১৩
ভুচুরা ক্রীশ্চান। ভুচুর বাবা জবলপুরের গান-ক্যারেজ ফ্যাকটরিতে সাধারণ কাজ করতেন। যখন উনি মারা যান তখন ভুচুর বয়স সাত। মা আগেই গেছিলেন। বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র সন্তান। তারপর একাই বড় হয়েছে ও। বড় হয়তো, অনেকে একা একাই হয়, কিন্তু ওর বড় হওয়ার ইতিহাস নিয়ে যদি কোনও শক্তিশালী সাহিত্যিক একটি উপন্যাস লিখতেন তাহলে একটা বইয়ের মতো বই হত। সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের যোগ কম দেখতে পায় বলেই, বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়া পৃথু প্রায় ছেড়েই দিয়েছে আজকাল। শুধু কবিতা পড়ে। আসলে ও নিজেও যে একজন কবি। কবিতার ডিম ফেটে ও বাইরে বেরুতে পারল না এ জীবনে। নাম হল না, কেউই জানল না ওর কবিতার কথা। পৃথু জানে যে, ওরাই দলে ভারী। সফল কবিদের সিংহাসন ওরাই যুগে যুগে কাঁধে করে বয়ে বেরিয়েছে।
বড়লোক বাবা-ঠাকুদার পয়সায় বসে বসে খাওয়া মানুষের বয়স, শুধু ক্যালেন্ডারেই বাড়ে; মনে বাড়ে না। প্রাপ্তবয়স্ক হয় তারা শুধু বয়সেই, প্রাপ্তমনস্ক হয় না কোনওদিনও। ফুটপাতে যে শিশু, জুতো-পালিশ করে পাঁচ বছর বয়স থেকে, বৃষ্টি, রোদ, খিদে, পুলিশ, গুণ্ডা, মাতাল, মাস্তান, জুতো-পরা বাবুদের হৃদয়হীনতা, সমকামী, বয়স্ক, কুৎসিত, দুর্গন্ধ, ভিখিরি ইত্যাদি ইত্যাদি দেখেশুনে জেনে দশবছর বয়সেই, তার মনের বয়স হয়ে যায় বোধহয় একশো বছরই! আর বড়লোকের বসে-খাওয়া ছেলের মনের বয়স পাঁচেই আটকে থাকে।
ভুচুকে অনেকদিন থেকেই চেনে পৃথু। যদিও হাটচান্দ্রাতে পাকাপাকি হিসেবে এসে বসেছে মাত্র একবছর। ভুচুকে দেখে, ভুচুকে চোখের সামনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে তিল তিল করে, ওর প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা জন্মেছে।
মান্দলার এক মোটর গ্যারাজে দশ বছর বয়স থেকে সে হেল্পার ছিল। জবলপুর থেকে মান্দলার বাসে চড়ে চলে এসেছিল দশ বছরের ছেলেটি ভাগ্য অন্বেষণে। একা একা। আজ মধ্য-তিরিশে পৌঁছে ভুচু নিজের কারখানার মালিক। একটি জীপ এবং গাড়ির মালিক। অনেক লোক কাজ করে তার কারখানায়। লেখাপড়াও শিখেছে তারই মধ্যে নিজে নিজে।
মানুষ অধিকাংশই বোধহয় নীচ। অস্বস্তিকর, পরিচয়হীন অতীতকে ভুলে যাবার এমন গভীর প্রবণতা কোনও জানোয়ারের মধ্যেও দেখেনি পৃথু। নিজের পায়ে অনেকেই দাঁড়ায়, অনেকেই সংগ্রাম করে বড়লোক হয়। সেটা কিছু আশ্চর্য ঘটনা নয়। যেটা ভাল লাগে পৃথুর চোখে, তা হল এই-ই যে, ভুচু তার দুঃখের দিনগুলো ভুলে যায়নি। যা নিরানব্বুই ভাগ নিজের-পায়ে দাঁড়ানো বড়লোকই সহজে ভোলে। তার কারখানার লোকদের সে যা মাইনে দেয়, তা হাটচান্দ্রার কোনও মোটর মেরামতির কারখানার