1 of 3

১৪. মায়ের সঙ্গে ঝুমকির বোঝাপড়ার অভাব

১৪

মায়ের সঙ্গে ঝুমকির বোঝাপড়ার অভাবটা অনেক দিনের পুরনো। এতই পুরনো যে এখন ব্যাপারটা তার গা-সওয়া, অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কি থেকে কি হয়, কেমন করে হয় তা জানে না ঝুমকি। শুধু জানে, তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সেই মায়ের সবচেয়ে অপছন্দের সন্তান। সে বড়, সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েনি, সে একটু অলস, একটু প্রতিবাদী—এগুলো দোষ কিনা কে বলবে? কিন্তু তার মা অপর্ণার চোখে সবটাই তার দোষ। তার সব কিছুর মধ্যেই দোষ। এ সংসারে মোট পাঁচ জনের মধ্যে ঝুমকির পক্ষে আছে একমাত্র তার বাবা।

তার বাবার হার্ট অ্যাটাকের পর এ বাড়ি চলে গেল ভূতের হাতে। শোক, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ পাথরের মতো চেপে বসল বাড়িটার ওপর। মায়ের সঙ্গে ঝুমকির ব্যক্তিত্বের সংঘাত ক’টা দিন নিরুদ্দেশ ছিল। বাড়িটা নিঝুম আর চুপচাপ হয়ে রইল কিছুদিন।

বাবার সাঙ্ঘাতিক বিপদের অবস্থাটা খানিকটা সামাল দেওয়া গেছে। হার্টের ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। সুস্থ হয়ে ওঠার পরই হয়তো আর একটা মারাত্মক অ্যাটাক এসে সব হিসেব ওলটপালট করে দেয়। তবু সংকট কাটিয়ে উঠছে তার বাবা। ব্যথা নেই, ঘুমের ওষুধ কম দেওয়া হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে কেবিনে স্থানান্তরিত করা হবে তাকে।

কাল থেকে তাই, এ বাড়ির ওপর থেকে ভূতুড়ে ও ভারী আবহাওয়াটি খানিক ফিকে হয়েছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলছে তারা। আর সেই সঙ্গে সঙ্গেই লুকোনো গর্ত থেকে সাপখোপ বেরিয়ে পড়ছে নাকি? নইলে আজ সকালে ঝুমকি একটু বেশীক্ষণ ঘুমোনোর জন্য অপর্ণা ওরকম রেগে যাবে কেন?

শুধু ঝুমকির সঙ্গেই লাগে অপর্ণার। আর কারও সঙ্গে নয়। মণীশের সঙ্গে অপর্ণার অনেক বিষয়েই মতান্তর আছে, তবু ঝগড়া হয় না কখনোই। এক গভীর ভালবাসা বুঝি দুটি উলের কাঁটাকে পরস্পরের সঙ্গে নানা নকশায়, নানা বাঁধনে ও সম্পর্কে বেঁধে রাখে। ছেলে বুবকা মা অপর্ণার কাছে যেন এক দেবদূত। যখন ছেলের দিকে অপর্ণা তাকায়, তখন চোখ দুখানা স্বপ্নাতুর হয়ে যায়। যখন ছেলেকে ডাকে অপর্ণা, তখন গলায় যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত এসে পড়তে চায়। অনু ততটা নয় বটে, কিন্তু অনুরও একটা দাবি আছে। সে কোলপোঁছা সন্তান, অথাৎ মণীশ ও অপর্ণার আরও সন্তান-সম্ভাবনার ওপর দাঁড়ি টেনে তার আসা। অনু লেখাপড়ায় ভীষণ ভাল, খুব বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিমতী বলেই সে মায়ের কাছে সরলা বালিকা সেজে থাকে। অন্য সময়ে দারুণ অ্যাডাল্ট।

ঝুমকি বারবার নানাভাবে এই পাঁচ জনের সম্পর্ক বিচার ও বিশ্লেষণ করেছে। শুধু মায়ের সঙ্গে তার শত্রুতা ভিন্ন এ সংসারে তেমন কোনও অশান্তি নেই।

