নবম পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ২রা জুন
কলিকাতায় বলরাম ও অধরের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দির হইতে কলিকাতায় আসিতেছেন। বলরামের বাড়ি হইয়া অধরের বাড়ি যাইবেন। তারপর রামের বাড়ি যাইবেন। অধরের বাড়িতে মনোহরসাঁই কীর্তন হইবে। রামের বাড়িতে কথাকতা হইবে। আজ শনিবার, ২০শে জৈষ্ঠ (১২৯০), কৃষ্ণা দ্বাদশী, ২রা জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ।
ঠাকুর গাড়ি করিয়া আসিতে আসিতে রাখাল ও মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের বলিতেছেন, “দেখ, তাঁর উপর ভালবাসা এলে পাপ-টাপ সব পালিয়ে যায়, সূর্যের তাপে যেমন মেঠো পুকুরে জল শুকিয়ে যায়।”
[সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের বিষয়াসক্তি]
“বিষয়ের উপর, কামিনী-কাঞ্চনের উপর, ভালবাসা থাকলে হয় না। সন্ন্যাস করলেও হয় না যদি বিষয়াসক্তি থাকে। যেমন থুথু ফেলে আবার থুথু খাওয়া!”
কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়িতে ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “ব্রহ্মজ্ঞানীরা সাকার মানে না। (সহাস্যে) নরেন্দ্র বলে ‘পুত্তলিকা’! আবার বলে, ‘উনি এখনও কালীঘরে যান’!”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরলীলা দর্শন ও আস্বাদন]
ঠাকুর বলরামের বাড়ি আসিয়াছেন।
ঠাকুর হঠাৎ ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। বুঝি দেখিতেছেন, ঈশ্বরই জীবজগৎ হইয়া রহিয়াছেন, ঈশ্বরই মানুষ হইয়া বেড়াইতেছেন। জগন্মাতাকে বলিতেছেন, “মা, একি দেখাচ্ছ! থাম; আবার কত কি! রাখাল-টাখালকে দিয়ে কি দেখাচ্ছ! রূপ-টুপ সব উড়ে গেল। তা মা, মানুষ তো কেবল খোলটা বই তো নয়। চৈতন্য তোমারই।
“মা, ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীরা মিষ্টরস পায় নাই। চোখ শুকনো, মুখ শুকনো! প্রেমভক্তি না হলে কিছুই হল না।
“মা, তোমাকে বলেছিলাম, একজনকে সঙ্গী করে দাও আমার মতো। তাই বুঝি রাখালকে দিয়েছ।”
[অধরের বাটীতে হরিকীর্তনানন্দে]
ঠাকুর অধরের বাড়ি আসিয়াছেন। মনোহরসাঁই কীর্তনের আয়োজন হইতেছে।
অধরের বৈঠকখানায় অনেকগুলি ভক্ত ও প্রতিবেশী ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। সকলের ইচ্ছা ঠাকুর কিছু বলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — সংসার আর মুক্তি দুই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তিনিই সংসারে অজ্ঞান করে রেখেছেন; আবার তিনিই ইচ্ছা করে যখন ডাকবেন তখন মুক্তি হবে। ছেলে খেলতে গেছে, খাবার সময় মা ডাকে।
“যখন তিনি মুক্তি দেবেন তখন তিনি সাধুসঙ্গ করিয়ে নেন। আবার তাঁকে পাবার জন্য ব্যাকুলতা করে দেন।”
প্রতিবেশী — মহাশয়, কিরকম ব্যাকুলতা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কর্ম গেলে কেরানির যেমন ব্যাকুলতা হয়! সে যেমন রোজ আফিসে আফিসে ঘোরে, আর জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁগা কোনও কর্মখালি হয়েছে? ব্যাকুলতা হলে ছটফট করে — কিসে ঈশ্বরকে পাব!
“গোঁপে চাড়া, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেন, পান চিবুচ্ছেন, কোন ভাবনা নেই এরূপ অবস্থা হলে ঈশ্বরলাভ হয় না!”
প্রতিবেশী — সাধুসঙ্গ হলে এই ব্যাকুলতা হতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হতে পারে, তবে পাষণ্ডের হয় না। সাধুর কমণ্ডলু চার-ধাম করে এল, তবু যেমন তেতো তেমনি তেতো!
এইবার কীর্তন আরম্ভ হইয়াছে। গোস্বামী কলহান্তরিতা গাইতেছেন:
শ্রীমতী বলছেন, সখি, প্রাণ যায়, কৃষ্ণ এনে দে!
সখী — রাধে, কৃষ্ণমেঘে বরিষণ হত, কিন্তু তুই মান-ঝঞ্ঝাবাতে মেঘ উড়াইলি। তুই কৃষ্ণসুখে সুখী নস্, তাহলে মান করবি কেন?
শ্রীমতী — সখি, মান তো আমার নয়। যার মান তার সঙ্গে গেছে।
ললিতা শ্রীমতীর হয়ে দুটো কথা বলছেন —
সবহুঁ মিলি কয়লি প্রীত…
কোই দেখাইলি ঘাটে মাঠে, বিশাখা দেখালি চিত্রপটে!
এইবার কীর্তনে গোস্বামী বলছেন যে, সখীরা রাধাকুণ্ডের নিকট শ্রীকৃষ্ণকে অন্বেষণ করিতে লাগিল। তারপর যমুনাপুলিনে শ্রীকৃষ্ণদর্শন, শ্রীদাম-সুদাম মধুমঙ্গল সঙ্গে, বৃন্দার সহিত শ্রীকৃষ্ণের কথা, শ্রীকৃষ্ণের যোগিবেশ, জটিলা সংবাদ, রাধার ভিক্ষা দেন, রাধার হাত দেখে যোগীর গণনা ও ফাঁড়া কথন। কাত্যায়নীপূজায় যাওয়ার আয়োজন কথা।
[The Humanity of Avatars ]
কীর্তন সমাপ্ত হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আলাপ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — গোপীরা কাত্যায়নীপূজা করেছিলেন। সকলেই সেই মহামায়া আদ্যাশক্তির অধীনে। অবতার আদি পর্যন্ত মায়া আশ্রয় করে তবে লীলা করেন। তাই তাঁরা আদ্যাশক্তির পূজা করেন। দেখ না, রাম সীতার জন্য কত কেঁদেছেন। “পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।”
“হিরণ্যাক্ষকে বধ করে বরাহ অবতার ছানা-পোনা নিয়ে ছিলেন। আত্মবিস্মৃত হয়ে তাদের মাই দিচ্ছিলেন! দেবতারা পরামর্শ করে শিবকে পাঠিয়ে দিলেন। শিব শূলের আঘাতে বরাহের দেহ ভেঙে দিলেন; তবে তিনি স্বধামে চলে গেলেন। শিব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি আত্মবিস্মৃত হয়ে আছ কেন? তাতে তিনি বলেছিলেন, আমি বেশ আছি!”
অধরের বাটী হইয়া এইবার ঠাকুর রামের বাটীতে গমন করিতেছেন। সেখানে কথকঠাকুরের মুখে উদ্ধব-সংবাদ শুনিলেন। রামের বাটীতে কেদারাদি ভক্তগণ উপস্থিত ছিলেন।