ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ৫ই জুন
হাজরার সঙ্গে কথা — গুরুশিষ্য-সংবাদ
বেলা পাঁচটা হইয়াছে। ঠাকুর বারান্দার কোলে যে সিঁড়ি, তাহার উপর বসিয়া আছেন। রাখাল, হাজরা ও মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। হাজরার ভাব ‘সোঽহম্’।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — হাঁ, সব গোল মেটে; তিনিই আস্তিক, তিনিই নাস্তিক; তিনিই ভাল, তিনিই মন্দ; তিনিই সৎ, তিনিই অসৎ; জাগা, ঘুম এ-সব অবস্থা তাঁরই; আবার তিনি এ-সব অবস্থার পার।
“একজন চাষার বেশি বয়সে একটি ছেলে হয়েছিল। ছেলেটিকে খুব যত্ন করে। ছেলেটি ক্রমে বড় হল। একদিন চাষা ক্ষেতে কাজ করছে, এমন সময় একজন এসে খবর দিলে যে, ছেলেটির ভারী অসুখ। ছেলে যায় যায়। বাড়িতে এসে দেখে, ছেলে মারা গেছে। পরিবার খুব কাঁদছে, কিন্তু চাষার চক্ষে একটুও জল নাই। পরিবার প্রতিবেশীদের কাছে তাই আরও দুঃখ করতে লাগল যে, এমন ছেলেটি গেল এঁর চক্ষে একটু জল পর্যন্ত নাই। অনেকক্ষণ পরে চাষা পরিবারকে সম্বোধন করে বললে, ‘কেন কাঁদছি না জানো? আমি কাল স্বপন দেখেছিলুম যে, রাজা হয়েছি, আর সাত ছেলের বাপ হয়েছি। স্বপনে দেখলুম যে, ছেলেগুলি রূপে গুণে সুন্দর। ক্রমে বড় হল বিদ্যা ধর্ম উপার্জন কল্লে। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল; এখন ভাবছি যে, তোমার ওই এক ছেলের জন্য কাঁদব, কি আমার সাত ছেলের জন্য কাঁদব।’ জ্ঞানীদের মতে স্বপন অবস্থাও যেমন সত্য, জাগা অবস্থাও তেমনি সত্য।
“ঈশ্বরই কর্তা, তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে।”
হাজরা — কিন্তু বোঝা বড় শক্ত। ভূকৈলাসের সাধুকে কত কষ্ট দিয়ে এক রকম মেরে ফেলা হল। সাধুটিকে সমাধিস্থ পেয়েছিল। কখন মাটির ভিতরে পোঁতে, কখন জলের ভিতর রাখে, কখন গায়ে ছেঁকা দেয়! এইরকম করে চৈতন্য করালে। এই সব যন্ত্রণায় দেহত্যাগ হল। লোকে যন্ত্রণাও দিলে, আর ঈশ্বরের ইচ্ছাতে মারাও গেল!
[Problem of Evil and the Immortality of the Soul]
শ্রীরামকৃষ্ণ — যার যা কর্ম, তার ফল সে পাবে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে সাধুর দেহত্যাগ হল। কবিরাজেরা বোতলের ভিতর মকরধ্বজ তৈয়ার করে। চারিদিকে মাটি দিয়ে আগুনে ফেলে রাখে। বোতলের ভিতর যে-সোনা আছে, সেই সোনা আগুনের তাতে আরও অন্য জিনিসের সঙ্গে মিশে মকরধ্বজ হয়। তখন কবিরাজ বোতলটি লয়ে আস্তে আস্তে ভেঙে, ভিতরের মকরধ্বজ রেখে দেয়। তখন বোতল থাকলেই বা কি, আর গেলেই বা কি? তেমনি লোকে ভাবে সাধুকে মেরে ফেললে, কিন্তু হয়তো তার জিনিস তৈয়ার হয়ে গিছল। ভগবানলাভের পর শরীর থাকলেই বা কি আর গেলেই বা কি?
[সাধু ও অবতারের প্রভেদ]
“ভূকৈলাসের সাধু সমাধিস্থ ছিল। সমাধি অনেক প্রকার। হৃষীকেশের সাধুর কথার সঙ্গে আমার অবস্থা মিলে গিছল। কখন দেখি শরীরের ভিতর বায়ু চলছে যেন পিঁপড়ের মতো, কখনও বা সড়াৎ সড়াৎ করে, বানর যেমন এক ডাল থেকে আর-এক ডালে লাফায়। কখন মাছের মতো গতি। যার হয়, সেই জানে। জগৎ ভুল হয়ে যায়। মনটা একটু নামলে বলি, মা! আমায় ভাল কর, আমি কথা কব।
“ঈশ্বরকোটি (অবতারাদি) না হলে সমাধির পর ফেরে না। জীব কেউ কেউ সাধনার জোরে সমাধিস্থ হয়, কিন্তু আর ফেরে না। তিনি যখন নিজে মানুষ হয়ে আসেন, অবতার হন, জীবের মুক্তির চাবি তাঁর হাতে থাকে, তখন সমাধির পর ফেরেন। লোকের মঙ্গলের জন্য।”
মাস্টার (স্বগতঃ) — ঠাকুরের হাতে কি জীবের মুক্তির চাবি?