আজ সকালে তার ঘুম ভেঙেছে অপর্ণার বকুনিতে। বউনিটাই খারাপ।

কাল যে অনেক রাত অবধি ঘুমোয়নি ঝুমকি, অপর্ণা তা জানে না। বলল, কাজ করার ভয়ে মটকা মেরে পড়ে আছিস। তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি। এত বড় মেয়ে, সংসারের কাজে এতটুকু সাহায্য পাই না তোর। কিসের চিন্তায় বিভোর থাকিস শুনি!

হতচকিত, শঙ্কিত ঝুমকি উঠে বসে ঘুমচোখে দুনিয়াকে খান খান হয়ে যেতে দেখে বলল, রাতে ঘুম হয়নি। ইনসোমনিয়া হয়েছিল—

কবে তোর সকালে ঘুম ভাঙে! রোজ কারও ইনসোমনিয়া হয়? এ সংসারটা কি আমার একার?

তার বিচ্ছিরি সর্দির ধাত আছে, টনসিল আছে। মাঝে মাঝে পেটে গ্যাস হয়। তা ছাড়া তার কিছু অদ্ভুত চিন্তাভাবনা আছে। ঝুমকি যে মাঝে মাঝে রাতে ঘুমোতে পারে না তার কারণ খানিকটা শরীর, খানিকটা মন। কিন্তু এসব শৌখিন কথা, সূক্ষ্ম যুক্তি, তার মা কখনও মানতে চায় না।

অপর্ণা আজ অনেকক্ষণ বকল মেয়েকে। অনেকক্ষণ। যেন বেশ কিছুদিন ধরে জমানো বিষ একসঙ্গে ঢেলে দিল। এমন নয় যে, ঝুমকি এক তরফা বকুনি খায়। উল্টে সেও ঝগড়া করে। প্রায়ই। ঝুমকি মাঝে মাঝে বুঝতে পারে, তার শরীরের নানা অস্বস্তির কারণেই সে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না, মাঝে মাঝে সে খিটখিটে হয়ে যায়। রেগে যায়।

আজ ঝুমকি মায়ের কথার একটাও জবাব দেয়নি। একতরফা শুধু সহ্য করেছে। দাঁত বুরুশ করে, চুল আঁচড়ে এবং কিচ্ছুটি না খেয়ে সে নিজের ঘরে জানালার কাছে তার বিছানায় বসে আছে এখন। রাগ করলে সে কিছু খায় না। চা অবধি নয়। আর সেই জন্যই অশান্তি আরও বাড়তে থাকে। অপর্ণা রাগের ওপর আরও রাগতে থাকে।

ঠিক এ সময়ে—যখন অপর্ণা রান্নঘর থেকে তার চিকন গলায় কিছু শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করছিল—ঠিক সেই সময়ে পড়ার টেবিল থেকে একটা স্বপ্নস্বপ্ন মুখ নিয়ে উঠে গেল অনু।

মা!

অপর্ণা ঝাঁঝালো চোখে তাকাল মেয়ের দিকে, কী বলছিস?

আমাদের বোধ হয় এখন চুপ করে থাকা উচিত।

কেন, চুপ করব কেন?

আমার মনে হয় এখন আমাদের পিস অফ মাইন্ড দরকার। বাবা তো এখনও বাড়ি ফেরেনি!

তাতে কি হল? বাপের জন্য কারও মাথাব্যথা আছে? নাকি মায়ের জন্যই আছে?

খুব নরম পাখির মতো গলায় অনু বলল, আমাদের কিছু সুপারস্টিশন মানা উচিত। একটা রিচুয়াল আছে। এসব করলে হয়তো একটা পলিউশন হয়।

পলিউশন! কিসের পলিউশন?

