পনের
এই ক’দিনে অর্ক যেন অনেক কিছু জেনে ফেলল। রকের আড্ডায় অথবা স্কুলের বন্ধুদের মুখে এসব ব্যাপারে অনেক গল্প শুনলেও সেগুলো ছিল ভাসা ভাসা। নিজের চোখে দেখার পর মনে হচ্ছিল ওর বয়স এখন অনেক বেশী।
আজ তৃষ্ণা পালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিডন স্ট্রীটের মোড়ে এসে একটা পানের দোকানের আয়নায় নিজেকে দেখল। যতই শরীরটা বড় দেখাক মুখের মধ্যে তার ছাপ একটুও পড়েনি। অথচ ও এখন যাদের সঙ্গে মেশে তারা কত না বড় বড় ব্যাপার স্যাপার করে থাকে। তৃষ্ণা পালের লেখা চিঠিটা বের করে আর একবার পড়ল সে। মেয়েটা নিশ্চয়ই কষ্ট পায়। নাহলে এইসব কি করে লিখল। বিলাস সোম ওর কাছে আসে কেন? অত বড় ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মানুষ, সুন্দরী মেয়ে বউ থাকতে এই খারাপ পাড়ায় হার দিতে আসার কি দরকার? সেই রাতে হার না দিয়ে চলে গিয়েছিল বিলাস, সেটাও কি কষ্ট পেয়ে? বিলাসের বউ এই মেয়েটার কথা অনুমান করে জ্বলে উঠেছিল, হাসপাতালে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, স্বামীর দুর্ঘটনার কথা শুনে ট্যাক্সিতে আসবার সময় হেসেও ছিল! এসবই কি কোন কষ্ট থেকে? এসব নিয়ে একবার ভাবতে শুরু করে অর্ক দেখল সব কিছুর চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। কোনদিন সে এভাবে চিন্তা করেনি। আজ যত ভাবছে তত যেন গিঁট খুলে গিয়েও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ঝুমকির চেহারা ভাল। বস্তিতে যখন থাকে তখন একটু আলাদা বলে চোখে পড়ে। সেই ঝুমকি পাড়ায় বলে আয়ার কাজ করে অথচ নাচ শিখতে যায় চৌরঙ্গী লেনে, শরীর বেচে, সোনাগাছিতে এসে তৃষ্ণা পালের কাছে তালিম নেয়। এসব কি ওকে দেখে কখনও কেউ অনুমান করতে পারবে? ও তো আয়ার কাজ করতে পারতো। কেন করেনি? তাহলে ওরও নিশ্চয়ই কোন কষ্ট আছে। কষ্টটা কি সেটা অর্ক এই মুহূর্তে ধরতে পারল না। খুরকি কিলা কিংবা বিলুর কোন কষ্ট নেই। যে কোন উপায়ে মাল যোগাড় করে বেশ মেজাজে থাকে। শুধু কোন বড় পার্টির সঙ্গে কিচাইন হলে অথবা পুলিসের ঝামেলা এলে ওরা খুব চিন্তায় পড়ে কিন্তু কষ্ট পায় না। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল, একদিন ট্রামরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কিলা বলেছিল, ‘দুনিয়ার সব হেমা মালিনী রেখাদের কারা পায় জানিস?’