মালিকই দেয় না। এ কারণে, ভুচুর একবার জীবন সংশয়ও হয়েছিল। এই লাইনের লোকেরা একটু মারদাঙ্গা-বাজি ভালবাসে। তাই, পৃথুর কোম্পানির উধাম সিং সাহেবের বুদ্ধিতে, ভুচু এখন বাজারের দরেই সকলকে মাইনে দেয় এখন এক নম্বরে। বাকিটা, মালিককে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অবশ্য একথাও ঠিক যে, এমন মালিকও গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না এ দেশে।
উধাম সিং মানুষটা ভুচুকে খুবই স্নেহ করেন। পৃথু তো করেই। ওদের কোম্পানির সব ট্রাক ও গাড়ি ভুচুর গ্যারাজেই সারানো হয়। উধাম সিং-এর সঙ্গে মিশে পৃথু এইটুকুই বলবে যে, মানুষটা খুব পুরুষ-পুরুষ। উধাম সিং-এরও খুব শিকারের শখ ছিল একসময়। এখনও চুরি করে মেরে দেয় মাঝে মধ্যে। শামীমরা সেদিনের বারাশিঙা থেকে ওকে এবং উধাম সিংকে মাংস দিয়েছিল কিলো দুয়েক করে। ভুচুর গ্যারাজের ছেলেরা বেশি খায় বলে, দশ কে. জি. দিয়েছিল ভুচুকে। উধাম সিং-এর চোরা শিকারের এক নম্বর সাকরেদ হচ্ছে ঠুঠা। কালচার-ফালচার নিয়ে যে উধাম সিং খুব একটা মাথা ঘামায় এমন নয়। মিসেস সিং খুবই কালচারড। রুষার সঙ্গে ভাব। কিন্তু ওঁরও আলগা আঁতেলপনা নেই কোনও। আলগা আঁতে বাঙালিরাই বেশি হয়। খাটনির সময় খাটে উধাম সিং, খাওয়ার সময় তড়কা-রাজমা-ডাল রটি, শর্ষুকা শাখ, সঙ্গে বিস্তর কাঁচা পেঁয়াজ কাঁচা-লংকা, তন্দুরি, মোরগা-মুরগি এবং দই খেতে ভালবাসে। খাওয়ার আগে, দুপুরবেলা হলে, একটু বিয়র-সিয়র, রাত হলে হুস্কি-উস্কি। সোজা লোক, সোজা কথা।
বাঙালিরা যে পুষ্টিকর খাওয়াটুকুও কেন গ্রহণ করল না উত্তর বা মধ্য ভারতীয়দের কাছ থেকে, তা ভেবে অবাক হয় পৃথু। দক্ষিণ ভারতীয়দের টক এবং দই, উত্তর ভারতীয়দের পেঁয়াজ এবং কাঁচা লংকা গ্রহণ করলেও বাঙালিদের চেহারা ও মানসিকতা বোধহয় বদলে যেত। ভুচু বা রুষা বা কুর্চি বা ভাঁটু কেউই আর নিজেদের বাঙালি বলে মনে করে না। পৃথুর বাঙলার সঙ্গে যোগ আছে শুধু বাঙলা সাহিত্য ও সঙ্গীতেরই মাধ্যমে। বাঙালি আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব তার নেই বললেই চলে। কুর্চিরও তাই। ভুচুর তার নিজের মূল প্রদেশ সম্বন্ধে এক অন্ধ ক্রোধ আছে। গভীর এক অভিমান। বাঙালিকে ও নিজে বাঙালি হয়েও দেখতে পারে না। ভাঁটু ও রুষা তো নিজের বাঙালি পরিচয় দিতে পর্যন্ত অস্বীকার করে। গোটা পশ্চিমবঙ্গ, বাঙালি জাত, তার নিজের ছেলেমেয়েদর মনে রাখেনি, তাদের ভালবাসেনি, তাদের অস্বীকার পর্যন্ত করেছে বলে মনে করেন মধ্যপ্রদেশের অনেকই বাঙালি।
ওদের কী? ওরা তো বাঙালি নয়। কলকাতার বা পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা যখন কখনও ওদের আপন বলে স্বীকারই করেননি। ওরাই বা তাঁদের স্বীকার করতে যাবেন কেন?