সায়েন্টিস্টরা বলছেন, মানুষ যে মানুষের ওপর রেগে যায়, গালাগাল করে, অপমান করে—সেটাও পলিউশন। তাতেও ক্ষতি হয়।

এসব কোথায় শিখছিস?

হয় মা, সত্যিই। আমার মনে হয় বাবা সম্পূর্ণ রিভাইভ করা পর্যন্ত আমাদের চুপ করে থাকা উচিত।

অপর্ণা কি বুঝল কে জানে, হঠাৎ বলল, ঠিক আছে, চুপ করব। তোর দিদিকে ধরে এনে কিছু খাওয়া, তাহলে চুপ করব।

দ্যাটস এ গুড গার্ল! বলে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চকাম করে একটা চুমু খেয়ে অনু দিদির কাছে এল।

ঝুমকি একটু শক্ত হয়ে ছিল। অনু আর অপর্ণার কথা সে সব শুনেছে। সে সহজে ভাঙবে না।

অনু এসে ঝুমকির পাশে বসল। তারপর বলল, দিদি, ফর মাই সেক, টু সেভ মাই ফেস, একটু খা।

না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

আমি ফ্রুট জুস করে দিচ্ছি, আর টোস্ট। নিজে করব।

তোকে কিছু করতে হবে না। আমি তো ভেসে এসেছি, আমার জন্য কিছু করার দরকার নেই।

ভেসে আসবি কেন? এ বাড়ির সত্যিকারের গার্জিয়ান কে বল তো! বাবা যখন বাড়িতে থাকে না তখন মা নয়, আমি তোকে গার্জিয়ান বলে ভাবি।

আমি গার্জিয়ান হতে চাই না। তুই এখন যা, জ্বালাতন করিস না।

অনু গেল না, তবে উপরোধ অনুরোধও করল না। গা ঘেঁষে চুপ করে বসে রইল।

ঝুমকি মুখ ফিরিয়ে বোনের দিকে চেয়ে বলে, বসে আছিস যে বড়!

অনু ছলছলে চোখে দিদির দিকে চেয়ে বলে, তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে।

আমার জন্য তোদর কষ্ট হবে কেন? আমাকে বোধ হয় এরা কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছিল। নইলে আমার সঙ্গে সবসময়ে এরকম করত না।

কিন্তু সেটা তো খুব রোমান্টিক ব্যাপার, তাই না?

রোমান্টিক! কিসের রোমান্টিক?

ধর আমি যদি চাইল্ডহুডে হারিয়ে যেতাম আর যদি কেউ—মানে কোনও কাপ্‌ল্‌ আমাকে কুড়িয়ে পেত, তাহলে কিরকম থ্রিলিং হত ব্যাপারটা! আমি জানতে পারছি না কে আমার মা-বাবা, আর তারাও আমাকে সার্চ করে বেড়াচ্ছে—উঃ, দারুণ ব্যাপার।

মোটেই দারুণ নয়।

আমার কাছে কিন্তু খুব থ্রিলিং লাগে। ইন ফ্যাক্ট, আমি মাঝে মাঝে চুপ করে বসে ভাবি যে, আমার আসল মা-বাবা এরা নয়, অন্য কেউ। আমাকে এরা কোনও ডেস্টিটিউট হোম থেকে বা অন্য কোনও জায়গায় কুড়িয়ে পেয়েছে। আই অ্যাম অলরাইট হিয়ার, নো প্রবলেম। কিন্তু অন্য কোথাও আমার আসল মা-বাবা আমার কথা দিনরাত ভাবছে, আমাকে খুঁজছে, আমার জন্য কাঁদছে। কী ইম্পর্ট্যান্ট ওদের কাছে এই লস্ট আমি! রিয়েল পেরেন্টরা তো একটু বোরিং। কিন্তু লস্ট পেরেন্টরা ভীষণ রোমান্টিক, তাই না?

ঝুমকি চুপ করে রইল। তবে তার মুখে একটু স্মিত হাসি।

অনু মৃদু স্বরে বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোকে? ডোন্ট প্লে বিগ সিস্টার, প্লীজ! তোর কোনও বয়ফ্রেন্ড হয়নি?

