সিগারেট খেলে ঠোঁট কালো হয়ে যায়।
দীপার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল মেয়েছেলে শব্দটা শুনে। সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। তারপর তেজেন্দ্রর সঙ্গে কোয়ার্টার্সের দিকে হাঁটা শুরু করল। কয়েক পা হেঁটে তেজেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, তোমার মুখ এত গম্ভীর কেন?
আপনি আমাকে কখনো মেয়েছেলে বলবেন না।
মানে? তুমি তো মেয়েছেলে।
না। আমি মেয়ে। মেয়েছেলে শব্দটার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য আছে।
তাচ্ছিল্য? তুমি খুব গল্পের বই পড় বুঝি?
দীপা জবাব দিল না। ওরা যখন আসাম রোড ছেড়ে মাঠে নামল তখন অঞ্জলি আর মনোরমাকে দেখা গেল। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ওরা। দীপা বলল, তাহলে আমরা সব ঠিকঠাক করে আপনাকে প্রেসিডেন্টের ব্যাপারটা জানিয়ে দেব।
তেজেন্দ্র বললেন, তাড়াতাড়ি করবে। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। কিন্তু তেজেন্দ্র নিজের কোয়ার্টার্সের দিকে গেলেন না। দীপাকে নিয়ে অঞ্জলিদের সামনে পৌঁছে বললেন, মেয়ের খুব সাধ হয়েছিল বাঘ দেখবার। খুব সাহসী, বুঝলেন। কথাগুলো মনোরমার উদ্দেশ্যে। তাঁদের দুজনের মাথায় এখন ঘোমটা। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করলেন, তুই না বলে চলে গিয়েছিলি যে বড়। লোকজন, দৌড়ে দৌড়ে এল অথচ তোর পাত্তা নেই। কি ভেবেছিস কি তুই?
তেজেন্দ্র বললেন, উত্তেজিত হয়ো না বউমা। আমি তো সঙ্গে ছিলাম। নদীতে যখন বর্ষার জল এসে মেশে তখন তার আচরণ কি শীতের মত হয়। তবে তখন বাঁধ দেওয দরকার গতি নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্যে। সেইজন্যেই আমি সঙ্গে ছিলাম। আবিও খানিক বকর বকর করে তেজেন্দ্র চলে গেলেন তখন মনোরমা মুখ খুললেন, তুই ওই হতচ্ছাড়া বুড়োটোর সঙ্গে নির্জনে গিয়েছিলি?
বুড়োমানুষ তো! তোমার থেকেও বড়। অনেক বড়।
তাতে কি হয়েছে? খবরদার ওর সঙ্গে কোথাও যাবি না। চিতায় উঠলেও ওরকম পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না। অনেক তো বড় হয়েছ। আর করে বুঝবে?
গতকাল রেজাল্ট আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। আজ সকালে সত্যসাধন-মাস্টার জলপাইগুড়িতে গিয়েছেন। গতকাল সারাদিন ধরে উত্তেজনা ছিল স্কুলে। বিকেলে অঞ্জলির সঙ্গে দীপা এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছিল। রাত্রে ঘুম আসেনি তেমন। অমরনাথ অবশ্য বলেছিলেন, তুই যা পড়েছিস আমি তার অর্ধেক পড়িনি। আমি যদি পাশ করে থাকি তাহলে তুইও করবি। এত চিন্তার কি আছে?
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সে একাই স্কুলে যাচ্ছিল। আসাম রোড ধরে যাওয়ার সময় বিশুদের দেখতে পেল। পাঁচটা সাইকেল পাশাপাশি যাচ্ছে রাস্তা জুড়ে। দীপা দাঁড়িয়ে পড়তেই অজিত বলল, এখনও কোন খবর নেই। প্রেসিডেন্ট সাহেব স্কুলে গিয়ে বসে আছে?
সঙ্গে সঙ্গে বাকি চারজন হেসে উঠল। তাদের সেই সাংস্কৃতিক ক্লাব আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। পরের দিন সিগারেটের প্যাকেট ফেরত দিয়ে বানানো গল্পটা বিশুদের বলতেই ওরা রেগে গিয়েছিল খুব। কিন্তু ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হয়েছে অনেক চেষ্টা করে। তেজেন্দ্ৰকে বোঝানো হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন বাগানের বড়বাবু, যিনি তাঁরই ছেলে। সেটাই উচিত। নিজের ছেলের বিরুদ্ধে যেহেতু তেজেন্দ্র যেতে পারেন না। তাই ওরা আপাতত ক্লাবটা করছে না। এই দুই আড়াই মাস দীপা তেজেন্দ্ৰকে এড়াতেই বাড়ির বাইরে খুব একটা আসেনি। বিশুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কদাচিত হয়েছে। এখন সে বলল, আমি স্কুলে যাচ্ছি। আমার মন বলছে আজ রেজাল্ট আসবে। অতএর সাইকেলগুলো ঘুরল।
ঠিক চারটের সময় বাস থেকে নেমে দৌড়তে দৌড়তে এলেন সত্যসাধন মাস্টার। তাঁর হাতে কাগজপত্র। সবাই ভিড় করে দাঁড়াতেই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন, না, না, এইভাবে না। আগে হেডমাস্টার মশাই-এর সঙ্গে কথা কই তারপর অ্যানাউন্সি করব। তিনি প্ৰায় জোবি করেই ভেতরে চলে গেলেন। একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। কেউ কথা বলছে না। দীপা মুখ ফিরিয়ে দেখল অমরনাথ সাইকেল চেপে স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এই অসময়ে তাঁকে এখানে দেখে সে ছুটে গেল। অমরনাথ তার কাঁধে হাত রাখতেই সত্যসাধন মাস্টার বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তারপর চিৎকার করে নাম আর ডিভিসন বলে যেতে লাগলেন। দীপা নিজের নাম শুনতে পেল না। সবাব নাম ডাকা শেষ হয়ে গেলে সত্যসাধন মাস্টার চিৎকার করে উঠলেন, শোন সবাই, আমাগো দীপা চারটা লেটার নিয়া ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করছে। সে কুথায়?
আর তখন সবাইকে ছাপিয়ে অমরনাথ সশব্দে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, মাগো! মা আমার!