হাটচান্দ্রাতে এস-ডি-পি-ওর বাড়িতে একজন ডি-সি এসেছিলেন বেড়াতে, সপরিবারে। খুবই সুন্দর দম্পতি। স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই অতি সুশ্রী, উচ্চশিক্ষিত। মুখার্জী। পাঞ্জাব ক্যাডারের। বাঙালি যদিও, বাংলা মুখে বলেনও পরিষ্কার, একটুও অ্যাফেক্টেশান নেই; কিন্তু বাংলা পড়তে পারেন না স্বামী-স্ত্রীর কেউই। তাও ওঁরা ওদের প্রজন্মে বাংলায় কথা বলে গেলেন। ছেলেমেয়েরা বাংলা আদৌ বলতে পারবে না। বললেও ভাঁটুর মতোই বলবে। অন্য বাঙালির সঙ্গে রেলস্টেশনে এয়ারপোর্টে, পার্টিতে দেখা হলে বলবে, “আমিও বাঙালিই হচ্ছি।”
‘বাঙালি’র উপর প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা পৃথুর আদৌ নেই। ভুচু তো লেখালেখির মধ্যেই নেই। কিন্তু পৃথুর সঙ্গে ভুচুর দেখা হলেই এইসব নিয়ে আলোচনা হয়। সবচেয়ে মজার কথা এই-ই যে, ভুচু বাংলা হরফে চিঠি লিখতে পর্যন্ত পারে না। যদি কখনও তার চিঠি লেখার দরকার আদৌ হয়, সে হিন্দি হরফে, কিন্তু বাংলা ভাষায় চিঠি লেখে। অথচ এই লোকেরই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে এতখানি দরদ। ওর জীবনে মাতৃভাষা শেখার সুযোগটুকুও বেচারি পায়নি বলেই বোধহয় ও এতখানি ভালবাসে মাতৃভাষাকে। ভুচুর বা ভুচুদের কথা বোঝেন বা ভাবেন, এমন বাঙালি কি বাঙলার নার্ভ-সেন্টার কলকাতায় একজনও নেই? ইংরিজি অবশ্য জানে, মোটামুটি।
ওরা সকলেই মধ্যপ্রদেশকে ভালবাসে। মধ্যপ্রদেশেরই বাসিন্দা হয়ে গেছে। ওরা গর্বিত মধ্যপ্রদেশ নিয়ে। ছেড়ে যাবেও না কখনও। কিন্তু…ওদের কথা বোধহয় বুঝিয়ে বলতে পারে না ওরা…কে জানে?