ঝুমকির মুখ এ কথায় সামান্য কঠোর হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলল, আমার কেন ওসব হবে? আমার তো কিছু নেই। না রূপ, না গুণ।

ডোন্ট ন্যাগ দিদি। সবাই জানে তুই কেমন।

আমি কেমন?

কোয়াইট অল রাইট। ইউ আর বিউটিফুল ইন ইওর ওন ওয়ে। কিন্তু তুই ভীষণ মেজাজী। আজকালকার ছেলেরা রাগী মেয়েদের ভয় পায়।

রাগী! কই আমি তো রাগী নই।

ভীষণ রাগী। তার মানে ইউ হ্যাভ এ পারসোনালিটি। ওটা সকলের থাকে না। রেয়ার। পারসোনালিটি মিনস্ স্ট্রং লাইকস্ অ্যান্ড ডিজলাইকস্‌। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে, আমার মধ্যে বা দাদার মধ্যে পারসোনালিটি কিচ্ছু নেই।

খুব কথা শিখেছিস।

আমি যখন বড় হবো, ঠিক তোর মতো হবো। একটু স্নব, একটু অহংকারী, একটু দেমাক আর মেজাজ হবে। কেউ চট করে কাছে ঘেঁষতে পারবে না। তবে তখন একটা প্রবলেম হবে।

কি প্রবলেম?

যারা স্ট্রং পারসোনালিটির হয় তারা কিন্তু একটু লোন্‌লি। চট করে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না তো। তাই দে আর ন্যাচারালি লোন্‌লি সোলস্‌।

খুব পেকেছিস তো।

আমি এসব নিয়ে খুব ভাবি। পিপল অ্যান্ড দেয়ার ক্যারেকটারিস্টিকস।

তোর কোনও ছেলে-ছোকরার সঙ্গে ভাব নেই তো!

অনু এ প্রশ্ন শুনে খিলখিল করে হাসল, সেই তো দিদিগিরি শুরু হল। বিগ সিস্টার, আমি তো কোএড-এ পড়ি। দেয়ার আর বয়েজ অ্যান্ড বয়েজ। কিন্তু ফ্রেন্ড একটাও নয়।

কেন?

আমার কনটেম্পোরারি ছেলেগুলোর ডেপথ্‌ ভীষণ কম। মগজ নেই। মনে হয় অল আর কম্পিউটারস।

ঝুমকি কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, তাহলে তোর কী হবে রে?

কেন, আমার তো একটু এজেড, একটু এরুডাইট, একটু ফিলজফিক পুরুষকে বেশী ভাল লাগে। মানে মেন উইথ পারসোনালিটি। তোর?

ঝুমকি বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলে, আমার যে কী ভাল লাগে, আমি বুঝতেই পারি না। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্য একটা ফ্যামিলিতে গিয়ে—মানে বিয়ের পর—একটু অন্যরকম লাগতে পারে।

অনু চোখ বড় বড় করে বলে, তুই এখনই বিয়ের কথা ভাবছিস? সত্যি!

আহা, ভাবতে দোষ কি? ভাবা তোত কিছু খারাপ নয়। ভাবা আর করা কি এক?

এনিওয়ে, আমি তো ভাবতেই পারি না।

আমার মতো বয়স হোক, তারপর ভাববি।

অনু ফের হাসে, সেই দিদিগিরি। তুই আমার চেয়ে কতই বা বড়! ইউ আর স্টিল ভেরি টেন্ডার এজেড।

তোর মাথা! মা এখন আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে। আমি শুনেছি, মা প্রায়ই বাবাকে আড়ালে আবডালে বলে, ঝুমকির কিন্তু বয়স হল, পাত্র দেখতে থাকো।

হি হি। মা একটু পাগলি আছে, না রে?