হাজরা — ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে পারলেই হল। অবতার থাকুন আর না থাকুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিয়া) — হাঁ, হাঁ। বিষ্ণুপুরে রেজিস্টারির বড় অফিস, সেখানে রেজেস্টারি করতে পাল্লে, আর গোঘাটে গোল থাকে না।
[গুরুশিষ্য-সংবাদ — শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত]
আজ মঙ্গলবার অমাবস্যা। সন্ধ্যা হইল। ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতেছে। দ্বাদশ শিবমন্দিরে, ৺রাধাকান্তের মন্দিরে ও ৺ভবতারিণীর মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টাদির মঙ্গল বাজনা হইতেছে। আরতি সমাপ্ত হইলে কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘর হইতে দক্ষিণের বারান্দায় আসিয়া বসিলেন। চতুর্দিকে নিবিড় আঁধার, কেবল ঠাকুরবাড়িতে স্থানে স্থানে দীপ জ্বলিতেছে। ভাগীরথীবক্ষে আকাশের কালো ছায়া পড়িয়াছে। অমাবস্যা, ঠাকুর সহজেই ভাবময়; আজ ভাব ঘনীভূত হইয়াছে। শ্রীমুখে মাঝে মাঝে প্রণব উচ্চারণ ও মার নাম করিতেছেন। গ্রীষ্মমকাল ঘরের ভিতর বড় গরম। তাই বারান্দায় আসিয়াছেন। একজন ভক্ত একটি মছলন্দের মাদুর দিয়াছেন। সেইটি বারান্দায় পাতা হইল। ঠাকুরের আহর্নিশ মার চিন্তা; শুইয়া শুইয়া মণির সঙ্গে ফিসফিস করিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়! অমুকের দর্শন হয়েছে, কিন্তু কারুকে বলো না। আচ্ছা, তোমার রূপ না নিরাকার ভাল লাগে?
মণি — আজ্ঞা, এখন একটু নিরাকার ভাল লাগে। তবে একটু একটু বুঝছি যে, তিনিই এ-সব সাকার হয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, আমায় বেলঘরে মতি শীলের ঝিলে গাড়ি করে নিয়ে যাবে? সেখানে মুড়ি ফেলে দাও, মাছ সব এসে মুড়ি খাবে। আহা! মাছগুলি ক্রীড়া করে বেড়াচ্ছে, দেখলে খুব আনন্দ হয়। তোমার উদ্দীপন হবে, যেন সচ্চিদানন্দ-সাগরে আত্মারূপ মীন ক্রীড়া করছে! তেমনি খুব বড় মাঠে দাঁড়ালে ঈশ্বরীয় ভাব হয়। যেন হাঁড়ির মাছ পুকুরে এসেছে।
“তাঁকে দর্শন করতে হলে সাধনের দরকার। আমাকে কঠোর সাধন করতে হয়েছে। বেলতলায় কতরকম সাধন করেছি। গাছতলায় পড়ে থাকতুম, মা দেখা দাও বলে, চক্ষের জলে গা ভেসে যেত!”
মণি — আপনি কত সাধন করেছেন, আর লোকের কি একক্ষণে হয়ে যাবে? বাড়ির চারিদেকে আঙুল ঘুরিয়ে দিলেই কি দেয়াল হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — অমৃত বলে, একজন আগুন করলে দশজন পোয়ায়! আর-একটি কথা, নিত্যে পৌঁছে লীলায় থাকা ভাল।
মণি — আপনি বলেছেন, লীলা বিলাসের জন্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না। লীলাও সত্য। আর দেখ, যখন আসবে, তখন হাতে করে একটু কিছু আনবে। নিজে বলতে নাই, অভিমান হয়। অধর সেনকেও বলি, এক পয়সার কিছু নিয়ে এস। ভবনাথকে বলি, এক পয়সার পান আনিস। ভবনাথের কেমন ভক্তি দেখেছ? নরেন্দ্র, ভবনাথ — যেমন নরনারী। ভবনাথ নরেন্দ্রের অনুগত। নরেন্দ্রকে গাড়ি করে এনো। কিছু খাবার আনবে। এতে খুব ভাল হয়।
[জ্ঞানপথ ও নাস্তিকতা –Philosphy and Scepticism]
“জ্ঞান ও ভক্তি দুই-ই পথ। ভক্তিপথে একটু আচার বেশি করতে হয়। জ্ঞানপথে যদি অনাচার কেউ করে, সে নষ্ট হয়ে যায়। বেশি আগুন জ্বাললে কলাগাছটাও ভিতরে ফেলে দিলে পুড়ে যায়।
“জ্ঞানীর পথ বিচারপথ। বিচার করতে করতে নাস্তিকভাব হয়তো কখন কখন এসে পড়ে। ভক্তের আন্তরিক তাঁকে জানবার ইচ্ছা থাকলে, নাস্তিকভাব এলেও সে ঈশ্বরচিন্তা ছেড়ে দেয় না। যার বাপ পিতামহ চাষাগিরি করে এসেছে, হাজাশুখা বৎসরে ফসল না হলেও সে চাষ করে!”
ঠাকুর তাকিয়ার উপর মস্তক রাখিয়া শুইয়া শুইয়া কথা কহিতেছেন। মাঝে মণিকে বলিতেছেন, “আমার পাটা একটু কামড়াচ্চে, একটু হাত বুলিয়ে দাও তো গা।”
তিনি সেই অহেতুক কৃপাসিন্ধু গুরুদেবের শ্রীপাদপদ্ম সেবা করিতে করিতে শ্রীমুখ হইতে বেদধ্বনি শুনিতেছিলেন।