‘কারা! ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ।’
‘দূর বে। যারা অনেক পড়াশুনার পরে বড় বড় চাকরি করে, ব্যবসা করে তারা।’
‘আমরা শালা ফেকলু, কেমন করে তাকায় দেখিস না? যেন থুতু ফেলছে।’ কথাটা যখন শুনেছিল তখন হাসি পেয়েছিল অর্কর। কিন্তু এখন, মনে পড়ার পর, মাথা নাড়ল সে। না, কিলাদেরও কষ্ট আছে। খুব বড় না হতে পারার কষ্ট। লোকের কাছে উপেক্ষা পাওয়ার কষ্ট। তবে এটা বুঝতে পেরেই যেন বুঝতে দিতে চায় না ওরা। এর পরেই মা এবং বাবার মুখ মনে পড়তেই ও রাস্তার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ওদের সব কষ্ট তো তার জন্যেই। ও যদি খুব পড়াশুনা করত, কিলাদের সঙ্গে না মিশত তাহলে মা-বাবার কোন কষ্ট থাকতো না। কিন্তু পড়াশুনা করতে যে তার একদম ভাল লাগে না! পড়াশুনা করেও তো বিলাস সোমের মত কষ্ট দিতে হবে, পেতে হবে। তাছাড়া কিলাদের সঙ্গে মিশছে বলেই সে গুণ্ডা হচ্ছে না। কেউ রোয়াবি করলে দল থাকলে বদলা নেওয়া যায়। হয় দল নয় ক্ষমতা—এই দুটোর একটা থাকা চাই। মা-বাবার কষ্ট দূর করা যায় কি করে তাহলে? তখনই অর্কর মনে হল শুধু তার জন্যেই কি মা-বাবার কষ্ট? মা কেন তাকে নিয়ে ছেলেবেলায় একা একা ছিল? কেন মাঝ রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো? তখন তো সে ছোট্ট, খুবই ছোট্ট? বাবা কেন জেলে গিয়ে শরীর নষ্ট করে এল? যে জন্যে বাবা জেলে গিয়েছিল সেটা সে শুনেছে। অনেক বড় বড় কথা বাবা বলেছে তাকে। এই দেশটাকে পাল্টে দিতে চেয়েছিল নকশালরা। বাবা তার জন্যে এখনও কষ্ট পায় এবং আজ অর্কর মনে হল এসব কাজ করে বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছে। আর যে উদ্দেশ্যের জন্যে বাবা এই কষ্ট দিল তা হল না বলে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। তার মানে কোন মানুষই কষ্ট ছাড়া বেঁচে নেই। সে নিজে কি কষ্ট পায়? দূর শালা। অর্ক হাসল। তার আবার কষ্ট কিসের? না, ঠিক হল না। দুটো ভাল শার্ট এবং প্যান্টের জন্যে তার কষ্ট আছে। এটুকু ভাবতেই আরও অনেক চাহিদার কথা মনে এল তার। তার মানে এই যে, যা চাওয়া যায় তা না পেলেই কষ্ট হয়।
এতখানি ভাবতে পেরে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে কি বেশ বড় হয়ে গেল? নাহলে একটার পর একটা ভাবার নেশা কি করে এল! আচ্ছা, কোনরকমে বারো ক্লাশটা পাশ করলে কেমন হয়? তাতে যদি মা একটু শান্তি পায় তো পাক। দিনে দু ঘন্টা বই নিয়ে বসলে বারো ক্লাশ পাশ করা যাবে? চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।
রেলিং ছেড়ে ট্রাম স্টপের দিকে এগোল অর্ক। বিলুকে কি বলবে সে সোনাগাছিতে এসেছিল? না, তাহলেই পাঁচটা প্রশ্ন উঠবে। ওই অতগুলো মেয়েকে দেখে বিলুরা নিশ্চয়ই খুব রসিকতা করত। কিন্তু তার একটুও ভাল লাগেনি। ওদের বাড়িঘর নেই, মা বাবা নেই, শুধু শরীর বিক্রি করে ভাত-কাপড় কিনছে। কিন্তু কাউকেও তো দুঃখী বলে মনে হল না। মাথা নাড়ল অর্ক, কোন মানুষের দুঃখ কি বাইরে থেকে বোঝা যায়? একটু আগেই তো এসব নিয়ে সে ভেবেছে। কিন্তু, অর্কর মনে এক ধরনের সঙ্কোচ এল। কিন্তু, ওই মেয়েদের দেখে তার ভয় লাগছিল কেন? ভয়টা চাপা, এখন টের পাচ্ছে। এমনকি যে ঝুমকিকে বাইরে সে তড়পায় তাকে দেখেও ওইরকম একটা কিছু হচ্ছিল!