একটু সেকেলে।

তুইও একটু সেকেলে। আচ্ছা, যখন ওকথা বলে, তখন বাবা কী জবাব দেয়?

বাবা উড়িয়ে দেয়। বলে, দুর দুর। এখনই বিয়ের কি!

বাবারা ওরকমই হয়। আচ্ছা দিদি, তোর কি খিদে পায় না? সত্যিই পায় না?

আবার ও কথা! পারলে আমি এ বাড়ির খাওয়া ছেড়েই দিতাম।

আহা, রাগের কথা বলছি না। কিন্তু এমনিতেই দেখি, তোর মিল খুব ফ্রুগ্যাল। একটুখানি করে খাস। চড়াই পাখির মতো। কিন্তু আমি আর দাদা খুব খাই।

আমার স্টমাকটা বোধ হয় ছোটো। খেতে আমার ভাল লাগে না।

কিন্তু তুই খুব ফুচকা খাস, আর তেলেভাজা। তাই না?

ঝুমকি হাসল, খাই। আর অম্বল হয় ভীষণ। তবু খাই।

আমি ফুচকাটা স্ট্যান্ড করতে পারি না। তেলেভাজাও না। ভীষণ আনহাইজিনিক।

হাইজিন ভেবে খেলে শুধু শুকতো আর ঝোল খেতে হয়। মা গো!

তুই পাতে ভাত ফেলিস, আমি ফেলি না।

আমিও ফেলতে চাই না। কিন্তু মা যে জোর করে বেশী ভাত দেয়।

মা পাগলি আছে। আমার কাছে একটা চকোলেট বার আছে, খাবি?

না।

রাগ করছিস কেন বাবা! আমার সঙ্গে তো ঝগড়া নয়।

রান্নাঘরে উৎকর্ণ হয়ে আছে অপর্ণা। দুই বোনে গুনগুন করে কথা হচ্ছে ঘরে। কি কথা হচ্ছে ওদের? ঝুমকি কেন এখনও কিছু খাচ্ছে না? খাওয়া নিয়ে বরাবর ঝুমকির নাক সিঁটকানো। কোনওদিন কোনও খাবার খেয়ে বলে না, উঃ, দারুণ হয়েছে তো! কোনওদিন বলে না, মা, ওমুক জিনিসটা রাঁধবে? খাওয়াটাই যেন ওর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। সেই জন্যই রোগা, সেই জন্যই ওর শরীরে হাজারো রোগ। আর সেইজন্যই ওর ওপর অপর্ণার এই রাগ। সেই শিশুকাল থেকে ওকে খাওয়াতে হিমসিম খেয়েছে সে, গলদ্‌ঘর্ম হয়েছে, মেরেছে, বকেছে, কেঁদেছে। আজ অবধি স্বভাব পাল্টাল না। একটা জিনিস চেয়ে খায়, সেটা চা। কিন্তু চা তো কোনও খাদ্য নয়। বরং অনিষ্টকারী। বিশেষ করে খালি পেটে।

অপর্ণার চোখ কড়াইয়ের দিকে। মাংস ফুটছে। কিন্তু তেমন ভাল গন্ধ বেরোচ্ছে না। কী একটা জিনিস দিতে ভুল হয়েছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না সে। মেজাজ বিগড়ে আছে, মাথা কাজ করছে না। আরও পনেরো মিনিট দেখবে অপর্ণা। তার মধ্যে ও যদি না খায় তাহলে—

এই ‘তাহলে’-টা নিয়েই হল মুশকিল। তাহলে কী করবে অপর্ণা? ওকে ধরে মারবে, না আরও বকবে? কিন্তু লাভ হবে তাতে? আরও শক্ত, আরও গোঁজ, আরও গুটি পাকিয়ে যাবে। না হলে ঝগড়া করবে। অথচ ঝুমকিকে নিয়ে তার চিন্তার অর্ধেক ব্যাপৃত থাকে সবসময়ে। এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না সে। একদম খোলামেলা নয়, অপর্ণার সঙ্গে বসে কখনও গল্প করে না। থাকে একটেরে। আলগোছ। কথা যেটুকু বলে তা বাবার সঙ্গে।