প্রতি রবিবার চার্চে যায় ভুচু। হাটচান্দ্রাতে ইংরেজ সাহেবরা ছিলেন বলে চার্চ আছে একটা। বহুদিনের পুরনো। ক্লাবও আছে। তখনকার। স্কোয়াশের কোর্ট, এখন ভাঙা-ইঁটের পাঁজা, সাপের আখড়া। টেনিসের ফেটে-যাওয়া হার্ড-কোর্ট-এ এখন গরু ছাগল চরে। কোম্পানির সাহেবী নামটা রয়ে গেছে। ফরেন ডিরেক্টরও আছেন। মীটিং অ্যাটেন্ড করতে আসেন। কিন্তু সেই ঠাটবাট নেই। আসলে, সেই দিনই নেই। দিনকাল সব বদলে গেছে। কাগজ হয়ে গেছে টাকা।
ভুচুর সঙ্গে মাঝে মাঝে চার্চ-এ আসতে বেশ লাগে পৃথুর। পিউ-এর সামনে দাঁড়িয়ে গান গায় সকলে। ও শোনে। এখানের চার্চে বেশিই আদিবাসীরা আসে। রেভারেন্ড পিটার ভূমিহার ছিলেন। ওঁর বাবা ক্রীশ্চান হয়ে গেছিলেন। চার্চটা খুব সুন্দর জায়গায়। রায়পুরের দিকে যাবার পথের উপরে। গভীর জঙ্গলের ধার ঘেঁষা।
আজ সন্ধেবেলা অফারেটরী হীম গাইছিল ওরা। “লুজ ইওরসেল্ফ ইন মী”।
“লুজ ইওরসেলফ ইন মী এন্ড উ্য উইল ফাইন্ড ইওরসেলফ, লুজ ইওরসেলফ ইন মী এন্ড উ্য উইল ফাইন্ড নিউ লাইফ, আনলেস আ গ্রেইন অফ হুইট ফলস ইনটু দ্যা গ্রাউন্ড, ইট স্টিল রিমেনস আ গ্রেইন অফ হুইট, বাট ইফ ইট ফলস এন্ড ডাইজ, দেন ইট বেয়ারস মাচ ফ্রুট সো ইট ইজ উইথ দোজ, হু লুজ দেমসেলভস ইন মী।”
গীর্জার মধ্যের পরিবেশ, পিয়ানোর গমগমে আওয়াজ, সম্মিলিত কণ্ঠের এমন গান! গা শিরশির করে পৃথুর!
অন্ধকার হয়ে গেছিল। তবে, এখন শুক্লপক্ষ। ওরা পাকা রাস্তায় পৌঁছে গেছিল অনেকক্ষণ। অনেকদূর গেছিল। চার্চ থেকে বেরিয়ে। এখন ফিরে আসছে। জার্কিনের কলারটা তুলে দিল পৃথু। ভুচুর শীত একেবারেই কম। গায়ে একটা পাতলা জিনের শার্ট, জিনের প্যান্ট। তার উপরে একটা নীলচে-রঙা পাতলা সোয়েটার। পামেলা বুনে দিয়েছে। পামেলা এই চার্চেই কাজ করে। ওদের বাড়ি বিহারের রাঁচীর কাছে। খুঁটি বলে একটা জায়গায়। মুণ্ডা ওরা। বাংলা বলতে পারে পামেলা। রাঁচী থেকে নেতারহাট যাবার পথে মান্দার-এ যে মিশন হাসপাতাল চার্চ আছে সেখানে অনেকদিনই ছিল। সেখান থেকে বদলি হয়ে এসেছে এখানে। ওর সঙ্গে ভুচুর একটা মিষ্টি সম্পর্ক আছে। বুঝতে পারে পৃথু। মেয়েটির গানের গলা চমৎকার। চার্চ হীম গাইবার সময়, ওর গলাই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে কানে আসে। পৃথুর কানটা ভাল। পৃথু জানে।
চাঁদের আলোয় সাদা-রঙা চাৰ্চটাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। পবিত্রতার প্রতিমূর্তির মতো। এই রকম জায়গাতে এসেই বোধহয় মন কনফেশান করতে চায়। ভাবছিল পৃথু। অন্যায়, দোষ, অপকর্ম সব কথা কবুল করতে হয় অকপটেই। তবেই না শুদ্ধি।
পৃথু ভাবে।
ওরা পাশাপাশি হেঁটে চলে। পথের উপরে তাদের চামড়ার জুতোর শব্দ হয়। পথের বাঁ পাশে পেঁচারা ঝগড়া করে কিঁচি-কিঁচি-কিঁচি-কিঁচর-কিঁচর-কিঁচর…।
এমন এমন মুহূর্তে পৃথুর হঠাৎ মনে হয়, ও এখানে কী করছে? কী করতে এসেছে? ওর না কোথায় যাবার কথা ছিল! কোথায়? কোনওখানে? অন্য কোনওখানে, যেখানে যাবার জন্যে, পৌঁছবার জন্যে ও জন্মর পর জন্ম ফিরে আসছে এই পৃথিবীতে!