ট্রামের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে অভ্যেস মত সে কণ্ডাক্টরকে খুঁজল। একদম প্রথম দিকের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে লোকটা। আধবুড়ো, টাক আছে। খুব খেঁকুরে হয় এই ধরনের লোক। ভাড়া না দিলে হেভি কিচাইন করবে। অবশ্য ওর দরজায় আসতে আসতে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে ফেলল অর্ক। আজ তো সে স্বচ্ছন্দেই ভাড়া দিয়ে দিতে পারে। তৃষ্ণা পালের সামনে যে টাকা সে ছুঁড়ে দিয়েছিল সেটা বেরোবার আগে জোর করে তৃষ্ণা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি ঝুমকিকে কিছুটা ভাগ দিতেও হয় তাহলে এমন কিছু কম থাকবে না। রোজ তো ট্রামবাসের টিকিট ফাঁকি দেয় আজ সে রাজার মত টিকিট কাটবে। চট করে গেট ছেড়ে ওপরে উঠে এল অর্ক। বেশ ভিড়। সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়াল সে। এদিকটাও কমতি নেই। লেডিস সিটের সামনে যত শুড্যাগুলো আঠা হয়ে থাকে। আজ বিকেলে সেই পার্ক স্ট্রীট ছুটতে হবে। যদি মাকে বলে কাটানো যায় তো ভাল হয়। বাবার ছোটকাকাকে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। দেখা করলে নিশ্চয়ই জ্ঞান দেবে খুব। এদিকে বিলাস সোমের বউ বলে গেল আজ বিকেলে একবার হাসপাতালে যেতে। কিন্তু লোকটা তাকে খোঁজ করছিল কেন? সেদিন তো স্পষ্টই বলল, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে অর্ক যেন দেখা করে। তাহলে এখন তাকে কি জন্যে দরকার। চুপচাপ কেটে পড়লে কেমন হয়! দূর! এখন আর বিলাস সোমকে সে ভয় করে না। তৃষ্ণার চিঠি পকেটে আছে, বিলাস নিশ্চয়ই আর ঝামেলা করতে চাইবে না।
এই সময় বি, কে, পাল অ্যাভিন্যু ছাড়িয়ে গ্রে স্ত্রীটে পড়ল ট্রামটা। আর তখনই একটা অস্ফুট শব্দ কানে এল। খুব চাপা কিন্তু আচমকা। অর্ক লেডিস সিটের দিকে ঝুঁকে দেখল একটি মেয়ে সিট ছেড়ে দরজার দিকে এগোতে গিয়েও যেন পারছে না। শব্দটা ওরই গলা থেকে বেরিয়েছে কিনা বুঝতে পারল না অর্ক। কিন্তু এবার মেয়েটি বলল, ‘সরে যান, নামব।’
‘যান না। যে বলল তার বয়েস একুশ বাইশ। কথাটা বলে সে সামান্য দোলাল শরীর, যেন সরে যাচ্ছে এমন ভান করল কিন্তু সরল না। ওই জায়গাটায় বেশ ভিড়। সবাই রড ধরে উর্ধ্বনেত্র হয়ে রয়েছে। মেয়েটি সেই ভিড় বাঁচিয়ে কোন মতে বের হবার চেষ্টা করল। বেরুতে গেলে তাকে ওই ছেলেটির শরীর ঘেঁষে আসতে হচ্ছে। অর্ক দেখল, ছেলেটির বাঁ হাত সামান্য উঠে মানুষের শরীরের আড়ালের সুযোগ নিয়ে মেয়েটির বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার মুখচোখের ভঙ্গীতে একটুও পরিবর্তন নেই। মেয়েটি সেটা অনুভব করে যেন পাথর হয়ে গেল। এর মধ্যে পেছন থেকে নামবার তাড়া আসছিল। অতএব না এগিয়ে কোন উপায় নেই, মেয়েটি প্রাণপণে নিজের শরীরটাকে ছোট করে নিয়ে পা ফেলতেই ছেলেটির হাত ছোবল মারল। এতটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না অর্ক। মেয়েটিও দ্বিতীয়বার অস্ফুট শব্দ করে যখন মরিয়া হয়ে বেরিয়ে আসছে তখন বাঁ হাত বাড়িয়ে ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে ভিড় থেকে হিড় হিড় করে টেনে এনে অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল অর্ক, ‘কি করছেন?’
একটুও না ঘাবড়ে ছেলেটা বলল, ‘কি করছি মানে? কলার ধরেছেন কেন?’
ডান হাতে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মারতেই ছেলেটা চট করে মুখ সরিয়ে নিল। ইতিমধ্যে ট্রামটা দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি নেমে যেতে ছেলেটি অর্কর হাত ছাড়িয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল। ঘুষিটা ঠিক মারতে পারেনি বলে আফসোস হচ্ছিল অর্কর কিন্তু ওকে নামতে দেখেই ভেতরে একটা জিদ এসে গেল। ছেলেটা নিশ্চয়ই এখন ওই মেয়েকে জ্বালাবে। কথাটা মনে হওয়ামাত্র অর্ক দ্রুত ট্রাম থেকে নেমে পড়ল। ছেলেটা হয়তো আশা করেনি অর্ক ট্রাম থেকে নেমে আসবে, তাই দেখামাত্র বেশ উল্লসিত হল। চিৎকার করে কয়েকজনকে ডাকতে লাগল হাত পা নেড়ে। সম্পূর্ণ বোধশূন্য হয়ে অর্ক দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর এবং প্রথম সুযোগেই ঘুষিটা চালালো মুখ লক্ষ্য করে। দরদরিয়ে রক্ত গড়িয়ে আসতেই দুহাতে ছেলেটার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আর ট্রামে বাসে মেয়েদের বুকে হাত দিবি? বদমায়েস লোচ্চার, তোর বাড়িতে মা বোন নেই?’