মণীশের প্রাণাধিক তিনজনই। ঝুমকি, বুবকা, অনু। তবু বুঝি ঝুমকিরই কিছু বেশী বশীভূত সে। রোগা, দুর্বল, অ্যালার্জিক এই মেয়েটিকে শাসন-টাসন করা একদম পছন্দ করে না মণীশ। বলে, ওকে ওর মতো থাকতে দাও। কোনও ব্যাপারে জোর জবরদস্তি কোরো না।

মণীশের বুদ্ধি পাকা নয় বলেই বলে। জবরদস্তি না করলে কি বাঁচিয়ে রাখা যেত ওকে এতদিন! উপোস করেই তো মরে যেত!

ডাক্তাররা বলে, খেতে না চাইলে খেতে দেবেন না। একদিন দু’দিন তিনদিন যদি খাওয়া নিয়ে প্রেশার না দেন তাহলে আপনা থেকেই খাবে।

ওসব ডাক্তারি বিদ্যেতে বিশ্বাস নেই অপর্ণার। মেয়ে তো আর ডাক্তারের নয়, তার। সে জানে, মেয়ে না খেয়ে থাকলে মায়ের ভিতরটা কেমন হয়।

পনেরো মিনিট পার করে অপর্ণা প্রস্তুত হল। আর একবার বকুনি দেওয়া দরকার। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মাংসটা চাপা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল অপর্ণা। মাথাটা গরম।

ঝুমকির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল সে। চোয়াল ও ঠোঁট কঠিন।

অনু তাকে দেখে এক গাল হেসে হাত বাড়িয়ে বলল, কাম অন মম, জয়েন দা ক্রাউড।

আমি জানতে চাই, এসব আর কতক্ষণ চলবে।

মাংস হলেই দিদি ভাত খাবে।

অপর্ণাকে দেখেই ঝুমকি জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অপর্ণা বলল, কথাটা আমি ওর মুখে শুনতে চাই।

অনু একটা ঠেলা দিয়ে বলে, দিদি, বল না।

বলব না।

অনু করুণ চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলে, মা, ইটস নাউ এ প্রেস্টিজ ইস্যু। দিদি এখন কমিট করলে ওর ইগো একটু উন্ডেড হবে। তোমার রান্না কি রেডি?

হয়ে এসেছে।

তাহলে যাও না, আমি দিদিকে ঠিক নিয়ে যাব।

অপর্ণা সামান্য শান্ত হল। বলল, যতক্ষণ রেডি না হচ্ছে ততক্ষণ এক কাপ দুধ খেয়ে নিতে বল।

অনু চোখ বড় বড় করে বলে, দুধ! মাই গড, দুধ আবার কবে দিদি খায়। মা, ইউ আর গোয়িং টু ফার। মাংসটা হোক, দিদি খাবে।

আমি কোনওকালে শুনিনি যে, বাচ্চারা দুধ খায় না। সব বাড়িতেই একটা নিয়ম আছে। মা যা দেয়, ছেলেমেয়েরা তাই খায়। শুধু এ বাড়িতেই উল্টো।

অনু হাসছিল। বলল, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ দুধ-টুধ খায় না মা। সব বাড়িতেই এ নিয়ে খুব ফাইট হয়।

খুব জ্ঞান হয়েছে দেখছি।

তবে অপর্ণা আর কথা বাড়াল না। যদি খায় তবেই বাপের ভাগ্যি। সংসারটা আজও অপর্ণা বুঝতে পারে না, ঠিক কেমন। ভাল না মন্দ? প্রয়োজন, নাকি না হলেও চলে? মণীশের সঙ্গে যখন তার ভালবাসা হল তখন মণীশ প্রায়ই বলত, তাদের এক ডজন ছেলেপুলে হবে। দি মোর দি মেরিয়ার।