ভুচু বলল, নাও পৃথুদা।
চার্মস এগিয়ে দিল। লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিল।
এই একটা কামিনার কাজ পৃথু করে। সেটা নেহাতই পয়সার অভাবে। রুষা সবই নিয়ে নেয়। তার হাতে সিগারেট খাওয়ার পয়সা থাকে না। থাকে না বললে, মিথ্যা বলা হয়, কিন্তু সিগারেট তো একা খাওয়া যায় না। প্যাকেট বের করলেই অন্যকে দিতে হয়। তাই-ই পান ছাড়া অন্য কিছু নিজে কেনে না। মাঝে মধ্যে নস্যি। ফর আ চেঞ্জ। রুষা ও মিলি-টুসুকে লুকিয়ে। কী-ই-বা দাম। চার আনার কিনলে সাত দিন চলে যায়।
একটা গাড়ি আসছিল উল্টো দিক থেকে। হেডলাইট জ্বালিয়ে। ওদের কাছে এসেই হঠাৎ ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা।
ভুচু স্বগতোক্তি করল, ব্রেক-অয়েল কম আছে। বুশ গেছে।
হঠাৎ গাড়িটা থেকে কুর্চি মুখ বাড়িয়ে বলল, পৃথুদা।
আঃ! কুর্চির গলার স্বরে চমকে উঠল পৃথু। ভাল লাগায়, ফুলের গন্ধে, চাঁদের আলো ভরে গেল।
কোথায় এসেছিলে? কার সঙ্গে আসছ?
এই যে! এই, নাম্না রিমা! মহেন্দ্র।
গাড়ি থেকে ওরা সকলে নামল।
কুর্চি আলাপ করিয়ে দিল। আমার বন্ধু, রিমা। আমরা স্কুলে পড়তাম একসঙ্গে। ওর বর মহেন্দ্র। মহেন্দ্র সিং। মালাঞ্জখণ্ড-এ আছে। উইকএন্ডে এসেছিল আমাদের কাছে। ভাবলাম, আমার বড়লোক দাদার সঙ্গে এবং রুষাদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। বেড়ানোও হল। চিহর্চিরি ঝিল-এও নিয়ে গেছিলাম ওদের। ওরা, ভাঁটু আর আমাকে বলছে মুক্কিতে গিয়ে থাকতে একটা উইক-এন্ডে। যাবেন আপনি, আমাদের সঙ্গে? পৃথুদা?
পৃথু বলল, তুমি নিয়ে গেলে, নরকেও যাব।
আহা!
কুর্চি, আসলে লজ্জা পায়। একা থাকলে, পৃথুর যে কথায় ও খুশি হয় ওর চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করে, সে-কথা সকলের সামনে শুনতে ভাল লাগে না ওর। বিব্রত বোধ করে। ধরা পড়ে যাবে বলে ভয় করে। পৃথুটা বড় ছেলেমানুষ। গোপনীয়তা বজায় রাখতে শেখেনি একটুও।
মহেন্দ্র সিং বলল, হাই!
পৃথু বলল, হ্যালো!
ভুচুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
ভুচু ইংরিজিটা কাজ চালানোর মতো বলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ওর আত্মবিশ্বাস আছে। আত্মবিশ্বাসের কোনওই বিকল্প নেই জীবনে। আত্মবিশ্বাস কোনওদিনও বালি বা দলাদলির উপরে গড়ে ওঠে না। ভুচুর ইংরিজি উচ্চারণ ভাল।
রিমা বাঙালি। মহেন্দ্র মধ্যপ্রদেশের ছেলে। বিলাসপুরে বাড়ি বলল।
রিমা বলল, কুর্চির কাছে সব সময়ই আপনার কথা শুনতাম পৃথুদা। আপনার গ্রেট অ্যাডমায়ারার কিন্তু ও। পাঁচ বছর শুনে শুনে এত্ত শখ ছিল আপনার সঙ্গে আলাপ করার।
ডিসঅ্যাপয়েন্টেড হলে তো!