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ভিড় জমে গেল। গ্রে স্ট্রীট চিৎপুরের এই সংযোগস্থলে সব সময়েই মানুষের জটলা। অনেকেই জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কি হয়েছে, কি ব্যাপার? অর্ক ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। উল্টো পিঠের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ওদের দেখছে মুখে হাত চাপা দিয়ে। সে কাঁধ ঝাঁকাল, দূর, ওসব কথা বললে লোকগুলো মেয়েটার দিকে তাকাবে, কি দরকার! সে দেখল ট্রামটা আর ধারে কাছে নেই। ছেলেটা মাটি ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল একটা চায়ের দোকানের দিকে। এখন পেছনে কোন ট্রাম নেই। অর্ক ঘাড় ঘোরালো, না মেয়েটি চলে গিয়েছে। দু’ চারজন তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে ভাই?’ অর্ক দেখল লোকটা বৃদ্ধ, ভাল মানুষ গোছের। নিতান্ত অনিচ্ছায় অর্ক বলল, ‘মেয়েদের বেইজ্জত করছিল।’
‘বেইজ্জত! আরে ব্বাপ। কোথায়?’
‘ট্রামে।’
ট্রাম শব্দটা শোনার পর লোকটার উত্তেজনা যেন কমে এল, ‘ও ট্রামে! ট্রামে আবার কি হবে। তা করেছিলটা কি?’
অর্ক ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘বুঝতে পারেন না একটা মেয়েকে কিভাবে বেইজ্জত করা যায়?’
দ্বিতীয়জন বলল, ‘নিশ্চয়ই খিস্তিখাস্তা করছিল।’
প্রথমজন বলল, ‘তাহলে অমন করে মারা ঠিক হয়নি। নিশ্চয়ই গায়ে হাতটাত।’
অর্ক বিরক্ত ভঙ্গীতে বলল, ‘আপনারা ফুটুন তো।’
সেই মুহূর্তে ওর চোখে পড়ল ছেলেটা ফিরে আসছে। একা নয়, সঙ্গে আরও চারজন আছে। অর্ক বুঝল ঝামেলা হবে। সে দেখল খুব দ্রুত ভিড় গলে যাচ্ছে। এখন পালানোর কোন মানে হয় না। পালালেই ওদের জোর বাড়বে। কিন্তু পাঁচজনের সঙ্গে একা কি করে লড়বে? অর্ক চট করে পকেটে হাত দিল। হ্যাঁ, একদম ভুলে গিয়েছিল, পকেটে সেই মাল রয়েছে। তৃষ্ণা পালের দেওয়াল আলমারি থেকে ঝাড়া ডট পেনের মত দেখতে অস্ত্র এখন ওকে বেশ শক্তি যোগাচ্ছিল।
ছেলেটা চিৎকার করল, ‘ওই যে ওই শালা!’
একদম সামনে চলে এলেও অর্ক এক চুল নড়ল না। এটা বোধহয় ওরা আশা করেনি। ছেলেটা চেঁচাল, ‘আমার রক্তের বদলা নেব। দলের একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘এই, ওর গায়ে হাত তুলেছিস কেন?’
অর্ক বুঝল উত্তর দিয়ে কোন লাভ নেই। তবু চোখের ইশারায় ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওকে জিজ্ঞাসা কর। মেয়েছেলের সম্মান না রাখতে জানলে ওরকম রক্ত বের হবে।’
আহত ছেলেটা তেড়ে এল, এবং পলকেই অর্ক দেখল তাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আক্রান্ত হবার আগেই আক্রমণ করল সে। প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল আহত ছেলেটির পেটে। কঁক করে একটা শব্দ বের হল, পেটে হাত চেপে বসে গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে বাকি চারজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপর। বেধড়ক ঘুষি এবং লাথি পড়তে লাগল ওর শরীরে। আঘাতের চোটে ফুটপাথে গড়িয়ে পড়ল অর্ক। তখনই ওই অবস্থায় পকেট থেকে দ্রুত কলমটা বের করে চাপ দিতেই চকচকে ফলা বেরিয়ে এল। যারা উল্লসিত হয়ে মারছিল তারা আচমকা থেমে গেল। জিনিসটা কি না বুঝলেও ওটা যে ভয়ঙ্কর কিছু অনুমান করে দাঁড়িয়ে পড়ল চারজন।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল অর্ক। তার জামা ছিঁড়েছে, জিভে নোনা স্বাদ। সে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘আয় শালারা আয়।’ তৎক্ষণাৎ চারটে ছেলেই উল্টোদিকে দৌড় দিল। কিন্তু প্রথমটি এখনও মাটিতে বসে। অর্ক ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যেতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ছেলেটা, ‘আমি আর করব না, আর মেয়েদের গায়ে হাত দেব না।’ ওর একটা চোখ তখন অর্কর হাতের ওপর স্থির। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই রোজ হাত দিস?’