অপর্ণা বলত, তাহলে তোমাকে পুলিশে দেবো।

কোন অপরাধে? ছেলেপুলে হওয়া তো বে-আইনি নয়।

না হলেই কি? পুলিশের কাছে বলব, এ লোকটা অত্যাচারী। জোর করে—

আরে না ভাই, ওসব ঠাট্টার কথা। তোমাকে তা বলে কষ্ট দেব নাকি? কিন্তু আগেকার দিনে তো হত।

তখন ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছিল না। বেশী ছেলেপুলে হলে কি হয় তা তো জানো। একটি সন্তানই যথেষ্ট। ভালভাবে মানুষ করা যাবে।

শেষ অবধি তিনটে হল। তাতে অপর্ণার বিশেষ আপত্তি হয়নি। কিন্তু এখন ভাবে, এ তিনজন তাদের দুজনকে তিনরকম দুশ্চিন্তায় রাখছে। একটা তো হল, ঠিকমতো বড় হবে কিনা! অসুখ-বিসুখ অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো! মানুষ হবে তো! ড্রাগ-ফাগ ধরবে না তো! চরিত্র ঠিক রাখতে পারবে তো! হাজার রকমের প্রশ্ন আর প্রশ্ন।

এটা কি প্রেমের খাজনা? ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটু অচেনা মাত্রাও যোগ হচ্ছে ক্রমে ক্রমে। যত বড় হচ্ছে তত কি নাগালের বাইরে যাচ্ছে? এই অচেনা ভাবটা সহ্য করতে পারে না সে।

ডোর বেল বাজল। দরজা খুলল অনু। বুবকা দরজার কাছ থেকেই চেঁচাল, মা! গুড নিউজ!

অপর্ণার বুক কেঁপে ওঠে। গুড নিউজ শুনেও ওঠে।

কি হল আবার?

দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাবার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পেরেছি।

কথা বলল! অপর্ণার অন্ধকার অভ্যন্তর যেন আলোয় ভরে গেল হঠাৎ। এ কয়দিন শুধু ঘুমন্ত মণীশকে দেখে এসেছে তারা। কখনও কথা হয়নি। মণীশের কণ্ঠস্বর প্রায় ভুলেই গেছে অপর্ণা।

কী বলল?

বুবকা মাকে দুহাতে ধরে বলল, তুমি কাঁদবে নাকি? চোখ তো টলমল করছে। বাবার কাছে যেতেই দিচ্ছিল না। অনেক ধরে করে যখন গেলাম তখন সেডেটিভের অ্যাকশন বেশী ছিল না। খুব টেনশন ছিল মুখে। আমি যেতেই বলল, তোরা কেমন আছিস? কি করে চলছে?

গলার স্বর কেমন শুনলি? নরমাল?

নরমাল। তবে একটু হাস্কি। আমি বললাম, আমরা খুব ভাল আছি। কোনও গণ্ডগোল নেই।

একটু হাসল কি?

একটুখানি। আর কিছু বলার আগেই নার্স বের করে দিল। আর একটা গুড নিউজ হল, বাবা সকালে স্যুপ খেয়েছে। নিজেই। নো হেল্‌প্‌। আজকেই হয়তো কেবিনে ট্রানসফার করতে পারে।

অপর্ণার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ে ভেসে যাচ্ছে বুক। মণীশ ফিরবে। মণীশ ফিরছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশী অপর্ণা আর কী চাইতে পারে?

দুটো পেলব হাত পিছন থেকে তাকে ধরল, মা!

অপর্ণা চোখের জলের ভিতর দিয়ে ঝুমকির অস্পষ্ট মুখটা দেখতে পেল! মান অভিমান রাগ ভেসে গেল কোথায়। দুহাতে ঝুমকিকে আঁকড়ে ধরে তার বুকেই মাথা গুঁজে দিল সে। যেন সে বাচ্চা মেয়ে, মায়ের বুকে আশ্রয় খুঁজছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *