১৪ জুন, সোমবার ১৯৭১
আবার সেই সকালে উঠে যন্ত্রচালিতের মত তৈরি হওয়া, নাশতা খাওয়া, গাড়িতে নিয়ে মাঝপথে কোথাও নামিয়ে দেওয়া।
নাদিম আর রুমী চলে গেল।
সারাটা দিন বাগানে কাটালাম। কাসেমকে রান্নাঘরে আর জামীকে বাবার কাছে রেখে বারেককে নিয়ে সারাদিন ধরে আগাছা নিড়ালাম। সেই সঙ্গে বারেককে বকুনি তোকে না রোজ বিকেলে আগাছা নিড়াতে বলেছি? কদ্দিন খুরপি লাগাস নি? দাঁড়িয়ে দেখলে কাজ করবি না? তাহলে বলে দে, এক্ষুণি মাইনেপত্র দিয়ে বিদায় করে দি।
কে যেন গেট দিয়ে ঢুকে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখি খুকু। ডাঃ এ. কে খানের মেয়ে। ওরা কিছুদিন থেকে রাজশাহীতে। ডাক্তার এখন ওখানকার হাসপাতালে পোস্টেড।
বললাম, খুকু কবে এলে? কার সঙ্গে? ডাক্তার এসেছে? চল, ঘরে চল।
খুরপি ফেলে খুকুকে নিয়ে ঘরে গেলাম। নিচের বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে বসলাম।
খুকু, তার ভাই খোকন আর খালা মঞ্জু, এই তিনজনে মার্চের মাঝামাঝি পাবনার এনায়েতপুরে নানার বাড়িতে চলে যায়। এতোদিন ওরা গ্রামেই ছিল। ক্র্যাকডাউনের পর প্রায় তিন সপ্তাহ রাজশাহীর কোনো খবর পায় নি। তারপর বাপের চিঠিতে জানে সবাই বেঁচে আছে।
তোমাদের গ্রামে মিলিটারির কোনো উৎপাত হয়েছিল?
না, আমাদের গ্রামে মিলিটারি যায় নি। তবে খবর পেতাম অন্যদিকে অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। টেলিফোন টেলিগ্রাফ লাইন সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চিঠিপত্রও অনেকদিন যায় নি।
ঢাকায় এলে কার সঙ্গে?
সারওয়ার মামার সঙ্গে।
খোকন, মঞ্জু কোথায়?
ওরা এনায়েতপুরেই আছে। পরে আসবে। এক সঙ্গে সবাই আসতে সাহস পেলাম। পথঘাট কিরকম আছে, কিছুই তো জানা ছিল না। খালাম্মা, আব্বাকে ফোন করতে হবে।
নিশ্চয়।
তক্ষুণি ট্রাঙ্কল বুক করলাম রাজশাহীতে। খুকুকে বললাম, ফোন না পাওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাক। চা-নাশতা খাও, কাগজ পড়। টিভির সময় হলে টিভি দেখ। তারপর স্বাধীন বাংলা রেডিও শুননা। গ্রামে শুনতে স্বাধীন বাংলা?
শুনতাম খালাম্মা। গ্রামে ট্রানজিস্টার ছাড়া আর তো কিছু ছিল না। তাই সবসময় রেডিওই শুনতাম। ২৫ মার্চের পরে তো খালি আকাশবাণী আর বিবিসি শুনতাম। তারপর স্বাধীন বাংলা রেডিও শুনতে পেলাম।
অনেক রাত পর্যন্তও লাইন পাওয়া গেল না। শেষে খুকু বলল, এখন বাসায় যাই খালাম্মা। কাল সকালে আবার চেষ্টা করব।