প্রথমে উত্তর দিল না ছেলেটা। কিন্তু অর্ক সামান্য ঝুঁকতেই সে দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। অর্ক অবাক হয়ে গেল। এর জামা-কাপড় এবং মুখের মধ্যে বেশ ভদ্র ভদ্র ছাপ আছে। তখনও পেটে হাত চেপে ছিল ছেলেটা, কেমন একটা ঘেন্না হল অর্কর। এই প্রথম কোন মানুষের দিকে তাকিয়ে ওর এই রকম অনুভূতি হল। তারপরেই খেয়াল হল কলমের ফলা ততক্ষণে অনেকের নজরে পড়ে গেছে। চট করে বোতাম টিপে সেটাকে গুটিয়ে ফেলে পকেটে রেখে জামার হাতায় মুখ মুছল অর্ক। হাতটা লালচে লালচে দেখাচ্ছে। মুখ ধুতে পারলে বেশ ভাল হত। সে যখন রাস্তা পার হয়ে চায়ের দোকানের দিকে যাচ্ছে তখনই চোখ পড়ল। মোটাসোটা একজন ভদ্রমহিলা, সুন্দর চেহারার একজন ভদ্রলোক আর সেই মেয়েটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। অর্ক কিছু বোঝার আগেই ভদ্রমহিলা ওর দুই হাত জড়িয়ে ধরল, ‘তোমার কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকলাম বাবা, তুমি আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছ। বেঁচে থাক বাবা, তোমার মত ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক। কথাটা শুনেই আমি ছুটে আসছি। উনি মানা করছিলেন, গুণ্ডা বদমায়েসদের মারামারির মধ্যে তুমি যেও না। কিন্তু জানলা দিয়ে দেখলাম ওরা তোমাকে মারছে। আমার মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি মার খাচ্ছ এ আমি সহ্য করতে পারলাম না। দীর্ঘজীবী হও বাবা।’ এক নাগাড়ে গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলেন মহিলা। অর্ক এত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে কিছু বলার মত অবস্থায় ছিল না। এবং তখনি ওদের ঘিরে ভিড় জমে উঠল।
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি পুলিসে ফোন করেছি।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘পুলিস ছাই করবে। কেউ যদি প্রতিবাদ না করে তাহলে তো এমন হবেই। সবাই বলে দিনকাল খারাপ কিন্তু তোমার মত ছেলে—, আহা রক্ত পড়ছে, তুমি দাঁড়িয়ে দেখছ কি, ওকে একটা ডাক্তারখানায় নিয়ে যাও।’
এই সময় হই হই শব্দ উঠল। যারা ভিড় করেছিল তারা চেঁচাচ্ছে, পেটে হাত দিয়ে পড়ে থাকা ছেলেটা এবার দৌড়ে পালাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘যেতে দাও ওকে। তুমি চলে ওই ডাক্তারখানায়।’
অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে ঘাড় নাড়ল, ‘না, দরকার নেই।’
ভদ্রমহিলা প্রতিবাদ করলেন, ‘এই অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কোন কথা শুনতে চাই না, তুমি ডাক্তারখানায় চল।’ মোটাসোটা ফরসা পাকা চুলের মহিলার দিকে তাকিয়ে অর্ক আর না বলতে পারল না।
ডাক্তারখানা পর্যন্ত ভিড় সঙ্গে ছিল। ডাক্তারবাবু সামান্য ফার্স্টএইড দিয়ে বললেন, ‘তেমন কিছু হয়নি।’
এদিকে ভদ্রমহিলা তখন অনর্গল তার প্রশংসা করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক এখন চুপচাপ। ভিড় সরে গেছে ফুটপাথ থেকে। অর্কর ক্রমশ অস্বস্তি বাড়ছিল। সে বলল, ‘আমি যাই।’ তখনই প্রথম মেয়েটি কথা বলল, ‘রাস্তায় ওরা কিছু করবে না তো!’
