চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ৪ঠা জুন
মণিলাল প্রভৃতি সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ ও নিরাকারবাদ
মণিলাল (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আহ্নিক করবার সময় তাঁকে কোন্খানে ধ্যান করব?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হৃদয় তো বেশ ডঙ্কামারা জায়গা, সেইখানে ধ্যান করো।
[বিশ্বাসেই সব — হলধারীর নিরাকারে বিশ্বাস — শম্ভুর বিশ্বাস]
মণিলাল ব্রহ্মজ্ঞানী, নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “কুবীর বলত, সাকার আমার মা, নিরাকার আমার বাপ। কাকো নিন্দো, কাকো বন্দো, দোনো পাল্লা ভারী!
“হলধারী দিনে সাকারে, আর রাতে নিরাকারে থাকত। তা যে ভাবই আশ্রয় কর, ঠিক বিশ্বাস হলেই হল। সাকারেতেই বিশ্বাস কর, আর নিরাকারেই বিশ্বাস কর, কিন্তু ঠিক ঠিক হওয়া চাই।”
[পূর্বকথা — প্রথম উন্মাদ — ঈশ্বর কর্তা না কাকতালীয়]
“শম্ভু মল্লিক বাগবাজার থেকে হেঁটে নিজের বাগানে আসত। কেউ বলেছিল, ‘অত রাস্তা, কেন গাড়ি করে আস না, বিপদ হতে পারে।’ তখন শম্ভু মুখ লাল করে বলে উঠেছিল, ‘কি, তাঁর নাম করে বেরিয়েছি আবার বিপদ!’ বিশ্বাসেতেই সব হয়! আমি বলতুম, অমুককে যদি দেখি, তবে বলি সত্য। অমুক খাজাঞ্চী যদি আমার সঙ্গে কথা কয়! তা যেটা মনে করতুম, সেইটেই মিলে যেত!”
মাস্টার ইংরেজী ন্যায়শাস্ত্র পড়িয়াছিলেন। সকাল বেলার স্বপন মিলিয়া যায় (coincidence of dreams with actual events) এটি কুসংস্কার হইতে উৎপন্ন, এ-কথা পড়িয়াছিলেন (Chapter on Fallacies) তাই তিনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন —
মাস্টার — আচ্ছা, কোন কোন ঘটনা মেলে নাই, এমন কি হয়েছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, সে-সময় সব মিলত। সে-সময় তাঁর নাম করে যা বিশ্বাস করতুম, তাই মিলে যেত! (মণিলালকে) তবে কি জানো, সরল উদার না হলে এ বিশ্বাস হয় না।
“হাড়পেকে, কোটরচোখ, ট্যারা — এরকম অনেক লক্ষণ আছে, তাদের বিশ্বাস সহজে হয় না। ‘দক্ষিণে কলাগাছ উত্তরে পুঁই, একলা কালো বিড়াল কি করব মুই’।” (সকলের হাস্য)।
[ভগবতী দাসীর প্রতি দয়া — শ্রীরামকৃষ্ণ ও সতীত্বধর্ম]
সন্ধ্যা হইল। দাসী আসিয়া ঘরে ধুনা দিয়া গেল। মণিলাল প্রভৃতি চলিয়া যাবার পর দু-একজন ভক্ত এখনও আছেন। ঘর নিস্তব্ধ। ধুনার গন্ধ, ঠাকুর ছোট খাটটিতে উপবিষ্ট। মার চিন্তা করিতেছেন! মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন। রাখালও আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে বাবুদের দাসী ভগবতী আসিয়া দূর হইতে প্রণাম করিল। ঠাকুর বসিতে বলিলেন। ভগবতী খুব পুরাতন দাসী। অনেক বৎসর বাবুদের বাড়িতে আছে। ঠাকুর তাহাকে অনেকদিন ধরিয়া জানেন। প্রথম বয়সে স্বভাব ভাল ছিল না। কিন্তু ঠাকুর দয়ার সাগর পতিতপাবন, তাহার সহিত অনেক পুরানো কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখন তো বয়স হয়েছে। টাকা যা রোজগার করলি, সাধু বৈষ্ণবদের খাওয়াচ্ছিস তো?
ভগবতী (ঈষৎ হাসিয়া) — তা আর কি করে বলব?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাশী, বৃন্দাবন, এ-সব হয়েছে?
ভগবতী (ঈষৎ সঙ্কুচিত হইয়া) — তা আর কি করে বলব? একটা ঘাট বাঁধিয়ে দিইছি। তাতে পাথরে আমার নাম লেখা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বলিস কি রে?
ভগবতী — হাঁ, নাম লেখা আছে, “শ্রীমতী ভগবতী দাসী।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিয়া) — বেশ বেশ।
এই সময়ে ভগবতী সাহস পাইয়া ঠাকুরকে পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিল।
বৃশ্চিক দংশন করিলে যেমন লোক চমকিয়া উঠে ও অস্থির হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে, শ্রীরামকৃষ্ণ সেইরূপ অস্থির হইয়া ‘গোবিন্দ’ ‘গোবিন্দ’ এই নাম উচ্চারণ করিতে করিতে দাঁড়াইয়া পড়িলেন। ঘরের কোণে গঙ্গাজলের একটি জালা ছিল — এখনও আছে। হাঁপাইতে হাঁপাইতে যেন ত্রস্ত হইয়া সেই জালার কাছে গেলেন। পায়ের যেখানে দাসী স্পর্শ করিয়াছিল গঙ্গাজল লইয়া সে-স্থান ধুইতে লাগিলেন।
দু-একটি ভক্ত যাঁহারা ঘরে ছিলেন তাঁহারা অবাক্ ও স্তব্ধ হইয়া একদৃষ্টে এই ব্যাপার দেখিতেছেন। দাসী জীবন্মৃতা হইয়া বসিয়া আছে। দয়াসিন্ধু পতিতপাবন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দাসীকে সম্বোধন করিয়া করুণামাখা স্বরে বলিতেছেন, “তোরা অমনি প্রণাম করবি।” এই বলিয়া আবার আসন গ্রহণ করিয়া দাসীকে ভুলাইবার চেষ্টা করিতেছেন। বলিলেন, “একটু গান শোন।”
তাহাকে গান শুনাইতেছেন:
(১) — মজলো আমার মন-ভ্রমরা শ্যামাপদ-নীলকমলে।
(শ্যামাপদ-নীলকমলে, — কালীপদ-নীলকমলে।)
(২) — শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়িখান উড়তেছিল।
কুলুষের কুবাতাস পেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।
(৩) — আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে।
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে ৷৷
পরমধন এই পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে ৷
কত মণি পড়ে আছে আমার চিন্তামণির নাচ দুয়ারে ৷৷