নট দ্যা লিস্ট। আমাদের ওখানে আসতে হবে কিন্তু। এনিটাইম আসবেন। আগে বলারও দরকার নেই। চমৎকার জায়গা। তবে, টাউনশিপটা একটু ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। গাছগুলো বড় হয়ে গেলে আর লাগবে না।
এক সময় ওখানে নিশ্চয়ই জঙ্গল ছিল। গাছগুলো কার বুদ্ধিতে যে কেটে অমন ন্যাড়া করে দিল কে জানে? গাছগুলো রেখে টাউনশিপটা গড়ে তুললে কী চমৎকার হত বলো তো!
পৃথু বলল।
ওঃ। গেছেন আপনি।
গেছি!
গাছ আমারও খুব ভাল লাগে। কুর্চিরও লাগে। কুর্চি বলে, ওর জীবনে যা কিছু সুন্দর তার সবই আপনার কাছ থেকে নেওয়া।
পৃথু লজ্জিত হল।
কুর্চিও।
মেয়েটা বেশি কথা বলে। তবে, ভাল মেয়ে। সরল, প্রাণবন্ত। তাছাড়া তিনমাস মোটে বিয়ে হয়েছে। এখন কথা তো বলবেই।
পৃথু ভাবল।
বলল, ভাঁটুবাবুকে দেখছি না।
বাঃ! সে তো মালাঞ্জখণ্ড-এ। মহেন্দ্র আর রিমার বাড়িতেই গিয়ে গেড়ে বসেছে। এখন থেকে ওখানে যাওয়া-আসা করে কনট্রাকট-টনট্রাকট ধরতে পারলে, তবে না! মালাঞ্জখণ্ড একদিন তো বিরাট ব্যাপার হবে। তাই না?
তা ঠিক।
পৃথু বলল।
ভাঁটু ফিরবে, রিমারা ফিরে যাওয়ার তিন চারদিন পর। কুর্চি বলল।
তখন? একা থাকবে?
বাঃ রে। দাঈ নেই বুঝি?
ভয় করবে না?
ভয় করলে আপনাকে ডেকে নেব। পাহারা দেবেন আমাকে।
পৃথু ইঙ্গিতটা বুঝল।
কুর্চি আবার বলল, আপাতত নিশ্চিন্ত। রিমারা বুধবার অবধি আছে।
মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে অনেকেই বেশি চালাক হয়। পৃথু ভাবল। কুর্চি তো পৃথুর চেয়ে চালাকই। অনেক অনেক চালাক।
পৃথু বলল, বাড়িতে রুষা ছিল?
জানা দরকার, ভাঁটুর অনুপস্থিতির খবরটা রুষাও জানে কি না!
না। রুষাদি ছিলেন না। আপনার ছেলে ছিল। টুসুবাবু। গান শুনছিল, একা একা। স্টিরিওতে।
কী গান?
ইংরিজি গান?
‘দ্যা পোলিস।’ রিমা বলল।
মহেন্দ্র হাসল।
খেলে তোমরা কিছু?
বাঃ অসময়ে কী খাব? তবে, টুসুবাবু যত্ন-আত্তির ত্রুটি করেনি।
ভেরি ওয়েলম্যানারড।
রিমা বলল।
ওর মায়ের জন্য। ওল্ দ্যা ক্রেডিট গো’জ টু হিজ মাদার। আমার স্ত্রী রুষার মতো কেপেবল স্ত্রী এবং মা খুব কমই হয়। নিজের স্ত্রী বলে, বলছি না। তুমি এসে ট্রেনিং নিয়ে যেয়ো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, পছন্দও হবে তোমাকে।
কী করে বুজলেন?
ন্যাকা ন্যাকা করে রিমা বলল।
আসলে নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন এবং ওয়েলইনফর্মড।
জানি।
বলেই, কথা কেটে দিল পৃথু, ঘুড়ি কাটার মতো। হোয়েন সামওয়ান ইজ ফিশিং ফর কমপ্লিমেন্টস। তার মাথায় বাল্টি-ভর্তি গোবর জল ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে পৃথুর। অনেক দেখেছে এসব। টায়ার্ড লাগে।
ভুচু, পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল লম্বা লম্বা টানে। চাঁদের আলোতেও ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল। ভুচু লোকচরিত্র যতটুকু বোঝে; ততখানি পৃথু বোঝে না।
রুষ কোথায়?