অর্ক মেয়েটিকে দেখল, ‘না। যারা ভয় পায় তারা কিছু করে না।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তবু তোমার একা যাওয়া উচিত হচ্ছে না। কোথায় বাড়ি?’
‘বেলগাছিয়ায়। আমার কিছু হবে না।’
‘তার কি ঠিক আছে! তুমি বরং একটা ট্যাক্সি ডেকে ওকে পৌঁছে দিয়ে এস।’
ভদ্রমহিলার এই প্রস্তাব যে ভদ্রলোকের পছন্দ হল না সেটা অর্ক বুঝতে পারল। সে দ্রুত প্রতিবাদ করল, ‘এসবের কোন দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারব।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘বেশ তাহলে অন্তত কিছুক্ষণ আমাদের বাড়িতে জিরিয়ে যাও। ওহো, আমি তো তোমার নামই জিজ্ঞাসা করিনি। কি নাম তোমার?’
‘অর্ক, অর্ক মিত্র।’
‘বাঃ, কি সুন্দর নাম।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘এখানে ভিড় বাড়ানো উচিত হচ্ছে না। বাড়িতে চল।’
ওঁরা অর্ককে কিছুতেই ছাড়লেন না। এখন ভরদুপুর। অর্ক বুঝতে পারছিল বেশী দেরি হলে বাড়িতে আর একটা ঝামেলা হবে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার এত প্রশংসা এবং আন্তরিক ব্যবহারকে এড়িয়ে যেতেও পারছিল না সে।
তিন চারটে বাড়ির পরই দোতলায় ওঁরা থাকেন। সুন্দর সাজানো ঘর। নিজের ছেঁড়া পোশাকের জন্যে বেডের সোফায় বসতে অস্বস্তি হচ্ছিল অর্কর। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি পড়?’
নিজের ক্লাসটা বলল অর্ক। এবং সেটা বলতে গিয়ে সে এই প্রথম লজ্জা পেল। এক বছর যদি নষ্ট না হত! ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এই হল আমার মেয়ে, উর্মিমালা তোমার ক্লাশেই পড়ে। বাগবাজার মাল্টিপারপাসে।’
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও অর্ক কিছু খেল না। ভদ্রমহিলা কথা আদায় করলেন যে সে আর একদিন আসবে। তার ঠিকানা লিখে নিলেন ভদ্রলোক। দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন ওঁরা। ঊর্মিমালা নিচু গলায় বলল, ‘সাবধানে যাবেন।’
খালি ট্রামে জানলার ধারে বসেছিল অর্ক। হাতিবাগান ছাড়িয়ে ট্রামটা ছুটে যাচ্ছে। কপাল এবং গালে ব্যাণ্ডেজ লাগানো হয়েছে। সামান্য চিনচিন করছে জায়গাগুলো। এইভাবে একা কোনদিন মারামারি করেনি সে। এবং এই প্রথম মারামারি করলে যে মানুষের আদর ভালবাসা পাওয়া যায় তা সে জানল। কিলা কিংবা খুরকিদের কেউ পছন্দ করে না, ভয় পায়, ভালবাসে না। কিন্তু ভাল কাজের জন্যে মারামারি করলে এক ধরনের আনন্দ হয় তাই বা কি সে জানতো!
অর্ক ভাবছিল এই কয়দিনে দুটো পরিবারের সঙ্গে তার আলাপ হল। বিলাস সোমের পরিবারের চেয়ে ঊর্মিমালাদের বেশী ভাল লেগেছে তার। অনেক ঘরোয়া, অনেক কাছের। ও রকম বাড়িতে থাকলে সে বাবা এবং মা ওই রকম ব্যবহার এবং কথা বলতে পারত। এবং তারপর উর্মিমালার মুখটা চোখের ওপর উঠে এল যেন। অত মিষ্টি মুখের মেয়ে সে কখনও দ্যাখেনি। মাথায় অর্কর চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক ছোট হবে কি হবে না, লম্বা বেণী মোটা হয়ে অনেকটা নেমে গেছে, ডিমের মত মুখ, ঘাড় লম্বা, ছিপছিপে শরীরের রঙ শ্যামলা। কিন্তু দুই ভ্রূর তলায় কি শান্ত টানা চোখ। তার চেনাশোনা কোন মেয়ের চেহারার সঙ্গে উর্মিমালার মিল নেই। না, ঠিক হল না, অর্ক ভেবে দেখল, মায়ের সঙ্গে যেন কোথাও ওর মিল আছে। কোথায়? নাক, চোখ, কপাল কিংবা চেহারায়? না মোটেই না। তাহলে তার এ রকমটা মনে হল কেন? তারপরেই হেসে ফেলল সে, মিলটা খুঁজে পেয়েছে। দুজনের তাকানোর ভঙ্গীটা এক। মা যখন খুব অবাক হয় তখন অমন ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। তাছাড়া মায়ের দিকে তাকালে শরীর ছাড়িয়ে আর একটা চেহারা অনুভব করা যায়। কথাবার্তা, হাত-পা নাড়া, হাঁটাচলা মিলে মিশে সেই চেহারাটা গড়ে দেয়। অর্কর মনে হল ঊর্মিমালারও সেই চেহারাটা আছে। এ রকম অনুভূতি আর কাউকে দেখে তার হয়নি। এবং তখনই সেই সঙ্কোচটা ফিরে এল। আজ সকাল থেকে যত সে ভাবছে তত অনেক কিছু মাথার মধ্যে পর পর এসে যাচ্ছে। এভাবে এর আগে কখনও চিন্তা করেনি সে। আর সেটা করতে গিয়েই মনে হচ্ছে উর্মিমালার চেয়ে সে কোথাও যেন ছোট, কিছুতেই সমান সমানও হতে পারছে না।
আর জি কর ব্রিজে ট্রাম উঠতেই আশেপাশে একদম খালি হয়ে গেল। অর্ক পকেট থেকে কলম বের করল। কি নিরীহ চেহারা, কেউ দেখলেও বুঝতে পারবে না। এদিক দিয়ে স্বচ্ছন্দে লেখা যাবে। কিন্তু বোতামটা টিপলেই সাপের জিভের মত ছিটকে বেরিয়ে আসে ধারালো ফলা। আচ্ছা, উর্মিমালার মা যদি দেখতে পেতেন জিনিসটা তাহলে কি অত ভাল ভাল কথা বলতেন? ঊর্মিমালা নিশ্চয়ই বাবা-মাকে নিয়ে ছুটে আসতো না। নিজের অজান্তেই বুক থেকে বাতাস বেরিয়ে এল। ছেঁড়া জামাটাকে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করল অকারণ।
এখন করকরে দুপুর। পাড়া তবু জমজমাট। ফুটপাথে ব্রিজের আড্ডা বসে গেছে। তিন নম্বরের যাবতীয় লোক ছুটির দিনে এই নেশায় ডুবে থাকে। কিলা কিংবা খুরকিদের চোখে পড়ল না। বিলুও ধারে কাছে নেই। অর্ক আর দাড়াল না। চুপচাপ গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। মোক্ষবুড়ি দ হয়ে উনুন-কারখানার ছায়ায় বসে রয়েছে। অনুদের ঘরের দরজা বন্ধ। বাঁক নিতেই মাধবীলতার মুখোমুখি হয়ে গেল অর্ক। দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল মাধবীলতা। আচমকা ছেলের ওপর চোখ পড়তেই কপালে ভাঁজ পড়ল। নিঃশব্দে দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’
‘হাসপাতালে।’ মিথ্যে কথা মনে করে বলল অর্ক।
‘কি হয়েছে?’ মাধবীলতার গলা চাপা কিন্তু তীব্র।
‘কিছু না।’
প্রচণ্ড জোরে একটা চড় পড়ল অর্কর গালে, ‘কিছু না! গুণ্ডামি লোচ্চামি করে এসে আবার মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। ওঃ, ভগবান। দ্যাখো, তুমি ছেলের চেহারা দ্যাখো। জামাকাপড় ছিঁড়ে মুখে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে এসে বলছেন কিছুই নাকি হয়নি।’ দু হাতে মুখ ঢেকে খাটের ওপর বসে পড়ল মাধবীলতা।
চেয়ারে বসে পথের পাঁচালি পড়ছিল বোধহয় অনিমেষ। অর্ক ঘরে ঢোকামাত্র সে বই ছেড়ে অপলক তাকিয়েছিল। মাধবীলতার কথা শেষ হওয়ামাত্র সে চোখ বন্ধ করল। আচমকা মার খেয়ে অর্ক প্রথমে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপরেই সে নিজেকে সংযত করল, ‘তুমি আমাকে মিছিমিছি মারলে!’