পৃথু শুধোল।
রুষাদি আর মিলি ক্লাব-এ গেছে সিনেমা দেখতে।
কী সিনেমা?
বেতাব না, কী যেন।
ভুচু বলল।
তুমি জানলে কী করে?
বিল আনতে গেছিলাম কোম্পানীর অফিসে। দেখলাম, ক্লাবের বারান্দায় পোস্টার।
তাহলে চলি আমরা। বলে, ওরা গাড়িতে উঠল।
কুর্চি জানালা দিয়ে মুখ বার করে আবার বলল, চললাম পৃথুদা।
চোখে চোখে কথা হল। কুর্চি আর পৃথুর।
ভুচু বুঝল।
গাড়িটা চলে গেল। টেইল লাইটের জোড়া লাল আলোটা ছোট হতে হতে জঙ্গলের গভীরের সোজা রাস্তায় অনেক দূরে গিয়ে বাঘের চোখের মতো জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎই নিভে গেল।
বাঘ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
পৃথুদা আর কুর্চির মধ্যে কেচাইন আছে। স্বাভাবিক। রুষা বৌদির জন্যেই ঘটেছে এটা। কিছু মেয়ে, নিজেদের সম্বন্ধে বড় বেশি ওভার-কনফিডেন্ট হয়। বিয়ে ব্যাপারটাকে পলাশ গাছের মতো মনে করে। যেন কোনও যত্ন ছাড়াই ঠিক বেঁচে থাকবে।
ভুচু ভাবছিল।
মনে মনেই ও বলল, কী করবে বেচারি পৃথুদা। বউ নয় তো ভাইসান রেঞ্জের বাঘ। আমি হলে তো কী যে হত; ভগবানই জানেন।
গাড়িতে বসে রিমা ভাবছিল, কুর্চির সঙ্গে পৃথুর নিশ্চয়ই কোনও রিলেশান আছে? কী রিলেশান? বেড-রিলেশান কী?
সম্বন্ধ করে, মাত্র তিন মাস হল বিয়ে-হওয়া মেয়ের পক্ষে অবশ্য বেড-রিলেশান ছাড়া অন্য কোনও রিলেশান যে মানুষে মানুষে হতে পারে, একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে একথা ভাবা হয়তো অসম্ভবই! আহা! রুষাদির ফোটো দেখলাম দেওয়ালে। কী সুন্দরী ডিগ্নিফায়েড, পার্সোনালিটিসম্পন্ন মহিলা। অমন স্ত্রী থাকতে কুর্চি! পুরুষগুলো খুব আনডিপেন্ডবেল। কী যে দেখে, কোন চোখ দিয়ে; তা তারাই জানে। খুব চোখে চোখে রাখবে ও মহেন্দ্রকে।
হাঁটতে হাঁটতে ভুচু একটা সিগারেট পৃথুকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও।
হঠাৎই বলল, মহেন্দ্র সিং-এর শিং আর বেশিদিন থাকবে না।
কেন?
চমকে উঠে, পৃথু বলল।
রিমা ওকে সিংহ থেকে কেঁচো বানিয়ে দেবে। এক বছরের মধ্যেই। দেখো তুমি।
পৃথুর লজ্জা হল। এই ছেলেটা সব বোঝে। মুখে বলে না কিছু। তাহলে পৃথুকে ও কেঁচোই ভাবে। রুষাকে বাইরের কেউ খারাপ বলুক, তা পৃথু চায় না। ও যা-কিছু বলতে পারে, বা ভাবতে পারে। রুষা যে ওর বিবাহিতা স্ত্রী। ওর ছেলেমেয়ের মা। রুষাকে যে ও…
ভুচু বলেছিল, কথাটা কী হল চোখে-চোখে দুজনের?