‘মিছিমিছি!’ মাধবীলতা ফুঁসে উঠল। অর্ক মাকে এমন ভীষণ চেহারায় কখনও দ্যাখেনি, ‘আমি মিছিমিছি বলছি? তোকে, তোকে খুন করতে পারলে আমার হয়তো শান্তি হতো। আঃ। এত করে বোঝালাম, এত অনুরোধ করলাম সব ভস্মে ঘি ঢালা হল! সেই তুই ওই লুম্পেনগুলোর সঙ্গে গিয়ে মারামারি করে এলি! ছিঃ।’
‘আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম না।’
‘ছিলি না? অর্ক, আমি আর মিথ্যে কথা শুনতে চাই না।’
হঠাৎ অর্কর বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মায়ের এই কঠোর মুখ, ঘেন্না জড়ানো উচ্চারণ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছিল। এই ঘরের দুটো মানুষই তাকে যে এক ফোঁটা বিশ্বাস করে না এটা বুঝতে পারা মাত্রই সমস্ত এলোমেলো হয়ে গেল তার। ঠিক তখন অনিমেষ শান্ত গলায় বলল, ‘ও কি বলতে চায় শোনা যাক।’
‘কি বলবে? একগাদা মিথ্যে কথা শোনাবে। আমার আর মুক্তি নেই।’
অর্ক শরীর থেকে জামাটা খুলে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আলনা থেকে একটা শার্ট টেনে নিয়ে বলল, ‘তাহলে আমি চলে যাই!’
‘কোথায় যাবি?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
‘আমাকে যখন তোমরা বিশ্বাস করতে পারছ না তখন—।’
ছেলের এই রকম গলার স্বর এর আগে শোনেনি মাধবীলতা। চট করে মুখ তুলে দেখল অর্ক দাঁতে ঠোঁট চেপে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘দাঁড়া।’ আদেশ অমান্য করার চেষ্টা করেও পারল না অর্ক। পেছন ফিরেই দাঁড়াল।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘তা দিয়ে তোমাদের কি দরকার?’
‘বেশ। কিন্তু মনে রাখিস—।’ মাধবীলতাকে কথা শেষ করতে দিল না অনিমেষ, ‘লতা, আমাকে বলতে দাও। তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দিসনি!’
‘কি প্রশ্ন?’ অর্কর শরীর কাঁপছিল।
‘কোথায় গিয়েছিলি, কি হয়েছিল?’
‘আমি তো মিথ্যে কথা বলব।’
‘মিথ্যেটাই বলে যা।’
অর্ক সামান্য দ্বিধা করল, ‘আমি বিডন স্ট্রীটে গিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে দেখা করতে—।’
‘বিডন স্ট্রীটে? ওখানে তোর কি দরকার?’ মাধবীলতা অবাক হল।
‘ওকে শেষ করতে দাও।’ অনিমেষ বলল।
‘ফেরার সময় দেখলাম ট্রামে লেডিস সিটের দিকে একটা ছেলে খুব খারাপ কাজ করছে। মেয়েটা নামছিল আর ছেলেটা ভিড়ের সুযোগে ওর গায়ে হাত দিচ্ছিল। তাই দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি ছেলেটাকে টেনে এনে মারলাম। মেয়েটা নেমে যেতেই দেখি ছেলেটাও ওকে অনুসরণ করল। আমার ভয় হল হয়তো রাস্তায় নেমে ছেলেটা মেয়েটাকে বেইজ্জত করবে। আমি নামতেই ছেলেটা যা-তা কথা বলছিল। তখন আবার আমি তাকে মারতে সে দলবল নিয়ে আমাকে—। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।’ কোন রকমে কথাগুলো শেষ করল অর্ক।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘মেয়েটার বয়স কত?’
‘আমাদের বয়সী। ওর মা বাবা খবর পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিল।’
অর্ক মায়ের দিকে তাকাল। মাধবীলতার মুখে বিস্ময়; ‘তুই সত্যি কথা বলছিস?’
অর্ক আর পারল না। দ্রুত এগিয়ে খাটে বসে থাকা মাধবীলতার পায়ের সামনে বসে কেঁদে ফেলল, ‘তোমরা আমাকে এত অবিশ্বাস কর কেন?’
‘তুই মেয়েটাকে বাঁচিয়েছিস? সত্যি!’ মাধবীলতার চোখ বন্ধ, গলার স্বর এখন অন্য রকম, শরীর স্থির।
‘হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস কর। ইচ্ছে হলে ওর মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পার আমার সঙ্গে গিয়ে! আমি কি অন্যায় করেছি?’
আর তখনি ভেঙ্গে পড়ল মাধবীলতা। দুহাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরল সে।
অর্কর মুখ চোখ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তুই ঠিক করেছিস। তুই ঠিক করেছিস।’ ওর দুই চোখ উপচে জল, মুখে তৃপ্তির ছবি।