তারপরই দিগা পাঁড়ের একটি তুলসীদাসী শ্লোক মনে পড়ায়, চাঁদের আলোয় ও হেসে উঠল। নিঃশব্দে।
“সমুঝই খগ খগ হী কে ভাষা”।
পাখিই শুধু বোঝে পাখির ভাষা।
পথটা সামনে বাঁক নিয়েছে। বাঁয়ে। ফ্যাকটরির মার্কারি ভেপার ল্যাম্পগুলো দেখা যাচ্ছে ঝাঁক-বাঁধা, স্বর্গের নীল পাখির মতো। শিশিরের গন্ধ উঠছে চার ধার থেকে। বনের গন্ধ। শীতের রাতের গন্ধ।
এখানে চার ধারে অনেক পাথর। শিলাময় জায়গাটা। দিনের বেলায় পাথরে বসে রোদ পোয়াতে বেশ লাগে এখানে।
আরও অনেক দূর হাঁটতে হবে। মাঝে মাঝে চলতে বড় কষ্ট হয় পৃথুর। মনে হয়, থামিয়ে দেয় সব হাঁটাহাঁটি। সব যাওয়া-আসা। আর কতদিন চলবে পথ? এই পথ? একই জীবনের ধূলিমলিন পথ?
থেমে যেতে ইচ্ছে হয়। পথের পাশের পাথর হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পথের পাশে পড়ে থেকে পথকে, পথিকদের দেখতে ইচ্ছে হয় বড়।
আবার মাথার মধ্যে শী-ই-ই-ই। কানের মধ্যে গুলি-খাওয়া তিতিরের ঝটাপটি। হালালকরা মোরগের করুণ ঝাঁপাঝাঁপি। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়। চোখ অন্ধকার। শুন্যতা।
ও হঠাৎ ভুচুর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলে।
কী হল পৃথুদা? হল কী তোমার?
পৃথু ওকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে একটুক্ষণ। কথা বলে না। ও এখন কথা বলতে পারবে না। তিরিশ সেকেন্ড; এক মিনিট, ওই রকমই। কিন্তু যখন কথা বলতে পারবে ও, তখনও ভুচুকে কিছু বলবে না। ভুচু যেমন অনেক কিছু বোঝে; যা পৃথু বোঝে না, পৃথুও আবার অনেক কিছু বোঝে, যা ভুচু বোঝে না। প্রত্যেকটি মানুষই দ্বীপের মতো। চারিদিকে বিচ্ছিন্নতা, অতলান্ত জল। মানুষের ভীড়। এই সমাজ, জঙ্গলেরই মতো। দূর থেকে মনে হয়, জড়াজড়ি করে একে অন্যের ওপর নির্ভর করে এক জোট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দারুণ ভালবাসায় একতাবদ্ধ মানুষেরা সব। আসলে, সবাই-ই আলাদা আলাদা। সব গাছ; সব মানুষ। বাঁচার জন্যে, নিজের রস নিজেকেই শুষে নিতে হয় মাটি থেকে, অন্য কেউই সাহায্য করে না; নিজের সব ফুল ফোটাতে হয় নিজেকেই। একা একা। নিজের সুগন্ধও ছড়াতে হয় একাই। যদি, সুগন্ধ বেঁচে থাকে কিছু।
আমরা সকলেই একা। পৃথু ভাবে। মানুষ, গাছ, আকাশের তারারা। আসলে, সমষ্টি একটা ইল্যুশান। চোখের ভুল।
কার কবিতা যেন? মনে থাকে না কবিদের নাম! শুধু কবিতা মনে থাকে। কার? মনে পড়েছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের…
“পথে যেতে কষ্ট হয়, পথের একপাশে বসে থাকি।
গভীর গাছের নিচে বসে থাকি যেন শুকনো পাতা—
পাতার মতন থাকি, কষ্ট পাই বাতাসের হাতে,
উড়ে যেতে পারি বলে ভয় পাই, পুড়ে যেতে পারি।
পথে যেতে কষ্ট হয়, তাই একপাশে বসে থাকি
পড়ে থাকি টিবি কিংবা পুরাতন পাথরের মতো—”